মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

উপন্যাস - রিংকু চৌধুরী


রিংকু চৌধুরী  
শামিয়ানা

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়া তিতিনের বরাবরের অভ্যেস! উঠেই বাড়ীর সামনের বাগানে চলে যায় তিতিন! শিশিরে ভেজা ঘাসে হাঁটতে ভালবাসে খুব !তিতিরের বাবা অবিনাশ বাবু অবসর সময়ে বাগান সাজান,  নানা ফুল ফলের গাছে সুন্দর করে সাজানো বাগান!!অবিনাশ বাবুর সোনার ব্যবসা,ক্ললকাতা শহরে টে শোরুম আছে ওনার!তার স্ত্রী মিতা ,তিতিনের মা, ওর ১১ বছর বয়সে এক সন্ধ্যায় আচমকা ওদের ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে উপরে বাসস্থন খুঁজে নেন!  ওদের এত বড় প্রাসাদোপম বাড়িতে ওরা চারজন প্রাণী বাস করে১ অবিনাশ বাবু তিতিন আর দুজন সব সময়ের কাজের লোক রাধা আর অনিল! বছেরের তিতিন ওরফে বিভাবরী বিয়ে করেনি, একটা নামকরা কলেজের ইতিহাসের শিক্ষিকা ! অবিনাশ বাবুর ইচ্ছে ছিল তিতিন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক, কিন্তু একগুঁয়ে তিতিন ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করতে চেয়েছিল, অগত্যা অবিনাশ বাবু রাজি হয়েছিলেন!  তাছাড়া  তিতিনের ইতিহাসের উপর ছোটবেলা থেকে অদ্ভুত টান আছে!
জানো বাবা ! যখনই ইতিহাস বইয়ের পাতা ওলটাই, মনে হয় আমি এসব দৃশ্য চিনি জানি, নিজের চোখে দেখেছি! অদ্ভুত ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায় আপনা আপনি!
মনে আছে অবিনাশ বাবুর কথা গুলো , তখন বোধহয় ক্লাস ফাইভে পড়ে! তাই দু একবার গাঁই গুই করে আর বাধা দেননি তিতিন কে, ভালবেসে পড়া আর জোর করে পড়ার  তফাৎ উনি বুঝেছিলেন !!
ইদানীং তিতিন বেনারসের গায়িকা দের নিয়ে কি একটা রিসার্চ করছে, একদিন রাতে খেতে খেতে বলল! ইংরেজ দের শাসনকালে যে সমস্ত গায়িকারা, নবাব এবং সাহেবদের জীবনে আলোড়ন তুলেছিল তাদের নিয়ে পড়াশোনা করছে সে, একটা খুব ইন্টারেস্টিং তথ্য ও পেয়েছে নাকি!
আজকাল তবে অবিনাশ বাবুর খুব চিন্তা হয় তিতিন কে নিয়ে, সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে! কারুর সাথে মেশে না! কি একটা খুঁজে যাচ্ছে! জিগ্যেস করলে তাকিয়ে দেখে আবার বইয়ে ডুবে যায়! কলেজ আর পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত সে,বিয়ের ব্যপারে যতবার  কথা বলেছেন সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে তিতিন! হাল ছেড়ে দিয়েছেন উনি! জেদ আর একগুঁয়েমি এ বংশের ধারা বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছেন!



বিভাবরী  আমার ভারী ভালো মেয়ে, যেমন রুপে তেমন গুনে, এমন মেয়ে পিদিম নিয়ে খুঁজলেও পাবে নেকো! ওর গানের গলায় স্বয়ং মা সরস্বতীর নিবেস!কথাটা বলেই পিকদানি তে পানের পিক ফেলে সাড়ির আঁচলে মুখটা মুছে নিলেন যোগমায়া দেবী!
মা ঠাকরুন আমরা কি আর তা জানিনে নাকি? মধু নাপ্তানি যোগমায়ার পায়ে আলতা পড়াতে পড়াতে বলল! অমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে গোটা গাঁয়ে পাবেনেকো কেউ!
ওর কথায় পুঁটি গয়ালানি সায় দিল! ঠিক কথা কইলে নাপিত বউ!
মা! একটা কতা ছিল, এবারের পুজোর সময় আমাকে একটা লাল পাড় সাড়ি দিতে হবে কিন্তু। আমার আব্দার রইল! মধু নাপ্তানি মধু ঝরিয়ে কথাটা বলল, সঙ্গে- সঙ্গে পুঁটি গয়লানি ও একি সুর তুলল!
আচ্ছা! সে হবে’খন এখন তোরা আয় দেকি! আমার ঘুমুবার সময় হয়ে গেচে!
চলি মা ঠাকরুন বলে দুজনেই চলে গেল!
যোগমায়া দেবী বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজলেন!

১৮৫৭ সাল চারিদিকে রক্ত রাঙানো পরাধীনতার চিৎকার, প্রান দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, সিপাহি বিদ্রোহের আগ্নেয়গিরি গ্রাস করছে মায়েদের কোল!
ভারতবর্ষ কে সে সময়ে যদি উপরে হেলিকপ্টার থেকে দেখা যেত, তাহলে শুধু লাল রঙটাই দেখা যেত! অন্য কোন রঙ নিজের সৌন্দর্য শোভা প্রকাশ করতে পারছিল না!
যেমন স্বদেশীদের লড়াই ছিল, তেমন ছিল বিত্তবানদের তোষামোদি, নিজেদের হাতে মাতৃভূমি কে নিঃস্ব করছিল! মানুষে মানুষে প্রভেদ, অত্যাচার আর লুণ্ঠন যেন রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছিল!
বীরভূমের একটা ছোট্ট গ্রাম বীরপুরের জমিদার নারায়ন চৌধুরীও রায় চৌধুরী উপাধি পেতে মরিয়া!! তাঁর আর যোগমায়া দেবীর তিন  সন্তান আশাবরী, বিভাবরী আর অনুপম! একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়েছেন ওনার পাল্টা ঘরে,বড় মেয়ে আশাবরী পরমা সুন্দরী, তার রুপে মোহিত হয়ে পাশের গ্রামের জমিদার অতুল চৌধুরী তার একমাত্র ছেলের বউ করে নিয়ে গেছে আজ বছর চারেক! অনুপম জমিদারি সামলায়! ওনার ছোট মেয়ে বিভাবরী সবার থেকে আলাদা! সুন্দরী ও গুণবতী, অসাধারণ গান গায় !নিজের জীবন নিজের মত বাঁচার স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখে গায়িকা হওয়ার, পৃথিবী জুড়ে তার গান একদিন সবাই শুনবে, আর পাঁচটা মেয়ের মত সংসার খেলা খেলতে চায় না সে! জমিদার বাবু তার ছোট মেয়েটিকে একটু অতিরিক্ত স্নেহ করেন ! বিভাবরীর আব্দারে গুরু ধরে গান শিখিয়েছেন তাকে! অবসর সময়ে মেয়ের গান শোনেন, অল্প কিছু পড়াশোনা ও শিখেছে বিভাবরী!

