‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতঃ স্বদেশ ভাবনার মহামন্ত্র
পার্থপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়
‘প্রবাসী’ পত্রিকার কার্তিক ১৩৬৭ সংখ্যায়, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন – গান্ধীজী জাতির জনক, কিন্তু ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্রের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র জাতির মন্ত্রদাতা গুরুদেব।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রথম খণ্ড দশম পরিচ্ছেদে ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতটি প্রথম সন্নিবেশিত হয়। যদিও তার অনেক আগে, ১৮৭৫-৭৬ সাল নাগাদ বঙ্কিমচন্দ্র গানটি লিখেছিলেন। শোনা যায় ‘বঙ্গদর্শন’-এর কার্যাধ্যক্ষ কাঁটালপাড়া নিবাসী পণ্ডিত রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একবার, একপাতা ম্যাটার কম পড়ায় সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রকে কিছু কিছু লিখে দিতে বলেন। বঙ্কিম তাকে আশ্বস্ত করে বলেন – ‘আচ্ছা, আজই পাবে।’ এইসময় পণ্ডিতমশায়ের নজর পড়ে টেবিলে রাখা একটি কাগজের উপর। কাগজটিতে ‘বন্দেমাতরম্’ গানটি লেখা ছিল। বোধহয় তিনি সেটা পড়েওছিলেন। পণ্ডিত মহাশয় বলেন – ‘বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই যে গীতাটি লেখা আছে – উহা মন্দ নয় ত – ঐটা দিন না কেন।’ একথায় নাকি বঙ্কিমচন্দ্র প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে কাগজটি তৎক্ষণাৎ দেরাজের ভেতর রেখে বলেছিলেন – ‘উহা ভালো কি মন্দ, এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না। কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে। আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব। তুমি থাকিতে পার।’ (দ্র. “বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্যকথা” পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ) ঠিক একই প্রসঙ্গের উল্লেখ পাই শচীশচন্দ্রের লেখা থেকেও। শচীশচন্দ্র লিখছেন – ‘বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর দুই চারি বৎসর পূর্ব্বে, একদা আমার ভগিনী ( বঙ্কিমচন্দ্রের জ্যেষ্ঠা কন্যা ) তাহার পিতার নিকট ‘বন্দেমাতরম্’ গানের কথা তুলিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছিলেন, “একদিন দেখিবে – বিশ-ত্রিশ বৎসর পরে একদিন দেখিবে, এই গান লইয়া বাঙ্গালা উন্মত্ত হইয়াছে – বাঙ্গালী মাতিয়াছে।” ( দ্র. বঙ্কিমজীবনী )
বলা বাহুল্য, ‘বিশ-ত্রিশ বৎসর’ যেতে হয়নি; স্বদেশী আন্দোলনের সময়ই ‘বন্দেমাতরম্’ গান বিপ্লবীদের মহামন্ত্রে পরিণত হয়। আসমুদ্র হিমাচল ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে। স্বয়ং, রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে ( ১৮৯৬ ) নিজের দেওয়া সুরে ‘বন্দেমাতরম্’ চেয়েছিলেন, দিকে দিকে গড়ে ওঠে ‘বন্দেমাতরম্ সম্প্রদায়’। বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ অরবিন্দ ঘোষ প্রকাশ করেন ‘বন্দেমাতরম্ পত্রিকা।’ এমনকি তিনি ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতের ইংরাজী অনুবাদও করেন। আবার অরবিন্দ মোটেই প্রথম তার
‘বন্দেমাতরম্ পত্রিকা’য় বঙ্কিমচন্দ্রকে ঋষি বলে সম্বোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ তার “স্বদেশী আন্দোলনে নিগৃহীতদের প্রতি আবেদন”–এ জানিয়েছিলেন—‘অদ্য কঠিন ব্রতনিষ্ঠ বঙ্গভূমির প্রতিনিধিস্বরূপ যেই কয়জন এই দুঃসহ অগ্নিপরীক্ষার জন্য বিধাতা কর্তৃক বিশেষরূপে নির্বাচিত হইয়াছেন তাহাদের জীবন সার্থক। রাজরোষরক্ত অগ্নিশিখা তাহাদের জীবনের ইতিহাসে লেশমাত্র কালিমাপাত না করিয়া বার বার সুবর্ণ অক্ষরে লিখিয়া দিয়াছেঃ বন্দে মাতরম্।’
এই ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি কন্ঠে নিয়ে সেদিন ক্ষুদিরাম – কানাইলাল – সূর্যসেনের দল হাসতে হাসতে ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছে। ১৯২৭ সালে গান্ধীজী একবার ‘বন্দেমাতরম্’ প্রসঙ্গে বলেছিলেন –
“When we sing the ode to motherland, “Bande Mataram”, we sing it to the whole of India.” আর ঋষি অরবিন্দের কথায় – “The Mantra has been given and in a single day a whole people had been converted to the religion of patriotism.”
