বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৩

উত্তর সম্পাদকীয় - অরিন্দম চন্দ্র

পরাধীনতাটা আজ আর দেশী নয়,আন্তর্জাতিক
অরিন্দম চন্দ্র



সেই কবে কবি লিখেছিলেন, “স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে...”। সত্যিই তো ১৯৪৭ থেকে প্রতি বছর এই দিনে আমরা এমন কত গান গাই,কবিতা আওড়াই, শপথ নিই। কিন্তু যাঁদের ঘাম-রক্তে পাওয়া এই স্বাধীনতা তাঁদের উত্তরাধিকার কিভাবে পাচ্ছি আমরা, কতটুকু স্বাধীন সত্যি সত্যি এ দেশের মানুষ?

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে দেশের ৭৭% মানুষ আজও দৈনিক ২০ টাকার বেশী খরচ করতে পারে না সেই দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের কাছে “স্বাধীনতা” শব্দটির ব্যঞ্জনা ঠিক কতটা হতে পারে সেটার প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ আমি-আপনি দিতে পারি না; কারণ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আমরা প্রায় সব্বাই এদের ভোট দিই, তাতে আম-আদমি বা ম্যাঙ্গো-পিপলের ঐ ২০ টাকা-ওয়ালারাও আছে, আছি আপনি-আমিও। তাই দেশের এক রাজপুরুষের মুখে শোনা “দারিদ্র্য একটি মানসিক অবস্থা” জাতীয় নির্মমতাও আমরা সহজেই হজম করতে পারি বা এখনও এই দেশে দৈনিক ৫ টাকায় ভরপেট খেতে পাওয়ারবর্বরোচিত রসিকতাকে অম্লানবদনে সহ্য করে যাই। আর ভরপুর উদ্যমে দীঘা-শংকরপুর-মন্দারমণির হোটেলগুলি স্বাক্ষ্য দেয় আমাদের স্বাধীনতার। স্বাক্ষ্য দেয় শপিং-মলগুলির বাৎসরিক আজাদি মোচ্ছব।

কি ভাবছেন, বিপ্লবের বুলি ? বা প্রগতিশীল তকমায় অন্ধের হস্তীদর্শন ? গণতন্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম পীঠস্থানের খুব কাছে মানেসর, মারুতির কারখানা। যে কোম্পানীর বার্ষিক আয় বৃদ্ধির হার ৪০% সেইখানে শ্রমিক-কর্মচারীরা ১৫% মাইনা বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন করে আজ তাঁদের প্রায় ১৫০ জন জেলে পচছেন। দেশের ১২ কোটি মানুষ গত ২০-২১ শে ফেব্রুয়ারী ধর্মঘটে নেমেছিলেন, স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীও যার দাবীগুলির মান্যতা দিতে একরকম বাধ্য হয়েছেন, সে দেশের কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই ধর্মঘটের সরাসরি বিরোধিতা করেন নি, ব্যতিক্রম আমাদের পশ্চিমবাংলা। এ’গুলি কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। আমি আপনি কোন ভাবে এই স্বাধীন দেশের রাজন্যবর্গের অপছন্দের কাজ করলে, সেটা যতই গণতান্ত্রিক পথে হোক না কেন, “চোপ” শব্দটা আসছে, কোথাও সরাসরি, কোথাও বা আইনী পথেই।

আর এই স্বাধীনতা হরণের সচল প্রয়াসটা শুধুমাত্র এই দেশের সীমারেখার মধ্যেই আবদ্ধ, এটা ভাবা সম্পূর্ণ ভুল। এই সমকালে সবচেয়ে বেশী সাংবাদিক জেলে পচছে তুরস্কতে। অথচ বর্তমান শাসক রেসেপ এর্দোয়ানই ২০০২ সালে গনতন্ত্রের অন্যতম জাজ্ঞিক হিসাবে উঠে এসেছিলেন। কাছাকাছি মিশরের চিত্রমালা আরও করুণ। অতি সম্প্রতি দু’জনের নাম উঠে এসেছে, এডওয়ার্ড স্নোডেন ও জুলিয়ান আসাঞ্জ। দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার নাগরিকদের অধিকার হরণের প্রয়াসের বিরুদ্ধে মুখ খুলে আজ একজন লণ্ডনের ইকুয়েডরস্থ দূতাবাসে স্থান পেয়েছেন, আরেক জন রাশিয়ার এয়ারপোর্টএ। এই পোড়া দেশের সরকারও আরো কঠিন-কঠোর আইন আনতে চলেছেন। সে আপনি পথে নামুন বা সাইবার-স্পেসকে ব্যবহার করে জনমতকে সংগঠিত করুন। আমার আপনার মোবাইলের I.M.E.I NUMBER, SIM CARD বা কম্পিউটরের I.P ADDRESS আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে উন্মুক্ত। এ এক ভয়ঙ্কর ব্যবস্থা ! অরওয়েলের “বিগ ব্রাদার” আজ প্রতি মুহুর্তে নজরদারীতে ব্যস্ত, আর আমি-আপনি স্বাধীনতার নরম পানীয়তে উল্লাসের চুমুক মারছি টিভি খুলে।

পরাধীনতাটা তাই আজ আর দেশী নয়,আন্তর্জাতিক।গোটা পৃথিবীতে আজ ষড়যন্ত্রটার জ্যামিতিটা স্পষ্ট হচ্ছে। তবুও আশা জাগে, প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতা হয়তো একদিন কবির কন্ঠ থেকে আমার আপনার প্রত্যেকের চেতনার অস্ত্রকে শান দেবে,সকলের জাতীয়,না আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে সেই মহামন্ত্র,

“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উত্‍‌সমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়...............”