বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

তৃতীয় ভুবনের কবি - পার্থ বসু

বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় ভবনের কবি ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ
পার্থ বসু



দেখা হয় / ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ

শব্দ, অর্থ, উপমা উৎপ্রেক্ষা আর বাকপ্রতিমার সঙ্গে
মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়।
নার্সিংহোমের দরজায়, ডাক্তারের ভিড়ঠাসা
চেম্বারের মোমের আলোয়।
ম্লান হাসি বলে দেয় ওরা কেউ ভালো নেই।
কি খবর ! এই চলে যাচ্ছে আর কি ।
তবে সুগার অনেকটা হাই, ঘুম কম ।
ই সি জি রিপোর্ট খুব ভালো নয়।
গ্যাস পাও ঠিকমতো! জিনিসের দাম কিরকম
বেড়ে যাচ্ছে ।
ছেলেরা কি করছে , তোমাদের টি ভি তে বাংলাদেশ
কি রকম পাও ?
কালকের খবর শুনেছ?দিন দিন কি হচ্ছে এ সব ?
এ রকম আলাপের পর অনিবার্য — চলি, দেখা হবে।
দেখা হয়ে কি হবে এখন !

এই কবিতার কবি ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ বাংলা কবিতার তৃতীয় ভবনের বরাক উপত্যকার বাসিন্দা । মাতৃভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী । বাংলা ভাষা তাঁর ধাত্রীমাতা ।দুই মায়েরই স্তন্যপান করে পুষ্ট হয়েছে তাঁর সাহিত্যবোধ । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাগোষ্ঠীর মানুষরা , যারা অবগত নন তাদের জন্য বলা, বাঙ্গালীর মতই দেশভাগের শিকার।তাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ওপার বাংলায় , মূলত সিলেট , চট্টগ্রামে ছড়িয়ে। এপারে

দেশভাগের পর সিলেটের যে তিনটি থানা / এলাকা আসামের ভাগে পড়ল এঁরা সেই বরাক উপত্যকায় পুরুষানুক্রমে বসবাস করে আসছেন। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ১৯ শে মে যে ভাষা আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল বরাক - অসমীয়া ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে , বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় তাতে এঁরা বিপুল ভাবে সামিল হন। সামিল হয়েছিলেন অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীও যেমন নেপালী , ডিমাসা , এবং হিন্দীভাষী জনতা।১৯ এর প্রেরণা জুগিয়েছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারী ।১৯ শে মে বরাকের মাটিতে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন আবিশ্ব ভাষা আন্দোলনের প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য । ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় মহিলা শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন আরও দুই দশকের ব্যবধানে। আমরা এই প্রসঙ্গে এই দুজন এবং ভাষা সংগ্রামের জানা ও অজানা সমস্ত শহীদদের শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। প্রণাম জানাই।

এত কথা এ জন্যই বলা যে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা উভয় বাংলায় বাংলা ভাষাকেও তাঁদের মেধা ও প্রতিভা দিয়ে সেবা করে চলেছেন। ওপার বাংলায় কবি শুভাশিস সিংহ বাংলায় লিখে সাহিত্যসাধনার জন্য ওদেশের জাতীয় পুরস্কার hsbc কালিকলম পুরস্কার পেয়েছেন। লক্ষ টাকার পুরস্কার। কবি ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহর কবি পরিচিতি এবং আরও একটি বাংলা ভাষায় লেখা কবিতা পোস্ট করা হল। আপাতত আমরা উদ্ধৃত কবিতা ‘দেখা হয়’-এর অন্তর্মোচনের প্রয়াস পাব।

একজন প্রখ্যাত মার্কিনী সাহিত্যিককে নাকি একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল স্বাভাবিক বানিয়া প্রবৃত্তি ছেড়ে তিনি সাহিত্য চর্চায় মন দিলেন কেন? লেখক জানিয়েছিলেন সকৌতুকে ---'বানিয়া বুদ্ধিতেই । লেখার পয়লা সুবিধে হল কাঁচা মাল, সবটাই মেলে মুফতে । দেখ আর লেখ । Absolutely no investment in raw material.'