‘প্রবাসী’ পত্রিকার কার্তিক ১৩৬৭ সংখ্যায়, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন – গান্ধীজী জাতির জনক, কিন্তু ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্রের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র জাতির মন্ত্রদাতা গুরুদেব।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রথম খণ্ড দশম পরিচ্ছেদে ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতটি প্রথম সন্নিবেশিত হয়। যদিও তার অনেক আগে, ১৮৭৫-৭৬ সাল নাগাদ বঙ্কিমচন্দ্র গানটি লিখেছিলেন। শোনা যায় ‘বঙ্গদর্শন’-এর কার্যাধ্যক্ষ কাঁটালপাড়া নিবাসী পণ্ডিত রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একবার, একপাতা ম্যাটার কম পড়ায় সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রকে কিছু কিছু লিখে দিতে বলেন। বঙ্কিম তাকে আশ্বস্ত করে বলেন – ‘আচ্ছা, আজই পাবে।’ এইসময় পণ্ডিতমশায়ের নজর পড়ে টেবিলে রাখা একটি কাগজের উপর। কাগজটিতে ‘বন্দেমাতরম্’ গানটি লেখা ছিল। বোধহয় তিনি সেটা পড়েওছিলেন। পণ্ডিত মহাশয় বলেন – ‘বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই যে গীতাটি লেখা আছে – উহা মন্দ নয় ত – ঐটা দিন না কেন।’ একথায় নাকি বঙ্কিমচন্দ্র প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে কাগজটি তৎক্ষণাৎ দেরাজের ভেতর রেখে বলেছিলেন – ‘উহা ভালো কি মন্দ, এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না। কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে। আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব। তুমি থাকিতে পার।’ (দ্র. “বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্যকথা” পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ) ঠিক একই প্রসঙ্গের উল্লেখ পাই শচীশচন্দ্রের লেখা থেকেও। শচীশচন্দ্র লিখছেন – ‘বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর দুই চারি বৎসর পূর্ব্বে, একদা আমার ভগিনী ( বঙ্কিমচন্দ্রের জ্যেষ্ঠা কন্যা ) তাহার পিতার নিকট ‘বন্দেমাতরম্’ গানের কথা তুলিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছিলেন, “একদিন দেখিবে – বিশ-ত্রিশ বৎসর পরে একদিন দেখিবে, এই গান লইয়া বাঙ্গালা উন্মত্ত হইয়াছে – বাঙ্গালী মাতিয়াছে।” ( দ্র. বঙ্কিমজীবনী )
বলা বাহুল্য, ‘বিশ-ত্রিশ বৎসর’ যেতে হয়নি; স্বদেশী আন্দোলনের সময়ই ‘বন্দেমাতরম্’ গান বিপ্লবীদের মহামন্ত্রে পরিণত হয়। আসমুদ্র হিমাচল ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে। স্বয়ং, রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে ( ১৮৯৬ ) নিজের দেওয়া সুরে ‘বন্দেমাতরম্’ চেয়েছিলেন, দিকে দিকে গড়ে ওঠে ‘বন্দেমাতরম্ সম্প্রদায়’। বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ অরবিন্দ ঘোষ প্রকাশ করেন ‘বন্দেমাতরম্ পত্রিকা।’ এমনকি তিনি ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতের ইংরাজী অনুবাদও করেন। আবার অরবিন্দ মোটেই প্রথম তার
‘বন্দেমাতরম্ পত্রিকা’য় বঙ্কিমচন্দ্রকে ঋষি বলে সম্বোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ তার “স্বদেশী আন্দোলনে নিগৃহীতদের প্রতি আবেদন”–এ জানিয়েছিলেন—‘অদ্য কঠিন ব্রতনিষ্ঠ বঙ্গভূমির প্রতিনিধিস্বরূপ যেই কয়জন এই দুঃসহ অগ্নিপরীক্ষার জন্য বিধাতা কর্তৃক বিশেষরূপে নির্বাচিত হইয়াছেন তাহাদের জীবন সার্থক। রাজরোষরক্ত অগ্নিশিখা তাহাদের জীবনের ইতিহাসে লেশমাত্র কালিমাপাত না করিয়া বার বার সুবর্ণ অক্ষরে লিখিয়া দিয়াছেঃ বন্দে মাতরম্।’
এই ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি কন্ঠে নিয়ে সেদিন ক্ষুদিরাম – কানাইলাল – সূর্যসেনের দল হাসতে হাসতে ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছে। ১৯২৭ সালে গান্ধীজী একবার ‘বন্দেমাতরম্’ প্রসঙ্গে বলেছিলেন –
“When we sing the ode to motherland, “Bande Mataram”, we sing it to the whole of India.” আর ঋষি অরবিন্দের কথায় – “The Mantra has been given and in a single day a whole people had been converted to the religion of patriotism.”
1 comments:
এই প্রবন্ধটির আরো দীর্ঘ, ব্যাপক ও জ্ঞানগর্ভ রূপান্তর দেখতে অপেক্ষায় রইলেম। এই বিন্দুতে সিন্ধুর স্বাদসঞ্চারের জন্যে অসংখ্য ধন্যবা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন