বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

চড়াইপাখীরা কি হারিয়ে যাবে - গৌতম চট্টোপাধ্যায়

চড়াইপাখীরা কি হারিয়ে যাবে
গৌতম চট্টোপাধ্যায়

চড়ুই চিন্তা
নিজন দে চৌধুরী

রোজই দেখি, আমার ঘরের পাশে
কেমন করে ঘুরে বেড়ায় এক-বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।
কেমন যে নির্ভয়ে, কেমন নির্ভাবনায় আসে
এই উঠোনে ঘুরে বেড়ায় এক- বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।

হায়রে চড়ুই ! কেবল হাহাকার ।
হায়রে চড়ুই, চারদিকে সব অভাবী সংসারঃ
খুঁটে খাবার খুদ কুড়ো কি রুটির টুকরো আর
তাও মেলে না, এমন হাহাকার ;
আহা, চড়ুই উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, তার
চারদিকে সব বাড়ন্ত সংসার ।

ফাঁকা উঠোন । শূন্য ধানের গোলা । মরাই খালি,
ক্ষেত- খামারে মা লক্ষ্মীর শূন্য বরণ ডালি ।
নটে গাছটা মুড়িয়ে গেছে কবে ।
দুঃখী মায়ের থান কাপড়ে রোদ্দুর ধবধবে,
ফাঁকা উঠোন । শূন্য ধানের গোলা । মরাই খালি ।
তুলসী তলায় মাথুর গায় বলাই- বনমালী ।

তবুও আজো আমার ঘরের পাশে
কেমন করে ঘুরে বেড়ায় এক-বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।
কেমন যে নির্ভয়ে, কেমন নির্ভাবনায় আসে
এই উঠোনে ঘুরে বেড়ায় এক- বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।

তখন ( ১৯৭০ এর দশক ) সত্যিই ছিল কবিদের ভুবন, কবিতার আবহ । নানা অছিলায় কবি সম্মেলন লেগেই থাকত । রাণাঘাট সহ নদীয়া প্রায় সব কবি সম্মেলনেই নিজন'দা ছিলেন অবধারিত ভাবে আমন্ত্রিত ও উপস্থিত । নিজন'দা কবিতা পড়তে শুরু করলেই অনুরোধ এসে যেত চড়াই চাই অথবা 'চড়ুই চিন্তা' হোক - নিজন'দাও স্বভাব সৌজন্যে নিরাশ করতেন না । এখানে বলে ফেলা যাক যে কোনো আবৃত্তিকারের দ্বারাই আজ পর্যন্ত কবি'র নিজস্ব অনুভূতি-অভিব্যক্তি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি - কবিরাই হতে পারেন কবিতা'র একমাত্র আবৃত্তিকার । আর মানুষটি যদি হন ভাষা- সাহিত্যের অধ্যাপক এবং নাট্যপ্রিয় ব্যক্তি - তবে তো কথাই নেই । নিজন'দা ছিলেন সেই বিরল কবি যিনি শুধুমাত্র তাঁর কবিতাই নয় অন্যের কবিতাও সমপর্যায়ের আবৃত্তি করতে সক্ষম ।

আমার জানা ছিল যে কবিরাও শুনেছেন অনেকবার, কবিতার তন্নিষ্ট পাঠকও পড়ে ফেলেছেন তবু বার বার প্রচারিত হওয়া দরকার এই বিবেচনায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশের পরের বছরই ১৯৭৭ এর শরৎকালে যখন আমি 'অনেক' সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা শুরু করলাম তখন আমার মনে হল ' চড়ুই চিন্তা ' কবিতাটি পুনর্মুদ্রণ করা যেতে পারে । নিজন'দাকে জানালাম , নিজন'দার মৃদু আপত্তিতে সম্মতির সুর লেগে আছে জেনেই পুনর্মুদ্রণের সাহস পেয়েছিলাম । কারণ কবিতাটি অব্যবহিত আগের বছর অর্থাৎ ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে ( ১৯৭৬ ইঙ্গাব্দ ) কলকাতা থেকে সুশীল রায় সম্পাদিত ' ধ্রুপদী ' ( ১৪ বর্ষ, ৭-৯ সংখ্যা ) সাহিত্যপত্রে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । এমনকি পরে ১৯৯০ এর দশকেও নাকি 'কফিহাউস' পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ।

আজ নিজন'দার অনুপস্থিতি বেদনা জাগায় মনে - আজ যা-ই লিখি না কেন আসলে সে তো ওবিচুয়ারিমাত্র । কিন্তু বিগত বছর পাঁচেক ধরে নিজের বাগানে দাঁড়ালে, ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শুধুই মনে হয় ওবিচুয়ারি লেখা দরকার চড়ুই পাখীদের বিষয়ে । কারণ মাত্র কয়েক বছর আগেও -

"রোজই (দেখতাম ), আমার ঘরের পাশে
কেমন করে ঘুরে ( বেড়াত ) এক-বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।" ( ছন্দচ্যুতি মার্জনীয় )

এখন আর দেখিনা চড়াই পাখীর ঝাঁক - ভিলেন সাব্যস্ত হয়েছে মোবাইল টাওয়ার । কিন্তু দরকার ছিল পেস্টিসাইড- দুষ্ট মাঠ, জল , মাটি - বিষদষ্ট কীটপতঙ্গ ও মাঠের বিষাক্ত ফসল- ফল - সব্জি ভক্ষণ করাকেই মূল ঘাতক রূপে চিহ্নিত করা । দিন এসেছে বোধয় হাতিবাগানের রবিবাসরীয় সকালে পাখীর হাটে ব্যাপারীদের কাছে খোঁজ নেওয়ার -চড়াই পাখী কিনতে পাওয়া যাবে কিনা ! নিজন'দার 'চড়ুই চিন্তা'র পুনর্নির্মাণ হতে পারে এই বন্ধ্যা সময়ে, তবে আমরা চাইব চড়াই-এর ঝাঁক আবার ঘুরে বেড়াক আমাদের উঠোনে এক- বুক বিশ্বাসে ।

1 comments:

illutionist milan বলেছেন...

কিছু বলতেই চাই না , শুধু বলি - এই মানুষটি আমার দাদা এটা ভেবে আমার গর্ববোধ হয় ।