মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৪

গল্প - বেবী সাউ

বিদায়ের ক্যানভাস
বেবী সাউ


এরপরে আর কিছুই করার নেই । হুড়হুড় করে জল ঢুকে এলো । সটসার্কিটে খেয়ে ফেললো লাইট ক্যামেরা একশান ।ছাদ নেই । বিস্তীর্ণ আকাশ । হতভম্ব ।

সহানুভূতির অনুভব হলেই প্রাক্তন প্রেমিকা রোজার কথা মনে পড়ে । যে শক্ত করে আঁটোসাটো চুল বেঁধে এক প্রজাপতি স্টাইল বিনুনী পিঠে ছড়িয়ে রহস্যময়ী চোখ তুলত । বিগত দিনের মতো সে ও গতকাল যদিও । সায়েন্টিস স্বামীর হাত ধরে জীবন্ত ছবির সাথে সাথে ঘুরে ঘুরে স্বপ্নে বসবাস করছে । আমেরিকায় প্রেজেন্ট এখন ।দু বছরের ছেলের সাথে এখন সে হ্যাপী হ্যাপী । কম্পিউটারে গেম খেলছে , ঘর সেজে উঠছে ।

এসময়ে রোজা কথা মনে আসা যুক্তিযুক্ত নয় কিন্তু সাধের স্বপ্ন ভাঙার পরেই , পর পর ব্যর্থতাগুলো ঝলকে ঝলকে আসে । আহত মানুষকে নিহত করার জন্য যেমন সরকারী হাসপাতালের দরকার পড়ে , ব্যর্থ মানুষকে স্মৃতি । চুনের রঙ , প্লাস্টার অফ প্যারিস আর আর ঢেউ খেলানো ব্লাবের টুকরোর মাঝখানেও যে খন্ডবিশেষ দেখা যাচ্ছিল তোলার জন্যে হাত বাড়াতেই সাদা বিধবা থেকে এয়োতি হতে আরম্ভ হল । ব্লাবের টুকরোটি মাঝখানের আঙুল থেকে কোনমতে বের করে সে ক্যামেরাটি তুলে নিল । ততক্ষনে অনেকে ফাস্টরুমের যেটাতে কম্পিউটার আর জেরক্স মেসিনটা ছিল , জমা হয়েছেন । বিভিন্ন রকম বাক্যবানের সাথে তাকেও খুঁজছেন তারা । দোকানের ছেলেটি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি , হতভম্ব ভাব নিয়ে এখনো কারণটা বোঝার চেষ্টা করছে এবং সবাইকে বোঝাচ্ছে সাধ্যমত । এসব কথার মাঝখানেও সে ক্যামেরাটি তুলে চুন আর প্লাস্টার অফ প্যারিসের সাদা ধুলো সরিয়ে তুলছে এবং তার মধ্যমার লাল লোহিত কনিকা ছুঁয়ে যাচ্ছে ক্যামেরার লেন্স , কালো ফিতে কভারের কিয়দংশ । হঠাত্‍ চমকে উঠে পেছনে দেখে পাড়ার রতনকাকা 'সায়ক সায়ক ' বলে ডাকতে ডাকতে হেঁচকি তুলছেন । প্রথমে বুঝতে না পারলেও সে শব্দটার সাথে পরিচয়ের হেতু প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে , তারপরই বুঝেছে এ ক্ষতি অতুলনীয় । চোখ ফেটে জল আসতে চাইলেও সে ছোট বাচ্চাটির খোঁজে সেকেন্ড রুমে ঢুকেই ডুকরে জল বেরিয়ে এল চোখ জ্বালা করে ।

এডমিশানের জন্য ছবির দরকার হয় এই ছোট শহরের একমাত্র ইংলিস মিডিয়াম স্কুলটিতে । প্রচুর নামডাক সায়কের নিজের হাতে গড়া এই 'প্রকাশের' । সকাল থেকে ব্যস্ততা আরম্ভ হয় আর চলে রাত দশটা পর্যন্ত । সায়কও প্রচুর খুশ তার এই সাধের জব নিয়ে । দারুন ছবিতোলার হাত তার । যদিও সে এখনো ফটোগ্রাফি কোর্স করেনি সেভাবে । পেটের দায়ে নিছকই এক স্টুডিও তে কাজ নেওয়া । তার কিছু দিন পর নিজের স্বপ্নকে তিল তিল সাজিয়ে আজ এখানে পৌঁছানো । তাদের অসচ্ছল পরিবার কিছুটা নিশ্চিত ভাবে ভাতের থালার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল এরপর । এই সাজানো , এই ছবিদের ক্যামেরায় ধরে থাকা , এই প্রিয় কাজের মধ্যে ডুবে থাকা সায়কের খুব ভালো লাগত । স্বপ্নে স্থান পেয়েছিল ছোট এই শহরে তার আপন স্টুডিওর জন্য একটা রুম বানাবে ।কাঁচের ডোর । কিছু সবুজ সবুজ লতাগুল্ম । মানিপ্ল্যান্ট , ক্যাকটাস ইত্যাদি নিয়ে এক দুর্দান্ত ঝকঝকে ছবিঘর । সময়ের সাথে সফর শেষ হলেও , তার ক্যামেরা ধরে রাখবে চলমান বর্তমানকে । আর এমন সব অসাধারণ ছবি তুলে চমকে দেবে বড় শহরের ডিগ্রীধারী নামীদামী বসদের । স্বপ্ন ।

সে ধুলোর মাঝখান থেকে সাবধানে তুলে আনছে বিরাট এক মেঘের ক্যানভাস । জলের প্লাস্টিক বোতলটি চেপ্টে গেছে অথচ ছিপি বন্ধ থাকায় ভেতরে জল টলটলে হয়ে খেলা করছে । এতকিছুর মাঝখানেও এসবের ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে তার । অবশ্য কিছু রিপোর্টার ইতিমধ্যে ক্লিক করতে করতে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কিছু বাক্য চালান করছেন । সায়কের চোখ নিসপিস করছে , হাত বাগে থাকছে না সে লেন্স থেকে রক্ত সরিয়ে সমুদ্রের ওপর ক্লিক করল । সমুদ্রের ক্যানভাসের সাথে চুনের এক আশ্চর্য বিবাহপর্ব যেন ।

এতদিন নিজস্ব সম্পদের মতো আগলে রেখেছিল এই অতীতকে । ভেঙে পড়া ছাদ আর হুড়মুড়িয়ে ঢোকা জলসব রঙ ধুয়ে ফেলেছে । বড় আপন এই ছবিটিকে ঢেনে তুলতেই একঝাঁক গন্ধ সায়কের সারা শরীরে বিদ্যুত্‍ খেলিয়ে দিল , রোজার গন্ধ। জল চুরি করে নিয়েছে ততক্ষণে ।

বিষন্ন সকালটা পার হল । দুপুরও থেমে নেই । মাথা যন্ত্রনা নিয়ে সায়ক রাস্তায় নামল ।বৃষ্টি জল খেলছে টুপটাপ । কয়েক ফোঁটা নোনা মিশল তাতে । এবড়ো-খেবড়ো পিচে উঠে এসেছে লাল মোরামের রং । ছেঁড়া পাতারা সবুজ । মনটা হঠাত্‍ই দুলে উঠল । ঝলসে উঠল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ।

সায়কের ছবির এগজিবিশন আজ ... বৃষ্টি ফোঁটা , মোরামের রং , রোজার গন্ধ , শিশিরের জল আর ... আর... অসংখ্য নার্সারী শিশুর হাসি ।