কৈসে যাওব
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
বাতাবাড়ি, রাজর্ষিদার সাথে। রাজর্ষিদা বরানাগরিক। মন যদিও সায় দিচ্ছিল না যেতে। মন বলছিল আসবে, ফোন। শকুন্তলার। তাও যাওয়া হল। কদমতলা গার্লসের সামনে থেকে বাস ধরে বাতাবাড়ি ফার্ম মোড়। ঘণ্টা দেড়েক। সকালের বাকি ঘুমটুকু বাসে পুষিয়ে নিয়ে যখন মাথা চুলকোতে চুলকোতে নাবলাম বাস থেকে, তখন দেখি, সামনে লেখা জায়গাটার নাম, মাথাচুলকা। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে যে সাইকেল ভ্যানটায় উঠলাম, তাতে সিমেন্ট, রড এসবও আছে। প্যাসেঞ্জার, মোরা দুজনায়। বারেবারে ফোনটা দেখে যাচ্ছি। শকুন্তলার ফোন এলো না। প্রায় আধ ঘন্টা দুলতে দুলতে গিয়ে পৌঁছলাম, লতিফ ভায়ের বাড়ি। রাজর্ষিদার মুখে এই নামটা শোনা ইস্তক মাথায় ঘুরছে একটাই শব্দ, বীফ। ভ্যান থেকে নেমে, রাস্তার ঢালু দিয়ে লতিফ ভায়ের বাড়ির দিকে যেতে যেতে, এই শব্দটাই মাথায় ঘুরছিল আবার। আর, স্যালাইভাতেও। যাই হোক, ব্যাগপত্তর রেখে আমরা যাচ্ছি সেই বহুশ্রুত জায়গাটা দেখতে। যেখানে অদূর ভবিষ্যতে একটা লিটল ম্যাগাজ়িন লাইব্রেরি হবে। একটা ফ্রি স্কুলও। মোট দেড় বিঘে জমি। মিউটেশনের কাজ চলছে। জায়গাটার তিনদিকে খুঁটি পুঁতে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এখানে হাতি আসে খুব। একটা খুঁটি ভেঙে দিয়ে গেছে ক’দিন আগে। একপাশ দিয়ে লাগানো হবে দেড়শো সুপুরি গাছ। তার ফাঁকে ফাঁকে ঝাউ। গেটের সামনে দুটো রাণিচাপ। বর্ষায় জল উঠে আসে ষোড়শী তণ্বীর মতো ঐ নদীটা থেকে। তাই বোল্ডার ফেলা হচ্ছে তার পাড় ঘেঁষে। পাশেই লাটাগুড়ি ফরেস্ট। অনেক চা বাগান। চা বাগান দেখেই, আমার আবার মনে পড়লো, শকুন্তলার কথা। ক’দিন আগেই আমি আর শকুন্তলা সুকনা ফরেস্টে গেছিলাম। সেখানে ওর খুব ইচ্ছে করছিল জঙ্গলের ভেতরে হারাতে। ডুয়ার্সের জঙ্গলের মতো এত মায়াবী জঙ্গল আর কোথাও কি আছে! চুপ করে কান পেতে আমরা শুনতে থাকি জঙ্গলের শব্দ। সে যেন তার নিজের খেয়ালে আছে। নিঃশ্বাসে একটা বুনো চাপ চাপ গন্ধ। নাক থেকে ফুসফুস, গোটা স্নায়ুতে সেই গন্ধটা ছড়িয়ে যেতে থাকে। আসার সময় আমাদের অটোটা থেমেছিল সুকনা স্টেশনের কাছে। ছোট্ট স্টেশন। ছবিতে এরকম দেখা যায়। জঙ্গল এই জায়গাটার মনটাই যেন অন্যরকম করে গড়ে দিয়েছে। শকুন্তলা স্টেশনের ছবি তুলছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আর হাওড়া স্টেশনের স্টেশন মাস্টার দুজনেই এক পদে চাকরি করেন, তবু দুজনের জীবন কতটা আলাদা। আমরা দুটো চা বাগানের মাঝখানে বসে ছিলাম। রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে। ও শুয়ে ছিল আমার
কোলে মাথা রেখে। কি কথা বলছিলাম আমরা তখন? মনে পড়ছে না। ছবিটা ভাসছে। আমি খুব ছবি তুলছিলাম, ওর ক্যামেরায়। বিকেল হতেই ও বলছিল,
— তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, এখানে সন্ধ্যের পরে হাতি বেরোয়।
একটা জলের ফোঁটা হঠাৎ যেন পড়লো আমার হাতে।
— বৃষ্টি? কিরে? চ’ উঠি।
অনেকটা ভেতরের দিকে এসে গেছি আমরা। বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে সময় লাগবে। তাই পা চালিয়ে। ফোঁটা আর পড়ছে না, তবুও, তাড়াতাড়িই বেশ ঝরাবে মনে হচ্ছে। ধ্রুপদী সঙ্গীত পরিবেশনের আগে ওস্তাদেরা যেমন যন্ত্রগুলির স্কেল ঠিক করে নেন টুং টাং করে বাজিয়ে, বৃষ্টি এখন সেরকম। এখানে ঢোকার সময় একটা ব্রিজ পেরোতে হয়েছে। ব্রিজটা তৈরি হচ্ছে। নিচের নদীটায় জল ছিল না। আর ব্রিজটায় মাঝেমাঝে কাঠের পাটাতন, কোথাও বেশ ফাঁকা। ফাঁকগুলো বাঁচিয়ে পাটাতনে পা রেখে রেখে ও দিব্যি চলে গেল ওপারে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম মাঝপথে। শুধু ফাঁকগুলোই দেখতে পাচ্ছি। মাথা ঘুরছে। ও হাসছে ওপারে দাঁড়িয়ে। এখন কি করা? পেছনে মিস্ত্রিগুলো নেপালি ভাষায় সাহস দিচ্ছে আমাকে।
— যানুস যানুস, কেই হুন্দেই ন
কিন্তু সাহস এমন একটা জিনিস একবার গেলে আবার চট করে আনা মুশকিল। একটা মিস্ত্রি নিজেই এগিয়ে এলো। আমার হাতটা ধরে পার করে দিল ব্রিজটা। ফেরার সময় মনে পড়লো, এই রে! আবার পেরোতে হবে ঐ ব্রিজটা? এখন তো মিস্ত্রিগুলোকেও পাবো না। বলতেই মাথায় খেললো, আরে! বাঁ-পাশ দিয়েই তো আরেকটা রাস্তা আছে। আমরা ঐ পথটাই ধরলাম। খিদেও পাচ্ছে এবারে। ছবি তুলতে তুলতে ফিরছি আমরা। শকুন্তলা খুব কায়দা করে ছবি তুলতে জানে। লোকজন টেরই পাবে না, ও ছবি তুলে নেবে। আবার কাছে গিয়ে, দাঁড় করিয়েও ছবি তোলে। বিস্কুট আর আলুর চিপ্স কিনে, সুকনা স্টেশনের কাছ থেকে যখন অটো ধরলাম, বৃষ্টি তখন আলাপ ছেড়ে মুখড়া ধরেছে। অটোর পর্দাটা হিমশিম খেয়ে নামালাম আমি আর উলটো দিকে বসা ছেলেটা, দুজনে মিলে। আমি তো ছাতা নিয়ে বেরোই নি। শকুন্তলার সাথে ছাতা আছে। ও আমাকে বলছিলো,
— কেন ছাতা নিয়ে আসিসনি? সবসময় ছাতা নিয়ে বেরোন উচিত।
আমি বেশ জোর দিয়ে বললাম—
— দ্যাখ, আর কেউ ছাতা নিয়ে আসেনি। কেউ তো জানতোই না যে বৃষ্টি আসবে।
আমার কথা শুনে, অটোতে বসা সবাই জানালো তারা ছাতা নিয়েই বেরিয়েছে। দু’একজন ব্যাগ থেকে বের করেও দ্যাখালো। সিটি সেন্টারের সামনে যখন নামলাম দুজনে, বৃষ্টি তখন ঝালায় পৌঁছে গেছে। ও ছাতাটা খুললো, নেমে। আমরা দৌড়ে ঢাউস ঐ বাড়িটার ভেতরে হারিয়ে গেলাম। হ্যাংআউটে বসা গেল না বৃষ্টির জন্য। টেবিলে আমরা মুখোমুখি বসে, আর অঝোরে তখন বাইরে ঝরছে বৃষ্টি। সুনীল গাঙ্গুলি বলতো, আগেকারদিনে গল্প-উপন্যাসে প্রায়ই এরকম একটা লাইন থাকতো, ‘তখন নিয়তি দেবী অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া হাসিলেন’। সেদিন হ্যাংআউটেও বোধহয় তিনি ছিলেন। এবং হাসছিলেন। নইলে কে জানতো, সেদিন রাতেই আমাদের দুজনের তুমুল ঝগড়া হবে! আর শকুন্তলা ভোর চারটের সময় হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে চাইবে!
