মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৪

সম্পাদকীয় - ৩য় বর্ষ ১০ম সংখ্যা


সম্পাদকীয়




শীত নিয়ে কিছু লিখব ভেবেছিলাম।পাটালি গুড়ের গন্ধ,সতেজ সবুজ সবজি ,লেপের ওম, মিঠে রোদ্দুর এইসব নিয়ে ।কিন্তু মুস্কিল করলো ল্যাপটপে বাজতে থাকা সেই গানের কলিটা -চালচুলো নেই তার ,নেই তার চেনা বা অচেনা ... চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার শহরের সেই পাগলটার মুখ ! এই তীব্র শীতের রাতে যে সারা গায়ে ছাই মেখে ,আগুন জ্বেলে গাছের নিচে ঘুমিয়ে আছে (নাকি জেগে ?) ! মাথার পোকাগুলো নড়ে উঠলো ! এই দুনিয়ায় কত মানুষ আছে যাদের মাথার ওপর ছাদ নেই ? শুধুই আকাশ ! গুগল জানালো ,ইউনাইটেড নেশনের হিউম্যান রাইটস কমিশনের ২০০৫ সালের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ,মানে ১০০০০০০০০ ! ২০১৪তে কি সংখ্যাটা কমেছে আদৌ ? দি একশন এড ২০০৩ সালে সমীক্ষা করে দেখেছে শুধু ভারতবর্ষেই আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৮ মিলিয়ন ! CRY ( চাইল্ড রিলিফ এন্ড ইউ ) ২০০৬ সালে হিসেব করে দেখেছে ভারতে ১১ মিলিয়ন শিশু রাস্তায় বাস করে ! যদিও ২০১১ সালের সরকারী তথ্য বলছে ভারতে মাত্র ১৮ লক্ষ মানুষ গৃহহীন !!! আচ্ছা , এইসব তথ্যের কচকচানি থেকে মুখ সরিয়ে আমরা যদি মাত্র একজন মানুষের কথাই ভাবি ! দীর্ঘ শীতের রাতে তার মাথায়,গায়ে ,ছেঁড়া চাদরে তীরের ফলার মতো ধেয়ে আসা একেকটা শিশিরের ফোঁটার কথাই ভাবি ! বন্ধুরা তার দমবন্ধ করা কাশির শব্দ শোনা যায় না কি ?

সেই গল্পটা মনে পড়ল যদিও সত্যি ঘটনাকে গল্প বলা যায় কিনা ঠিক জানি না ! বিদ্যাসাগর একবার তাঁর মায়ের গায়ে সুতির চাদর দেখে একটা ভালো শাল কিনে আনলেন।কিন্তু ভগবতী দেবী সেটি পরলেন না , রেখে দিলেন বাক্সে ! বিদ্যাসাগর একদিন তাই দেখে কারণ জানতে চাওয়ায় ভগবতী দেবী বললেন ,এই গাঁয়ে তাঁর অনেক ছেলে-মেয়ে আছে যাদের এই ঠান্ডায় পরার মত কিছুই নেই ,তিনি সেখানে এই গরম চাদর কিভাবে পরবেন ? বিদ্যাসাগর তারপর প্রত্যেকের জন্যে গরম চাদর এনে দিয়েছিলেন !

লিখতে বসেছিলাম শীতের কথা ,শীতের সুখের কথা ,নিবিড় লেপের ভেতর পাশ ফিরতেই যাদের গালে লাগে সঙ্গিনীর তপ্ত নিঃশ্বাস -তাদের কথা ! কিন্তু জীবনের মতো কথাও কথা রাখে না , অন্যদিকে ঘুরে যায় ! কিন্তু ঘুরে গিয়েও বা কী হয় ? যদি কবিতা হয় কিম্বা একটি সম্পাদকীয় , তাতেই বা কী !! কবিতা কি লেপের ওম হতে পারে ? কারোর মাথার ওপর ছাউনি ? 
কলম তরবারির চেয়ে শক্তিশালী ,সত্যি বিশ্বাস করেন আপনারা ?




ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে - নীলাঞ্জন সাহা 




উত্তর সম্পাদকীয় - চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না

অবিশ্বাসযোগ্য যৌনহেনস্থার অভিযোগে ক্ষতি মেয়েদেরই
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য



“ঠোঙ্গা ভরা বাদাম ভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না।” কি অনবদ্য লাইনটাই না লিখেছিলেন সুকুমার রায়! এতদিন পরও দেখা যাচ্ছে তাঁর বলা লাইনটা এক্কেবারে চুল-টু-পা ট্রু। আমাদের মাথার উপরে স্ব-মনোনীত অবিভাবকের মত বসে থাকা মিডিয়া-মনোহরেদের সম্পর্কে সুকুমার রায় কত বছর আগেও বিন্দাস আজকের হাল মানসচক্ষে দেখে আকাশবাণীর মত বলে রেখে গেলেন, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। ইদানিং মিডিয়াই কেবল খাওয়ায়, আরে সুকুমার রায় কতদিন আগে এদেরকেও খাইয়ে গেছেন, ভাবা যায়!

কিছুদিন আগে শতবর্ষে পা দেওয়া এক সাংবাদিকের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কলকাতার এক সিনিয়ার সাংবাদিক বলছিলেন, “মিডিয়ার এখন নতুন নতুন বিট হয়েছে, যার মধ্যে পড়ে ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ। কোথায় কে কি মন্তব্য করল, তাঁর জন্যেও সতর্ক থাকতে হয়।” তারি সর্বশেষ এক মনহারক নিদর্শণ দেখা গেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আশোক গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে এক ল’ইন্টার্নিকে যৌনহেনস্থার অভিযোগে। অভিযোগ সত্যি না মিথ্যে, তা প্রমাণের অপেক্ষা না রেখেই মিডীয়াবাগীশরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিচার করতে। বিচার বলে বিচার, এক্কেবারে পঞ্চায়েতী রাজ। গাঁয়ের খবর পত্রিকা পেলে লুফে নিত! অভিযুক্তের মতামত শোনার দরকারই নেই। “অহম গাঁয়ের পঞ্চজন, মনে করিয়াছি, অভিযোগ সিত্য এবং অভিযুক্তই অপরাধী। ব্যস” হয়ে গেল পঞ্চায়েতের রায়। রায় মানলে সম্পত্তি ছেরে পালা, না মানলে গাঁয়ের বার করে দেব। অর্থাৎ, সোজাই যাও আর বাঁকা, তুমি যাও ঢাকা কিংবা মক্কা।

মামলাটার পূর্বাপর একটু ভেবে দেখুন, বেশ মজা পাবেন। ঐ মহিলা ইন্টার্নি ঘটনার এক বছর পর এ-বছর নভেম্বরে নিজের ব্লগে এঁকে লিখলেন ‘সম্প্রতি’ ঘটা এক কাহিনী বলে। সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতি ২০১২-র ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিজের হোটেলের রুমে তাঁকে ওয়াইন অফার করেছিলেন, মাথায় ও পিঠে হাত দিয়েছিলেন, হাতে চুমু খেয়েছিলেন। মহিলার মনে হয়েছিল এগুলি “আনওয়েলকাম বিহেভিয়ার’। তাই চলে আসতে চেয়েও ঐ বিচারপতির সঙ্গেই সে রাতে ডিনার  খেয়ে তারপর ফেরেন। বিচারপতিই তাঁকে বাড়ি ফেরার গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন এবং গাড়ি পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে যান। সেখানেই তাঁর মনে হল, বিচারপতির আচরণ ‘অনওয়েলকাম বিহেভিয়ার, কিন্তু তিনি সেটা ব্লগেও প্রকাশ করলেন ২০১৩-র নভেম্বরে’, ১১ মাস বাদে।

এবার সূত্রগুলি মেলান। ঐ মহিলা খ্রিস্টান, তাই ২৫ ডিসেম্বর তাঁর উৎসবের রাত। উচ্চশিক্ষিতা ঐ মহিলা অন্য পার্টিতে যাওয়ার কথা ছিল। সে-রাতে খ্রিস্টান্দের ওয়াইন খাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ তা অফার করলে তা বরং তাঁদের রীতি মানার ভদ্রতা বলে গণ্য হওয়ার কথা। কোনও খ্রিস্টান বাড়িতে পৌষ সংক্রান্তির দিন যদি আপনাকে পিঠে খেতে দেয়, আপনি কি ভাবতেন? আনয়েলকাম বিহেভিয়ার হলে তো তাঁর তখনই চলে আসার কথা! তিনি সেখানে বসে ২৫-৩০পাতা টাইপ করার পর ডিনার খেয়ে বিচারপতিরই আনা গাড়িতে বাড়ি ফিরতেন না। এবং এ-সবই যদি মেনে নেয়া হয় যে মহিলাটিও ভদ্রতার খাতিরেি তৎক্ষণাৎ রিঅ্যাক্ট করেন নি, তাহলেও সেই অভিযোগ জানানোর জন্যে ১১ মাস! বিশ্বাস্য? এক জন আইনজীবির আচরণ কি বলছে?

আইনের ছাত্রী হিসাবে তিনি ভালই জানেন, যে কোনও ফৌজদারী অপরাধের অভিযোগ তখনই গ্রাহ্য হয়, যখন পুলিশে অভিযোগ এফআইআর বা জেনারেল ডায়েরি হিসাবে দায়ের করা হয়। পুলিশ তাঁর তদন্ত করে, মামলা হয়য় নিম্ন আদালতে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে জেলা আদালত, হাই কোর্ট তারপর সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে যায়। নদীর জল যেমন পাহাড় থেকে গড়িয়ে এসে সমুদ্রে এসে মেশাই তাঁর স্বাভাবিক পথ, উল্টোটা নয়; মামলার ক্ষেত্রেও ওটাই তাঁর স্বাভাবিক নিয়ম, উল্টোটা নয়। কিন্তু, বিচারপতির গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ঘটনায় দেখা গেল সমুদ্রের জল নদী বেয়ে পাহাড়ে যাচ্ছে।

বলার কারণ, মামলাটা নিম্ন আদালতে এলই না। কারণ, পুলিশে আজও কোনও অভিযোগই দায়ের হয় নি। ফলে জেলা আদালত, হাইকোর্ট ইত্যাদি সব ফালতু হয়ে গেল। সোজা গেল সুপ্রিম কোর্টে… না সেখানেও কোনও মামলা হয়য় নি, কেউ করেনি। প্রধান বিচারপতি স্বতপ্রণোদিত হয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি করলেন অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখতে। সেই কমিটি আসলে প্রশাসনিক তদন্তের, বিচারবিভাগীয় নয়। রিপোর্টে সেই মহিলা ‘আনওয়েলকাম বিহেভিয়ার এর কথাই পুণরুক্তি করে প্রাথমিকভাবে তারাও অভিযোগের খানিকটা সত্যতা পেয়েছেন, যদিও বিচারপতি গাঙ্গুলী তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের কমিটি বলে দিন, “যেহেতু ঘটনার সময় বিচারপতি গাঙ্গুলী সুপ্রিম কোর্ট থেকে অবসর নিয়েছেন, তাই এই অভিযোগের বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার এক্তিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই।” তা ছাড়া ‘এই ল’ইন্টার্নি স্টেলা জেমসও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে যুক্ত নন’ বলে সর্বোচ্চ আদালত এ নিয়ে কিছুই করতে পারে না। দেখুন, একথা বলছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বের কমিটি, যিনি নিজেই বিচারপতির গাঙ্গুলীর অবসর উপলক্ষে প্রদত্ত পার্টিতে ছিলেন। তিনি কি এই কমিটি গড়ার আগে জানতেন না যে উনি ঘটনার আগেই অবসর নিয়ে নিয়েছেন? জানতেন না যে অভিযোগকারিনী সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাক্টিশ করেন না? সে অজ্ঞানতার দায় কার? অজ্ঞানতাপ্রসূত একটি মন্তব্য যে গোটা ঘটনায় একজন বিচারপতির মর্যাদায় কালি ছেটাল, তাঁর কি হবে? সুপ্রিম কোর্ট এমন মন্তব্য করার ফলে মামলাটি আর নিম্ন আদালতে গেলেও সুবিচার দূর অস্ত। ফলে, গোটা বিষয়টাই কেচিয়ে এল। যদি, সত্যি বিচারপতি গাঙ্গুলী অপরাধীও হন, তাও তো তাঁর ন্যায্য বিচার সম্ভন নয়!

তাহলে এমনটা হল কেন? এর উদ্দেশ্যই বা কি? এর পিছনে কি কোনও কোট-আনকোট ষড়যন্ত্র আছে বা ছিল?

এগুলিই এখন জরুরি প্রসঙ্গ। এই লেখা লেখার সময়েই জানা গেল, এত দেরিতে অভিযোগ জনসমক্ষে আনায় সুপ্রিম কোর্টও বিরক্তি প্রকাশ করেছে। কিন্তু, সত্যি বললে, মেয়েটি কিন্তু কোনও অভিযোগই জানায় নি। সে ব্লগে লিখেছিল তাঁর কথা – তা সে ঠিক বা বেঠিক – যাই হোক। তাকে মুখোরোচক করে খবরে এনেছে নির্দিষ্ট একটি সংবাদপত্র। তারপর অন্য মাধ্যমগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ে। কি ছিল সেই সংবাদ মাধ্যমের উদ্দেশ্য? প্রাপ্ত অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই না করে ব্লগের ভিত্তিতে খবর কতটা যুক্তিসংগত? এ সব নানা প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তারপরই দেখা গেল, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিচারপতি গাঙ্গুলীর অপসারণ চাইলেন। তিনি অবশ্য এক বচর আগে থেকেই বিচারপতি গাঙ্গুলীর উপর ক্ষুব্ধ। রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান হিসাবে তিনি পার্ক স্ট্রিট ধর্ষোণ থেকে অম্বিকেশ মহাপাত্র মামলা, শীলাদিত্যকে মাওবাদী বলে অন্যায় গ্রেফতারের মত ঘটনা সহ বহু ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মনোভাব গোপন রাখেন নি, বরং বলেছিলেন, ““মানবাধিকার কমিশনে একজনকে আমরা বসালাম, তিনি এসে আমাদের বিরুদ্ধে রায় দিচ্ছেন।” যেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিয়োগে সুপারিশ করেছেন বলে তাঁকে রায় দেওয়ার সময় ধামাধরা হতে হবে! এ কেবল হাস্যকর দাবীই নয়, বিপজ্জনকও। কোনও রাজ্যের বা দেশের প্রধান যদি এই দাবী করেন, তাহলে ধরে নিতে হবে সে রাজ্যে বা দেশে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটেছে। যে বিচারপতি শ্রীমতী গান্ধীর নির্বাচনকে অবৈধ রায় দিয়েছিলেন, তাঁর নিয়োগও কিন্তু শ্রীমতী গান্ধীর সরকারি দিয়েছিল। তিনি কিন্তু এমন উদ্ভট তর্ক তোলার কথা স্বপ্নেও ভাবেন নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পদত্যাগ চেয়েছিলেন। এছাড়া কলকাতার আইন বিশ্ববিদ্যালয় এনইউজেএস-এর একদল অধ্যাপক সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর পদ থেকে বিচারপতি গাঙ্গুলীকে সরাতে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়েছেন। এতেও আশ্চর্যের কিছু নেই। আইনজীবি কল্যাণবাবু তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ এবং দুর্মুখ, এটা সকলেই জানেন। মুখ্যমন্ত্রী ইস্তফা চাইলে সভাসদেরা যে ‘বলে তাঁর শতগুণ’, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ইস্তফা চেয়েছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের শীর্ষকর্তারাও, কারণ বিচারপতির সেদিনকার রিপোর্টে ক্লাবের বিপুল টাকা জরিমানা হয়েছিল। এই শীর্ষকর্তা আবার একই দলের রাজ্যসভা সাংসদ, অর্থাৎ সভাসদ। তাঁরা যে অপসারণ চাইবেন, এতে বিষ্ময়ের কি আছে!

বিষ্ময়ের বিষয় এল কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত সলসিটার জেনারেল (এএসজি) ইন্দিরা জয়সিংহ কলকাতায় এসে অভিযোগকারিণীর লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করে এবং দিল্লিতে সংসদে বিরোধী নেত্রী বিজেপির সুষমা স্বরাজ বিচারপতির ইস্তফা চাওয়ায়। অভিযোগকারিনী সুপ্রিম কোর্টের তিন-সদস্যক কমিটিকে যে মৌখিক বিবৃতি (কেন মৌখিক, তাও প্রশ্নবোধক) দিয়েছিল, তাঁর কপি অভিযুক্ত বিচারপতি গাঙ্গুলীও পান নি, কারণ সেটি ছিল আদালতের সম্পত্তি। আদালতের সম্পত্তি কিন্তু সরকারের নয়। দি-তিন দিন পর সেটাই মুখ্যমন্ত্রীর প্রসাদধন্য কলকাতার এক বাণিজ্যিক কাগজে ছাপা হয়ে গেল! তাতে লেখা হল, কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রকের মাধ্যমে তাঁরা ঐ বিবৃতি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক এমন কাজ করতে পারে কি? আইন মন্ত্রক বেআইনি কাজ করে বসে নি তো? সেখানেই জানা গেল, অভিযোগকারিনী ম্যেটির নাম স্টেলা জেমস। নাম তো প্রকাশ তো বেআইনি! হল কেন? কারা করল? এএসজি ইন্দিরা জয় সিং কি করে সেই বিবৃতি প্রেস কনফারেন্সে প্রকাশ করলেন, যা সুপ্রিম কোর্টের ভাষায় ছিল গোপনীয়’?

এমন বহু প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য। ইতিমধ্যে আরেকজন বিচারপতির বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে, এবং এ-ক্ষেত্রেও অভিযোগকারিনী কলকাতার আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ইন্টার্নি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আবার কেন্দ্রীয় গ্রিন ট্রাইবুনালের প্রধান বিচারপতি, যিনি পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ আদালতটি কলকাতায় খোলার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। তা ছাড়া, তাঁর দফতরে গিয়ে আটকে আছে এমন বহু বিনিয়োগের প্রকল্প, যেগুলি আদতে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। এমনই এক প্রকল্পে বাঁধা দেওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে জয়ন্তী নটরাজনের মত স্পষ্টবক্তা মন্ত্রীকে সরে যেতে হয়েছে।

ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যৌনহেনস্থার এ-সব অভিযোগ কি আসলে বিচারপতিদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হল? এখনই এই নিয়ে চূড়ান্ত মতামত না দিলেও এমন প্রশ্ন ওঠাকে কিন্তু আটকানো যাচ্ছে না। নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্টের অনেক আইনজীবিই, যঅধিকাংশই মহিলা, এখন এই নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছেন। তাঁরা চিন্তিত, এর পর বিচারপতিরা মহিলা ইন্টার্নদের আর সুযোগ দেবেন তো? এমনকি চেম্বার অ্যাডভোকেট হিসাবেও মহিলা আইনজীবিদের সুযোগ সত্যিই কমে গেল কি না! যদি একটি ঘটনাতেও প্রমাণিত হয় যে, অভিযোগটি কেবল মিথ্যাই নয়, ষড়যন্ত্রমূলক; সে ক্ষেত্রে অভিযোগকারিনীর পরিচয় গোপন রাখা যাবে তো? অভিযোগকারিনী যদি বয়ান বদল করে থাকেন, তাহলে আইনের চোখে তিনিই হয়ে যাবেন ‘কন্ডেমন্ড লায়ার’, বা স্বঘোষিত মিথ্যাবাদী। গুজরাত দাঙ্গার বেস্ট বেকারী মামলায় এই কারণে শাস্তি পেয়েছেন তিনি, যার পরিবারের প্রায় সবাই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন। এমন হলে কিন্তু সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হবে মহিলাদেরই। স্বার্থের ষড়যন্ত্রে আর কেউ জড়িয়ে পড়ার আগে, এই পরিণতিটাও মনে রাখা ভাল।



(বাকিটা পরের সংখ্যায়)

উপন্যাস - শৌনক দত্ত

একুশে শ্রাবণ
শৌনক দত্ত



১#
কতদিন ধরেই একটা অস্পষ্ট ভয়ানক স্বপ্ন দেখছি।আজো স্বপ্নটা দেখার পরই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।ঘড়ির কাটায় মাত্র রাত বারটা আঠাশ,মানে বাকীটা রাত আমাকে এভাবেই জেগে কাটিয়ে দিতে হবে।খুব ছেলেবেলাতেও আমি এমন বিদঘুটে স্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠতাম। বর্ষা আমায় একটা মন্ত্র শিখিয়েছিলো।আজ এত বছর পরে তা আর কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। বর্ষা আমার মামাতো বোন।জন্মতারিখ সুত্রে আমরা দুজনই একুশে শ্রাবণ জন্মেছি ও উনিশ শ সত্তর,আমি উনিশশআশি!বয়সে ও আমার দশ বছরের বড় হলেও আমি ওকে নাম ধরেই ডাকি। মা খুব বকে।কে কার কথা শোনে।বর্ষার বাবা মানে মিষ্টি মামাকে আমি কখনো চোখে দেখিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনারা তাকে তুলে নিয়ে যায় তারপর তার আর কোন হদিশ পাওয়া যায়নি।

সবাই তাকে মৃত ভেবে নিলেও আমার মা এবং মামী এখনো ভাবেন মিষ্টি মামা ফিরে আসবেন।এসেই মাকে ডেকে বলবেন ফুলমনি ওই ফুলমনি একটা নতুন সুর করেছি শুনে যা! মিষ্টি মামাকে আমি সাদা কালোয় মা র ফ্যামিলি এলবামে দেখেছি। একটা জীবন্ত মানুষ এভাবে ছবি হয়ে যেতে পারে এটা মেনে নিতে যে আমার কষ্ট হয়নি তা নয়।ছোট্টবেলায় তো এত বুঝতাম না স্কুলে,বাসায় বন্ধুদের মামা আসতো। মামা মানে কি তা না বুঝলেও তখন একটা ব্যাপার বুঝতাম মামা মানে খেলনা,চকলেট আরো কত্ত কি সঙ্গে বেসুমার আদর।ব্যতিক্রম মামাও ছিলেন যেমন ঋদ্ধির মামা আসা মানেই ঋদ্ধির বিকালের খেলা বন্ধ,স্কুল থেকে ফিরে আঁকা তারপর সাঁতার এরপর পড়া আর পড়া।তখন মিষ্টিমামার জন্য আমার খুব কান্না পেতো।অবুঝের মত মা কে বলতাম মা পাকিস্তানিদের বল না আমার মামাকে পাঠাতে মা তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো আর বলতো আসবে,ঠিক আসবে বাবাই তোর মামা।তখন কি আর বুঝতাম, ফুলের মালা নিয়ে ঝুলে থাকা ছবি,স্পর্শে দাঁড়ায় না কোনদিন।



মিষ্টি মামা..

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন অরুনকে প্রথম রাজপথ,মিছিল,পোস্টার লেখা চেনায়।অরুনের একটা বিশেষ গুণ ছিলো,তখনো গান লেখা,সুর দিতে না পারলেও ওর গানের গলাটি তখন খাসা।আন্দোলনের এই দিনগুলোতে অরুন সারাটা দিন পত্রিকা আর রেডিও নিয়ে বসে থাকে। সেই যে বাহান্ন তাকে বিপ্লবের দীক্ষা দিয়েছিলো একাত্তরে খান সেনা তুলে নিয়ে যাবার ক্ষণ পর্যন্ত সেই দীক্ষা,আদর্শ থেকে টলতে দেখা যায়নি অরুনকে।বাহান্নতে অরুন সক্রিয় না থাকলেও এরপর থেকে সে সরাসরি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। বাহান্নার আগে পর্যন্ত অরুনের জগত বলতে পড়া,গান।আর তেপান্নতে তার আপন জগতে এলো আদরের ছোটবোন

ফুলমনি।কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকা তখন বিভূতিভুষণের পথের পাঁচালির সেই কাশফুল ঘেরা রেললাইনটির মত।অরুন ফুলমনিকে প্রথম যেদিন রেলগাড়ি দেখাবে বলে নিয়ে গেলো সেদিনও শরতকাল!দুই ভাই বোন কাশবনের মধ্য দিয়ে ছুটছে রেল লাইনের দিকে তখনই ধোঁয়া ছেঁড়ে চলে যায় ট্রেন।তারা দুজন

থমকে দাঁড়ায় ফুলমনি আনন্দে কি যেন বলতে থাকে ট্রেনের শব্দে সেইকথা মিলেমিশে ট্রেনের সাথে চলে যায়।ট্রেন চলে যাবার পর

একটা অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে অনেকটা ঠিক প্রতীক্ষীত মানুষটির আগমনের পর তার বিদায় বেলার মত!অরুন তখন গত

সপ্তাহে শোনা একটি গান টান দেয়'আমি কেমনে সে গাঁয় যাই রে। কি কব সেই পড়শীর কথা ও তার হস্ত পদ স্কন্দ মাথা নাইরে।ও সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।পড়শী যদি আমায় ছুঁতো আমার যম যাতনা সকল যেত দূরে।'ফুলমনি তখন মুগ্ধ শ্রোতার মত কেউ দেখলে বলবেই না এই মেয়ের বয়স ছয়।অরুন মুচকি হেসে ফুলমনিকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ীর দিকে হাঁটতে থাকে আর রেলব্রীজ পেরিয়ে দিনের আলো দিগন্তের ওপারে নিখোঁজ হতে পা বাড়ায়।



বর্ষা..

দরজায় বেলের শব্দ।রোজকার মত পিন্টু বেরিয়ে গেছে কাজে।অফিস শেষ করে বাড়ী ঢুকতে ঢুকতে তার সন্ধ্যা সাতটা কম করে।গত কয়দিন ধরে রোদের দেখা নেই।এমনিতেই পিন্টুহীন এই সময়টুকু তার কাটতেই চায়

না।মেঘলা দিনে অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে ওঠে তার।টিভি নিজের মত চলতে থাকে।তাকায় না।মোবাইল ফোন

নিয়ে শুয়ে আপনমনেই কনট্যাক্ট লিস্ট দেখে যায়,কল করে না।আবোলতাবোল চিন্তা হয়,পুরনো কথা মনে পড়ে।স্কুলের

বন্ধু,আত্নীয়স্বজন,ছে­লেমেয়ে এমনকী পলাশের কথা মনে হয়। পলাশের কথা মনে পড়লেই এখনও রাগ চাপতে পারে না সে।

আজও প্রতিদিনের মত ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে সকালের কাগজটা নেড়েচেড়ে দেখার চেষ্টা করছিল,কিছুই মাথায় ঢুকছিল

না।বেলের শব্দে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। কে এল?তার ছেলে অংশু কিংবা মেয়ে মোম? অংশু আর মোম পলাশের সাথে থাকে।

কত্তবছর ওদের দেখে না বর্ষা। সে কয়েকবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পলাশ ওদের এমন মন্ত্র দিয়েছে যে ওরা তাকে মা স্বীকার

করতেই রাজী না।সারাদিন শুধু কাঁদতো বর্ষা।এ নিয়ে প্রথম প্রথম বর পিন্টু অনেক বুঝিয়ে তাকে শক্ত হতে শিখিয়েছে। এখনো কান্নাকাটি করলে পিন্টু অসহায়ের মত মুখ করে বোঝায়।হাজার হোক মা র মন,সে কি আর এত সহজে নাড়ির টান ছিঁড়তে পারে। তবে পিন্টুর ছলছলে চোখ দেখে তখন নিজেকে মনে মনে শক্ত করে নেয় বর্ষা।তাড়াতাড়ি বর্ষা পেপার ফেলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।দরজা খুলতেই সামনে এক অচেনা ছেলে। হাতে একটি কার্ড ও কয়েকটি কাগজ।

-শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অরুন স্যারের মেয়ে ম্যাডাম বর্ষা?

-হ্যাঁ আমিই।

কাগজে একটা দাগ দিয়ে, কার্ডটি ওয়ালে রেখে কি একটা লিখে,ম্যাডাম! হাজব্যান্ড নেইম কি পলাশ নাকি পিন্টু?

দ্বিধাহীন উত্তর দিলো বর্ষা, পিন্টু।

কার্ডটি বর্ষার হাতে দিয়েই ছেলেটি বিনম্রভাবে বললো আসবেন কিন্তু অবশ্যই।বর্ষা খামে একপলক চোখ বোলালো তারপর স্মিত

হাসিতে বললো,দেখি চেষ্টা করবো। দরজাটা লাগিয়ে সোফায় এসে বসলো বর্ষা।টি-টেবিলে রাখা খামটিতে তখন কয়েকটি অক্ষর মেঘলাদিনেও জ্বলজ্বল করছে। 'শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অরুন অমর রহে'তার নিচে লেখা মাননীয়া, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কন্যা বর্ষা।

স্বামীঃপলাশ কেটে লেখা পিন্টু ও তাদের সন্তানেরা।



২#
১৯৫৪...

মুসলিমলীগের পরজায় আর যুক্তফ্রন্টের বিজয় যেন অরুনের জীবন চাকায় মোড় ঘোরালো।বাবার রাগারাগি আর মার

আদরকে বুকে ধরেই সে পালিয়ে এলো কলকাতায়।সেই কবে একবার বাবার হাত ধরে এই শহরে এসেছিলো অরুন।

কলেজস্ট্রীট,জোড়াসাঁকো,শ্যামবাজার,পা­র্কস্ট্রীট ঘুরতে ঘুরতে এই শহরটা তখন তার খুব আপন মনে হয়েছিলো।আজ এতবছর

পর এই শহরে এসে সেই মায়াটা তার কেটে যায়নি দেখে তার বেশ লাগলো।শিয়ালদা ষ্টেশন থেকে সে হাঁটতে থাকে কলেজষ্ট্রীটের

দিকে।এই শহরের রাস্তাঘাট ছাড়া কেউ তাকে চেনে না।সেও রাস্তাঘাট ছাড়া কাউকে চেনে না।

কোথায় থাকবে?কি করবে? ভাবনাটা জেঁকে বসতে চাই ছিলো কিন্তু

পকেটে হাত দিতেই পকেটে রাখা টাকা আর মার দেয়া তার কানপাশা দুটি পলকেই অরুনের মেজাজটি ফুরফুরে করে দিলো।

হাঁটতে হাঁটতে ফেভারিট কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো অরুন।ভেতর থেকে সিগারেটের গন্ধের সাথে ভেসে আসচ্ছে রকমারী কন্ঠস্বর। শ্বেত পাথরের একটি টেবিল বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিলো একটি ছেলে ভাঁড়ে চা রেখে যেতেই অরুনের চা তেষ্টা যেন

জোরেজারে পেলো।চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখ তার ছানাবড়া।এদিক ওদিক যেদিকেই চোখ মেললো কোথাও যেন একটি টেবিলও খালি নেই।

-দাদা,চা খাবে?

একটু আগে এই ছেলেটিকেই সে বাইরে থেকে দেখেছিলো।ঘোর কাটিয়ে অনেক কষ্টে অরুন জবাব দিলো।

-হ্যাঁ।একটু জলও দিও।

ছেলেটা কথার উত্তর পেয়েই তাকে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত বার দুয়েক দেখেই চলে গেলো।

-দাদা,এই চা আর জল।

এখানে দাঁড়িয়ে খাও ঐ যে তিন নম্বর দেখছো এটা এক্ষুণি খালি হবে।তারপর ওখানে গিয়ে বসো।

তুমি কি পূর্বপাকিস্তান থেকে এসেছো?

অরুন তার কথায় হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে জলে চুমুক দিলো। ছেলেটা বারবার এ টেবিল সে টেবিলে চা দিচ্ছে আর

অরুনকে দেখছে।প্রথমে ব্যাপারটা এত আমলে না নিলেও কয়েকবার চোখাচোখি হতেই অরুন প্রথমে তার

ব্যাগটা দেখলো তারপর পকেটের ওপর হাত রেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলো। ভাঁড়ে চা খেলে মাটির একটা গন্ধ পাওয়া যায়।অরুন ভাঁড়ের চায়ে খরতাপে মাটি শুকিয়ে যাওয়ার দিনে হঠাত্ বৃষ্টি এলে প্রথম কয়েক ফোঁটার পড়ার পরেই যে সোঁদা গন্ধটা নাকে আসে,ভাঁড়ে প্রথম চুমুকে সেই গন্ধটাই মিলেছে।গন্ধটা যখন নিজে নিজে আবিষ্কার করলো তখন চা প্রায় শেষ।

সেই ছেলেটা এগিয়ে এলো।পাশে দাঁড়ালো। গলার স্বর একটু নামিয়ে জানতে চাইলো,-তুমি অরুন না? অরুনকে এই অচেনা নগরে কেউ চিনেছে। তাতে তার আনন্দ হবার কথা তা না সে বিস্ময় মাখা চোখে ছেলেটির দিকে তাকালো। -আমাকে চেনোনি?আমি নিতাই গো! তোমাদের মরা বন্ধে থাকতাম।তোমার সাথে ছয় ক্লাস পড়েছি। অরুন তখন ভাল করে দেখলো আরে নিতাই তুই!

-আমি কিন্তু তোমারে এক দেখাতেই চিনছি।তোমার থুতনির দাগটা দেখছি এখনো যায়নি।সেই ধাক্কাটা আমিই তোমায় দিয়েছিলাম কিন্তু এত্ত ভয় পেয়েছিলাম তোমার

রক্ত দেখে..

-নিতাই,পাঁচ নম্বরে ছয়টা চা দে।

কাউন্টারে বসা লোকটি হাঁক দিলো।ঐ দিকে একপলক তাকিয়ে নিতাই অরুনের দিকে তাকালো।

-বসো।আমি এক্ষুনি আসচ্ছি।বলেই নিতাই ছুটলো। নিতাই চা আনতে গেলেও চোখটা তখনো অরুনের দিকেই। থুতনি কাটার ঘটনাটা সে মনে করতে ডুব দেয়ে স্মৃতির গভীরে।হাতড়ে বেড়ায় অতীত,চলচ্চিত্রের মতো ক্যানভাস দৌড়ে যায়,স্কুল থেকে বাড়ী,বাড়ী থেকে অশেষডাঙ্গার মাঠ,মাঠ থেকে পদ্মবিল,পদ্মবিল

থেকে নদী,তারপাড়ের শরতবেলা ঘুরতে ঘুরতেই খেয়াতলীর হাটে অরুন খুঁজে পায় দুইটি শিশুকে যারা খেয়া পারাপারের পয়সা নেই বলে পরনের ধুতি মাথায়বেঁধে মরা নদী পার হয়ে গিয়ে আর ফিরে আসতো প্রতি হাটে।খুঁজে পায়দুইটি অন্তরঙ্গ বন্ধুকে যাদের নাম অরুন আর নিতাই।চেনার আনন্দে অরুন চেয়ার থেকে উঠে জড়িয়ে ধরেছিলো নিতাইকে। ততক্ষণে তার মনে পড়ে যায় পিছন থেকে ধাক্কা মারা নিতাই কে সে দেখেছিলো কিন্তু পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে থুতনি কাটার অপরাধে সে নিতাইকে দায়ী করেনি বরং নিজেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে এটাই বলেছে সবাইকে।কাজের ফাঁকে একটা দুটো কথা আর চা দিয়ে একটু পর পর নিতাই এসে খালি বলছে আর একটু বসো একসাথেই বেরুবো।আর একটু যে এতটা সময় তবু অরুনের এই প্রতীক্ষায় কোন বিরক্তি ছিলো না। যখন অরুন আর নিতাই একসাথে বেরুলো বাইরে তখন জোছনা উপছে পড়ছে।

-এই দিকটায় কি ভাল থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে?

-আছে তো।ঐ সামনে গিয়ে বাঁয়ে।

-আমাকে একটু নিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা করে দিবি?

বিস্ময়ে তাকায় নিতাই।

-কেন?তুমি ঐসবে থাকবে কেন?

-দেখ,আমি এখানে পড়তে এসেছি। আমি তোকে ছাড়া কাউকে চিনি না তাও তোর দেখা মিলবে এভাবে ভাবিনি।

-বেশ।তবে তুমি আমার সাথে আমার বাড়ীতে থাকো যতদিন থাকতে চাও।

-কিন্তু তোর বাড়ীর লোকজন..

-বাবা মারা গেছেন দুবছর হলো আর

মা তো সেই ছেলে বেলাতেই।থাকার মধ্যে আছে আমার বৌ যে তোমাকে দেখলে খুশিই হবে।

শিয়ালদহ পর্যন্ত হেঁটে এসে ওরা ট্রেন ধরলো।

বেলঘড়িয়া স্টেশনে এসে ওরা নামলো। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই দুজনে দুটো চারমিনার ধরালো।

-এই যে রাস্তাটা দেখছো এটা দিয়ে সোজা এগিয়ে ডানে মোড় নিলেই তুমি পৌঁচ্ছে যাবে আমার বাড়ী। কয়টা দিন

আমরা একসাথে চলতে ফিরতে থাকলেই তুমি সব চিনে যাবে।তা গানটা এখনো কর তো নাকি?

-হ্যাঁ করি।

ওরা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে হাঁটতে থাকে।এমন একটা এলাকা যে কলকাতার

মধ্যে আছে এখানে না এলে জানাই হতো না অরুনের।ছোট ছোট চালা ঘর। ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি বসতি আর লোক।

-এই দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।

হ্যারিকেন মুখের কাছে রেখে নিতাইয়ের বৌ রাধিকা বেরিয়ে এলো।নিতাইয়ের

দিকে তাকিয়েই অরুনকে দেখলো একপলক।

-এই হচ্ছে আমার অরুন।

-ও মা,ইনিই বুঝি অরুন দা!কথাটা বলেই

হ্যারিকেনটা মাটিতে রেখে ঘোমটা টেনে অরুনকে প্রনাম করতে যাচ্ছিল রাধিকা।অরুন তাকে ফেরালো।

-প্রনাম লাগবে না।তা তোমার নামটাই তো নিতাই বললো না আমায়।

-আমার নাম রাধিকা।আপনার বন্ধু রাধা ডাকে।

নিতাই হাসচ্ছে।অরুন পকেটে হাত দিয়ে মার কানপাশা দুটো বের করে রাধিকার হাতে দেয়।নিতাই আর রাধিকা অবাক হয়ে তাকায়।

-আরে,কলকাতা আসার আগে মা এটা দিয়েছিলেন যেন বেছে দিয়ে কিছু করি। না বেছে বরং তোমাকে প্রথম দেখার মুখ

দেখাই দিলাম।



৩#

নিতাইয়ের কর্মস্থল ফেভারিট কেবিনে আসা কার কার সাথে কথা বলে নিতাই অরুনের আর্ট কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলো।এক বছরের ফুলমনিকে ফেলে এসে যখন প্রায়ই মন খারাপ হয় অরুনের রাধিকা তখন ছোটবোনের সেই কষ্ট ভোলাতে এগিয়ে আসে।

-দাদা,ফুলমনি এখানে নেই তো কি হয়েছে তোমার আরেকটি ছোটবোন আমি তো আছি এখানে।রাধিকার এমন কথায় অরুন আর মন খারাপ করে থাকতে পারেনা।হেসে উঠে। কলেজ শেষ করে নিতাই এর ঠিক করে দেয়া কয়টা টিউশন করে ফিরতে ফিরতে কোন কোন দিন একটু বেশিই রাত হয়ে যায়।রাধিকা তখন মায়ের ভূমিকায়,পথ চেয়ে না খেয়ে বসে থাকে।অরুন বেশ কয়েকদিন এভাবে না খেয়ে বসে থাকতে বারণ করছে তাকে,কে কার কথা শোনে। আগে নিতাই ও অরুনের না ফেরা পর্যন্ত খাবার পেতো না গত কয়েকদিন আগে অনেক বুঝিয়ে নিতাইয়ের খাবারটা সময় মতন জুটিয়েছে অরুন। কিন্তু রাধিকা নিজে না খেয়েই বসে থাকে।কোন কোন দিন রাধিকা যখন অরুনকে শাসন করে,দূর থেকে শুনলে মনে হবে অরুনের মা যেন সাক্ষাত কথা গুলো বলছে।খাবার জন্য,বেশী বেশী রাত জাগা আরো কত্ত কিছুর জন্য যে রাধিকা অরুনকে শাসন করে।অরুন মুচকি মুচকি হাসে,মাঝে মাঝে পাশের ঘর থেকে নিতাই একটু পোড়ন অমনি রাধিকা তেলবেগুনে জ্বলে ওঠে।

-আমার দাদা,আমি তাকে কি করবো,কি বলবো আমি বুঝবো তুমি কে হে এখানে নাক গলাতে আসার।

-বা রে!অরুন আগে আমার বন্ধু তারপর না হয় তোমার দাদা।

এই তর্কবিতর্ক চলতেই থাকে রোজ। আর অরুন হাসেতে থাকে।



৪#

রাধিকা,নিতাই...

রাধিকা কোচবিহারের মেয়ে।জন্মের পর থেকে বাবা জাতীয় দেবতা ছাড়া বাবা বলে সে কাউকে ডাকেনি। যখন বুঝতে শিখেছে বাবা না থাকার কষ্ট,যখন বুকে চিনচিন ব্যথা জাগাতো তখন একদিন সাদা থান পড়া মা জানালো তার বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজ সৈন্যের গুলিতে শহীদ হয়।এরপর থেকেই রাধিকা যেখানেই শহীদদের নাম পায় সেখানেই তার বাবার নাম খুঁজে বেড়ায় কিন্তু কোথাও পায় না! কোচবিহার শহরটি পরকল্পিত একটি নগর।কোচ বংশের এই রাজারা যেমন ধার্মিক,উদার

তেমনি শিক্ষা,শিল্প সাহিত্য ক্রীড়া এবং স্বাস্থ্যসেবায় উত্সাহী এর ফলেই আসামের

কামাক্ষ্যা মন্দির,কোচবিহার শহরের মদনমোহন

মন্দির,দেবীবাড়ী কিংবা শিবমন্দিরের সাথে গড়ে তুলেছেন সুনীতিস্কুল,রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন স্কুল,এম জে এন স্টেডিয়াম,এম জে এন হাসপাতাল। আছে সাগরদীঘি,বৈরাগী দীঘি আরো অনেক কয়টা দীঘি।রাধিকা আর তার মা রানীবাগান থাকে।একচিলতে জমি রাজার দান। দেশভাগের একবছর আগে নিতাইয়ের বাবা নিতাইকে নিয়ে কোচবিহার আসে।নিতাইকে জন্ম দিতে গিয়ে নিতাইয়ের মার মৃত্যু হয়। বুঝতে শেখার কাল থেকে সে মা কিংবা বাবা বলতে তার বাবাকেই জানতো।



৫#

কলকাতা ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত বাংলার রাজধানী হওয়ায় ঘটিদের কথা যে পরিমানে প্রচার ও গুরুত্ব পেয়েছে,বাঙ্গালদেরটা তেমন পায়নি। ইংরেজ আমলেই ভাষাগত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ চালু ছিলো তার একটিতে বলা হয়েছেঃপূর্ববঙ্গবাসীদের

আশীর্বাদ অভিশাপের সমান কেননা ওরা 'শ' কে 'হ' বলে।তাই কাউকে 'শতায়ু হও' বলতে গিয়ে বলে ফেলে 'হতায়ু হও'। ভাষা নিয়ে এই বঙ্গ বিদ্রূপ শুনতে শুনতে পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালরা এক

সময় কিছুটা হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে।তখনকার কোচবিহারও এর

বাইরে ছিলো না।এখানে ঘটি না থাকলেও কামতাপুরীরা ছিলো, যারা পূর্ববঙ্গের বাঙালি কে কলকাতার মতই বাঙ্গাল

আখ্যা দিয়ে অবজ্ঞার প্রকাশ ঘটায়। কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করেই উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের সৃষ্টি হওয়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গীয়দের উচ্চম্মন্যতার পাশাপাশি পূর্ববঙ্গীয়দের হীনম্মন্যতাও ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে। নবজাগরণকে পশ্চিমবঙ্গ এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে তাতে মনে হবে কলকাতা ও তার আশেপাশেই নবচেতনা ঘটেছে।মনেই হয় না যে,পূর্ববঙ্গের বিশাল এলাকায় নবজাগরণের কিছুমাত্র ছোঁয়া লেগেছিল,কিংবা বাঙালির নবজাগরণে পূর্ববঙ্গীয়দের কোনো অবদান আছে।ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বিচারে পূর্ববঙ্গই যে প্রকৃত বাংলা এবং এখানকার মানুষই যে বাঙালি জাতির মূল অংশ-এ সহজ

সত্যটা পর্যন্ত বিস্মৃতির তলে চাপা দেয়া হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর রাধিকাকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম

খাচ্ছিলো রাধিকার মা।গয়না,বাসনপত্র বেছে আর কত চলা যায় অগত্যা অনেকদিন আগে থেকে রাধিকার মামার দেয়া প্রস্তাবটাই গ্রহন করে ঘরবাড়ী ভাইয়ের হাতেই তুলে দিলেন।রাজার দেয়া জমি বিক্রির সাধ্য তো নেই অগত্যা থাকা খাওয়া শর্তে মা মেয়ে একটু সুখে থাকার আশায় আপন ঘরে হলেন পরবাসী।তবু মনের কোথাও একচিলতে আশা বেঁচে থাকে রাধিকা পড়ছে একদিন

পড়ালেখা করে বড় হবে। কিন্তু সেই আশা আশাই থেকে গেলো।অস্থির সংসার আর কষ্টের ঝড় বুকে নিয়েই রাধিকার মা ও এক ঝড়ের রাতে ইহলোক ছেড়ে গেলেন।মা র মৃত্যুর বছর কয়েক পরেই রাধিকার পড়া বন্ধ হলো। একদিন মামাতো বোনটিকে টিউশনে দিয়ে ফেরার পথে মহারাজা ক্লাবের সামনে রাধিকার সাথে দেখা হলো নিতাইয়ের।নিতাইয়ের বাবা কি একটা কাজে যেন রাধিকার মামার কাছে আসেন রোজ। মাঝেমাঝে নিতাইও আসে।নিতাই এলে রাধিকার মামী এটা সেটা করিয়ে নেয় সেইসূত্রে রাধিকা নিতাইকে চেনা কিন্তু কখনো কথা হয়নি ওদের।নিতাই কিছু একটা ভাবে।তারপর এগিয়ে আসে।

-এই দিকে কোথায়? রাধিকা একটু হেসে

-বাবলিকে পড়তে দিয়ে গেলাম মাষ্টারমশাইয়ের বাড়ীতে।

-ও,আচ্ছা।

-তা তুমি এখানে কি কর?

-একজন কলকাতায় একটা চাকরী দেবেন

বলেছে তার খোঁজেই এসেছি।

-অনেকদিন হলো তুমি আমাদের

বাড়ী যাও না।কেন গো?

-এমনি।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে রাসমেলায় এসে ঢোকে।কোচবিহারের রাসমেলার মাঠ জুড়ে বাহারী দোকান। ওরা মদনমোহন বাড়ী ঢোকে।মেলার সময় সোনার মদনমোহন মন্দির থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসেন। ওরা প্রনাম করে পুরোহিত চরনামৃত দেন সঙ্গে টুকরো সন্দেশ।নিতাই পকেট থেকে প্রনামী থালায় পয়সা দেয়।রাস ঘুরিয়ে অন্যসব দেবী দেবতার মন্দির প্রদক্ষিণ করে ওরা বেরিয়ে আসে। মন্দিরের নহবতখানায় তখন করুন সুর বাজচ্ছে।

-কিছু কিনবে?

-না বাবা।এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেলো এবার আমি বাড়ী যাবো। দুইজনে হাঁটতে হাঁটতে সাগরদীঘি পর্যন্ত এলো।সাগরদীঘির

জলে পরিযায়ী পাখিদের ভিড় তখন একটু একটু বাড়ছে। সবে পাখি আসতে শুরু করেছে দূর দেশ থেকে।শীতের

সময়টা সাগরদীঘিতে তাই সবসময় নানান বিদেশী পাখির মিলনমেলা। শীত শেষে ওরা আবার ফিরে যায়। নিতাই বিদায় নিয়ে ফিরে যায়,আর রাধিকা মনের ভেতর অচেনা এক আনন্দে যেন উড়েছে বাড়ীর দিকে।

এই দেখার পর আরো বার কয়েক নিতাই আর রাধিকার দেখা হয়েছে।তার কিছু মাস পরেই নিতাই চলে এসেছে কলকাতায়।



৬#

না থাকার আক্ষেপ যে পাবার সুপ্ততায় কখন মনের মাটিতে অঙ্কুরিত হয়ে যায় মানুষ তা জানতেও পারে না।জন্মের পর

থেকেই পরের জমি,পরের জায়গায় থাকতে থাকতে নিতাইয়ের ভেতরে কখন যে নিজের একটা ঠিকানার তৃষ্ণা জেগেছিলো তা নিতাই ই জানে না। অথচ এই নিতাই গানের আড্ডা বসলেই অরুনকে বলতো 'অরুন আমার প্রিয় গানটা ধর না'আর অরুন তখনি দরাজ গলায় গাইত-'পরে জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই। আমি তো ভাই ঘরের মালিক নই' অরুনকে ছেড়ে আসার বেদনা বাজে নিতাইয়ের গভীরে। নিতাইয়ের ভেতরের নিতাই জেগে ওঠে। তার কান্না পায়।এ জীবনে আর হয়ত অরুনের গান শোনা হবে না।রাস্তায় হাঁটা হবে না আর উদভ্রান্তের মত।এই দেশভাগ,রাজনীতির মারপ্যাঁচ তার কাছে অর্থহীন মনে হয়।মনে হয় সব বিচ্ছেদের বেদনা অনতিক্রান্ত একজীবনের দৌড় যা ফুরবে না। রাধিকার মামা আর মামী অনেক ভেবে রাধিকার পাত্র হিসেবে নিতাইকেই বেছে নিলেন।একে তো চেনা তার উপর এই চার পাঁচ বছরেই ছেলেটা কলকাতায় চাকরী,পারটাইম,ভোরে সবজীর ব্যবসা করে বেলঘড়িয়ায় একটুকরো জমি বায়না করেছে। তাছাড়া মা মরা মেয়েটার যদি নিতাইয়ের সাথে বিয়ে হয় কোচবিহারের এই জমি ফেরত চাইতে নিতাই সাহস পাবে বলে মনে হয় না।এছাড়া সাইকেল রেডিও সোনাদানা দিয়েও বিয়ে দিতে হবে না।রাধিকার মামী রাধিকার কাছে বিয়ের কথাটা তুলতেই লজ্জা রাঙা হয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রাধিকা। রাধিকার মামী বুঝলেন নিতাই ছেলেটা রাধিকার অপছন্দ নয়।এবার নিতাইয়ের বাবার মত হলেই হলো। দিন তিনেক পর এক সন্ধ্যায় নিতাইয়ের বাবার কাছে কৌশলে রাধিকার মামা কথাটা তুললো।

-কি হে ছেলের বয়স তো বাড়ছে বই কমছে না।তা বিয়ে ঠার কথা কি কিছু ভাবলে?

-না,কর্তা।বিয়ের কথা বলেই নিতাই খালি বলে দেরি আছে বাবা আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই।

-ছেলের তো এখন ভাল রউপর জমি বায়না করেছে কলকাতার মত শহরে।তা বলছিলাম কি জানো আমার টাকাটা তো দিয়ে দিলেই ল্যাটা চুকে যায় মাত্র তো চারশ আটচল্লিশ টাকা বার আনা।

-দিয়ে দেবো কর্তা আর কয়েকটা মাস,এত বছর যখন ফাঁকি দিয়ে আপনার টাকা খাইনি এই কয়টা টাকাও মেরে খাবো না।

-ছিঃছিঃছিঃ।আমি কি সেই কথা বলেছি উপেন,বলছিলাম এত কষ্টের পর বাবা মহাকাল তোমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন,তোমার সোনার টুকরো ছেলে।কিন্তু আমার দিদি যে আমায় গুরু দায়িত্ব দিয়ে রেখে গেছে।মা মরা মেয়েটার যে বিয়ের বয়স হলো ওর বিয়ের কথা ভেবে রাতে ঘুম আসে না।ওর মা তো টাকা কঁড়ি কিছু রেখে যায়নি সেটা তো তুমি জানোই যা করতে হবে তা আমাকেই করতে হবে আর আমার গাঁটের খবরটাও তো তুমি জানো তাই ভাবছিলাম টাকা পয়সা গুলো তুলে এখন কন্যাদায় মুক্ত হই।তাই বলছিলাম টাকার কথা।

-ছোটমুখে একটা বড় কথা কই কর্তা। যদি রাধিকা মা কে আমার নিতাইয়ের সাথে...



৭#

কিংশুকের মিষ্টি মামা যখন তমা কে বিয়ে করে আনলেন ফুলমনি তখন পনের।অরুন বিয়ের পরে তমাকে ক্ষ্যাপাতে ইয়ার্কি করে গেয়ে উঠতেন মুক্তির ও মন্দির ও সোপান তলে কত

প্রাণ হলো বলি দান লেখা আছে অশ্রুজলে।তমা তখন ফুঁপিয়ে কাঁদতো।

তমা ভাবতো তাকে বিয়ে করে অরুন হয়ত সুখী না নিভৃতে কাঁদে।ফুলমনি একদিন গানের মানেটা বুঝিয়ে দিলে তমা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যায়। ফুলমনি হারমনিয়ামে 'এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে বাহির হয়ে এসো'গানটা তুলছে। অরুন পাশের বসার ঘরে বসে কি যেন পড়ছে।তখনই খবরটা পেলো ফুলমনি কাজের মাসির কাছে।গান থামিয়ে লাফিয়ে উঠলো ফুলমনি দৌড়ে গেলো মার ঘরে,মা ঘরে নেই তমার ঘরে গিয়ে মা ও তমাকে পাওয়া গেলো। মা আমি নাকি পিসি হচ্ছি? তমা হাসলো,মা হেসে বললো হ্যাঁরে পাগলি। ফুলমনি আবার দৌঁড়ে বসার ঘরে এসে দেখে ভাইয়ার কাছে কারা যেন এসেছে।রাজনৈতিক কথা বার্তা চলছে সেখানে। ফুলমনি অরুনের কানে কথাটা ফিসফিস করে বললো।বলেই অরুনের হাত ধরে টানতে লাগলো।

-তুই যা,আমি এখুনি আসচ্ছি কথাটা শেষ করে।

ফুলমনি একটু গাল ফুলিয়ে ধীর পায়ে ফিরে এলো অরুন তমার বেডরুমে। ফুলমনির এই চেহেরা দেখে তমা অবাক হয়ে বললো

-কি হলো? দাদা বুঝি তোমার দেয়া খবরটা শুনেও মিটিং ছেড়ে এলো না।রাগ করেনা মনি।দেশের যে অবস্থা তুমি তো জানো তোমার দাদার এখন কত্ত কাজ।এসো আমার কাছে এসো। পলকেই মন খারাপ ভুলে ফুলমনি তার রাজ্যের খেলনা এনে জড়ো করলো এই ঘরে।

-মনি,তুমি ছেলে চাও না মেয়ে? ফুলমনি একটু ভাবলো তারপর একগাল হেসে বললো

-আমার একটি মেয়ে ডল চাই।

-ও মা।কেন?

-ছেলে হলে ও আমার সাথে খেলবে না।দাদার মত মিটিং করবে আর মেয়ে হলে ও সবসময় আমার সাথে থাকবে,খেলবে।আমি ওকে স্নান করিয়ে সাজিয়ে দেবো।গান শেখাবো। একসাথে ঘুরতে যাবো। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অরুন আর তার মা ফুলমনির কথা শুনছিলো কথা শেষ হতেই অরুন এসে জড়িয়ে ধরলো ফুলমনিকে ওরে আমার পাকনী বুড়ি। বেশ কয়দিন ধরেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি সঙ্গে ঝড়।বাইরে যাবার উপায় নেই।ফুলমনির বড়দা অরুন ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে গেলো।অরুন বেরিয়ে যাবার কয়েক ঘন্টার পরই তমার প্রসব ব্যথা উঠলো। ফুলমনি ভিজতে ভিজতে বাড়ীর পাশের থানায় গিয়ে পরিচিত পুলিশদের বলে কয়ে একটি এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে বাড়ী এলো।প্রসব বেদনায় কাতরানো তমার ছটফট আরো বেড়ে গেছে তার আর ঘামছে।

-ফুলমনি,অরুনকে পেলি?

-না মা।তবে এম্বুলেন্স আসচ্ছে এখুনি।

-তুই এম্বুলেন্স পেলি কোথায়?

-থানার চাচাকে বলে ফোন করিয়েছি। পাড়ার একজনের কাছে খবরটা পেয়ে অরুনও ফিরে এলো ততক্ষণে তমাকে এম্বুলেন্সে তোলা হয়ে গেছে।

বৃষ্টি কমার নামই নিচ্ছে না।রাস্তায় জল জমতে শুরু করেছে।রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা।আর অপরেশন থিয়েটারের সামনে আতংকিত মুখ।এই বৃষ্টি অবজ্ঞা করে আত্মীয়স্বজনরাও এসে জড়ো হচ্ছে।হাসপাতা জুড়ে গুমট হাওয়া।অপরেশন থিয়েটারের লাল বাতিটা নিভে গেলো।ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।

-আর একটু দেরী হলে সমস্যা হতো।এখন

যেতে পারেন মা মেয়ে দুজনেই এখন সুস্থ। অরুনের এক সহযোদ্ধা কথাটা শুনে অজু করে এসে আযান দিলেন নবজাগতের কানে।

ফুলমনির সাহসিকতা আর বুদ্ধিমত্তার জন্য অরুন ফুলমনিকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো।এরই মাঝে শুরু হয়ে গেলো নাম

নির্বাচন কেউ বলে তুল্য,কেউ সূর্যস্পর্শা,আরো কত কি নাম ফুলমনির এক চিত্কারে সবাই থমকে গেলো।আমার

ডলের নাম আমি রাখবো বলেই মার কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নবজাতকের কপালে ঠোঁট

ছুয়ে ফুলমনি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চোখ ফিরে এনে বললো আজ থেকে ওর নাম বর্ষা।অরুন

হাততালি দিয়ে বলে উঠলো শ্রাবণমাস তার উপর অঝোর বৃষ্টি ফুলমনির দেয়া নামটা একদম যথার্থ।ফুলমনির

মা ও আরো কেউ কেউ মনক্ষুণ হলেও অভিমান চেপে রেখে হেসে উঠে সায় দিলো।আর ফুলমনির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।

ঐদিকে তমার মুখেও মাতৃত্বের এক অবর্ণনীয় হাসি।তমাকে দেখলে বোঝাই যাবে না একটু আগেও এই তমাই ব্যথায় কাতরাতে কারতে নীল হয়ে উঠেছিলো।এখন তার মুখে লাল আভা।সমস্ত ব্যথা যেন জাদুর পরশে গায়েব।সন্তানকে বুকের পাশে হাত বোলাতে বোলাতে সে কাঁদচ্ছে।কখনো হাসচ্ছে যেন তার চোখে বিস্ময়।মা হওয়াটা যে একটি নারীর পরম প্রাপ্তি তমাকে দেখে তা আরো দৃঢ় হলো অরুনের।মাতৃত্বের সাথে সাথেই একটি নারীর রূপের যে আমূল পরিবর্তন ঘটে তা তমার তোড়জোড়েই বোঝা যাচ্ছিলো।সারাটা রাত জেগে কাটালো ফুলমনি আর তমা।অরুন কখন যে ঘুমিয়ে গেছে।ফুলমনি কাঁথা পালটে দেয়,কান্না জুড়লেই তমা বুকের দুধ খাওয়ায়।কাথা ফেলে দিলে ফুলমনি কাঁথা ঠিক করে দেয় একটু পরে পরে হাত দিয়ে দেখে কাঁথা ভিজলো কিনা।হাতে পায়ে তেল দিয়ে দেয় তমা আর কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে আদর করে।চুমু খায়।



৮#

সঙ্গীত শিক্ষা ও সলিল চৌধুরী...দেশাত্ববোধক গান দেশ ও জনগণের প্রতি নিবেদিত গান, যা স্বদেশী সঙ্গীত নামেও পরিচিত। জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে এ গান রচিত হয়। গানের বিষয় যখন হয় দেশ তখন তাকে বলা হয় দেশাত্ববোধক গান, আর জনগণ হলে তাকে বলা হয় গণসঙ্গীত। দেশাত্ববোধক গানের এই দুটি ধারা। বাংলা দেশাত্ববোধক গানের সূচনা হয় উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ঈশ্বর গুপ্ত ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গীতের মাধ্যমে। এরপর উনিশ শতকের মধ্যভাগে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এর পর্যায়ক্রমিক বিকাশ ঘটে। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ীর‘জাতীয় মেলা’ এবং ‘সঞ্জীবনী সভা’ ছিল এর লালন ক্ষেত্র। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সঙ্গীতের এই নতুন ধারা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। এ সময় থেকে ইংরেজ শাসনের বিরূদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা সৃষ্টি এবং স্বাজাত্যবোধ জাগরিত করার জন্য একের পর এক দেশাত্ববোধক গান রচিত হতে থাকে। দেশের ঐশ্বর্য বর্ণনা এবং দেশের বীর নায়কদের বীরত্বগাথা এসব গানের বিষয়বস্তু। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুল, মুকুন্দদাস, ইকবাল, তালিম হোসেন, ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবি ও গীতিকার প্রচুর দেশপ্রেমমূলক গান রচনা করেন। দেশের কোন সংকটময় মুহূর্তে দেশাত্ববোধক গান জনগণের

মনে আশা ও শক্তি সঞ্চার করে। বাংলা গণসঙ্গীতের সূচনা হয় ১৯৪৩ সালে গণনাট্যসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই সঙ্ঘের সাঙ্গীতিক

কার্যক্রমের একটি বিশেষ ধারাই ছিল গণসঙ্গীত। বিনয় রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখ তাঁদের অনন্যসাধারণ প্রতিভাবলে সঙ্গীতের এই নতুন ধারাকে সম্প্রসারিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন। তাঁরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীত

এবং রাবীন্দ্রিক ও পাশ্চাত্য সুরধারাকে গণসঙ্গীতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। সলিল চৌধুরী কর্তৃক ব্যবহৃত পাশ্চাত্য

সুরধারাই পরবর্তীকালে গণসঙ্গীত রচনায় গুরূত্বপূর্ণ ভৃমিকা পালন করে। গণসঙ্গীতের মুখ্য উদ্দেশ্য শ্রমজীবী মানুষকে সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরূদ্ধে সোচ্চার করা, অন্যায়ের বিরূদ্ধে তাদের সংগঠিত ও সংগ্রামশীল হতে উদ্বুদ্ধ করা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার আদায়ের মাধ্যমে একটি সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ জোগানো। বিশ শতকের মধ্যভাগে গণসঙ্গীতের দুটি বিশেষ চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। এ সময় জাতীয় মুক্তি অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে এমন কিছু গান রচিত হয় যা ইংরেজ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির আন্দোলনে প্রচণ্ড শক্তি জোগায়। সেসব গান শুনে দেশের মুক্তিকামী যোদ্ধারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হন। এর পাশাপাশি কিছুটা ভিন্ন ধরনের অনেক গান রচিত হয় যার বক্তব্য ছিল একটি শোষণহীন সমানাধিকারসমপন্ন সমাজ গঠন করা। এ প্রসঙ্গে চারণ কবি মুকুন্দদাস এবং নজরূলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের দুজনের গানেই ভারতের রাজনৈতিক মুক্তি এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার ধারণা প্রকাশ পায়। নজরুল যখন সৈনিক হিসেবে করাচি ব্যারাকে ছিলেন তখন তিনি রুশ বিপ্লবের সাফল্য ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা জেনেছিলেন। তাই তাঁর গানে বিশেষভাবে দেশের স্বাধীনতা এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়। পর্যায়ক্রমে গণসঙ্গীতে আন্তর্জাতিক ধ্যান-ধারণা যুক্ত হয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শোষিত মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ এবং সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ প্রভৃতি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করা এ গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।অনেকদিন ধরে একটি স্বপ্ন অরুন লালন করছে।ফেভারিট কেবিন থেকে বেরিয়ে সরবতের দোকান প্যারাডাইডের কাছে আসতেই অরুন দেখলো তার স্বপ্ন পুরুষ সলিল চৌধুরী দাঁড়িয়ে। নিতাইকে বলতেই নিতাই তাকালো।

-কথা বলবি উনার সাথে?

-চিনি না জানিনা কি কথা বলবো। যদি রেগে যায়।

-আরে আমি তো চিনি সলিল দাকে চল কথা বলিয়ে দেই। নিতাই অরুনকে নিয়ে এগিয়ে যায়। জটলার মাঝেও সলিল চৌধুরী নিতাইকে ঠিক দেখলেন।

-নিতাই যে,কি খবর কেমন চলছে সংসার।

-ভাল দাদা।কিন্তু একটা কথা বলার ছিলো।

-বলে ফেল।রজত,জীবন কি আজ এসেছিলো তোর ঐখানে?

-না তো।

-বেটারা সব গেল কোথায়?তা কি যেন বলবি বল।আমি আবার একটু পার্টি অফিসে যাবো।সামনে প্রোগ্রাম দেখি গিয়ে কি করছে ওরা।

-দাদা,এ আমার বাল্য বন্ধু অরুন পূর্ববঙ্গ থেকে এসে আর্ট কলেজে পড়ছে ওর গানের বড্ড শখ। যদি আপনি..

-বেশ তো চল পার্টি অফিসে নিয়ে দেখি ওখানে কেমন গায়।যদি ঠিকঠাক থাকে তবে মেজেঘঁষে তুলে দেবো এবারের অনুষ্ঠানেই।তা ভাই অরুন কমিউনিষ্টে এলার্জি নেই তো? বলেই সলিল চৌধুরী হাসতে লাগলেন। নিতাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই অরুন বললো না, কমরেড! অরুনের গায়কি।সুর তাল বোধ আর তার সাথে রাজনৈতিক পড়া লেখাটা সলিল চৌধুরীকে মুগ্ধ করলো।মুখে কিছু না বললেও তিনি অরুনকে গানের তালিম নেবার ব্যবস্থা করে দিলেন।কোন গান সুর করে অরুনকে শোনান।অরুন ও বাধ্য ছাত্রের মত শেখে নিজের মতামত দেয়। ধীরে ধীরে অরুন হয়ে ওঠে সলিল চৌধুরীর ছায়া সঙ্গী।রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় অরুন এখন পার্টিতেও সক্রিয় এবং জনপ্রিয়।তার মতামত এখন আলোচনায় আসে। পার্টির কাজে প্রায় রাতেই অরুনের বাড়ী ফেরা হয়না।রাধিকা গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।ভোর রাতে ফিরে অরুন দেখে রাধিকা তার অপেক্ষায় বসে আছে।অরুনের খুব খারাপ লাগে।

-আমার জন্য সারারাত এভাবে বসে কাটালে শরীর খারাপ করবে যে তোমার।

-করুক।তোমার কি? যত নষ্টের মূল তোমার ঐ বন্ধু।তুমি এইসব পার্টি ফার্টি ছেড়ে দাও দাদা। আঁকা,গান নিয়েই তো ভাল ছিলে কেন এইসবে জড়ালে।নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই।আয়নাটায় মুখটা একবার দেখো কি হাল করেছো সোনার অঙ্গের। একদমে কথাগুলো বলে কেঁদে উঠলো রাধিকা। রাধিকার কান্না শুনে ঘুম চোখে উঠে এলো নিতাই।

-আমি তো ভাবলাম বাড়ীতে ডাকাত পড়েছে এখন তো দেখি ভাইবোনের সিনেমা চলছে। নিতাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ঝামটা মেরে আঁচলে মুখ ঢেকে বেরিয়ে গেলো রাধিকা।



৯#

রাতে উঠানে বসে গান গাইল অরুন সঙ্গে নিতাই,রাধিকাও গাইলো।বেশ রাত পর্যন্ত চলেছে তাদের এই আড্ডা মাঝে মাঝে রাধিকা উঠে গিয়ে চা করে মুড়ি মেখে নিয়ে এসেছে। তখনও কিছু বলেনি অরুন কিংবা তেমন কোন আভাসও মেলেনি অরুনের কথা বার্তায়।বেশ খুশ মেজাজেই অরুন শুতে গেলো। কুয়াশার চাদর সরিয়ে মিঠেল রোদ ছড়িয়ে পড়েছে নিতাই,রাধিকার বাড়ীর দাওয়ায়।পাখির কিচিরমিচির। উঠানের একপাশে লাগানো গাঁদা গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে।নিতাই অনেক আগেই সবজী ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে গেছে।রাধিকা ঘরদোর ঝেড়েমুছে কয়লার উনুন জ্বালছে।অরুন তখনো দরজা খুলে বাইরে আসেনি তবে তার সিগারেটের গন্ধ ঘর ছাড়িয়ে রাধিকার নাকে পৌঁচ্ছে গেছে।রাধিকা অরুনের এই নিয়মটার সাথে অভ্যস্ত অরুন সিগারেটটা শেষ করে দরজা খুলবে আর প্রতিদিনের মত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দরজায় দাঁড়াবে রাধিকা। আজ দরজা খুলতে দেরী হচ্ছে দেখে রাধিকাই কড়া নাড়লো।সিগারেট ঠোঁটেই দরজা খুললো অরুন।ঘরে ঢুকেই রাধিকা বুঝলো কাল সারারাত অরুন বিছানায় গা ফেলেনি।টেবিলে বইপত্তর গোচ্ছানো ছাইদানী সিগারেটে ঠাসা।

-কি গো দাদা।ঘুমাওনি কেন?আর জামাকাপড়,বইপত্তর গুছিয়েছো কেন?

-ভাবছি আজ বাংলায় ফিরে যাবো।

-তোমার বন্ধু জানে?আমাকে তো কাল কিছু বললে না।তা আসবে কবে।

-নিতাই জানেনা।কাল রাতেই ঠিক করেছি অনেক তো থাকলাম তোমাদের ঘাড়ে।

-এভাবে কেন বলছো।বন্ধুর বাড়ী,বোনের কাছে দাদা কি বোঝা হয় কখনো। মা কে,ফুলমনিকে দেখতে মন চাইছে যাও কদিন থেকে চলে আসো আবার।

-এখানে বোধ হয় আর আসবো না।

-তোমার আর্ট কলেজ,গান,টিউশনের

কি হবে।

-কলকাতা আর ভাল লাগছেনা।

নিতাই ফিরে এসে দেখে রাধিকা উনুনের পাশে বসে কাঁদচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই অরুন তার ঝোলা ব্যাগ আর একটা বইপত্রের গাঁট্টি নিয়ে বারান্দায় এলো।

-নিতাই তুই এসে গেছিস ভালই হলো। আমি আজ ফিরে যাচ্ছি।এই চিঠিটা সলিলদা কে পৌঁচ্ছে দিস।তুই ও রাধিকা আমার জন্য যা করেছিস তা আমি জীবনেও ভুলবো না।ভাল থাকিস তোরা।

-ফিরে যাচ্ছো মানে!

-কলকাতা আর ভাল লাগছে না।

রাধিকার কান্না,নিতাইয়ের আকুতি পিছে ফেলেই অরুন হাঁটতে থাকে। রাধিকার ঝাপসা চোখে ঝাপসা হতে হতে অরুন হারিয়ে যায়।নিতাইয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।গতরাতে অরুনের গাওয়া গানটা কানে বাজে তখন'মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে'....



গন্তব্য করাচী...

কলকাতা থেকে ফিরে কয়েক দফা চিঠি চলাচালি হলো নিতাই ও সলিল চৌধুরীর সাথে অরুনের।সলিল চৌধুরীর চিঠিতেই অরুন জানতে পারে ওস্তাদ খোদাবকশ খাঁ এর কথা।ওস্তাদ করাচীতে থাকেন। অন্তরালে থাকা একজন গুণী সঙ্গীতজ্ঞ। সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন যদি ওর তালিম নিতে পারতে তবে তোমার বেশ উপকার হতো।সেই চিঠি পড়ার পর থেকেই অরুনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে করাচী যাওয়ার ফন্দি। কি করে যাওয়া যায় করাচী ভাবনাটা গাঢ় হয়ে এলে এক পূর্ণিমার রাতে মা র গয়না বাক্স চুরি করে বেরিয়ে পড়ল অরুন ওস্তাদ খোদাবকশ খাঁ এর সন্ধানে অজানা অচেনা করাচীর পথে। ফজরের আজান ভেসে আসতেই উঠে পড়েন অরুনের মা।মশারী খুলে ভাঁজ করে রাখতে গিয়ে দেখেন বালিশের পাশে একটি কাগজ।

কাগজটি তুলে এনে আলোর কাছে আনতেই বুঝলেন অরুনের চিঠি। চিঠিটা হাতে নিয়েই

দরজা খুলে দৌঁড়ে গেলেন অরুনের ঘরের দিকে।অরুনের ঘরের দরজা হা করে খোলা,মশারি তুলে দেখলেন বিছানা ফাঁকা।অরুন নেই।সদরদরজার কাছে এসে দেখলেন সদর দরজা চাপানো বেন্দা ছিটকানী খোলা। বুঝলেন অরুন বেরিয়েছে কিন্তু কোথায়?

ঘরে এসে আলোর সামনে চিঠিটা মেলে ধরলেন অরুনের মা।

-কি গো তোমার ছেলে কি আবার বিবাগী হলেন?আগেই বলেছিলাম এই ছেলে ঘরে থাকার ছেলে না।ওর বয়সে কোন ছেলেটা এমন ভবঘুরে। না উনি গায়ক হবেন,ছবি আঁকবেন,রাজনীতি করে আমার গুষ্টি উদ্ধার করবে। অরুনের মা আঁচলে চিঠিটা লুকিয়ে বেরিয়ে এলেন।

-এভাবে কেন বলছেন।হয়ত একটু হাঁটতে বেরিয়েছে এক্ষুনি চলে আসবে।

-চলে আসবে।এবার যদি উনি বিবাগী হয়ে থাকেন আমি বলে রাখলাম এ বাড়ীতে তার জায়গা নেই।হাতে ঐটা কি দেখি। চিঠিটা লুকাতে চেয়েও পারলেন না অরুনের মা।চিঠিটা পড়েই অরুনের বাবা আরো রেগে গেলেন

-এই নাও তোমার আদরে আদরে বাঁদর ছেলে তোমার গয়না বাক্স চুরি করে করাচী যাচ্ছেন।আমার বাড়ীতে চোরের কোন জায়গা নেই।গান শিখবে উনি।গিয়ে দেখো বড় বাক্সটা নিয়েছে না ছোটটা। ফুলমনি চোখ ঢলতে ঢলতে বাবা মা এর দিকে এক পলক তাকিয়ে অরুনের ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে।



১০#

করাচীতে নেমে দেবু ভট্টাচার্যকে খুঁজে পেতে অরুনের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।করাচী শহর থেকে একটু এগিয়েই সিন্ধু নদীর

ধারে দেবু ভট্টাচার্যর বাড়ী।দেবু ভট্টাচার্য তখন একটা গানের সুর করছিলেন।কিছুতেই সুরটা কথার সাথে ফেলতে পারছেন না।অরুন বারান্দায় বসে বেশ কয়েকবার সুর ও কথা শুনতে শুনতে গুনগুন করছে।ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবী পড়া দেবু ভট্টাচার্য কখন এসে দাঁড়িয়েছেন অরুন খেয়ালই করেনি।

-কি দরকার দেবু ভট্টাচার্যর সাথে? ভরাটগলার স্বরে অরুন একটু কেঁপে উঠলো।

-আমাকে সলিল চৌধুরী পাঠিয়েছিলেন। কথাটা বলতে বলতে বুক পকেটে রাখা সলিল চৌধুরীর চিঠিটা বের করে অরুন দেবু ভট্টাচার্যর হাতে দিলো। চিঠিটা বার দুয়েক উল্টেপাল্টে পড়লেন দেবু ভট্টাচার্য ।

-তা কলকাতা ছেড়ে খোদবখসের কাছে তালিম নিতে এসেছো।আমার এখানে তো লঙ্গরখানা নেই যে তোমায় বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো।যতটুকু শিখেছো তাতে যে কিছু করতে পারবে তাও তো মনে হচ্ছে না।এসো ভেতরে এসো দেখি তোমাকে দিয়ে কি করানো যায়। আর আজ বিকালে খোদাবখস হয়ত আসবে এখানে দেখি সে রাজি হয় কিনা।সলিলের যত্তসব কান্ড। অরুন দেবু ভট্টাচার্যর পেছন পেছন ঘরে ঢুকলো।

-দাদা,একটা কথা বলবো?

-বলো।

-সুরটা 'কোমল নি' থেকে ধরলে হয়ে যাবে।

দেবু ভট্টাচার্য ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে হারমনিয়ামের পাশে দাঁড়িয়ে ঠেলে দিলেন হারমনিয়ামটা অরুনের দিকে।

-দেখি তোমার 'কোমল নি'টা কি করে লাগালে সুরটা হয়।

অরুন হারমনিয়ামটা নিজের দিকে টেনে নিলো।ধ্যানস্থের মত একপলক নীরব থেকে সুরটা বাজিয়ে একটু গাইতেই দেবু ভট্টাচার্যর চোখমুখে আলোর দীপ্তি ফুটে উঠলো।

-আরে তুমি তো বেশ করিত্কর্মা ছেলে। গত সাতদিন ধরে এই সাধারণ বিষয়টা আমার মাথায় এলো না।

বসো বসো।আমার সহযোগী হয়ে কাজ করবে।এখানে থাকবে খাবে আর খোদাবখসের কাছে তালিম নেবে।যাও তোমার একটা হিল্লা হয়ে গেলো। তা তোমার নামটা যেন কি লিখেছে সলিল।

-অরুন।

-হ্যাঁ অরুন।তা তুমি এই ঘরটাতেই থাকবে।ঐদিকটায় চানের ঘর অনেক পথ পেরিয়ে এসেছো যাও চানটা সেরে নাও। আমি বরং ভেতরে গিয়ে তোমার খাবার ব্যবস্থাটা করি।



স্নান খাওয়া করে কখন অরুনের চোখ বুঁজে এসেছে অরুন জানেই না।কথা আর হাসির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো অরুনের।চোখে মুখে জল দিয়ে এসে বসেছে অমনি দেবু ভট্টাচার্যর ডাক ভেসে এলো বসার ঘর থেকে।

-এই যে অরুন এসো এসো।খোদাবখস খাঁ কে তোমার কথাই বলছিলাম কি করিশমাটা তুমি দেখালে।খাঁ সাহেব তোমাকে তালিম দিতে রাজী হয়েছেন কাল থেকেই লেগে পর।

অরুন মাথাটা সন্মতিসূচক ভাবে নাড়ালো।খোদাবখস খাঁ উঠে গিয়ে বাইরে পানের পিক ফেলে এলেন।

শুরু হয়ে গেলো এক অন্য জীবন।দেবু ভট্টাচার্যর সহযোগী হয়ে কখনো দেবু ভট্টাচার্যর সুরে গান গেয়ে আর খোদাবখস খাঁর তালিমে অরুন খুব ব্যস্ত হয়ে উঠলো সঙ্গীতে।একদিন এক আর্ট প্রদর্শনীতে পরিচয় হলো ইমরান বেগের সাথে।ইমরান স্মার্ট ছেলে।তার জলরঙের কাজ বেশ প্রসংশনীয়।কথায় কথায় বেশ বন্ধুত্ব হয়ে উঠলো দুজনের।ইমরান বেগেই অরুনকে নিয়ে গেলো তার ওস্তাদ জাভেদ মৃধার কাছে।পূর্বপাকিস্তানের অরুনকে দেখেই উনি বেশ খুশি হলেন।জয়নাল আবেদিন,সুলতানের কথা জানতে চাইলেন।কথার ফাঁকে চা এলো।চা খেতে খেতে জাভেদ মৃধা জয়নাল আবেদিন যে পূর্বপাকিস্তানে একটি আর্ট কলেজ খুলতে যাচ্ছেন সেই কথা জানালেন।অনেক রাত পর্যন্ত কথা চললো আর্ট নিয়ে।

বাড়ী ফিরে অরুন দেখলো বারান্দায় দেবু ভট্টাচার্য দাঁড়িয়ে।

-কটা বেজেছে ঘড়িতে দেখেছিস?

-দেবু দা,আমি কাল বাড়ী যেতে চাই।

-সে কি রে অরুন!চার চারটি সিনেমার কাজ হাতে এখন তুই বাড়ী যেতে চাইছিস কোন সমস্যা।

-না দেবু দা আমি তো দুটো সিনেমার গান করেই রেখেছি।মনটা মাকে দেখতে খুব কাঁদচ্ছে।

-কাল না কয়দিন পরে যা কাজগুলো নামাই তারপর।

অরুন কিচ্ছু উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো।দেবু ভট্টাচার্যও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকলেন।



১১#

করাচী থেকে ফিরে দুইদিন অরুন তার বাবার চোখ এড়িয়েই ছিলো।অরুনের বাবাও যেন দেখে না দেখার অভিনয় করে যাচ্ছিলেন কিন্তু আজ বাবা পুত্র মুখোমুখি হয়ে গেলো।

-নবাবজাদা, আপনি কবে এলেন রাজ্য জয় করে?সোনাদানা বুঝি আটমাসেই ফুরিয়ে গেছে।কী কুক্ষণে যে একটা চোর আপনার মা পেটে ধরেছিলেন।আমার বাড়ীতে চোরের কোন জায়গা নেই। তা আপনি গান করে কোন বিশ্বজয়টা করে এলেন শুনি। অরুন মাথা হেড করে দাঁড়িয়ে। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ফুলমনি আর অরুনের মা।

-আমি দেবু ভট্টাচার্যর সাথে সহসঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কয়েকটা কাজ করেছি সিনেমায় তাছাড়া ওস্তাদ খোদাবখস খাঁ,তিমির রঞ্জনের কাছে তালিম নিয়েছি।

-গুষ্ঠি উদ্ধার করে এসেছো।মনির মা এই চোর ছেলে বাড়ীতে থাকলে আমি বাড়ী ছেড়ে চলে যাবো বলে রাখছি।

-আমি কাল সকালে কলকাতায় চলে যাবো।

-যাও।এবার আপনার মার বড় গয়নার বাক্সটা নিয়ে যাবেন।অপদার্থ একটা। তোকে আমার ছেলে ভাবতেও লজ্জা হয়। কুলঙ্গার একটা। কথাটা বলতে বলেই অরুনের বাবা নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।পেছন পেছন অরুনের মাও গেলেন।

-এই ছেলে কে দিয়ে কিচ্ছু হবে না মনির মা। আমি বলে দিচ্ছি মিলিয়ে নিও। তা এবার অপদার্থটা কতদিনের জন্য যাচ্ছেন কিছু বলেছে।

-আপনি ছেলেটাকে এভাবে বলেন। ছেলে তো আর ছোট নেই ঠান্ডা মাথায় ওকে কাছে বসিয়ে একটু বোঝালেও তো পারেন।

-অপদার্থ ছেলের জন্য দরদ উত্তলে পড়ছে। উকালতি করতে এসো না যাও ছেলের জন্য গয়না বের করে দাও। অরুনের মা চলে যাচ্ছিলেন।

-শোনো, গয়নাঘাঁটি আর কত দেবে আলমারীতে কিছু টাকা রাখা আছে ওগুলো নিয়ে দাও।আর আমি দিয়েছি বলতে যেও না।তোমার জমানো টাকা বলেই দিয়ো। আলমারী খুলে টাকাগুলো নিয়ে মুচকি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। অরুন তখন ফুলমনিকে নিয়ে তার ঘরে গান গাইছে।ফুলমনিও অরুনের সঙ্গে সঙ্গে গাইছে 'অবাক পৃথিবী অবাক

করলে তুমি জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি'।



১২#

কলকাতায় এসে কাউকে কিছু না জানিয়ে অরুন চলে আসে বেলঘরিয়ায়। তখন সন্ধ্যা।তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বেলে রাধিকা প্রনাম সেরে উঠে তাকিয়ে দেখে দরজার পাশের অন্ধকারে কে যেন একটা দাঁড়িয়ে।

-কে?কে ওখানে। অরুন চুপ করে ঘরে ঢুকে গেলে রাধিকা কে,কে ওখানে বলে প্রদীপ ধুনচি হাতে দৌঁড়ে আসে। অরুন ইচ্ছে করেই গলাটা একটু পাল্টে নেয়।

-আমি থানা থেকে আসচ্ছি।নিতাই কোথায়? তার বন্ধু অরুন কোথায়?তাদের নামে ওয়ারেন্ট আছে। রাধিকা অবুঝ বাচ্চার মত কান্না জুড়ে অরুন আর নিতাইয়ের কোন দোষ নেই সাত পাঁচ বলে যাচ্ছে তার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদচ্ছে।অরুন ঘুরে দাঁড়াতেই রাধিকা এমন একটা হাসি দিলো দেখে বোঝার উপায় নেই এই মেয়েটাই একপলক আগেই কাঁদচ্ছিলো।

-কি রে কেমন চমকে দিলাম বল।

-তোমার সাথে কথা নেই যাও।

-আচ্ছা বাবা ঘাট হয়েছে।এবার চোখ মুছে কিছু খেতে দে।পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে।

-তোমার বন্ধু গতরাতেই বলছিলো তোমাকে এত চিঠি দিয়েছে একটার ও উত্তর নাকি দাওনি।

-আমি তো করাচী ছিলাম এখান থেকে গিয়েই কয়েকমাস পরেই করাচী চলে গিয়েছিলাম।

-তুমি আসবে তোমার বন্ধু জানে?

-না।ওকে বলিনি।দেখাও করে আসিনি। তোকে দেখতে খুব মন চাইছিলো তাই সরাসরি বাড়ী চলে এলাম। পরের দিন সলিল চৌধুরীর বাড়ী গিয়ে অরুন হাজির হলো।অরুনকে দেখেই সলিল চৌধুরী হেসে উঠলেন। দেবু,খোদাবখস কে নাকি খেল দেখিয়ে এলি।দেবু লিখেছিলো তার চিঠিতে।তা এবার কলকাতায় কয়দিন রে?দেখতো একটা নতুন গান লিখেছি। সুরটা ঠিক আছে কিনা।বলেই সলিল চৌধুরী হারমনিয়ামটা টেনে নিয়ে গাইতে লাগলেন। হো..ও ও হো...হা... হেই সামালো ধাণ হো, কাস্তেটা দাও শান হো জান কবুল আর মান কবুল আর দেব না, আর দেব না রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো চিনি তোমায় চিনি গো, জানি তোমায় জানি গো সাদা হাতির কালা মাহুত তুমি না জান কবুল আর মান কবুল, আর দেব না ...মোদের প্রাণ হো পঞ্চাশে লাখ প্রাণ দিছি, মা- বোনেদের মান দিছি কালো বাজার আলা করো তুমি না জান কবুল আর মান কবুল, আর দেব না ...মোদের প্রাণ হো মোরা তুলবো না ধান পরের গোলায়, মরবো না আর ক্ষুধার জ্বালায়, মরবো না ধার জমিতে লাঙল চালায়, ঢের সয়েছি, আর তো মোরা সইবো না এই লাঙল ধরা কড়া হাতের শপথ ভুলব না জান কবুল আর মান কবুল, আর দেব না ..মোদের প্রাণ হো ...দেখতো অরুন পারিস কিনা তুলতে গানটা। এটা পরশু পার্টি সন্মেলনে তুই যখন এসেছিস তোকে দিয়েই গাওয়াতে চাই।

-আমি কি পারবো দাদা?

-পারবিনা মানে।তোকে পারতেই হবে এই গান। অরুন কলকাতা থাকতেই দেবু ভট্টাচার্য কলকাতায় এলেন সঙ্গে আরেক দিকপাল জহির রায়হান। জহির রায়হান একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক,এবং গল্পকার।অরুনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে জহির রায়হানের পরিচয় ঘটেছিলো সেই রক্তঝরা বাহান্নের দিনে। জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে পূর্ব পাকিস্তান স্থানান্তরিত হন।তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া,যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাবেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়াতে। এই জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রের জন্য জহির রায়হান দেবু ভট্টাচার্যকে ধরে ছিলেছিলেন সঙ্গীত পরিচালনা করতে।দেবু বাবু জহির রায়হান কে বলেছিলেন যার রক্তে রিদম বাজে এই সিনেমার জন্য তেমন একজন তরুন অথচ টগবগে প্রতিভাবান সঙ্গীত পরিচালক চাই।তাই জহির রায়হানকে নিয়ে কলকাতায় আসা।



১৩#

গনসঙ্গীতে অরুনের দক্ষতা ও গায়িকী এখন লোক মুখে।সলিল চৌধুরীও অরুনের গায়িকীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দেবু ভট্টাচার্য ও সলিল চৌধুরী দুজনেই অরুনকে বোঝালেন এবার তার সঙ্গীত পরিচালনা করার সময় ও জ্ঞান হয়েছে এবার তাকে সুরকার হিসেবে কাজ শুরু করা উচিত।দেবু ভট্টাচার্যের ডাকে অরুন কলকাতা থেকে করাচী ছুটলো।দেবু ভট্টাচার্য তার সুরে অরুনকে একটি সিনেমায় গান গাওয়াবার সিদ্ধান্ত নিলো। রেকর্ডিং এর দিন এলো এক দুঃসংবাদ ভায়োলিন বাদকের টাইফয়েড।দেবু ভট্টাচার্যের তো মাথায় হাত সব লাইভযন্ত্রীরা এসে গেছে এখন ভায়োলিন বাজাবে কে?আর এই গানে ভায়োলিনটাই মুখ্য কি করা।

-দেবু দা ভায়োলিনটা আমি বাজিয়ে গানটা খাই।

-তুই বাজাবি? তুই কি ভায়োলিন বাজাতে জানিস অরুন?

-বছর কয়েক শিখেছিলাম দাদা।

-আগে বাজিয়ে দেখা দেখি। অরুনের ভায়োলিন শুনে দেবু ভট্টাচার্য মুগ্ধতায় পিঠ চাঁপড়ে দিলেন অরুনকে।

-তুই আর কি জানিস ভাই।তুইই বাজিয়ে গানটা গা। রেকর্ডিংটা হয়ে গেলো।দেবু ভট্টাচার্যের খুঁতখুঁতে স্বভাবের চরিত্রে আজেই সবাই দেখলো দেবু বাবুর পরিতৃপ্ত হাসিমাখা মুখ। ওস্তাদ জাভেদ মৃধা,ইরমান বেগ এর ছবি প্রদশর্নীতে গিয়ে অরুন দেখলো প্রদশর্নীতে তার আঁকা ছবিও প্রদর্শীত হচ্ছে।অরুন বেশ অবাক হলো। ওস্তাদ জাভেদ মৃধা এগিয়ে এলেন অরুনের দিকে।

-তৈয়ারী করহো বেটা প্যারিস যানে ক্যাঁ। আমার পাসপোর্ট তো করাচী সরকার আটকে রেখেছে ওস্তাদজী।

-কিউ?

-তা তো জানিনা।

-কোয়ি বাত নেহী ইমরান হেঁ না।মিল যায়ে গা।এই প্রথম অরুন জানলো ইমরান বেগ পাকিস্তান সেনায় উচ্চপদে কর্মরত।অরুন বছর খানেক আগে "ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে" আমন্ত্রিত হয়েছিল, কিন্তু করাচিতে পাকিস্তানী সরকার তাঁর পাসপোর্ট আটকে দেয় তাই সেখানে যোগ দিতে পারেনি অরুন।



১৪#

ও মোদের দেশবাসীরে---আয়রে পরাণ ভাই আয়রে রহিম ভাই কালো নদী কে হবি পার | এই দেশের মাঝেরে পিশাচ আনেরে কালো বিভেদের বান, সেই বানে ভাসেরে মোদের দেশের মান | এই ফারাক নদীরে বাঁধবি যদিরে ধর গাঁইতি আর হাতিয়ার হেঁইয়া হেঁই হেঁইয়া মার, জোয়ান বাঁধ সেতু এবার | এই নদী তোমার আমার খুনেরি দরিয়া এই নদী আছে মোদের আঁখিজলে ভরিয়া এই নদী বহে মোদের বুকের পাঁজর খুঁড়িয়া (মোরা) বাহু বাড়াই দুই পারেতে দুজনাতে থাকিয়া (ওরে) এই নদীর পাকে পাকে কুমীর লুকায়ে থাকে ভাঙে সুখের ঘর ভাঙে খামার, হেঁইয়া হেঁই হেঁইয়া মার, জোয়ান বাঁধ সেতু এবার | বুকেতে বুকেতে সেতু অন্তরের মায়া ঘিরে বাঁধিরে কুটিলের বাধা যত ঘৃণার নিষ্ঠুরাঘাতে ভাঙ্গিরে সাম্যের স্বদেশ ভূমি গড়ার শপথ নিয়ে বাঁধিরে হেঁইয়া হেঁই মারো, জোর বাঁধি সেতু বাঁধিরে বাঁধি সেতু বাঁধিরে | ফুলমনিকে হারমনিয়ামে গানটা তুলে দিচ্ছিলো অরুন কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়ে অরুনের বাবা ফুলমনি কিংবা অরুন কেউই খেয়াল করেনি।একবার অরুন পুরো গানটা গাইলো তার পর ফুলমনি গাইছে। যেখানে যেখানে ফুলমনি আটকে যাচ্ছে অরুন ঠিক করে দিচ্ছে।বার কয়েকবার গেয়েই ফুলমনি গানটা তুলে ফেললো গলায় সুরে কথায়।দুইবার সে কোথাও না আটকে গেয়ে গেলো।অরুন বেশ খুশি হলো আদুরে বোনের সঙ্গীত দক্ষতায়।

-এটা কি তোর লেখা গান?

চমকে উঠলো অরুন।দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে এই প্রথম বোধ হয় অরুন মনে করার চেষ্টা করলো তার বাবা তার গান শুনতে দরজায় দাঁড়িয়েছেন।অরুন ব্যস্ত হয়ে উঠলো চেয়ারে রাখা কাপড় বই সরিয়ে চেয়ারটা এগিয়ে দিলো বাবার দিকে।

-বসুন বাবা,এটা সলিল চৌধুরীর কথা ও সুর।

-শাজাহান সাহেব বলছিলেন তুই নাকি সিনেমায় গান গেয়েছিস। সিনেমায় সুরকার হিসেবে কাজ করছিস।

-হ্যাঁ,বাবা।

-আমি তো এ বাড়ীর কেউ না।বাইরের মানুষের কাছে আমাকে শুনতে হয় আমার ছেলে কি করছে। থাকো তোমরা মা ছেলেতে।আমাকে কিছু বলবে কেন আমি তো তোমার শত্রু। আমি তো তোমার ভাল হোক,সুনাম হোক চাই না।কি তাই না?

-বাবা,আপনি ভুল বুঝচ্ছেন। আমি তো জানি আপনি আমাকে কতটা ভালবাসেন। আপনি যা বলেন আমার ভাল ও মঙ্গলের জন্যই বলেছেন বা বলবেন।

-থাক থাক আমি সব বুঝি। কথাটা বলেই চেয়ারটা ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলেন।একটু থেমে পিছন ফিরে অরুনের মার দিকে তাকালেন রত্নগর্ভা মা তুমি। ছেলের যে বিয়ের বয়স হচ্ছে সেটাও কি আমাকেই বলে দিতে হবে? আমি তো আর এ বাড়ীর কেউ না পাত্রীর খোঁজ কর।বিয়ের আগে আমায় ইচ্ছে করলে জানাতেও পার নয়ত পাড়ার কারো কাছে জেনে নেবো।তোমার সইয়ের মেয়ে তমা মেয়েটা দেখতে শুনতে আচারে ব্যবহারে মন্দ নয়।দেখুন আপনারা ভেবে..



১৫#

এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনে...অবশেষে দিনটা চলেই এল- দিনটা সকাল থেকেই গুমোট,আকাশ ছাই ছাই মেঘাচ্ছন্ন।সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল।তারপর দুঃসহ গরম।ভ্যাপসা আবহাওয়া,বিষের কণার মতো রৌদ্রপাত।তপ্ত দুপুরে আদিগন্ত হলদে ধূসর মাঠে ঘূর্ণি হাওয়ার মতো পাক খেয়ে চিন্তাগুলো ঘুরছিলো অরুনের মাথায়।তমা কে সেই ছোট্টবেলায় এক দুবার দেখেছিলো অরুন এরপর আর দেখেনি।সেই ছোট্টবেলায় তমা ছিলো পুতুলের মত দেখতে।গায়ের রঙটিও ছিলো দুধে আলতা।এত বছর পর তমা কি তেমনটিই আছে? দুই পরিবারের অভিভাবকরা আনুষ্ঠানিক আলাপ চারিতা সেরে ফেলেছে।আজ পাত্র পাত্রীর সৌজন্য সাক্ষাত। ফুলমনির পছন্দেই অরুন পড়েছে খদ্দরের পাঞ্জাবী।টেবিলে বসে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছিলো অরুন অথচ কিছুই লেখা হচ্ছে না বার কয়েক তমা নামটি লিখে কাটাকাটি করছে। প্রতীক্ষার সময় বড় দীর্ঘ হয়।বারবার ঘড়ি দেখছে অরুন।ফুলমনি আর মা গেছে তমাকে ওদের বাড়ী থেকে আনতে। ফুলমনি বলছিলো তমা নাকি কয়েকদিন এসে অরুনদের বাসায় থাকবে।

-এসো,এসো,এই হচ্ছে আমার বড়দা।আর বড়দা এটা হচ্ছে তমা দিদিভাই। অরুন কতটা সময় অপলক তাকিয়ে ছিলো অরুন জানেনা।এই তমা যে তার কল্পনাকেও ছাপিয়ে গেছে।ছোট্টবেলায় দেখা পুতুলের গায়ে টোকা দিলে যেন রক্ত পড়বে।এত সুন্দর কেউ হতে পারে? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না অরুন।ফুলমনির ডাকে ঘোর ভাঙ্গে অরুনের।

-দিদিভাই একটা গান শুনতে চাইছিলো? মন্ত্রমুগ্ধের মত অরুন বিছানায় রাখা হারমনিয়ামটা টেনে নিয়ে গাইতে লাগলো'তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম'। গানটা শেষ করেই একপলক তমাকে দেখলো অরুন তারপরেই গাইলো'ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ও বন্ধু আমার'। এমন সময় কখন যেন তমার মা এসে হাজির !

-অনেক গান হয়েছে আমার সই আর তমা দুদিন থাকবে আরো গান শোনাতে পারবি এতটা পথ এসেছে ওরা এবার নাওয়া খাওয়া করুক। তারপর সব কথা গান হবে ক্ষণ ।



১৬#

তমা মাদের সাথে চলে গেল।ক্ষানিক সান্নিধ্য কি তবে বাড়িয়ে দেয় চাইবার তীব্রতা।অরুনের ইচ্ছে করছিলো তমা কে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে যেখানে নদীর ওপর পড়বে নীল আকাশের ছায়া। জলকে দেখাবে নীল। সাদা পালতোলা নৌকায় চেপে ভেসে পড়বে জলে ভাসতে ভাসতে ভাসতে বলবে চাঁদ কিংবা রামধনুর কথা,চিল কিংবা রোদ্দুরের কথা। তমা কে বলবে ভালবাসা কী,এই যে মুগ্ধ ব্যাকুলতা বিচিত্র অনুভূতি একি ভালবাসা।আমি আজ নতুন করে জানতে চাই ভালবাসার সংজ্ঞা। তমা তখন হয়ত বলবে ভালবাসা প্রকৃত এক অরূপের সন্ধান। ফুলমনির ডাকে ঘুম ভাঙে অরুনে।

-বড়দা, পছন্দ হলো তমা দিদিভাইকে?

-তোদের হলেই হলো।আমার কি। ফুলমনি হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। দুইদিন তমা ও তার মা ছিলেন। আশ্চর্যভাবে বাড়ীর সবাই একটা জিনিষ খেয়াল করলো অরুন এই দুইদিন বাড়ীর বাইরে গেলো না। অরুন বিকেলে ছাদে উঠে দেখে ফুলমনি আর তমা দাঁড়িয়ে।অরুন নেমে আসচ্ছিলো ফুলমনি ডাকলো। বড়দা এইদিকে আসো দেখো তোমার গাছে ফুল ফুটেছে।অরুন এগিয়ে গেলো। ফুলমনি চা মুড়ি আনার উচ্ছিলায় ওদের রেখে নেমে গেলো। অনেকটা সময় নীরব থেকে অরুনেই মুখ খুললো।

-সেই কতবছর আগে তোমায় দেখেছিলাম তার পর আর দেখাই হয়নি আমাদের। কি করছো এখন তুমি।

-আপনার গান আমার খুব প্রিয়।

-আমার গান তুমি শোন নাকি?

-তোমার পুতুল পুতুল চেহারাটা আরো সুন্দর হয়েছে।ভেনাসও বুঝি এমন সুন্দর ছিলেন না। তমা একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।

-আমার তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে তুমি নিশ্চয় জানো।আমার মত উড়নচন্ডীকে বিয়ে করতে তোমার কোন অমত নেই তো।

-জানি না,পাগল একটা,বলেই তমা দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো। অরুন ও হাসতে হাসতে নামতে থাকলো পেছন পেছন।বিয়ে কিন্তু আমি তোমাকেই করবো পাগল হলেও।তমা মুখ ঘুরিয়ে ভেঙচি কেটে আমার বয়েই গেছে পাগলকে বিয়ে করতে।



১৭#

খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি...

তমারা ফিরে যাবার পর বেশ কয়েকবার অরুন তমার সাথে দেখা করতে ছুটে গেছে তমাদের ওখানে।প্রথম প্রথম কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে তমার কলেজে ঢোকা দেখা তারপর প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা কলেজ শেষে তমার বেরিয়ে আসার দর্শন। এভাবেই চললো কিছুদিন একদিন কলেজ ঢোকার মুখে তমাকে ডেকে বললো চলো কোথাও ঘুরে আসি।

-ইশ! কত্ত শখ।কলেজ ফেলে আমি পাগলের সাথে ঘুরতে যাই।আমার তো খেয়ে আর কাজ নেই। কথাটা বলেই হাসতে হাসতে দৌড়ে ঢুকে গেলো তমা। এরপরদিন সকালে ঘটলো এক মজার কান্ড কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গেইট বন্ধ হয়ে গেলো তমার দেখা নেই। কিছুক্ষণ আরো দাঁড়ালো অরুন। মনে মনে ভাবতে লাগলো তমার যদি শরীর খারাপ করে থাকে তারচেয়ে বরং তমাদের বাড়ী গেলে ভাল হয়।তমার বাড়ী যাবার জন্য যখন মনস্থির করেছে তখন একটা বাচ্চা ছেলে এসে বললো কলেজের পিছনে কোন এক নারী নাকি অরুনের প্রতীক্ষায়। যাবে কি যাবেনা ভেবে অরুন কলেজের পেছনে গিয়ে দেখে গোলাপী রঙের সালোয়ার কামিজে দাঁড়িয়ে থাকা এ যেন কোন স্বর্গীয় পরী তমা নয়।

-কোথায় নিয়ে যাবেন?

-বাসায় বলেও সামলে নিলো অরুন বাসা থেকে দূরে কোথাও। আমি কি তোমাদের এখানের সব চিনি বরং তুমি নিয়ে চলো। তমা অনেক ভেবে অরুনকে নিয়ে শহর থেকে দূরে নদীর বাঁধে এলো।অরুন অপলক তাকিয়ে শুধু তমাকে দেখছে।

-এই বুঝি আপনার জরুরী কথা আমায় সাথে? অরুন কিছু বললো না শুধু আবৃত্তি করে গেলো হঠাত্ দেখা,বনলতা সেন।

-একটা গান গাইবেন?

-কি গান শুনতে চাও।

-আপনার যেটা ইচ্ছে সেটাই গান অরুন 'না চাহিলে যারা পাওয়া যায়'ভালবাসি ভালবাসি'গেয়ে শেষ করলো'আলগা কর খোঁপার বাঁধন দিল মেরা'দিয়ে। তমা লজ্জায় যেন আরো সুন্দরী হয়ে উঠলো।অস্ফুটে শুধু বললো পাগল একটা।

-আমি পাগল।তবে বিয়ে করো না।

-পাগল ই তো নইলে কেউ এভাবে রোজ রোজ একঘন্টার পথ ভেঙে এসে কলেজ গেইটে দাঁড়ায় তাও আবার মেয়েদের। আর বিয়ে করার ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখবো।বাদাম খাবেন?ঐ যে যাচ্ছে ডাকুন।

-ভাই বাদাম দাও তো এক কেজি।

-তমা অবাক হয়ে অরুনের দিকে তাকিয়ে বললো পাগল একটা। তারপর বাদাম ওয়ালার দিকে স্মিত ভেসে বললো ভাই একশ গ্রাম বাদাম দাও।



১৮#

হৃদীবরেষু তমা, অনেকদিন তোমায় দেখিনা।বিয়ের আগে এভাবে বারবার যাওয়াটা নাকি ঠিক না। ফুলমনিকে দিয়ে মা বলিয়েছে।আমার তো মন মানছে না।কোন কাজে মন বসাতে পারছিনা।সুর করতে বসলেই তোমার মুখটা ভেসে ওঠে। গাইতে গেলে মনে হয় তোমার সাথে কথা বলি।প্রতীক্ষার এই দিনগুলি যেন কাটছেই না।এক একটা দিন যেন চব্বিশ ঘন্টায় না বাহাত্তর ঘন্টায় যাচ্ছে।গতকাল রফিকদের সাথে বাজারে ঘুরতে গিয়ে একটা লাল জামদানী এত পছন্দ হলো মনে হলো তাঁতি যেন এটা তোমায় কল্পনা করেই বানিয়েছে।তাই ওটা না কিনে পারলাম না।এই পাগলের জন্য তোমার নিশ্চয় কোন ব্যাকুলতা নেই।তবে যতই পাগল বলো জানি মনের চিলেকোঠায় এই পাগলটাই তোমায় ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে। ঠিক করেছি তোমার গায়ে হলুদের দিন আমি যেভাবেই হোক তোমাদের ওখানে থাকব।আমার নামে তোমার দুধে আলতা শরীরে হলুদ স্পর্শ নেবে আর সেখানে আমি থাকব না তাই কি হয়?আর পাঁচটা দিন তবু মনে হচ্ছে এ যেন পাঁচ যুগের অপেক্ষা আমার।তোমার ও কি এমন হচ্ছে তমা? নাকি সিঁড়িতে বলা ভালবাসা মাখা কন্ঠে বলবে আমার বয়েই গেছে পাগলের জন্য অপেক্ষা করতে।আমাদের বিয়ের শুভেচ্ছা বার্তা আসতে শুরু করেছে। গতকাল সলিলদা ও দেবুদার চিঠি পেলাম।আজ ঘনশ্যাম,ইরমান বেগ ও ওস্তাদ জাভেদ মৃধার টেলিগ্রাম পেলাম।সকালে জয়নাল আবেদিন স্যার আর্টকলেজে সবাইকে নিয়ে অভিনন্দন ও চা চক্র করে নিজের আঁকা একটি ছবি উপহার দিলেন।আর আমার পুরোনো প্রেমিকাদের কেউ কেউ বুক ভাঙ্গা শুভকামনা জানিয়েছে।কেউ কেউ আবার উপন্যাসের মত চিঠি পাঠিয়েছে একে তাকে দিয়ে। বিয়ের পরে একসাথে বসে পড়বো বলো চিঠিগুলি সযত্নে রেখে দিয়েছি। জানি একটু হিংসা খানিক রাগে তুমি রক্তিম হয়ে উঠেছো।তবে এও জানি আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা মনের সমস্ত মেঘ কাটিয়ে নিচ্ছে ভালবাসার দমকা হাওয়ায়। আজ আর লিখছি না।পাগলের ভালবাসা নিও।

ইতি,

তোমার পাগল বন্ধু

পুনশ্চঃ স্বামী স্ত্রী হয়ে নয় আমি চাই আমাদের সংসার হবে দুইজন অকৃত্রিম বন্ধুর বন্ধুত্বপূর্ন বসবাস।



১৯#

অবশেষে তমা আর অরুনের বিয়েটা হয়ে গেলো।বাসর রাতে দরজার বাইরে যখন বৌদি বেয়াই বেয়াইনীদের কান পাতা ভিড়, ভিতরে তখন অরুন,তমা খুলে বসেছে চিঠি।চিঠি,গল্প আর গানে কখন ভোরের পাখি ডেকে উঠলো ওরা দুজনের কেউই বুঝতে পারলো না।

-দেখলে তমা,প্রতীক্ষায় থাকলে একটা দিনকে মনে হয় কত্ত বড় আর তোমার সাথে কাটানো ছয়টা ঘন্টা যেন ছয় মিনিটে ফুরিয়ে গেলো। তমাকে যে অরুন পুতুলের মত সাজিয়ে রাখে তা নিয়ে আত্নীয়স্বজনদের মধ্যে গুঞ্জন থাকলেও ওদের ভালবাসা,বোঝাপড়ার প্রসংশায় সবাই পঞ্চমুখ এমনকি নিন্দুক স্বজনরাও এটা অস্বীকার করে না।তমা কিছু চাইলে অরুন পারলে দোকান তুলে নিয়ে আসে এমন অবস্থা।একদিন তমা জাম খেতে চাইলে অরুন একবস্তা জাম নিয়ে হাজির।তার চেয়েও মজার ঘটনা ঘটলো তমার গর্ভাবস্থায়।তখন তমার পাঁচ মাসের পেট প্রচন্ড গরম পড়েছে কিছুদিন ধরে তমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ফ্রিজের ঠান্ডা জল খায়।বাড়ীতে তো ফ্রিজ নেই কি করা অগত্যা ফুলমনি পাশের বাড়ী থেকে এক বোতল ঠান্ডা জল নিয়ে এলো।অরুন বাইরে থেকে ফিরে বিন্দু বিন্দু জল জমে থাকা বোতলটা দেখলো কিছুক্ষণ তারপরই ঘুরেই আবার বেরিয়ে পড়লো। তমা,ফুলমনি ডাকলো অরুন যেন শুনলোই না এমন ভাব করে হেঁটে গেলো। ঘন্টা তিনেক পরে একটা ফ্রিজ কিনে নিয়ে ভ্যান করে সে বাড়ী এলো।

-ফ্রিজ কিনতে গেলে কেন?

-তোমার ঠান্ডা জল খেতে ইচ্ছে হলে যখন খুশি তখন যেন খেতে পার তাই কিনে ফেললাম।

-সত্যিই তুমি একটা পাগল। হাসতে হাসতে তমাকে জড়িয়ে ধরলো অরুন। ফুলমনির ঘর থেকে তখন ভেসে আসচ্ছে

'ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার

নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে'....



২০#

যুদ্ধ সবচেয়ে প্রাচীন গনজমায়েত..

উনসত্তরের গন অভ্যুত্থানের স্ফুলিঙ্গ একাত্তরের সাতই মার্চ জ্বলে উঠলো আর পঁচিশে মার্চের কালো রাত সে আগুন ছড়িয়ে পড়লো মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে।একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নে বিভোর আমজনতা প্রতিরোধ গড়ে তুললো।চেতনা,আদর্শ আর স্বাধীনতার স্বপ্নে।প্রস্তুত হতে লাগলো জনতা। সারা দেশজুড়ে যে যেভাবে পারলো তৈরী করতে লাগলো মুক্তিবাহিনী। নারীরাও এগিয়ে এলো অসীম সাহসে। ট্রেনিং নিতে ভারতের আগরতলা,কোচবিহার সহ জায়গায় জায়গায় তৈরী হলো অস্ত্র ট্রেনিং কেন্দ্র।পচা গলা লাশ ভেসে যায়।বাতাসে লাশে গন্ধ। নিতাইয়ের চিঠি এলো।অরুন উত্তরে লিখলো বন্ধু নিতাই, মরলে এখানেই মরবো এই দেশ আমার এই দেশ আমাদের কাপুরুষের মত বেঁচে থাকার চেয়ে বীরের মৃত্যু অনেক গর্বের।আমার কিছু ছেলে পাঠালাম তোর ওখানে ওদের একটু দেখিস।কমরেড বিমল কিছু অস্ত্র দেবে সঙ্গে কিছু গোলাবারুদ আশা রাখি এই ক্রান্তি কালে নিতাই প্রাণ গেলেও মুখ লোকাবে না।আগরতলায় রুমি সহ ওর কিছু বন্ধু আছে ওরা হয়ত কলকাতায় আসবে শীঘ্রই

ওরা সবাইকে চেনে না তুই একটু পরিচয় করিয়ে একটা ব্যবস্থা করে দিস। রাধিকা ও অর্নবকে আমার ভালবাসা দিস।

ইতি তোর বন্ধু।

অরুনের বাড়িতেই একটা অপরেশন ক্যাম্প গড়ে উঠলো।স্বাধীনবেতার কেন্দ্রের জন্য গান তৈরী করে গোপনে পাঠাচ্ছে অরুন। অরুনের বাসায় বসেই অপরেশন প্ল্যান

হয়।আগরতলা থেকে গভীর রাতে রুমি ও

তার সহযোগীরা আসে অপারেশ করেই রাতের অন্ধকারেই তারা ফিরে যায়। যুদ্ধ দিন দিন চরম রূপ নিচ্ছে।এর মাঝেই বেশ কিছু পাকিস্তানী ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।আলবদর,রাজকার আলসামসরা শান্তি বাহিনী তৈরী করে মহল্লায় মহল্লায় কমিটি গঠন করে ঘর থেকে মেয়ে ছেলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। টর্চার সেলে চলছে অমানবিক অত্যাচার।খান সেনাদের মাথায় জামাতি নেতারা একটা বদ্ধমুল ধারনা ঢুকিয়ে দেয় এই পূর্বপাকিস্তানে সব ব্যাটা মালোয়ান ইসলাম তারা মানেনা।তাই ইসলামের বীজ প্রতিটি নারী গর্ভে রোপন করে দেয়া ইসলাম রক্ষার প্রধান কাজ। শুরু হলো ঘর ঘর থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে ক্যাম্পে অমানবিকউল্লাস। ফুলমনিই একদিন খেয়াল করলো কয়জন লোক তাদের বাড়ীর চারপাশে সারাদিন ঘোরা ফেরা করে। উঁকি মারে।অরুন কে জানাতেই অরুন ফুলমনিকে একটা চিরকূট লিখে মোড়ের দোকানে দিয়ে আসতে পাঠালো ফুলমনিকে যাতে কেবল লেখা "আজ অমাবস্যা না বেরোনোই ভাল রাতে"।অস্ত্রের একটা বড় এস্যাইন্টমেন্ট আসার কথা রাতে। খবরটা কি শত্রু পক্ষ জেনে গেছে।অরুন ছেলেগুলো কে চেনে এরা মসজিদের ইমাম সাহেবের ছেলে।ইমাম সাহেব এই মহল্লার শান্তি কমিটির সভাপতি।



২১#

এক সন্ধ্যায় ইমরান বেগ এসে হাজির অরুনের বাড়ীতে।হাতে মিষ্টির প্যাকেট।অরুন তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি গানের সুর নিয়ে ব্যস্ত।ফুলমনি এসে বলো।

-বড়দা,ইমরাগ বেগ বলে একজন এসেছেন।তোমায় খুঁজচ্ছে। অরুন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে এলো।বসার ঘরে ইরমান ঘুরে ঘুরে অরুনের আঁকা ছবি দেখছে।মিষ্টির প্যাকটগুলো টি টেবিলে রাখা।

-আরে ইমরান যে,কি সৌভাগ্য আমার। বাড়ী চিনলে কি করে! দেয়ালে টানানো ইমরান বেগ,ওস্তাদ

জাভেদ মৃধা আর অরুনের ফটোগ্রাফ থেকে চোখ ফিরিয়ে ইমরান জড়িয়ে ধরলো অরুনকে।অনেকটা সময় বুকে চেপে ধরে ইমরান ভরাক্রান্ত গলায় বললো

-ওস্তাদজী হাম লোগো কোঁ ছোড় কেঁ গ্যাঁয়ে কল। ইমরানের চোখে জলের অভাস বোঝা যায়। আবহাওয়াটা সহসা ভারী হয়ে উঠলো।

-কি করে হলো।গত কদিন আগেও তো ওস্তাদজীর চিঠি পেলাম।অসুস্থতার কথা তো কিছু লিখেননি।

-পাতা নেহী।ম্যাঁ কল করাচী যানে কাঁ সোচা হেঁ তুম ভি চলো মেরে সাথ।

-যাবার ইচ্ছা ও প্রয়োজন দুটোই ছিলো কিন্তু এই মুহুর্তে আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব ইমরান। ফুলমনি চা জলখাবার নিয়ে এলো।

-তুম ফুলমনি হোঁ না?তুমারা ভাইজান হর বক্ত তুমারি বাত করতে রেহেতে থেঁ যব করাচী মেঁ থাঁ। ফুলমনি হেসে মাথা দোলায়।

-ভাবীসাহেবা কাঁহা?

অরুনই উত্তরটা দিলো

-তমা একটু বাইরে গেছে। তোমাকে দেখলে খুব খুশি হতো।তোমার কথা এত শুনেছে ও আমার কাছে। আরো ঘন্টা খানেক শিল্প সাহিত্য বর্তমান রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ কেন এইসব নিয়ে কথা বলো ইমরান অরুন ও ফুলমনির কাছে থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ল।

-তা কাল করাচী গেলে আবার কবে দেখা হবে কে জানে।ভাল থেকো।

-ম্যাঁয় তো ঢাকা মেঁই হু দো মাস স্যাঁ লটকে ফের মিলেঙ্গে।

-তুমি ঢাকায় আছো দুইমাস।আর আজ এলে বন্ধুকে দেখতে।মনে খুব কষ্ট পেলাম ইমরান।তা ফিরে এসে একদিন আমার বাসায় তোমার খাবার নিমন্ত্রন থাকলো।



২২#

বিকেলে অরুনের বাড়ীর সামনে একটা পাকিস্তানের সেনা জীপ এসে থামলো।গেইট টেলে ঢুকে এলেন এক সেনা প্রধান আর কয়েকজন সিপাহী।অরুন বারান্দায় নেমে এলো। সেনাপ্রধান এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো অরুনকে। ক্যাঁয় সে হো মেরে ইয়ার।ইমরান বেগকে দেখে অরুন বেশ অবাক হলো।

-তুমি এখানে কবে ফিরলে ইমরান?

-কুছ দিন পেহেলে দোস্ত ।

অরুন ইমরান বেগকে বসার ঘরে নিয়ে এসে বসালো। বাইরে সিপাহীদের সাথে ইমাম সাহেব সহ আরো কিছু মানুষের ভিড়।

-অরুন,তুমি শিল্পী আদমী।গান আর্ট লিয়েই রহো।কিউ মুক্তিদের সাথ মিলতে হোঁ।শুনা হে মুক্তি লোগ তুমারে পাস আতা হেঁ।তুম নে উন লোগো কোঁ খানা পিনে ক্যাঁ অর অপারেশন করনে কাঁ সব কুছ কর দেতে হতো।মুক্তি কো পাকাড় ক্যাঁ দো ম্যাঁ তুম কোঁ হর মুমকিন সবকুছ দেঙ্গে।

-ইমরান,একজন শিল্পী মানবতার স্রষ্টা।স্রষ্টা তার মাকে বিক্রি করেতে না।যখন তার মা ও মানুষ হায়নার মুখে।

-অরুন তুম মেরে ইয়ার।সোছো ম্যাঁয় নে তুমহারি আচ্ছে ক্যাঁ লিয়ে আয়া হু।

-ইমরান আমি তো শস্ত্র যুদ্ধে নেই। আমি আমার গান আর আঁকা নিয়েই আছি।

-ঝুঁট মত বলো।যো চার ক্যাম্প উড়ায়ে হে ও সব তুমহারি আদমী। ক্যাপ্টেন রমিজ কো ভি তুমহারি আদমী সুট কিয়া থাঁ।

-ইমরান একটা কথার উত্তর দেবে?রঙ তুলিতে যে ক্যানভাসে ছবি আঁকে সে কি করে রক্তপিপাসু হয়ে এত নিষ্ঠুর হয়? ইমরান নিরুত্তর থাকে।চোখ ঘুরিয়ে দেখে দরজার আঁড়ালে ফুলমনি আর অরুনের মা পর্দার আড়াঁলে দাঁড়িয়ে। তমা ট্রেতে করে চা নিয়ে ঢুকলো।

-আপন কিঁয়া মেরা ইয়ার কি বিবি?

-তমা,তোমাকে ইমরান বেগের কথা বলেছিলাম।এই হচ্ছে আমার বন্ধু ইমরান বেগ। তমা সালাম দিলো।চা শেষ করে ইমরান

বেগ উঠে দাঁড়ালেন।ইমরানের পাশে পাশে অরুন বেরিয়ে এলো।ইমরান গলার স্বরটা নামিয়ে প্রায় ফিসফিসে বললো রুমি ওর উনকা দোস্ত ক্যাঁয়া আর্মস লেকে আজ আয়ে গ্যাঁ?



