কাঁটাতার
অলোকপর্ণা
১
চন্দনা হেঁটে এসেছে অনেকখানি,- কাঁটাতারে পৌঁছে তা টের পেয়ে নিশ্চুপ সে ফেরার পথ ধরে। যেন এছাড়া অন্য আর কিছু হওয়ার ছিল না। ওপাশের গ্রাম তার নজর এড়িয়ে যায়, মগ্ন চন্দনা আজ সকাল থেকে মনে মনে ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল’ গেয়ে চলেছে। তাই তার মনে পড়েনা, কাঁটাতারের ওপাশের কথা জিজ্ঞেস করায় কেমন করে চড় মেরেছিল পুষ্পল, মনে পড়েনা পুজোয় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলায় কেমন ঘাড়ধাক্কা জুটেছিল। এসব পুরোনো কথা চন্দনা ভুলে গিয়েছে। পুষ্পলের পাখি হয়ে গিয়েছে সে, পুষ্পল যা বলিয়েছে তাই বলেছে, যা পরিয়েছে তা পরেছে। চন্দনার হাসি পেয়েছে তার নামের এমন সার্থকতায়, এতই হাসি পেয়েছে যে হাসতে হাসতে সে কেঁদে ফেলেছে, মিনিট চারেক পর বেরিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে।
কাজের লোক শুক্লা তিন মাস আগে জানাল পুষ্পলের পরকীয়ার কথা। সে কথা বিস্তারিত শুনে চন্দনা বাথরুমে ঢুকে আবারও হাসতে শুরু করেছে। সেদিন কান্না আসেনি আর। খুব হেসে নিয়ে যখন সে বাইরে এসেছে, দেখেছে বিকেল, পুষ্পলের আসার সময় হয়েছে। সেই থেকে চন্দনা গান গাইছে মনে মনে, যেমন আজ ‘হৃদয় আমার...’ গেট ঠেলে সে কম্পাউন্ডে ঢোকে, লেটার বক্স খুলে দেখে নেয় কেউ এল কি না। এসেছে, অফিসিয়াল এক চিঠি। এনভেলপে নিজের নাম দেখে চন্দনার গান থামে। ঘরে ঢুকে টেবিলে বসতে বসতে চিঠির বয়ান বার তিনেক পড়া হয়ে যায়। পুষ্পল ডিভোর্স চেয়েছে অবশেষে। শুক্লা নেই। দরজা জানালা সব বন্ধ। চন্দনা গেয়ে ওঠে, ‘এই- যে আলোর আকুলতা...’ গলা কত বদলে গিয়েছে!
গান থেমে যায় কলিং বেলের ডাকে। দরজা খুলতে না খুলতে শুক্লা একমুখ হাসি নিয়ে বলে যায় “ঘরভাঙানি ডাইনিটা পরিবার নিয়ে চলে যাচ্ছে শহরে, এবার তোমার কপাল ফিরবে গো!” বিত্তের বাঁধা মাঝে না থাকলে শুক্লা যে আনন্দে তাকে জড়িয়েই ধরত চন্দনা তা বোঝে। কাঁটাতারের ওপারে কি আছে তা ও বলতে পারবে জেনেও গা ঘিনিয়ে শুক্লার গায়ের আঁশটে গন্ধ থেকে বেরিয়ে আসে চন্দনা। পুষ্পলের প্রেমিকা চলে যাচ্ছে,- তাহলে ডিভোর্সের চিঠির মানে কি? সে বারান্দায় এসে গাছেদের পাশে বসে। ভাবে গাছের থেকে স্বাধীন কেউ আছে! টবের গাছেরা ফরিশ্তার বেশে দাঁড়িয়ে, যেন সময় হলেই উড়ে যাবে,- ওড়া! চন্দনা ভাবে পাখির চেয়ে স্বাধীন...- নাহ্ আর কেউ নেই। পুষ্পলের থেকে ছাড়া পেলে সে সত্যিই পাখি হয়ে যাবে।
পাখি হয়ে যাবে... এটা আনন্দ না বিষণ্ণতা সে টের পায় না।
২
সন্ধ্যের মুখে টিউব জ্বালিয়ে টেবিল ক্লথটা নামিয়ে চন্দনা সূঁচ- সুতো তৈরী করে। কাশ্মীরী স্টিচের এই কাজটা দুবছর পরে রয়েছে। একগাদা রঙিন সুতোর রিল ছড়িয়ে দিতে বিছানাটা এমন হেসে উঠল যে সেখানকার প্রতি রাতের নির্মমতাকে চন্দনা এক্কেবারে ভুলে গিয়ে ফুলের পাপড়িটা লাল হবে না হলুদ- এই দ্বিধার মাঝে দাঁড়িয়ে মনে মনে গেয়ে উঠল, ‘সব নিয়ে শেষ ধরা দিলে...’। পুষ্পল ঘরে আসে।