তাই এবার ছোট মেয়ে বিভাবরী কে সুপাত্রস্থ করতে পারলে তাঁর শান্তি! তা পাত্র তার দেখা, বড়ই পছন্দের সে পাত্র! নাম বিনয় চাটুজ্যে, অল্প বয়সী ছেলে, কিন্তু ধুরন্ধর ব্যবসায়িক বুদ্ধি! সাহেবদের মহলে বড় যাতায়াত! এমন পাত্র তো হাতছাড়া করা যায়না!!
 কাছারি থেকে ফিরে খেতে বসে যোগমায়া কে জানাতে তিনি তো হাতে স্বর্গ পেলেন!
হ্যাঁ গা! তাকে দেখতে শুনতে কেমন গা? বিভুর পচ্ছন্ধ হবে তো?
হবে মানে হতেই হবে, এমন সুপাত্র হাতছাড়া করতে পারব না! বিভু কে ডাকো তো একবার!!
তিতিন! খেতে চল বেলা হয়ে গেছে যে! অবিনাশ বাবু উপরের ঘরে মেয়ে কে ডাকতে এসে দেখেন তিতিন ল্যাপটপ এ কি একটা খুঁজছে আর খসখস করে লিখে যাচ্ছে কাগজে! বাবার ডাকেও হুঁশ নেই তার!
অবিনাশ বাবু মেয়ের গায়ে হাত ছোঁয়ালেন, এই তিতিন!
উম্ম! হ্যাঁ বাবা! কিছু বলবে? অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল তিতিন
তোকে কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না? রাগত স্বরে অবিনাশ বাবু বললেন!
ও আচ্ছা ! হ্যাঁ! চল!চল সব ছড়িয়ে রেখে বিছানায় নীচে নেমে গেল , নামতে নামতে বাবা কে ডাকল এসো বাবা!!
খেতে বসে মেয়ে কে জিজ্ঞেস করলেন অবিনাশ বাবু ‘ কি এত পড়াশুনা করছিস রে? কি এত খুঁজে চলেছিস? আমি ও যে বাড়িতে আছি, তোর তো মনেই থাকেনা আজকাল!
তোমাকে তো বলেছিলাম !
হ্যাঁ কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত ব্যপার নিয়ে রিসার্চ করে কি করবি? বেনারসে সে আমলে অনেক গায়িকা ও বাইজি ছিল! তাদের সবার তথ্য কি তুই পাবি?
কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি কিছু আছে? সবথেকে অবাক হলাম যে উর্দু এবং হিন্দু ভাষার গায়িকাদের পাশাপাশি এক বাঙালি গায়িকাও ছিলেন! তিনি উর্দু তে অনেক ঠুমরী গজল লিখেছেন! নাম আসমা বেগম! যা তার নিজের নাম না! এর বেশী কোন তথ্য আমি পাচ্ছি না! আমার মাথা কাজ করছে না! তাই ঠিক করেছি বেনারস যাব!
কি? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে তিতিন! কোথায় খুজবি তাকে? আর ১৮০০ সালের ঘটনা! এটা ২০১৪ তিতিন!
হাত ধুতে- ধুতে তিতিন বলল এটা মুঠোফোনের যুগ বাবা, ইচ্ছে থাকলে সব পাওয়া যায়! আমরা পরশু ৭ দিনের জন্য বেরচ্ছি , তোমার ও কোথাও যাওয়া হয়না, তুমিও যাচ্ছ আমার সাথে ! আমি টিকিট করে এনেছি! ব্যাগ গুছিয়ে নাও বাবা! আমি উঠলাম, কাজ পড়ে অনেক! বলে উপরে চলে গেল!
অবিনাশ বাবু হতবাক হয়ে মেয়ে চলে যাওয়া দেখলেন!
আমি তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারব না বাবা! বাবার চোখের উপর চোখ রেখে বিভাবরী বলেই ফেলল কথাটা!
কি? ঠাস করে ওর গালে চড় কসাল অনুপম! বাবার মুখের উপর কথা? এত সাহস হয় কি করে?
যোগমায়া বলে উঠলেন, ওকে মেরে ফেল খোকা, ও মেয়ের মরে যাওয়া ভালো, বাপের মুখের উপর কতা বললে কি হয় ওকে বুজিয়ে দে!
আহ! ধমকে উঠলেন নারায়ন চৌধুরী! চুপ কর তোমরা!
মেয়ের থেকে জানতে চাইলেন! কেন বিয়ে করবে না জানতে পারি?
আমি গায়িকা হতে চাই, তাছাড়া আমি একজন কে কথা দিয়েছি!
কি? কে সে? বল মুখপুড়ি কে সে? কি নাম তোর ভাতারের?? যোগমায়া মেয়ের চুলের মুঠি ধরে মারতে শুরু করলেন!
বোবা পশু কে মানুষ যে তীব্র ভাবে মারে, কোন অংশে কম ছিল কিনা সে মার
কোন পুঁথিতে লেখা নেই, যেমন লেখা নেই সেদিন একফোঁটা জল পড়েনি বিভাবরীর চোখ দিয়ে!
নারায়ন চৌধুরী তার পাথরের মত চোখ দিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন! ওকে ঘরে আটকে রাখো, আর খোকা তুমি খুঁজে বের করো কে আমার বাড়ীর সম্মান নিয়ে খেলা করছে!
টেনে হিঁচড়ে সেদিন বিভাবরী কে আটকে রাখা  হয়েছিল ওর ঘরে! কিন্তু মুক্তির স্বপ্ন যে পাখি দেখেছে, তাকে সোনার তারে কি সত্যি বাঁধা যায়?


 

তিতিন এ তোর কি পাগলামো বল দেখি! বেনারস ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে গরম চায়ের চুমুক দিতে দিতে ঘুম ঘোর চোখে মেয়ে কে বললেন অবিনাশ বাবু!
কেন কিসের পাগলামো? তিতিন ভাঁড় টা ফেলে ভ্রু কুঁচকে বাবা কে একবার দেখে, চায়ের দোকানি কে জিজ্ঞেস করল ‘কিতনা হুয়া ভাইয়া??’
১০ রূপয়ে জী!
ইয়ে লিজিয়ে!
চল বাবা, হোটেলে চেক ইন করতে হবে তো!
হুম! আমাকে কেন আনলি বলতো? তুই তো সারাদিন ঘুরে বেড়াবি, আর আমি একা একা হোটেলে কাটাব!
আমি কি বলেছি, তোমাকে একা কাটাতে হবে, তুমিও যাবে আমার সাথে, তোমার ঘোরা হবে আর আমার কাজ ও হবে!!
 আজকাল সব টুরিস্ট স্পটে স্টেশনের বাইরে বিভিন্ন রকম গাড়ী পাওয়া যায়, যারা একাধারে গাইড ও! তেমন একটা ৪ সিটার গাড়ি ভাড়া করলেন অবিনাশ বাবু, যে কিনা গোটা বেনারস ওদের ঘোরাবে!
গাড়িতে উঠে তিতিন বলল ‘ পহলে হোটেল ব্লু মনসুন চলিয়ে ভাইজি’!



মাঝরাতে আচমকা দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল অনিকেতের! অনিকেত ঘরের প্রদীপটা জ্বালিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল কে? কে ওখানে?
অনিকেত বিভাবরীদের আশ্রিত, অনিকেতের বাবা গোবিন্দ মুখুজ্জে জমিদার বাবুর পাঠশালার বন্ধু ছিলেন, পড়ে উনি একটা টোল খোলেন, অনিকেত যখন ১০ বছর বয়স একদিন রাতে গোবিন্দ মুখুজ্জে পৃথিবী ছেড়ে ড্যাং- ড্যাং করে ওপারে চলে যান! মৃত্যুকালে গোবিন্দ মুখজ্জে ছেলেকে তাঁর বাল্যবন্ধুর কথা বলেন! অনিকেতের এক প্রতিবেশী তাকে জমিদার বাড়িতে দিয়ে যান, এবং সকল বৄতান্ত বলেন! জমিদার বাবু অনিকেত কে থাকতে জায়গা দেন, এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাকে নিজের ও তাঁর ছোট মেয়ের ফাইফরমাশ খাটার কাজের লোক হিসেব নিয়োগ করেন! এখন অনিকেত ২৪ বছরের সুঠাম যুবক, ঘরের সব কাজ করে, বিভাবরীর পাশে পাশে সবসময় থাকে, ওর আরেকটা পরিচয় হল, ওই সে যাকে বিভাবরী ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়! অনিকেত ভালো বাঁশি বাজায় ও সবার চোখ এড়িয়ে পড়াশুনাও করে, বিভিন্ন বই পড়ে বিভাবরী কে শোনায়! অনিকেত জানে ও বোঝে যে এই সম্পর্কের  পরিণতি ভয়ংকর কিন্তু বিভাবরী সে যে নাছোড়বান্দা! কি করে বোঝায় যে জমিদারবাবু তাকে গ্রহণ কোনদিন করবেন না!

আবার দরজায় হাল্কা আওয়াজ পেল অনিকেত! এবার দরজা টা আসতে করে খুলল
 ও !দরজা খুলে বাইরে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে অনিকেত হতবাক হয়ে গেল!


দরজার বাইরে রুম সার্ভিসের ছেলেটি বালিশ হাতে দাঁড়িয়ে, অবিনাশ বাবু ছেলেটির হাত থেকে বালিশটা নিয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে দরজাটা দিয়ে দিলেন! বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন তিতিনের কথা, মাঝে মাঝে ওর এই পাগলামো গুলো ওনাকে বেশ মজা ও দেয়! তিতিন তখন বোধহয় স্কুলে পড়ে ক্লাস টেন হবে এসে বলল বাবা স্কুলের একটা প্রজেক্ট আছে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর, পাহাড় নিয়ে ও তাদের সেখানকার মানুষ নিয়ে লিখতে হবে, গরমের ছুটির পর দেখবে,তাই বায়না হল স্কুলে যেদিন ছুটি পড়বে ওকে হিল ষ্টেশন নিয়ে যেতে হবে, ওখানে থেকে ওখানকার মানুষজন কে কাছ থেকে দেখতে চায়! প্রথমে না না করলেও পড়ে অবশ্য অবিনাশবাবু নিয়ে গেছিলেন ওকে! এসে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত লেখা জমা দিয়েছিল ও, ওদের ইংরেজির শিক্ষিকা পুরো স্কুলে দেখিয়েছিল ওর লেখা আর তার সাথে কিছু ছোট- ছোট মুহূর্তর ছবি যা তিতিন ওখানকার লোকেদের সাথে কাটিয়েছিল!

মেয়েটা অনেকটা অবিনাশ বাবুর ঠাকুমা বিভাবরী দেবীর মত, উনি নিজেও কোনদিন তাঁকে দেখেননি, উনি ছিলেন তাঁর বাবার ছোট পিসিমা! তাঁর বাবার মুখে শোনা যে একরাতে বাড়িতে ডাকাত পড়ে, অনেক সোনাদানা, মহামুল্যবান সামগ্রীর  সাথে খোয়া যায় তাঁর এই অসম্ভব রূপসী ঠাকুমাটি ও! তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোল বছর, অনেক খোঁজা খুজির পরও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি!  অসাধারণ গানের গলার অধিকারিণী, জেদি ও একরোখা এই ঠাকুমাটির গল্প শুনতে খুব ভালবাসত অবিনাশবাবু! প্রায় সময়েই বাবার কাছে আব্দার করত গল্প বিভাবরীর গল্প শোনার জন্য! বড় হতে –হতে সময়ের গুনে বিভাবরী মন থেকে মুছে যায় তাঁর, আবার মনে পড়ে যেদিন তিতিন কে প্রথম বার কোলে নিয়েছিলেন তিনি, সেদিনই ঠিক করেন মেয়ের নাম রাখবেন বিভাবরী!! আশ্চর্য হল তিতিন ও বিভাবরীর গল্প শুনতে ভালোবাসে! কিন্তু আরেকটা গল্প তিতিন কে কোনদিন বলা হয়নি!

১০
আজ নিয়ে ৩ দিন হল অনিকেত আসেনা, কোথায় আছে কে জানে? এমনটা তো এর আগে কোনদিন হ্য়নি,কোথায় গেল কি হল ওর? কাকে বা জিজ্ঞেস করবে ওর কথা ? বিভাবরী জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে যে রাস্তা দিয়ে অনিকেত আসে ওর কাছে!ভাবনা গুলি মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে আছে, কিছু ভালো লাগছে না আজ তার!
বিভু! বিভু! দরজা খোল একুনি! কতা আচে! যোগমায়া তারস্বরে ডাকছে বিভাবরী কে!
বল! কি বলবে! দরজা খুলে মাকে জিজ্ঞেস করল বিভাবরী!
মুকপুড়ি! হতচ্ছাড়ি! যমের অরুচি মেয়েমানুষ! একি চেহারায় ঘুরচিস? তোকে বলিনি আজ তোকে কলকেতা থেকে দেকতে আসবে! বলিনি তোকে , বলেই মেয়ের চুল মুঠি ধরে ঘা কতক লাগালেন যোগমায়া!

আমি যাব না! কঠিন স্বরে বিভাবরী বলল!
আমিও দেকব তুই কি করে না গিয়ে থাকিস, বলেই টানতে – টানতে মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন!
বাইরে থেকে হাল্কা গোঙানির আওয়াজ জমিদার বাড়ি গুমোট করে তুলল বুঝি!

১১

বাবা তুমি কি রেডি? আমি কিন্তু রেডি ! আজ এখানকার যত নামকরা ট্যুরিস্ট স্পট দেখব, কাল থেকে শুরু করব আমার কাজ, এখানকার গঙ্গার যে ঘাটগুলি আছে তারই আশেপাশে ছিল বাইজী দের আস্তানা! নিশ্চয় এখন ও কাউকে না কাউকে পাবোই!
অবিনাশ বাবু মেয়ে কে দেখলেন বললেন হ্যাঁ চল! কাশী বিশ্বনাথ কে দর্শন করে জানাবো তোর যাতে একটু সুবুদ্ধি হয়, আর যেন বিয়ে টা তোর দেখে যেতে পারি!
তোমার বকবক থামলে চল গাড়ী এসে গেছে! বলে মুখ বেঁকিয়ে তিতিন চলে গেল, হাসতে –হাসতে দরজা লক করে অবিনাশ বাবু ও এগোলেন!
প্রথমে ওরা দশশ্বামেধ ঘাট ঘুরে একটা গুমটি মত দোকানে চা কচুরির অর্ডার দিল!
“ বাবা তোমার Aldous Huxley –এর প্রবন্ধ বেনারস পড়া?
হ্যাঁ পড়েছিলাম! কেন বলতো?
 বলছি! তার আগে কচুরিটা ধরো!
গরম কচুরির একটা টুকরো ফু দিতে দিতে মুখে পুরল তিতিন!
বেশ ভালোই খেতে বল?
হ্যাঁ
এবার বল কি বলছিলি!
ওনার লেখাতে বেনারস কে আমরা অন্য ভাবে পাই, উনি মজা করেছিলেন হিন্দুদের  অন্ধবিশ্বাস নিয়ে, গঙ্গার ঘাটের নানারকম কাণ্ডকারখানা উনি ফুটিয়ে ছিলেন লেখাতে,উনি একটা জায়গায় লিখেছিলেন বড় বড় বজরা করে জমিদার বাড়ীর বউরা আসত কাশী বিশ্বনাথ দর্শন করতে!
তোমরা ও তো জমিদার ছিলে দাদু বা দাদুর পূর্বপুরুষরা বেনারস এসেছিল কোনদিন??
হ্যাঁ এসেছিল হয়তো আমাকে কোনদিন সে কথা কেউ বলেনি,আমি জানি ও না! কেন বলতো?
উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে তিতিন বলল না কিছু না চল!
ভাইয়া জী কিতনা হুয়ল!বলে খাবারের পয়সা মিটিয়ে গাড়ির দিকে এগোল!
পরের গন্তব্য মির ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট দেখার জন্য গাড়িতে উঠল আবিনাশ বাবু আর তিতিন! গাড়িতে উঠে অবিনাশ বাবু বলেন জানিস তিতিন বেনারসের গল্পে আছে একবার পার্বতীর কানের সোনার দুল মণিকর্ণিকা  ঘাটে হারিয়ে যায় তাই শিব রেগে অভিশাপ দিয়েছিল মণিকর্ণিকা ঘাট কে তাই এখানে শব দেহ জ্বালানো হয়! 



১২
১৮৭০ বেনারসের জমজমাট সকাল বিকেল,চারিদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘বন্দে মাতরম’ –এর সাথে বাইজিদের ঠুমরী, গজল এক হয়ে উঠছে! চারিদিকে শুধু কোলাহল ঘোড়ার ক্ষুরের চিৎকার,গুলির আওয়াজের সাথে ঘুঙরুর আওয়াজ, রাতের মহফিল আলো করছে কত না সুন্দরী রা! এমন ই এক বেনারস আলো করা সুন্দরী গায়িকা ছিলেন আসমা বেগম, তার কণ্ঠের জাদুকরী তে পাগল ছিলেন সে সময়ের অনেক নওয়াব, জমিদারেরা!তার গানের উষ্ণতা ছুঁতে চেয়ে সে সময়ের অনেক বড়লোকদের রাতের ঘুম নষ্ট হয়েছে!
এহেন আসমা বেগম সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে! গান ই  তার জীবন, প্রথম প্রেম তাকে জীবন চিনিয়ে গেছে, আর টাকাকড়ির মোহ তার কোনদিন ছিল না! তাই গান কেই জীবনের সব রকম কষ্টের ওষুধ ভেবে আগলে রাখেন!
বেনারসের  মণিকর্ণিকা ঘাটে প্রত্যেক দিন ভোরবেলা শ্বেত বসন পরিহিতা এক সুন্দরী মহিলা গঙ্গার স্নানে আসেন, !স্নানের শেষে একঘটি গঙ্গা জল নিয়ে ধীরে ধীরে বেনারসের গলির মধ্যে হারিয়ে যান! কোথায় যান কখন আসেন কেউ জানেনা!
এক সকালে যখন উনি স্নানে আসেন দেখেন এক যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে! কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখেন প্রান আছে কিন্তু অচৈতন্য! একটা ঘোড়ার গাড়ী কে আসতে দেখে মহিলা যুবকটি কে তার বআসায় নিয়ে আসেন! তার চিকিৎসা
করিয়ে সুস্থ করে তোলে! যুবকটি যখন অনেকটাই সুস্থ সুন্দরী মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করেন
কউন হো তুম? ক্যা নাম হ্যা তুমহারা?
 আমার নাম বিপুল, আমি বিপ্লবী! আমাদের দলের বেনারসে একটা গোপন সভা ছিল, আমি কলকাতা থেকে এসেছি!  কিন্তু পুলিশের কাছে খবর ছিল আমাদের, অনেক বন্ধু আর বেঁচে নেই, যারা বেঁচে গেছে তারা জানে আমি মারা গেছি, আমার বাড়িতে বিধবা মা আর বোন আছে, কি হবে যদি ওরা জানে আমি বেঁচে নেই!
তুমি ভেব না তোমার বাড়ীর ঠিকানা দাও আমি লোক পাঠিয়ে তাদের তোমার বেঁচে থাকার খবরটা দিয়ে দিচ্ছি তাদের!
বিপুল একই সাথে অবাক ও হতভম্ভ! আপনি বাংলা জানেন?
আমি বাঙালি
তাহলে এমন অদ্ভুত সাজে কেন আপনি?
 আমার নাম আসমা বেগম, বেনারসের বিখ্যাত গায়িকা, নামকরা বাইজী!
বিপুল অবাক হয়ে দেখতে থাকে আসমা কে!

সুলেমান! সুলেমান! আসমা ডাকে তার এক খিদমৎগার কে!
জী ! কৃশকায় এক বুড়ো এসে দাঁড়াল!
উস লড়কে সে উসকা পতা লো, অউর উসকে ঘর যাকে খবর দো কি ও জিন্দা হ্যা!
জী মালকিন!
তখলিয়া!
সুলেমান চলে গেল, আসমা যাওয়ার আগে বলল বিপুল তুমি সুলেমানের সাথে যাও! আমি আসছি পড়ে দেখা হবে!
বিপুল এত সুন্দরী নারী আগে দেখেনি, দুচোখ ভরে দেখছে তার চলে যাওয়া!

১৩

 কি দেখছ বাবা ? বাবার পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল তিতিন, অবিনাশ বাবু তখন প্রকৃতির রুপে বুঁদ হয়ে আছেন!
গঙ্গার শোভা , প্রকৃতি কি সুন্দরী রে মা!
হটাৎ বিভাবরী অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করল!
বাবা! তোমার কোনদিন জানতে ইচ্ছে করেছে বিভাবরী কোথায় হারিয়ে গেল?
অবিনাশ বাবু মেয়ের দিকে ঘুরে দেখলেন। মানে?
মানে কোনদিন ইচ্ছে হয়নি তোমার জানতে যে কোথায় হারিয়ে গেল তোমার সেই ঠাকুমা!
নারে ! কি করে জানব? দাদু কে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোনদিন বলেনি ,বাবা যা জানত বলেছে! তাও যতটুকু তার ঠাকুমা তাঁকে জানিয়েছিল ততটুকু!!!
আমার জানতে ইচ্ছে করে, আগেও করত খুব, সে কোথায় হারিয়ে গেল, যার নাম আমার আজকের পরিচয়! তোমাদের পুরনো বাড়িতে অনেকের ছবি দেখেছিলাম, শুধু তার ছবিটাই মিসিং! আমার যে কি ইচ্ছে করত কি বলব!
জানো বাবা তখন আমি কলেজে, আমাদের পুরনো বাড়ি ভাঙার কাজ চলছিল, মনে আছে তো তোমার? আমরাও গেছিলাম কলকাতা থেকে কয়েকদিনের জন্য! হটাত একদিন চিলেকোঠার তালা লাগানো ঘরে একটা ছবি আর বেশ কিছু টুকিটাকি পাই  তখন তো ওই ঘরটা খুলে দেওয়া হয়েছিল! ছবি টার ফসিল পেয়েছিলাম বলতে পারো! অতদিনের পুরনো ছবি! তবু বুঝেছিলাম ছবি টা কার! নোংরা জিনিসে ঠাসা ঘরে ওটাই একটা রত্ন আবিষ্কার করেছিলাম!!!!

মেয়ের মুখে দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে অবিনাশ বাবু!!
অস্ফুটে বললেন কাকে খুঁজছিস তুই তিতিন?



১৪

মেরে সাথ চলো আসমা, ইশক্ হ্যা মুঝে তুমসে! নিজের দুটো হাত দিয়ে আসমা বেগমের দুটো হাত চেপে ধরলেন আওয়াধের নবাব! মেরে হারেম কি মলিকা বনোগি তুম! তুমহারি আওয়াজ অউর খুবসুরতি ভা গই মুঝে! চলো আসমা!
নওয়াব সাহাব ইস বন্দি নে অপনা সবকুছ গীত অউর সুরো কে নাম লিখ দিয়া!
মুঝে মাফ কিজিয়ে!
ম্যা ইন্তেজার করুঙ্গা তুমহারে ইকরার কা আসমা!
মুচকি হেসে মালকোষ ধরল আসমা বেগম, গভীর রাত আরও মায়াবী হয়ে উঠল সুরের মূর্ছনায়!!

বিপুলের চোখে ঘুম নেই! তাড়া করে ফিরছে বিপ্লবী মন তাকে! তবু কেন সে যেতে পারছে না বারানসি ছেড়ে! সে কি মৃত্যুভয়ে? নাকি অন্য আরেকজন বাসা করেছে তার বিপ্লবী মনে!

গভীর রাতে মজলিশ শেষ হলে আসমা বেগম তার কোঠির সামনে ঘোরা গাড়ী থেকে নামতে গিয়ে দেখেন, একটা ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে তার দুতলার ছাদে!!!
ছায়ামানুষ কে চিনতে পেরে কোন অজান্তে হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে! ধীরে ধীরে কোঠি ভিতরে ঢুকে পড়লেন তিনি!
একে একে আসমা বেগমের খোলসটুকু শরীর থেকে নামিয়ে সাধারণ এক রমণীর বেশে ছাদে গিয়ে দেখেন যার খোঁজে তার উপরে উঠে আসা সে তখন ও ওখানেই আছে!
কিছু হয়েছে বিপুল?
বিপুল তখন ছাদের কোনে দাঁড়িয়ে বারানসির অন্ধকার গলি দেখছে, উপরে খোলা আকাশের চাঁদ তখন দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অভিসারি মনের খেলা দেখছে!
না! এমনি দাঁড়িয়ে, ঘুম আসছিল না তাই উপরে এলাম!
আচ্ছা! তোমার বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?
হ্যা ভালো আছে, তবে ওদের জানিয়ে দিয়েছি যেন কাউকে না বলে আমি বেঁচে আছি!
তাহলে তোমার দলের কাজ?
ওরাও তো জানে আমি মৃত! আমি খুব অস্থির আসমা! কি করব বুঝতে পারছিনা!
কেন বিপুল? শরীর খারাপ লাগছে? কবিরাজ মশাই কে খবর দেব কি?
না! আসলে আমি তো বিপ্লবী, বিপ্লবের জন্যে এ জীবন উৎসর্গ ছিল, কিন্তু আজ তো এ মনে অন্য কিছু বাসা করছে, এই নতুন আমি কে তো আমি চিনি না! এটাই আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে!
স্রোতের টানে ভেসে চল বিপুল, জীবনের স্রোত তোমাকে যে ভাবে ভাসাবে সে ভাবে ভেসে যাও তুমি!
 আমিও তাই চাই আসমা!
তবে নিজেকে সামলাও বিপুল! স্রোত কে বয়ে যেতে দাও! ভেবো না নীচে চল, ঠাণ্ডা পড়ছে একটু একটু, কার্ত্তিক মাস, চোরা ঠাণ্ডা লেগে যাবে, চল
পিছন ঘুরে আসমা নামতে গেলে, বিপুল বলে ওঠে, আমার জীবনের সেই স্রোত যে তুমি আসমা! আমার বিপ্লবী মন আজ প্রেমিক মন হয়ে শব্দ তোমার জন্য!

বিপুল! আড়ষ্ট আসমা বেগম , এক পা নড়ার ক্ষমতা টুকু ও লোপ পেয়েছে
যেন! কি শুনল সে? বিপুল কে তার ও পছন্দ! সে কোন ছোটবেলায় একজন কে ভালবেসেছিল, সেও তো কোথায় হারিয়ে গেছিল একদিন, তারপর যারা এসেছে তারা সবাই শরীরের লোভে! কিন্তু বিপুল অন্যরকম বুঝেছে আসমা! বিপুলের সাথে যখন কথা বলে, সমস্ত কথা তার অন্তর কে ছোঁয়! ভাললাগায় ভরে ওঠে সে মন! আসমা তার মনকে আরও লাই দেয়, আরও অনেক কথা সে শুনতে চায় বিপুলের কাছ থেকে! কিন্তু আজ যা বলল বিপুল সে তো স্বপ্নাতীত মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল সে। বিপুল এসে জড়িয়ে ধরল তার দু বাহুর বেষ্টনী তে!
আমি তোমাকে ভালোবাসি আসমা! আমরা কি পারিনা নতুন করে একটা জীবন শুরু করতে!
পারি বিপুল পারি পারি পারি ! আসমা বেগমের দামী চোখে চক চক করছে অশস্রুবিন্দু!
সেদিন খোলা আকাশের নীচে, দুজন প্রেমে কাতর মানুষের দু ঠোঁট এক হয়ে মিশে গিয়েছিল ! আর তার সাক্ষী থেকেছিল কয়েক জোড়া রাতচরা পাখি, চাঁদ, তারা, আর ছাদের শিরশিরে হাওয়া! 
আর সেই অন্ধকারের বুকে চিরে সিঁড়ি নিঃশব্দে দিয়ে নেমে গিয়েছিল একটা কৃশ ছায়ামূর্তি!

১৫
বেনারসে আজ তৃতীয় দিন সকাল থেকে কোথায় যে গেল তিতিন টা! অচেনা শহরে কোথায় ঘুরছে কে জানে! কিছু বললেই বলবে বাবা! কিছু হবে না! ও কি করে বুঝবে বাপ মায়ের কত চিন্তা থাকে সন্তানের জন্য!
আচ্ছা তিতিন ঠিক খুঁজতে এসেছে? কি চাইছে তিতিন? ওকে কি বলব গল্পটা, যেটা ওর জানা হয়নি! নাকি কবর খুঁড়ে সে স্মৃতি না বের করাই ভালো? কিন্তু ও তো এই পরিবারের মেয়ে, ওকে জানানোটা উচিৎ! ও যে কাল বলছিল একটা ছবি পেয়েছিল আগে তো কোনদিন বলেনি?  কোথায় সে ছবি? ছোট থেকে বড় হয়েছে পুরনো বাড়িতে চিলেকোঠার ঘর টা কোনদিন খোলা হয়নি! কোন মুঘল যুগ থেকে বন্ধ, কারুর কি ইচ্ছাও হয়নি খোলার?নাকি সকলে মিলে ও ঘরেই আটকে রাখতে চেয়েছিল অবাধ্য মেয়ের স্মৃতিকে! যাকে ওরা কেউ আটকাতে পারেনি!!
মাথার মধ্যে কিলবিল করছে পুরনো ভাবনা গুলো! সেই সমস্ত ভাবনার জাল ছিঁড়ে মুঠোফোন বেজে উঠল অবিনাশ বাবুর!
হ্যালো
ওপাশে তিতিনের গলা হ্যালো বাবা
হ্যা বল্
তুমি ৫ টা নাগাদ দশস্বামেধ ঘাটে চলে এসো, গাড়ী পাঠিয়ে দেব, সন্ধ্যে আরতি দেখে ফিরব।। এখন রাখছি!
কিন্তু তুই আছিস কোথায়?
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ওখান থেকে একটু লাইব্রেরি হয়ে মণিকর্ণিকা ঘাটে যাব! লাঞ্চ করে নিও! আমি আমার এক বন্ধু সুপ্রতিম কে পেয়েছি এখানে! এখন       ওর সাথেই আছি! কে সুপ্রতিম এসে বলব! টাটা
আচ্ছা! খুট করে কেটে গেল লাইন!
অবিনাশ বাবু রুম থেকে হোটেলের রেস্তোরাঁ তে ফোন করে খাবারের অর্ডার করে দিলেন!


১৬

আসমা তুমি এত ভালো বাংলা কি করে বল,আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে! বিপুল জিজ্ঞেস করল?
বিপুল আমার তোমাকে কিছু জানাবার আছে , আসমা বিপুলের হাতের আঙ্গুলগুলো নিজের হাতে গুঁজে নিল!
বল না! আমার তোমাকে জানতে ইছে করে খুব!
বিপুল আমি বারানসির নওাব,জমিদারদের কাছে আসমা বেগম, কিন্তু আমার আসল নাম বিভাবরী! বীরভুমের বীরপুরে আমার বাড়ি, বাবা সেখানকার জমিদার ছিলেন, আমরা তিন ভাই বোন! আসমা বলে চলে তার গল্প!
বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে সে গল্প শোনে বিপুল মাঝে মাঝে গল্প থেমে গেলে বলে ওঠে কি হল বল তারপর! বল কি হল!
আসমা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে বিপুলের দিকে আর বলে চলে তার জীবনের গল্প!
অনিকেতের কি হল আসমা? জিজ্ঞেস করে বিপুল
জানো আমি বিয়ে করব না বলেছিলাম বাবার পছন্দের ছেলেকে, আমার উপর শুরু হয় প্রবল অত্যাচার! তখন কেউ সন্দেহ ও করেনি আমার প্রেমিক অনিকেত, বিদায় দেওয়া হয়েছিল আমার গানের শিক্ষক কে, বন্ধ করে দিয়েছিল আমার বাইরে বেরনো! মার  শাসানি, দাদার কটূক্তি, বাবার পাথরের দৃষ্টি  আমি আর পারছিলাম না সহ্য করতে! অনিকেত কে বললাম, ও আমাকে বলল, একটা দিন ভাবার সুযোগ দাও, ঠিক করি কোথায় পালানো যায় এখান থেকে! সেদিন দুপুরে ওর সাথে শেষ দেখা আমার! আর কোনদিন আমাদের দেখা হয়নি, মাকে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, আত্মীয়ের বিয়েতে গেছে, শীগগির ফিরবে! সে ফেরা আজ ও ফেরেনি!
তারপর?
আমার উপর অত্যাচার বেড়ে চলছিল। শেষ যেদিন আমার হাত থেকে গানের খাতা নিয়ে মা ছিঁড়ে ফেলল, ঠিক করেছিলাম আর না কিছুতেই না!সেদিন রাতেই ঘর ছাড়ব ঠিক করলাম, সেদিন বিধাতা ও আমার সাথে ছিলেন বুঝি সে রাতে আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়ল, আর আমি ও ফাঁক বুঝে পিছনের দরজা দিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম!
গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে দেখছে বিপুল আসমার দিকে তাই দেখে হেসে ফেলল আসমা!
কি হল বিপুল, কি দেখছ অমন করে?
তুমিও তো বিপ্লবী আসমা, দেশ মাত্রিকা স্বাধীন হওয়ার আগে অন্তত একটি নারী তো স্বাধীন হতে পেরেছে!রুখে দাঁড়ানোটাই তো বিপ্লব!
মাথা নিচু করে ফেলল আসমা!
আসমা লজ্জা পেয়েছে দেখে, দু হাতে ওর মুখ টা তুলে ওর গালে ঠোঁট রাখল বিপুল, লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল আসমা!
ছাড়ো! কেউ চলে আসবে!
আলতো হেসে আসমা কে বিপুল জিজ্ঞেস করল, এখানে কি করে এলে?
পালিয়ে কলকাতা চলে আসি, এসে বুঝতে পারি বাড়ীর বাইরে জীবন টা মোটেই সুখকর না, একদিন কিছু দুর্বৃত্তের হাত থেকে বাঁচতে এক মুসলিম বাড়িতে আশ্রয় নিলাম, নিঃসন্তান দম্পতি আমাকে বুকে তুলে নিলেন, ওরাই আমার নাম রাখে আসমা, ওখানে আমি উর্দু ও শিখি!কিন্তু দুর্ভোগের কপাল পিছু ছাড়ল না! একদিন  ওঁদের এক আত্মীয় বেড়াতে এসে আমাকে দেখলেন,আমি গান গাই জানতে পেরে ওঁদের বললেন আমাকে গুরু ধরে গান শেখাবেন তাই বারানসি নিয়ে এলেন, বললেন মাস দুয়েকের মধ্যে আবার ফিরিয়ে  দিয়ে যাবেন!আজ ৫ বছর এখানে আমি! আমাকে বারানসি তে হিরাবাই এর হাতে এক লক্ষ টাকায় বেচে দিলেন সে আত্মীয়! পরে আমার সেই মুসলিম বাবা মার খবর নিয়েছিলাম, কিন্তু ততদিনে ওরা কেউ বেঁচে নেই আর!!
হুম! চল না আসমা আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করি, নতুন একটা সংসার! যাবে  আমার সাথে?
সত্যি বলছ ! আমি যাব তোমার সাথে, যেখানে বলবে!
তবে কাল চল, কাল মাঝ রাতে আমরা বারানসি ছাড়ব! পরেরদিন সকাল হবে নতুন একটা জায়গায়, যেখানে আমি স্বামী আর তুমি স্ত্রী হবে! বিভাবরী, আসমা না নতুন নাম দেব আমি তোমার, ‘অনুপমা’!
অনুপমা! আমি অনুপমা! ঘুরে ঘুরে নেচে উঠল  আসমা!
তখনই বাইরে থেকে ডেকে উঠল সুলেমান!
মালকিন! আওয়াধ কে নাওয়াব আপকি এক নজর কি খোয়াইশ ফরমায়ে হ্যা!
উনসে কহ দো হম বিমার হ্যা!
জী মালকিন!
বিপুল কাল না আজ রাতে পালাব আমরা! খুব বিপদ আমাদের!
কিসের বিপদ!
আছে! তুমি তৈরি থেকো আজ রাতে, আমি এখন আসছি!
কোথায় যাচ্ছ!
এসে বলব, তুমি সব গুছিয়ে নিও!
ঘরের বাইরে বেড়িয়ে হাঁক দিল সুলেমান! সুলেমান!

১৭
 সন্ধ্যা টা কি সুন্দর তাই না বাবা?
 হ্যা রে! সারাদিন কি করলি?
 কিছু না বাবা বললাম না বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলাম সেখানে সুপ্রতিমের সাথে দেখা আমার কলেজের বন্ধু, এখানে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক, আমার রিসার্চের ব্যাপারে বলাতে বলল কিছু সাহায্য করতে পারে ও!
আচ্ছা! তোকে একটা কথা বলব বলব করছিলাম জানিস!
 কি বাবা?
আমার সেই বিভাবরী ঠাকুমার ব্যাপারে!
উচ্ছসিত হয়ে উঠল তিতিনের চোখ মুখ বল বাবা!
বলব আগে আরতি টা হয়ে যাক!
আচ্ছা!
সন্ধ্যারতির ঘোরে তিতিনের মনে হচ্ছে, এসব ওর সাথে আগেও হয়েছে, এমন তো মাঝে মাঝে সবার সাথেই হয়, কিছু কিছু মুহূর্তে মনে হয় এসব আমার সাথে আগেও হয়েছে! তিতিনের শরীরে মনে ধূপ ধুনোর আবেশ! চোখে লেগে আছে কোন এক সুদূর অতীতের আহ্বান! মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল অবিনাশ বাবু সামলে নিলেন!
তুই ঠিক আছিস?
 হ্যা! অদ্ভুত একটা ঘোর লেগে গেছিল !
আয় এখানটাতে বসি, একটা ফাঁকা চাতাল মত জায়গায় গিয়ে বসল দুজনে!
এই নে একটু জল খা!
ঢকঢক কিছুটা জল খেয়ে এখন একটু ভালো লাগছে তিতিনের!
বল বাবা কি বলবে বলছিলে!
 জানিস তিতিন তোকে যেটা বলা হয়নি তা হল, বিভাবরী বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছিলেন, বাবার ঠাকুরদা জমিদার নারায়ন চৌধুরী লুট হয়ে যাওয়া সমস্ত টাকা পয়সা ফিরে পেয়েছিলেন, ডাকাতরা ধরা পড়েছিল, ম্যাজিস্ট্রেট কে তারা জানিয়েছিল, তারা কোন মেয়ে কে নিয়ে যায়নি!
অবাক হয়ে শুনছিল তিতিন, তারপর?
তার আগে যে ঘটনাটা হয়েছিল সেটা আগে শোন।
জমিদার নারায়ন চৌধুরী জানতে পেরে গেছিল যে অনিকেত-ই তার সেই শ্ত্রু যে তার মান সম্মান নিয়ে খেলছে, তাই একরাতে অনিকেতের ঘরে বাইরে গিয়ে দারালেন,অনিকেত ভাবল বুঝিবা বিভাবরী, দরজা খুলতেই স্বয়ং মৃত্যু কে দেখল! অনিকেত কে মেরে সে রাতেই বাগানে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল,
যোগমায়া দেবী সব জানতেন উনি মেয়ে কে বললেন অনিকেত আত্মীয়ের বিয়েতে গেছে! ভেবেছিলেন কিছুদিন পরে মেয়ে ভুলে যাবে, কিন্তু একরোখা জেদি মেয়ে বাবার আত্মবিশ্বাস নড়িয়ে দিয়েছিল, কি করে সহ্য করতেন যে ওনার রায় বাহাদুরের পথের কাঁটা ওনার নিজের সন্তান!! অসম্ভব অত্যাচার শুরু হল বিভাবরীর উপর, যে রাতে ডাকাত পড়ল বিভাবরী পালালো!
তারপর?
তার আর পর নেই! জানিস তোর নাম কেন বিভাবরী?
না!
জমিদার নারায়ন চৌধুরীর কানে অনিকেতের কথাটা যে তুলেছিল সে তোর ঠাকুমা! এই অপরাধবোধ তাঁকে সারাজীবন কুঁড়ে – কুঁড়ে খেয়েছিল, তার ইচ্ছে ছিল আমার যদি মেয়ে হয় তার নাম যেন বিভাবরী রাখি!
হাল্কা একটা ঠাণ্ডা হাওয়া আছড়ে পড়ল ওদের উপর! দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ, মৌনতা ভাঙল তিতিন-ই
কার্ত্তিক মাস পরে গেছে বাবা?
বোধ হয়! হাল্কা ঠাণ্ডা পড়া শুরু হয়েছে!


১৮
তুমনে মুঝসে ঝুট বোলা আসমা! ইয়ে জুররাত তুমহারি, নাওাবের পাশে তখন মুচকি মুচকি হাসছে সুলেমান!
ম্যা উসসে প্যার করতি হু! আপকো মুঝসে শিকায়াত হ্যা! উসে ছোড় দিজিয়ে!
নওয়াবের অট্টহাসিতে কেঁপে উঠল বারানসির বুক! কেঁপে উঠল বিধাতার বা চোখের পাতা!
সুলেমান আল্লাহ তুঝে দোজখ মঞ্জুর করে!
শেষ এই কথাটা বলতে পেরেছিল আসমা বেগম, তারপর? তারপর বুকফাটা আর্তনাদ বেজে উঠেছিল বাইজিদের মেহফিলে সারেঙ্গীর মনখারাপ করা সুরে!


সকাল ৭ টা হবে, সুপ্রতিমের ফোন! উম্ম বল! তিতিনের ঘুম জড়ানো গলা!
ঘুমাচ্ছিস? পারলে ১১ টার পর দেখা কর, তোর রিসার্চের কিছু জিনিস জোগাড় করেছি!
উম্ম আচ্ছা! এখন রাখলাম! ফোন টা কেটে তিতিন জুবুথুবু হয়ে শুয়ে পড়ল!