বলা বাহুল্য উক্ত মার্কিন সাহিত্যিক এবং আলোচ্য কবি শুধু ভূগোলে নয় মননেও দুই মেরুর। কিন্তু দুজনের সাধারণ মিল তাঁরা দুজনেই দ্রষ্টা ।

পশু পাখিরও চোখ আছে ।তাদের ভাষা নেই। বহুস্তর শব্দ নেই।তারা ছবি দেখে অনুমান করি। মানুষ নিছক ছবি দেখে না ।যা দেখে তা শব্দে অনুবাদ করে , রূপ দেয়। স্মৃতি তা সঞ্চয় করে।গ্রহন বর্জন করে।কবি এখানেই থামেন না।তিনি তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে, অনুধাবন করে উপমায় যাচাই করেন। যেন উৎপ্রেক্ষা আকীর্ণ প্রেক্ষাপট। এরই মধ্যে তার প্রতীক্ষা বাকপ্রতিমার জন্য। চিত্রকল্পটির জন্য ।

তাহলে যা কিছু দেখছেন কবি তা সংশ্লিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট হচ্ছে শব্দে অর্থে উপমা উৎপ্রেক্ষা আর বাকপ্রতিমায়। এটি কবিতার সংগ্রহ পর্ব ।এই সংগ্রহ তাঁর জীবন যাপন থেকে, যে জীবনের ছবি এঁকেছেন পরবর্তী আপাত আটপৌরে কথোপকথনে । যেন কবিতাই মোক্ষ। কবিতাই আরোগ্য নিদান । নিরাময়।তার উপাদানগুলি এখন কিনা অসুখে ভুগছে।উদাসীন সরকারী হাসপাতাল নয় তারা ছুটে গেছে নার্সিং হোমে – ডাক্তারের চেম্বারে।সেখানে মোমের আলো।লোডশেডিং। এই নিত্য অভিজ্ঞতার মোড়কে প্রাত্যহিকের নানা বৈপরীত্য।প্রাণের প্রদীপ না জ্বালানো মেধা।এইসবে কবি কাতর। ডাক্তার কে? তাঁর পাঠক? সমালোচক? নাকি সহমর্মী কেউ? অথবা কবি নিজেই?

কথোপকথনে যেটা লক্ষ্যনীয়, কবি বিশেষ থেকে নির্বিশেষে বিস্তার করেছেন তাঁর অবলোকন। গ্যাস,বাজারদর,বাংলাদেশ টি ভি থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করেন --- কালকের খবর শুনেছ? দিন দিন কি হচ্ছে এসব? কোন নির্দিষ্ট খবর কবি উল্লেখ করেন নি। কিন্ত দিন দিন কি হচ্ছে এসব এই প্রতিক্রিয়া এখন সার্বজনীন ।প্রতিদিনের।আমরা বিষণ্ণ হই, বিষাদে আক্রান্ত হই, আচ্ছন্ন হই।

অথচ কবিতা লিখতে হবে তাঁকে ।শব্দ যাপনের শীলিত অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন না তিনি। কবিতা লিখতে হবে এই আবহেই। এসব থেকেও। এসব দেখেও।

চলি, দেখা হবে এই অনিবার্য অন্তিম সংলাপের পর তাই তাঁর ব্যক্ত হাহাকার--- দেখা হয়ে কি হবে এখন! একটি নিটোল সুস্থ সুন্দর কবিতারসঙ্গে যদি দেখাই না হল! এই বেদনা , এই আক্ষেপ আমাদের স্পর্শ করে।

অমনি দেখা হয়ে যায় একটি মহৎ কবিতার সঙ্গে ।

কাব্য পরিচিতি - বাংলায় দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।

( ১ ) ত্রাণ শিবির
( ২ ) ভিখারী বালকের গান। প্রবন্ধের বই --ছন্দের কারিগরি।

সম্পাদনা করেছেন রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ--উত্তরা।

সম্পাদিত পত্রিকা---সাহিত্য এবং সমাবর্তন । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থ---৪৩, ৩ টি প্রেসে।

1 comments:

illutionist milan বলেছেন...

ফেসবুকে যাঁদের লেখায় মুগ্ধ হই তাঁদের অন্যতম এই মানুষটি আমার খুব কাছের । আশ্চর্যের ব্যাপার - সম্বিতের সাথে যতটা না আলাপ তার থেকে হাজার গুণ আলাপ এই মানুষটির সাথে । যার সাথে কথা বলে আমি প্রত্যহ কিছু শিখছি । প্রণাম রইলো দাদা , ভালো থেকো ।