“একটা চিঠি আসবে তোমার কাছে, ডিভোর্স পেপার, ওটা আমায় দিয়ে দেবে। আমি উইথড্র করছি।” সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে যায়।
সূঁচ হাতে থেমে থাকে চন্দনা। লাল না হলুদ- হলুদ না লাল... স্বাধীন ভাবে হলুদ সুতো বেছে নিয়ে চন্দনা তার শীর্ণ কবজিতে নিপুণ স্টিচ ফেলে চলে যতক্ষণ না পিঠ থেকে তার ডানা বের হয়।
যতক্ষণ না বিছানায় শুয়ে পরতে পরতে সে দেখে তার সারা গা ভরে যাচ্ছে পালকে,
যতক্ষণ না চোখ বোজার পর ‘অনন্ত আকাশে...’ গাইতে গিয়ে কিচিরমিচির ছাড়া অন্য কিছু সে শুনতে পায়না।
ভোরের দিকে শুক্লা সরকারী কোয়ার্টারে আসার পথে দেখে কাঁটাতারের ওপাশে কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে কি কারণে যেন উৎসব লেগেছে, নাচাগানা, হৈ হট্টগোল, আনন্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকেই। তার ইচ্ছে হয় ওপারে চলে যায়...
আঁশটে গন্ধ নিয়ে শুক্লা কাঁটাতার থেকে সরে আসে, যেন এছাড়া অন্য কিছুই আর করার ছিল না।
অলোকপর্ণা
১
চন্দনা হেঁটে এসেছে অনেকখানি,- কাঁটাতারে পৌঁছে তা টের পেয়ে নিশ্চুপ সে ফেরার পথ ধরে। যেন এছাড়া অন্য আর কিছু হওয়ার ছিল না। ওপাশের গ্রাম তার নজর এড়িয়ে যায়, মগ্ন চন্দনা আজ সকাল থেকে মনে মনে ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল’ গেয়ে চলেছে। তাই তার মনে পড়েনা, কাঁটাতারের ওপাশের কথা জিজ্ঞেস করায় কেমন করে চড় মেরেছিল পুষ্পল, মনে পড়েনা পুজোয় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলায় কেমন ঘাড়ধাক্কা জুটেছিল। এসব পুরোনো কথা চন্দনা ভুলে গিয়েছে। পুষ্পলের পাখি হয়ে গিয়েছে সে, পুষ্পল যা বলিয়েছে তাই বলেছে, যা পরিয়েছে তা পরেছে। চন্দনার হাসি পেয়েছে তার নামের এমন সার্থকতায়, এতই হাসি পেয়েছে যে হাসতে হাসতে সে কেঁদে ফেলেছে, মিনিট চারেক পর বেরিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে।
কাজের লোক শুক্লা তিন মাস আগে জানাল পুষ্পলের পরকীয়ার কথা। সে কথা বিস্তারিত শুনে চন্দনা বাথরুমে ঢুকে আবারও হাসতে শুরু করেছে। সেদিন কান্না আসেনি আর। খুব হেসে নিয়ে যখন সে বাইরে এসেছে, দেখেছে বিকেল, পুষ্পলের আসার সময় হয়েছে। সেই থেকে চন্দনা গান গাইছে মনে মনে, যেমন আজ ‘হৃদয় আমার...’ গেট ঠেলে সে কম্পাউন্ডে ঢোকে, লেটার বক্স খুলে দেখে নেয় কেউ এল কি না। এসেছে, অফিসিয়াল এক চিঠি। এনভেলপে নিজের নাম দেখে চন্দনার গান থামে। ঘরে ঢুকে টেবিলে বসতে বসতে চিঠির বয়ান বার তিনেক পড়া হয়ে যায়। পুষ্পল ডিভোর্স চেয়েছে অবশেষে। শুক্লা নেই। দরজা জানালা সব বন্ধ। চন্দনা গেয়ে ওঠে, ‘এই- যে আলোর আকুলতা...’ গলা কত বদলে গিয়েছে!