বেলা এগারোটা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সুপ্রতিম অবিনাশ বাবু আর তিতিন!
কোথাও একটু বসা যাক না সুপ্রতিম বলল
হ্যা নিশ্চয়! কফি শপে বসি চল! তিতিন বলল
একটা কফি শপে বসল তিন জন! তিন কাপ কফি অর্ডার করলেন অবিনাশবাবু
সুপ্রতিম বলা শুরু করল বিভাবরী ১৮৫৭ এর এবং তারপরের বারানসি তে তিনজন বাঙালি গায়িকা বা তথাকথিত বাইজী ছিলেন! এদের জীবনপঞ্জী এখানে পাবি! বলে একটা ফাইল দিল তিতিন কে তার মধ্যে দুজনের ছবি কোথাও পাইনি, অনেক কষ্টে পুরনো বেনারসের ইতিহাস ঘেঁটে কয়েকটা জিনিস পেয়েছি এবং ছবি পেয়েছি!
সুপ্রতিমের কথা গুলি মন দিয়ে শুনছে তিতিন আর অবিনাশবাবু
আমি একটা অবাক করা জিনিস দেখে কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি জানিস
 কি রে? তিতিন সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল!
পরে বলছি আগে নোটস্ গুলো দ্যাখ!
 তিতিন পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক্তার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে সুপ্রতিম কে, আর সুপ্রতিম উত্তর দিয়ে যাছে প্রত্যেকটার!
ততক্ষণে  কফি এসে গেছে , গরম কফি তে চুমুক দিতে দিতে তিতিন সর্বশেষ গায়িকার কথা জিজ্ঞেস করল সুপ্রতিম কে,
আসমা বেগমের ব্যাপারে খুব একটা কিছু পাইনি জানিস! কেন বলতো!
 দ্যাখ বিভাবরী, এই একটি মহিলার জীবন রহস্যে ঢাকা পুরো! জমিদার বাড়ীর মেয়ে,  বিখ্যাত বাইজী তখনকার দিনের, লক্ষ টাকা ভেট ছিল তার গানের! অপরূপ সুন্দরী, পর্দানশীন এই মহিলা হটাৎ এক রাতে উধাও হয়ে যায়! এখানকার জনমত বলে এঁকে দশাশ্বমেধ ঘাটের উপর মৃত পাওয়া গেছিল, ওর চাকর সুলেমান কে ওর বাড়ীর ছাদের উপর মৃত পাওয়া যায়, আর পাওয়া যায় আরেকজন  তরুণের  মৃতদেহ, তার পরিচয় জানা যায়নি!
অবিনাশবাবু আর তিতিন একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখেন!
অবিনাশবাবু বলেন আসমা বেগমের বাড়িটা কোথায়, যদি একবার দেখা যেত, এত রহস্য যাকে নিয়ে,
হাসল সুপ্রতিম, বলল, আপনাদের হোটেলটা, যেটাতে উঠেছেন সেটা ওর বাড়ী ভেঙে হয়েছে! লোকে বলত বাড়িটা নাকি ভূতুড়ে হয়ে গেছিল ওর মৃত্যুর পর!
বাবা- মেয়ে অবাক হয়ে উঠছে অতীত বর্তমানের যোগসূত্র পেয়ে যাচ্ছে যেন!
এখনো কিছুটা অন্ধকার হাতড়ানো বাকি ছিল বোধহয়!  তিতিন বলল, আমি ওর কোন ছবি খুঁজে পায়নি জানিস
 আমি পেয়েছি এবং সেটা অনেক কষ্টে এখানকার অনেক লাইব্রেরি খুঁজে।। দেখলে তুই অবাক হয়ে যাবি! সুপ্রতিম বলল!
পকেট থেকে একটা হলদেটে ছবি বের করল, কালো ছাপ ধরা, সুপ্রতিম বলল এই দ্যাখ!
তিতিন আর অবিনাশ বাবু দেখলেন ছবিটা, যে ছবি টা তিতিন দেখেছিল সেটা এটা না !অবিনাশ বাবু তিতিন বাকরুদ্ধ, সুপ্রতিম বল যাছে  অবাক হলেন কাকু? আমিও তাই হয়েছিলাম! এটা অতীতের বিভাবরী মনে হচ্ছে, কি অদ্ভুত মিল দুজনের চেহারায়!
কোন এক অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে তিতিন, অতীতের আয়নায় নিজেকে দেখছে অ!শুনতে পাচ্ছে যেন দূরে কোথাও ঠুমরী, গজল গাইছে এক নারী কণ্ঠ! মজলিশের ঝলমলানি, খিলখিল হাসি আর তারপর তীব্র একটা চিৎকারে চারপাশ চুপ!
চোখ খুলে দেখে ও হোটেলের বিছানায় পাশে বাবা আর সুপ্রতিম,
চোখ খুলেছে কাকু
তিতিন তুই ঠিক আছিস তো?
হ্যাঁ বাবা!
কি হয়েছিল কি তোর?
কি জানি মাথাটা ঘুরে গেছিল একটু
আচ্ছা! এবার উঠে বসে কিছু খা!
সুপ্রতিম বাবা তুমি যা করলে আমাদের জন্য! অবিনাশ জড়িয়ে ধরলেন ওর হাত টা
কি যে বলেন কাকু!
আচ্ছা এখন আসি আমি,চলি বিভাবরী!
সুপ্রতিম আমরা আর দুদিন আছি কাল পরশু কাঁটা না আমাদের সাথে, একটু বেনারস টা ঘুরিয়ে দেখাস!
ওকে ম্যাডাম, বলে চলে গেল সুপ্রতিম!
রাতে ডিনারের পর অবিনাশ বাবু বললেন  আমার ছেলেটাকে খুব ভালো লেগেছে, এমন জামাই যদি পেতাম! তিতিন একবার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে বলে দেখ যদি রাজি হয়! আমি ঘুমাতে গেলাম
আবার ওনাকে অবাক করে দিয়ে তিতিন চলে গেল, উনিও ঘরে গিয়ে শুয়ে শুয়ে সকালে দেখা ছবিটার কথা ভাবতে লাগলেন! তবে কি ২০০ বছর আগে ছেড়ে চলে যাওয়া পরিবারের টানে এই ফিরে আসা? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন অবিনাশ বাবু!

ঘরে ফিরে তিতিন ফোন করল সুপ্রতিম কে
হ্যালো সুপ্রতিম
হ্যাঁ বল বিভাবরী!
তোর সাথে কথা আছে সু
আজ বহু বছর পর বিভাবরী ওকে সু বলে ডাকল! সেই সম্পর্কের সময় ওকে এমন ভাবে ডাকত, আজ ও ভিতরের কষ্টটা চেপে রাখা আছে, সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়া মানতে পারেনি সুপ্রতিম
বল কি বলবি বিভাবরী
তুই আমাকে আজ ও ভালবাসিস সু? সেই আগের মত?
 চমকে ওঠে সুপ্রতিম, কি হয়ছে তোর?
বল্ না সু, ভালবাসিস আজো?
হ্যাঁ বাসি!
বিয়ে করবি আমাকে?
তুই মজা করছিস নাতো বিভাবরী?
না!
করব বিয়ে তোকে খুব ভালবাসি আমি!
কাল বাবা কে বলবি আমাদের কথা টা প্লিজ!
বলব, আমি আজ খুব খুশি রে!
জানিস তোকে আজ একটা নতুন নাম দিতে ভারী ইচ্ছে করছে
কিরে সু?
‘অনুপমা” আমার অনুপমা!
কাল সকালে আসছি তোকে নিতে।
উম্ম! শুভরাত্রি! সু
শুভরাত্রি! অনুপমা

ও কাল সুপ্রতিম কে বলবে বিয়ের পর ও বেনারসে থাকবে আর কোথাও যাবে না ! রাতের আদুরে আকাশ  ভেসে যাচ্ছে মালকোশ রাগের মূর্ছনায়, এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর বিভোর হয়ে গেয়ে ওঠে ‘নির ভরণ ম্যা তো চলি জাতি হুঁ, বিচ ম্যা মিল গয়ে নন্দ কি ছৈলবা’!!!