কিন্তু, তাই বলে বাতাবাড়িতে বৃষ্টি? রাজর্ষিদার গুঁতো খেয়ে তিরতিরে ঐ হাঁটুজল নদীটায় নেমে স্নান করতেই হল। উঠে আসতেই নামল বৃষ্টি। আর বাজ। ওফ্! সে এক দৃশ্য। চারদিকে মাঠ, আর চা বাগান, তার একপাশ দিয়ে নদীটা। নদীর ঠিক পাশেই একটা টং ঘরে আমরা। কুচকুচে আকাশ। এখানেও ছাতা আনিনি। কেউই আনেনি। আমার মনে হচ্ছিল, সব জায়গার বৃষ্টি কি আলাদা? আমার জন্মের সময়ের বৃষ্টি, শিলিগুড়ির বৃষ্টি, বাতাবাড়ির বৃষ্টি, সুকনার বৃষ্টি, সব জায়গার বৃষ্টির মেজাজটাই তো আলাদা। রাজর্ষিদা বলছিলো, শকুন্তলাকে আনলে পারতাম। ওর ভাল্লাগতো। বৃষ্টি একটু থামতে, নেমে এলাম টং ঘর থেকে। লতিফ ভাই, রাজর্ষিদা আর আমি। হাঁটছি। রাতে থাকবো কি থাকব না, এই নিয়ে দোনামনা চলছে আমাদের দুজনের। নাঃ, দুপুরে বীফ জুটলো না। কিন্তু তার বদলে যা জুটলো তাও দারুণ। খেয়ে উঠে আমরা ঠিক করলাম, থাকবোনা। যাব কোথায়? ও যাবে, আলিপুরদুয়ার। শৌভিকদার বাড়ি। আর আমি? আমি কোথায় যাব? জলপাইগুড়িই ফিরে যাই। মন তখনও বলছে আসবে আসবে, ফোন আসবে। শকুন্তলা আজকে শিলিগুড়িতে। জলপাই থেকে শিলিগুড়ি যাওয়াটা সহজ হবে। অবশ্য, যদি শকুন্তলা ডাকে। আর না ডাকলে? তাহলে কালই ফিরে যাব কুচবিহার। কিন্তু, রাজর্ষিদা চাইছে আমাকে আলিপুরে নিয়ে যেতে। বিকেল সাড়ে তিনটে প্রায় তখন। ভাবলাম এখনও যখন ফোন এলো না, তাহলে চলো আলিপুর। তারপরে দেখা যাবে। বৃষ্টি থেমে গেছে। আমরা আবার ভ্যানে চেপে বাতাবাড়ি ফার্ম মোড়। মালবাজারের বাস। মনটা কিন্তু খচখচ করেই যাচ্ছে। মালবাজারে পৌঁছে, রিকশা নিয়ে রেল স্টেশন। স্টেশনের কাছে এসেছি যখন, ট্রেন ঢুকছে। রাজর্ষিদা বললো—
— অর্জুন, যা দৌড়ে টিকিটটা কাট। আমি রিকশা ভাড়াটা দিয়ে আ—
ব্যাগ রইলো ওর কাছেই। আমি নেমে দৌড়। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে আমি, রাজর্ষিদা দু’দুখানা ব্যাগ নিয়ে আধা দৌড় আর দু’পাশে আধা হেলতে হেলতে ঢুকছে। আর ট্রেনও ছেড়ে দিল তখন। দৌড়ে ধরলাম তাকে। আঃ…. পেরেছি। ঝাঁঝা এক্সপ্রেস।
আগের রাতে প্রায় সাড়ে তিনটে অবদি কথা হয়েছে শকুন্তলার সাথে। তারপরে সাত সকালে উঠে বাতাবাড়ি। ঘুম হয়নি তেমন। বাসের ঐ দেড় ঘন্টায় আর কতটুকু হয়! ট্রেনে উঠে জায়গাও পেয়ে গেলাম কপালজোরে, দুজনেই। আমি মালবাজার থেকেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলস্টেশনে, ঘুম। তাও জার্নির সময় যা
হয়, টানা হয়না। যা হয়, ছেঁড়া ছেঁড়া। রাজর্ষিদা একবার বললো,
— শকুন্তলাকে ফোন করে বলে দে ট্রেনে উঠে গেছিস।
— থাক।
ওকে আর বললাম না, সকালের পর থেকে ওর ফোন স্যুইচড অফ। মালবাজার থেকে ট্রেনে আড়াই-তিন ঘণ্টা লাগে আলিপুর যেতে। সন্ধ্যে যখন হব হব, ট্রেনও গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গেছে, অন্য প্যাসেঞ্জারদের মুখ থেকে জানা গেল, আলিপুরে ভয়ানক বৃষ্টি হচ্ছে। ছ’টা নাগাদ নিউ আলিপুরদুয়ারে আমরা নেমে দেখলাম, বৃষ্টি তখন চলে গেছে। সে যে এসেছিল, তার চিহ্ন সর্বত্র। বছর চারেক হল আমি আর ছাতা ব্যবহার করিনা। চার-পাঁচ বছর আগে, এক জুলাই মাসে, ঘোর বর্ষায় আমি বেয়াক্কেলের মতো পরপর ছ’সাত খানা ছাতা হারিয়েছি। শৌভিকদাকে ওর আই-টেন সমেত দেখা গেল একটু এদিক ওদিক করতেই। ওর বাড়িতে ব্যাগ রেখে আমরা চারজনে আবার বেরিয়ে গেলাম। আমি, রাজর্ষিদা, শৌভিকদা আর আই-টেন। রাজর্ষিদাও খুব ভালো গাড়ি চালায়। এখন শৌভিকদাই চালাচ্ছে। পেছনে আমরা দুজন। মদ আর শসা কিনে, কবি সুদীপ মাইতির বাড়ি। শঙ্খবাবু যতই বলুন ‘মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই’, মদের যে কিছু গুণ আছে সে তো মদ্যপায়ী মাত্রেই জানে। বাকিরা শুধু বিয়োগই দ্যাখে। গুণ অঙ্কটা এখনো অনেকেই ভালো করে কষতে পারে না। রাজর্ষিদার সামনে আমি মদ খেলে, ও কাকা আর জ্যাঠার মাঝামাঝি একটা গার্জেন হয়ে যায়। আমি দু’পেগ খেলে, ও বলে, আমি চার পেগ খেয়েছি। আমাদের কবিতা, পান চলতে চলতেই আবার নামলো বৃষ্টি। রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা আড্ডা ভাঙলাম। প্ল্যান হল পরদিন চিলাপাতা যাওয়া হবে। আমি তখনও জানি না, আমি যাচ্ছি না। শকুন্তলার আর ফোন না আসায় আমি ভেবেছি এখান থেকেই কুচবিহার ফিরে যাব। অনেকদিন পর মদ খেয়ে সত্যি মাতাল মাতাল লাগছে। রাতে প্রায় বারোটা নাগাদ ফোন এলো শকুন্তলার। আশ্চর্য হয়ে গেলাম এটা জেনে, ওর মনেই নেই কাল রাতে আমরা প্রায় সাড়ে তিনটে অবদি কথা বলেছি। এমন কি আজ সকালেও যে আমি বাসে ওঠার একটু পরে, ন’টা নাগাদ ও ফোন করেছিল, আমি ওকে বলেছিলাম বাতাবাড়ি যাচ্ছি, সেসবও কিচ্ছু মনে নেই। ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু ওকে বুঝতে দিলাম না সেটা। শকুন্তলা বললো,
— কাল আসতে পারবি?
আমিও হ্যাঁ বলে দিলাম। রাত তখন আড়াইটে। আলিপুর থেকে শিলিগুড়ি যেতে সাড়ে চার ঘণ্টা তো লাগবেই। সকাল সকাল বেরোতে হলে এখনই শুয়ে পড়া দরকার। কাল শকুন্তলাকে আবার দেখার উত্তেজনা নিয়ে শুয়ে
পড়লাম। শুধু চিন্তা একটাই, আগেরবার গিয়ে উঠেছিলাম শিবমন্দিরের একটা হোটেলে, সোনার তরী। ভালো হোটেল। কিন্তু সেটা ও যেখানে থাকে একদম সেই এলাকায়। ওর বাড়িওলা, পাড়ার লোকেদের কাছ থেকে একটা অন্য দৃষ্টিলাভ হয় এর ফলে। তাহলে? শিলিগুড়ি একেবারেই আমার চেনা শহর নয়। তাহলে ভরসা সুব্রত। আমার বন্ধুই বলা চলে। আমার চেয়ে বেশ বড় একটু বয়েসে। কিন্তু বন্ধুই। এনজেপিতে থাকে। ওর এক বন্ধুর হোটেল আছে মেডিকেলের কাছে। ঠিক হোটেল বলা ভুল, রেস্টুরেন্ট কাম বার। সকাল সকাল উঠে রাজর্ষিদাকে বললাম,
— বেরোচ্ছি, শিলিগুড়ি।
ট্রেনের খোঁজ করে জানা গেল সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ একটা গাড়ি আছে। শৌভিকদার বাড়ির কাউকে না জানিয়েই বেরিয়ে গেলাম। ওরা তখনো ওঠেনি ঘুম থেকে। রাজর্ষিদা আমাকে কিছুটা এগিয়ে দিল। আমি অটো ধরে আবার নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে। কালই সন্ধ্যায় নেমেছিলাম এখানে। স্টেশনে পৌঁছে কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সাড়ে বারোটার আগে ট্রেন নেই। আমি আবার অটো ধরে চৌমাথায়। বাস পেয়ে গেলাম। জায়গাও। রাজর্ষিদাকে এসএমএস করে দিলাম।
শকুন্তলা জলপাইগুড়ি শহরের মেয়ে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে এখন, ভুগোল নিয়ে। পেটে একগাদা খিদে নিয়ে যখন তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যাণ্ডে নামলাম, তখন দুপুর প্রায় বারোটা। নেমেই সুব্রতকে ফোন করলাম। ও আধ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেলের হোটেল মালিকের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে দিল। আমি বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। টেনশনটা গেল। তখন নিয়তি দেবী বোধহয় অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া আবার হাসিলেন। ওখানে গিয়ে ঘর বুক করে শিবমন্দিরে এসে দেখা পেলাম শকুন্তলার। তখন দেড়টা। পেট আর কিছুই মানছে না। জানা গেল দুপুরে আমাদের দুজনের নেমন্তন্ন, নার্গিসদির বাড়ি। যেতে যেতে শকুন্তলা বললো—
— যেখানে যাচ্ছিস সেটা কিন্তু আর্মি ম্যানের বাড়ি। যদি আমাকে কষ্ট দিয়েছিস, তাহলে থানা না পুলিশ না, একেবারে কোর্ট মার্শাল।
নার্গিসদির বর, শামসেরদা, বি.এস.এফ-এ চাকরি করে।
বিকেল বিকেল নার্গিসদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা এদিকে ওদিকে আর সিটি সেন্টারে ঘুরেই কাটালাম। সন্ধ্যেবেলা হোটেলে ফিরে মাথায় বাজ পড়ল। এত দৌড়ঝাঁপে শরীর এমনিতেই ক্লান্ত। জানা গেল, মহিলা নিয়ে থাকা যাবে না। মানে? আমার তো আগে থেকেই বলা ছিল। আমি ভাবলাম, মালিকের সাথে নিশ্চই এদের এখনো কথা হয়নি। আমি কি তখন জানতাম, নিয়তি দেবী আগেই অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে খানিকটা হেসে নিয়েছেন! সুব্রতকে ফোন, মালিককে ফোন। ব্যবস্থা কিছুই হল না। অগত্যা মধুসূদন। সোনার তরী। খোঁজ করা হল আগেরবারের ঘরটা খালি আছে কিনা। ওটা আমাদের দুজনেরই পছন্দ। খালি নেই। অন্য ঘর পাওয়া গেল। আমরা অনেকক্ষণ নিভৃতে কাটালাম, একসাথে। শকুন্তলা ওর নতুন একটা লেখা শোনালো। গত