২৩ #

কলকাতা থেকে মোহন কিছু এক্সপ্লোসিভ সংগ্রহ করে সাপ্লাই দিয়ে ও চলে গেল।অরুনের কথা মত তিনজন ইকবাল হলের মাঠে বসে চুপচাপ সময় কাটাচ্ছে।সতেরা আঠারো বছরের তিনজন তরুন একসঙ্গে রাতের বেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম দৃশ্য অকল্পনীয়।রাতের বেলা কারফিউ থাকে।আর তখন শহর যেন মৃত্যুপুরী। সারা শহরে টহল দিচ্ছে খাকি পোশাকের সশস্ত্র সৈন্য।রাতের নির্জনতা চুরমার করে ছুটে যাচ্ছে খান সেনাদের জীপ আর ট্রাক।আজো একটু পরপর সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ দিকের

রাস্তা দিয়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে যাচ্ছে পাকবাহিনীর জীপ।কিছুটা সময় ইকবাল হলের মাঠে কাটিয়ে মিলন,বদীর,প্রীতিলতা তাদের গন্তব্য জোড়া তেতুঁল গাছের দিকে এগিয়ে গেলো।প্ল্যান অনুযায়ী রুমির দল তাদের কভার দেবে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের রাস্তাটা নির্জন।যে কোন সময় আর্মির জীপ অথবা ট্রাক ছুটে আসতে পারে।দ্রুত জায়গাটা পার হলো ওরা।ঐদিকে অস্থির অরুন বারান্দায় পায়চারি করছে আর ঘড়ি দেখছে। ফোকড় গলে নিঃশব্দে ওরা নেমে গেলো ট্রান্সফরমারের কাছে।প্রীতিলতা বদীরের হাত থেকে এক্সপ্লোসিভ নিয়ে ব্যাগ থেকে একটা পিস্তল বের করে মিলনের হাতে দেয়।মিলন পকেট থেকে বের করে কর্ড আর ডেটোনেটার।ঝটপট কাজে লেগে গেলো প্রীতিলতা।বদিরের দায়িত্ব প্রীতিকে কভার দেওয়া।আর কোন বিপদ হলে রুমি ভাইরা আছে রাস্তার ওপাশে। ট্রান্সফরমারের গায়ে এক্সপ্লোসিভ সেঁটে দিয়ে নরম এক্সপ্লোসিভের মধ্যে ডেটোনেটর গেঁথে দিল প্রীতি। পলাশির দিক থেকে আসছে একজোড়া হেডলাইটের আলো আর জীপের আওয়াজ। রাস্তা থেকে খানিকটা নীচে শুয়ে পড়লো ওরা। সাঁ করে জীপ চলে যেতেই মাটি থেকে উঠে দ্রুত আবার হাত চালালো প্রীতি।সবকিছু রেডি।পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ও আগুন জ্বালিয়ে জোরে একটা টান দিলো রুমি। তারপর আগুনটা ছোঁয়ালো কর্ডের মাথায়।সঙ্গে সঙ্গে হিসহিস শব্দে নীল আগুনের

ধোঁয়া তুলে পুড়তে লাগলো কর্ড।তিরিশ সেকেন্ড পরেই ঘটলো বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণ ঘটা মাত্রই চারদিক থেকে ধেয়ে আসচ্ছে পাকবাহিনীর জীপ।ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশে ফুলার রোড আবাসিক এলাকার গেট দিয়ে বেরুনের পথে রুমি বললো

-ভিসির বাড়ির গেটে কয়েকজন রাজাকার সারাক্ষণ পাহারা দেয়। ওদিক থেকে জীপও চলে আসতে পারে যে কোন সময়। ফুলার রোডের গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকা মাত্র দ্বিতীয় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেলো বুম!! সেই শব্দে কেঁপে উঠলো সারা এলাকা। অন্ধকারে ঢেকে গেল চারপাশ। চাপা উদ্ভাসিত গলায় হাঁপাতে হাঁপতে প্রীতি বললো অপারেশন সাকসেসফুল!চাপা কন্ঠে সবাই সমস্বরে বলো উঠলো জয় বাংলা!!



২৪#

আরো কিছু ছোট বড় অপারেশনের পর পাকস্থানি বাহিনী বেপড়োয়া হয়ে উঠেছে।

এরই মাঝে বেশ কিছু আর্মস আর গোলাবারুদ এসে পৌঁচ্ছে গেছে।অরুন বেশ কৌশলে সে সব পৌঁচ্ছে দিচ্ছে জায়গায় জায়গায়। আরো কিছু অস্ত্র আজ রাসেল,মিনারা নিয়ে আসচ্ছে। আগরতলার চেত্তখোলা থেকে রাতে আসচ্ছে রুমি সহ একদল টগবগে তরুন।আজকের অপারেশন নিয়ে সবার অবস্থান কর্মপন্থা আগেই ঠিক হয়ে আছে।শহরের সবচেয়ে বড় পাকিস্থানী ক্যাম্প আজ উড়িয়ে দেয়া হবে।সকাল থেকেই অরুন আজ বেশ অস্থির।গতরাতেই মহল্লার শাহজাহান সাহেবকে জবাই করে হত্যা করেছে তার মসজিদের ইমামও তার সহযোগিরা।শাহজাহান সাহেবের স্ত্রী ও কন্যাকে ধর্ষনের পর তুলে নিয়ে গেছে রাজকার বাহিনী। গোপাল,হরেকৃষ্ণকে জোর করে মুসলমানী করা হয়েছে।এইসব

খবরে অরুন বিচলিত।ইলিয়াস এসে জানালো রাস্তার মোড়ে মোড়ে নাকি কাপড় খুলে পুরুষদের লিঙ্গ দেখা হচ্ছে।মুসলমান হলে ছাড় পাচ্ছে আর হিন্দু হলে ধরে নিয়ে গিয়ে মুসলমানী করে দেয়া হচ্ছে।

-শুনলাম ক্যাম্পগুলোতে আমাদের

নারীদের অবস্থা আরো খারাপ।কাপড় চোপড়হীন তাদের উপর চলছে গনধর্ষন। ক্যাম্পগুলো ভরে গেছে আর্তনাদে।এদের

জন্য আমরা কি কিছু করতে পারিনা অরুন।অমানবিক বিভত্স অত্যাচার থেকে আমাদের বোন মেয়েকে কি রক্ষার কোন পথ নেই? শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন প্রফেসরকে তুলে নিয়ে গেছে আজ।কাদের মোল্লা মিরপুরে তান্ডব চালাচ্ছে।

-ইলিয়াস,গোলাম আজমের মত ভাষা সৈনিক যখন পিচাশ হয়ে উঠে তখন বিড়াল ও বাঘ হয়ে যায়।

-চাঁটগায়ের অবস্থা তো আরো খারাপ। আমরা কি হেরে যাবো অরুন?

-ইলিয়াস তুমি ভুলে গেছো পিপিলিকার পাখা জন্মায় মরিবার তরে।তাছাড়া সারা বাঙালী যখন জেগেছে সেই রৌদ্রতাপে অন্ধকার থাকতে পারবেনা এই বাংলায় আমি নিশ্চিত।জয় আমাদের সূর্য সৈনিকদের হবেই তুমি দেখে নিও।



২৫#

২৯শে আগষ্ট রাতে খবরটা এলো। আগরতলা থেকে ফেরার পথে সাজিদ সহ পাঁচজন পাকিস্থানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে।শহরে ঢোকার পথে। সঙ্গে কিছু অস্ত্র ও পাওয়া গেছে।খবরটা শোনার পরই অরুন ঘরের সব গোলাবারুদ বাগানে গর্ত করে লুকিয়ে ফেললো।বাড়ীতে তখন রুমি,বদির,প্রীতি সহ আরো কয়েকজন। অরুনের মা বললেন

-তোরা কোথাও চলে যা অরুন। সাজিদরা যদি অত্যাচার সইতে না পেরে তোদের কথা বলে দেয়।খান সেনারা ঠিক বাড়ীতে আসবে। তমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।অরুন তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত আদর করতে করতে

-আমার বর্ষাকে তুমি সত্ মানুষের মত মানুষ করবে বলো।ফুলমনিকে বোনের মত আগলে রেখো ওকে আমার অভাব বুঝতে দিও না কখনো। তুমি বলো তমা আমি কি কাপুরুষের মত পালিয়ে গেলে তুমি গর্বিত হবে নাকি বীরের মত মরলে.. তমা হাত দিয়ে অরুনের মুখ চেপে ধরে। আমি তোমাকে ছাড়া কি করে বাঁচবো বাকীটা জীবন। বন্ধুহীন এ জীবন কি করে কাটবে বলো।

-বর্ষা আছে ফুলমনি আর মা ওতো থাকলো।আর যখনই তোমার এই বন্ধুকে মনে পড়বে চোখ বন্ধ করে আমায় ডাকবে আমি ঠিক চলে আসবো তাছাড়া আমার সুরগুলো তো থাকলোই পুতুল শোনা। বাড়ীর বাইরে বেশ কটা গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেলো।

-অরুন তুই পালা ওরা এসে গেছে।

-মা,তুমি অরুন পেটে ধরেছো।অরুন পালাতে জানে না।তার তেজ পুড়িয়ে দেয় সব।আজ যদি আমি পালিয়ে যাই তবে মা ও

দেশমাতৃকার কাছে আমি চোখতুলে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারবো না।মা আমায় তুমি পিঠ দেখিয়ে পালাতে আদেশ দিও বরং রত্নগর্ভা মায়ের মত বুক চিতিয়ে লড়ার সাহস দাও। কথাগুলো বলেই ফুলমনির গালে কপালে চুমু খেলো অরুন বর্ষাকে তোর কাছে দিয়ে গেলাম ফুল ওকে মানুষের মত মানুষ করবি তারপর বর্ষাকে কোলে তুলে আদর করে কেঁদে ফেললো অরুন। দরজায় তখন ধাক্কার আওয়াজ।অরুন বর্ষাকে ফুলমনির কোলে দিয়ে দরজা খুললো।দরজার বাইরে পাকসেনার সাথে ইমরান বেগ দাঁড়িয়ে।

-ফের আনা পরা। যতটা স্বাভাবিক থাকা যায় ততটাই স্বাভাবিক ভাবে অরুন

-এসো।কি ব্যাপার।

-আর্মস অর মুক্তি লোগ কাঁহা হেঁ

-এসব কি বলছো ইমরান। আচমকা ইমরান বেগ সজোরে একটা লাথি মারলো অরুনের পেটে।মাদারচুদ হামকোঁ ক্যাঁয়া সামজা।তেরে ঘর ম্যাঁ আর্মস হেঁ সাজিদ নে কাঁহা। সারা ঘরে তল্লাসিতে কিছুই মিললো না।এদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।বাথরুম ভেঙ্গে বের করা হলো পাঁচজন কে।অরুনকেও বাঁধা হলো।ঘর তছনছ করে বের করে ওদের নিয়ে বাগানে এসেই ইমরান বেগ একটু থামলেন।খুবলানো মাটির দিকে তীক্ষ নজরে কিছুক্ষন দেখে সিপাইদের অর্ডার করলেন মাটি খুঁড়তে মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে এলো অস্ত্রভর্তি ট্রাংক। ইমরান বেগের অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলো বাড়ী আর তমা,ফুলমনি আর অরুনের মায়ের কান্নায় তিরিশে আগষ্টের ভোরে যেন ভাসছিলো করুন এক সুর।

'কাঁদো বাংলার মানুষ

আজিকে কাঁদো কাঁদো কাঁদো বোন ভাই।

সোনার দেশের সোনার মানুষ

হারিয়ে গিয়েছে হায়'...



২৬#

যুদ্ধ যখন শেষ হলো...কোন কোন জায়গা নভেম্বরের শেষ থেকেই স্বাধীন হতে শুরু করেছে।সমগ্র বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত বিজয় পেলো ১৬ই ডিসেম্বর।সতের তারিখ জানা গেলো চৌদ্দতারিখ ধরে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবিসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার বিকৃত লাশ পড়ে আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

-তমা, চলো ঐখানে দেখে আসি যদি অরুন থাকে ঐসব লাশেদের মধ্যে।

-মা, আমার অরুন তো মরেনি।ও বেঁচে আছে।বেঁচে থাকবে।ঐ দেখুন ওর চশমা ওর কলম।ঐযে রেডিওতে ওর গান বাজাচ্ছে।কথা গুলো বলেই তমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ফুলমনি আর তার মা বধ্যভূমি খুঁজে এলো পেলো না।কেউ

বললো ড্রাম ফ্যাক্টরীতে গিয়ে দেখো ওখানেই তো নিয়ে গিয়েছিলো হায়নারা পহেলা সেপ্টেম্বরেও অরুনকে ওখানে দেখা গেছে।ফুলমনি আর তার মা সেখানেও গেলো তারপর এক এক করে হাসপাতালগুলো।জেলগুলো এমনকি পাকবাহিনীর ক্যাম্প বা চর্টারসেলের আশেপাশেও খোঁজা হলো।নিতাইও শরনার্থী ক্যাম্পগুলো তন্ন করে খুঁজলো কিন্তু

ফুলমনির বড়দা,ছেলেহারা মায়ের অরুনের দেখা মিললো না কোথাও।কত বীর পুত্র ঘরে ফেরে অরুন ফেরে না।

মা কাঁদে।ফুলমনি কাঁদে আর বড়দের এই ব্যস্ততায় বা বা করা বর্ষনের অস্ফুট কষ্ট বাবাকে ঘরময় খুঁজে ফেরার সন্ধানী চোখ এড়িয়ে যায় সবার চোখে।বর্ষন কথা বলতে পারে না তবু বা বা করতে করতে হারমনিয়াম জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে।দেয়ালে টানানো ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে কেউ দরজায় কড়া নাড়লে বা বা করে যেন বলতে চায় বাবা এসেছে।কিন্তু সে জানেনা তার বাবা আর ফিরবে না।বর্ষনসোনা বলে কোলে তুলে নেবে না আর কোনদিন।জানালা থেকে যতটুকু পথ দেখা যায় ফুলমনি জানালা ধরে তাকিয়ে থাকে এই বুঝি বড়দা এলো।রেডিও তে তখন বেজে যাচ্ছে

'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন'...

বধু কোন আলো লাগলো চোখে...ফুলমনি আর্টস্কুলের পড়া শেষ করে সঙ্গীতের উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে বরোদা থেকে ফেরার পর

থেকেই তার জন্য পাত্র দেখা শুরু হলো। ফুলমনির স্পষ্ট জবাব সে বিয়ে করবেনা।

মা ফুলমনিকে বোঝান ফুলমনি কিছুতেই বুঝে না।অনেক ভেবে চিন্তে ফুলমনি একটা শর্ত

জুড়ে দিলো বিয়ের ব্যাপারে। মাকে সে বললো

-

আমি বিয়ে করতে পারি তবে আমাকে যে বিয়ে করবে তাকে হতে হবে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাকে বর্ষন,বৌদিমনি আর

তোমাকে নিজের আপনজন করে একই সংসারে রাখতে হবে। মা বুঝলেন এমন পাত্র তার মেয়ের জন্য জোগাড় করা অসম্ভব এই মেয়ে আইবুড়োই থাকবে সারাটা জীবন। চিটাগাং এর একটি অনুষ্ঠানে ফুলমনির সাথে পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা রায়ানের সাথে। পরিচয়টা ঘনিষ্ট হলেও ফুলমনি প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যথার আড্ডায় না বসে শুয়ে পড়েছে কামরায়।এক ফাঁকে রায়ান এলো শরীরের কুশল জানতে চেয়ে সামনের সীটে বসে আনমনেই আবৃত্তি করতে লাগলো 'ফুলমনির অসুখ হলে সবাই বড় দুঃখে থাকে'...

ফুলমনি মনে মনে খুব খুশি হলো। তাকে নিয়ে একজন এভাবে কবিতা বানাতে পারে ভেবেই

তার আনন্দ হলো অথচ তার চোখেমুখে ভাললাগার কোন প্রকাশ ঘটলনা।আর ফুলমনি এটাও জানলো না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরার অসুখ কবিতাটি অবলীলায় রায়ান ফুলমনি নামটি জুড়ে দিয়ে নিজের কবিতা বলে চালিয়ে দিলো।

রায়ান আর ফুলমনির সম্পর্ক কখন গাঢ় হতে হতে আপনি,তুমি পেরিয়ে তুই এ এসে ঠেকেছে ওরা কেউই তা জানেনা। ভালবাসা অনেকটা ঠিক জোছনার মত। কিংবা স্রোতের মত ধীর অথচ বহমান। একবিকেলে ফুলমনির কি হলো ফুলমনি জানেনা দুম করে রায়ানকে বলো

-তুই আমাকে বিয়ে করবি? আমার সবাইকে আপন করে আমার সাথে থাকতে দিয়ে। রায়ানের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা সহসা শ্রাবণ আকাশের মত গম্ভীর হয়ে উঠলো।

-মনি, আমাকে ভাবতে হবে। অপমানে,কষ্টে আর আত্নধিক্কারে ফুলমনি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। তার মনে হলো সে আদতে বোকা।মানুষ চিনতে সে ভুল করেছে।ভালবাসলেই তাকে বিয়ে করতে হবে এমন শর্ত তো ভালবাসায় নেই।রায়ান কি তবে কেবল ভালবাসার অভিনয় করেছে।ভালবাসা কি তবে একটি শব্দ মাত্র।নিজের উপর প্রচন্ড ক্ষোভে ফুলমনি কেবল নিজের ভেতর ভেঙ্গে চুরমার করেছে নিজেকে।



২৭#

সাতদিনের দিন ফুলমনির কাছে একটি চিঠি পাঠালো রায়ান। ফুলমনি, গত কয়দিন ভেবে দেখলাম তোকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা বড় কষ্টকর। সেইদিন তোকে উত্তর দিতে পারিনি। কেন বলতে পারিনি জানিনা কিন্তু বলা উচিত ছিলো হ্যাঁ আমি তোর সব দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে করতে চাই। ভালবাসা যে কখনো কখনো বোবা হয়ে যায় তা সেইদিনই উপলব্ধি করেছি।এই কয়দিনে আমি নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছি।আর কোন

ভাবনা বা দ্বিধা নেই।তুই আমাকে বিয়ে করবি ফুলমনি?

ইতি,

রায়ান।

রায়ান,

তোকে বিয়ে করতে হলে আমাকে এখন ভাবতে হবে।আমি ভেবে দেখলাম ভালবাসাটা একতরফা তোর তরফ

থেকে কোন টান নেই।তাই বিয়ের স্বপ্নটা বাদ দিয়ে বন্ধুত্বটাই বরং বেঁচে থাকুক।

ইতি,

ফুলমনি।

চিঠি আদান প্রদানের পর রায়ান বেশ কয়েকবার দেখা করতে চেয়েছে ফুলমনি বারবার না ছুঁতায় তাকে এড়িয়ে চলে এসেছে।

-তোর সমস্যাটা কি বলবি তো?

-আমার কোন সমস্যা নেই।বাসায় বর্ষন একা আমাকে বাড়ী ফিরতে হবে এক্ষুনি।

-তুই আমাকে বিয়ে করবিই না!

-এক কথা গ্যাঁনগ্যাঁন করিস না তো।

-তোর বাড়ী গিয়ে কথা বলবো মা আর বৌদিমনির সাথে?

-খবরদার একদম না। তোকে আমি বিয়ে করবো না।

অনেক কষ্টে কথাগুলো বলে ফুলমনি রিক্সায় চেপে বসলো। সময় অনুক্ষণ হাঁটে তার পায়ে ধুলো উড়ে না।ভালবাসা কাঁচের

মতো একবার আঁচড় লাগলে কিছুতেই মোছা যায় না সেই দাগ।অনেক মান অভিমান ঝগড়া ঝাঁটির পরও ফুলমনি আর

রায়ান ও সেই দাগ মুছে ফেলতে পারেনি।সমঝোতার সীমারেখায় এসে অবশেষে তারা দাঁড়ালো। খাবার টেবিলে ফুলমনি অসংকোচে কথাটা তুললো।

-মা,রায়ান কে তো তুমি চেনো। বৌদিমনি তুমিও তো চেনো ঐ যে তথ্যমন্ত্রনালয়ে চাকরী করে।

-হ্যাঁ।কি হয়েছে ওর। তমা স্মিত হাসলো। ফুলমনি কি বলতে চাইছে বুঝতে পারছো না মা?

-বৌদিমনি!

মেয়ে বউয়ের কথা কিছুই বুঝতে পারছেননা অরুনে মা।

-কি হয়েছে বলবি তো।

-রায়ান চায়... তমা ফোঁড়ন কাটে রায়ান চায় কি চায় ফুলমনি?

-যাও জানিনা। বলে খাবার থালা নিয়ে উঠে যায় ফুলমনি।তমা হাসতে থাকে।মা কিছুই না বুঝে বিস্ময়ে তাকিয়ে তমাকে বলে

-রায়ান কি চায় রে?

-রায়ান আমাদের ফুলমনিকে বিয়ে করতে চায় মা।

-আমার এই পাগলী মেয়েটাকে রায়ান

বিয়ে করতে চায় তুমি ঠিক জানো।মনির বিয়ে নিয়ে যে নক্কড়া তা কি রায়ান জানে।জানলেও কি মানবে এইসব পাগলামী?তুমি বরং রায়ানের সাথে কথা বলো বউমা।রায়ানকে একদিন বাসায় আসতে বলো।একটা গোটা জীবনের ব্যাপার

বিয়ে তো আর পুতুল খেলা নয়!



২৮#

তমার আমন্ত্রণে রায়ান ফুলমনিদের বাড়ীতে এলো।মা আর তমা দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বললো।ফুলমনির শর্তের

কথাও উঠে এলো।রায়ান চুপচাপ সব শুনলো।উঠে পরার আগে বর্ষনকে কোলে তুলে নিয়ে শুধু বললো আমি সব জেনে শুনেই ফুলমনির হাত ভিক্ষা চাইছি।যদি আপনাদের কোন অসুবিধা না থাকে আমি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত।বর্ষন আমার মেয়ের মতই

বড় হবে।রায়ান ও ফুলমনির পরিবারের আলাপ আলোচনা চলো আরো কিছুদিন।তারপর ঠিক হলো বিয়ের দিন তারিখ।

জানুয়ারীর ঠান্ডায় দুটি উষ্ণ হৃদয় পর্দাপন করলো অচেনা অজানা সংসার জীবনে।ভালোবাসা যেখানে গভীর সেখানে অনেক অপ্রতুলতাও যে ভালোবাসায় প্রতুল হয়ে ওঠে। রায়ান ও ফুলমনির সংসারে ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না তাই অনেক

প্রতিকুলতা তাদের ভালোবাসার স্রোতে ভেসে গেছে। বর্ষন একটি কিন্ডার গার্টেনের প্লেতে ভর্তি হয়েছে।এরই মাঝে ফুলমনির গর্ভ থেকে পৃথিবীর আলো দেখলো কিংশুক।বর্ষণ পেয়ে গেলো তার খেলার সাথী।কিংশুক যখন চার বছরের তখন রায়ান ফুলমনির সংসারে এলো আরেক নবজাতক দিশা।

বর্ষন,কিংশুক আর দিশা ফুলমনি আর রায়ানের তিন সন্তানের পরিচয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো।বর্ষনের ভেতরে যে একটা ক্ষোভ ছিলো তার বাবা কেন তাকে এভাবে রেখে চলে গেলো।সময়ের প্রলেপে রায়ানের স্নেহে সেই ক্ষোভ যেন শুকিয়ে আসচ্ছিলো সময়ের নিয়মেই।



২৯#

আমরা সবাই রাজা...

বর্ষন যখন ক্লাস ফাইভে আমি তখন ওয়ান।দিশা তখন প্লে।বর্ষন বোন থেকে কখন যে আমার বন্ধু আর মা হয়ে উঠেছে জানতেই পারিনি। আমার স্কুল ছিলো সকালে আর বর্ষনের দশটায়।প্রতিদিন আমায় ডেকে তুলতো বর্ষন।আমি চিরদিন ঘুমকাতুরে কত পন্থায় যে বর্ষন আমাকে তুলতো।ঘুম থেকে তুলে ব্রাশ করিয়ে আমার স্কুল ড্রেস পড়িয়ে খাইয়ে দিতো।জুতার ফিতা আমি আজো বাঁধতে পারিনা বর্ষন জুতার ফিতা বেঁধে দিতে দিতে বলতো আমাই যদি দিদিভাই না ডাকিস কাল থেকে দেখবো কে তোকে ফিতা বেঁধে দেয়। দিশা তখন এত কিছু না বুঝলেও এইটুকু

বুঝতো বর্ষন আমাকে একটু বেশিই ভালবাসে তাই প্রতিদিন গোমরা মুখে তাকিয়ে থাকতো সে।বর্ষন

তখন দিশার কাছে গিয়ে চুল আঁচড়ে দিতো।দিশা ইচ্ছা করে চুল এলোমেলো করে দিতো বর্ষন আবার আঁচড়ে দিতো।

খাওয়াতে গেলে দিশা খেতো না। তখন তাকে আদর করে বর্ষন কোলে বসিয়ে বলতো

-কিংশুক একটা পচা ছেলে আমার দিশামনি কত লক্ষ্মী বোন।দাদাভাইতো তোমার মত ড্রেস পড়তে পারেনা। ফিতা বাঁধতে পারেনা তাই তো দাদাভাইকে করে দিতে হয় নাহলে যে দাদাভাই স্কুলে যেতে পারবেনা।আর তুমি তো সব পার দাদাভাইয়ের চেয়ে তুমি আমার কত্ত প্রিয়।তোমায় আমি কত্ত ভালবাসি দেখো তোমায় আমি চকলেট দেই।আইসক্রিম খাওয়াই

দাদাভাইকে তো দেই না।দিশার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বাবা কে আমি যতটা ভালবাসি তার জন্যই কিনা ভয়টাও একটু বেশি পাই।আর ঐ বয়সেই আমি জেনে গিয়েছিলাম বর্ষন

বাবার খুব কাছের জন। বর্ষনকে জোরে কথা বলতে বাবা কিংবা মা কে আমি কোনদিন

দেখিনি।তাই এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আমার যত আবদার সব বর্ষনের কাছে।এমন

কি খাতা কলম কিনতে হলেও আমি কখনো বাবা মা কে বলিনি।বর্ষন

কেই বলতাম।আর বর্ষন সেটা বাবা কিংবা মা কে বলতো। মা বাবা দুজনেই কর্মব্যস্ত।তবু

আমারা তিনজন তাকিয়ে থাকতাম শুক্রবারের প্রতীক্ষায়। শুক্রবার ছিলো আমাদের জন্য

সোনালী সময়।সারা সপ্তাহের কর্মব্যস্ততায় কাটানো বাবা শুক্রবার দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই

আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।আমাদের তখনো গাড়ি হয়নি।রিক্সায় চেপে আমাদের দিয়ে শহরের

আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতেন বাবা।বাবার পাশে বসতো বর্ষন কোলে দিশা আর আমি বসতাম উপরে।

শুক্রবার মানে শুধু ঘোরা নয় বাবা আবৃত্তি করতেন রূপসীবাংলা,বনলতা সেন,তুমি বলেছিলে,শহীদদের

প্রতি,নিজের স্বদেশে,আগ্নোয়াস্ত্র সহ বহুকবিতা।কোন কোন দিন গল্পে গল্পে বলতেন যুদ্ধের গল্প।

কোন কোন শুক্রবার বাবা আমাদের আবৃত্তি করতে বলতো। বনলতা সেন,রূপসী বাংলা আংশিক

বলে ফেললেও দুইলাইন বলা বর্ষনের প্রশংসায় বাবা পঞ্চমুখ। দিশা আধো আধো শব্দে যখন আবৃত্তি করে তখন এক

মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু বাবা আমাকে কিছুই বলে না।আমার ভেতরে তখন রাগ বুদবুদ করে।

বাসায় ফিরে বর্ষন আমায় বোঝায় তোর আবৃত্তিটা সবচেয়ে ভাল হয়েছে রে কিংশুক বাবা চায় তুই আরো ভালো আবৃত্তি কর তাই কিছু বলে না।এটাই তোর প্রেরণা মন খারাপ করিস না।বাবা তোকে কত ভালবাসে তুই জানিস না।

-কচু ভালবাসে বাবা মা তোকে আর দিশাকেই ভালবাসে আমাকে ঠিকই হয়ত

পেয়ে এনেছে।তুই বলিস না আমাকে ফুটপাত থেকে কুঁড়িয়ে এনেছে এটাই ঠিক।

-ধুর পাগল এটা তো আমি তোকে ক্ষ্যাপাতে বলি রে বোকা। ঋতু পর ঋতু বদলে যায়।বর্ষন এস.এস.সি তে প্রথম শ্রেণীতে পাশ

করে। আমি আরো বেশি ছায়া সঙ্গী হয়ে উঠেছি বর্ষনে। বর্ষণ বান্ধবীর সাথে বেড়াতে যাবে আমিও জেদ ধরি ওর সঙ্গে যাবার। কখনো কখনো বকা ও মার জুটে তবুও আমি বর্ষনের পিছ ছাঁড়িনা।ওর বন্ধু বান্ধবীরা অবাক হয় এতবড় তবু বর্ষনকে আমি আজো দিদিভাই ডাকিনা।নাম ধরে ডাকার জন্য বাবার বকা খেয়েছি মার হাতে মার খেয়েছি তবু দিদিভাই ডাকিনি।মিষ্টিমামী আর দিদা প্রশয় দেয়। মেরে কি হবে।বড় হলে ঠিক ডাকবে। দিদিভাই ডাকা নিয়ে বর্ষন ও কয়দিন কথা বলেনি।তখন চিরকুটে আমাদের কথা চলেছে। বাবা ঠিক করলেন বর্ষনকে পড়তে ভারতে পাঠাবে। স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা হলো। আমিও জেদ ধরেছি আমিও ভারত যাবো বর্ষনের সাথে।বাবা কিছুতেই রাজি না।মিষ্টিমামী আর দিদাকে ধরলাম আমি জানি তাদের কথা বাবা ফেলবেনা।মা কে বললাম মা সাত পাঁচ বুঝিয়ে বললো তুই

আরেকটু বড় হও তোকেও পাঠাবো বাবাই।এখন দিদিভাই যাক তারপর তুই যাস।আমি বর্ষনকে ছাড়া একা থাকতে পারবো না মা। বাবাকে বলো না মা।



৩০#

বর্ষনের কলকাতা যাবার প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে।মা বর্ষন আর মিষ্টি মাসি কি কিনতে মার্কেটে গেছে।

আমি আর দিশা গিয়ে বসেছি দিদার ঘরে অনেক পুরনো কথার মাঝে উঠে এলো মিষ্টিমামার নিরুদ্দেশের পর দাদুর ব্যাংকের চাকরীর পেনশনে সংসার চলছিলো না মার আর্টকলেজে পড়ার খরচ তারপর ভারতে যাবার খরচ তার উপর সংসার চলানোর খরচ চলাতে দাদু হিমসিম খাচ্ছিলো অগত্যা দাদু অনেক ভেবে সংসার সচল রাখতে দোকান খুলে বসলেন। অরুনটা যদি থাকতো তবে বৃদ্ধ বয়সে মানুষটার এত খাটতে হতো না বলে দিদা চোখ মুছে তাছাড়া মেয়েটাও পিতৃহীনের অভিমানে এত একরোখা হয়ে উঠতো না। কথাটা আমি প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।তাই

দিদাকে আবার ঘুরিয়ে বললাম বর্ষনতো একরোখা হয়েছে তোমাদের আদরে আদরে।দিদা আঁচলে চোখ মুছলো কিংশুক দাদুভাই তোমার মিষ্টিমামার খুব প্রিয় ছিলো তার বোন ফুলমনি আর মেয়ে বর্ষন!তোমার মা তো তাও অনেকটা সময় পেয়েছে তার বড়দাকে কিন্তু বর্ষন তো বাবার স্নেহ ভালোবাসা কি বোঝার আগেই তো বাবা হারা হলো।কি পোড়া কপাল নিয়েই না এসেছে মেয়েটা।এই প্রথম আমি জানলাম বর্ষণ আমার মামাতো বোন।কেন জানিনা চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার।তখন মনে হলো আমার প্রাপ্য স্নেহ ভালবাসাও বাবা মা ওকে দিয়ে দিক। সেদিন থেকে আমার ভেতরে যে কি এক ভাঙন শুরু হয়েছিলো আর সেইদিনই প্রথম আমি নিজের অজান্তে বর্ষনকে দিদিভাই বলে ডেকেছিলাম।বাড়ীর সবাই সেদিন বিস্ময়ে আমাকে দেখেছে।যদিও এরপর আর কোনদিন ওকে দিদিভাই ডাকিনি। কেন সেদিন দিদিভাই ডেকেছিলাম আমি আজো তার উত্তর খুঁজে পাই না।



৩১#

দূরে কোথাও দূরে দূরে...



গতকাল বর্ষন কলকাতায় চলে গেছে। সঙ্গে মা,বাবা আর দিশা গেছে।নিতাই মামা মারা গেছেন বহুবছর।এতবছরেরও এই একটি পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। অর্নবদা এম.বি.এ করে নিতাইমামার থ্রিস্টার হোটেল দেখে,আর রাধিকা মামী ছেলে বউ নাতি নিয়ে বেশ আনন্দেই আছেন।বর্ষনের কলকাতায় পড়তে যাবার খবর পাবার পর কতবার যে টেলিফোন করেছেন হিসাব নেই। হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হলেও রাধিকা মামীর আবদার তার দাদার মেয়ে এইবাড়ীতে থেকেই পড়বে। বর্ষনের চলে যাবার পর অনুভব করলাম আমারমাঝে ও বাড়ীতে এক বিশাল শূন্যতা। বাড়ীতে থাকলে মনে হয় এই বুঝি বর্ষন ডাকচ্ছে।একটা মানুষের শূন্যতা যে এত প্রকট হতে পারে আমি এই প্রথম উপলব্ধি করলাম আর তক্ষুনি মিষ্টিমামার শূন্যতা বর্ষনের মাঝে কত বড় শূন্যতা তা যেন অনেকটা অনুভব করতে পারছিলাম। বর্ষন যে বাড়ীতে নেই এটা মনেই

থাকেনা।সকালে মিষ্টিমামী ঘুম থেকে ডেকে দেয়ার পর আমার হাঁকডাক শুরু হয়ে যায় বর্ষন মাথা আচঁড়ে দে,খাইয়ে দে,জুতার ফিতা কে বাঁধবে কোথায় তুই জলদি আয়। পলকেই মনে পড়ে বর্ষন কলকাতায়।

দিদা কিংবা মিষ্টিমামী এগিয়ে আসে। আমি জুতার ফিতা না বেঁধেই বেরিয়ে পড়ি স্কুলে।

সময় উড়ে যায়।শূন্যতাও সময়ের নিয়মেই বুকের কোণে ঘাপটি মেরে চুপচাপ জেগে থাকে।বর্ষন ছুটিতে আসচ্ছে। বাড়ী জুড়ে তোড়জোড়।প্রায় একবছর পর বর্ষন আসবে।আগামী বৃহস্পতিবার বর্ষন আসবে।আমার আনন্দের সীমা নেই।এই একবছরের শুক্রবারগুলোতেও আমি বাবা আর দিশা রিক্সায় বেরিয়ে বেড়িয়েছি কিন্তু কোথায় যেন একটা খামতি ছিলো।কোথায় যেন কিছু একটা নেই।এই শুক্রবার নিশ্চয় সব খামতি সব শূন্যতা ঘুছে আমরা আবার একসাথে ঘুরে বেড়াবে শহরের পথে প্রান্তরে। মিষ্টিমামী বললো এবছর আমাকেও নাকি বর্ষনের সঙ্গে পড়তে পাঠাবে কলকাতায় বাবা নাকি এমনটাই বলেছে।ডবল খুশিতে আমায় আর কে পায়। আনন্দে আমি তখন উড়ছি। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখ কেটে যাচ্ছি রোজ।

-কুম্ভকর্নের বাপ উঠ।নয়ত জল ঢেলে দেবো। মামীর আওয়াজটা বর্ষনের মত লাগছে ভেবে আমি মুখ ডেকে পাশ

ফিরে শুই।

-বিলু এই বিলু উঠছ।

বর্ষন খুব আদর করে আমায় বিলু ডাকে।তড়িঘড়ি উঠে বসি।বর্ষন জড়িয়ে ধরে।আমার বিলুটা কত্ত বড় হয়ে গেছে।খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক করিস না মনে হচ্ছে শরীরটা কেমন শুকিয়ে গেছে।দুইভাই বোন

জড়িয়ে কাঁদতে থাকি।তুই ও তো শুকিয়ে গেছিস।দরজার বাইরে তখন সবাই দেখছে ভাইবোনের অকৃত্রিম ভালবাসার আন্তরিকতার টান।



৩২#

আমি কলকাতায় এসে সিক্সে ভর্তি হলাম।অর্নবদা প্রতিদিন আমায় স্কুলে ড্রপ করে দিয়ে যায় রাধিকা মামী ছুটির পর আমাকে নিয়ে যায়।কলকাতায় আসার পর শুক্রবারটা খুব মিস করি।যদিও কলকাতার ছুটির দিন রবিবার।অর্নবদা আমাদের নিয়ে গড়েরমাঠে যায়,ভিক্টোরিয়া,জাদুঘরে নিয়ে যায় কখনো কখনো শান্তিনিকেতন,দীঘা ও যাওয়া হয় কিন্তু বাবার সাথে শুক্রবারের সেই রিক্সা ভ্রমণ এগুলোকে কিছুতেই ছাপিয়ে যায় না। এখানে আসার পরই আমি বুঝেছি বাবা,মা আর দিশাহীন আমি কতটা অপূর্ন,পূর্নিমার রাতে মিষ্টিমামীর কুলে মাথা রেখে দিদাকে জড়িয়ে ধরে গল্প শোনার অপূর্নতা মাঝে মাঝে ভাবায় ঐখানেই তো ভালছিলাম কেন এলাম কলকাতায়।রাধিকামামী কিংবা বৌদির স্নেহ ভালবাসার কমতি ছিলো না কিন্তু কোথায় যেন এক অপূরনীয় অভাব। রাধিকামামী বাবাই করে ডাকলেও সেই ডাকে যেন মা কে খুঁজে পাইনা।কোন কোন রাত মা ও সবার কথা ভেবে কষ্ট গলে গলে বালিশ ভেজায়।

মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হবার দিন আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা মা আর দিশা এসে হাজির।বর্ষন ও এলো হোস্টেল থেকে।আমার তো ভয়ে বুকে জল নেই। অর্নব দা স্কুল থেকে গোমড়া মুখে এসে জানালো আন অফিসিয়ালী প্রিন্সিপালের কাছ

থেকে জেনে এসেছে আমি ডাব্বা মেরেছি। এক দৌড়ে বিছানায় গিয়ে কাঁদতে লাগলাম! আমার আত্নবিশ্বাস আমি ফেল করতে পারিনা।কিছুক্ষণ পর বর্ষন এলো ঘরে।বিলু কাঁদিস না এবার হয়নি পড়ের বার হবে এনে ফেল করার উপলক্ষে একটা সন্দেশ খা। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলাম বর্ষন কে। বিলু ধর তুই যদি এখন শুনিস রেকর্ড মার্কে তুই বোর্ডে প্রথম হয়েছিস তখন

কেমনটা হবে একবার ভাব।আমার সোনাভাই এতবছরের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে ছিয়ানব্বই শতাংশ মার্ক নিয়ে প্রথম হয়েছে যা ইতিহাস।অর্নবদা ইয়ার্কি মারছিলো তোর সাথে। আমি এক লাফে উঠে জড়িয়ে ধরলাম বর্ষনকে সত্যি বলছিস তুই।হ্যাঁ রে। এবার চোখ মুছ।ওড়নার আঁচলে চোখ মুছিয়ে দুজনে মিলে সন্দেশ খেলাম আমি আর বর্ষন বাইরে তখন হাসির রোল।



৩৩#

যে রাতে দুয়ার গুলি ভাঙলো ঝড়ে...

ভার্সিটিতে ভর্তি হবার কয়েকদিন পরেই বর্ষনের সাথে পরিচয় হলো বাংলাদেশী এক যুবক পলাশের সাথে।

পলাশ বর্ষনের এক বান্ধবীর

আত্নীয়ে দাদা।এসেছে কলকাতা সহ ভারতের কিছু জায়গায় ঘুরতে।বান্ধবীর

সাথে পলাশকে কলকাতা ঘোরাতে বর্ষনও কিছু কিছু জায়গায় ঘুরতে গেছে।কেউ কেউ এমন থাকে যাকে এক পলকে দেখেই

ভাল লাগে।পলাশের চেহারাও তেমন।তার

উপর তার উচুঁতা চোখে পড়ার মত। ফ্যাশন সচেতন কিংবা নিজেকে আর

দশজনের মাঝে একজন করে তোলার চেষ্টা তার বেশভূজায় বেশ পরিস্কার

ছাপ রেখেছে।কথা বার্তাতেও পলাশ বেশ

বিচক্ষণ তাছাড়া পলাশের রসবোধ ও যে কাউকে একপলকেই আকর্ষিত

করতে সক্ষম। কফি হাউজে বসে কথার মাঝে পলাশ ইচ্ছা করেই আলতো হাত ছুঁয়ে দিলো বর্ষনে।তড়িত্ গতিতে হাত

সরিয়ে নিলো বর্ষন।কিছুই যেন হয়নি এমন ভাব করে পলাশ

-বর্ষন তুমি কাউকে ভালবাসো?তোমার বান্ধবী তো শুনলাম তিনজনকে নাকে বড়শি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। বর্ষন এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না।বান্ধবী রাকাই উত্তর দিলো।

-

তোকে কে বলছে রে তিনজনকে বড়শি দিয়ে ঘুরাচ্ছি।

ছেলে বন্ধু দেখলেই তোরা খালি প্রেমিক ভাবিস এই চরিত্রটা বদলা।আর বর্ষনকে নিয়ে তোর এত ইন্টারেস্ট কেন রে।

-এত সুন্দর একটি মানুষ কারো চোখে পড়লো না।সুন্দর মানুষটিও কারো দিকে তাকালো না এটা একটা বিস্ময় কর ব্যাপার না।তার উপর তোর প্রিয় বান্ধবী তোর ভাইরাস তাকে ছুঁলো না এটা বিশ্বাস করা কঠিন না। রাকা চেচিঁয়ে উঠলো।আমি মোটেই এমন না।উল্টোপাল্টা কথা বললে আমি কিন্তু চলে যাবো। বর্ষন নীরব হয়ে শুনছিলো সব।কফি হাউজ থেকে বেরিয়ে কলেজস্ট্রীটের দেজ এ ঢুকলো তারা।বেশ কিছু বই দেখে পলাশ দুটি বই নিলো। একটি সুনির্বাচিত প্রেমের কবিতা বইটি বর্ষনকে দিলো আর রাকাকে দিলো সুনির্বাচিত গল্প।কাল আমি বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছি।এই বইটি আমাকে ও আমাদের

কাটানো দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে থাকবে। রাকা কি একটা বই খুঁজতে পাশের দোকানে গেলে পলাশ গলার স্বর নামিয়ে একটা কার্ড দিয়ে বললো।

-এই কয়দিনে তোমায় আমি ভালবেসে ফেলেছি।জানি তোমার যোগ্য আমি নই।তবু হৃদয়ে যদি কখনো আমার জন্য একটুও

ভাল লাগা তৈরী হয় কার্ডের ঠিকানায় একটা চিঠি লিখো আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে আসবো তোমার কাছে। রাকা ফিরে এলো।কি রে কি এত কথা বলা হচ্ছে।বর্ষন তখনো চুপ পলাশই বললো তোর বান্ধবী আমার চলে যাবার বিরহে বোবা হয়ে গেছে।হয়ত ভালোবেসে ফেলেছে এ কদিনে।ইশ! চেহেরাটা আয়নায় দেখছিস তোর প্রেমে পড়বে বর্ষন কত হাতি গেলো তল মশা বলে কত জল !



৩৪#

আমাকেই প্রথম জানালো বর্ষন সে আর পড়বে না বাংলাদেশ ফিরে যাবে। আমরা এত ঘনিষ্ট হলেও বর্ষন পলাশের কথাটা আমার কাছে চেপে গেলো।তার বক্তব্য পড়ালেখা আর মাথায় ঢুকছে না তাছাড়া বাবা মার জন্য তার খুব কষ্ট লাগছে সে আর কলকাতায় থাকতে পারবে না।অর্নবদা,বৌদি,রাধিকা মামী সবাই বোঝালো তার এক জেদ সে বাংলাদেশ

ফিরেই যাবে।খবরটা বাংলাদেশ জানালো হলো বাবা বলবো কয়েকদিন বাংলাদেশ থেকে ফিরে যেও। না বর্ষনের এক কথা সে আর কলকাতায় ফিরবেনা।সে এখন থেকে বাংলাদেশেই থাকবে।বর্ষন ফিরে যাবার তিনদিন আগে পার্কস্ট্রীটে রাকাদির সাথে দেখা আমরা নিউমার্কেটের সামনে ওবরয় হোটেলের বাঁপাশে ফুচকা খেতে খেতেই রাকাদির কাছে পলাশ নামটা জানলাম।শুনলাম আরো অনেক কিছুকথা।

-কিংশুক,বর্ষনকে তুইই ফেরাতে পারবি। ছয় সাতমাসে জল যদিও

অনেকটা গড়িয়েছে তবুও চেষ্টা করলে তুই পারবি।পলাশ খুব ভাল

ছেলে না রে।নিজের কাকাতো ভাই তবু বলছি।বর্ষনের চোখে এখন পলাশের উপর অংশের রঙিন চশমা। আরো কি কি বলে গেলো রাকাদি আমার কানে কিচ্ছু ঢুকছিলো না কেবল বুকের ভেতরে একটা কথাই বাজচ্ছিল বর্ষন ভুল পথে হাঁটছে।

বাড়ী ফিরে হাসতে হাসতেই বর্ষনকে বললাম

-পলাশ যুবরাজটা কে রে?

বর্ষন একটু লজ্জা পেলো হয়ত আলতো করে একটা চাপড় দিলো।

-পলাশ কে আমি কি জানি।

-ন্যাকামী করবিনা বলছি পলাশটা কে?

-তুই আমার ডাইরি পড়েছিস নাকি পলাশের চিঠি?

-আমি কিচ্ছু পড়নি।আজ রাকার সাথে দেখা হলো চৌরঙ্গীতে কথায় কথায় পলাশের কথা বললো।

-ওই শয়তান আমাকে নাম ধরে ডেকে ডেকে বেয়ারা হয়েছো রাকা দি বলতে মুখে বাজে।

-তুই আমার কাছে এত্তবড় একটা ঘটনা লুকিয়ে গেলি কি করে বর্ষন! বর্ষন অপরাধবোধে হোক কিংবা কিছু

একটা ভাবলো বেশ কিছুটা সময় নীরব থেকে।বেশকিছু চিঠি এনে আমায় দিলো পড় এগুলো।তবেই বুঝবি পলাশ কে?

কতটা ভালবাসে আমায় পাগলের মত দেখ।

চিঠির খামে ও চিঠির কাগজে একটা শৈল্পিক ছোঁয়া আছে যা প্রথম দেখাতেই ভাল

লাগে।চিঠিগুলো সব পড়লাম।কিন্তু চিঠিগুলোয় এত বেশি প্রশস্তি এত

বেশি মুগ্ধতা আর সুখে রাখার এত আশ্বাস আমাকে কেন জানি অচেনা অজানা মানুষটির

প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাসের জন্ম দিলো।বর্ষনকে কিছুই বললাম

না বললাম বেশ তো পড়াটা শেষ করে তারপর বিয়ে কর।

-তুই বুঝবি না বিলু।

আমি সবটুকু না বুঝলেও এইটুকু বুঝেছিলাম শরীর বড় বিশ্বাসঘাতক।



৩৫#

ভালবাসা মানুষের বোধ চিন্তাকে অচেতন করে দেয়।নিজের সত্ত্বা হারিয়ে যায়।বর্ষনের ক্ষেত্রেও তাই হলো। মা বাবা কারো কথাই সে শুনলো না ফিরে গেলো বাংলাদেশ পলাশের টানে।বাড়ীতে কলকাতায় এই নিয়ে অনেক কথা বার্তা রাগারাগি হলো তবুও তার এক কথা সে বাংলাদেশ ফিরে যাবে। কারণটা কেউ না জানলেও মাকে অগত্যা পলাশের কথাটা আমাকেই জানাতে হলো।মার কাছে থেকে কথাটা বাবার কানেও গেলো।বর্ষনের জিদের কাছে হার মানলো সব যুক্তি তর্ক বর্ষন ফিরে গেলো বাংলাদেশ পড়ালেখার পাঠচুকিয়ে।মিষ্টিমামী কে কিছু জানানো হলো না। হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিয়ে আমি ও

ছুটিতে দেশে এলাম।তিনমাসের ছুটি। বর্ষন আমাকে নিয়ে গিয়ে পলাশের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।কেন জানিনা পলাশকে একদেখায় আমার ভাল লাগলো না।বাসায়

ফিরে বর্ষনকে কথাটা বলতেই বর্ষন ক্ষেপে গেলো।

-কি খারাপটা দেখলি।কয়েকঘন্টায় একটা মানুষকে দেখে তুই বুঝে ফেললি পলাষ ভাল না।যত্তসব।

রেগে বেরিয়ে গেলো বর্ষন।আর আমি ভাবতে লাগলাম কেন একপলকে আমার পলাশকে ভালোলাগলো না।এতবড়

এক্সপোর্ট ইনপোর্ট বিজনেসম্যান। দেখতে শুনতে ভাল তবু কেন আমার

ভাললাগলো না।এটা কি আমার মনের জেলাসী নাকি বর্ষনের

ভালবাসা স্নেহ ভাগ হয়ে যাবার আশংকায় পলাশকে আমার ভাল লাগেনি। নাকি এ কোন মনের আগাম বার্তা।



৩৬#

বাবা মার এই বিয়েতে মত নেই মিষ্টিমামী ও দিদার ও একমত

এমনকি দিশা ও রাজিনা।বর্ষনের স্পষ্ট কথা বিয়ে করতে হলে সে পলাশকেই বিয়ে করবে।আর আমাদের সবার অমতের

একটাই কারণ শিল্পসংস্কৃতিহীন ব্যবসায়ী পরিবারে মিষ্টিমামার মত শিল্পসংস্কৃতি মনা একজন পথিকৃত্ এর মেয়ের বিয়ে হতে পারেনা।পলাশের পরিবারে শিল্পসংস্কৃতির ছিটেফোঁটাও

নেই ব্যবসা ছাড়া ওদের পরিবার আর কিছু শিখেনি।তবে বর্ষনের জন্য পলাশকে গানের স্কুলে ভর্তি হতে হলো। কয়েকমাস গানের ক্লাসে বেশ উদ্দীপনা নিয়ে গেলেও কিন্তু মাস

ছয়েক পড়েই পলাশ বুঝলো সঙ্গীত শিক্ষা ব্যবসা নয়।অগত্যা গানের ভুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হলো পলাশকে। বর্ষনের জেদের কাছে পরিবারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পলাশের পরিবারের সাথে কথা চললো।অর্নবদা সহ সপরিবারে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এলো বর্ষনের বিয়ে উপলক্ষে।একমাত্র আমিই গেলাম না।কলকাতা থেকে ওর বিয়ের সব শপিং করে দিয়েও আমি আসিচ্ছি না শুনে টেলিফোনে বর্ষন খুব কাঁদলো অনুরোধ করলো বিয়েতে আসতে।মা বার বার ফোন করে বলেছে বাবাই তুই আয় বাবা নয়ত খারাপ দেখাবে ব্যাপারটা।বাবাও একদিন ফোন করে আসতে বলো। বাবার মুখের উপরে আমি কোনদিন কথা বলিনা। সে দিন যে আমার কি হলো বাবার মুখের উপরে বলে ফেলাম তোমার আদরের

মেয়ে যখন পরিবারকে অবজ্ঞা করে তোমাদের ভালবাসাকে তুচ্ছ করে সবার অমতেই বিয়ে করতে চাইছে সেই আদরের মেয়ের

বিয়েতে তোমরাই আনন্দ কর আমি আসচ্ছি না।বাবা একটা কথাও বললো না।মৃতপুরীর নীরবতা টেলিফোনের ঐদিকে।

হ্যালো,হ্যালো বাবা,এইজীবনে আমাদের আর শুক্রবার করে রিক্সায় ঘোরা হবেনা।আমাদের এখন তিনটে গাড়ী অথচ বুকের ভেতর সেইসব দিন ডেকে যায় তুমিও শুনতে পাও আমি জানি।চোখ কেবল পোড়ায় আর পোড়ায়।বাবা টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিলেন ওপাশ থেকে শুধু কান্নার মত টু..টু.. বেজে গেলো কিংবা অব্যক্ত এক পিতার কান্না টুটু শব্দে কেঁদে উঠলো।



৩৭#

বাইরে দুঃখের মতো মিহিন বাতাস...

চারদিকে সোনারঙ বালির ঢিপি। লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে চলেছে একদল উট।দূরে দেখা যাচ্ছে মাটির নিকোনো দেওয়াল ঘেরা বনজারাদের ছোট্ট একটি গ্রাম। রাজস্থানি সঙ্গীতের নেশা ধরানো সুর ভেসে আসচ্ছে।মাটির উনুনে সেঁকা হচ্ছে মোটা মোটা রুটি। হানিমুনি এসে রাজস্থানী সুরে পাগল হয়ে কখন বর্ষন গাইতে শুরু করেছে'বিনিদ্র এই রাত্রি আমার মৌনতার এই সুতোয় বোনা'।

-যত্তসব বালির ঢিপিতে কেউ হানিমুনে আসে।টাকাটাই মাটি। এখানে বসে না থেকে উঠো জয়সলমির থেকে স্যামের দুরত্ব আরো প্রায় পঞ্চাশ কিমি। এই প্রথম পলাশের কথাটা শুনে বর্ষনের মনে হলো কিংশুকের কথা প্রথম দেথার দিনই ও বলেছিলো দেখিস পলাশ সবকিছুতে টাকা টাকা করবে।

মা বাবাও বলেছিলো পলাশের রক্তে সাংস্কৃতিক ছোঁয়া নেই ও তোকে বুঝবে না।এখন যেটা দেখছিস অনুভব করছিস সেটা কেবল মোহ রে মা।

কথাটা গাঁয়ে মাখলো না বর্ষন। হানিমুনটা স্যাম স্যান্ড ডিউনে করবে এটা বর্ষনের অনেক দিনের স্বপ্ন।জয়সলমির থেকে জিপে যেতে যেতে রাস্তায় ময়ূর ময়ূরীর ছোটাছুটি আর উটের দল দেখে আনন্দে নেচে উঠতে মন চাইলো পলাশ গোমড়া মুখে বসে।

-কি হয়েছে তোমার চুপ কেন এই দেখো থর মরুভূমির দিগন্তবিস্তৃত বালিয়াড়ি স্যাম। জানো এখানে প্রতিমুহূর্তে হাওয়ার

গতিবেগের ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে বদলে যায় বালিয়াড়ির আকার আয়তন।শুধু আকার বা অভিমুখ

নয়,আলো ছায়ার এই নিসর্গ চিত্রকল্প প্রতি মুহূর্তে বদলে ফেলে নিজের রঙও। দেখো পলাশ ঐ যে সোনালী ঢেউয়ের

ওঠাপড়াগুলো দেখে মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোন শিল্পী তাঁর সূক্ষ্ম তুলির টানে তৈরী করছেন নিজস্ব অননুকনীয় ক্যানভাস।

-মাথা ধরছে একটু চুপ কর প্লীজ। গুম মেরে গেল বর্ষন।নতুন জীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই এক ছায়াযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে যেন। এরকমটা তো কল্পনা করেনি সে !



৩৮#

হানিমুন থেকে ফিরেই পলাশ ব্যবসায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।পাবার আকাঙ্খা পাবার পর ফুরিয়ে অসে।আমার সাথে আজো বর্ষনের দেখা বা কথা হয়নি।মার কাছে ওর খবর নেই।ভাল আছে জেনে মনের গভীরে তৃপ্তি পাই।সময় ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।বন থেকে বনের মাথায়,জল থেকে জলের শূন্যতায়।তারই মাঝে মাঝে ভাঙা সেতু। জোড়া লাগে।হারায়,ফিরে পায়,আবার হারায় ফিরে পেয়ে যায়। তবে স্মৃতি তাহলে এখনো রয়ে গেছে। বর্ষন সুখে আছে জেনে খুশি হই।কিন্তু ওর জন্য আমার ভেতর যে শূন্যতা তা কেমন?ঈশ্বর যেমন। ঈশ্বর কেমন?একটা গোলাকার বস্তু,মনের ভেতর আবোল তাবোল কথা দগ্ধ করে।ঈশ্বর গোলাকার হলে আমি না দিয়ে আরম্ভ করে নাতেই পৌঁচ্ছাবো,বর্ষন হ্যাঁ দিয়ে আরম্ভ করে তবে হ্যাঁতেই পৌঁচ্ছবে।ঈশ্বর তবে হ্যাঁ এবং না।তবে শূন্যতাও না এবং হ্যাঁ!মাথা গুলিয়ে যায়। টেলিফোনটা তুলে নাম্বার চাপি। রিং হতেই কেটে দেই।আবার চাপি আবার কেটে দেই।মনটা খুব চাইছে বর্ষনকে কল করে চমকে দেই কিন্তু সব শূন্যতার শিল্প এক রকম নয়। যেমন আমারটা।



৩৯#

ভালবাসার ও একটা অসহ্য ভার আছে। তাকে বহন করে চলার জন্যেও একটা শক্তি লাগে,অলিখিত কিছুশর্ত আপনা থেকেই এসে যায়।হয়তো বা সেই সব মানতে মানতে এক ধরনের ক্লান্তিও এসে যায়।মানুষ সেটা বুঝতে পারেনা। কিংবা পারলেও যা পেয়েছে সেটা হারানোর ভয়ে চুপ করে থাকে।বর্ষনের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা প্রথমে এরকম হয়নি। শ্বশুরবাড়িতে আসার পর পরিবারের সকলের সাংস্কৃতিক রুচির অভাব ননদের কুটনামী সহ আরো কিছু মেয়েলী ব্যাপার বাদ দিলে সকলের থেকে এত ভালবাসা ও মনোযোগ পেয়েছিল যে,সত্যিই সে খুশিতে ভয় পেয়ে উঠেছিল।ওর ওপরে সকলের নির্ভরতা ও উপভোগই করত। পলাশের বাড়ী ফেরা দিনকে দিন সময় অতিক্রম করে যাচ্ছে বিয়ের পরে পরে এগারটা সাড়ে এগারটায় ঢুকে পড়তো এরপর একটা দুটো হতে লাগলো আজ ভোর চারটায় টলতে টলতে পলাশ বাসায় ফিরলো।

-তুমি মদ খেয়ে বাড়ী ফিরেছো।তাও ভোর চারটায়।

-পার্টিতে গেলে একটু আটটুকু খেতে হয় ডালিং নয়ত স্ট্যাটাস থাকে না। তুমি এগুলোর কি বুঝবে না।ভোর রাতে নাটক না করে ঘরে যাও মা বাবা জেগে যাবেন।

-জাগুক।দেখুক তাদের ছেলে ঠিকঠাক মত দাঁড়াতে পারছেনা পা টলছে। ঘরে ঢুকে পলাশ বর্ষনকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইলো।বর্ষন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই পলাশ নেশার ঘোরে সজোরে একটি চড় মারলো বর্ষন কে। বর্ষনের এইটুকু জীবনে চড় তো দুরের কথা গালে কেউ হাত পর্যন্ত দেয়নি। ঘটনাটা বুঝে উঠতে বর্ষনের তাই সময় লাগলো কিছুটা। আমি তোর বাপের টাকায় মদ খাই আমার টাকায় খাই আরো খাবো।ন্যাকা!পলাশের এই অশ্লীশ ভাষা এই ব্যবহার তাকে কেমন জানি ভেতরে গুড়িয়ে দিলো বুক ভেঙ্গে কান্না এলো।এই অপরিচিত পলাশ কে তার ভোর রাতের দুঃস্বপ্ন লাগছিলো যেন এখনই এই ঘুম ভেঙে যাবে ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখবে পলাশ তাকে শিশুবাচ্চার মত জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। কিছু সত্যি এমন হাজার প্রার্থনায় তাকে মিথ্যায় রূপ দেয়া যায় না।



৪০#

সপ্তাহ খানেক পলাশ বর্ষনের কথা হলো না সেইরাতের পর থেকে। বাড়ীতে গুঞ্জন চলে কিছু কথা বর্ষনের কানেও আসে।মধু ও পলাশের মা তবুও বর্ষনকে কিছু বলেনা।পলাশ বেরিয়ে গেলে বর্ষন নিজের ঘরে বসে গান শোনে ঘর গোঁছায়। পলাশের বাবা সেদিন কি মনে করে বর্ষনের ঘরে প্রথম এলো।

-গানটা এত জোরে শোনার কি দরদার বউ মা।এই বাড়ীর আদব কায়দা তো উঠে যাচ্ছে। মধুকে তো বিয়ে দিতে হবে। বর্ষন সাউন্ড সিস্টেমটা বন্ধ করে দিলো।

-তোমার গালে এটা কিসের দাগ।

-বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম।

-আজকালকার মেয়েছেলেদের সব

কিছুতে তাড়াহুড়ু কিছু একটা লাগাও গালে। কথাটা বলে চলে যেতে যেতে পলাশের বাবা অনুমান করেছেন এটা পলাশের চড়ের চিহ্ন।বউকে ছেলে যে শাসন করে এটা ভেবে কিছুটা তৃপ্তবোধ করে পাঞ্জাবীর কলারটা যেন গর্বে অহেতুক ঠিক করলেন।

আজ বিকাল পাঁচটায় পলাশ বাড়ী ফিরে এলো।বর্ষনের রাগভঞ্জন করতে সরি বলে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।

-চলো আজ ঘুরে আসি।

-না।আমার ভাল লাগছেনা।

-চলোই না দেখবে খুব ভাল লাগবে।

-আনিসসাহেবের বিগ পার্টি উনার ওয়াই রিমাভাবী তোমাকে নিয়ে যেতে বিষেশ অনুরোধ করেছেন। তাছাড়া আনিসসাহেবের সাথে দেড় কোটি টাকার ডিলটা যদি আজ হয়ে যায় বুঝতেই পারছো কত্ত প্রফিট হবে।

-এইসব পার্টিফার্টি আমার ভাল লাগেনা তুমিই যাও।

-প্লীজ সোনা আর রাগ করে থেকো না। তাছাড়া এইসব পার্টিতে তো তুমি তো কখনো যাওনি। এইসব সোসাইটি পার্টিগুলোর ব্যাপারই আলাদা।প্লীজ চলো।সেইদিন রাতে যা করেছি তা ভুল করেছি আই এম সরি বর্ষন।কথা দিচ্ছি এ জীবনে আর হবে না।এই যে কান ধরছি। বর্ষনের চোখ ভিজে উঠে। জানো সেইদিনই এইজীবনে কেউ আমায় মারলো।বাবা মা কেঊ কোনদিন আমার শরীরে হাত দেয়নি।আর তুমি এত ভালবাসার মানুষ হয়ে আমায় মারলে। পলাশ বর্ষনকে জড়িয়ে ধরে সরি বলতে বলতে কখন যেন দুজনেই ভালবাসার গভীরে তলিয়ে গেলো।



৪১#

পলাশ আর বর্ষন যখন পৌঁচ্ছালো পার্টি সবে জমতে শুরু করেছে।এর আগে এমন পার্টিতে বর্ষন আসেনি।পরিচয় পর্ব চলছে।আনিসসাহেব আর তার স্ত্রী এগিয়ে এসে বর্ষনকে রিসিভ করলেন।আনিসসাহেব বর্ষনের প্রসংশায় যত ভাষা আছে সব ব্যবহার করে ফেলেছেন।পলাশ বর্ষনকে রেখে এগিয়ে গেলো।কয়েকজনের সাথে কথা বলে একদল নারীর আড্ডায় জমে গেলো।রাত যত বাড়ছে পার্টির রঙরূপ তত বাড়ছে।কত রকমের পোশাক হতে পারে এই পার্টিতে সব আছে। আনিসসাহেব একটি ড্রিংকসের গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলেন নিন আপনি তো কিছুই নিচ্ছেন না।

-আমি হার্ডড্রিংকস নিতে পারিনা সরি।

-সে কি এতবছর ভারত থেকেছেন এতবড় ব্যবসায়ীর ওয়াইফ আপনি হার্ডড্রিংকস খাননা এটা বেমানান। এক ভদ্রমহিলার ডাকে আনিসসাহেবে একটু অন্ধকারে গেলেন তবুও আলোআঁধারীতে বোঝা যাচ্ছিলো সিগারেট ধরা হাতে ভদ্রমহিলা আনিসসাহেবকে কিস করছেন। ওয়াশ রুম খুঁজতে এসে বর্ষন বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়লো।ওয়াশ রুম খুঁজতে গিয়ে বেডরুমে ঢুকে আনিসসাহেবের ওয়াইফ ও অন্য একজন কে এমন বিব্রত পরিস্থিতিতে দেখলো দেখে বর্ষনেই লজ্জা পেলো বরং আনিসসাহেবের বউ

হাসিমাখা মুখে বললো এসো পরিচয় করিয়ে দেই আমার বয়ফ্রেন্ড তিনটি গার্মেন্টস ও অন্যান্য বিজনেশ আছে ওর।বর্ষন প্রায় দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো।পলাশ একদল

নারীর সাথে মদ খাচ্ছে আর সিগারেটে দম দিয়ে অশ্লীল জোকস শোনাচ্ছে।বর্ষন কে দেখে একটু থেমে গেলো।

-এসো পরিচয় করিয়ে দেই ইনি ইন্ড্রালিয়ালিট আনিসুর রহমানের ওয়াইফ টিনা,ইনি হট মডেল রেশমা।আর এই দুইজনকে তো তুমি চেনোই চিত্রতারকা রায়া আর জিয়া। বর্ষন সৌজন্য হাসিতে সবাইকে হ্যালো বলে পলাশকে একটু পাশে ডাকলো।

-এক্সকিউজ মি আপনাদের আড্ডার মাঝখান থেকে পলাশ কে একটু নিয়ে যাচ্ছি।

-কি হয়েছে? এনি প্রবলেম জান

-আমার ভাল লাগছে না পলাশ আমি বাড়ী যাবো।

-যাবো তো সবে তো পার্টি শুরু হলো একটু পরে দেখবে কার ওয়াইফ কার বুকে কার হাবি কার ওয়াইফ নিয়ে।

-ছিঃ এটাকে সোসাইটি পার্টি বলো।

এটাই জীবন এটাই স্ট্যাটাস জান।এক কাজ কর তুমি খেয়ে নাও। পলাশকে এই নারী সেই নারী ডালিং আরো কত শব্দে যে ডাকছে বর্ষনের মেজাজটা খারাপ হচ্ছে।পলাশ কিছুটা হয়ত আন্দাজ করতে পারছিলো।

-পলাশ আমি আর থাকতে পারবো না তোমাদের সো কল সোস্যাল পার্টির নামে নোংরামিতে তুমি যাবে এখন? নয়ত আমি ফিরবো। পলাশ সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো আনিসসাহেব আর তার স্ত্রী বর্ষনকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো।

আলতো করে আনিসসাহেব বললেন ম্যাডাম আপনার ফিগারটা খুব সুন্দর একবার আসুন আমার ফার্মহাউজে।বর্ষন অগ্নি চোখে তাকালো একপলক।পশাশ হাসিমাখা মুখে গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বললো আনিসসাহেব আমার প্রজেক্টটা।আনিসসাহেব ও

একগাল হেসে ওটা কাল অফিসে এসে নিয়ে যাবেন আর একটা ফার্মহাউজের প্রোগাম করুন।

পলাশ হাসিমুখে গাড়িতে চড়লে বসলেও তার মুখ গোমরা।

-এ গুলো তোমাদের সোস্যালপার্টি? মদের ফোয়ারা আর যত্তসব নোংরামি। যা সব দেখলাম।বর্ষন একে একে আনিসসাহেব তার স্ত্রী সহ আরো কয়েকজনের দেখা ঘটনা বলে গেলো।

পলাশ চুপচাপ সব শুনছিলো।

-টেইক ইট ইজি ডার্লিং। হাইসোসাইটিতে এইসব কোন ফ্যাক্ট নয়।এগুলো অল টাইম ঘটে।এতে যে যার

মত কাজ হাসিল করে নেবার জন্য এইসব করে এগুলো কোন ম্যাটারই না।

তাছাড়া এইসব ইন্ডাস্টিয়াল ওয়াইফরা স্বামীকে পায় কতক্ষণ পরপুরুষেই চলাতে হয় তেমনি তাদের হাবিরা ও সেক্রেটারী বা পরনারীতেই সময় কাটায় এটাই ওদের ফ্যামলি রিলেশনের ওপেন সিক্রেট।

বর্ষনের মুখ থেকে হুট করে বেরিয়ে গেলো তুমিও কি তবে...

পলাশ একটু হোঁচট খেলো তবু নিজেকে সুকৌশলে সামলে নিয়ে বর্ষনকে জড়িয়ে ধরে চুমু

খেলো।আমার এত্ত সুন্দর বউ থাকতে অন্যকে নিয়ে ভাববো সেই সময়

কোথায় আমার।বর্ষন হেসে জড়িয়ে ধরলো পলাশকে।পলাশ মনে মনে ভাবলো মেয়েদের একটু

আদরমাখা কথা বললেই গলে জল ভাগ্যিস এরা এমন নয়ত পুরুষের দশা যে কি হতো!

-আনিসসাহেবের কন্ট্রাকটা তো পেয়েই যাচ্ছি মনে হয়।যাবে নাকি উনার ফার্ম হাউজে।

-না।

-কেন? দারুন জায়গা তোমার খুব ভাল

লাগবে।চারদিকে নদী আর দিগন্তমাঠ মাঝে কেবল দুতলা ফার্মহাউজটা দাঁড়িয়ে।

-আনিসসাহেবে নজরটা আমার ভাললাগেনি।গাড়িয়ে উঠার আগে কি বললো শুনেছো।

-বর্ষন এগুলো সিলি ম্যাটার। এগুলো নিয়ে এত ভাবতে নেই।



৪২#

ঘরতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে...

ডাক্তার ঘুরে যাবার পর থেকেই বাড়ীতে আনন্দের বাতাস বইছে।বর্ষন হতে যাচ্ছে ডাক্তার তাই বলে গেলো।ফুলমনি সহ বর্ষনের বাড়ীর সবাই মানা করেছিলো এখনই বাচ্চা না নিতে।বর্ষন সে কথা শোনেনি।বর্ষনের বিশ্বাস ছিলো একটা বাচ্চা এলে পলাশের

অত্যাচার তার পরিবারের মানসিক নির্যাতন কমে যাবে।সন্তানের মুখ চেয়ে হয়ত পলাশ বদলে যাবে।এই কয়েকমাসে পলাশের অত্যাচার চড় ছাড়িয়ে মারামারিতে এসে পৌঁচ্ছেছে। পলাশের বোন মা বাবা ও ছেলের

পক্ষেই কথা বলেন।এছাড়া নানা রকম গঞ্জনা তো আছেই।সেদিন রাতে পলাশ

এমন মেরেছে সারা শরীরে মুখে কালশিটে দাগ পড়ে গেছিলো ফুলমনি বর্ষনকে দেখতে সেদিনই এসেছিলো পলাশদের বাড়ী।জীবনের প্রথম মিথ্যাকথাটা সেইদিনই ফুলমনিকে বর্ষন বলেছিলো।

-পা পিঁছলে পড়ে গিয়েছিলাম মা। ফুলমনি মেয়েকে নিজের চেয়েও ভাল চেনে তাই কি হয়েছে বুঝেও চুপ করে থেকে শুধু বলেছিলেন।

-যে মিথ্যা বলতে পারেনা সে যখন মিথ্যা বলে তা বোঝা যায় রে মা। ফুলমনিকে জড়িয়ে ধরে বর্ষন

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।কিছুক্ষণ পর পলাশের মা এলেন

-মেয়ে মা তে এত কান্না কেন?বেয়াইন আমাদের সময় তো এইসময় মেয়েদের বাপের বাড়ী নিয়ে যাবার চল ছিলো।

পলাশ ও তার বাবাও বলছিলেন আপনারা চাইলে এই কয়মাস বউমাকে আপনাদের ওখানে নিয়ে রাখুন

বউমার ও ভাল লাগবে।আপনজনদের দেখতে পারবে।তবে মধু তো তার বৌমনিকে দিতেই চাইচ্ছেনা।দেখুন

আমি কিন্তু বলছি না নিয়ে যান তবে যদি আপনারা চান নিয়ে যেতে পারেন। কথার ইঙ্গিতটা যে কি ফুলমনির

বুঝতে অসুবিধা হলো না।

-তা বেয়াইন বর্ষন কি আজেই নিয়ে যাবো নাকি..

-আজ চাইলে আজেই নিতে পারেন সমস্যা কি?

বর্ষন প্রথমে যেতে চাইল না। মা আমি এখানেই থাকি?পলাশকে ছেড়ে আমাদের বাড়ীতে আমি থাকতে পারবো না।

-যাও বউমা ওখানে তোমার দেখভাল ভাল হবে তাছাড়া পলাশকে বলবো রোজ

একবার গিয়ে তোমায় দেখে আসবে। তাছাড়া আমি মধু পলাশের বাবাও মাঝে মাঝে যাবো তোমায় দেখতে।

বর্ষন শাশুড়ির কথায় যা বোঝার বুঝলো। সে ব্যাগ গোঁচ্ছাতে লাগলো।পলাশকে একটা ফোন করলো।বর্ষন ভেবেছিলো পলাশ হয়ত না করবে যেতে। চোখ

মুছতে মুছতে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসে বর্ষন। গাড়ি চলতে থাকে ধীরে তারপর গতি বাড়তে থাকে হাওয়ার জন্য

জানালার কাঁচ তুলে দেয় বর্ষন! বাড়ী ফিরেই বর্ষন কিংশুকের ঘরে গিয়ে ঢুকলো।যেন বইয়ে টেবিলে বিছানা থেকে কিংশুকের স্পর্শ নেয়া।বর্ষন জানে তার চেয়েও বেশি কষ্টে আছে বর্ষনের আদরের বিলু। কি মনে করে কিংশুকের নম্বর

চাপলো বর্ষন একটা রিং হতেই কেটে দিলো।আবার দিলো এবার রিং বাজচ্ছে।কয়েকটা রিং বাজার পরই কিংশুকের গলা ভেসে এসো ওদিক থেকে।

-হ্যাঁলো,হ্যাঁলো মা। বর্ষন ক্ষানিকটা চুপ থেকে ভাবলো

-হ্যাঁলো মা।

-বিলু কেমন আছিস রে? কিংশুকের গলার স্বরটা কেমন জানি ভারী আর ভেজা ভেজা হয়ে গেলো।

-বর্ষন!তুই কেমন আছিস?

-তোর জন্য একটা খবর আছে।

-বর্ষন তুই সুখী তো পলাশের সাথে?

-বিলু তুই খুব সিগারেট খাচ্ছিস আমি বুঝতে পারছি।

-না তো!ঠান্ডা লেগেছে একটু।

-বান্দর একটুও মিথ্যা বলবি না এটা সিগারেটের কাশি এবং আমি সিওর তুই এখনো সিগারেট

খেতে খেতে কথা বলচ্ছিস।

-তুই আর মানুষ হলিনারে পেঁচি।

-বিলু আগে দিদিভাই বল তোকে এমন একটা খবর শোনাবো তুই লাফাতে লাফাতে দেশে চলে আসবি।

-ইশ!পেঁচি পেঁচি পেঁচি এবার বল কি হয়েছে।

-পিচ্ছি বিলু যে মামা হতে যাচ্ছে।

-কি? সত্যিই

আমি মামা হতে যাচ্ছি দিদিভাই?

-হ্যাঁ রে বিলু।

দুই প্রান্তের উচ্ছ্বাস দেখলে কেউ বুঝবে না এই একাত্নার কথা নেই প্রায় দেড় বছর।

-বিলু সামনের মাসে আমাকে সাধ খাওয়াবে আমি চাই তুই থাক এই অনুষ্ঠানে।কত দিন তোকে দেখিনা। দুই পাশ থেকেই কান্না ভেসে আসচ্ছে।

-তুই আসবি না বিলু?

-বর্ষন সামনের সপ্তাহ থেকে আমার পরীক্ষা রে।আমি সশরীরে না থাকলেও তোর পাশে ঠিক থাকবো ছোটবেলায় যেভাবে তোর ছায়ায় ছায়ায় থাকতাম তেমন করে।

-তুই কিন্তু বললিনা পলাশের সাথে তুই

কি সুখী? খানিক নীরবতার পর লাইনটা কেটে গেলো নাকি কেটে গেলো কিংশুক বুঝলনা ফোনে এক

দীর্ঘনীরবতা থেকে গেলো।



৪৩#

বাড়ীতে অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। বাড়ীর বড়মেয়ের সাধখাওয়ার অনুষ্ঠান বলে কথা।আত্নীয়স্বজন ভিড় করতে শুরু

করেছে। ঝুরিবাতিতে সারা বাড়ীতে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। সদর দরজা থেকে প্রতিটি ঘর ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে।সাধ খাওয়ার যে নতুন কাপড় লাগে কিংশুক তা কলকাতা থেকে পাঠিয়েছে।এই বাড়ীতে বিয়ে না মেয়ের সাধখাওয়ানোর অনুষ্ঠান

বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। সবাই মিলে আঠার পদ খাবার তৈরী করেছে দিশা আবার সদ্য শেখা ইটালিয়ান ডিস ও জুড়ে দিয়েছে। মেয়েলি রীতিনীতি মেনে গীত গেয়ে সাধ খাওয়া শেষ হতেই কিংশুকের ফোন।

-পেঁচি সব হলো?

-হ্যাঁ।

-শোন আজ পূর্নিমা রাতে গানের আসর হবে বলে দে।আর শোন শরীরের প্রতি যত্ন নিবি কাল বিগবাজারে গিয়ে ভাগ্নির জন্য বেশ

কিছু খেলনা জামা জুতা কিনেছে।

-ঐ শয়তান তুই কি করে জানিস ভাগ্নি হবে যদি ভাগ্না হয়। কিংশুক একটু থেমে গেলো।যাই হোক আমি তো মামা হব ওতেই হবে।

মা কে একটু দে তো ফোনটা। ফুলমনি কাছাকাছি ছিলো না এসে ফোনটা ধরলো।

-মা রাতে গানের আসর বসাবে।আমার মামাটা পেট থেকেই গান শুনে শুনে পৃথিবীতে আসুক আমি তাই চাই।

-বাবাই, এত ধকলের পর রাতে আবার গানের আড্ডা আমি পারবো না রে বাবাই।

-পারবেনা মানে পারতেই হবে। মিষ্টিমামার গান দিয়ে শুরু করবে। যুবরাজমামা আর মিতা মামী কে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গনসঙ্গীত

গাওয়াবে তাছাড়া আরো তো আমাদের মামারা আছেন।সব শেষে নিধুবাবুর টপ্পাটা গাইবে তুমি আর মাঝখানে বাবাকে বলবে আমাদের যে শুক্রবারে কবিতাগুলো শোনাতো তার দুই একটা আবৃত্তি করতে।

-বাবাই এত্তসব হবে না রে সবাই টায়ার্ড।সারাদিন কি ধকল গেছে তুই বুঝিস।নে তোর বাবাকে বল। কিংশুক তো বাবার হ্যাঁলো শুনেই গলা শুকিয়ে কাঠ।বাবা বলছিলাম কি সেই শুক্রবার গুলোর মত যদি তুমি দুই একটা কবিতা আবৃত্তি করতে একটা গানের আড্ডা হতো ভালো হতো না?

-ঠিক আছে তুমি যখন চাইছো পূর্নিমার রাতে ছাদে আসর বসবে।নাও দিশার সাথে কথা বলো।

-দাদামনি আমি সব ভিডিও করে রাখছি তোর আইডিয়াটা দারুন তুই যদি আজ থাকতি আরো মজা হতো।তুই

কবে আসবি দাদামনি। পূর্নিমার মস্ত গোল চাঁদ উঠেছে আকাশে।একে একে গান কবিতা সব হলো।আসর শেষ করে দেয়া হচ্ছিল তখন বর্ষন ফুলমনিকে নীচ তলা থেকে ডেকে আনলো অনুষ্ঠান যে শেষ করে দিচ্ছো বিলু যে বললো নিধুবাবুর টপ্পায় অনুষ্ঠান শেষ হবে।

-ধুর এই বয়সে টপ্পা গাইবার গলা কোথায় সবার জোরজবস্তিতে শেষে ফুলমনি গান ধরলো-

'ভালবেসে ভাল কাঁদালে

যদি মজিবে না মনে ছিল

তবে কেন মন মজালে।'

গানের প্রসংশায় যখন সবাই মশগুল বর্ষন পলাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলো কিংশুক কি এত বছর দূরে থেকেও তার বেদনা নিজের বুকে উপলব্ধি করে। কিংশুক কি এই গানটা মাকে দিয়ে গাইয়ে বোঝাতে চাইলো কেউ যা জানেনা সম্পর্কহীন দূরত্বে সেটা সে জানে তার পেঁচি সুখে নেই।এক এক করে সবাই নেমে গেছে শূন্য ছাদ আর মস্ত চাঁদের জোছনায় কেবল বর্ষন আর কিংশুকের কল বেজে যায়।



৪৪#

পৃথিবীর সুচারু নিশ্বাস...

সময় যেন খুব দ্রুত গেলো।

ডেলিভারী ডেইট ডাক্তারের টাইম

অনুয়ায়ী কাল।কিন্তু দুপুর থেকেই

বর্ষনের লেবার পেইন বাড়ছে।পলাশ ও

তার

বাড়ীতে জানানো হলো তারা দায়সারা ভাবে জানালো আপনারা যা বুঝেন

করেন।এই উত্তর পেয়ে ফুলমনি ঠিক

করলো বর্ষনকে ক্লিনিকে শিফট

করে দেয়াই উচিত হবে।

ব্যথা যে বাড়ছে বর্ষনের ঘাম আর লাল

হয়ে উঠা মুখ

দেখে বোঝা যাচ্ছে তাছাড়া ব্যথার

যন্ত্রনায় ছটফট করছে বর্ষন চাদর

তোষক দুইহাতে শক্ত করে ধরে মুখ

চেপে একটু পর পর শুধু মাগো ও

মা করে চিত্কার করছে।এম্বুলেন্স

চলে এসেছে।সবাই

মিলে ধরা ধরি করে বিছানা থেকে নামচ্ছে যখন

ফুলমনির মা শুধু বললেন জল

কাটছে রে ফুল।দরজার কাছে আসতেই এত

ব্যথাতেও হেসে উঠলো বর্ষন বিলু তুই!

ব্যাগটা কোন রকমে মিষ্টিমামীর

হাতে দিয়ে বর্ষনকে কোলে করে এম্বুলেন্সে তুললো কিংশুক।

ধীর গলায় বর্ষন বললো তুই আজ

এলি যে?

-পরশু স্বপ্নে দেখলাম তুই ডাকছিস তাই

আজই চলে এলাম।

পলাশ এসে কিংশুককে দেখে বেশ অবাক

হলো মনে হয়।

-কেমন আছেন?

-ভাল।তবে খুব ব্যস্ত সাড়েচার শত

কোটির কন্ট্রাক নিয়ে ব্যস্ত এইসময় হাসপাতাল ক্লিনিকে সময় দেবার সময় কোথায় বলো।তুমি এসেছো ভালই হয়েছে। আজ রাতেই আমি ব্যাংকক যাচ্ছি। ফিরতে ছয় সাতদিন দেরী হবে। বাচ্চা হলে ক্লিনিক থেকে সরাসরি বর্ষন আমাদের বাড়ী যাবে আর হ্যাঁ তোমার মাকে বলো আমাদের সন্তানকে আমারা আমাদের মত মানুষ করতে চাই তাই অনুগ্রহ করে উনি যেন আমাদের বাড়ীতে যেন না যান আর ফোন করে ন্যাকা ন্যাকা কথা বলার ও দরকার নেই। কিংশুকের ইচ্ছে করছিলো একটা সজোড়ে ঘুসি মেরে নাকের বাঁশিটা ভেঙ্গে দেয় তখনই কান্নার আওয়াজ এ অভিমান মমতায় রূপ নিলো কিংশুক ছুটে গেলো।ঠিক মিষ্টিমামার মত হয়েছে।পলাশ এসে উঁকি দিলো ছেলে না মেয়ে। পলাশের মা বললেন ছেলে।ফুলমনি নাম রাখলো অগ্নি।কিংশুক হঠাত্ রেগে গেলো

-তুমি নাম রাখার কে মা?

-একি বলছিস বাবাই প্রথম নাতির নাম আমি রাখবো না তো কে রাখবে। রায়ান কয়েকবাক্স মিষ্টি নিয়ে হাজির পলাশের বাবা আর বোন মধু চলে ঘেলো।

-মা শোনো।

পলাশের বলা কথাগুলো কিংশুক তার মা কে বলছিলো।অনতিদূর থেকে তখন ফায়ার ব্রিগেড তিনচারটি গাড়ির ঘন্টি দূর থেকে কাছে সশব্দে ছুটে গেলো কোথায় যেন বড় আগুন লেগেছে।আর মনের ভেতরের আগুন তখন অজানা প্রশ্ন জ্বালায় আর বুকে বাজে কেন? কেন? কেন এই নিষেধাজ্ঞা....!! মা কে পলাশ ওদের বাড়ী যেতে এমনকি বর্ষনের সাথে যোগাযোগ না করতে কেন বললো এটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছিলোনা।আমি আমার মাকে চিনি তাকে কেউ হাজার গালমন্দ করে চলে যাবে সে কিচ্ছু প্রতিউত্তর দেবে না।তা হলে মা এর সাথে এমন ঝগড়াঝাঁটি হবার প্রশ্নই আসে না। তবে কেন?কাঁটার মত বিঁধচ্ছে পলাশের এই অপমানটা। হাসপাতাল থেকে আজ বর্ষনের ডিসচার্জ।পলাশ ব্যাংকক ওদের বাড়ী থেকেও কেউ আসেনি এখনো।বর্ষন মা হয়েছে আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। ওর বেডের পাশে বসেছি নিজের সন্তানকে পাশে রেখে আমার গালে হাত রেখে আদর করে দিচ্ছে।

-তুই কত শুকিয়ে গেছিস রে বিলু।

-অনেকদিন পড়ে দেখলি তো তাই এমনটা লাগছে।

-তুই মদ খাস বিলু

-এক আধটুকু খাই সেই তুই আমি লুকিয়ে ভিক্টোরিয়ার পাশে বসে যেমন সিগারেট আর ইয়ে খেয়েছিলাম।দেবো আজ মাকে বলে।

-ব্ল্যাকমেইল করছিস মা জানে।

-আর তোমার আদরে বাদর বানানো বাবা?

-বাবাও জানে যা বল গিয়ে দেখি। মনে নেই বাবাকে একবার মুখস্থ পড়া বলতে গিয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে বন্যা বানিয়ে দিলি ঘরে। দেখ বর্ষন এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলে দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়েছি।তখনই বাবা এসে ঢুকলো।ভাইবোন নিয়ে একটা চার লাইনের কবিতা বলতে বলতে।বর্ষন ও বিটলা দি গ্রেট।

-বাবা এই কবিতাটি কি সত্যিই আছে নাকি মাকে পটানোর মতো নীরা কবিতা যেভাবে ফুলমনি বলে চালিয়ে দিয়েছিলে এটাও তেমন।বাবা একটু লজ্জা পেলো আরে না না এই কবিতাটা আছে তো। কি আছে বলতে বলতে মা ও হাজির।

-শোন ওদের বাড়ীর তো কেউ এলো না এখনো পলাশ ও নেই বিলপেমেন্ট দিয়ে দে তারপর আমরা বাড়ী নিয়ে চলে যাই।বাবা মার কথা মত বেরিয়ে গেলো।

-মা বর্ষন বরং ওর শ্বশুড় বাড়ীতেই যাক এখন এটাই ভাল দেখাবে।

-বিলু তুই নিয়ে যাবি আমায়। না করতে চেয়েছিলাম মার চোখের ইশারায় বললাম

-কেন তোর ননদীর ভয়ে নিতে চাচ্ছিস না। তোর ননদ যে আমার প্রেমে হাবুডাবু খাচ্ছে জানিস।

-ইশ কি আমার চেহেরা রে!

-তোর পলাশের চেয়ে অনেক ভাল রে।

কথাটা বলে ভুল করলাম বোধ হয়। বর্ষনের রৌদ্র উজ্জ্বল মুখ এক পলকে শ্রাবন মেঘের মত

আঁধারে চেয়ে গেলো।এই পেঁচি কি হলো। তোর সাথে আমার অনেক

কথা আছে রে কিংশুক।কথা দে তুই আর রাগ করে থাকবিনা আমার উপর।রোজ এক দুবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমার

সাথে কথা বলবি।বর্ষন আমাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো আমিও

বর্ষনের চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে নিজেও কেঁদে ফেললাম।অগ্নি ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠলো।বর্ষন

তাকে বুকে তুলে নিলো আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। মনে তখনো পলাশ আর তার অপমান আঁচড় কাটছে।



৪৫#

বর্ষনকে নিয়ে আমিই গেলাম ওর শ্বশুড়বাড়ী।বিয়ের আগে পরে আমি এই বাড়ীতে আগে কখনোই আসিনি।বর্ষন খুব খুশি।অগ্নি আমার কোলে। গাড়ি বাসার সামনে দাঁড়াতেই পলাশের বাবা এগিয়ে এসে হাঁক দিলেন ভেতরে।

-আমাকে তো তোমার মা বলেছিলেন কাল ডিসচার্জ করবে।একটা ফোন করে তো বলতে পারতেন আমায়।

একবার বলে ফেলতে চেয়েছিলাম ফোনটা তো ধরেননি।নিজেকে সংযত

রেখে বললাম বাবা মা তো ফোন করেছিলেন তো হয়ত আপনার ফোনটা সাইলেন্সমুডে আছে।পলাশের বাবা ফোনটা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বের করে দেখলেন বিশটা মিসডকল ইনি যে ইচ্ছে করে কল ধরেননি সেটা চতুরতায় লুকিয়ে বললেন

তাই তো বাবা কখন যে সাইলেন্ডমুডে চলে গেলো খেয়ালই করি নি ছিঃছিঃ।তখন পলাশের মা আর মধু এসে আমার কোল

থেকে অগ্নিকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো।

-হ্যাঁলো বেয়াই

কি লজ্জা যে পাচ্ছি কি বলবো। মোবাইলটা সাইলেন্ডমুডে থাকায় আপনার

কল ধরতে পারিনি।তা টাকা পয়সা কত লাগলো হিসাবটা করে আমায় জানাবেন। আরে একি বলেন সব খরচ আপনি কেন

দেবেন নাতি তো আমারও নাকি।হাফ হাফ করুন তবে।একদম নেবেন না এটা কেমন হয়।যাক আপনাদের যখন ইচ্ছা আমি সেই

ইচ্ছাতে আর বাধা দিচ্ছি না তবে আমাকে শরিক করলে ভাল লাগতো। কৌশলী কথা বার্তা শুনে মনে মনে খুব হাসলাম,মজাও পেলাম। আমি ব্যাগ লাগেজ বের করে গাড়িতে উঠে বসলাম।বর্ষনের চোখ ছলছল

-বিলু তুই ভিতরে আসবি না?

-আরে দেখো কান্ড কিংশুক এই প্রথম আমাদের বাড়ী এলো পলাশের মা তোমার বোধবুদ্ধি এই বয়সেও হলো না। ছেলেটাকে কোথায় বাসার ভেতরে নেবে তা না দাঁড়িয়ে আছো। মধুটাও তার মার মত মেন্দা।পলাশের বাবাই এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে আমাকে নামালেন।

-আমি বাজার যাচ্ছি তুমি আজ দুপুরে খেয়ে বিকালে যাবে আমি তোমার বাবাকে জানিয়ে দিচ্ছি।

-না মেসো আমার যে একটু কাজ আছে।

-সে বিকালে করো।তুমি প্রথম এলে আর

খালিমুখে যাবে এটা হয়না বাবা। বর্ষনের চোখের দিকে তাকিয়ে মানা করেও থেকে গেলাম।

বর্ষনের চোখে যেন রোদ খেলে গেলো।মধু এগিয়ে এলো আসুন আসুন ভেতরে আসুন গরীবের ঘরে হাতির পা।

-আমি কি হাতি নাকি?

মধু একটু লজ্জা পেলো বোধ হয় আরে এটা একটা প্রবাদ কলকাতায় থেকে এইগুলোও জানেন না। বর্ষন আমাকে নিয়ে তার বেডরুমে ঢুকলো সঙ্গে মধু।

-আসুন আপনাকে আমাদের

বাড়ীটা ঘুরিয়ে দেখাই।এর আগে তো আপনি আসেননি। আমি বর্ষনের দিকে তাকাই।

-দিদি অর্ডার ছাড়া বুঝি আমার সাথে যাবেন না।

-তা কেন? এমন রূপসীর আহবান কি কোন পুরুষ রিজেক্ট করতে পারে।

মধু একটু লজ্জা পেলো। আমি রূপসী নাকি কলকাতায় আমার চেয়ে কত্ত রূপসী আপনার

পিছনে ঘুরে কে জানে।চলুন কিংশুকদা বাড়ীটা ঘুরিয়ে দেখাই।বর্ষন

চোখের ইশারায় সন্মতি দিলো।মধুর

পেছন পেছন আমি।ছাদের ল্যান্ডিং এ মধু দাঁড়ালো আমার দিকে মুখ

করে কিংশুক দা আপনার প্রেমিকার নাম কি!অপ্রস্তুত প্রশ্নে একটু থেমে বললাম আমার তো কোন প্রেমিকা নেই।মধুর মুখে এক ঝলক হাসি খেলে গেলো আমার মনে তখন হঠাত্ করে একটি কবিতা জেগে উঠলো

'তুমি ভালো না বাসলেই

বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।

তুমি ভালো না বাসলেই

ভালোবাসা জীবনের নাম

ভালোবাসা ভালোবাসা বলে দাঁড়ালে দু’হাত

পেতে ফিরিয়ে দিলেই

বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।

না না বলে ফেরালেই

বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায় না কখনো।

না না বলে ফিরিয়ে দিলেই ঘাতক পাখির

ডাক শুনতে পাই চরাচরময়।

সুসজ্জিত ঘরবাড়ি, শখের বাগান

সভামঞ্চে করতালি, জয়ধ্বনি,

পুষ্পার্ঘ্য

ইত্যাদি সব ফেলে

তোমার পায়ের কাছে অস্তিত্ব

লুটিয়ে দিয়ে

তোমাকে না পেলে, জানি

যে পায়, সে পায়

কি অমূল্য ধন।'

মধুদের চারতলার বাড়ী।নীচ তলায় মধু আর মধুর মা বাবা থাকেন।দুই তলায় বর্ষন রা আর তিনতালায় নাকি পলাশের দাদু থাকতেন এটা এখন সব সময় বন্ধই থাকে।সপ্তাহে একবার পলাশের বাবা তালা খুলে ঢুকেন ঝাড় পোঁচ করে আবার তালা আর চতুর্থ তালাটাকে ঠিক চিলেকোঠা বলা যায় যা আজকাল দেখাই যায় না তারপর

বিশাল ছাদ বাহারী গোলাপ আর অর্কিডের পাশে অন্য বাহারী ফুল আছে,আছে বনসাই।

-কিংশুকদা কেমন লাগলো আমার বাগান।

-খুব সুন্দর।

-আপনি তো লেখালেখি করেন তাই না?

-তোমাকে কে বললো।কেন বৌদিমনির কাছে আপনার লেখা কত কবিতা গল্পের বই তাছাড়া পেপারেও তো আসে।

-তুমি কবিতা পড়ো?

-না বুঝিনা তবে আপনারটা পড়ি। আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে দেবেন কিংশুক দা। আমার বেশ হাসি পায় তবে প্রকাশ করিনা।

-কিংশুকদা আপনার লেখা একা কবিতা শোনাবেন তবে একটা গিফট দেবো।

-কি গিফট দেবে সেটা আগে বলো।

-দেবো একটা ভাল গিফট দেবো শোনান না একটা কবিতা। আমার চরম খারাপ অভ্যাস নিজের লেখা আমি নিজে মনে রাখতে পারিনা। কি করা মধুকে বললাম বর্ষনের কাছ থেকে একটা বই নিয়ে এসো এখান থেকে পড়ে শোনাই।

আপনি একা ছাদে থাকবেন তার চেয়ে চলুন একসাথে নিচে গিয়ে বৌদিমনি আর মার

সামনেই আপনার কবিতা শুনবো। তবে আমাকে নিয়ে একটা কবিতা কিন্তু আপনাকে লিখতেই হবে।আমি আর মধু

নেমে আসচ্ছিলাম তিনতলার দরজা খোলা দেখে মধু একটু থমকে দাঁড়ালো বাবা বুঝি তাড়াহুড়ার

মাঝে দরজা লাগায়নি যাবার সময় তো খেয়াল করিনি চলুন

ভেতরটা দেখে আসি।আমি বেশ অবাক হলাম দেখে আসি মানে?এই ঘরে তুমি যাওনি কখনো।মধু গলার স্বর

নামিয়ে আনলো জন্মের পর এই ঘরে আমি ঢুকিনি শুনেছি মাও

যায়নি কেবল পলাশদাদাভাই কয়েকবার ঢুকছে আর খালি বাবা।আজ আপনাদের আওয়াজে হয়ত ঝাড়মোছ

করে তালা না লাগিয়েই নেমে গেছেন নীচে। যাবেন কিংশুক দা?মধুর গল্পটা শুনে আমার ভেতরেও

একটা ইচ্ছা জাগলো ঘরটা দেখার। দরজা ঠেলে ঢুকলাম আমি আর মধু মেহগনীকাঠের একটা খাট

তাতে সাদা ধবধবে চাদর বালিশ আর পাশবালিশ।বিছানার ঠিক

মাঝখানে একটা তোলায়ার আর দুটো ছুঁড়ি রাখা রক্তের কালছে দাগ লেগে আছে।দেয়ালে একটা তৈলচিত্র একাত্তরে আকাঁ একটু ঝাপসা হয়ে এলেও যত্নে এখনো বেশ ভালই আছে।খুব কাছে গিয়ে ছবিটা দেখতেই আমার

মনে হলো এই মানুষটিকে আমি কোথাও দেখেছি কিন্তু কিছুতেই

মনে করতে পারছিনা। ইনি কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মধু? কথাটা বলেই চোখ পড়লো ছবির

ব্যক্তির মাথায় জিন্না টুপিতে চাঁদতারা আঁকাটা।কে ইনি? আমার এত চেনা কেন লাগছে?মধুর তাড়ায় বেরিয়ে এলাম।

-মধু তোমার বাবা কি ভুত প্রেত নিয়ে সাধনা করেন?

-আমি ঠিক জানিনা কিংশুকদা তবে ঘরটা দেখে আপনার মত আমারো বেশ বিদঘুটে লাগলো।

দোতলায় নামার সিঁড়িতে পলাশের বাবার সাথে দেখা ছাদ দেখলে বাবা?

-হ্যাঁ।তিনতলাটা বন্ধ কেন মেসো!

-ওটায় আমার বাবা থাকতেন তাই তিনতলার সব ঘর উনার স্মৃতিতে বন্ধ রাখি।

-ও আচ্ছা।

বুদবুদের মত প্রশ্ন আর মুখটা আমার ভেতরে কেবল বড় থেকে বড় হচ্ছে।



৪৬#

আমার মনে তখনো এক জিজ্ঞাসার সাগর বড় হচ্ছে।

-কি রে বিলু সব দেখা এত তাড়াতাড়ি শেষ।কি রে মধু

–তোমার ভাই কবিতা শোনাবে উনার লেখা উনার

নাকি মনে থাকেনা তাই বই দাও।

আমি মা বাবাকে ঢেকে আনি রান্না নিয়ে ব্যস্ত বলে পলাশের মা এলেন না।আর পলাশের

বাবা অফিসে বেরিয়ে গেছেন। অগত্যা বর্ষন অগ্নি আর মধুই আমার কবিতার শ্রোতা।বর্ষনই আমার

দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাটা বের করে দিলো এটা পড়।

কতরাত তোর এই কবিতাটা পড়েছি তার কেঁদেছি।আমার আবৃত্তির গলাটাও খারাপ না পড়তে লাগলাম-

এক পূর্ণিমায় হাত পুড়িয়ে

আর এক পূর্ণিমায় লিখছি । নীল

জোছনায় ভেসে যায় চরাচর

পায়ে পায়ে বেরিয়ে যাই

মেলে দেই আঁচ লাগা মন ।

আমি বৃষ্টির প্রার্থনা করি আমাদের

ভিজে যাওয়া দুঃখের

কাছে আমি সামলাতে চেষ্টা করি তোমার

অকারণ অস্বস্তি ।





নি

সারা গায়ে বৃষ্টির রেণু

মেখে বৃষ্টিরঙা শাড়ি পরে তুমি এলে ।

আমি তাঁবু উড়িয়ে দেই,আর মাথার উপর

নেমে আসে শরত্ আকাশ

আমাদের গায়ে এসে পড়ে উড়ন্ত

আগুন,যার জন্য প্রতীক্ষায় ছিলাম

আরুণির মতো গত কয়েক জনম । এসব

কি আর বুঝবে অন্য লোকে আমার ভীষণ

কান্না পায় অকারণে কান্না ।

চারপাশে জীবনের সব উপচারই সুন্দর

সাজানো ,

আমি মিলিয়ে যাচ্ছি মিলিয়ে যাচ্ছি তবুও

ওই কান্নাটুকুর জন্যই বেঁচে থাকা ।

কিংশুকদা সত্যিই কি অসাধারণ লেখেন

আপনি।

-এই যে একটু

আগে বললে তুমি কবিতা বুঝো না এটা কি করে বুঝলে ভাল

হয়েছে।

-আমি কবিতা না বুঝলেও আপনার কবিতা আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বর্ষন হাসে আপাতত

মা ডাকছে ওখানে ভেসে আয়। বর্ষনকে তিনতলার ভুতরে ঘুরটার কথা বললাম।বর্ষন আজ পর্যন্ত ঐ তলার ঘর গুলোয় ঢুকেনি শুনেছে ঐ তলায় দাদাশ্বশুর চাচারা থাকতো।অবাক হয়ে বললাম চাচা দাদা এসব

কবে থেকে বলিস রে তুই।এই বাড়ীতে আব্বা আম্মা চাচা চাচী ভাইজান

ভাবীজান এইসবই ডাকা হয় কেবল আমাদের বাড়ীর কেউ এলে ডাকগুলো বদলে যায়।তোর দাদাশ্বশুড় কি করতেন?সঠিক

জানি না তবে ইমাম ছিলেন একদিন পলাশের মুখে শুনেছিলাম।

-পলাশ কবে আসবে রে?

-কাজ শেষ হলেই আসবে।

-বর্ষন তুই পলাশের সাথে সুখী তো? কথাটার মাঝেই মধু চা মিষ্টি নিয়ে হাজির কিংশুকদা আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে দেবেন।

আচ্ছা দেবো।কিন্তু আমার গিফট কোথায়?গিফট পেলেই তো হলো। অনেকক্ষণ লোডসেডিং হঠাত্ সবাইকে চমকে দিয়ে বেজে উঠলো 'আমি যেন

শুনে বিষ করেছি প্রাণ' বর্ষন জলদি উঠে গিয়ে সাউন্ডসিস্টেমটা বন্ধ করলো।

-বন্ধ করলি কেন চলতো গানটা। মধু আব্বা বলেও থেমে গিয়ে বললো বাবা বলেন গানবাজনায় নাকি বাড়ীর আদবকাদয়া নষ্ট হয়।মধু তোমার বাবার বাবাও কি ব্যবসায়ী ছিলেন? না মা র

কাছে শুনেছি উনি অনেক বড় নামীদামী মানুষ ছিলেন।ইমাম হলেও ওনার জ্ঞান নাকি তখনকার দুই পাকিস্তানেই কদর পেতো।

দুপুরে খেয়ে দেয়ে ফেরার সময় মধু একটা গোলাপ দিয়ে বললো এটা আপনার গিফট কিংশুক দা একটা মাত্র গোলাপ আমার কবিতার গিফট তখনি আচমকা গালে একটা চুমু

দিয়ে দৌড় দিল মধু।বিদায় দিতে সবাই এলেও মধু এলো না।

আমি গাড়িতে বসতে গিয়ে দেখি গোলাপের সাথে একটা কাগজ যাতে অসুন্দর

হাতে লেখা কিংশুকদা আমি আপনার হয়ে বাঁচতে চাই মরতে চাই।খুব

হাসি পেলো।গাড়িটা ঘুরিয়ে স্পিড বাড়াতেই আচমকা কাগজটা বাইরে উড়ে গেলো।

বাড়ী ফিরে মাকে সব বললাম।ছবিটার কথা বলতেই মা হাসিতে গড়াগড়ি।বাবাই

তোর মার বয়স কত ছিলো একাত্তরে জানিস?আমিই এখন কত চেনা মানুষ চিনি না আর একাত্তরে মারা যাওয়া একটা মানুষের পোট্রেট দেখে তুই বলছিস তুই তাকে দেখেছিস কোথাও তুই তাকে চিনিস এটা কিভাবে সম্ভব বাবাই আমাকে বল।

মার যুক্তিটা যে ফেলনা তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি কিন্তু আমার মস্তিষ্ক থেকে ব্যাপারটা কিছুতেই যাচ্ছেনা। আমি কোথাও না কোথাও এই মুখ দেখেছি।

আচ্ছা মা আমি না হয় চিনিনা ছবিটা কখনো তুমি দেখে তো চিনে ফেলতে পারো তাই কি পলাশ তোমায় ওদের বাড়ী যেতে নিষেধ করেছে।

-দূর পাগলা।এই বললি ঘর বন্ধ থাকে।

বাবাই মধুর চুমুটাই তোর মাথা গুলিয়ে দিয়েছে তবে বাবধন ঐ বাড়ীতে মেয়ে দিয়েই ঠেকেছি ঐ বাড়ীর মেয়ে আমার ঘরে আনার চিন্তাও করো না বলে রাখছি।

-মা তুমি না কি বলো মধু কবিতা বুঝেনা অথচ আমারগুলো পড়ে এখন বোঝ কেমন বোঝে।আচ্ছা মা ঐ ছবির মুখটা আমি কোথায় দেখেছি?

মিষ্টিমামী ও বড়মামা এবার এসে দেখছি তো আমার জন্য তোর একটুও দরদ নেই আর বুড়ি তো যেন অষ্টাদশী হয়ে গেছে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

মা একটা গাঁট্টা দিলো বড়মামা মানে মিষ্টিমামী মাকে একটু শাসন করে আমাকে কোলে শোয়ালো।

কে রে কোন শয়তান আমাকে নিয়ে ঢংঙের কথা বলছে। এখনো যে রঙে রূপে আছি না একটা এনে দেখা দেখি আমার ধারে কাছে যায় কিনা।

-বড়মা মিষ্টিমামা ডাইরি লিখতো একটা ছবির এলবাম ছিলো না ওগুলো কোথায় গো?

-তোমার আর যোদ্ধা হতে হবেনা।

-বুড়ি কানের কাছে প্যাঁচপ্যাঁচিও না তো।

-কানে ধরে ঐ শয়তান তুই কারে বুড়ি বলিস তোর মা দুজনের সাথে ভাল করে সেজে বসলে এখনো তোর মা বড়মা আমার ধারে কাছেই আসতে পারবেনা আর কলকাতায় যে রঙের মানুষটি আছে তাকেও আনো আমি চ্যালেঞ্জ করছি সে ও হার মারবনে।

-আচ্ছা দিদা ক্ষেমা কর আমায় তুমি জয়ী।

-ওগুলো সব যত্নে রেখেছি তোর লাগবে বাবুসোনা।

-লাগবে বড়মা তুমি একটু বের করে রেখো।

-আচ্ছা বাবুসোনা রাখবো আজই লাগবে না পরে দেখবি।

-পরে দেখবো বড়মা।হঠাত্ এক দমকা হাওয়া টেবিলে রাখা ম্যাগাজিনের পাতাগুলো প্রথম থেকে উড়িয়ে এক পলকে শেষে গিয়ে থামলো।



৪৭#

এমনি করে যায় যদি দিন...

গঙ্গা পদ্মায় জল গড়িয়ে গেছে অনেক।

ফারাক্কা বাঁধ হয়ে গেছে।অংশু যখন

মামা ডেকে কথা বলে ফোনে মনটা জুড়িয়ে যায়। বর্ষনের সাথে রোজ দুইচার বার কথা হয়।আমি ম্যানেজমেন্ট শেষ করে আপাতত অর্নবদার থ্রি স্টার হোটেলের চিফ ম্যানেজমেন্ট দেখছি। এরই মাঝে খবর পেলাম বর্ষন আবার প্রেগনেন্ট।মা ফোনে বললো একদিন বাবাই বর্ষনকে বাচ্চা নিতে এখন মানা কর।কিন্তু কেন তা মা এড়িয়ে গেলো।সেই আসার পর প্রায় পাঁচ বছর দেশে যাওয়া হয়নি। এবার যাব ভাবছি। ফোনে বর্ষনকে বাচ্চা না নেবার কথা বললাম বর্ষন আমাকে সাতপাঁচ বোঝালো।পলাশের কথা বললেই বর্ষন কথা এড়িয়ে যায়।আমার মাথা থেকে সেই পোট্রেট এর মুখ এখনো যায়নি।বড়মা মিষ্টিমামার সব

ডাইরি এলবাম বের করে রেখেছে।তার উপর পলাশের সেই অপমানটাও আমি ভুলতে পারছিনা।বর্ষন পলাশের কথা এড়িয়ে যাওয়াটাও আমার মাথায় নতুন এক যন্ত্রনার কীট ঢুকিয়ে দিয়েছে।মন বলে বর্ষন সুখে নেই।অংশু সেদিন কথা বলতে বলতে বলছিলো

-মামা,এবার তুমি এলে আব্বুকে বকে দেবে আব্বু একদম ভাল না আম্মুকে খালি.. বর্ষন ফোনটা অগ্নির কাছ থেকে নিয়ে নিলো বুঝতে পেরেছি।

-অগ্নি কি বলছিলো রে বর্ষন।

-আরে ঐসব কিছুটা পলাশ সেদিন ওর কাগজ পত্র খুঁজে না পেয়ে রাগারাগি করছিলো এটাই বলছিলো হয়।তুই নাকি আগামী মাসে আসবি?

-হ্যাঁ ইচ্ছে আছে।দেখি।

অগ্নির কথার সাথে বর্ষনের কথাটা কেন জানি আমি মেনে নিতে পারছিলামনা। আমি কি সন্দেহবাতিক হয়ে উঠছি। আমার কি ডাক্তার দেখানো উচিত নাকি বোনের প্রতি এ আমার গভীর ভালবাসা আমাকে ভীত করে রাখে সারাক্ষণ ! আমার আসা হলো না রাধিকা মামীর অসুস্থতার কারনে।বর্ষন খুব অভিমান করেছে।গত কয়েকদিন রাধিকা মামীকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম কয়দিন বর্ষনকে কল করা হয়নি। আজ ফোন করতেই এক চোট কাঁদলো বর্ষন। এই কান্না যে আমার না যাবার কান্না তা আমার সন্দেহবাতিক মন মানতে চাইলো না কিছুতেই।বর্ষনের সাথে কথা শেষ করে দিশাকে কল দিলাম।

-হ্যাঁলো দিশা।

-হ্যাঁ বল দাদাভাই।

-বর্ষনের কি হয়েছে রে কিছু জানিস?

-না তো।পরশুদিনও তো একসাথে শপিংকরলাম আমি আর রাঙাদি।কেন বলতো?

-আজ কল করেছিলাম।আমি না আসায় খুব কাঁদলো কিন্তু আমার মনে হলো কান্নাটার মানে অন্য কিছু।

-তুই ওকে আর বাচ্চা নিতে মানা করেছিস বহুবার,তার জন্য ও হতে পারে।

-দিশা,এটার জন্য এমন উন্মাদের মত ও কাঁদতো না।

তাছাড়া বাচ্চা নেয়া না নেওয়ার ব্যাপারে ঝগড়াঝাঁটি যা হবার তা তো মাস দুয়েক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

-তবে তুই কি বলতে চাস দাদাভাই।

-বর্ষন কে পশাশ কোন না কোন ভাবে টর্চার করছে।

-তুই রাঙাদি কে নিয়ে ফালতু চিন্তা করিস গতকাল ওরা একসাথে পার্টিতে গেছে তারপর কোন বিজনেসম্যানের ফার্মহাউজে রাত

কাটিয়ে এসেছে।আজই তো আমায় বললো।

-তোর সাথে যখন কথা বলেছে তখন বর্ষন কি হাসিখুশি ছিলো?

-রাঙাদি তখন!না মুড অফ ছিলো ওর অংশু নাকি কি একটা ভেঙ্গে ফেলেছে তাই পার্টি ভাল হয়েছে বলে লাইন কেটে দিয়েছে।

-তোকে একটা কাজ দেবো করতে পারবি?

-কি বল।

-বর্ষনকে সব সময় কল করবি এটা সেটা গল্প করবি আর তোর কোন বন্ধু দিয়ে পলাশ সম্পর্কে খবর নিতে পারবি?

-প্রথমটা তো পারবো কিন্তু পলাশদার খবর নেয়াটা হয়ত সম্ভব হবে না।

-ঠিক আছে প্রথম কাজটাই তুই কর বাকীটা আমি দেখছি।

-দাদাভাই,তুই রাঙাদির ডেলিভারীতে আসবি না?

-না রে এবার আসা হবেনা।

-এটা কি রাগে আসবি না?

-রাগ না একটা ছেলে যখন আছে আর নেবার কি প্রয়োজন আমি বুঝিনা তাছাড়া ওর শরীরের প্রতি যে কত ধকল যাবে ও সেটাও

বোঝেনা।

-দাদাভাই,এবার এলে আমার জন্য কলকাতার টিন রসগোল্লা আনিস তো আর কতগুলো টিপের পাতা।

-ঠিক আছে আনবো তবে যে কাজটা দিলাম সেটা করে আমাকে আপডেট জানাবি।আর ও যেন বুঝতে না পারে আমরা ওকে অনুসরণ বা ওর অবস্থা বুঝতে এই কাজ করছি।

-ঠিক আছে দাদাভাই।

-রাখছি তবে।ও শোন পড়াশোনা কেমন চলছে তোর এখানে এডমিশনের ব্যবস্থা আমি করছি।মাকে বলিসতো কল দিতে রাতে।



৪৮#

বর্ষনের কন্যাসন্তান মোম রাখলো দিশা মোমের জন্মের পর কিংশুক দেশে এলো।এই আটমাসে তার প্রশ্নের সাথে আরো কিছু প্রশ্ন জড়ো হয়েছে।এবার তাকে সবগুলো প্রশ্নের সমাধান তাকে করতেই হবে।কিংশুক আসচ্ছে জেনে বর্ষন এয়ারপোর্ট যাবে শুনেই মধুও সঙ্গে গেলো। এয়ারপোর্টে বর্ষনকে দেখে কিংশুক যেন নতুন এক বর্ষন কে দেখলো।মধু এগিয়ে এলো আমার নামে কবিতা লিখেছেন কিংশুক দা।

এইসময়েই ফুলমনি দিশা এসে পড়ায় মধুর হাত থেকে যেন নিস্তার পেলো। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বর্ষন আর কিংশুক এক গাড়িতে উঠলো অন্য গাড়িতে মধু,দিশা,অংশু,ফুলমনি আর দুই ড্রাইভার।

-চেহেরার এ কি দশা করেছিস?আয়নায় নিজেকে দেখেছিস এর মধ্যে। বর্ষনের চুপ ওর চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে দেখে মনে হয় কতকাল যেন ও ঘুমায় না।

-তোর চেহারাও তো খারাপ হয়েছে কত শুকিয়ে গেছিস এই ছয়বছরে। -বর্ষন

একটা সত্যি কথা বলতো পলাশের সাথে তুই সুখী?

বর্ষন চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ।

-তোর নীরবতা বলছে তুই আনহ্যাপি মেরিডলাইফ লিড করছিস।

-না রে পলাশ খুব ভাল।ড্রিংকস করলে একটু বেসামাল হয়ে যায় তবে ওর মত এত ভাল মানুষ হয় না।

- দিদিভাই,মিথ্যা কথা না বলতে তুইই আমায় শিখিয়েছিলি।আমাকে তুই সব খুলে বলতে পারিস আমরা দুজনেই এখন ম্যাচুয়র।তাছাড়া তোর আমার মাঝে কোন কালেই কিছু গোপন ছিলো না আমার তরফ থেকে আজো নেই। আমি আশা করি তোর তরফেও নেই।ঠিক এই কারনেই আমি তোকে নিয়ে আলাদা গাড়িতে এসেছি। বর্ষন কেঁদে উঠলো।বিলু আমি ভাল নেই রে।তবে এ কথা বাসায় জানলে সবাই কষ্ট পাবে আমি চাইনা এটা বাড়ীর কেউ জানুক।আমি তোকে সব বলবো তবে কথা দে তুই ছাড়া কেউ জানবে না।

-তুই আমাকে দ্বিধাহীন বল দিদিভাই। আমি জানি তুই ভাল নেই।সেইদিন তুই

ওভাবে হাউমাউ কাঁদছিলি কেন বলতো? ট্রাফিকের লাল

লাইটে গাড়িটা থামলো।নাকি জীবনের রেড সিগন্যাল এটা?

চোখের আয়নায় দেখা,না দেখা...

বর্ষন যা বলে যাচ্ছিল আমার মনে হচ্ছিল আমি মরে যাই কিংবা এখনই ছুটে গিয়ে পলাশ কে মেরে ফেলি।কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছিলাম না।

-এতকিছু ঘটছে, ঘটলো তুই আমায় একটু জানালি না। আমি এতটা দূরে চলে গেছি তোর। বর্ষন তখনো কাঁদচ্ছে।তুই মা বাবাকে কিছু বলিস না বিলু ওরা বেঁচে থেকেও মরে যাবে রে এইসব জানলে। পলাশের বাড়ীতে মার যাওয়া নিষিদ্ধ করার একটা জট বুঝি খুলছে।

-পার্টিতে নিয়ে গিয়ে পলাশ কি করে তোকে বলতেও লজ্জা লাগে। সেদিন ওর একটা ডিল পাশ করাতে ও আমাকে ঐ লোকের সাথে ঘরে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এসেছে। মদে বুদ বাবার চেয়েও বয়স্ক সেই বদ আমার শাড়ি ব্লাউজ টানতে টানতে বলছে পলাশ এত দিনে একটা খাস সেক্সিমাগী এনেছে। কোনরকমে ঠেলে বেরিয়ে এসেছি।এরপর বাসায় এনে পলাশ আমায় এত মারলো কথাটা শেষ করে বর্ষন হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

আমার রক্ত টগবগ করছে কি করবো বুঝতে পারছিনা।

-সেইদিন কেন এত কেঁদেছিলাম

জানতে চাস।ফার্ম হাউজে নিয়ে গিয়ে ওরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আর পাশের ঘরে বসে পলাশ মদ খাচ্ছিল

আমি ব্লাউজ আর সায়া পরে দৌড়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় আসি অচেনা অজানা জায়গা রাস্তায় দিকবিদিক দৌঁড়াতে থাকি একবার

মনে হচ্ছিল মরে যাই।পলাশ গাড়ি নিয়ে পেছন পেছন এসে গাড়িতে তোলে।সেদিন অকথ্য গালাগালি আর মার চলে আমার উপর।বড় বড় ক্যাপালিসট ও কর্পোরেটগুলোর ওয়াইফদের নাকি এমন ছিনাল মাগী হতে হয় আমি কি করলো বিলু কাকে বলবো এইসব। বাবা মা কে বললে পলাশকে তো ওরা মেরে ফেলবে।

কতরাত আমি ঘুমাতে পারিনা বিলু আমাকে একটু ঘুমাতে দিবি সেই ছেলেবেলার মত।

-তুই পলাশকে ডির্ভোস দে বর্ষন।ও তো মানুষ না।

-পলাশকে ছাড়া আমি বাঁচবো না রে।

-এত কিছুর পর ও তুই এই কথা বলিস?তুই কি রে !

-পলাশ আমায় খুব ভালবাসে।আসলে ওর ব্যবসায়িক পরিবেশটা এত নোংরা যে পলাশ চাইলেও ভাল থাকতে পারেনা রে।

-তুই বলতে চাইছিস পলাশ তোকে ব্যবহার করেনি।তুই আজো দিদিভাই বোকার রাজ্যে বাস করিস।আমি থাকতে থাকতে তোর

ডিভোর্সের কাগজপত্র আমি রেডি করবো।

-না রে।পলাশ ভাল হয়ে যাবে ও কথা দিয়েছে।সরি বলেছে।

-এই পর্যন্ত কতবার পলাশ ভাল হয়েছে আর সরি বলেছে আমায় বলতো?

বর্ষন চুপ করে গেলো।একটা লাশ কাঁধে করে কবরের দিকে যাচ্ছে একদল মানুষ কান্না আর শোকের আওয়াজ গাড়ির কাঁচ ভেদ করে কানে বাজচ্ছে আমার।



৪৯#

আমি একটু বেশিই রেগে ছিলাম হয়ত। বর্ষন কে তার ঘরে যেতে বললাম বেশ জোরেই।আমার এই রুদ্ররূপ এবাড়ীর কেউ এর আগে দেখেনি বড়মা,দিদা,এমনকি দিশা ও মার সাথে মধুও একটু থমকে গেল অংশু এক দৌঁড়ে মার পেছনে গিয়ে লুকালো।বর্ষন আমার ছোট্টবোন যেন মাথা নুয়ে চুপচাপ ওর ঘরে মোমকে কোলে নিয়ে চলে গেলো।

-মধু তুমি বরং বাড়ী ফিরে যাও আর তোমার বাবাকে বলো বর্ষনরা এখানে কিছুদিন

থাকবে।পলাশের সাথে আমি কথা বলে নেবো।আর বাবা তোমার বাবার সাথে কথা বলে নেবেন। অংশু মধুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

-মামা তুমি তো এখানে থাকবে বাবা। ফুফু আম্মা বাড়ী যাবে।

-না,আমি থাকব না।তুমিও আব্বুর মত বাজে লোক।

অংশুর কথায় নিজেই লজ্জা পেলাম।

বাবা আমি তো তোমায় বকিনি। তুমি বলেছিলে না আব্বুকে বকতে তাই আব্বুকে বকবো বলে তোমার

আম্মাকে ঘরে যেতে বলেছি এবার আব্বুকে ডেকে আনবো।পকেটে চকলেট ছিলো অংশুর হাতে চকলেট দিলাম।

-তুমি আব্বুর মত মাকে বকবে না তো?

-না বাবা।

অংশু বোধ হয় কথাটা বিশ্বাস করে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।

-আমি তবে বাড়ী যাই।

কী ঘটছে কেউ কিছু বুঝতে পারছেনা। নির্বাক হয়ে সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

-হ্যাঁ মধু তুমি বরং এখন বাড়ী যাও।

মা এতক্ষণ চুপ ছিলো সবার মতই। তবে আমি জানি কেউ কিছু না বুঝলেও মা যে কিছুটা ধরতে পরেছে ঘটনাটা সেটা আমি নিশ্চিত।

-বাবাই এ কি ব্যবহার তোর।এই শিক্ষা তো আমি তোকে দেইনি।এত পড়ালেখা শিখে ম্যানারটাও শিখিসনি।এ কেমন আচরণ।মা মধু তুমি বসো তো।এটা আমার গোয়ার ছেলে আদব কায়দা কিচ্ছু শেখেনি।

-না, আমি বরং যাই আম্মা চিন্তা করবে।

মার কথার মাঝে আমি ধীরে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছি।দিশা,বড়মা আর দিদি ঢুকেছে বর্ষনের ঘরে। মধু আর না দাঁড়িয়েই চলে গেছে গাড়ীর আওয়াজে ঘর থেকেই বুঝলাম। মা আমার ঘরে এলো মাথাটা ভনভন করছে।মেজাজটা এতটাই গরম হয়েছে খেয়ালই

করিনি মা এসে ঢুকেছে।আমার হাতেরসিগারেটেটা তাড়াতাড়ি লোকাবো কোথায় ভাবছি।

-ফেলতে হবে না বাবাই খা কিন্তু কি হয়েছে বলতো?

মার সামনে সিগারেটটা টানতে মন চাইছেনা। হাতে লুকিয়ে পেছনে ধরে রেখেছি।

-আচ্ছা আমি একটু পরে আসি খাওয়া শেষ করে ডাকিস।

সিগারেট অর্ধেক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সিগারেটার অর্ধেক আগুনে তাকিয়ে মনে হলো দহনের আগুন ছাই

করে আমরা আনন্দে ধোঁয়া টানি কেবল তামাকই বোঝে কতটা পুড়লে কতটা ছাই হলে সুখটানের ধোঁয়া গোল পাকিয়ে উড়ে...



৫০#

মা আর দিশাকে সব খুলে বললাম।আমার কথা শুনেই মা কান্না জুড়লো।দিশার চোখেও জল।

-দাদাভাই তুই পলাশ দা কে এখনই ডেকে পাঠা।

-আজ না।দুচারটা দিন যাক।বর্ষনকেও একটু ভাবতে দে। তাছাড়া ওকে কোনভাবেই বুঝতে দেয়া যাবেনা আমি ছাড়া কেউ ব্যাপারটা জানে।মা জানো ও যখন কেঁদে কেঁদে বললো কতরাত ও ঘুমায় না নিজেকে এত স্বার্থপর লাগছিলো। এতসব ঘটে গেলো ঘটলো আমি একটুও জানতে পারলাম না।নিজেকে এত ছোট লাগছিলো তখন মনে হচ্ছিল আমি একটা অযোগ্য ভাই।

দরজায় শব্দ হলো বড়মার গলা।

মা দিশা চোখমুছে নিজেদের স্বাভাবিক করার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে দরজা খুললো।

-বাবুসোনা তোরা বড় হয়েছিস এখনো যদি এভাবে ঝগড়া করিস তা মানায় বল বাবা।তুই তো বর্ষনকে চিনিস ওর রাগ বেশি তাই বলে তুই ও যদি রেগে যাস এইবয়সে মানায় দেখলিনা অংশুটা পর্যন্ত ভয় পেয়েছে। তোদের যত ভালবাসা বাসি তত ঝগড়া আবার একজন আরেকজনের প্রাণ তোদের মতিগতি বুঝিনা।এবার বলতো বাবুসোনা কি নিয়ে ভাইবোনের এত রাগ?

বড়মা সে কথা যদি তোমায় বলতে পারতাম।কিন্তু তা কি করে বলি। তোমার মেয়ে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হয়ে লাঞ্চিত হয়। তার দেহ ব্যবহার করে প্রজেক্ট ফাইল সই করানো হয়।একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মেয়েকে বিবস্ত্র হয়ে রাস্তায় ছুটতে হয়।পশুর মত মানুষ,যারা স্বাধীনতার বুলি ফোটায় টকশোতে নারীর স্বাধীনতার

কথা বলে নারীর সামাজিক মূল্যায়ন মর্যাদার কথা বলে টক শো শেষে টক শোর উপস্থাপিকাকেই বিছানায় যাবার

প্রস্তাব দেয়। স্বাধীনতা ভাঙ্গিয়ে যারা পাকবাহিনীর চেয়েও পৈচাশিক নারীলোভী।সমাজের সব স্তরে যারা নারীকে পন্য

করে ব্যবহার করছে।শিল্পসংস্কৃতিতে নারীকে যারা দেহকে তাদের উল্লাসের উপাদান করে দিনদিন নোংরা করে তুলছে সমাজ চেতনা তার চেয়ে পাকসেনার নারী ধর্ষন অনেক ভাল ছিলো আমরা জানতাম ওরা শত্রু আজ মুখোশের আড়ালে মুখোশ চিনিনা।

কেননা তারা আমরাই স্বামী,ভাই,বাবা,মা,বোন।

-কি রে বাবুসোনা বল কি হয়েছে তোদের?

-তেমন কিছু না বড়মা ওকে বললাম আমি এসেছি বাড়ীতে কয়দিন থাক ও থাকতে পারবে না তাই একটু...

-যাক বাবা তুই এসে যা করলি আমার তো বুক কাঁপছিলো।যা বাবা এবার ফ্রেশ হয়ে তিনভাই বোন খেয়ে নে।

-বড়মা মিষ্টিমামার ডাইরীগুলো আর এলবামটা দিও তো। মা র আঁকা একটা ছবি আছে আমার ঘরে খাঁচা ভেঙ্গে একটি মানুষ বের হচ্ছে দূরে এক ঝলক আলো।ছবিটার নাম মুক্তি এত বছর আমার ঘরে এই ছবিটা আছে অথচ আজ প্রথম মনে হলো ছবিটা আমি বুঝতে পারছি! বড়মা মিষ্টিমামার ডাইরি এলবাম দিয়ে গেছে আমার ঘরে।আসার পর থেকে বর্ষন ঘুমাচ্ছে।যতবার ওর ঘরে যাই মনে হয় কতদিন পর কে জানে এমন পরিতৃপ্ত ঘুম

ঘুমাচ্ছে বর্ষন। সারারাত ধরে মিষ্টিমামার ডাইরি পড়ে যাচ্ছি। হলদে হয়ে আসা পাতায় মিষ্টিমামার হাতে লেখা দিনলিপি।

তারিখ ০৫।০৬।১৯৭১

শুনলাম পাড়ার শাজাহানসাহেবের মসজিদের ইমাম শান্তি কমিটির প্রধান হয়েছে।দৃষ্টি শিল্পসংস্কৃতির লোকের উপর না পড়লেও এখন থেকে একটু সাবধান থাকতে হবে।আজ ইমাম এসেছিলো কেন বুঝিনি। এতবছরে তিনি একদিন ও আসেনি।আমার

ছেলেরা পেপারওয়ালা,কলা সবজি বিক্রেতার ছদ্ম বেশে যে আমার কাছে আসে সেটা কি যাচাই করে গেলেন?

০৭।০৭।১৯৭১

মাত্রই খবর পেলাম শাহাজান সাহেবকে ইমাম বখতিয়ার জবাই করে বৌ মেয়ে কে ধর্ষন করে পাকসেনাদের

ট্রাকে তুলে দিয়েছে।একজন ইমাম.....

২২।০৭।১৯৭১

আমাদের ছেলেরা আজ একটা কাজ করেছে।অনেকদিন পর আজ ঘুম হবে হয়ত।বখতিয়ারকে জবাই করেই

মেরে গেছে বীর বাংলা সেনা।কাল সকালে পাকসেনারা তছনছ করবে নিশ্চিত সারা পাড়া।হয়ত

নিরীহ কিছু মারা পড়বে তুলে নিয়ে যাবে তবুও আমাদের সংগ্রাম চলবেই। এলবামে অনেক ছবি দেখতে দেখতে আমার দেখা সেইমুখ পেলাম না কোথাও।সিগারেট জ্বালিয়ে ফ্যামেলি এলবাম উল্টাচ্ছি হঠাত্ একছবিতে সম্ভব সেদিন ঈদ ছিলো মসজিদের

সামনে অচেনা অনেক মানুষের ভিড়ে এক কোনে একটি মুখ আমায় থমকে দিলো পুরোপুরি ছবিটা ফ্রেমে আসেনি তবু যতটুকু এসেছে তাতে আমি নিশ্চিত এই লোকটার পোট্রেট আমি পলাশদের তিনতলার ঘরে দেখেছি।উত্তেজনা যেন

আমায় পেয়ে বসেছে সিগারেট হাতে করেই বাবা মার ঘরের দরজায় ছুটে গেছি।

-মা, ওমা,মা একটু উঠে আসবে।

আমার উত্তেজিত আওয়াজে বাবা মা দুজনেই উঠে এলো আমার তখন খেয়াল ও নেই হাতে জ্বলছে সিগারেট বাবা বেরিয়ে এসেও ঢুকে গেলো ঘরে।

-বাবাই সিগারেটটা ফেল।

সিগারেট টা টি টেবিলের এশস্টেতে নেভালাম বাবা তুমিও একটু আসো না আমার ঘরে।

-কেন রাতে কি হয়েছে তোমার?

-এসো না তোমরা দুজন আমার এখন তোমাদের সাহায্য দরকার খুব।

বাবা মা দুজনেই এলো।

-তোমরা দেখতো এই ছবির কোনায় অর্ধেক আসা মানুষটাকে চেনো কিনা। বাবা কাউকেই চিনলো না।

মা অনেকক্ষণ ছবিটা তাকিয়ে দেখে স্মৃতিমন্থন করে বললো আরে এটা তো বখতিয়ার মামা।আমাদের পাড়ায় শাহজাহান

কাকার মসজিদের ইমাম পড়ে অবশ্য শান্তি কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন।

-মা এই মুখটাই আমি পলাশদের তিনতলায় দেখেছিলাম।অর্থাত্ পলাশের দাদুই শান্ত কমিটির বখতিয়ার।

ভোরের আলো ভারী পর্দা ভেদ করে ঘরে এলো।



৫১#

দুদিন পর সকালে পলাশের বাবা আমাদের বাড়ীতে এলেন। আমি সবে ঘুম থেকে উঠেছি।অংশু আমার কোলে চড়ে ব্রাশ করছে।বর্ষন তখনো উঠেনি।

-বউমা কোথায় তাকে নিতে এলাম। গলার আওয়াজে মা বাবা দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

-আরে বেয়াই যে বসুন বসুন।

-না বসবো না বউমাকে ডাকুন বেয়ান ওদের নিতে এসেছি।

-কিংশুকতো চাইছে ওরা আরো কয়েকদিন থাকুক। তাছাড়া বর্ষন ও অনেকদিন পর বাড়ী এলো।

-মেসো বড়দের মাঝে আমার কথা বলা অশোভনীয় তবু বর্ষন আমার দিদি আপনার অনুমতি থাকলে আমি কিছু কথা বলতে চাইছিলাম।

-হ্যাঁ বলো কি বলবে।তবে তোমার ভদ্রতার কথা আমি মধুর কাছে শুনেছি।সে কথা বাদ দাও বলো কি বলবে।বর্ষন আর আপনার

বাড়ী যাবেনা।

-তোমার ঘুম হয়ত কাটেনি তুমি কি বলছো তার মানে বোঝো?

-হ্যাঁ আমি যা বলছি বুঝে ভেবেই বলছি।বখতিয়ার ইমামসাহেবের নাতীর আদব কায়দা তো এমন হবার কথা নয়। আপনি বা আপনারা জানেন না প্রায় প্রতিরাতে পলাশ বর্ষনকে পেটায়। আমি তো এখনো কিছু করি নি আমি আপনাদের জেলের ভাত খাওয়াবো।

বখতিয়ার ইমাম নামটা শুনে পলাশের বাবা যে আঁতকে উঠে ঢোক গিললেন এটা আমার চোখ এড়ালো না। মনে মনে মজাই পেলাম।

-একটু পানি হবে? বাবা কিংশুক তুমি যা বললে আমরা তার কিছুই জানিনা।তাছাড়া সংসারে এইসব একটু আধটুকু বাদবিবাদ ঘটেই।

ঘটিবাটি একসাথে থাকলে টুকিটাকি লাগেই। এটাকে এত বড় করা ঠিক না। মা কিছু জলখাবার আর এক গ্লাস জল নিয়ে এলো।

-আপনার কাছে এটা ছোট ব্যাপার মনে হচ্ছে! আপনারও একটা মেয়ে আছে ঈশ্বর না করুক মধুর সঙ্গে এমন

ঘটলে আপনি মেনে নিতে পারবেন?আর এটা ঘটিবাটির টুকটাক নয় রীতিমত গায়ে হাত দেয়া।

-বাবা পলাশের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি আর এমনটি হবেনা তোমায় কথা দিচ্ছি।

-আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন। ক্ষমা চাইতে হলে পলাশ চাইবে বর্ষনের কাছে।যদিও আমি ভাবছি বর্ষন পলাশকে ডির্ভোস করবে।

-বাবা এতে লোকহাসাহাসি হবে তাছাড়া এইটা দুই পরিবারের জন্যই কলঙ্ক বয়ে আনবে। যারা জানেনা তারাও জানবে তারাও

নানান কথা বলবে।

-তা বলুক তবু একটা পশুর হাতে আমার দিদিকে আমি তুলে দিতে পারিনা জেনে শুনে।

-বর্ষন পলাশকে ডির্ভোস করবে তুমি বললেই এটা কিভাবে ভাবলে।তাছাড়া ওদের দুটি সন্তান আছে।

পলাশের বাবার কথায় যে ঝাঁঝটা বের হলো তাতে আমিও একটু থমকে গেলেও বুঝতে না দিয়েই বললাম

-বাচ্চারা এই বাড়ীতে মানুষ হবে। আর আপনিই কিভাবে বুঝলেন বর্ষন পলাশকে ডির্ভোস করবেনা। আমি তো কাগজপত্র

তৈরী করে ফেলেছি।

পলাশের বাবা এই রির্টানটা হয়ত আশা করেননি।থমকে গেলেন একটু। আমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন আমি পলাশকে বোঝাবো নারীর শরীরে হাত দেয়া গুনহা। ওকে আমি সন্ধ্যায় পাঠাবো বউমাকে দিয়ে দিও।আর আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি এমনটা আর হবে না।আমি তবে এখন যাই বেয়াই। পলাশের বাবা উঠে বেরিয়ে গেলেন। বাড়ীময় এক নৈঃশব্দের মাঝে ঘুম চোখে বেরিয়ে এলো বর্ষন।



৫২#

আব্বাজান বখতিয়ার ইমামের কথা কিংশুক ছোকরা কি করে জানলো এই কথাটা ভাবতে ভাবতেই পলাশের বাবা বাড়ী এলেন।

-ভাবীজান কে আনেননি আব্বা?

-না।

পলাশের মা বেরিয়ে এলেন

-আপনি গেলেন তাও এলো না এত কিসের দেমাক?

-তোমার ছেলে যা করেছে জানো না। তখনই বলেছিলাম ছেলেরে সামলাও। এখন জেলের ভাত খাবার জন্য

তৈরী হও।ইচরেপাঁকা ছেলে কিংশুকের মত এইটুকুন ছেলেও আমায় আজকে হুমকি দেয় তাও তোমার বদ ছেলের কাজের জন্য,কতবারবলেছি আমার কথা কেউ শোনেনি এখন পলাশ বর্ষনের ডির্ভোস সামলাও।

তিনি এসব কথা বললেও উনার ভেতরে একটাই শব্দ বাজচ্ছে।বখতিয়ার ইমামের নাতি।এই ইতিহাস তো অনেক আগেই চাপা পড়ে গেছে।তার আব্বাজান তো কেবল তার কাছেই বেঁচে আছেন। পলাশ কিছুটা জানে তবে কি তার

এতদিন ধরে সাজানো স্বপ্ন বিফলে যাবে।তার আব্বা কি তবে আজ কিংশুকের কাছেই হেরে গেলেন?না,এ

হতে পারে না।এত বছরের স্বপ্নকে এভাবে ভেঙে দিলে সব বৃথা। পোট্রেটের সামনে হাত রেখে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে পলাশের বাবা দরজা বন্ধ করে পাগলের মতো দৌঁড়ে নীচে এলেন।ফোনের বটন

টিপলেন ও পাশে রিং হচ্ছে। এপাশে বুকের ভেতর স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবার শব্দ অন্ধ

একুয়ারিয়ামে ঢেউ তোলা গোপন সংসিহতার মত শব্দ তুলছে।



৫৩#

পিগম্যালিয়ন দিন গিয়েছে বিফল..

সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে পলাশ এলো। আমি তখন বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। ওকে দেখেও দেখিনি এমন একটা ভাব নিয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই পেছন থেকে আওয়াজটা এলো।

-কিংশুক কি বের হচ্ছো?

ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম হ্যাঁ একটু ল ইয়ারের সাথে মিটিং আছে।

-আমি বর্ষন কে নিতে এসেছিলাম।

ওর উপর রাগটা গাড়ির দরজার উপর চালিয়ে সজোড়ে দরজাটা বন্ধ করলাম।

-কোন মুখে তুমি বর্ষনকে নিতে এসেছো? তোমার লজ্জা করেনা তোমার ভালবাসার জন্য যে আত্নীয় পরিজন সংসারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তোমাকে বিয়ে করলো তাকে তুমি ব্যবসার জন্য ব্যবহার করতে চাও তাকে পশুর মত মারধর কর।যে মেয়েকে এই পরিবারে কেউ টোকা পর্যন্ত দেয়নি।

-কিংশুক আই এম সরি।আসলে ড্রিংকসের পর আমার হুশ থাকেনা।

-যা খেয়ে হুশ রাখতে পার না তা খাও কেন?তাছাড়া সেসব ব্যবসায়ীক কাজে তুমি বর্ষনকে ব্যবহার করতে চেয়েছো তখন তো তুমি মাতাল থাকতে না তবে কেন এই নোংরামী। তুমি যদি বর্ষনের ভালবাসা না হতে আমি তোমাকে মেরে মেরে হুশ করে দিতাম।বখতিয়ার ইমামের রক্ত এর চেয়ে ভাল হয় কি করে।

-মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েস কিংশুক।

মারতে আমিও তোমায় পারি।এখানে আমার দাদাকে নিয়ে কথা বলার তুমি কে? স্কাউন্ড্যাল নিজেকে কি ভাবো তুমি?

তোমার মত এমন কিংশুক আমার অফিসের এমপ্লয়ার।

কথাকাটাকাটির শব্দে মা সহ সবাই বেরিয়ে এসেছে।পলাশ এগিয়ে গিয়ে বড়দের প্রনাম করে অংশুকে কোলে তুলে নিলো।

-কি হয়েছে বাবাই বাইরে কিসের এত

চেঁচামিছি? তুই দিন দিন অভদ্র হয়ে যাচ্ছিস।লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়।

মা র কথায় রাগটা ভেতরে আরো বাড়লো। চোখটা ভিজে এলো। বড়মা এগিয়ে এসে আমাকে ঘরে নিয়ে গেলো।

-বাবা পলাশ বাইরে কেন

ঘরে এসো কিংশুকের কথায় কিছু মনে করো না। এখনো ছেলেমানুষী যায়নি ওর।

-আরে না মা তেমন কিচ্ছু হয়নি শ্যালক

জামাইবাবু একটু রাজনৈতিক কথা বলছিলাম ও একটু ক্ষেপে গেছে এই যা।আমার পেছন পেছন বর্ষন এলো আমার ঘরে।

-বিলু তুই কি চাস আমি ডির্ভোস করি?

-তোর কি ইচ্ছা?

-দেখ পলাশ এসেছে।সে কি বলে। একটা মানুষ তো বদলাতেও পারে। তাছাড়া এতবছর এইসব কথা কেউ জানতি না তোরা এখন যখন জানিস সে হয়ত সেই ভয়ে হোক বা লজ্জায় হোক এমনটা আর নাও করতে পারে।



৫৪#

অনেকক্ষণ মার সাথে কথা বলে। নিজেকে শুধরে নেবার শপথ করে।পলাশ আমায় ডাকলো।আমার পাশে বর্ষন।অংশু মার কোলে বসে।বড়মা,দিদা ও বসা। বাবা বাইরে থেকে এসে ঢুকলো।

-পলাশ যে কেমন আছো বাবা।

পলাশ উঠে গিয়ে বাবাকে প্রনাম করলো।আমি আছি একরকম বাবা তা আপনি কেমন আছেন?

-এই বয়সে আর থাকা বেঁচে আছি।

-বাবা আমি আমার সব অপরাধ মেনে বর্ষনদের নিয়ে যেতে এসেছি। আর কথা দিচ্ছি এমন ঘটনা আর ঘটবে না।আমাকে ক্ষমা করে একবার যদি সুযোগ দেন নিজেকে শুঁধরে নেবার। বাবা আমার দিকে তাকালো।তারপর বর্ষনের দিকে।

-বর্ষন প্লীজ ফিরে চলো।আমি তোমার বাড়ীর সবার কাছে ক্ষমা চাইছি ইভেন তোমার কাছেও এমন আর হবে না আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখো। বর্ষন মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ঘরের দিকে ছুটে গেলো।

- মামা,তুমি যে বলেছিলে আব্বুকে বকে দেবে আম্মাকে বকে বলে।

অংশুর দিকে তাকালো পলাশ আমি নির্বাক এক চাউনি দিয়ে হেঁটে গেলাম বর্ষনের রুমে।

-আমি কি করবো বিলু?

দিশা আর আমি নির্বাক।আমিও ঠিক বুঝতে পারছিনা এইসময় কি করা উচিত। কি উত্তর হবে আমার।মা ঘরে এলো।দেখ বাবাই এভাবে যখন কাতর মিনতি করছে পলাশকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখ।

আমি তখনো বুঝে উঠতে পারছিনা নিজের হাতে কি আবার নরকে ঠেলে দিচ্ছি বর্ষনকে নাকি সুখের পালকে!

-দিদিভাই তুই কি চাস বলতো?

-তুই বা তোরা যা চাস আমি তাই করবো।

গলায় কাশি দিয়ে পর্দা সরিয়ে পলাশ ঢুকলো।কোলে অংশু।

-কিংশুক তুমি কি আমায় এখনো বিশ্বাস

করতে পারছো না?খালি কাগজ আনো আমি সিগন্যাচার করে বর্ষনকে নিয়ে যাচ্ছি।

খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো বিশ্বাস সে তো পৌষের শিশির রোদ ছুঁয়ে গেলে আর তার দেখা মেলে না।



৫৫#

কাহিনীটা বর্ষনের ফিরে যাওয়ার মাঝেই শেষ হয়ে যেতে পারতো কিন্তু জীবন এমন একটা পরিক্রমা তার পথে পথে বাঁক বর্ষনের জীবন পরিক্রমায় ও এক ভয়াবহ বাঁক এলো। আমার গত কয়দিন ধরে দেখা আবছায়া দুঃস্বপ্নের পেছনেও যে একটা কাহিনী ইশারায় জানান দিচ্ছিলো কিছু একটা হতে যাচ্ছে তাই বা কি জানতাম ! ঐদিন রাতে আর বর্ষন পলাশকে যেতে দেয়া হয়নি।পরেরদিন সকালে বর্ষন আবার তার সংসারে ফিরে গেলো।বাড়ীতে বর্ষনের অনুপস্থিতি কোণায় কোণায় জানান দিচ্ছে।অংশুর হৈচৈ নেই।মোমের কান্না নেই।সারা বাড়ীতে যেন হঠাত্ ছেঁড়া তারের রিদম।আমিও দিন পনের থেকে কলকাতা ফিরে এলাম।বর্ষনের সাথে রোজ কথা হয় অংশু এবং মোম ও কথা বলে তবে ওদের কথার চেয়ে আবদার থাকে বেশি। মামা এটা আনবে,ওটা আনবে।আমার বেশ লাগে তবে মাঝে মাঝে মিষ্টিমামার কথা মনে হলে কান্না পায় মনে হয় মিষ্টিমামা থাকলে এমন কতশত আবদার তো আমিও করতাম। মাঝে একবার এসে ঘুরে গেছি দেশে। মধুকে নিয়ে কবিতা লেখার কথা মধু ভুলেনি কি করা বর্ষন বললো একটা লিখে দিয়েই দে না। বেচারী তোর প্রেমে হাবু ডাবু খাচ্ছে।

অগত্যা কি করা একটা কবিতা লিখে দিলাম।

যে মধু কবিতার কিছুই বোঝেনা সেই মধু কবিতা পড়ে কি বুঝলো কে জানে বর্ষনের সামনে ডাইরীটা বুকে চেপে লজ্জারাঙা হয়ে আমিও আপনাকে ভালবাসি বলেই ডাইরি ফেলেই দৌঁড়।বর্ষন ডাইরী খুলে পড়ে আর হাসে-

ভালোবাসা শিখতে চাই

তাই জন্মান্ধের মতো

উত্তাপের বুদবুদে

বিষন্ন সমুদ্র জলে

ভয়াবহ বশ্যতার কাছে

আমি ফেট্টিবাধা গান্ধারী চাই না

একটি হাত চাই

একটি মানহুশ যে বুঝবে

যে শেখাবে প্রতিটি অক্ষর

তারপর এক ভোরে

পাখির ঠোঁটের শব্দ নিয়ে

পালকে লিখে ফেলবো

ভা ল বা সি তোমাকেই

ভালবাসা...

-এইটা পড়ার পর মধু কেন যেকোন মেয়ে ধরেই নেবে তুই তার প্রেমে পড়েছিস বিলু।

-যা!

পলাশ এলো।আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো।

-কি আমার নামে কোন কমপ্লেন নিঃশ্চয় পাওনি।বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। যাবার আগে বর্ষনকে আলতো করে গালে ছুঁয়ে গেলো। মনে হচ্ছিল সেইদিন বর্ষনকে পলাশের বুকে ফিরিয়ে দিয়ে ভুল করিনি।সুখের পালকেই আছে বর্ষন।বর্ষন ও খুব প্রশংসা করলো পলাশের আমূল পরিবর্তনের। কিন্তু সব সকাল সবসময় বলে দেয় না দিনটা কেমন যাবে !



-সেইদিন কিংশুক ছোকরার কাছে অপমানিত হয়ে এসে তোমায় কল করে যা বলেছিলাম তার সময় হয়ে এসেছে পলাশ।আব্বার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আমাকে অনেক দিন ধরে যন্ত্রনা বুকে রেখেও হেসে কথা বলতে হয়েছে।অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।আমার নিস্পাপ আব্বাকে সেইদিন যারা আমার সামনে জবাই করছে তারা সবকটা ঐ কুত্তার বাচ্চা অরুনের লোক।এত বছর পর সময় এসেছে মুক্তিযোদ্ধার নামে আব্বাজান রে মরা সেই কুত্তার বাচ্চা অরুনের বদলা নেবার।আব্বাজান আল্লাহপাকের দলে ছিলেন তুমি জানো। উনার মত জ্ঞানী ইমাম তখনকার দিনে ছিলেন না।শান্তিবাহিনীর সভাপতি হয়েছিলেন তিনি ইসলাম কায়েম করতে।আব্বাজানকে যেভাবে ইসলাম বিরোধিরা জবাই করে মেরেছিলো অরুনের কথায় আমিও চাই তুমিও সেভাবেই বর্ষনকে জবাই করে তোমার দাদার মৃত্যুর বদলা নাও।

-কিন্তু আব্বু এটা এখানে করলে বড়রকম ঝামেলা হয়ে পড়বে।তাছাড়া বর্ষনের বাপ মা আমাদের ছাড়বে না।

-এখানে কেন করবে। গল্পটা আমি যে কলকাতা থেকে শুরু করেছিলাম গল্পটার শেষ তুমি সেই কলকাতাতেই করবে।

-অংশু,মোম ওরা থাকবে তো তাছাড়া কলকাতার হোটেলে এসব করতে গেলে ভিসা পাসপোর্ট দেখিয়ে রুম নিলে ধরা পড়ে যাবনা।

-গলাকাটা পাসপোর্ট অনেক পাওয়া যায় তার একটা ম্যানেজ কর। নয়ত বর্ষন পরে যাবে তুমি চোরাই পথে আগে চলে যাও।

-আব্বু আপনি যা করতে চাইছেন এটা কি ঠিক হবে?

-কাফেরের সাথে থেকে থেকে তোমার রক্ত ও ঠান্ডা হয়ে গেছে পলাশ। ছোট্টবেলা থেকে আমি আব্বাজানকে জবাই করা যন্ত্রগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে তোমাকে বড় করে তুলেছি প্রতিশোধ নিয়ে তোমার দাদার হত্যাকারীর মেয়েকে হত্যা করে তোমার দাদাজানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আজ তুমি এইকথা বলো।ছিঃছিঃ

-না মানে আমি অংশু আর মোম এর কথা বলছিলাম।

-ওরা যাবে না।আমি ওদের বুকে ওদের মার প্রতি এমন বিষ ঢোকাবো আল্লার কসম ওরা কোনদিন জীবনে ওদের মার নাম মুখেও আনবে না।তুমি তৈরী হও আব্বাজানের মৃত্যুদিনেই আমি চাই নেককাজটা হোক।

পলাশের বাবা তিনতলার ঘর বন্ধ করে ছাদের সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে উপরের দিকে উঠতে লাগলেন আর নীচের সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে পলাশ নামতে লাগলো নীচে।দূরের একটা স্ট্রীট লাইট জ্বলছে নিভছে।আর কয়টা কুকুর কেন জানি কান্নার সুরে ডাকছে।



৫৬#

বছর পার হয়ে গেছে বর্ষনকে দেখিনা। গতকাল কল করে জানালো আমার জন্য এক দারুন সারপ্রাইজ অপেক্ষা আছে।

কি সারপ্রাইজ সারাদিনে জানালো না।দিশা কে কল করতেই জানলাম ঘুরতে এবং ব্যবসায়িক কাজে পলাশ কয়েকদিন আগেই কলকাতায় গেছে আর আগামীকাল বর্ষন যাচ্ছে ফ্লাইটে কলকাতায় সেখানেই পলাশ থাকবে।

-অংশু আর মোম?

-ওরা যাচ্ছে না।রাঙাদির সেকেন্ডহানিমুন বলে কথা।

-ওদের আমাদের বাসায় এনে রাখিস।

-রাঙাদি নাকি তাই বলেছিলো পলাশদা র আব্বা আম্মা নাকি কান্না জুড়ে দিয়েছে নাতি নাতনী ছাড়া একা থাকতে।

-কয়দিনের জন্য আসচ্ছে ওরা?মাস খানেক নাকি থাকবে তাই তো বললো।

-কোন হোটেলে উঠবে কিছু জানিস? অর্নবদার হোটেলেই তো উঠবে কথা।

-আমাকে কিচ্ছু বলেনি জানিস শুধু বলছে বিলু সারপ্রাইজ আছে।

-আচ্ছা দিশা রাখছি।মা কেমন আছে? বলিস পরে কল করে নেবো মা কে।

বাসা থেকে হোটেল খুব একটা দূরে নয় গাড়িতে দশমিনিট আর গলি পথে হেঁটে বের হলে মিনিট

চারেক।পলাশ কলকাতায় এলো যোগাযোগ করলো না কোথায় উঠলো কিচ্ছু জানালো না ঘটনা কি।তখন

রাধিকা মামী বললেন জানো তো আমার মামনি আসচ্ছে বাড়ীতে থাকতে বললাম জামাই কিছুতেই শুনলে না অগত্যা তাকে রাজী করিয়েছি যতদিন কলকাতায় থাকবে ততদিন আমাদের হোটেলেই থাকতে হবে।অনেক বলার পর রাজী হলো। অনর্বকে বলে রেখেছি তোমাকেও বলি হোটেলের বেষ্ট রুমটা যেন আমার মামনির হয়।

-পলাশ আজ এসেছিলো? কখন ?

-পলাশ তো আজ তিনদিন রোজ আসচ্ছে বর্ষনের নিষেধ আছে নাকি তোমাকে জানাতে তাই আমায় বলতে বারণ করেছে,কিন্তু পারলাম কোথায় বলতেই হলো তোমাদের।

-আচ্ছা মামনির ঐ যে সুইডেন থাকে ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুটার কি যেন নাম ছিলো...

-ঋত।কেন?

-একটা প্যাকেট দিয়ে বললো এটা যেন মামনিকে পৌঁচ্ছে দেই। জামাইকে বললামও দেবো কিন্তু ভুলে গেছি।

-ঋত কবে এসেছিলো?

-কালই তো না না পরশু আজকাল সব ভুলে যাই প্যাকটটা তুমি রাখো মনে করে মামনিকে দিও।



৫৭#

আনন্দবাজারের ভেতরের পাতায় চোখ পড়তেই আমি অবাক।খুব মন দিয়ে খবরটা পড়লাম প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ঋতব্রতর আত্মহত্যা। পেপারটা আর পড়তে মন চাইল না।মৃত্যু কি আগাম জানান দেয় সে আসচ্ছে। নাকি মৃত্যু স্বপ্নের মত জড়িয়ে যায়।

ঋতদা কলকাতা এলেই দেখা করতো। বর্ষনের খুব ভাল বন্ধু ছিলো।হয়ত বর্ষনকে খুব ভালোওবাসতো কিন্তু কোনদিন বলতে পারেনি।ঋতদা র জন্য খুব কষ্ট লাগছিলো।হঠাত্ কি মনে হতেই রাকা দিকে কল দিলাম। রাকা দি বিয়ের পর এখন ব্যাঙ্গালোর থাকে। ওপাশে রিং তুলতো রাকা দি নিজেই হ্যালো বলতেই

-কি রে কিংশুক কেমন আছিস?

-ভাল।কাল কলকাতায় বর্ষন আসচ্ছে।

-তাই নাকি।দারুন খবর দিলি আমিও গতপরশু কলকাতায় এসেছি।

-পলাশ তবে কি তোমাদের বাসায় উঠেছে?

-পলাশ কে?

-পলাশ কে মানে!তোমার দাদা বর্ষনের হাবি।

-ও সেই পলাশ তো আমার আত্নীয় দাদা নয় তাই খেয়াল নেই।ওর বাবা আমার বাবার প্রতিবেশী ছিলো ওপারে থাকতে সেই সূত্রেই কয়েকবার কলকাতায় এলে বাড়ীতে থাকতো।বর্ষনের সাথে পরিচয় হবার পর সেই যে গেলো একটা যোগাযোগও করেনি। পরে তো তোর কাছেই জানলাম পলাশ বর্ষন বিয়ে করেছে।যাক বহুবছর পর দেখা হবে ভাবতেই এক্সাইটেট লাগছে।উঠবে কোথায় আমাকে জানাস এসে সারপ্রাইজ দেবো বর্ষনকে।

-ঋতদার খবরটা পড়েছো?

-না তো।আরেকটা পুরষ্কার বাগিয়েছে।

-না আনন্দবাজারের ছয় নম্বর পাতায়

দেখো।আজ ছাড়ছি বর্ষন এলে জানাবো তোমায়।

জীবনানন্দ দাশের কয়টা পংক্তি মনের ভেতর জেগে উঠলো-

"কোথাও পাখির শব্দ শুনি;

কোনো দিকে সমুদ্রের সুর; কোথাও

ভোরের বেলা র'য়ে গেছে - তবে।

অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে -

অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়

বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;

এ কোন সিন্ধুর সুর:

মরণের - জীবনের?

এ কি ভোর?

অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।

একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে - সময়

কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে

আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য

বুকে ক'রে জেগে ওঠে?

কোথাও ডানার শব্দ শুনি;

কোন দিকে সমুদ্রের সুর - দক্ষিণের

দিকে,

উত্তরের দিকে,

পশ্চিমের পানে?

সৃজনের ভয়াবহ মানে;

তবু জীবনের বসন্তের মতন

কল্যাণে সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-

পাখিদের শব্দ শুনি;

ভোরের বদলে তবু

সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল ভিয়েনা,

টোকিও, রোম, মিউনিখ - তুমি?

সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল

সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার

নিখিল মরুভূমি! বিলীন হয় না মায়ামৃগ

- নিত্য দিকদর্শিন;

যা জেনেছে - যা শেখেনি -

সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত

জ্ব'লে

জাগে না কি হে জীবন - হে সাগর -

শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।"



৫৮#

এয়ারপোর্টে আমাকে আর রাকাদিকে দেখে বর্ষন নিজেই সারপ্রাইজ।পলাশ একটু পরে এলো।দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বের

হয়ে গাড়িতে চেপে জোড়ামন্দিরের কাছে আসতেই বর্ষন গাড়ি থামাতে বললো।

-বিলু এতবছর পর এলাম কলকাতায় ঋতের মা বাবাকে একটু দেখে যাই। আমার পাশের সিটে রাকাদি।নির্বাক তাকালাম দুজন দুজনের চোখে।পলাশ নিজের অজান্তেই পরিস্থিতি সামলে নিলো ইয়ার্কি মেরে।

-তোমার পুরোনো প্রেমিক তো সুইডেন পরে এসে দেখা করে যেও।

-ঋত আমার ভাল বন্ধু ছিলো।ওদের বাড়ীতে রাকা আমি এমন কি বিলুও বহুবার এসেছে।

-বর্ষন এইদিকে বরং কাল আসি এখন সরাসরি হোটেলে চলে যাই। হোটেলে এসে গাড়ি থেকে লাগেজ বের করছে হোটেল বয় একটা ব্যাগ পলাশ নিজে নিলো অনেক অনুরোধ স্বত্ত্বেও ঐ ব্যাগটা কিছুতেই সে হোটেল বয়কে দিলনা।অর্নব বসের স্পেশাল গেষ্ট খবরটা প্রায় সমস্ত হোটেল জানে তাই ইনকিউয়ারী পাসর্পোট এন্ট্রি কিছুই করা হলো না কেবল রুম কি তে বর্ষন লেখা হলো। ব্যাগটা যেভাবে পলাশ নিয়ে রুমে ঢুকলো আমার ঠিক সেই প্রথম দেখা পলাশকে মনে করিয়ে দিলো। হোটেলের সবচেয়ে দামী রুমটা দেয়া হয়েছে অর্নবদার ইচ্ছায়।দখিনের জানালা সহ দুইপাশ থেকে ঢোকার দুটি দরজা। ঘরটি সাজানো হয়েছে ইটালীয় স্টাইলে।ডবল বেড,ডাইনিং সহ ড্রয়িংরুম।দরজা খুললেই দুপাশে লবি। ঘর দেখে বর্ষন যেন ফড়িং হয়ে উঠলো তখনই অর্নবদা ঢুকলো।বর্ষন পলাশকে জড়িয়ে ধরলেন।তোরা বাসায় থাকলে কত ভাল হতো বল।তোমাদের বৌদি আসচ্ছে।সব ব্যাগ কেবিনেটে রাখলেও আমি খেয়াল করলাম পলাশ তার ব্যাগটা বেডের নীচে রাখলো।পলাশ ইয়ার কন্ডিশন রুমেও একটু ঘামছে মনে হলো।

অর্নবদা,রাকাদি আর বর্ষন লবিতে বসে আড্ডা দিচ্ছে।পলাশ বেরিয়ে এসে বসলো ওদের পাশে। বৌদি এসেও জুটলো আড্ডা জমে উঠেছে কিন্তু পলাশ যেন একটু নিস্প্রভ। গল্পের মাঝেই ঠিক হলো রাকাদি সহ

আমরা দীঘা যাবো।বর্ষন পাসপোর্টটা বের করে আমায় দিলো জেরক্স করিয়ে নিতে। পাসপোর্টটা অর্নবদার কাছে রেখে জেরক্স কপি বর্ষন তার ব্যাগে রেখে দিলো।পরেরদিন যাবার কথা ঠিক হলেও রাকাদি বললো পরশু

গেলে ওর হাবিও যেতে পারবে। সেইমতই প্রোগ্রাম ঠিক করে দীঘায় হোটেল বুকিং করা হলো।বর্ষনকে নিয়ে অনর্বদা হোটেল

দেখাতে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে রাকাদি ও বৌদি।পলাশকেও ডাকলো অনর্বদা পলাশ টায়ার্ড বলে এড়িয়ে গেলো মনে হলো আমার।

-পলাশ তুমি কি জানো আমাদের পরিবারে বর্ষনকে লক্ষ্মী মানা হয়। বাবা বলতেন বর্ষন অরুনের

মেয়ে হতে পারে আমার ঘরের লক্ষ্মী ও যেদিন ওর মার পেটে এলো সেদিন হোটেলের জমি কিনি আমি আর ওর জন্ম হবার পর কলকাতার হোটেল জগতে আমাকে গোনা শুরু।পলাশ মৃদু হাসলো। ওরা বেরিয়ে যেতেই আমি পলাশকে বললাম তুমি নাকি সাত

আটদিন আগে এসেছো কোথায় ছিলে?কাজ শেষ হয়েছে?

-আমতা আমতা করে পলাশ যা উত্তর দিলো তাতে সঠিক লিংক যেন পেলাম না।কাজ বলছে ঢাকুরিয়ায় উঠেছে বললো নাগেরবাজার। নাগেরবাজারে তেমন কোন হোটেল আছে বলে আমার জানা নেই। যে কম্পানীর নাম বললো অলৌকিক ভাবে সেই কম্পানী আমাদের ক্লায়েন্ট ওদের কোন ফরেন ডেলিগেট এলে এরা সাধারণত আমাদের হোটেলেই পাঠায়।

-কি ভাবচ্ছো কিংশুক?

-না ভাবছিলাম তুমি যে কম্পানীর নাম বললে তারা তোমায় নাগেরবাজার কেন রাখলো !

পলাশ একটু ঘেমে উঠলো যেন।রুমাল বের করে মুখটা মুছলো।

-কিংশুক আমি বরং একটু ফ্রেশ হয়ে নিই ফিরে আসতে আসতে।

-শিওর।

পলাশ ঘরে ঢুকে গেলো আমি নীচে নেমে কল করলাম একটা।কম্পানী জানালো এই নামে তাদের কোন ডেলিগেট আসেনি। গতকয়দিন ধরে দেখা স্বপ্নটা আমার কেন যেন মনে পড়ে গেলো আমি আঁতকে উঠলাম।

আজকের দিনটাকে পর্যায় ক্রমে সাজাতে সাজাতে আমার কেন জানি মনে হলো কোথাও একটা গন্ডগোল আছে।কিন্তু কিছুতেই কিছু

মেলাতে পারছিনা। নিঃসঙ্গ মাটির আয়না...

ভিক্টোরিয়া,নন্দন,নিউমার্কেট বাড়ী হয়ে ডিনার শেষ করে আমরা যখন হোটেলে ফিরেছি তখন রাত নয়টা দশ। পলাশ আমাদের সাথে বেরোয়নি।ফ্রেশ হবার পর থেকেই সে সুইটে।বর্ষনকে সুইটের দরজার কাছে এসে কেন জানিনা হাত ধরে বললাম দক্ষিণের দরজাটা লক করা নেই।লক করিস না।

-সে কি! কেন রে?

-জানিনা, গত কয়দিন ধরে ছোট্টবেলার মত ভয়ানক স্বপ্ন দেখছি।কয়েকরাত ঘুমাতে পারছি না।আমার মন কেন জানিনা কু ডাকছে।একটু সাবধানে থাকিস দিদিভাই।

-পাগল একটা।তুই কি বড় হবি না রে বিলু!

-দরজাটা লক করবিনা আমায় ছুঁয়ে বল।

আর উল্টাপাল্টা কিছু হলে দক্ষিনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নীচে চলে আসবি আমি সিকিউরিটিকে বলে যাচ্ছি।

-পাগল একটা।কিচ্ছু হবে না।তুই শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিস।পলাশ আছেনা আমার সাথে।

-ঐ পলাশকেই আমার কেন জানি ভয় লাগছে।সেই প্রথম দেখার মত আজো ওকে দেখে আমার সেইদিনের মত লাগছে।তাছাড়া আমি খোঁজ নিয়েছি পলাশ কোন কাজে কলকাতা আসেনি।আর ইনকুয়ারীতে ওর পাসপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছিলাম এই সেই বলে দিলো পাসপোর্ট দিলো না। ছেলেটি বলেছিলো জেরক্স করে দিয়ে যাচ্ছে ও তোর

নামে এন্ট্রি করে নিতে বলে দিল আর অনর্বদার কাছে তোর পাসপোর্ট রাখা আছে সেটা বলে দরজা লক করে দিলো।

-আচ্ছা তুই যা আমার কিচ্ছু হবেনা।কাল সকালে কিন্তু গঙ্গার ঐ পাড়টায় যাবো। তাড়াতাড়ি উঠে আসবি।কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাস না যেন।

একটু এগিয়ে গিয়ে লবির থেকে উঠে বর্ষন দরজায় নক করতেই দরজা খুলে পলাশ বের হলো।

-কেমন হলো তোমাদের কলকাতা ভ্রমণ?

-তুমিও গেলে কিন্তু পারতে। তা খেয়েছো তো?

ওদের কথার মাঝেই আমি বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।বেরিয়ে এলাম ঠিকই বাড়ীতে যেন আসতে পারিনি। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছি। আবার সেই স্বপ্ন ঘড়িতে তখন ঠিক এগারটা চল্লিশ।উঠে বসেছি।দুই গ্লাস জল খেলাম।আমার কানে যেন বর্ষনের

চিত্কার বাজচ্ছে।আনমনেই লাইট জ্বালালাম চোখটা গিয়ে পড়লো ক্যালেন্ডারে আজ জুলাইয়ের একুশ তারিখ অর্থাত্ আর বিশ

মিনিট পরেই বাইশে জুলাই। মিষ্টিমামার ডাইরীর পাতা গুলো যেন চোখে ভাসচ্ছে।লাফিয়ে উঠলাম টিশার্টটা গায়ে গলিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ি নেবো কিনা ভাবলাম একটু তারপর আবার ঘরের দিকে ছুটে গিয়ে গাড়ির

চাবিটা নিয়েই দৌঁড়ে নামছি রাধিকামামী ডেকে উঠলেন

কি হয়েছে তোমার এমন করছো কেন?

অর্নব,এই অর্নব!

রাধিকামামী ডাকতে ডাকতে আমি শুধু

বললাম হোটেল যাচ্ছি বর্ষন খুব বিপদে।মেইন গেইট পাগলের মত খুলেই গাড়ি স্ট্রাট দিয়ে বেরিয়ে পড়ছি।

হোটেলের সামনে কোনরকমে গাড়িটা পার্ক করেই দৌঁড় লাগালাম সিকিউরিটি পেছন পেছন দৌঁড়াচ্ছে।

-হোটেল থেকে কেউ বাইরে গেছে?

-জ্বি সাহব জি।

-কৌন?

-স্রেফ আপকা দুলহাজী।

যা ভেবেছি তাই কি ঘটে গেছে? মনেপ্রাণে চাইছি তা যেন না হয়।

দৌঁড়ে সুইটে এসে দেখি দুটি দরজাই খোলা।কেউ কোত্থাও নেই ফ্লোরে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেখে আমি হাউমাউ

করে কাঁদচ্ছি আর এই রুম সেই রুম ওয়াশ রুম খুঁজে কোথাও পেলাম না বর্ষনকে দরজার পাশে সেই মধুদের বাড়ীতে দেখা রক্তমাখা ছুরি পড়ে আছে শুধু তারপর সব কেমন জানি ব্ল্যাক আউট। আমি একটু একটু করে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি যেন বহুদিন জমে থাকা ঘুমে ডুবে যাচ্ছি।আমার হাত থেকে পিচ্ছলে যাচ্ছে বর্ষনের রক্তমাখা হাত।তারপর আর কিচ্ছু আমি দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিনা কেবল ডুবে যাচ্ছি গভীরে গহীনে...



৫৯#

বর্ষন ডেকে যখন আমার জ্ঞান ফিরলো। ঝাপসা চোখে দেখলাম অর্নবদা,বৌদি দাঁড়িয়ে।

বৌদি এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরলো।অর্নবদা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।আমার দুচোখ গড়িয়ে জল পড়ছে।ভেতরে ভেতরে এত দূর্বল তবু নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছি কারণ জানি এখনই শুনতে হবে বর্ষন আর

বেঁচে নেই।বৌদির চোখ গড়িয়ে দুফোঁটা জল যখন হাতে পড়লো আমি মনে মনে নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমার ভুলের জন্য বর্ষন

আমায় ছেড়ে চলে গেছে।কেন যে সেদিন বাড়ী গেলাম হোটেলে থেকে গেলেই আজকের দিনটা দেখতে হতো না। ডাক্তার এসে প্রেসার মাপলেন,চোখ দেখলেন।

-নাও হি ইজ টোটালি আউট অফ ডেঞ্জার।

অনর্বদা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাছে এসে বসলেন।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন

-তোর জন্যই বর্ষন বেঁচে গেছে।

তবে পলাশকে ধরা যায়নি।মাসি,মেসোর সাথে কথা হয়েছে। ঐদিকটা উনারা দেখছেন।

-বর্ষন কোথায় দাদামনি?

-আছে এই হাসপাতালেই আছে পাশের কেবিনে।

-আমি যাব।ওকে একটি বার দেখবো আমি।

ডাক্তারের দিকে তাকালেন অর্নবদা ডাক্তার নার্সকে হুইলচেয়ার এনে আমাকে বসাতে বললেন। হুইলচেয়ারে বসে পাশের কেবিনে গিয়ে দেখি বর্ষনের মাথায় ব্যান্ডেজ,পেটে ব্যান্ডেজ।চোখ বন্ধ অক্সিজেন চলছে।হাতে স্যালাইন।

রাধিকামামী বসে বসে কাঁদছেন রাকাদি মামীকে স্বান্ত্বনা দিচ্ছে। দেখো মামী তোমার মামনির কিচ্ছু হবে না।আমাকে দেখে রাকাদি আর রাধিকামামী এগিয়ে এলো। মামী আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে

-বাবা তুমি ঠিক হয়ে উঠেছো।আমার সোনা বাবা! সেইরাতে তুমি যদি না বের হতে তবে...মামী আবার কেঁদে ওঠে।



৬০#

আমার জ্ঞান একদিন পর ফিরলেও বর্ষনের জ্ঞান ফিরলো সাতদিন পর।

জ্ঞান ফিরলো কিন্তু আমার বর্ষন ফিরলো না। অর্নবদা যা বললো তাতে মনে হয় আমি কিছু আন্দাজ করছি এটা পলাশ

বুঝেছিলো।পাশের সুইটের কাস্টমারদের বয়ান অনুয়ায়ী প্রথমে ধস্তাধস্তি হয় বর্ষন দক্ষিনের

দরজা দিয়ে পালাতে চায় তখন পলাশ ওকে ধরে আনে এবং হয়ত ছুরি মারে যখন বর্ষন জানালা দিয়ে লাফ দেয় আওয়াজ শুনে পেছনের সিকিউরিটিরা বাগানে ঢোকে তুমি সোজা পথে ঘরে। জানালা দিয়ে লাফ দেয়ায় ছুঁড়ির আঘাত পেটের বদলে কোমরেও

পিঠে লেগেছে আঠারটা সেলাই লেগেছে আর এত উপর থেকে পড়ার ফলে মস্তিস্ক ভীষনভাবে ঝাঁকি খায় আর তাই বর্ষন আমাদের এখন নতুন করে চিনবে আগের স্মৃতি ফেরাতে হলো দীর্ঘ চিকিত্সা ও ওকে ওর সব পুরোনো জিনিস দেখাতে শোনাতে হবে।মেডিক্যাল বোর্ড তাই বললো।এছাড়া সিঙ্গাপুর ও বাইরের দেশগুলোতে এই রোগের উন্নত চিকিত্সা আছে। দেখি মাসি মেসো কি বলেন।

-দাদামনি।

-বলো।

-আমি আর তোমাকে সময় দিতে চাইছি না।জানি শুনতে খারাপ লাগছে বাট আই ওয়ান্ট মাই হোল লাইফ টু মাই সিস্টার।

অর্নবদা হাসলেন পিঠ চাপড়ে বললেন আজ সত্যিই আমি গর্বিত কিংশুক।তোমার যা মন চাইছে তাই কর

তবে বর্ষনকে সবটা সময় দেবে বলে আমাকে সময় দিয়ে যে সেলারী তুমি পেতে সেটা তোমায় নিতেই হবে।

-না দাদামনি বর্ষনের জন্য আমি নিঃস্বার্থ থাকতে চাই।

-ওকে এজ ইউ উইশ। তবে দরকারে লজ্জা করো না চাইতে।

দাদামনি চলে গেলে।কেবিনের সব পর্দা সরিয়ে আনমনেই আবৃত্তি করতে থাকি-

মৃত্যুই আদতে প্রেম না মানো তবু!

ভালবাসার জন্য কতটুকু কাঙাল হলে

কিংবা কতটুকু ভালবাসলে থেমে যাবে সব

ঘরে শীত এসেছে পকেটে সিগারেট দেশালাইহীন মিসকল আসেনা

আমার বড় ঠান্ডা লাগে মাথায় তামাকের নেশা

একটি দেশালাইয়ের খোঁজে অথচ ভালবাসা শেখাবে বলে

সেই যে কুমারীজোছনায় গেলে চিতার আগুনে আজ তাই

জোছনা পোড়ে সিগারেট জ্বলে আর ভালবাসা

মাটির অক্ষরে লেখে মেঘলা পূর্নিমা

প্রেমহীন আকাশের মত

মিথ্যে চেয়ে থাকা...!

-বাহ!কার কবিতা এটা?বেশ সুন্দর তো। আচ্ছা তোমার নাম কি?

বর্ষনকে জড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। কান্না কখনো কখনো শুকিয়ে যায় তখন পেয়াজের ঝাঁঝেও কান্না আসে না।



হোটেলের রেপুটেশন এবং পলাশের কোন আইডেন্টিটি না ইকুয়ারিতে না থাকায়

তার উপর বর্ষনের মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে অর্নবদার বন্ধু লালবাজারের পুলিশের কর্তা ব্যাপারটা পুলিশ কেস হিসেবে এই ঘটনাটি নিলেন না। বরং কিছু জরিমানা ভরতে হলো আর একটু দৌঁড়ঝাঁপ চললো কয়দিন।বাংলাদেশ

থেকেও জানা গেলো পলাশ দেশে ফেরেনি ফলে অংশু আর মোমকে বাদ রেখে পুরো পরিবারের নামে জেনারেল ডাইরী করে রাখা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হয়নি। হাসপাতাল থেকে যেদিন ছাড়া পেলো বর্ষন আমি ওর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা শান্তিনিকেতন নিয়ে গেলাম কোপাইয়ের পারে বসে আনমনেই ও যখন গেয়ে উঠলো'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ খেলে যায় রৌদ্র ছায়া বর্ষা আসে বসন্ত...'আমার চোখ চিকচিক করে উঠলো মনে এক আশার রোদ উঁকি দিয়ে গেল অজান্তেই।সাঁওতাল পাড়া ঘুরে ফেরার পথে বর্ষন বললো আমাকে গঙ্গা দেখাবে। গঙ্গা নাকি খুব সুন্দর।তুমি জানো এই জায়গা গুলো আমার খুব চেনা লাগছে। মনে হয় এখানে আমি বহুবার এসেছি। রাধিকামামী বলছিলেন আমি কলকাতায় পড়েছি।তুমি কি সেটা জানো?

-হ্যাঁ জানি তো।তোমার খুব ভাল বন্ধু ছিলো রাকা, ঋত, সোমজা,শুভঙ্ক­র,শম্পা,শুভজ্যোতি,সুদীপ্তা।

-তাই বুঝি! আমার কেন কারো কথা মনে পড়ছে না বলো তো।

-তুমি তো এখনো অসুস্থ তাই তোমার সব মনে পড়ছেনা।ওষুধ গুলো খেলেই সব মনে পড়ে যাবে।

-আমার নাকি তুমি ভাই লাগো? আমার কি হয়েছিলো বলো তো।

একবার ভাবছিলাম বলি।পরে ভাবলাম এখন থাক কিছু জিনিস পরে জানাও ভালো কখনো কখনো।



৬১#

মধুর মিথ্যে স্বান্ত্বনায় অংশু ও মোম এতগুলো মাস অপেক্ষায় থাকলেও তাদের

ধৈর্যের বাঁধও ভাঙতে শুরু করেছে। এতদিন ফুফু,দাদীকে আব্বা আম্মু কবে আসবে বলো না কবে আসবে করতে করতে আজ দাদাজানকেই প্রশ্ন করে বসলো অংশু আর

মোম।পলাশের বাবাও মনে মনে এই সময়টার প্রতীক্ষাতেই ছিলেন। তোমাদের আব্বু মৃত্যুর সাথে লড়ছে।

তোমার আব্বুকে মেরে তোমাদের আম্মু কলকাতার ঋতব্রত বলে একজনের সাথে পালিয়ে গেছে।সে আর তোমাদের কাছে ফিরবে না তবে কয়েকদিনের মধ্যে তোমাদের আব্বু হাসপাতাল

থেকে ছাড়া পাবে।আল্লাহ তলহার গজব পড়বে এমন ফুটফুটে দুটো বাচ্চাকে ফেলে যে চলে যেতে পারে তার

মা হবার কি যোগ্যতা আছে।তোমাদের আব্বু এটাই বলেছিলো 'আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো যাও অংশু আর মোমকে ছেড়ে যেও

না ওরা তোমাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবে।'তোমাদের

আম্মা তোমাদের অস্বীকার

করেছে তোমরা নাকি তার

ছেলে মেয়ে নও।আমি তোমার আম্মুর খোঁজ

করছি খোঁজ পেলেই তার কাছে তোমাদের ফিরিয়ে দেবো। তিনদিন পর মাথায় ছোট্ট একটা বেন্ডেজ বেঁধে পলাশ সন্ধ্যায়

বাড়ী ফিরলো তার বাবার সাথে। সেইদিন ধস্তাধস্তির সময় পলাশকে ঠেলে দক্ষিনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়

পলাশের মাথা দেয়ালে লেগে ফেটে গিয়েছিলো তিনটি সেলাইও লেগেছে তাতে আর এটাই অংশু আর মোমের কাছে পলাশকে খুনের চেষ্টা বলে চালিয়ে দেয়া হলো।অংশু আর মোম কেমন জানি নির্বিকার হয়ে গেছে।বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালে আর একটি চাল চাললেন পলাশের বাবা।দিশাকে তিনি রিং দিলেন অনুনয় করলেন অংশু ও মোমকে নিয়ে যেতে দিশা রাগের মাথায় অনেক কিছু বললো।যখন অনেক কথার শেষে দিশা বলতে শুরু করেছে যার সন্তান তাকেই মেরে ফেলে আর কি নাটক বাকী আছে।অংশু মোম যেদিন বুঝবে লাউডস্পিকারটা অফ করে দিলেন পলাশের বাবা।দিশা লাইন কেটে দিলেও পলাশের বাবা মিথ্যে অনেক অনুনয় অনুরোধ করে ফোনটা রাখলেন।অংশু আর মোম কি বুঝলো কে জানে তারা দৌঁড়ে পলাশের

কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।ঘরের সবাইকে চমকে দিয়ে আর পলাশের

বাবাকে জয়ী করে অংশু আর মোম একসাথে বলে ওঠে

-এমন আম্মু আমাদের চাইনা।আজ থেকে জানবো আমাদের কোন আম্মু নেই।

কথাটা শেষ করেই এক দৌঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে গেলো অংশু আর মোম আর গোঁফ দাঁড়ির ফাঁকে পলাশের বাবা মৃদু হাসলেন।বাইরে তখন গোধূলির আলো পেরিয়ে আধো আলোয় আযানের আওয়াজ ভেসে আসে।



৬২#

ডাক্তার অনেক কয়টি টেস্ট করে বললেন কিংশুক আপনার নিরলস শ্রম ও চেষ্টার জন্যই এই কয়েকমাসে বর্ষন

অনেকটা রিকোভার করেছে।ওকে যতটা পারেন অতীতে নিয়ে যান গল্প বলুন ওকে ভাবান।অতীতে যত ঢুকতে থাকবে তত তাড়াতাড়ি রিকোভারী করবে তবে খেয়াল রাখবেন একদিনে খুব বেশি চাপ দেবেন না।

আজ সকালে বর্ষনকে নিয়ে ওর বেথুন স্কুল থেকে বেরিয়ে আমরা যখন জোঁড়াসাঁকোর

দিকে হাঁটছি হঠাত্ বর্ষন থমকে দাঁড়ালো আচ্ছা কিংশুক আমি যেন কাকে বিলু ডাকতাম সে কি তোমাকে?

নাকি আমার আরো কোন ভাই আছে?

মনে হচ্ছিল প্রখর কুয়াশায় হঠাত্ রোদের ঝিলিক।আবেগ চেপে রাখতে পারিনি নিজের ভেতর অনেক দিন পর আমি যেন

নিজেকে খুঁজে পেলাম আমি ছাড়া তোর আর কোন ভাই নেই রে আমিই তোর ভাই বিলু।আর তোর একটা বোন

আছে দিশা যে রাঙাদি ডাকে তোকে। দিশা,রাঙাদি।আচ্ছা তুমি আমায় তুই করে এতদিন তো বলোনি আজ

বললে তবে কি আমিও তোমায় তুই করে ডাকবো।

হ্যাঁ।

জানো আমার না আবছা আবছা দুটো বাচ্চার ছবি ভাসে।আর লম্বা চুলের মহিলার আবছায়া, আমার মা নেই?

-তোর একটা না দুটো মা আছে। বাবা আছে।দিদা আছে।

-তাই বুঝি? আমি কেন মনে করতে পারছিনা।আর দুটো বাচ্চার মুখ যে দেখি তারা কারা?

-তোমার ছেলে অংশু আর মেয়ে মোম।

-আমার ছেলে অংশু মেয়ে মোম!

জপতে জপতে অনেকটা পথ হেঁটে আমরা জোঁড়াসাঁকো পেরিয়ে গঙ্গায় এসে দাঁড়িয়েছি।তখনো বর্ষন অংশু আর

মোম জপচ্ছে।

জানো,আমার আবছায়া মনে পড়ছে কিন্তু কিছুতেই মুখগুলো স্পষ্ট হচ্ছে না।অংশু আর মোম আমার ছেলে আমার মেয়ে !

আমার মানিব্যাগে রাখা অংশু আর মোমের ছবি দেখালাম। অনেকক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখলো বর্ষন তারপর

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো ওদের বাবার নাম কি পলাশ? গঙ্গায় তখন জোয়ার জল ফুলছে।আমার ভেতর তখন উচ্ছ্বাস কান্না হয়ে বইছে।



কয়েকদিন ব্যাঙ্গালোর ঘুরে আসা হলো রাকাদির বিশেষ নিমন্ত্রণে।ফেরার সময় রাকাদিও আমাদের সাথে কলকাতা এলো।এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোতেই বর্ষন প্রায় চেচিয়ে উঠলো রাকা এই রাকা এইখানে কোথায় যেন ঋতব্রত থাকতো।রাকা দি বললো জোড়া মন্দিরে। কিন্তু আজ প্রায় বছর খানেক ও মারা গেছে।ঋতব্রত মারা গেছে!

রাকা কি বলিস তুই?হ্যাঁ যেদিন তুই কলকাতা এলি ঠিক তার আগে আমি যেদিন কলকাতা এলাম,আমি কলকাতা এলাম হ্যাঁ আমি কলকাতা এলাম তুই আর বিলু আমায় নিতে এসেছিলি।পলাশ একটু পরে এলো।সেইরাতে হ্যাঁ সেই

রাতে সুইটে ঢোকার আগে বিলু আমায় অনেক কিছু বললো আমি কথাগুলো ওর পলাশের প্রতি খেদ বা সন্দেহ বলে উড়িয়ে দিলাম।

এরমাঝে চারদিন বর্ষন খুব একটা কথা বললো না।আমরা প্যারাডাইসে শরবত খেয়ে বের হয়ে হাঁটছি ফেভারিট কেবিনের দিকে বর্ষন হঠাত্‍ বলে উঠলো জানো বৌদি সুইটে ঢোকার একটু পরই পলাশ বেড থেকে তার লাগেজ বের করলো আমি ওয়াশরুমে ঢুকে ফেইসওয়াস নিতে বাইরে এসে দেখি পেপারে মোড়া বড় দুটি ছুরি পলাশ ওর লাগেজ থেকে বের করে বালিশের নীচে রাখছে। আমি ধীরে ওয়াশরুমে চলে এলাম কি করবো ভাবছি।তারপর কি হয়েছিলো বৌদির প্রশ্নের মুখে বর্ষন অনেকক্ষণ ভাবলো কিন্তু কিছুই মনে করতে না পেরেই হয়ত চুপ মেরে গেলো।

বর্ষনের মেডিকেল ভিসার একস্টেশনের জন্য বেশ কয়েকদিন দৌঁড়াতে গিয়ে অপূর্বের সাথে পরিচয়।বাংলাদেশী,কর্মসূত্রে কলকাতার ভিসা অফিসে আছে।বর্ষনের কাহিনী শুনে ওই কিসব করে ভিসা বাড়িয়ে দিলো।

প্রেসিডেন্সিতে পড়েছে বর্ষন প্রেসিডেন্সি থেকে বের হতেই অপূর্বের সাথে দেখা।রাকাদি ও বর্ষনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমরা কফিহাউজে বসেছি চারজনে।কফিবয় কে ডেকে চারটে কফির অর্ডার করতেই বর্ষন বলতে লাগলো

তখনই পলাশের ডাক শুনে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ঘরে এলাম জানালা খুলে দেখলাম সিকিউরিটি খুব

কাছেই।খোলা জানালায় পর্দা টেনে দিলাম এই ভেবে সাউন্ডপ্রুফ রুমের আওয়াজ যেন নীচে যায় বিলুর কথা,আশংকা তখন

আমার সত্য মনে হচ্ছিল। ডাক্তার এর মাঝেই খুব আশাবাদী হয়ে উঠছেন লাস্ট থ্রি মানথে বর্ষন যেভাবে ফিরছে ও খুব দ্রুত স্মৃতি ফিরে পাবে।সেইদিন সন্ধ্যায় বাড়ীর ছাদে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছি রাধিকামামীর অনুরোধে বর্ষন একটা গনসঙ্গীত গাইলো।গানের রেশটা অপূর্বের কাছে গিয়ে লাগলো এত ভরাট গলা এত ভাল সুর তাল অথচ এই মানুষটি নিজের জন্য গান শিখে নিজের জন্য গায় সেই অপূর্ব যখন গাইলো 'তুমি কেমন করে গান কর হে গুনী...'বৌদি বেশ খেপালো পিন্টু এটা কাকে উত্‍সর্গ করলে ভাই কাকে বললে কথাগুলো।রাধিকামামী বেশ অবাক হয়ে বললেন সব বুঝলাম পিন্টুটা কে বৌমা।আরে মা অপূর্বের ডাক নামই তো পিন্টু।ও আচ্ছা।অপূর্ব লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। বিলু জানিস তুই বলেছিলি তাই সাহস পাচ্ছিলাম তুই বলেছিলি দক্ষিণের

দরজা খোলা আর সিকিউরিটিকে বলে যাবি।ওয়াশরুম থেকে পলাশ তখনো আসেনি দেখে আমি ফোন করলাম ইনকিউরিতে রিং বাজলো কিন্তু তখনই পলাশ এসে লাইনটা কেটে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো কি চাই এত

রাতে ইনকুয়ারিতে?তোমার ভাইকে ডাকবে?আমিও খুব স্বাভাবিকভাবেই বললাম ভাইকে ডাকবো কেন?কেন তোমার

আদরের বিলু কি কি বলে গেলো না স্বপ্ন আশংকার কথা।ঠিক বলে গেছে।তারপর বর্ষন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।অর্নবদা সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে কল করলো ডাক্তার কান্নাটাকে পজেটিভ নিতে বললেন।এর মানে বর্ষনের স্মৃতি ফিরছে একটু চাপ দিয়ে বলুন এরপর কি হলো দেখুন কতটুকু এগোয় কান্নায় মনে হচ্ছে ওর ঐদিনের কথা সব স্মৃতিতে ফিরে এসেছে তাই কান্নাকাটি করছে।অর্নবদা কল কেটে বর্ষনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন তারপর কি হয়েছিল বর্ষন একটুক্ষণ চুপ থেকে বর্ষন বলতে থাকে পলাশ বলে

আজ একুশে জুলাই আর আধঘন্টা পরেই বাইশে জুলাই একাত্তরের এইদিনে তোমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার সান্ডাপান্ডারা আমার দাদাজান শান্তিবাহিনীর সভাপতি ইমাম বখতিয়ারকে জবাই করে খুন করেছিলো আজ

আমি সেই প্রতিশোধ নেবো।

আমি আঁতকে উঠি তুমি রাজাকারের নাতি।খুব গর্বে বুক চাপরে পলাশ হেসে উঠে আর বলে হ্যাঁ আমি রাজাকার

ইমাম বখতিয়ারের নাতি তো!

আমি আস্তে আস্তে দক্ষিণের দরজার দিকে পেছাতে থাকি।পলাশ কেমন জানি বিভত্স হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধারা রিক্সা চালাবে ভিক্ষা করবে আর রাজাকাররা স্মৃতিসৌধে শহীদমিনারে ফুল দেবে মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে স্বাধীনতার

কথা বলবে আর একটা করে চেতনা হত্যা করবে বলেই বালিশের নীচ থেকে বড় ছুরিটা বের করে পলাশ আমি দৌড়ে গিয়ে দক্ষিনের দরজা খুলতে গেলে পলাশ আমার চুল টেনে ধরে অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে আমি পলাশকে ধাক্কা মারি ওর মাথা ঠুকে দেয়ালে রক্ত বের হতে থাকে আমি দক্ষিণের দরজা খুলে চিত্কার করি বাঁচাও অমনি ও ছুরি তুলে তেড়ে আসে জানালা খোলাই ছিলো ওর প্রথমবারের ছুঁড়ির আঘাত থেকে বাঁচতে আমি সরে যাই দ্বিতীয়বার আঘাত করতে এলে পর্দা ধরে ঝাঁপ

মারি আর ওর ছুঁড়ি আমার পেটে না লেগে কোমড় থেকে পিটে লাগে ও আমাকে ধরে ফেলে আমি সজোরে লাথি মারি পলাশের

হাতের ছুরি ছিটকে পরে আর আমি নিচে তারপর সব অন্ধকার..

দাদামনি আমি আমার ছেলে মেয়ের কাছে যাবো।আমাকে বাংলাদেশ যাবার ব্যবস্থা করে দাও।ওরা নিশ্চয় ভাল নেই আমার জন্য ওরা দুজন কত না জানি কাঁদচ্ছে।



৬৩#

ভালবাসার দ্বিতীয় অধ্যায়....

কিছু রুটিন টেস্ট করার ছিলো কিন্তু বর্ষনের জেদ আর কান্না দেখে ডাক্তার বললেন ছেলে মেয়েকে দেখে আসুক তারপর না হয় হবে।এয়ারপোর্টে আসার পথে অপূর্ব অবাক করে দিয়ে প্রশ্ন করলো সব তো শুনলাম।এবার নিশ্চয় ডির্ভোস ছাড়া পথ নেই?

তখনো জানিনা আরো নাটক আটকে আছে জীবনের তারে। আমি স্বাভাবিকভাবে অতশত না ভেবেই

বললাম তা আর বলতে। তুমি বর্ষনকে এভাবে আর কতদিন দেখবে মানে? হোল লাইফ তোমার সংসার তোমার জীবন না হয় বাদ দিলাম কিন্তু বর্ষন বাচ্চা দুটো নিয়ে বিনা অবলম্বনে বাকীটা জীবন কাটিয়ে দেবে বা দিক তাই চাও তুমি?

আমি ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না তাছাড়া এই বিষয়টা নিয়ে এর আগে ভাবিনি।আমার নীরবতার মাঝেই অপূর্ব বললো-তোমার ও তোমাদের মত থাকলে এবং অবশ্যই বর্ষন যদি চায়

আমি বর্ষনের সাথে পাশাপাশি বাকীটা জীবন কাটাতে চাই। বর্ষন এক পলক তাকালো তারপরই সোজা রাস্তার দিকে দৃষ্টি।

দেখো কিংশুক আমিও একজন শহীদ ডাক্তার মুক্তিযোদ্ধার ছেলে। আমি চোখের সামনে তোমার

মিষ্টিমামা কে যেমন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখছি।তার গানে প্রেরণা পেতে দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের

তেমনি দেখছি আমার ডাক্বাবাকে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা পয়সায় চিকিত্সা করতে মার গহনা বিক্রি করে মুক্তিযোদ্ধাদের

জন্য ওষুধ কিনতে।তোমার মিষ্টিমামার মতো তখন আমাদের বাড়ীতেও

পেপারওয়ালা,সবজিওয়ালা সহ কতরকম লোকের ভিড় বেড়ে গেলো।একদিন ওষুধ ও অস্ত্র পাঠাতে গিয়ে পাকসেনার

হাতে ধরা পড়লেন আমার বাবা।অনেক অত্যাচার নির্যাতন শেষে যদিও তিনি ফিরলেন কিন্তু স্বাধীনতার কয়েকদিন পরেই তিনি মারা গেলেন আর আমার বাবাকে থুঁজে না পাওয়ার শোকে মানসিক ভারসাম্য হারানো আমার মা বেঁচে থাকলেন শুধু। আমার এক ভাই এক বোন বিদেশে থাকলেও মাকে ছেড়ে আমি দেশ ছেড়ে যাইনি,কিন্তু মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন গত কয়েকবছর আগে।এগুলো আসলে কোন না কিংশুক এটা বর্ষনের পাশে বাকীটা জীবন পাশাপাশি হাঁটার প্রেরণা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিয়ে বাঁচা।



৬৪#

বাংলাদেশ পৌঁচ্ছেই যা করা হলো তা উকিল নোটিশ।অংশু মোম এর সাথে স্কুলে দেখা করতে গেলাম বর্ষনের দিকে করুন তাকিয়ে হেঁটে চলে যায়।পেছন পেছন গেলাম কি হয়েছে মামা তোমরা আম্মুর সাথে এমন করছো কেন বাবা।আমার দিকে তাকিয়ে অংশু চোখ মাটির দিকে রেখে বললো আমাদের আম্মু আমাদের কাছে মৃত ঋতব্রত এর জন্য যে আব্বুকে খুন করতে পারে যে আমাদের তার সাথে নিতে অস্বীকার করে সেইদিন থেকেই আমরা দুজন ঠিক করেছি আমাদের আম্মু নেই হাতটা উঠেই যাচ্ছিল মোম আর অংশুর কান্নার আওয়াজে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। যাই মামা,ওরা স্কুলবাসে উঠে বসলো বুঝলাম সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের চেয়েও ভাল ব্রেইন ওয়াশ করা হয়ে গেছে।ওদের আর ফেরানো যাবে না।বর্ষনকেও

এটা বলা যাবে না। কি রে বিলু ওরা চলে গেলো কেন? ডির্ভোস রুল আছে।চল বাড়ী যাই।

আচ্ছা ধর পলাশ অংশু আর মোমকে দিলো না তবে কি তুই পলাশকে ডির্ভোস করবি না? কষ্ট হবে অংশু মোম ছাড়া বাঁচতে তবে রাজাকারের সাথে আর বসবাস নয়।রাজাকার ও রাজাকারের রক্ত ধুয়ে মুছে ফেলার এখন শ্রেষ্ট সময় তা সে দেশে হোক

কিংবা সম্পর্কে। আদালতে ঠিক সেই দিনের কথাগুলোই বললো বর্ষন জানি ওর বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে তবু পাহাড়ের মত বলেছে আমার কোন রাজাকারের রক্ত চাইনা।মিষ্টিমামাকে কোনদিন দেখিনি কিন্তু আজ বর্ষনের আদলে আমি যেন মিষ্টিমামাকেই

দেখছি। মুক্তিযোদ্ধা আর লাখো জনতার জয় দেখছি। কটা দিন বিষন্ন কাটলো।

মাকে বাবাকে অপূর্বের কথা বললাম। দিশা অবশ্য খবরটা আগেই

জানে বড়মা আর দিদার এক কথা তুই যদি ভাল বুঝিস তবে তাই কর।বর্ষনকে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করছি।

অপূর্ব খারাপ না আমার সাথে বিয়ে দিবি?

বর্ষনের কথা শুনে তো আমি থ।

অনর্বদা কল দিলো রুটিন টেস্ট করাতে কলকাতা যেতে মা সেই ফাঁকে বর্ষন আর অপূর্বের বিয়ের আলাপ করে তারিখ ঠিক করে ফেললো। এবার বর্ষন যা করলো অপূর্বের চার পুরুষের অতীত তাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক

অবস্থানের খবর নিলো আমাকে সাথে নিয়ে নিয়ে।অপূর্বকে কল করে জানালে অপূর্ব হাসে।দুই পরিবার মিলে বিয়ের তারিখ ঠিক

করলো রাধিকামামীর ইচ্ছে তার ঘরের লক্ষ্মী তার ঘর থেকেই যাবে অগত্যা বিয়ের স্থান ঠিক হলো কলকাতার বেলঘড়িয়া। কলকাতা পৌঁচ্ছে বিয়ে বৌভাত শেষ করে বর্ষনের সব বন্ধুবান্ধব তাদের বাচ্চাকাচ্চা, দুই পরিবারই দেশে ফিরেছে। আমি আবার অর্নবদার সাথে কাজে যোগ দিয়েছি।বর্ষনের রুটিন টেস্ট হয়ে গেলেই অপূর্ব আর বর্ষন হানিমুনে যাবে কর্ণাটক।

বোটে হানিমুন। স্পনসর বাই রাকা দি। ড্রয়ারটা খুলে কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করতে গিয়ে ঋতব্রতদার মৃত্যুর

আগেরদিন দিয়ে যাওয়া ডাইরিটা পেলাম। আমি জানি এই মুহূর্তে অপূর্ব বর্ষণ

গঙ্গার পাড়ে বসে। ডাইরিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম,খুঁজে পেতে খুব একটা সময় লাগলো না।

ডাইরিটা বর্ষনের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। কি এটা? ঋতব্রত দার ডাইরি মৃত্যুর আগেরদিন

মামীকে দিয়ে গেছিলো তোকে দিতে। বর্ষন ডাইরীটা নিলো। ডায়েরিটা খুললো,প্রায় সব পাতাই

খালি,শুধু একটা পাতায় লেখা রয়েছে- 'পলাশকে প্রথম দেখে ভাল লাগেনি তবু

বলতে পারিনি।যেমন বলতে পারিনি মনের কথা জানতাম তুমি আসবে।দৈবাত্ দোসর মিললেও,মিল

হয় না সকলের।শুধু মনের ভূমিতে রয়ে যায় সে।চিরকাল।দু-একদিনের মধ্যেই আমার ট্রেন ছেড়ে যাবে পৃথিবীর স্টেশন

মনে প্রাণে চাইছি আমি চলে গেলেও এই লেখাটা তুমি জোর বৃষ্টিতে একুশে শ্রাবণ পড়ো গঙ্গার সেই

ধারে না হোক পদ্মা,মেঘনা,যমুনা নচেত্ কোন একটা নদীর ধারে।'জোর বৃষ্টি নেমেছে। গঙ্গার

দিকে তাকিয়ে আমরা তিনজন।

ঢেউগুলোর ওপর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে।গঙ্গাপ্রেমী ঋতব্রত মনের কষ্টকে ভাসিয়ে দিতে পারেনি। পারলে এভাবে চলে যেত না।গঙ্গার এইধার আবার একা হয়ে গেলো। একা। হঠাত্ অপূর্ব চেঁচিয়ে উঠলো হোয়াট এ

মিরাকল আজই তো একুশে শ্রাবণ।জোর বৃষ্টি,গঙ্গার সেই ধার। আমার কেন জানি মনে হলো চারটি সুখী মানুষ গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে ঢেউ দেখছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ।ঋতব্রত দা অঝোর শ্রাবণ ধারায় যেন বিক্ষত ঢেউ।

তখনি অপূর্ব আর বর্ষন একসাথে গেয়ে উঠলো।

'এমন দিন তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়

এমন দিন তারে বলা যায়....'



[এই উপন্যাসের সব চরিত্র স্থান কাল কাল্পনিক]