গান থেমে যায় কলিং বেলের ডাকে। দরজা খুলতে না খুলতে শুক্লা একমুখ হাসি নিয়ে বলে যায় “ঘরভাঙানি ডাইনিটা পরিবার নিয়ে চলে যাচ্ছে শহরে, এবার তোমার কপাল ফিরবে গো!” বিত্তের বাঁধা মাঝে না থাকলে শুক্লা যে আনন্দে তাকে জড়িয়েই ধরত চন্দনা তা বোঝে। কাঁটাতারের ওপারে কি আছে তা ও বলতে পারবে জেনেও গা ঘিনিয়ে শুক্লার গায়ের আঁশটে গন্ধ থেকে বেরিয়ে আসে চন্দনা। পুষ্পলের প্রেমিকা চলে যাচ্ছে,- তাহলে ডিভোর্সের চিঠির মানে কি? সে বারান্দায় এসে গাছেদের পাশে বসে। ভাবে গাছের থেকে স্বাধীন কেউ আছে! টবের গাছেরা ফরিশ্তার বেশে দাঁড়িয়ে, যেন সময় হলেই উড়ে যাবে,- ওড়া! চন্দনা ভাবে পাখির চেয়ে স্বাধীন...- নাহ্ আর কেউ নেই। পুষ্পলের থেকে ছাড়া পেলে সে সত্যিই পাখি হয়ে যাবে।
পাখি হয়ে যাবে... এটা আনন্দ না বিষণ্ণতা সে টের পায় না।
২
সন্ধ্যের মুখে টিউব জ্বালিয়ে টেবিল ক্লথটা নামিয়ে চন্দনা সূঁচ- সুতো তৈরী করে। কাশ্মীরী স্টিচের এই কাজটা দুবছর পরে রয়েছে। একগাদা রঙিন সুতোর রিল ছড়িয়ে দিতে বিছানাটা এমন হেসে উঠল যে সেখানকার প্রতি রাতের নির্মমতাকে চন্দনা এক্কেবারে ভুলে গিয়ে ফুলের পাপড়িটা লাল হবে না হলুদ- এই দ্বিধার মাঝে দাঁড়িয়ে মনে মনে গেয়ে উঠল, ‘সব নিয়ে শেষ ধরা দিলে...’। পুষ্পল ঘরে আসে।
“একটা চিঠি আসবে তোমার কাছে, ডিভোর্স পেপার, ওটা আমায় দিয়ে দেবে। আমি উইথড্র করছি।” সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে যায়।
সূঁচ হাতে থেমে থাকে চন্দনা। লাল না হলুদ- হলুদ না লাল... স্বাধীন ভাবে হলুদ সুতো বেছে নিয়ে চন্দনা তার শীর্ণ কবজিতে নিপুণ স্টিচ ফেলে চলে যতক্ষণ না পিঠ থেকে তার ডানা বের হয়।
যতক্ষণ না বিছানায় শুয়ে পরতে পরতে সে দেখে তার সারা গা ভরে যাচ্ছে পালকে,
যতক্ষণ না চোখ বোজার পর ‘অনন্ত আকাশে...’ গাইতে গিয়ে কিচিরমিচির ছাড়া অন্য কিছু সে শুনতে পায়না।
ভোরের দিকে শুক্লা সরকারী কোয়ার্টারে আসার পথে দেখে কাঁটাতারের ওপাশে কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে কি কারণে যেন উৎসব লেগেছে, নাচাগানা, হৈ হট্টগোল, আনন্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকেই। তার ইচ্ছে হয় ওপারে চলে যায়...
আঁশটে গন্ধ নিয়ে শুক্লা কাঁটাতার থেকে সরে আসে, যেন এছাড়া অন্য কিছুই আর করার ছিল না।
1 comments:
ছোটগল্প এক অন্য ভূবন। অনুগল্প স্রেফ ইঙ্গিতময়তা। যে কোন শিল্পমাধ্যমের ডায়মেনশন, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধ-সময়-এর সীমানা কমলে তার প্রকৃত লড়াই শুরু হয়; স্বকীয়তার, আর তা প্রকাশের-ও। অলোকপর্ণার ঝুরোগল্প এর আগেও মুগ্ধ করেছে আমাকে। এই গল্পের ক্ষেত্রে ইঙ্গিতগুলির সার্থকতা এইখানেই যে, কয়েকটি অসাধারন রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদ্যক্ষর, অক্ষরের সঙ্গে দূরতর সম্পর্ক থাক বা না-থাকাকালীন-ই গল্পকে অনেকটা দৃশ্যায়নের অতীতে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। যদিও দৃশ্য আছে, ভীষনভাবেই আছে। আখ্যান আছে খুব প্রকট ও ঢিলেঢালা, দুর্বল প্লটের আকারে। কিন্তু, অলোকপর্ণার লেখায় যে নারীরা অন্য ভূবনের আধুনিকা - তাদেরকে এক্সপ্লোর করাই সন্ধিৎসু পাঠকের নেশালু চার্ম ! প্রসঙ্গতঃ, সম্পাদনার প্রয়োজনে গল্পটিকে দুটি ভাগে ভাগ করে নিতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। এ জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা রইল। শূভেচ্ছা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন