সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৩

ধারাবাহিক - অভীক দত্ত


বিলাভারত-৩ অভীক দত্ত


কোলাজ বিলা

১।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। মহাভারতে সঞ্জয়ের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। সঞ্জয়ের কাজ ছিল ধৃতরাষ্ট্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট করা, কোথায় কি হল। মানে এখনকার দিনের রেডিও সাংবাদিকের কাজ। এবার সমস্যা হল সঞ্জয়ের আবার কোন দলের ব্যাপার ছিল না। তখনকার দিনে চিটফান্ড বলে কিছু ছিল না, শাসকদলের চ্যানেল বিরোধী দলের চ্যানেল ইত্যাদি কিছু ছিল না। তাই সঞ্জয়কেও হলুদ সাংবাদিকতার আশ্রয় নিতে হয় নি। কুরুক্ষেত্রে যা যা ঘটেছে তাই তাই জেনেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। ভাগ্যিস মহাভারত এই সময়ে লেখা হয় নি। তাহলে এত চ্যানেলের জ্বালায় ধৃতরাষ্ট্রর ইয়ে মারা যেত।

কোন আখ্যানে হিরো আর ভিলেইন যেমন আলাদা করে বোঝা সহজ মহাভারতে এই কাজ বেশ কঠিন। কর্ণকে কখনও খুব কঠিন ভাবে দেখানো হয়েছে, আবার যখন কৃষ্ণ কর্ণকে সরাসরি লোভ দেখাতে গিয়েছিল কর্ণের তীক্ষ্ণ উত্তর কৃষ্ণকে চমকে দিয়েছিল। অর্জুনকে হিরো বলতেও অসুবিধা হয় কারণ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় অর্জুনের চুপ থাকাটা কাপুরুষতার পরিচয়। ভীমকে পেটুক, মাংসলোভী ও স্বার্থপর বলা হয় কিন্তু দেখা যায় দ্রৌপদীর বারে সব থেকে বেশি নেচেছে ভীম। রামায়নে শ্ত্রুঘ্নর যেমন কোন ভূমিকা পাওয়া যায় না(ভানুর ভাষায় ও যে সারাজীবনে কয়ডা শ্ত্রু মারসে তার হিসাব নাই), মহাভারতে দুই মাদ্রিপুত্রের অবস্থাও সেরূপ। নকুল আর সহদেবের কোন কংক্রিট ভূমিকা পাওয়া যায় না সেভাবে। শকুনিকে মারা ছাড়া এরা যে সেরকম কিছুই করেনি।

কর্ণের সাথে দরাদরির সময় কৃষ্ণ কর্ণকে প্রস্তাব দিয়েছিল তুমি বাপু পান্ডবপক্ষে যোগ দাও তবে তুমি রাজ্য তো পাবেই তার উপরে দ্রৌপদীর ভাগটাও পাবে। এ এক অত্যন্ত নোংরা ঘটনা। নারীদের দাঁড়িপাল্লায় তুলে ভীষণ বিচ্ছিরিভাবে লোভ দেখানো হত। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে কোন রকম প্ররোচনাতেই পা দেয়নি কর্ণ, এই ব্যাপারটাও তার পক্ষে যায়। উল্টে দুর্যোধন তার জন্য কি কি করেছে, সারথি পরিবারে তার কি কি কমিটমেন্ট আছে এইসব হাজারো তথ্য কৃষ্ণকে শুনিয়ে দেয় সে। তার দিকে তাকিয়ে দুর্যোধন কুরুক্ষেত্রর মত এতবড় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এই সময় সে কি করে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে?

আদতে কুরক্ষেত্র যুদ্ধের কিছু আগে থেকে কর্ণের চরিত্র মহিমান্বিত করার একটা চেষ্টা দেখা যায়। এর আগে কর্ণকে রীতিমত ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রোজেক্ট করা হয়েছিল।

মহাভারতের আরও এক ট্রাজিক চরিত্র ভীষ্ম। নিজের বাবার জন্য নিজের যৌবন কুরবান করে দিয়েছিলেন তিনি। ভাবা যায়? একই ধরণের চরিত্র আদিকথায় রাজা যযাতির পুত্র পুরু। শুক্র ক্রুদ্ধ হয়ে যযাতিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন তিনি জরাগ্রস্থ হবেন। যযাতি তখন শুক্রের হাতে পায়ে ধরলে তখন শুক্র বলেন তার কোন ছেলে যদি বাপের জরা ধারন করে তবেই যযাতি পুনরায় যৌবন ফিরে পাবেন, পাঁচ ছেলের মধ্যে একমাত্র ছোট ছেলে পুরু এই শর্তে রাজি হলে যযাতি এক হাজার বছর (* মহাভারতের এই এক হাজার বছর, একশো ছেলের বাপ এই সব ব্যাপারে লীলা মজুমদার একটা চমৎকার ব্যাপার বলে গেছেন। তারা তো তখন বড় বড় রাজা ছিলেন,ছোট ছোট কাজ করলে ঠিক প্রচার পেতেন না। তাই পাঁচ ছেলেকে পঞ্চাশ ছেলে, পাঁচ বছরকে পঞ্চাশ বছর দেখিয়ে গেছেন। এই নিয়ে অনেকের মধ্যে অবশ্য মতপার্থক্য দেখা যায়। তখনকার দিনে সবকিছু নাকি ফ্রেশ ছিল, শুধু তারই জন্যে নাকি অনেকে অনেক বছর বেঁচে থাকত। ) যৌবন ভোগ করেন। ওই সময়টা পুরু জরাগ্রস্থ হয়ে থাকে। যৌবন কাটিয়ে এলে যযাতি তার সমস্ত সম্পত্তি ও যৌবন ছোট ছেলেকে দান করে। প্রজারা যযাতির কাছে জানতে চায় কেন সে চার পুত্রকে সম্পত্তি থেকে কাটিয়ে দিল। উত্তরে যযাতি বলে দিল যে ছেলে বাপের কথা শুনেছে, সেই রাজত্ব পাবে।

আমাদের ভীষ্ম সারাজীবন অনেক কষ্ট করেছেন। সামনে ডবকা ডবকা মেয়েছেলে দেখেছেন। হারেম ছিল। ব্যবহার করেননি। এমনকি যখন তার সৎ মা তাকে অনুরোধ করেন তার বউ মাদের সাথে শোয়ার জন্য তখনও সম্পূর্ণ ভাবে নিজের প্রতিজ্ঞা বজায় করেছিলেন তিনি।

সবাই ক্ষুদিরামকে যে কেন একা দোষী বলে!

২।

তখনকার দিনের স্বর্গের অপ্সরা বেশ অ্যাভেইলেবল ছিল। যখন তখন মর্ত্যে নেমে এসে যার তার সাথে শুয়ে পড়ত। কিন্তু কেসটা হল তারা মর্তেই বাচ্চা পয়দা করে যেত। শকুন্তলা থেকে দ্রোণাচার্য সবাই এই পথের পথিক। পরের সংখ্যার বিলাভারতে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

(চলবে)