বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৩

ঘনাদার কলম - মেছো বাঙালি

ঘনাদার কলম
মেছো বাঙালি



সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন- বেহেস্তে ইলিশের বর্ণণা নেই । সুতরাং ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না, তাই তিনি বেহেস্তে যাবেন না ।

বাঙালী স্বর্গে গেলেও মাছ খাবে। বাঙালীর মাছ খাওয়ার বাড়াবাড়ি দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নাই। মাছ না খাওয়াটা বাঙালির বড্ড চাপ ।

চীন, জাপান, বার্মা, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যাতালিকায় আছে ভাত-মাছ।

বাঙালীদেরও তাই। বাঙলার অজস্র খাল-বিল, নদী-নালায় এত মাছের ছড়াছড়ি দেখেও মাছ না খাওয়ার লোভ বাঙালী কোনোকালেই ছাড়তে পারেনি, বরং দিন দিন বেড়েছে। এই মৎস্যপ্রীতিই সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে অন্যান্য ভারতীয়দের কাছে থেকে আলাদা করে রেখেছে।

ভারতের আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতি, বাঙালীদের এই মৎস্যপ্রীতি কোনোদিনই ভালো চোখে দ্যাখে নি।

আজও বাঙালীদের এই মাছ খাওয়া দেখে অনেকে নাক সিঁটকোয়। কিন্তু তাতে কি! ভাত-মাছই বাঙালীদের প্রাণ । সুদূর প্রবাসে থাকলেও মাছ না পেলে বাঙালি শোকাহত হয়ে বসে থাকে ।

প্রায় আড়াই হাজার বছরের আগে থেকেই ভারতের আর্য-ব্রাহ্মণ্যধর্মে (বৌদ্ধ, জৈন সহ) খাওয়ার জন্য প্রাণীহত্যার প্রতি একটা নৈতিক আপত্তি প্রকাশ করে।

সেই থেকে তারা নিরামিষ ভোজের প্রতিই পক্ষপাতী হয়ে উঠেছিল। (পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের চেয়ে ভারতীয়দের পাতলা-চিকনা শারীরিক গঠনের এটা একটা প্রধান কারণ কিনা সেটাও একটা তর্কের বিষয় হতে পারে।)

প্রাণীহত্যার প্রতি আপত্তি বাঙলাতেও উঠেছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেটা কোনোদিনই তেমন পাত্তা পায় নি। কোনো শক্তিই চিরাচরিত ও বহু দিনের অভ্যস্ত প্রথা এত সহজে ভাঙতে পারে না।

বাঙলার অন্যতম প্রথম ও প্রধান স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট। তিনিও অনেক যুক্তিতর্ক দিয়ে বাঙালীদের অভ্যাসকেই সমর্থন করেছিলেন। তিনিই অনেক শাস্ত্র ঘেঁটে প্রমাণ দেখিয়েছিলেন যে মাছ-মাংস খাওয়ায় কোনো দোষ হয় না। কিছু তিথি ও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে না খেলেই হলো। অনেকে বলেন বাঙালীর চিরাচরিত অভ্যাসকে সমর্থন না জানিয়ে তাঁর কোনো উপায় ছিল না। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ তেল বা চর্বির তালিকায় জীমূতবাহন ইলিশ মাছের কথা বলেছেন। বাঙালীর আরেক স্মৃতিকার শ্রীনাথাচার্যও এই মত সমর্থন করেন। বৃহর্দ্ধমপুরাণেও আছে যে সাদা ও আঁশযুক্ত মাছ ব্রাহ্মণেরাও খেতে পারেন। কিন্তু যে মাছ গর্তে বা কাঁদায় বাস করে, মুখ ও মাথা সাপের মত (যেমন, বাণ মাছ), দেখতে কদাকৃতি, আঁশহীন, পচা, শুকনো মাছ ব্রাহ্মণদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়াও শামুক, কাঁকড়া, মোরগ, সারস, বক, হাঁস, পাখী, উট, গরু, শূকর – এসব নিষিদ্ধ ছিল।

তবে নিম্নতর সমাজে এসব কেউ মানত না। (সমাজে স্তর বিন্যাসে এটাও একটা কারণ কি?)

