শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩

ধারাবাহিক – সুবীর সরকার

এপিটাফ - শেষ পর্ব
সুবীর সরকার



- ৪০ -

ধনীরাম হেঁটে আসছে এক অন্তহীনতা নিয়ে হাওড়হাওয়ার দিকে।নিশারাত্তিরের ছমছমে অনুভূতি জড়িয়ে মায়াময় হয়ে উঠতে চাওয়া পৃথিবীর অতিঘোর বিস্তারের বহতায় আকাশজোড়া মেঘের চলনবিচলন ও একাকীত্বের অসহাতায় তার কেমনতর হয়ে ওঠা জীবনের রহস্যকে মাঠের মধ্যে বাজিকরদের তাঁবুতে যৌথ কোলাহল সংগীতধ্বনীতে বিমনা হতে হতেও কিভাবে যেন টাল খাওয়া স্বপ্নগুলি বারবার জেগে উঠতে থাকে স্মৃতিকন্দরে।দূরের গাঁ-গঞ্জে তখন হিমস্তব্ধতা।কুকুরের ডাক। মিটমিট লম্ফআলো।বাঁশবাগানের ভিতর সাপখোপ ফিসফিস সংকেতভাষ্য।ধনীরাম দ্বিধাগ্রস্থতা থেকে সামান্য সরে এসে দ্রুতগামী হয়।মাথার তন্ত্রীতে জেগে থাকে ব্যাপারীপাইকার পেঁয়াজ হলুদ পুঁইপাতা টাড়িবাড়ির ধুলোমাখা মানুষজন।সব মিলিয়ে গমগম করে ওঠে যেন আস্ত একটা নাথুয়ার হাট।জঙ্গলঘেরা।চা-বাগান ঘেরা।ভূটান পাহাড়ের কোলঘেঁষা।হাট থেকে দু’কদম দূরে আঞ্চলিক নদী,বামনীঝোরা আর পিয়ারুদ্দিনের মহিষবাথান।পিয়ারু তার ইতিহাস ও আখ্যান মেখে জেগে উঠতে চায় স্পষ্টতর দিবালোকের মতো।বাথানের ভিতর মহিষের গালার ঘান্টি এবং আকালু বর্মণের গান যুগপৎ ভেসে ওঠে-‘ওরে বাথান বাথান/করেন মইশাল ও/ও মইশাল/বাথান কইচ্চেন বাড়ি/যুবা নারী ঘরত থুইয়া/কায় করে চাকিরি/মইশাল ও.’..।

গানের সুর আবহ শিল্পোর্ত্তীর্ণ হয়ে ওঠে কারণ ঘান্টির বাইজন যেন বাদ্যবাইজের ঢেউ ছড়িয়ে দেয়।রাত ঘন হয়।ধনীরাম ঘাড়ের গামছায় মুখ মুছে বাড়ির সদরে উঠে আসে।



- ৪১ -

জন্মজন্ম ধরে জন্মান্তর পেরিয়ে এভাবেই তো ধনীরামদের বাঁচা;বেঁচেবর্তে থাকা।ধনীরাম,ধনীরামের মতোন করে এই আকাশবাতাসপরিধীর ভিতর অতিজীবিত করে ফেলতে থাকে যাপনটুকুন।শরীরের ভাঁজে ভাঁজে কম্পনরেখাসূত্র ধরে কিংবদন্তী থেকে খুঁজে আনতে থাকে লোককথার দর্শনদর্পণ কাজলটানা এক সময়পরব। যেখানে স্বাদু জলের আঞ্চলিক মাছেরা ঘাই মারে।জালুয়ার জাল ফেটে বেরিয়ে যেতে চায় মহাশোল।পূজাবাড়ির উৎসবমুখরতায় স্তব্ধতা এনে দেয় জঙ্গলের প্রসারতা থেকে ছলকে আসা ২১ হাতির দঙ্গল।

বিলপুখুরির শিথানে দেহতত্বের আখড়া বসায় অধিকারি।জোড়শিমুলের ডালে ডালে স্পন্দন তোলে গানের সেই বিষাদসুরটুকু_’একবার হরি বলো মন রসনা/মানব দেহাটার/ গৈরব কৈর না’...

জীবনের সহজ প্রশ্নসমুহ কি ধনীরামকে বিচলিত করে?না কি জায়মানতা থাকে না কোথাও তবু জায়মান মাঠপ্রান্তরের ভিতর হালবলদগরু নিয়ে নেমে গিয়ে হলকর্ষণে মেতে ওঠা।৪০/৫০ শরত হেমন্তের আগেকার দিনগুলির মায়ামেদুরতায় আচ্ছন্ন হতে হতে ধনীরামের স্মৃতিঝিল্লিতে ভেসে ওঠে পিরডাঙ্গার সাজুবিল-এ ‘বাহপরব’,মাছ ধরার উৎসব।জোতদারের খোলানে ধান লুঠের মেলামিছিল।নুরুদ্দিন জোতদারের খুটার বন্দুকের সে কি বিক্রম!বিগত সব দিনগুলি আগিলা মানষিলা সব কেমন হাওয়া!উধাও।ধনীরাম বিষাদ্গ্রস্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে না চাইলেও জীবন তাকে বাধ্যতই এই চিরসত্য দার্শনিকতায় একপ্রকার পৌঁছেই যেন দেয়।



- ৪২ -

ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে কিংবা স্বপ্নতাড়িত কোন এক ঘুমকুহকে ঢুকে যেতে যেতে মাতব্বর তার সমগ্রতায় এক ধরনের শিহরণ টের পায়;তার মনে হয় কোথাও জায়মানতা থাকে না;কেবল নদীর ভিতর জেগে ওঠে অগণন নদী যাদের আঞ্চলিক প্রবাহের ফাটল ছুঁয়ে বিষন্ন সব বুদবুদ জেগে ওঠে।মাতব্বর আবার দেখতে পান ফালাকাটা শহরের কবেকার সেই শহর কাঁপানো বাঘটিকে।বাঘ কেবল আর বাঘ থাকে না,তার গায়ের ডোরাকাটা হলুদের উজ্জলতায় বারবার মানুষের তাড়া খাওয়া,জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাঘের ভীত সন্ত্রস্ত দিশেহারা ছুটে বেড়ানোটুকু বুঝি মাতব্বরের ঘুমকে হিমশৈলের মতো জাগিয়ে রাখে।অনন্ত ঘুমের কুয়াশাময় আর্তিতে কোচবিহার রাজার শিকারী ভাই ফালাকাটা শহরের বিপুল জমায়েত ডোরাকাটা বাঘের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা জার্মান সাহেব;সব যেন তুমুলভাবে দুলে উঠতে থাকে।

মাতব্বর তার ঘুমকে সঞ্চরণশীল মেঘের মতো,বৃষ্টিপতনের মতো স্থিরতা এনে দিতে না পারলেও তার প্রয়াসটুকু জারি থাকে।জোতদারবাড়ির ভগ্ন আগাছা গজানো বর্তমানে এসে নস্টালজিয়ার রেশ ও রেণু সর্বাঙ্গে মাখতে মাখতে মাতব্বরকে ঘুমের পাঁকে পাঁকে তুমুল ডুবেই যেতে হয় পরিত্রাণহীন ভবিতব্যতায়,সুদূরপ্রসারী কোন গানের মতোন।