সপ্তাহে যখন এসেছিলাম, এই হোটেলেই পাশের ঘরে উঠেছিলাম আমরা। শনি-রবি দু’দিন ছিলাম। ভোর অবদি জেগে থাকতাম পাশাপাশি। প্রথম দিন ওকে হোটেলে রেখে রাতের খাবার কিনতে বেরিয়েছি। মটর পনীর, রুটি। আমাকে এসএমএস করে জানালো, চার প্যাকেট প্যানটীন শ্যাম্পু আর ময়েশ্চারাইজ়ারের ছোট প্যাকেট একটা। কিনে নিলাম। আমার নিজেকে বেশ সাংসারিক সাংসারিক মনে হচ্ছিল। ফিরে এসে দুজনে গল্প করছি বিছানায় বসে। একটু রাত করেই খাব আমরা। দুধের মতো ধবধবে সাদা চাদর পাতা বিছানায়। চুমু খেতে গেলাম, বলে কিনা না, হবে না। আমার মুখে নাকি গন্ধ। আগে ব্রাশ করে আয়। ব্রাশ এনেছি, কিন্তু পেস্ট তো আনিনি। রাত দশটায় বেরিয়ে পেস্ট কিনে এনে ব্রাশ করলাম। শকুন্তলা টিভিটা চালিয়ে দিল। যাতে পাশের ঘরে শব্দ না যায়। হোটেলের ঘরে টিভি কি এই জন্যেই থাকে? একই জিনিস যখন যেভাবে কাজে আসে। আদর থামিয়ে ও কবিতা পড়ছে, কবিতা থামিয়ে আদর। এবারে শকুন্তলা রাতে থাকবে না। আর কি যোগাযোগ! এই ঘরে টিভি নেই। ঠিক হল পরদিন আমি প্রদীপের মেসে শিফট করে যাব। প্রদীপ এখানেই থাকে, মেসে। তরুণ কবি। সাড়ে ন’টা নাগাদ বেরিয়ে আমরা ডিনার সেরে নিলাম। ওকে ওর ঘরে পৌঁছে আমি ফিরে এলাম সোনার তরীতে। প্রায় একবছর আগে, গত বছর জুলাই মাসে প্রথম আসি এখানে। সেবার রাত প্রায় এগারোটা অবদি আড্ডা দিয়েছি ওর ঘরে। তার পরেরদিন ভোরবেলা, পাঁচটা নাগাদ, শকুন্তলা হোটেলে হাজির। বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, টিপ টিপ করে। আমি তো চমকেই গেছি। এতো ভোরে! দেখি গেরুয়া রঙের একটা সালোয়ার পরে এসছে। খোঁপা বাঁধা উঁচু করে। বোষ্টমীর মতো লাগছিলো ওকে দেখতে। অত ভোরে হোটেলের লোকগুলোও ঘুমে কাদা। আমি যত ডাকি-
— ও দাদা, ও দাদা, ঊঠুন, গেটটা খুলে দিন।
কে শোনে কার কথা। একবার শুনে ঊঁ—আঁ ক’রে আবার পাশ ফিরে শোয়। শেষে আমাকেই দেখিয়ে দিল বালিশের নিচে চাবি আছে। আমি চাবি নিয়ে গেট খুলে দিলাম। কিন্তু, এবারে যেটা নেই, তা’ হল বৃষ্টি। এবারে সকালে আমরা অনেকক্ষণ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। গতবছর রাতের অন্ধকারে ঘুরেছিলাম। এবারে সকালের আলোর কৈশোরে। আমরা ফুল কুড়াই, ছবি তুলি। আঙুল ছুঁয়ে থাকি। কেউ কাউকে না ছুঁয়ে পাশাপাশি হাঁটলেও শরীরে-মনে একটা লেনদেন হয়। সকালের হাল্কা রোদ মাখা গাছগুলো আস্তে মাথা ঝোঁকায়, অল্প হাসে আমাদের দেখে। কাল ও জলাপাইগুড়ি ফিরে যাবে। আমি কুচবিহারে। পরশু ও যাবে কোলকাতায়, ডাক্তার দেখাতে। ফিরে পিএইচডি আর বি.এড-এর পড়াশোনায়, আমি চাকরির জন্য জি.কে। কিন্তু, ফেরার পথে গল্পটা একটু জলপাইগুড়ি ছুঁয়ে গেল। এয়ারভিউ মোড় থেকে কুচবিহারের কোনো বাস না পাওয়ায় ময়নাগুড়ির একটা বাস ধরে নিলাম। আমরা গোসালায় নেমে যাব। ও রিকশা নিয়ে বাড়ি, আমি বাস ধরে কুচবিহার। বাসে আমরা দুজনেই একটা ভালো জায়গা পেলাম। ও জানলাটা নিল। আমি ওর পাশেরটা। আমাদের দুজনের ঠোঁটই কাতর ও প্রত্যাশী হয়ে ছিল, বোঝা যাচ্ছিল ওর ঠোঁটের তিরতির করে কেঁপে ওঠা
দেখে। গোসালায় নেমে আবার মত পাল্টালাম আমরা। আমি শংকরদার বাড়ি যাব। ও সন্ধ্যে বেলা আসবে দেখা করতে। পরদিন সকালেও আসবে, ট্রেন ধরার আগে।
সন্ধ্যায় শকুন্তলা এলো। সকালেই বেরোবার সময় ও রায়তা করে নিয়ে এসছিলো। আমার ব্যাগে রাখা ছিল সেটা। বের করে নুন দিয়ে ঝাঁকিয়ে ভাল করে বানালাম। বেশিক্ষণ বসলো না। রিমঝিম শংকরদার মেয়ে। সেভেনে পড়ে। ওকে স্কুল থেকে টেবিল ক্যালেণ্ডার আর পেন স্ট্যাণ্ড বানাতে দিয়েছে। তাই নিয়ে বেশ একটা হুলুস্থুল পড়ে আছে বাড়িতে। আমি বারান্দায় বসে সিগারেট খাই, পেপার পড়ি। কিছু মনে এলে খাতায় টুকে রাখি। লেখা হলে বৌদিকে খুব পোলাইটলি বলি—
— ব্যস্ত আছো? একটা লেখা শুনবে?
পরদিন সকালে দশটা নাগাদ আবার এলো শকুন্তলা। বিকেলে ট্রেন ওর। রিমঝিমের হাতের কাজটা করে দিল। যেন ও আগে থেকে জানতো কি করতে হবে। আগে থেকেই যেন ওর প্ল্যান করা ছিল কিভাবে করবে ওটা। ফটাফট করে দিল জিনিসটা। আমি চেয়ারে বসে বসে দেখলাম। তারপরে ছাদে গেলাম আমরা। দুপুর মেঘলা তখন। ও নিভৃতে চাইছিল আমাকে। এ বাড়িতে ছাদের ওপরে ছাদ আছে একটা। অনেক বাড়িতেই থাকে। সেখানে উঠে আবিষ্কার করা গেল একটা ঘরও আছে। হুড়কো খুলে, ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
শকুন্তলার ঠোঁট এখন নতুন জিভের মতো অল্প লাল হয়ে আছে। ও বললো, আমার ঠোঁটও তাই। ছাদের ঘরটা থেকে আমরা বেরিয়ে, নেমে এলাম নিচের বড় ছাদে। রেলিঙে হাতের ঠেস দিয়ে ঝুঁকে আছি দুজনে। এখান থেকে শংকরদার ফ্ল্যাটে ঢোকার গলিটা দেখা যায়, স্পষ্ট। গলির মাথায় রাস্তাটাও দেখা যায় কিছুটা। শকুন্তলা বললো,
— নিচে চল। বৌদি স্নান করে বেরিয়ে ছাদে কাপড় মেলতে আসবে হয়তো।
আমরা তাও আরো কিছুক্ষণ তুলোর মতো লেগে লেগে ভেসে ভেসে বেড়ালাম ছাদের এখান থেকে ওখানে। ওর গলায় ঘাড়ে মুখ গুঁজে ওর গন্ধ মেখে নিচ্ছি। শিবমন্দিরে থাকার সময়, এক রাতে ক্যাডবেরি কেনা হয়েছিল। ডেয়ারি মিল্কের ছোট প্যাকেট পাওয়া গেল না। তাই, অপছন্দের কিটক্যাট। আমি হোটেলের ঘরে ফিরে আসার পর শকুন্তলা বারবার জিজ্ঞেস করছে,
— ক্যাডবেরি এনেছিস?
— না।
— কেন?
— এমনিই… ক্যাডবেরি দিয়ে কি হবে?
— বলনা.. এনেছিস তাইনা?
— না বললাম তো
— ও, আচ্ছা। ঠি-কা-ছে।
আমি শ্যাম্পু, ময়েশ্চারাইজ়ার এগুলো টেবিলের ওপর রাখছি। ও বাথরুমে গেল। এই ফাঁকে আমি ক্যাডবেরিটা আমার ব্যাগে লুকিয়ে রাখলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে, আমার ব্যাগ ঘাঁটতে লাগল। কি করে যেন ঠিক সন্দেহ করেছে। কিন্তু পেলো না। সালোয়ার পালটে শকুন্তলা এখন হাউজ় কোট পরেছে। লাল আর কালো মেশানো। আমাকে বাঁ-হাত দিয়ে ঠেলে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর বাঘিনীর মতো আস্তে আস্তে আমার ওপরে উঠে আসছে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। কামাতুরা সব নারীর চোখ কি এক? যেমন সানি লিওন তেমনিই শকুন্তলা? টিভি চলছে। বোধহয় অ্যানিমেল প্ল্যানেট। টেবিলের ওপর রাখা রাতের খাবার। আমি হাত বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে ক্যাডবেরিটা বের করে ওর হাতে দিলাম। ওর চোখে একটা দুষ্টুমি ঝিলিক দিল। আর ঐ ঝিলিকটাকে চোখে রেখেই খুলে ফেললো কিটক্যাটের প্যাকেটটা। এক টুকরো ঢুকিয়ে নিল নিজের মুখে। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে এলো শকুন্তলার মুখ। জিভ দিয়ে কিটক্যাটের ভেজা টুকরোটা চালান করে দিল আমার মুখে। ঠোঁটের ভেতরে ঠোঁট, জিভের ভেতরে জিভ, আর তার ভেতর দিয়ে কিটক্যাটের একটা টুকরো এ-মুখ থেকে ও-মুখে চলে যাচ্ছে। তারপর মুখ সরিয়ে আয়নায় দেখি, দুজনের ঠোঁটই অল্প লাল অল্প বাদামি। দুজনের চোখেই আদরের ভাষা বরফের মতো ঝরে ঝরে পড়ছে। আমরা হোটেলের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। রাত গভীর হচ্ছে আস্তে আস্তে। রাস্তার বাতিগুলো কি এক অজানা মনখারাপ নিয়ে চুপচাপ ঝুঁকে আছে। দুটো নেড়ি কুকুর এখানে সেখানে রাস্তার ময়লা শুঁকছে। দূরে কোথায় একটা দুটো কুকুর ভৌউউউউউ করে উঠল। নেড়ি দুটো চমকে তাকালো এদিক ওদিক, কান খাড়া ক’রে। আমাদের হোটেলটাও চুপ করে আছে। শকুন্তলা হঠাৎ বলে উঠল—
— কাল আমার ডায়রিতে যেটা লিখে দিয়েছিলি এটা তার উত্তর।
— কাল? কাল কি লিখেছিলাম?
— মনে কর
— কাল… কাল… কাল… কি লিখেছিলাম রে?