বাঙালীদের মৎস্যপ্রীতির পরিচয় ময়নামতি ও পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকগুলোতে পাওয়া যায়। সেখানে মাছ কোটা বা ঝুড়িতে ভরে হাটে নিয়ে যাওয়ার চিত্র আছে। হরিণ শিকার করে নিয়ে যাওয়ার চিত্রও আছে। এর বর্ণনা পাওয়া যায় চর্যাগীতেও।

বৌদ্ধাচার্য লুইপা নাকি মাছের অন্ত্র খেতে ভালবাসতেন, তাই তার নাম হয়েছিল মৎসেন্ত্রাদ। তবে মাছ যে বাঙালি জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝা যায় মধ্যযুগের বাংলায় জেলেদের বার বাড়ন্ত দেখলেই, কৈবর্তরা তো আসলে জেলে সম্প্রদায়ই যারা নাকি এক কালে রাজার বিরুদ্ধে সমবেত হয়ে বিদ্রোহ করেছিল। বাঙালি চিরকালই মাছেভাতে আছে

মাছ খাওয়ার এমন ঐতিহ্য পৃথিবীতে আর কোন জাতির আছে বলে জানা নেই। ঈশ্বরগুপ্ত বলেছেন, ‘ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল’।

বরিশালের বৈষ্ণবরা যাতে মাছ খেতে পারেন, তার জন্য বিধান এলো -

ইল্লিশ, খল্লিস, ভেটকী, মদগুর এব চ।
রোহিত রাজেন্দ্র, পঞ্চমৎস্যা নিরামিষাঃ।।

অস্যার্থঃ- ইলিশ, খলসে, ভেটকী, মাগুর এবং রুই- এই পাঁচরকম মাছ নিরামিষ। খেলে দোষ নেই!

সাথে, আরও জুড়ে দিলেন:- কাঁচকলা দিয়ে রান্না করলে, সব রকম মাছই খাওয়া যায়!

তন্ত্রশাস্ত্র আরও সরেস! তাঁরা কী বলেছেন বিধান দিতে গিয়ে!!!!!!

মৎস্য তিন প্রকার। উত্তম, মধ্যম ও অধম।

উত্তম মৎস্য= প্রায় কন্টক বিহীন।

মধ্যম মৎস্য= কিছু পরিমাণ কন্টক।

অধম মৎস্য= প্রচুর কন্টক হইলেও উত্তম রূপে ভর্জিত হইলে অতীব উপাদেয়। মানেটা হলো, কাঁটা মাছ কড়কড়ে করে ভেজে খেতে পারো!

কী মৎস্যপ্রেম! কাউকে ছাড়া নেই! বাঙালি বলে কথা !! হুঁ হুঁ বাওয়া !