— মনে কর মনে কর… তুই-ই তো লিখেছিলি। তোরই তো মনে থাকা উচিত
— আঃ, মনে পড়ছে না তো, বল না—
— তাড়াহুড়ো নেই তো কোনো। পরে মনে ক—
— মনে পড়েছে
— ভালো
— ওটা ভাস্কর চক্রবর্তীর লাইন। ‘সঙ্গে থেকো সঙ্গে থেকো। সবসময় সঙ্গে সঙ্গে থেকো।’
কাল শকুন্তলা বলছিলো, আমরা যদি বাকি জীবনটা হোটেলে হোটেলে কাটিয়ে দিই? আসলে কিন্তু আমি যতটা জীবন ও জীবিকা বিমুখ, শকুন্তলা ততটাই জীবনমুখী। আমিও ওরকম জীবনমুখী হয়ে থাকবার চেষ্টা করে দেখেছি কয়েকবার। দু’তিন মাসের বেশি টানতে পারিনি। হাঁপিয়ে যাই। মাঝে মাঝে মনে হয় সারাদিন সিগারেট খেয়ে যাওয়া আর আমজাদ আলি খান সাহেবের সরোদ শুনবার জন্যেই বোধহয় বেঁচে আছি। ছাদ থেকে নেমে এলাম আমরা। যতটা ধীরে নামা যায়। নামছি। বৌদি স্নান করে বেরিয়েছে সদ্য। ভেজা চুল খুলে পুজোয় বসেছে। শকুন্তলা বৌদিকে আর রিমঝিমকে বলে বেরিয়ে গেল। আমি ওকে খানিকটা এগিয়ে দিলাম। ফিরে এসে দেখি চশমাটা ফেলে গেছে। বিকেলের বাস ধরে আমিও ফিরে এলাম কুচবিহার। সঙ্গে ক’রে নিয়ে এলাম ওর চশমাটা। আর পরদিন থেকে কি এক ভয় কোত্থেকে এসে চেপে ধরলো আমাকে। চিনিনা জানিনা কি এক ভয়। এরকম দম বন্ধ করা, শ্বাসরোধী একা লাগছে কেন বুঝতে পারছি না… হয়ত ভয় পাচ্ছি… হয়ত বুঝতে চাইছি না… যদি সেই কারণটা এই একার থেকে বেশি জোরালো হয়…? সারাদিন ধরে একটার পর একটা সিনেমা দেখে যাচ্ছি… যতক্ষণ দেখছি, ততক্ষণ, নিরাপদ লাগছে সব কিছু। সিনেমা ফুরোলেই, সারা ঘর, টেবিল, খাট, বইয়ের তাক, এমন কি ফ্যানের হাওয়া, সব চেপে আসছে… একের পর এক সিগারেট খেতে খেতে আর একটার পর একটা সিনেমা দেখতে দেখতে আমি কি কারোর আসার জন্য অপেক্ষা করছি? সবকটা সিনেমা দেখা শেষ হয়ে গেলে তখন আমি কি করব, সেটাও আরেকটা ভয়। কি মনে হল, fbটা খুলে চলে গেলাম এক মৃত মানুষের অ্যাকাউন্টে… কেন গেলাম? একটা মানুষ একদিন নিজের হাতে সাজিয়েছিল এই প্রোফাইল, কভার। সেই পুরনো পোস্ট, পুরনো শেয়ার, পুরনো ট্যাগগুলো। পুরনো স্টেটাস। ছবি। সব আছে। লোকটা নেই। নিজের মনে এটাই ভাবছি, এটাই বলছি, কেন গেলাম? আমিও তো এক আত্মধ্বংসী, আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ... এবং vulnerable... তাহলে? এত লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু, কিছুতেই কিচ্ছু লিখতে পারছি না। জীবনের ঝামেলাগুলোর মতোন চুলগুলো মুখের সামনে, চোখের সামনে চলে আসছে বারবার। নাকি চুলগুলোর মতোন ঝামেলাগুলো চলে আসছে! সারাদিন ধরে মাথাটা ব্যথা করে করে কাঁপিয়ে দিল একেবারে। সন্ধ্যে একটু রাতের দিকে গড়াতে শুরু করলে, ব্যথাটাও কমেছে যাহোক। কি মনে ক’রে ভাতখন্ডের হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতির বইটা বের করলাম। পঞ্চম খন্ড। খুব ভালো লাগলো এই কথাটা— দেসরাগশ্চ দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। কি সুন্দর কথাটা! দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। যতবার উচ্চারণ করছি, কথাটা, ভেতরে ইকো হয়ে হয়ে ঘুরছে। দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। সারাদিন খুব ঘুমিয়েছি। রাতে কি জাগবো তাহলে? যদি জেগেই থাকি, কে জাগবে আসলে? আমি? নাকি আমার মতোন দেখতে কেউ জাগবে? এই ঘরে, এই খাটে, এই কম্পিউটারের সামনে, বুকসেলফের পাশে, কে থাকে? আমি? বাথরুমে যাবার সময়, টবে রাখা গাছগুলোর দিকে চোখ যায়। না, ঠিক যাবার সময় নয়, তখন একটা তাড়াহুড়ো থাকে যাবার প্রতি। চোখ যায়, ফেরার সময়। খুব মায়া হয় ওই সবুজগুলোর জন্য। নেহাতই অল্প ওরা। কিন্তু, তাতেই কতটা ভরিয়ে রাখতে জানে। ভরে থাকতে জানে। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে, আমি যখন বাথরুমে যাই, আমার কেন দেস অথবা সৌরঠ, কোন রাগের কথাই মনে আসে না!? বেশ একটু বড় হয়ে, ইমন রাগ শিখছি তখন। কল্যাণ ঠাট। বেহালার তারে সে রাগ তুলতে গিয়ে যেই না কড়ি মা লাগিয়েছি, ছেলেবেলার সেই ডাক, ফিরে এলো কানে। সন্ধ্যেবেলা, খেলার মাঠ থেকে ফিরে, আধো আলো আধো অন্ধকারে, কলতলায় হাত-মুখ ধুচ্ছি, আর চিৎকার করে বলছি, মাআআআআআআআআ….. খেতে দাও খিদে পেয়েছেএএএএ…. সেই তীব্র মা… আমার স্কেলটা মিলে গেল ন্যাচরাল সি-তে। আর কি আশ্চর্য, এটাও সন্ধ্যের রাগ। সেই কতদিন আগে, সন্ধ্যেবেলা, না জেনেই, কড়ি মা লাগিয়েছি। বিশুদ্ধ কড়ি মা-য় ডেকেছি মাকে। তারও কত পরে লিখেছি, ইমন ধুয়ে গেছে মায়ের কল্যাণে। সেই সন্ধ্যে। সূর্যাস্ত। ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট করে আমি টিউকল পাম্প করছি, আর হড়হড় করে জল নেমে আসছে, ধুয়ে ফেলছি হাঁটুতে, পায়ের পাতায়, আঙুলে, হাতে, ধুলো কাদা। আর সন্ধ্যে নামছে, আস্তে আস্তে কালো হয়ে আসছে মাঠ। দূরের বাড়িগুলো আরো আবছা হয়ে যাচ্ছে। শাঁখে ফুঁ দিচ্ছে মা। চৌকাঠে দিচ্ছে জল ছিটিয়ে। শকুন্তলা হঠাৎ করে কেন জানিনা যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ভাস্কর চক্রবর্তী নামের ঐ লোকটার মতো আমিও প্রতিদিন আরো বুঝতে পারছি, একমাত্র লেখাই পারে, লেখাই পারে আমাকে বাঁচাতে। রক্তের মধ্যে শব্দের চোরকাঁটা ঢুকে গেছে কখন, অজান্তে। রাস্তায় বেরোলে অবধারিত ভাবেই কিছু চেনা মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। তবে জানা মানুষ নয়। একজন মানুষের একটা জীবনে জানা মানুষ ক’জন থাকে? আমার ক’জন জানা মানুষ? কিছু কিছু মানুষের সামনে শুধু হাসতে হয়। ঠোঁটদুটো দুপাশে যতটা পারা যায় ছড়িয়ে রাখতে হয় তাদের সাথে কথা বলার সময়। তারা যখন কথা বলেন, তাদের কথাগুলো যেন শুনছি, এরকম একটা ভান করার জন্যে সবসময় তখনো ঐরকম হাসিটা ধরে রাখতে হয়। তারা মুখ নিচু করে দেখেন আমার দু’পায়ের বড় বড় নখ। আমি এদেরকে কখনো আমার ঘরে আসতে বলতে পারি না। এদের সামনে প্রচুর মিথ্যেও বলে ফেলি আমি অবলীলাক্রমে। দেখাই, আমি কত ভাল আছি এখন, কত কাজ করছি, কত দায়িত্ব সামলাই আমি। কত পড়াশুনো করছি। কবিতা উপন্যাস পড়ার মতো ফালতু পড়াশুনো নয়। এ হল কাজের পড়াশুনো। যে পড়া পড়লে চাকরি হবে। জি.কে., জি.আই., কারেন্ট এফেয়ার্স, রিজ়নিং টেস্ট। কত ঠিক এবং ঠাক আছি আমি আজকাল, ইদানীং, দেখাই। নীল রঙের একটা সাইকেল ভ্যান বাচ্চাদের নিয়ে ফিরছে স্কুল থেকে। সরু সরু গলার তীক্ষ্ণ কোরাসের আওয়াজ চিঁ চিঁ করতে করতে চলে গেল। আজ মঙ্গলবার। কিছু একটা পুজো-টুজো হবে হয়তো বা। পাশের কোনো বাড়িতে শাঁখে ফুঁ পড়ল তিনবার। তৃতীয়বারের ফুঁতে বেশি জোর পেলো না ফুঁ দাত্রী। আচ্ছা, যদি ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার কী করতে ভালো লাগে, আমি কি বলতে পারবো, আমার ‘দেসরাগশ্চ দ্বিতীয়প্রহরে নিশি’ কথাটা বারবার উচ্চারণ করতে ভালো লাগে?
১.
আমি যখন জন্মাই, তখন নাকি মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। কোলকাতায় পুলিশের জীপ, ট্যাক্সি অর্ধেক ডুবে গেসলো সেদিন।
সেদিন, আষাঢ়স্য বিংশ দিবসে।
সেদিন, আষাঢ়স্য বিংশ দিবসে।
বাতাবাড়ি, রাজর্ষিদার সাথে। রাজর্ষিদা বরানাগরিক। মন যদিও সায় দিচ্ছিল না যেতে। মন বলছিল আসবে, ফোন। শকুন্তলার। তাও যাওয়া হল। কদমতলা গার্লসের সামনে থেকে বাস ধরে বাতাবাড়ি ফার্ম মোড়। ঘণ্টা দেড়েক। সকালের বাকি ঘুমটুকু বাসে পুষিয়ে নিয়ে যখন মাথা চুলকোতে চুলকোতে নাবলাম বাস থেকে, তখন দেখি, সামনে লেখা জায়গাটার নাম, মাথাচুলকা। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে যে সাইকেল ভ্যানটায় উঠলাম, তাতে সিমেন্ট, রড এসবও আছে। প্যাসেঞ্জার, মোরা দুজনায়। বারেবারে ফোনটা দেখে যাচ্ছি। শকুন্তলার ফোন এলো না। প্রায় আধ ঘন্টা দুলতে দুলতে গিয়ে পৌঁছলাম, লতিফ ভায়ের বাড়ি। রাজর্ষিদার মুখে এই নামটা শোনা ইস্তক মাথায় ঘুরছে একটাই শব্দ, বীফ। ভ্যান থেকে নেমে, রাস্তার ঢালু দিয়ে লতিফ ভায়ের বাড়ির দিকে যেতে যেতে, এই শব্দটাই মাথায় ঘুরছিল আবার। আর, স্যালাইভাতেও। যাই হোক, ব্যাগপত্তর রেখে আমরা যাচ্ছি সেই বহুশ্রুত জায়গাটা দেখতে। যেখানে অদূর ভবিষ্যতে একটা লিটল ম্যাগাজ়িন লাইব্রেরি হবে। একটা ফ্রি স্কুলও। মোট দেড় বিঘে জমি। মিউটেশনের কাজ চলছে। জায়গাটার তিনদিকে খুঁটি পুঁতে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এখানে হাতি আসে খুব। একটা খুঁটি ভেঙে দিয়ে গেছে ক’দিন আগে। একপাশ দিয়ে লাগানো হবে দেড়শো সুপুরি গাছ। তার ফাঁকে ফাঁকে ঝাউ। গেটের সামনে দুটো রাণিচাপ। বর্ষায় জল উঠে আসে ষোড়শী তণ্বীর মতো ঐ নদীটা থেকে। তাই বোল্ডার ফেলা হচ্ছে তার পাড় ঘেঁষে। পাশেই লাটাগুড়ি ফরেস্ট। অনেক চা বাগান। চা বাগান দেখেই, আমার আবার মনে পড়লো, শকুন্তলার কথা। ক’দিন আগেই আমি আর শকুন্তলা সুকনা ফরেস্টে গেছিলাম। সেখানে ওর খুব ইচ্ছে করছিল জঙ্গলের ভেতরে হারাতে। ডুয়ার্সের জঙ্গলের মতো এত মায়াবী জঙ্গল আর কোথাও কি আছে! চুপ করে কান পেতে আমরা শুনতে থাকি জঙ্গলের শব্দ। সে যেন তার নিজের খেয়ালে আছে। নিঃশ্বাসে একটা বুনো চাপ চাপ গন্ধ। নাক থেকে ফুসফুস, গোটা স্নায়ুতে সেই গন্ধটা ছড়িয়ে যেতে থাকে। আসার সময় আমাদের অটোটা থেমেছিল সুকনা স্টেশনের কাছে। ছোট্ট স্টেশন। ছবিতে এরকম দেখা যায়। জঙ্গল এই জায়গাটার মনটাই যেন অন্যরকম করে গড়ে দিয়েছে। শকুন্তলা স্টেশনের ছবি তুলছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আর হাওড়া স্টেশনের স্টেশন মাস্টার দুজনেই এক পদে চাকরি করেন, তবু দুজনের জীবন কতটা আলাদা। আমরা দুটো চা বাগানের মাঝখানে বসে ছিলাম। রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে। ও শুয়ে ছিল আমার
কোলে মাথা রেখে। কি কথা বলছিলাম আমরা তখন? মনে পড়ছে না। ছবিটা ভাসছে। আমি খুব ছবি তুলছিলাম, ওর ক্যামেরায়। বিকেল হতেই ও বলছিল,
— তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, এখানে সন্ধ্যের পরে হাতি বেরোয়।
একটা জলের ফোঁটা হঠাৎ যেন পড়লো আমার হাতে।
— বৃষ্টি? কিরে? চ’ উঠি।
অনেকটা ভেতরের দিকে এসে গেছি আমরা। বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে সময় লাগবে। তাই পা চালিয়ে। ফোঁটা আর পড়ছে না, তবুও, তাড়াতাড়িই বেশ ঝরাবে মনে হচ্ছে। ধ্রুপদী সঙ্গীত পরিবেশনের আগে ওস্তাদেরা যেমন যন্ত্রগুলির স্কেল ঠিক করে নেন টুং টাং করে বাজিয়ে, বৃষ্টি এখন সেরকম। এখানে ঢোকার সময় একটা ব্রিজ পেরোতে হয়েছে। ব্রিজটা তৈরি হচ্ছে। নিচের নদীটায় জল ছিল না। আর ব্রিজটায় মাঝেমাঝে কাঠের পাটাতন, কোথাও বেশ ফাঁকা। ফাঁকগুলো বাঁচিয়ে পাটাতনে পা রেখে রেখে ও দিব্যি চলে গেল ওপারে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম মাঝপথে। শুধু ফাঁকগুলোই দেখতে পাচ্ছি। মাথা ঘুরছে। ও হাসছে ওপারে দাঁড়িয়ে। এখন কি করা? পেছনে মিস্ত্রিগুলো নেপালি ভাষায় সাহস দিচ্ছে আমাকে।
— যানুস যানুস, কেই হুন্দেই ন
কিন্তু সাহস এমন একটা জিনিস একবার গেলে আবার চট করে আনা মুশকিল। একটা মিস্ত্রি নিজেই এগিয়ে এলো। আমার হাতটা ধরে পার করে দিল ব্রিজটা। ফেরার সময় মনে পড়লো, এই রে! আবার পেরোতে হবে ঐ ব্রিজটা? এখন তো মিস্ত্রিগুলোকেও পাবো না। বলতেই মাথায় খেললো, আরে! বাঁ-পাশ দিয়েই তো আরেকটা রাস্তা আছে। আমরা ঐ পথটাই ধরলাম। খিদেও পাচ্ছে এবারে। ছবি তুলতে তুলতে ফিরছি আমরা। শকুন্তলা খুব কায়দা করে ছবি তুলতে জানে। লোকজন টেরই পাবে না, ও ছবি তুলে নেবে। আবার কাছে গিয়ে, দাঁড় করিয়েও ছবি তোলে। বিস্কুট আর আলুর চিপ্স কিনে, সুকনা স্টেশনের কাছ থেকে যখন অটো ধরলাম, বৃষ্টি তখন আলাপ ছেড়ে মুখড়া ধরেছে। অটোর পর্দাটা হিমশিম খেয়ে নামালাম আমি আর উলটো দিকে বসা ছেলেটা, দুজনে মিলে। আমি তো ছাতা নিয়ে বেরোই নি। শকুন্তলার সাথে ছাতা আছে। ও আমাকে বলছিলো,
— কেন ছাতা নিয়ে আসিসনি? সবসময় ছাতা নিয়ে বেরোন উচিত।
আমি বেশ জোর দিয়ে বললাম—
— দ্যাখ, আর কেউ ছাতা নিয়ে আসেনি। কেউ তো জানতোই না যে বৃষ্টি আসবে।
আমার কথা শুনে, অটোতে বসা সবাই জানালো তারা ছাতা নিয়েই বেরিয়েছে। দু’একজন ব্যাগ থেকে বের করেও দ্যাখালো। সিটি সেন্টারের সামনে যখন নামলাম দুজনে, বৃষ্টি তখন ঝালায় পৌঁছে গেছে। ও ছাতাটা খুললো, নেমে। আমরা দৌড়ে ঢাউস ঐ বাড়িটার ভেতরে হারিয়ে গেলাম। হ্যাংআউটে বসা গেল না বৃষ্টির জন্য। টেবিলে আমরা মুখোমুখি বসে, আর অঝোরে তখন বাইরে ঝরছে বৃষ্টি। সুনীল গাঙ্গুলি বলতো, আগেকারদিনে গল্প-উপন্যাসে প্রায়ই এরকম একটা লাইন থাকতো, ‘তখন নিয়তি দেবী অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া হাসিলেন’। সেদিন হ্যাংআউটেও বোধহয় তিনি ছিলেন। এবং হাসছিলেন। নইলে কে জানতো, সেদিন রাতেই আমাদের দুজনের তুমুল ঝগড়া হবে! আর শকুন্তলা ভোর চারটের সময় হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে চাইবে!
কিন্তু, তাই বলে বাতাবাড়িতে বৃষ্টি? রাজর্ষিদার গুঁতো খেয়ে তিরতিরে ঐ হাঁটুজল নদীটায় নেমে স্নান করতেই হল। উঠে আসতেই নামল বৃষ্টি। আর বাজ। ওফ্! সে এক দৃশ্য। চারদিকে মাঠ, আর চা বাগান, তার একপাশ দিয়ে নদীটা। নদীর ঠিক পাশেই একটা টং ঘরে আমরা। কুচকুচে আকাশ। এখানেও ছাতা আনিনি। কেউই আনেনি। আমার মনে হচ্ছিল, সব জায়গার বৃষ্টি কি আলাদা? আমার জন্মের সময়ের বৃষ্টি, শিলিগুড়ির বৃষ্টি, বাতাবাড়ির বৃষ্টি, সুকনার বৃষ্টি, সব জায়গার বৃষ্টির মেজাজটাই তো আলাদা। রাজর্ষিদা বলছিলো, শকুন্তলাকে আনলে পারতাম। ওর ভাল্লাগতো। বৃষ্টি একটু থামতে, নেমে এলাম টং ঘর থেকে। লতিফ ভাই, রাজর্ষিদা আর আমি। হাঁটছি। রাতে থাকবো কি থাকব না, এই নিয়ে দোনামনা চলছে আমাদের দুজনের। নাঃ, দুপুরে বীফ জুটলো না। কিন্তু তার বদলে যা জুটলো তাও দারুণ। খেয়ে উঠে আমরা ঠিক করলাম, থাকবোনা। যাব কোথায়? ও যাবে, আলিপুরদুয়ার। শৌভিকদার বাড়ি। আর আমি? আমি কোথায় যাব? জলপাইগুড়িই ফিরে যাই। মন তখনও বলছে আসবে আসবে, ফোন আসবে। শকুন্তলা আজকে শিলিগুড়িতে। জলপাই থেকে শিলিগুড়ি যাওয়াটা সহজ হবে। অবশ্য, যদি শকুন্তলা ডাকে। আর না ডাকলে? তাহলে কালই ফিরে যাব কুচবিহার। কিন্তু, রাজর্ষিদা চাইছে আমাকে আলিপুরে নিয়ে যেতে। বিকেল সাড়ে তিনটে প্রায় তখন। ভাবলাম এখনও যখন ফোন এলো না, তাহলে চলো আলিপুর। তারপরে দেখা যাবে। বৃষ্টি থেমে গেছে। আমরা আবার ভ্যানে চেপে বাতাবাড়ি ফার্ম মোড়। মালবাজারের বাস। মনটা কিন্তু খচখচ করেই যাচ্ছে। মালবাজারে পৌঁছে, রিকশা নিয়ে রেল স্টেশন। স্টেশনের কাছে এসেছি যখন, ট্রেন ঢুকছে। রাজর্ষিদা বললো—
— অর্জুন, যা দৌড়ে টিকিটটা কাট। আমি রিকশা ভাড়াটা দিয়ে আ—
ব্যাগ রইলো ওর কাছেই। আমি নেমে দৌড়। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে আমি, রাজর্ষিদা দু’দুখানা ব্যাগ নিয়ে আধা দৌড় আর দু’পাশে আধা হেলতে হেলতে ঢুকছে। আর ট্রেনও ছেড়ে দিল তখন। দৌড়ে ধরলাম তাকে। আঃ…. পেরেছি। ঝাঁঝা এক্সপ্রেস।
আগের রাতে প্রায় সাড়ে তিনটে অবদি কথা হয়েছে শকুন্তলার সাথে। তারপরে সাত সকালে উঠে বাতাবাড়ি। ঘুম হয়নি তেমন। বাসের ঐ দেড় ঘন্টায় আর কতটুকু হয়! ট্রেনে উঠে জায়গাও পেয়ে গেলাম কপালজোরে, দুজনেই। আমি মালবাজার থেকেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলস্টেশনে, ঘুম। তাও জার্নির সময় যা
হয়, টানা হয়না। যা হয়, ছেঁড়া ছেঁড়া। রাজর্ষিদা একবার বললো,
— শকুন্তলাকে ফোন করে বলে দে ট্রেনে উঠে গেছিস।
— থাক।
ওকে আর বললাম না, সকালের পর থেকে ওর ফোন স্যুইচড অফ। মালবাজার থেকে ট্রেনে আড়াই-তিন ঘণ্টা লাগে আলিপুর যেতে। সন্ধ্যে যখন হব হব, ট্রেনও গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গেছে, অন্য প্যাসেঞ্জারদের মুখ থেকে জানা গেল, আলিপুরে ভয়ানক বৃষ্টি হচ্ছে। ছ’টা নাগাদ নিউ আলিপুরদুয়ারে আমরা নেমে দেখলাম, বৃষ্টি তখন চলে গেছে। সে যে এসেছিল, তার চিহ্ন সর্বত্র। বছর চারেক হল আমি আর ছাতা ব্যবহার করিনা। চার-পাঁচ বছর আগে, এক জুলাই মাসে, ঘোর বর্ষায় আমি বেয়াক্কেলের মতো পরপর ছ’সাত খানা ছাতা হারিয়েছি। শৌভিকদাকে ওর আই-টেন সমেত দেখা গেল একটু এদিক ওদিক করতেই। ওর বাড়িতে ব্যাগ রেখে আমরা চারজনে আবার বেরিয়ে গেলাম। আমি, রাজর্ষিদা, শৌভিকদা আর আই-টেন। রাজর্ষিদাও খুব ভালো গাড়ি চালায়। এখন শৌভিকদাই চালাচ্ছে। পেছনে আমরা দুজন। মদ আর শসা কিনে, কবি সুদীপ মাইতির বাড়ি। শঙ্খবাবু যতই বলুন ‘মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই’, মদের যে কিছু গুণ আছে সে তো মদ্যপায়ী মাত্রেই জানে। বাকিরা শুধু বিয়োগই দ্যাখে। গুণ অঙ্কটা এখনো অনেকেই ভালো করে কষতে পারে না। রাজর্ষিদার সামনে আমি মদ খেলে, ও কাকা আর জ্যাঠার মাঝামাঝি একটা গার্জেন হয়ে যায়। আমি দু’পেগ খেলে, ও বলে, আমি চার পেগ খেয়েছি। আমাদের কবিতা, পান চলতে চলতেই আবার নামলো বৃষ্টি। রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা আড্ডা ভাঙলাম। প্ল্যান হল পরদিন চিলাপাতা যাওয়া হবে। আমি তখনও জানি না, আমি যাচ্ছি না। শকুন্তলার আর ফোন না আসায় আমি ভেবেছি এখান থেকেই কুচবিহার ফিরে যাব। অনেকদিন পর মদ খেয়ে সত্যি মাতাল মাতাল লাগছে। রাতে প্রায় বারোটা নাগাদ ফোন এলো শকুন্তলার। আশ্চর্য হয়ে গেলাম এটা জেনে, ওর মনেই নেই কাল রাতে আমরা প্রায় সাড়ে তিনটে অবদি কথা বলেছি। এমন কি আজ সকালেও যে আমি বাসে ওঠার একটু পরে, ন’টা নাগাদ ও ফোন করেছিল, আমি ওকে বলেছিলাম বাতাবাড়ি যাচ্ছি, সেসবও কিচ্ছু মনে নেই। ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু ওকে বুঝতে দিলাম না সেটা। শকুন্তলা বললো,
— কাল আসতে পারবি?
আমিও হ্যাঁ বলে দিলাম। রাত তখন আড়াইটে। আলিপুর থেকে শিলিগুড়ি যেতে সাড়ে চার ঘণ্টা তো লাগবেই। সকাল সকাল বেরোতে হলে এখনই শুয়ে পড়া দরকার। কাল শকুন্তলাকে আবার দেখার উত্তেজনা নিয়ে শুয়ে
পড়লাম। শুধু চিন্তা একটাই, আগেরবার গিয়ে উঠেছিলাম শিবমন্দিরের একটা হোটেলে, সোনার তরী। ভালো হোটেল। কিন্তু সেটা ও যেখানে থাকে একদম সেই এলাকায়। ওর বাড়িওলা, পাড়ার লোকেদের কাছ থেকে একটা অন্য দৃষ্টিলাভ হয় এর ফলে। তাহলে? শিলিগুড়ি একেবারেই আমার চেনা শহর নয়। তাহলে ভরসা সুব্রত। আমার বন্ধুই বলা চলে। আমার চেয়ে বেশ বড় একটু বয়েসে। কিন্তু বন্ধুই। এনজেপিতে থাকে। ওর এক বন্ধুর হোটেল আছে মেডিকেলের কাছে। ঠিক হোটেল বলা ভুল, রেস্টুরেন্ট কাম বার। সকাল সকাল উঠে রাজর্ষিদাকে বললাম,
— বেরোচ্ছি, শিলিগুড়ি।
ট্রেনের খোঁজ করে জানা গেল সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ একটা গাড়ি আছে। শৌভিকদার বাড়ির কাউকে না জানিয়েই বেরিয়ে গেলাম। ওরা তখনো ওঠেনি ঘুম থেকে। রাজর্ষিদা আমাকে কিছুটা এগিয়ে দিল। আমি অটো ধরে আবার নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে। কালই সন্ধ্যায় নেমেছিলাম এখানে। স্টেশনে পৌঁছে কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সাড়ে বারোটার আগে ট্রেন নেই। আমি আবার অটো ধরে চৌমাথায়। বাস পেয়ে গেলাম। জায়গাও। রাজর্ষিদাকে এসএমএস করে দিলাম।
শকুন্তলা জলপাইগুড়ি শহরের মেয়ে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে এখন, ভুগোল নিয়ে। পেটে একগাদা খিদে নিয়ে যখন তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যাণ্ডে নামলাম, তখন দুপুর প্রায় বারোটা। নেমেই সুব্রতকে ফোন করলাম। ও আধ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেলের হোটেল মালিকের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে দিল। আমি বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। টেনশনটা গেল। তখন নিয়তি দেবী বোধহয় অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া আবার হাসিলেন। ওখানে গিয়ে ঘর বুক করে শিবমন্দিরে এসে দেখা পেলাম শকুন্তলার। তখন দেড়টা। পেট আর কিছুই মানছে না। জানা গেল দুপুরে আমাদের দুজনের নেমন্তন্ন, নার্গিসদির বাড়ি। যেতে যেতে শকুন্তলা বললো—
— যেখানে যাচ্ছিস সেটা কিন্তু আর্মি ম্যানের বাড়ি। যদি আমাকে কষ্ট দিয়েছিস, তাহলে থানা না পুলিশ না, একেবারে কোর্ট মার্শাল।
নার্গিসদির বর, শামসেরদা, বি.এস.এফ-এ চাকরি করে।
* * *
বিকেল বিকেল নার্গিসদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা এদিকে ওদিকে আর সিটি সেন্টারে ঘুরেই কাটালাম। সন্ধ্যেবেলা হোটেলে ফিরে মাথায় বাজ পড়ল। এত দৌড়ঝাঁপে শরীর এমনিতেই ক্লান্ত। জানা গেল, মহিলা নিয়ে থাকা যাবে না। মানে? আমার তো আগে থেকেই বলা ছিল। আমি ভাবলাম, মালিকের সাথে নিশ্চই এদের এখনো কথা হয়নি। আমি কি তখন জানতাম, নিয়তি দেবী আগেই অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে খানিকটা হেসে নিয়েছেন! সুব্রতকে ফোন, মালিককে ফোন। ব্যবস্থা কিছুই হল না। অগত্যা মধুসূদন। সোনার তরী। খোঁজ করা হল আগেরবারের ঘরটা খালি আছে কিনা। ওটা আমাদের দুজনেরই পছন্দ। খালি নেই। অন্য ঘর পাওয়া গেল। আমরা অনেকক্ষণ নিভৃতে কাটালাম, একসাথে। শকুন্তলা ওর নতুন একটা লেখা শোনালো। গত
সপ্তাহে যখন এসেছিলাম, এই হোটেলেই পাশের ঘরে উঠেছিলাম আমরা। শনি-রবি দু’দিন ছিলাম। ভোর অবদি জেগে থাকতাম পাশাপাশি। প্রথম দিন ওকে হোটেলে রেখে রাতের খাবার কিনতে বেরিয়েছি। মটর পনীর, রুটি। আমাকে এসএমএস করে জানালো, চার প্যাকেট প্যানটীন শ্যাম্পু আর ময়েশ্চারাইজ়ারের ছোট প্যাকেট একটা। কিনে নিলাম। আমার নিজেকে বেশ সাংসারিক সাংসারিক মনে হচ্ছিল। ফিরে এসে দুজনে গল্প করছি বিছানায় বসে। একটু রাত করেই খাব আমরা। দুধের মতো ধবধবে সাদা চাদর পাতা বিছানায়। চুমু খেতে গেলাম, বলে কিনা না, হবে না। আমার মুখে নাকি গন্ধ। আগে ব্রাশ করে আয়। ব্রাশ এনেছি, কিন্তু পেস্ট তো আনিনি। রাত দশটায় বেরিয়ে পেস্ট কিনে এনে ব্রাশ করলাম। শকুন্তলা টিভিটা চালিয়ে দিল। যাতে পাশের ঘরে শব্দ না যায়। হোটেলের ঘরে টিভি কি এই জন্যেই থাকে? একই জিনিস যখন যেভাবে কাজে আসে। আদর থামিয়ে ও কবিতা পড়ছে, কবিতা থামিয়ে আদর। এবারে শকুন্তলা রাতে থাকবে না। আর কি যোগাযোগ! এই ঘরে টিভি নেই। ঠিক হল পরদিন আমি প্রদীপের মেসে শিফট করে যাব। প্রদীপ এখানেই থাকে, মেসে। তরুণ কবি। সাড়ে ন’টা নাগাদ বেরিয়ে আমরা ডিনার সেরে নিলাম। ওকে ওর ঘরে পৌঁছে আমি ফিরে এলাম সোনার তরীতে। প্রায় একবছর আগে, গত বছর জুলাই মাসে প্রথম আসি এখানে। সেবার রাত প্রায় এগারোটা অবদি আড্ডা দিয়েছি ওর ঘরে। তার পরেরদিন ভোরবেলা, পাঁচটা নাগাদ, শকুন্তলা হোটেলে হাজির। বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, টিপ টিপ করে। আমি তো চমকেই গেছি। এতো ভোরে! দেখি গেরুয়া রঙের একটা সালোয়ার পরে এসছে। খোঁপা বাঁধা উঁচু করে। বোষ্টমীর মতো লাগছিলো ওকে দেখতে। অত ভোরে হোটেলের লোকগুলোও ঘুমে কাদা। আমি যত ডাকি-
— ও দাদা, ও দাদা, ঊঠুন, গেটটা খুলে দিন।
কে শোনে কার কথা। একবার শুনে ঊঁ—আঁ ক’রে আবার পাশ ফিরে শোয়। শেষে আমাকেই দেখিয়ে দিল বালিশের নিচে চাবি আছে। আমি চাবি নিয়ে গেট খুলে দিলাম। কিন্তু, এবারে যেটা নেই, তা’ হল বৃষ্টি। এবারে সকালে আমরা অনেকক্ষণ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। গতবছর রাতের অন্ধকারে ঘুরেছিলাম। এবারে সকালের আলোর কৈশোরে। আমরা ফুল কুড়াই, ছবি তুলি। আঙুল ছুঁয়ে থাকি। কেউ কাউকে না ছুঁয়ে পাশাপাশি হাঁটলেও শরীরে-মনে একটা লেনদেন হয়। সকালের হাল্কা রোদ মাখা গাছগুলো আস্তে মাথা ঝোঁকায়, অল্প হাসে আমাদের দেখে। কাল ও জলাপাইগুড়ি ফিরে যাবে। আমি কুচবিহারে। পরশু ও যাবে কোলকাতায়, ডাক্তার দেখাতে। ফিরে পিএইচডি আর বি.এড-এর পড়াশোনায়, আমি চাকরির জন্য জি.কে। কিন্তু, ফেরার পথে গল্পটা একটু জলপাইগুড়ি ছুঁয়ে গেল। এয়ারভিউ মোড় থেকে কুচবিহারের কোনো বাস না পাওয়ায় ময়নাগুড়ির একটা বাস ধরে নিলাম। আমরা গোসালায় নেমে যাব। ও রিকশা নিয়ে বাড়ি, আমি বাস ধরে কুচবিহার। বাসে আমরা দুজনেই একটা ভালো জায়গা পেলাম। ও জানলাটা নিল। আমি ওর পাশেরটা। আমাদের দুজনের ঠোঁটই কাতর ও প্রত্যাশী হয়ে ছিল, বোঝা যাচ্ছিল ওর ঠোঁটের তিরতির করে কেঁপে ওঠা
দেখে। গোসালায় নেমে আবার মত পাল্টালাম আমরা। আমি শংকরদার বাড়ি যাব। ও সন্ধ্যে বেলা আসবে দেখা করতে। পরদিন সকালেও আসবে, ট্রেন ধরার আগে।
* * *
সন্ধ্যায় শকুন্তলা এলো। সকালেই বেরোবার সময় ও রায়তা করে নিয়ে এসছিলো। আমার ব্যাগে রাখা ছিল সেটা। বের করে নুন দিয়ে ঝাঁকিয়ে ভাল করে বানালাম। বেশিক্ষণ বসলো না। রিমঝিম শংকরদার মেয়ে। সেভেনে পড়ে। ওকে স্কুল থেকে টেবিল ক্যালেণ্ডার আর পেন স্ট্যাণ্ড বানাতে দিয়েছে। তাই নিয়ে বেশ একটা হুলুস্থুল পড়ে আছে বাড়িতে। আমি বারান্দায় বসে সিগারেট খাই, পেপার পড়ি। কিছু মনে এলে খাতায় টুকে রাখি। লেখা হলে বৌদিকে খুব পোলাইটলি বলি—
— ব্যস্ত আছো? একটা লেখা শুনবে?