খাল-বিল নদী-নালার দেশ বঙ্গদেশে আগাগোড়াই খাওয়া হতো মাছ। সে জন্যেই বাঙালিদের সঙ্গে ভাত এবং মাছ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চন্দ্রকেতু গড়ে মাছের ছবিসহ একটি ফলক পাওয়া গেছে। নীহাররঞ্জন রায়ের ধারণা, এই ফলকটি চতুর্থ শতকের। তাছাড়া অষ্টম শতাব্দী থেকে পাহাড়পুর এবং ময়নামতিতে যে সব পোড়ামাটির ফলক তৈরি হয়, তার অনেকগুলোতেই মাছের ছবি আছে। এ থেকে মাছের প্রতি এ অঞ্চলের লোকদের ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতবর্ষের অন্য অনেক অঞ্চলের লোকেরা বাংলাদেশের এই মৎস্য প্রীতিকে ভালো চোখে দেখেন নি। তারা এখনো মাছ খান না। সুকুমার সেনের মতে, প্রাচীন বাঙালির সমাজে মাছ-মাংস জনপ্রিয় ছিলো ব্রাহ্মণ নয়, অব্রাহ্মণদের মধ্যে। আর, ধর্মভীরু বৌদ্ধদের মধ্যে মাছ খাওয়া আগাগোড়াই বারণ ছিলো। কিন্তু কই, রুই, ইলিশের মতো মুখরোচক খাবার অথবা একটা দেশের জনপ্রিয় রীতিকে কেবল ধর্মের নামে রাখা সহজ ছিলো না। বারো শতকে সবর্বানন্দ যখন তাঁর টীকাসবর্বস্বতে মাছের নিন্দা করেছেন তখনও ইলিশের কথা তিনি ভুলে যাননি বলা হয়, উদ্ভট শ্লোক রচিত হয়েছিলো বারো শতকে অথবা তার কিছু কাল পরে। এতে মাছের বিশেষ করে রুই মাছের কীর্তন করা হয়েছে। আর মাছ খাওয়ার রীতিমতো প্রশংসা করা হয়েছে । এর একটি পদে বলা হয়েছে যে, যে-নারী রোজ কলা পাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল আর নালিতা শাক পরিবেশন করেন, তাঁর স্বামী পুণ্যবান অর্থাৎ ভাগ্যবান। মাছ বাঙালিদের কাছে এতো প্রিয় হবার জন্যেই বাঙালি গৃহিণীরা বিশেষ যত্ন নিয়ে নানাভাবে মাছ রান্না করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন।

বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো রান্নার বই “পাক রাজেশ্বর” প্রকাশিত হয়েছিলো ঊনিশ শতকে। তারপর ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের পাকপ্রণালী। এই দুই বইতে মাছ রান্নার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে। কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী তাঁর রান্নার বই মাছের ৫৮ রকমের রান্নার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ থেকে মাছের প্রতি বাঙালিদের আকর্ষণ কতো প্রবল তার আভাস পাওয়া যায়।

মাছের প্রতি এই ভালোবাসার কারণে প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিদের মাছ-খেকো বলে অনেকে দুর্নাম করেছেন। সর্বানন্দও তাদের একজন। টীকাসর্বস্বে তিনি লিখেছেন যে, শুটকি মাছ হলো নিম্নবর্ণের লোকদের খুবই প্রিয় খাদ্য। তিনি এ জন্যে বাঙালিদের শুটকি খেকো বলেছেন।

বঙ্গদেশে যে মোগল কর্মকর্তারা বাস করতেন, তারাও বাঙালিদের মাছ-ভাতকে ঘৃণা করতেন। ঈসা খান এবং তাঁর পুত্র মুসাকেও তারা জেলে বলে আখ্যায়িত করেছেন। যখন ইংরেজ আমল শুরু হয়ে যায় তখনও মোগল আমলের সাবেক কর্মকর্তারা এই মানসিকতা ভুলে যেতে পারেন নি। গোলাম হোসেন সালিম ১৭৮০ এর দশকে তার রিয়াজ-উস-সালাতীনে এই মনোভাবই প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘এ দেশের উঁচু-নিচু সবাই মাছ, ভাত সর্ষের তেল, দই, ফল আর মিঠাই খেতে পছন্দ করে। প্রচুর লাল মরিচ এবং লবণ তাদের পছন্দ। তারা আদৌ গম এবং যবের রুটি খায় না। ঘিয়ের রান্না খাসি এবং মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না।

মধ্যযুগের সাহিত্যে মাছের যে বিবরণ পাওয়া যায় তা বিস্তারিত। বিশেষ করে ভারত চন্দের তালিকা রীতিমতো দীর্ঘ, আধুনিককালে বিদেশ থেকে আনা কিছু মাছের কথা বাদ দিলে, অন্য যে সব মাছের সঙ্গে বাঙালিদের পরিচয় আছে সে সব মাছের বেশির ভাগের নামই সেকালের সাহিত্যে পাওয়া যায়।

পদ্মপুরাণ, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল ভারতচন্দ্র এবং ঈশ্বর গুপ্ত মিলিয়ে যেসব মাছের কথা জানা যায় সেগুলো হলো : আড়/আউড়, ইচা,( চিংড়ি) ইলিশ, উলকা এলেঙ্গা কাতল, কালবসু, কুড়িশা, কৈ, খয়রা, খরশোলা, খলিশা, গড়ুই, গাগর, গাঙ্গাদাঁরা কাঁকলেকা, চাঁদা (নানা রকমের), চান্দাগুঁড়া চিংড়ি, চিতল, চেঙ্গ, চেলা, টেংরা, ডানিকোনা, তাপসে, তেচক্ষা, পাঁকাল, পাঙ্গাস, পাবদা, পার্শে, পুঁটি (নানা রকমের), ফলুই। ফলি, বাঁশপাতা, বোয়াল, বাচা, বাটা, বাণ (নানা রকমের), বানি, বেলে, ভেকুট, ভেদা, ভোল-চেঙ্গা, ভোলা, ময়া, মহাশোল, মাগুর, মৃগাল, মৌরলা, রিঠা, রুই, লাটা, গড়ই শঙ্কর শাল গজাল, শিঙ্গী আর শোল। এসব মাছের বাইরে বিশ শতকের গোড়ায় সতীশচন্দ্র শাস্ত্রী যেসব মাছের তালিকা করেছিলেন, সেগুলো হলো : অঞ্জনা, আলবুলা, আরশি, কটকটিয়া, করাতি, কাকাল, কাকাশিয়া, কারসি কুরচি, ঘাগৌট, ঘারুয়া, চন্দ্রমারা, চাকুন্দা, চাপলি, টেপা, তর, দেওকাটা, দেবারী, নফেলা, পটকা, পান, ফেসা, ভাঙ্গন এবং শিলন্দ।

সেকালের সাহিত্য থেকে কেবল বিচিত্র ধরনের মাছের নামই জানা যায় না, সেই সঙ্গে আরা জানা যায়, খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধির জন্যে কতো বিচিত্রভাবে মাছ রান্না করা হতো। যেমন, রান্না মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল থেকে মাছ রান্নার রকমারি সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলেও মাছের বিভিন্ন রকম রান্নার বিবরণ দেওয়া আছে। যেমন, রুই মাছ দিয়ে পলতার আগা; মাগুর মাছ দিয়ে গিমা শাক, ঝাঁঝালো সর্ষের তেল দিয়ে রান্না খরসুন মাছ; ভেতরে লাল লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে বাইরে সুতো জড়িয়ে চিংড়ি মাছের মাথা, চিতল মাছের কোল ভাজা আর কৈ মাছ দিয়ে মরিচের ঝোল।

জানি না, এই সব রান্না আজকাল কয়জনে পারে !!!!!

তবে আমাদের কাটা পোনা, আজও সমান ভাবে জনপ্রিয় এই পশ্চিমবাংলায় ।

জয়তু মৎসপুরাণ ।

-

উৎস – ইনটারনেট এবং বিভিন্ন বই ।

5 comments:

Nirmalya Bachhar বলেছেন...

লিখিবি পড়িবি মরিবি দুখে,
মৎস ধরিবি খাইবি সুখে!

Soumitra Chakraborty বলেছেন...

অনবদ্য পান্ডিত্যে আবার ঘনাদাকে পেলাম।
আমি মন্ত্রমুগ্ধ!
প্রত্যেক লেখার মতই এই মাছের ইতিহাসও সমৃদ্ধ করলো আমাকে।
ঘনাদা জিন্দাবাদ।

মামনি দত্ত বলেছেন...

মৎস্য ইতিহাস জেনে সমৃদ্ধ হলাম। ..কিছু অজানা মাছের কথাও জানলাম। অসাধারণ তথ্য।

Rudrodip Majumdar বলেছেন...

নানাধরনের রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগের ফলে এখন চিংড়ির মাথা খাওয়া খুব নিরাপদ নয়, বাকি পদ্গুলির কয়েকটি মা - দিদিমার হাতে খেয়েছি ।। সুস্বাদু প্রবন্ধ

malabika বলেছেন...

simply fantastic.মৎস্য লোলুপ জাতির জন্য উত্তম উপহার।