পরদিন সকালে দশটা নাগাদ আবার এলো শকুন্তলা। বিকেলে ট্রেন ওর। রিমঝিমের হাতের কাজটা করে দিল। যেন ও আগে থেকে জানতো কি করতে হবে। আগে থেকেই যেন ওর প্ল্যান করা ছিল কিভাবে করবে ওটা। ফটাফট করে দিল জিনিসটা। আমি চেয়ারে বসে বসে দেখলাম। তারপরে ছাদে গেলাম আমরা। দুপুর মেঘলা তখন। ও নিভৃতে চাইছিল আমাকে। এ বাড়িতে ছাদের ওপরে ছাদ আছে একটা। অনেক বাড়িতেই থাকে। সেখানে উঠে আবিষ্কার করা গেল একটা ঘরও আছে। হুড়কো খুলে, ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
* * *
শকুন্তলার ঠোঁট এখন নতুন জিভের মতো অল্প লাল হয়ে আছে। ও বললো, আমার ঠোঁটও তাই। ছাদের ঘরটা থেকে আমরা বেরিয়ে, নেমে এলাম নিচের বড় ছাদে। রেলিঙে হাতের ঠেস দিয়ে ঝুঁকে আছি দুজনে। এখান থেকে শংকরদার ফ্ল্যাটে ঢোকার গলিটা দেখা যায়, স্পষ্ট। গলির মাথায় রাস্তাটাও দেখা যায় কিছুটা। শকুন্তলা বললো,
— নিচে চল। বৌদি স্নান করে বেরিয়ে ছাদে কাপড় মেলতে আসবে হয়তো।
আমরা তাও আরো কিছুক্ষণ তুলোর মতো লেগে লেগে ভেসে ভেসে বেড়ালাম ছাদের এখান থেকে ওখানে। ওর গলায় ঘাড়ে মুখ গুঁজে ওর গন্ধ মেখে নিচ্ছি। শিবমন্দিরে থাকার সময়, এক রাতে ক্যাডবেরি কেনা হয়েছিল। ডেয়ারি মিল্কের ছোট প্যাকেট পাওয়া গেল না। তাই, অপছন্দের কিটক্যাট। আমি হোটেলের ঘরে ফিরে আসার পর শকুন্তলা বারবার জিজ্ঞেস করছে,
— ক্যাডবেরি এনেছিস?
— না।
— কেন?
— এমনিই… ক্যাডবেরি দিয়ে কি হবে?
— বলনা.. এনেছিস তাইনা?
— না বললাম তো
— ও, আচ্ছা। ঠি-কা-ছে।
আমি শ্যাম্পু, ময়েশ্চারাইজ়ার এগুলো টেবিলের ওপর রাখছি। ও বাথরুমে গেল। এই ফাঁকে আমি ক্যাডবেরিটা আমার ব্যাগে লুকিয়ে রাখলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে, আমার ব্যাগ ঘাঁটতে লাগল। কি করে যেন ঠিক সন্দেহ করেছে। কিন্তু পেলো না। সালোয়ার পালটে শকুন্তলা এখন হাউজ় কোট পরেছে। লাল আর কালো মেশানো। আমাকে বাঁ-হাত দিয়ে ঠেলে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর বাঘিনীর মতো আস্তে আস্তে আমার ওপরে উঠে আসছে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। কামাতুরা সব নারীর চোখ কি এক? যেমন সানি লিওন তেমনিই শকুন্তলা? টিভি চলছে। বোধহয় অ্যানিমেল প্ল্যানেট। টেবিলের ওপর রাখা রাতের খাবার। আমি হাত বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে ক্যাডবেরিটা বের করে ওর হাতে দিলাম। ওর চোখে একটা দুষ্টুমি ঝিলিক দিল। আর ঐ ঝিলিকটাকে চোখে রেখেই খুলে ফেললো কিটক্যাটের প্যাকেটটা। এক টুকরো ঢুকিয়ে নিল নিজের মুখে। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে এলো শকুন্তলার মুখ। জিভ দিয়ে কিটক্যাটের ভেজা টুকরোটা চালান করে দিল আমার মুখে। ঠোঁটের ভেতরে ঠোঁট, জিভের ভেতরে জিভ, আর তার ভেতর দিয়ে কিটক্যাটের একটা টুকরো এ-মুখ থেকে ও-মুখে চলে যাচ্ছে। তারপর মুখ সরিয়ে আয়নায় দেখি, দুজনের ঠোঁটই অল্প লাল অল্প বাদামি। দুজনের চোখেই আদরের ভাষা বরফের মতো ঝরে ঝরে পড়ছে। আমরা হোটেলের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। রাত গভীর হচ্ছে আস্তে আস্তে। রাস্তার বাতিগুলো কি এক অজানা মনখারাপ নিয়ে চুপচাপ ঝুঁকে আছে। দুটো নেড়ি কুকুর এখানে সেখানে রাস্তার ময়লা শুঁকছে। দূরে কোথায় একটা দুটো কুকুর ভৌউউউউউ করে উঠল। নেড়ি দুটো চমকে তাকালো এদিক ওদিক, কান খাড়া ক’রে। আমাদের হোটেলটাও চুপ করে আছে। শকুন্তলা হঠাৎ বলে উঠল—
— হঠাৎ হাইনে!There lies the heat of summer
On your cheek’s lovely art:
There lies the cold of winter
Within your little heart.
That will change, beloved,
The end not as the start!
Winter on your cheek then,
Summer in your heart.
— কাল আমার ডায়রিতে যেটা লিখে দিয়েছিলি এটা তার উত্তর।
— কাল? কাল কি লিখেছিলাম?
— মনে কর
— কাল… কাল… কাল… কি লিখেছিলাম রে?
— মনে কর মনে কর… তুই-ই তো লিখেছিলি। তোরই তো মনে থাকা উচিত
— আঃ, মনে পড়ছে না তো, বল না—
— তাড়াহুড়ো নেই তো কোনো। পরে মনে ক—
— মনে পড়েছে
— ভালো
— ওটা ভাস্কর চক্রবর্তীর লাইন। ‘সঙ্গে থেকো সঙ্গে থেকো। সবসময় সঙ্গে সঙ্গে থেকো।’
২.
এত মন কেমন নিয়ে এই শহরের জল ছুঁইনি কখনো, আগে। এত জল এত মেঘ এত শহরও এই শহরে দেখিনি আগে। একটা বাসার নাম রাখা হয়েছিল, অক্ষরবৃত্ত। না, বরং বলা ভালো, রাখা হবে এমনটাই ঠিক হয়েছিল। এখন সেখানে ছন্দ কম, পড়িয়াছে। কিন্তু আমি জানি, মাত্রা অক্ষর পর্বে নয়, ছন্দ সব থেকে বেশি বাস করে যতির বাসায়। তবে, যতিতে থাকে স্মৃতি। তার পূর্বের সবটুকুর চলা ডুবে থাকে, মিশে থাকে যতির চুল থেকে নখ। একটা বাসার নাম রাখা হয়েছিল, অক্ষরবৃত্ত। এখন যতিতে এসে, সে বাসা, জ্বলজ্বল ও ছলছল করছে। বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতেও কি থাকে না বন্যার জল, মিশে?
কাল শকুন্তলা বলছিলো, আমরা যদি বাকি জীবনটা হোটেলে হোটেলে কাটিয়ে দিই? আসলে কিন্তু আমি যতটা জীবন ও জীবিকা বিমুখ, শকুন্তলা ততটাই জীবনমুখী। আমিও ওরকম জীবনমুখী হয়ে থাকবার চেষ্টা করে দেখেছি কয়েকবার। দু’তিন মাসের বেশি টানতে পারিনি। হাঁপিয়ে যাই। মাঝে মাঝে মনে হয় সারাদিন সিগারেট খেয়ে যাওয়া আর আমজাদ আলি খান সাহেবের সরোদ শুনবার জন্যেই বোধহয় বেঁচে আছি। ছাদ থেকে নেমে এলাম আমরা। যতটা ধীরে নামা যায়। নামছি। বৌদি স্নান করে বেরিয়েছে সদ্য। ভেজা চুল খুলে পুজোয় বসেছে। শকুন্তলা বৌদিকে আর রিমঝিমকে বলে বেরিয়ে গেল। আমি ওকে খানিকটা এগিয়ে দিলাম। ফিরে এসে দেখি চশমাটা ফেলে গেছে। বিকেলের বাস ধরে আমিও ফিরে এলাম কুচবিহার। সঙ্গে ক’রে নিয়ে এলাম ওর চশমাটা। আর পরদিন থেকে কি এক ভয় কোত্থেকে এসে চেপে ধরলো আমাকে। চিনিনা জানিনা কি এক ভয়। এরকম দম বন্ধ করা, শ্বাসরোধী একা লাগছে কেন বুঝতে পারছি না… হয়ত ভয় পাচ্ছি… হয়ত বুঝতে চাইছি না… যদি সেই কারণটা এই একার থেকে বেশি জোরালো হয়…? সারাদিন ধরে একটার পর একটা সিনেমা দেখে যাচ্ছি… যতক্ষণ দেখছি, ততক্ষণ, নিরাপদ লাগছে সব কিছু। সিনেমা ফুরোলেই, সারা ঘর, টেবিল, খাট, বইয়ের তাক, এমন কি ফ্যানের হাওয়া, সব চেপে আসছে… একের পর এক সিগারেট খেতে খেতে আর একটার পর একটা সিনেমা দেখতে দেখতে আমি কি কারোর আসার জন্য অপেক্ষা করছি? সবকটা সিনেমা দেখা শেষ হয়ে গেলে তখন আমি কি করব, সেটাও আরেকটা ভয়। কি মনে হল, fbটা খুলে চলে গেলাম এক মৃত মানুষের অ্যাকাউন্টে… কেন গেলাম? একটা মানুষ একদিন নিজের হাতে সাজিয়েছিল এই প্রোফাইল, কভার। সেই পুরনো পোস্ট, পুরনো শেয়ার, পুরনো ট্যাগগুলো। পুরনো স্টেটাস। ছবি। সব আছে। লোকটা নেই। নিজের মনে এটাই ভাবছি, এটাই বলছি, কেন গেলাম? আমিও তো এক আত্মধ্বংসী, আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ... এবং vulnerable... তাহলে? এত লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু, কিছুতেই কিচ্ছু লিখতে পারছি না। জীবনের ঝামেলাগুলোর মতোন চুলগুলো মুখের সামনে, চোখের সামনে চলে আসছে বারবার। নাকি চুলগুলোর মতোন ঝামেলাগুলো চলে আসছে! সারাদিন ধরে মাথাটা ব্যথা করে করে কাঁপিয়ে দিল একেবারে। সন্ধ্যে একটু রাতের দিকে গড়াতে শুরু করলে, ব্যথাটাও কমেছে যাহোক। কি মনে ক’রে ভাতখন্ডের হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতির বইটা বের করলাম। পঞ্চম খন্ড। খুব ভালো লাগলো এই কথাটা— দেসরাগশ্চ দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। কি সুন্দর কথাটা! দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। যতবার উচ্চারণ করছি, কথাটা, ভেতরে ইকো হয়ে হয়ে ঘুরছে। দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। সারাদিন খুব ঘুমিয়েছি। রাতে কি জাগবো তাহলে? যদি জেগেই থাকি, কে জাগবে আসলে? আমি? নাকি আমার মতোন দেখতে কেউ জাগবে? এই ঘরে, এই খাটে, এই কম্পিউটারের সামনে, বুকসেলফের পাশে, কে থাকে? আমি? বাথরুমে যাবার সময়, টবে রাখা গাছগুলোর দিকে চোখ যায়। না, ঠিক যাবার সময় নয়, তখন একটা তাড়াহুড়ো থাকে যাবার প্রতি। চোখ যায়, ফেরার সময়। খুব মায়া হয় ওই সবুজগুলোর জন্য। নেহাতই অল্প ওরা। কিন্তু, তাতেই কতটা ভরিয়ে রাখতে জানে। ভরে থাকতে জানে। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে, আমি যখন বাথরুমে যাই, আমার কেন দেস অথবা সৌরঠ, কোন রাগের কথাই মনে আসে না!? বেশ একটু বড় হয়ে, ইমন রাগ শিখছি তখন। কল্যাণ ঠাট। বেহালার তারে সে রাগ তুলতে গিয়ে যেই না কড়ি মা লাগিয়েছি, ছেলেবেলার সেই ডাক, ফিরে এলো কানে। সন্ধ্যেবেলা, খেলার মাঠ থেকে ফিরে, আধো আলো আধো অন্ধকারে, কলতলায় হাত-মুখ ধুচ্ছি, আর চিৎকার করে বলছি, মাআআআআআআআআ….. খেতে দাও খিদে পেয়েছেএএএএ…. সেই তীব্র মা… আমার স্কেলটা মিলে গেল ন্যাচরাল সি-তে। আর কি আশ্চর্য, এটাও সন্ধ্যের রাগ। সেই কতদিন আগে, সন্ধ্যেবেলা, না জেনেই, কড়ি মা লাগিয়েছি। বিশুদ্ধ কড়ি মা-য় ডেকেছি মাকে। তারও কত পরে লিখেছি, ইমন ধুয়ে গেছে মায়ের কল্যাণে। সেই সন্ধ্যে। সূর্যাস্ত। ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট করে আমি টিউকল পাম্প করছি, আর হড়হড় করে জল নেমে আসছে, ধুয়ে ফেলছি হাঁটুতে, পায়ের পাতায়, আঙুলে, হাতে, ধুলো কাদা। আর সন্ধ্যে নামছে, আস্তে আস্তে কালো হয়ে আসছে মাঠ। দূরের বাড়িগুলো আরো আবছা হয়ে যাচ্ছে। শাঁখে ফুঁ দিচ্ছে মা। চৌকাঠে দিচ্ছে জল ছিটিয়ে। শকুন্তলা হঠাৎ করে কেন জানিনা যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ভাস্কর চক্রবর্তী নামের ঐ লোকটার মতো আমিও প্রতিদিন আরো বুঝতে পারছি, একমাত্র লেখাই পারে, লেখাই পারে আমাকে বাঁচাতে। রক্তের মধ্যে শব্দের চোরকাঁটা ঢুকে গেছে কখন, অজান্তে। রাস্তায় বেরোলে অবধারিত ভাবেই কিছু চেনা মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। তবে জানা মানুষ নয়। একজন মানুষের একটা জীবনে জানা মানুষ ক’জন থাকে? আমার ক’জন জানা মানুষ? কিছু কিছু মানুষের সামনে শুধু হাসতে হয়। ঠোঁটদুটো দুপাশে যতটা পারা যায় ছড়িয়ে রাখতে হয় তাদের সাথে কথা বলার সময়। তারা যখন কথা বলেন, তাদের কথাগুলো যেন শুনছি, এরকম একটা ভান করার জন্যে সবসময় তখনো ঐরকম হাসিটা ধরে রাখতে হয়। তারা মুখ নিচু করে দেখেন আমার দু’পায়ের বড় বড় নখ। আমি এদেরকে কখনো আমার ঘরে আসতে বলতে পারি না। এদের সামনে প্রচুর মিথ্যেও বলে ফেলি আমি অবলীলাক্রমে। দেখাই, আমি কত ভাল আছি এখন, কত কাজ করছি, কত দায়িত্ব সামলাই আমি। কত পড়াশুনো করছি। কবিতা উপন্যাস পড়ার মতো ফালতু পড়াশুনো নয়। এ হল কাজের পড়াশুনো। যে পড়া পড়লে চাকরি হবে। জি.কে., জি.আই., কারেন্ট এফেয়ার্স, রিজ়নিং টেস্ট। কত ঠিক এবং ঠাক আছি আমি আজকাল, ইদানীং, দেখাই। নীল রঙের একটা সাইকেল ভ্যান বাচ্চাদের নিয়ে ফিরছে স্কুল থেকে। সরু সরু গলার তীক্ষ্ণ কোরাসের আওয়াজ চিঁ চিঁ করতে করতে চলে গেল। আজ মঙ্গলবার। কিছু একটা পুজো-টুজো হবে হয়তো বা। পাশের কোনো বাড়িতে শাঁখে ফুঁ পড়ল তিনবার। তৃতীয়বারের ফুঁতে বেশি জোর পেলো না ফুঁ দাত্রী। আচ্ছা, যদি ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার কী করতে ভালো লাগে, আমি কি বলতে পারবো, আমার ‘দেসরাগশ্চ দ্বিতীয়প্রহরে নিশি’ কথাটা বারবার উচ্চারণ করতে ভালো লাগে?
4 comments:
Golpota pore chup kore gelam. Ekebare ek ovinobo kabyovasha pelam...ek onyo ucchota sporsho koreche e golpo... Hats off boss (Y)
"আর পরদিন থেকে কি এক ভয় কোত্থেকে এসে চেপে ধরলো আমাকে। চিনিনা জানিনা কি এক ভয়। এরকম দম বন্ধ করা, শ্বাসরোধী একা লাগছে কেন বুঝতে পারছি না… হয়ত ভয় পাচ্ছি… হয়ত বুঝতে চাইছি না… যদি সেই কারণটা এই একার থেকে বেশি জোরালো হয়…? সারাদিন ধরে একটার পর একটা সিনেমা দেখে যাচ্ছি… যতক্ষণ দেখছি, ততক্ষণ, নিরাপদ লাগছে সব কিছু। সিনেমা ফুরোলেই, সারা ঘর, টেবিল, খাট, বইয়ের তাক, এমন কি ফ্যানের হাওয়া, সব চেপে আসছে… একের পর এক সিগারেট খেতে খেতে আর একটার পর একটা সিনেমা দেখতে দেখতে আমি কি কারোর আসার জন্য অপেক্ষা করছি? সবকটা সিনেমা দেখা শেষ হয়ে গেলে তখন আমি কি করব, সেটাও আরেকটা ভয়। কি মনে হল, fbটা খুলে চলে গেলাম এক মৃত মানুষের অ্যাকাউন্টে… কেন গেলাম? "
ওহহহহহহ ! কি জীবন্ত কি জীবন্ত সব দৃশ্য- অসুখের কি নিপাট বর্ণনা খাপছাড়া অশান্তি ডুকরে ঊঠেছে প্রতিটা শব্দে । এমন একটি ভ্রমণ যা প্রাথমিক পর্বে নেহাত ভ্রমণেরই পাঠ নিয়ে আসে তারপর মেরি গো রাউণ্ড ছলকে ওঠে অসীম দ্যুতিতে কৈশোর থেকে কেউ ডাক ছাড়ে
"সন্ধ্যেবেলা, খেলার মাঠ থেকে ফিরে, আধো আলো আধো অন্ধকারে, কলতলায় হাত-মুখ ধুচ্ছি, আর চিৎকার করে বলছি, মাআআআআআআআআ….. খেতে দাও খিদে পেয়েছেএএএএ…. "
একী সত্যিই মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া ? নাকি কিছুটা মা কিছুটা সংগদোষ কিছুটা আত্মভ্রমন এ কেমন ডাক যা শুধু ফিরে আসে অসুখকালীনসময়ে অসময়ে
" আচ্ছা, যদি ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার কী করতে ভালো লাগে, আমি কি বলতে পারবো, আমার ‘দেসরাগশ্চ দ্বিতীয়প্রহরে নিশি’ কথাটা বারবার উচ্চারণ করতে ভালো লাগে? "
একটা ডোণ্ট কেয়ার দায়িত্ববোধে ছেড়ে দেয় অর্জুন ! যেখানে যাবে যাক্ ! নাগরদোলা এই চেনা পৃথিবীর স্বরূপ বাঁই বাঁই ঘুরিয়ে দিয়ে নেমে আসছে নীচে শীতল মাটির দিকে । আমাদের মাথায় তখন ঘুরন্ত জাড্য বাঁধভাংগা ! থামতে গিয়েও ছিটকে যাচ্ছে একটা ভালো থাকা একটা গল্প একটা গল্পের ছায়া
এই মাতনে বাঁচিয়ে রাখো খেলার আসর
"এত মন কেমন নিয়ে এই শহরের জল ছুঁইনি কখনো, আগে। এত জল এত মেঘ এত শহরও এই শহরে দেখিনি আগে। একটা বাসার নাম রাখা হয়েছিল, অক্ষরবৃত্ত। না, বরং বলা ভালো, রাখা হবে এমনটাই ঠিক হয়েছিল। এখন সেখানে ছন্দ কম, পড়িয়াছে। কিন্তু আমি জানি, মাত্রা অক্ষর পর্বে নয়, ছন্দ সব থেকে বেশি বাস করে যতির বাসায়। তবে, যতিতে থাকে স্মৃতি। তার পূর্বের সবটুকুর চলা ডুবে থাকে, মিশে থাকে যতির চুল থেকে নখ। একটা বাসার নাম রাখা হয়েছিল, অক্ষরবৃত্ত। এখন যতিতে এসে, সে বাসা, জ্বলজ্বল ও ছলছল করছে। বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতেও কি থাকে না বন্যার জল, মিশে?"
এই একাকীত্ব আর পিছুডাক এভাবেই বুক ফুঁড়ে চালান করো ফানেলে
There lies the heat of summer
On your cheek’s lovely art:
There lies the cold of winter
Within your little heart.
That will change, beloved,
The end not as the start!
Winter on your cheek then,
Summer in your heart.
সব ভেংগে যাবার তছনছ হয়ে যাবার গর্জনশীল মেলোডি রেশ ধরে থাকুক শিরায় শিরায় স্পন্দনে । জয় রক \m/
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
আত্মধ্বংসী শ্বাসরোধী এই একা এবং একা থাকার দমফেটে যাওয়া বাঁচার সময়ে একের পর এক সিনেমা দেখার এই অদ্ভুত যোগটা তোর-আমার লেখার সাথে কিভাবে যেন মিলে গেল !!! লেখাটায় তবে আরো অনেক বেশ কিছু স্কোপ ছিল মনে হয়। যেখানে কিছু এবাসার্ডনেস/ইমেজারি দিয়েছিস সেই জায়গাগুলোকে আরো এক্সপ্লোর করলে পারতিস। ছোট লেখার প্ল্যান থাকলেও প্ল্যান ক্যানসেল ক'রে লেখা যেত।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন