মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

নভেলেট - সুবীর সরকার

সোনা পাড়ার হাঁস
সুবীর সরকার


১।

আকাশে মেঘ জমছে। মাসুদ ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। শান্ত উঠোন। উঠোনময় মায়া। হাঁসেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাল নিকরদীঘি থেকে কিনে আনা ধলা মোরগটা বেশ টুকটুক খুঁটে খাচ্ছে কি যেন। মেঘের ডাক। মেঘের ডাকের নিচে আশ্চর্য

পৃথিবী। মাসুদের মন ভালো হয়ে গেল। মাসুদ আড়মোড়া ভাঙলো। মাসুদ অন্যমনস্ক হয়। তার চোখ কেমন দূরাগত হয়ে ওঠে। আঙিনা পেরিয়ে দূরের ধানমাঠের দিকে হাঁটতে থাকে। এখন সে মাইল মাইল হাঁটবে।শালিক চড়ুই ঘুঘুর ডাক শুনতে শুনতে একসময় কোকিলের ডানাঝাপটে তার ঘোর কাটবে। ভোরপেরনো সকালটা তার খুব প্রিয়।যত রাজ্যের ভাবনার জাল বুনতে বুনতে আশ্চর্য এক খেলাই খেলতে থাকে মাসুদ এইসময়। তার চোখের ভিতর সর ফেলতে থাকে আরো আরো মেদুরতা। আর মেদুরতার বাঁকে বাঁকে কেমন দলা পাকানো কুয়াশার মতো বিষণ্ণতাও। বিষণ্ণতা থেকে কি চাইলেও মুক্তি মেলে মানুষের!এতসব ঘটনাপরম্পরার ভিতর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরে মাসুদ।গাছের ছায়ায় ছায়ায় তার এই হেঁটে যাওয়াতে প্রথাগত কোন ছন্দ থাকে না যদিও,তবু কেমনধারা ছন্দবদ্ধতায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে মাসুদ বাড়ির খোলানে এসে দাঁড়ায়। সে একা একাই হাসে। হেসে ফেলে।এক গ্লাস পানি খায়। এসবের ভিতর কখন যেন ইমামা চা নিয়ে আসে। আকাশে আরো আরো মেঘ জমে। আজ বুঝি রোদ উঠবে না আর!



২।

মাসুদের আজ স্কুল যাওয়া হবে না।মিঠুভাই আর বিউটি বেরিয়ে গেলে মাসুদ আব্বার ঘরে ঢোকে। কিন্তু আব্বা ঘরে নেই।মাঠকোটার দিকে গেছে বোধ হয়। উঠোনে কামলাকিষাণেরা গোল হয়ে বসে নাস্তা সারছে।আম্মা আর ইমামার তদারকীতে।লালন চলে এল বুঝি।গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।মাসুদকে আজ যেতে হবে পাঁচবিবি।সুজন হাজারীর কাছে।ওখান থেকে জয়পুরহাট।লালন সঙ্গে যাবে।মাসুদ বাইরে আসে।আশমানপানে তাকায়।আজ কি বৃষ্টি হবে!গাভীন মেঘ

দেখে যুগপৎ সংশয় ও পুলক জাগে তার।ভারি পোষাক চাপিয়ে প্রস্তুতিও শুরু করে। আর একসময় বেরিয়েও যায়।মোটরযান,পিছনে লালন বসে।পাঁচবিবি যাওয়াটা জয়পুর যাওয়াটা মাসুদের কাছে আর কেবল যাওয়াই থাকে না।উপাদেয় এক ভ্রমণ হয়ে ওঠে।নন্দীগ্রাম বাজার পেরিয়ে মাসুদকে সামান্য থামতে হয়। হঠাৎ চকিত চলে আসা কবিতার লাইন সে টুকে রাখে ডাইরিতে;পাছে হারিয়ে না যায়।মাসুদের মোটরযান এগিয়ে চলে সরু গ্রাম্য পথে।দু’পাশে চিরায়ত নিসর্গ।মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের টুকরোটাকরা।মাসুদের ঠোঁটের ভাঁজে হাসি মাখা।পিছনে বসে থাকা লালন গান ধরে।চটুল সুর।পাগলপারা।বোধহয় মমতাজ।না কি বেবী নাজনিন! এইভাবে একপর্বে মোটরযান ও লালন সমেত মাসুদ ঢুকে পড়ে,তাকে ঢুকে পড়তেই হয় পাঁচবিবি শহরের পেটের ভিতর।বৈদ্যদার বন্ধ দোকানঘরের পাশ দিয়ে ফেরদৌস-এর কম্পুটার সেন্টারের মোড় পেরিয়ে মাসুদ সুজন হাজারীর বাড়ির রাস্তা ধরে।আকাশের মেঘ একচুলও নড়ে না।মেঘ থেকে বৃষ্টিও গড়ায় না।পৃথিবীটা বরং গুমোটের গুমঘরের ভিতর সেঁধিয়ে পড়ে।আকাশের যাবত মেঘকে মাসুদ একপ্রকার

উপেক্ষাই করে।



৩।



‘একটি জলের খনি তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি,চেয়েছিলো

একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!’

(আবুল হাসান)

ফুটফুটে জ্যোৎস্না।চাঁদরাত।মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে এল মাসুদ।আজ সে একা একাই হাঁটলো।অন্যদিন কখনো লালন, কখনো মিঠু,কখনো বা ইমামা সঙ্গী হয় তার।চাঁদের রাত হোক ,আন্ধার রাত হোক এই রাত্রিভ্রমণ মাসুদের আবশ্যিক

যাপনাংশ।শুধু বর্ষা,খুব শীতে বেরোন হয় না।ইমামা বেরোতে দেয় না।মাসুদের যে তীব্র অসুখ আছে।যে বুকের অসুখ বারবার মৃত্যুর খুব কাছে নিয়ে যায় তাকে! চাঁদমাখা শরীর নিয়ে মাসুদ হাঁটতে থাকে।আজ তাকে ভর করেছে আবুল হাসানের কবিতা।অকালপ্রয়াত বরিশালের এই কবি বাড়ি ফিরবার কথা বললেই বলতেন একেবারেই যাবার কথা।আবুল হাসান–এর কবিতা,তাঁর দর্শন,বিষাদ মাসুদের খুব প্রিয়।আরো কিছু প্রিয় কবিদের মতো।কবিতার ভিতর দিয়ে বারবার জীবনেই ফিরতে চায় মাসুদ।টুকরো মেঘের মতো কবিতা জড়িয়ে থাকে।কবিতাই তো আশ্রয় তার। কি এক আকুতি যেন ঘুমঘোরের মতো তাড়িয়ে বেড়ায়।জীবনে তো কিছুই পারে না সে!কিছুই তো করা হল না তেমন।অনন্ত শোক নিয়ে সে বসে থাকে।ব্যর্থতাবোধ নিয়ে সে কেবল হেঁটে যাওয়াটাই পারে।কেউ বোঝে না তাকে।সে কি বাতিল নোটের মতো বাতাসে উড়ে বেড়ানো প্রত্নমানুষ!কিছুই বোঝে না মাসুদ।ভুতগ্রস্থ হয়ে অনন্তের দিকে সে তার যাত্রাবিন্দুটিসহ এগিয়ে যায়।তাকে পীড়িত করে পুরাতন স্মৃতি।ঢাকার উজ্জল কবিতাস্রোতের দিনগুলি।কবিতায় নিবেদিত হবার প্রস্তুতিপর্বের বীজবপন।একমাত্র ইমামাই তার জীবনের টাটকা বাতাস।খোলা জানালা।ইমামা হিলি সীমান্তের মতো উন্মুক্ত তার জীবনে। প্রিয়তম নারী। অনবদ্য বান্ধবী।শান্ত মেয়েটির দু’চোখে খেজুরগাছের নান্দনিক সৌন্দর্য।ইমামার জন্যই তো তার ঢাকা থেকে ফিরে আসা এই কবিতাগ্রাম সোনাপাড়ায়।ইমামা তাকে স্বপ্ন দেখায় আর মাসুদ নির্মাণ করতে থাকে কবিতাগ্রাম সোনাপাড়া।মাসুদকে পথ দেখায় চাঁদআলো।সামনে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে চকিতখরিস,শেয়ালেরা।জ্যোৎস্নায় বাঁশপাতা কাঁপে।শূণ্য চাতালের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মাসুদের মাথায় ভর করে আবারো আবুল হাসান-এর কবিতার পংক্তি,



‘ মা বকুক,বাবা তার বেদনা দেখুক!

অতটুকু চায়নি বালিকা!’



৪।



এক একদিন রাতে মাসুদের ঘুম ভেঙে যায়।অন্ধকার ঘরে সে উঠে বসে।পাশে বাবু।ইমামা।সন্তর্পণে মাসুদ মশারীর বাইরে আসে।দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।নিশুত রাত।উঠোনের পশ্চিম পাকে গোয়ালঘরে গোরুগুলির নড়াচড়া। খসরমসর। লেজ নাড়িয়ে মশা তাড়াবার শব্দ।ঘুমন্ত চরাচরে মিটমিটে আলোর স্ফূরণে রহস্যময়তা জাগে।এই কি জীবন!দিনের পিঠে দিন টপকে যায়। মাসুদের স্মৃতিকাতরতা জাগে। পানির পিপাসা পায়।না পড়া বইগুলির কথা ভাবতে ভাবতে মাসুদ দূরের কাছের সব জনপদ্গুলিকে নিবিড়নৈকট্যে টেনে আনে।তার খুব খালিদ ভাইএর কথা মনে পড়ে। খালিদ থাকে আদিতমারিতে। খালিদ মানেই গল্পের তোড়ে ভেসে আসা আদিতমারির ডোরাকাটা বাঘ।মাসুদ যেন দেখতে পায় ঘোড়াঘাট পরগণার ইতিহাসের ভিতর দৌড়তে থাকা বাদশাহী সেনাসমাবেশ।করতোয়া সেতুতে জড়িয়ে ধরা দোস্তের ম্লান মুখ।সুখের দিনগুলি নূপুরের মতো বাজে।দোস্তরা আসে,চলেও যায়।আসাযাওয়ার ভিতর বারবার জেগে ওঠে মোলান বাজার,তুলসিগঙ্গা নদী,ডুগডুগির হাট।দোস্তকে নিয়ে ঢেকি ও কচুশাক কিনেছিল। ছোট মাছ কিনেছিল।জিলিপি খেতে খেতে গল্পগাছা হয়েছিল। স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত হতে হতে মাসুদ রাত্রিজাগরণের অভ্যেসটাকেই আয়ত্ব করে ফেলতে থাকে। জীবন নিয়ে,একটা আস্ত রক্তমাংসের জীবন নিয়ে কি করে মানুষ! চলে যায়,ভেসে যায় সব।নিয়তিতাড়িত যাতায়াতে আটকে না গিয়ে মাসুদ নিজেকে সংশয়ের দিকে,ঢালে গড়িয়ে দেয়।রাতপাখি ডেকে ওঠে। খোপরার হাঁসমুরগিও। মাসুদকে ডাকতে থাকে জোড়াপুকুর হেলেঞ্চাঝোঁপ কলাবাগান ইলিয়াসের লালদিঘী। মাসুদ বারান্দা থেকে ঘরে ফেরে। আলো জ্বালায়। আলমারি থেকে বের করে পড়তে শুরু করে মাসুদুল হক এর বই-‘আবার কাৎলাহার’। এইভাবে একসময় মাসুদ আর মাসুদ থাকে না। মাসুদার হয়ে ওঠে।



৫।



জীবনমরণ নিয়ে আলোআন্ধার নিয়ে ভাইবেরাদর নিয়ে বিবিবাচ্চা নিয়ে ময়মুরুব্বি আস্ত এক জীবন যাপন করতে হয় মানুষকে।মাসুদ সাইকেল চেপে কখনো বেড়িয়ে পরে।পথে পথে সাইকেল ছোটে।মাসুদ সারাজীবনজুড়ে কি যেন খুঁজে চলে।তার সবকিছুই সে ভরে দেয় সাদা পাতায়;শব্দে,অক্ষরে।তাড়িত এক দুঃখের মত তার এই প্রশ্নোত্তরহীন খুঁজে চলা।মাসুদ কখনো চলে যায় সাঁওতালপাড়ায়।লাল মাটির ধূলো ওড়া পথে।কখনো মহিপুর হয়ে চলে যায় পাখামেলা ব্রিজের কাছে।এতকিছু দিয়ে এতসব নিয়ে আস্ত একটা জীবন নিজেরই মতোন যাপন করতে চায়।ব্যর্থতাবোধের গ্লানি কচুর পাতের পানির মতো তার মধ্যে স্থির হয়ে থাকে। থাকা না থাকার পরিসীমা মুছে গিয়ে মাসুদ তার জীবনযাপনকে হালকাপলকা কোন বাদ্যযন্ত্রের মতো বাজাতে থাকে।আশমানমাটির মধ্যবর্তী শূন্যতায় ফাঁকা মাঠঘাট গাছপালার সারি নদী পুষ্করিণী বাজারহাট বাড়িটাড়ি যেন সাজানোই থাকে।মাসুদ নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে গিয়ে এক ধরণের প্রস্তুতিহীন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়ে পড়ে যেন আর সে তার ভিতরকার সংশয়সংকটজাত অস্বস্তিগুলি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় প্রানপণ।অথচ জীবনমরণঘেরা অসুখবিসুখময় দিনকালের ভিতর নেমে গিয়ে মাসুদ তার অসহায়তাকেই যেন দিবালোকের মতো প্রকট করে তুলতে থাকে।সে দিনকালগুলিকে বহুরৈখিক বহুবর্ণ করে তুলতে চাইলেও শেষাবধি তা আর হয়ে ওঠে না।এই ব্যর্থতায় তার ভিতর পুনশ্চ বিষাদ জেগে ওঠে।ঘনিয়ে ওঠা আকাশময় হাড়িয়া ম্যাঘের মতোন।পাখামেলা ব্রিজ থেকে নেমে সে বিড়বিড় করে আওড়ায়-‘আমার হবে না,আমি বুঝে গেছি,আমি সত্যি মূর্খ,আকাঠ’।এত এত পরাজয় নিয়ে এত গ্লানিময় দৈনন্দিন নিয়ে কিভাবে সার্থক করে তুলবে সে তার জীবনযাপন!



৬।



যাবতীয় স্মৃতিরা ফিরে আসতে থাকে।স্মৃতিকুয়াশার ঝাপসায় মাসুদ কেমন সচকিত হয়ে ওঠে। চর ভিতর ডুবে গিয়ে স্মৃতিকে কুকুরে টানা স্লেজগাড়ি মনে হতে পারে; তবুও মাসুদকে স্মৃতিসমগ্রতাকে মান্যতা দিতেই হয়। মাসুদের মনে পড়ে রাজশাহী শহরের কথা।শহীদ ইকবাল রাজু আতাউর সৈকত আরেফিনের কথা। শহীদ ভাইএর ছোট কি অদ্ভুত সব ছবি আঁকে। মনে পড়ে আবহমানের দোস্তের কথা।রাজশাহী শহর।পদ্মাবাঁধ।পদ্মায় নৌকোভ্রমণ । গানে গানে ভরে ওঠা নদীর পানিতে ঢেউ জাগে।সেই সন্ধ্যেরাত, শীত ফুরোন শহরের রাস্তা, সাহেববাজার, সম্রাট স্বপনের টানারিক্সা। জুবেরি ভবনের সামনের মাঠে একা একা হেঁটে যাওয়া।দিনগুলি স্থিরতর হয়।স্থিরতা থেকে চঞ্চলতা জাগে।কবিতার পর কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকা মাসুদের।জীবন এমন কেন!সাবানের ফেণায় লেগে থাকা বিজ্ঞাপনবুদবুদ।উৎসবকালীন উন্মাদনা সরে গেলে একটানা বিষাদ।জীবন বুঝি কারবালার প্রান্তর।কোথাও বুঝি মেঘ থাকে।মনকেমনের গায়ে বরফকুচির মতো লেগে থাকা মেঘ। মাসুদ সবসময় কেমন যেন সন্ত্রস্ত থাকে। ভয়ভীতি এড়িয়ে কিভাবে সে নিজেকে মেলে ধরবে। আত্মগত হয়ে উঠতে উঠতে তার খুব ঘুম পায়। মাসুদ স্মৃতিময় হয়ে ওঠাটাকে মান্যতা না দিলেও তার স্মৃতিগুলি দিবালোকের স্পষ্টতায় মাথা তুলে দাঁড়ায়। মাসুদের মনে পড়ে পারিবারিক সব সুখস্মৃতির কথা।সেই জয়পুর পাহাড়পুর মহাস্থানের কথা।ইমামাকে নিয়ে সেই সব স্মৃতি।মহাস্থানে গেলেই করতোয়া অতিক্রম করলেই মাসুদের স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।কতবার খোয়াবনামায় ডুবে থেকেছে সে।মজনু শাহ মুন্সি বরকতুল্লাহ সন্নাসীফকির টেলর সাহেব!কতবার মাসুদকে যেতে হয়েছে পোড়াদহ মেলায়। মাসুদ স্মৃতিতে নিমজ্জিত হতে হতে দু’হাতে তুলে আনতে থাকে জনমুনিষ্, কিসানপাট, খিয়ার অঞ্চলের কৃষিকথার আসর। মাটির ঢেলা ভাঙতে ভাঙতে ইতিহাসের ইতিহাস হয়ে উঠতে চাওয়া দেশকালখণ্ডগুলি কখন কিভাবে যেন শিকড় খোঁজে। দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে।এতসব আত্মীকরণ ও প্রকরণের আলিসা থেকে একসময় মাসুদ উড়িয়ে দেয় স্মৃতিমুখর পাখিগুলিকে।



৭।

কবেকার সেই এক বাঘ একা একা চলে এসেছিল বারকান্দি থেকে সোনাপাড়ায়। সে অতিপুরাতন কালের কথা।সেই ডোরাকাটা বাঘের গায়ের বোটকা গন্ধ শুকতে শুকতে ভয়লহরীর মত ত্রাসের মত গ্রামের পর গ্রামে গুজবের বেগে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কবেকার শোনা গল্প। মাসুদ তার আব্বার কাছে শুনেছিল। তার আব্বা শুনেছিল তাঁরও আব্বার কাছে। বাঘটি কিংবদন্তির বাঘে রূপান্তরিত হয়েছিল। বাঘটি ঘনকৃষ্ণরাতগুলিতে যথেচ্ছ বিচরণ করলেও বাঘটিকে দেখা যেত না।

সেই অদৃশ্য বাঘের গল্প মাসুদকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তুমুল। মাসুদ একধরণের সংক্রমণতায় পীড়িত হতে হতে বেড়ে উঠেছিল। যতদূরেই সে যাক, যেভাবেই যাক; সে হিলি যাক দিনাজপুর যাক নীলফামারী যাক সবখানেই যেন তাকে অনুসরণ করত সেই দূরাগত অদৃশ্য বাঘটি। ইমামাকেও সে শুনিয়েছিল সেই বাঘের গল্প। খুব বাল্যকালে নানাবাড়ি যাবার পথে শীতরাতে গরুর গাড়ির দুলুনির ভিতর কেমন ঘোর লেগে যেত। আম্মার কোলের কাছে ঘেঁষে যেতে যেতে গাড়ির ধোঁয়ায় দুলতে থাকা লন্ঠনপ্রীতি জাগলেও সে কিন্তু চঞ্চলতা থেকে সরে আসতে পারতো না। তাকে অতিকায় সেই বাঘের গায়ের বোটকা গন্ধ আবিষ্ট করে তুলতো। খুব ঘুম পেত তখন মাসুদের। বারকান্দির সেই বাঘ; দেশকাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার চলাচল মাসুদ কে সুদুরবর্তী করে দিতে চাইলেও মাসুদ কিন্তু তার মজ্জাগত একাগ্রতায় প্রতিরোধপ্রবণতা নিয়ে কালখণ্ডটাকে বর্তমানেই এনে ফেলতে চায়।এ তার স্বত্বালগ্ন স্বভাবজতা; যা দিয়ে অদৃশ্য সেই বাঘের মিথটিকে ব্যবহার করা যায়। মিথের জালক ভেঙে বারবার কুহককুয়াশাই হয়তো উড়ে আসে। মাসুদ তার অবসাদ নিয়ে বিষাদ নিয়ে চিরনুতন সব জীবনবৃওান্ত বলে যেতে থাকে। বলেই যায়। ভাঙা গলায় স্বরক্ষেপনের ওঠানামায় সে কি তবে অনবদ্য এক জাদুকর হয়ে উঠবে! মাসুদ তার জীবন নিয়ে বারবার তো জীবনযাপনের ছন্দেই ফিরতে চেয়েছিল! মাসুদ কি তার পরাজয়ের পাশে আবারো ডেকে নেবে আব্বার মুখে শোনা বারকান্দির সেই অদৃশ্য বাঘটিকেই।



৮।



আজকাল মাসুদ খুব একাকীত্ব টের পায়। তার ভিতরকার অস্থিরতায় উত্যক্ত হতে হতে সে গাছপালার ছায়ায় ছায়ায় কলাবাগানের ভিতর ময়মুরুব্বির কবরের দিকে নেমে যায়। শ্যাওলাসবুজ কচুপাতার মাথাল মাথায় কখনো হেঁটে যায় বৃষ্টির দুপুরে। তার সঙ্গে লালন থাকে। পোষা কুকুর ভুলুয়া থাকে। কবিতায় কবিতায় ভ্রমণসঙ্গীত লিখতে চায় সে। একাকীত্ব নিয়ে একাকীত্বকে বহন করতে করতে মাসুদ এক একদিন সোনাপাড়ার বৃষ্টি দেখে। বৃষ্টি পান করে। তার হাঁচিকাশি হয়। হাঁচিকাশির পৃথিবীতে নির্জন হতে হতে নির্জনতার কাঁথা জড়িয়ে মাসুদ তার মৃত্যুচেতনার খুব নিকটেই চলে যায়। একাকীত্ব নিয়েই মাসুদ লিখতে থাকে হাটের কবিতা। কখনো ইমামাকে পিছে বেঁধে সে উড়েই চলে হিলির দিকে। মহামান্য এক জীবনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এই যে অপেক্ষাগুলি,যা অপেক্ষারত আসবার; পৌঁছবার তৈরি করে দিতে থাকে। বইপত্র আসে। শব্দের পর শব্দে সেজে ওঠে ভাষাপালকি। একাকীত্ব দিয়েই মাসুদ টের পায় কিভাবে রচিত হয়ে চলেছে পালকিযাত্রার উপাখ্যান। তার খুব খালিদের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। ইমামাকে বলেও ফেলে খালিদ ভাইএর আম্মার হাতের বিচিত্র পিঠেপুলি, তেলকই-এর কথা। খালিদ আর সে যেন ঘুরে বেড়াতে থাকে রংপুর লালমণি কুড়িগ্রাম আদিতমারি তিস্তা ঘাঘট স্বর্ণামতীর মায়াবী চালচিত্রের ভিতর। যেমন, ঢাকা যেতে যেতে যমুনা সেতু থেকে সে দেখে ফেলেছিল শীতের বিস্তারিত চরাঞ্চল, তরমুজখেত, চরুয়াদের ঘরবসতি। একাকীত্বভরা জীবন আছে বলেই মাসুদ জীবনটাকে জীবনযাপনের অন্তর্ভুক্ত করতেই চায় যেন অন্ধকারের দেশগাঁয়ে জোনাকিআলোর স্তরবিভক্তির ম্যাজিকছায়া। মৃত্যুশাসিত পল অনুপল জুড়ে দীর্ঘ তাঁতের শাড়ির বিস্তারিতে মাসুদ তার কবিতাকে তার হাটবাজারকে স্থাপিত করতে চায়। ফের আসবার সম্ভাবনাকে জিইয়ে রেখে তার একাকীত্ব দূরে সরে যায়। আর মাসুদ হেঁটে চলে ইদ্গাহ ময়দানের পাশ দিয়ে গন্তব্যহীন গন্তব্যে।



৯।



কোথাও কি যাবার থাকে মানুষের! গাছপালার ভিতর রৌদ্রপ্লাবিত দিগদিগরে নদীর কূলে কূলে বাতাসের প্রবহমানতায় কিছু কি অনুভব করা যায়। মানুষ তার জীবনের ভিতর প্রাত্যহিকতায় দিনকালের রূপান্তরিত হয়ে পড়বার ধারাবাহিকতায় কেমন বিমোহিত হয়। মাসুদ তার অসুখশয্যা থেকে বারবার ফিরে আসে।এই ফিরে আসার ভিতর সে তার বেঁচে থাকাটাকে ভীষণ টের পায়। শীতের রোদ তাকে ইশারায় ডাকলে সে রোদে পিঠ দিয়ে বসে পড়ে। এ যেন ভীষণ পুনরুত্থান। আশ্চর্য এই ফিরে আসার ভিতর দিয়ে মাসুদ আবহমানের এক জীবনযাপনকে মেঘনদীভাসানগানের সারিজারিভাটিয়ালির গানে গানে যেন বড় গাঙে দুলে দুলে এগিয়ে চলা কোষাডিঙিনৌকো; যার ভিতর বাদ্য বাজে নাচ হয়, নাচবাদ্যের পৃথিবীতে যেন নেমে আসেন হাসন রাজা। মাসুদের মনে পড়ে কুষ্ঠিয়ার কথা। কুমারখালির লালনের মাজারের কথা। কবি তানজিন তামান্নার কবিতার কথা। মানুষের যাওয়াআসা দিয়ে হাঁটাচলা দিয়ে আস্ত এক জনপদের যাপনকেই বুঝি এঁকে ফেলা যায়। বারবার থিতু হতে চেয়েও পারে না মাসুদ।তার মনে হয় কবিজীবন আদতে অভিশাপের জীবন।তার মনে হয়, সে যেন কাঁধে পাখি নিয়ে হেঁটেই চলেছে। কোথাও যাবার থাকে না, গন্তব্যহীনতার সুত্র খুঁজতে গিয়ে মাসুদ সামান্য হোঁচট খায়। সে বাল্যকাল থেকে নানাবাড়ি থেকে সোনাপাড়ার মাঠঘাট থেকে পুকুরের খুব গহীনে ডুব দিয়ে মহার্ঘ সব চিরাগবাতিই যেন তুলে নিয়ে আসে। খুঁজতে খুঁজতে তাকে হাতে তুলে নিতে হয় ইলিয়াসের ‘দোজখের ওম’, আবুল কালামের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ কিংবা জাকির তালুকদারের ‘কুরসিনামা’। কোথাও যাবার থাকে না মানুষের। কেবল ঘুরে ঘুরে আসে মহরমের তাজিয়া। হায় হাসান হায় হোসেনের আহাজারি। মাসুদ কোথাও যেতে চায়। হাড়হিম শীতসন্ধ্যের দিকে তার চোখ মেদুর হয়ে ওঠে। সে তার জীবনযাপনের অন্তহীনতায় মাঘনিশীথের কোকিলের মতো দিগভ্রান্ত হতে হতে খড়ের চালাঘর দিয়ে সাজানো গ্রাম্যদৃশ্যের নিস্তরঙ্গতায় আত্মগোপনই করে ফেলে। অনেকানেক নদীর পানির ছলাৎছলে যেন

ভাসিয়ে দেয়া কলাপাতার নৌকো। কোথাও যাবার থাকে না মানুষের এটা যেমন ঠিক তেমনি ফ্রেমের বাইরে আসা জীবনের পরতে পরতে কিভাবে হেঁটে যেতে থাকে দূর চরাঞ্চলের চরুয়া সব মানুষেরা।




১০।




কত কথাই তো বলতে হয় মাসুদকে।কথা বলতে বলতে সে বুঝি এক কথোয়ালই হয়ে ওঠে। কথার রকমফেরে বাঁকবদলে পালটে পালটে যাওয়া সবকিছু। মাসুদের মনে পড়ে সোনালি আপার কথা। সোনালি বেগম। দূরদেশের হাওয়ায় বুঝি ভেসে যায় সোনালি আপার কবিতা। হাণ্টিং ট্রিপ। কথা বলবার প্রস্তুতি না থাকলেও কথারা অন্তর্জগত থেকে হাউই-এর মত উড়ে আসে। মাসুদের খুব স্বজনসুজনদের কথা মনে পড়ে। কথার পিঠে কথা সাজালেও কথার কোন ভাষ্যপাঠ হয় না জেনেও গম্ভীর মেঘের সঞ্চরণশীলতায় সে কেবল পীড়িত হয়ে ওঠে। আত্মরক্ষা করতে চায়। জীবনের সকল অবসন্নতায় গ্লানিময়তায় তীব্র আকুলতায় মাসুদ তার জীবনের অস্তিত্বকে অস্তিত্বহীনতার প্রশ্নোত্তরপর্বের ঢালে আলগোছে টেনে নিয়ে আসে। মহামহিম এক জীবনকে ইতিহাসেরও ইতিহাস হয়ে ওঠার বাস্তবতাটাকেই সামনে এনে ফেললে মাসুদের আর কিছুই করবার থাকে না। সে কেবল তার কবিসত্তায় বহুকালের তীব্র সেই তাগিদ আর আলোড়নটুকু টের পায়; যা ধ্বনিময় সোনাটার মতো গমগম করে ওঠে।



১১।



মাসুদ তার জীবনের ভিতরকার সকল সংশয় সংকট নিয়ে তার কবিতা তার সৃষ্টিকর্ম বইপত্তর যাপন নিয়েই তিরতির কাঁপতে থাকা নদীপুস্করিণীর পানির স্বচ্ছতায় আশ্চর্যময় এক জীবনকেই যেন দেখতে পায়! সে তার স্মৃতিস্বত্বায় নবীকৃত খণ্ডবিখন্ডকে জড়ো করতে করতে রোদমেঘবৃষ্টির দিনগুলির ভিতর বিমর্ষতার ফ্রেমে যেন আটকেই দিতে থাকে সব। তার ব্যাকুলতা কি সে নিজে টের পায়! না কি আকুল হয়ে খুঁজতে শুরু করে জীবনের হর্ষউল্লাসবেদনার ধারাবাহিক নিমগ্নতাকে। জীবনের দিকে নিক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলিকে ফিরিয়ে আনবার আপ্রাণ প্রয়াসটুকুন জারি রেখেও মাসুদ আলোআন্ধারময় এক নতুন রূপকথাই বুঝি লিখে ফেলে।নতুন কবিতার দিকে এ এক নতুন জার্নি। মাসুদ দুপুরের রৌদ্রে এসে দাঁড়ায়। পুরনো সব চিঠির স্তূপে মুখ গুঁজে বসে পড়ে।কতো কতো চিঠি। মূহুর্ত। জীবনের গল্পগুলি ধারাবর্ষণের মতো ঝরে পড়তে থাকে।উঠোনের হাঁসগুলি পাকঘর গোহালিয়া মহিষধোয়া পুকুর জুম্মাঘর ফুফুনানীর হেঁটে যাওয়া ; অন্তহীন অন্তহীনতায় এগোতে থাকলেও মাসুদ দু’চোখে যেন গভীরতা তৈরি করে ফেলে। তার প্রিয় পাখিগুলি তাকে ঘিরে ধরে। তার চোখে আম্মার বহুবর্ণ শাড়ির প্রান্ত দুলে ওঠে। লালন মিঠু মেহেদি উঠোনের দিকে ছায়ার পাখির মতো এগোয়। ইমামার হাসির মৃদুশব্দে পরিবেশে প্রবীণত্ব এসে পড়ে। মাসুদ তার জীবনকে নতুনভাবে সজ্জিত করবার প্রয়াসে উঠে বসে। তার ভিতর থেকে কবরখানার হাহাকারমাখা বাতাসের মতো শীতল শ্বাস বেরিয়ে এলে জীবনের সদ্যরচিত সংজ্ঞাটিকে মাসুদের মতো করে মাসুদ অনুমোদন করে। এইভাবে তার কবিস্বত্বা সংশয় সংকট অতিক্রমণ করতে থাকে।




১২।



আলোঅন্ধকারের ভিতর বসে থাকতে থাকতে মাসুদ একসময় বিনধারা সরাইলের দিকে চলে যাবার কথা ভাবে। তার ভাবনারা স্থির থাকতে পারে না। তখন মাসুদকে তো আর অগ্রপশ্চাৎ ভাবলে চলে না; তাকে ভরতপাখির মতো নিশিবকের মতো চঞ্চল হতে হয়। একপর্বে সে পাঁচগাছির দিকে চলে যাবার কথা ভাবে। এত কিছুর রকমফেরে দিকভ্রান্তির ভিড়ে মাসুদকে সমাগত দুঃখরাশির ওপর খরবায়ুবেগে ছুটেই আসতে হয়। সে তার অসুখবিসুখ ভুলতে পারে না। বড় অসুখের পর, অসুখমুক্তির পর তাকে সিলেট যাবার কথা ভাবতে হয়। রংপুর বেতার থেকে প্রচারিত তার গানের সুরে কথায় কান পাততে হয়। সে সকল প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিকে সবলে আঁকড়ে ধরতে চায়। শালিকের নরম হলুদ পা, বকের শুভ্রতায় মৃত্যুময় এক জীবনের হাওড়ে কি তবে ডুবে মরতে হবে তাকে! না কি মৎসশিকারী পানকৌড়ির উচ্ছাসের অনুবাদকর্মে নিজেকে নিয়োজিত করবার প্রাণান্তকর প্রয়াসে ঘনায়মান দিনের অবসাদক্ষণ তার জন্য বিশেষ কিছু একটা হয়ে ওঠে। এইরকমভাবে মাসুদ তার পরিক্রমণটাকে পরিভ্রমণের সাথে যুক্ত করে দিলে ফকিরের আলখাল্লা নিমকাঠের এস্রাজ মুশকিল আসানের লম্ফ হয়ে কেমনধারা মুক্তির স্বাদ বয়ে আনে। মাসুদের চোখে আজন্মের বিষাদ লেপ্টে থাকে। প্রশ্নে প্রশ্নে নিজেকে বিক্ষত করেও সে আর্তি ও বিপন্নতা থেকে কিছুতেই রেহাই পায় না। জীবন বুঝি তাকে আর অবসরই দেবে না! স্বপ্নে স্বপ্নে উড়ালপঙ্খির উড়ে চলাটাকে ভীষণরকম বালির গর্তের ঘূর্ণীতে আটকে গিয়েও সরলবক্ররেখাময় পথঘাটকে টেনে নিতে থাকে বাওড়ের হা হা শূণ্যতায়। মাসুদ তার কবিস্বত্বায় কিংবা কবিস্বত্বাটিকে দার্শনিকতায় জড়িয়ে ফেললে তার নান্দনিক বোধের বিচ্ছুরণে ভাঙা ভাঙা বাক্যের ফাঁকে গুঁজে দেওয়া শব্দরাশির মতো ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া নিয়েই আজন্মের স্বপ্নবৃত্তান্ত দিয়েই যেন ধাঁধাগোলকে ঘুরতে থাকে। মাসুদ নিজের সবকিছু দিয়ে সংশয়ী হয়ে পড়লে তার কপালের ভাঁজগুলি গভীর হয়ে উঠলে সে চিরদিনের সব চিরদিনগুলিকেই শ্বাসপ্রস্বাস দিয়ে নিজের ভিতর টেনে আনতে থাকলে হাজার পাখি, মাসুদের প্রিয় পাখিরা উড়ে যায় প্রান্ত ও প্রান্তিকের দিকে।



১৩।



ধানের দেশ। খালের দেশ। ফড়িং ওড়ে। ফুলের গুচ্ছে গুচ্ছ ভ্রমর। কত বৃক্ষ। কত পাখি। দেশ আদতে কি? দেশতো একটা বাড়ি। নদীজলবাহিত কোন আখ্যানের ভিতর চুপ করে বসে থাকা। গভীর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেরা ঝাঁপায়। সোনার রোদে ভেসে যাওয়া চরাচর। আর্ট গ্যালারীর প্রেক্ষিতটা থাকলে দেশ যেন দেশকালের রূপ ধরে ফিরে ফিরে আসে। নিকরদীঘি থেকে নিয়ে আসা ধলা মুরগিটার একা একা দাঁড়িয়ে থাকবার দৃশ্য বিষ্মরণ নিয়ে আসে। অথচ আকাশের নীল ছড়ানোটাকে মায়াময় মনে করলেও সোনাপাড়া কখন যেন পুরাকল্প বয়ে আনে প্রত্নপৃথিবীর সব রঙ রস গন্ধ মুছে ফেলে। তখন গ্রাম্য পথে কবিরাজী ঔষধবিক্রেতা যায়। মুর্শিদী গানের দল ঘোরে। মিসকিনেরা আসে। হাজিসাহেবের অস্তিত্ব অনস্তিত্বকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে হাজিসাহেবের খড়মের শব্দকম্পনটুকু। শিকারফেরত সাঁওতালপুরুষ তার পেশীময় শরীর নিয়ে গর্বিত হয়ে পড়ে। কৃষিবউ ধান ঝাড়ে। কুলোর বাতাস দিয়ে ঘনায়মান সন্ধ্যেটুকুন যেন সাজিয়ে রাখা হয়। কবেকার, কতকালের সুখটুকুন ধানের বুকে জমে ওঠা দুধের আহ্লাদে চিরদিনের ধানের দেশের মায়াময়তায় হামলে পড়ে। শীতশুরুর দিনগুলি থেকে রওনা হয় কুয়াশারা। হিমে শিশিরে কার্তিকের মাঠ ভিজে গেলে করুণ গানের মতো কোন বৃষ্টিদিন এসে পাখিদের পালক খসে পড়া উঠোনের কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। রাত্রির রহস্যে শেয়ালের ডাক নতুন বাছুরের ক্ষুরের সচলতাকে উস্কে দিতে চেয়েও কিন্তু জিনপরিদের নিজস্ব দিনদুনিয়ায় ভুলক্রমে এসে পড়া চিরকালিন সব মানুষের জমায়েত যেন হাওড়ের ডাক শুনতে পায়। এইভাবে ত্রাস জাগে। পরিত্রানহীন ত্রাস এসে তছনছ করে দেয় সবকিছু। নৈশভ্রমণকালে বেশ দেখে ফেলা যায় নৈশ বাদুড়। পেঁচার চোখের ধাতবতা। তক্ষকের শিস। করতোয়ার রেলপুল পেরোতে থাকে রাতের মেল। অনেক অনেক যাপন পেরিয়ে ধানের দেশে বেঁচে থাকতে থাকতে বেঁচে থাকাটা আদতে একধরনের অভ্যেস হয়ে যায়। উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকাটাই তখন মুখ্য। বেঁচে থাকবার ভিতর আরো আরো বেঁচে থাকা। খালের দিকে নদীর দিকে খেতের দিকে তখন কেবলই যেন বেঁচে থাকবার আকুলতার তীব্রতা।



১৪।



পাখি এসে ফিরে যায়,ভিজে উঠোনে। এক একদিন খুব উড়তে ইচ্ছে করে মাসুদের। তার খুব আলোয় থাকতে,ভালোয় থাকতে ইচ্ছে করে। সে তার কবিজীবনকে পাখিশাবকের মতো লালন করে চলে। সে কি চূড়ান্ত কোন প্রস্তুতি নিয়েই সাদামাটা এক জীবনের চালচিত্র বুনতে বুনতে চলে যাবে নদীপার্শ্বের জনপদগুলিতে! সে কি ঢেঁকিছাটা চালের ভাত খেতে খেতে অশ্রুসজল করে তুলবে নিজেকে!কবিতার শব্দে শব্দে তার যাবত দার্শনিক সঙ্গ অনুষঙ্গ দিয়ে সে চিরদিনের গানগুলি নাচগুলি দিয়ে ভরিয়ে তুলবে তার খোলান। ফসলের মাঠে মাঠে তার অন্তহীন হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য অতিকায়ত্বাকারে মূর্ত হয়ে উঠলেও সে কিন্তু একধরণের বিমূর্ততাই এনে ফেলতে চায় তার বোধের মহাজগতে। যেখানে মরণবাঁচন নিয়ে সমযোগে বেঁচে থাকাটাকে উদযাপিত করা হয় চিৎকারসমগ্রের অসামান্য কোরাসে। দর্শনকে ভেঙে ভেঙে অর্থ পালটে দিয়ে দর্শনের ভিন্নমাত্রায় বুঝি দার্শনিক তত্ত্বজট ছাড়াতে থাকে। তার চোখের তারা চকচক করে ওঠে। শীতবর্ষা অতিক্রম করতে করতে বেঁচে থাকবার বৃও কি সম্পূর্ণ করা যায়! আসলে মানুষের মৃত্যু নেই। মরণবীজ ফেটে শিমুলতুলোর মতো নতুন নতুন জন্ম এসে ধাক্কা মারে। তখন ইতিহাসটাকে পরিসর দিতে হয়। শূন্যতাকে মান্যতা দিতে হয়। ভূতগ্রস্থের মতো বসে থাকা আর হয় না মাসুদের। সে বেরিয়ে পরে। গাছপালার ছায়ায় মায়ায় জড়িয়ে যেতে যেতে মাসুদ কি কোন মহাশুণ্যতাকে নিবিড়ভাবে টেনে আনতে থাকে পটভুমির ভিতর! সে আশ্চর্য পুলক বোধ করে। পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে থাকে আকাশভরা আলো। আলোয় ভাসতে ভাসতে জীবনযাপনের কোন সংজ্ঞাকে সে সংজ্ঞায়িত করতে চায় তা বোঝা না গেলেও সে তার একাগ্রতা দিয়ে প্লাবনকাল বহন করে। জানা অজানা দিয়ে সে খুঁজতে থাকে তার অস্তিত্ব,মানুষের বেঁচে থাকবার উদ্দেশ্যটিকেই। ভ্রমভ্রান্তির ভিতর কেমন ধন্ধ ঘনিয়ে আসে। আশ্চর্য এক শীত বোধ করতে থাকে মাসুদ ঘনায়মান দিনকালগুলির ভিতর।



১৫।



‘অসম্ভব কিছু ঘটছে,যার চারদিকে বসে

আমরা দেখছি বিড়ালনৃত্য,প্রেতের মস্করা’

(ওবায়েদ আকাশ)





মাসুদ ঘরে ফেরে। কবিতা লেখার কথা ভাবে। কবিতা পড়ার কথা ভাবে। মাথায় ঘুণপোকা নিয়ে সে একা একাই হাসে। তার হাসির ভিতর অনুপ্রবিষ্ট হয় ক্ষয় ও বিষাদ। জীবনের গূঢ় কোন বেদনাবোধকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও বেদনার বোধ

আর যায় না। জীবনের অর্থহীনতার ভারে সে কিঞ্চিত ক্লান্তি বোধ করে। ক্লান্তি কাটাতে হাই তুলতে হয়। লালন এসে, মিঠু ভাই এসে মাঠঘাটের কথা শোনায়। পরিপার্শ্ব নিয়ে গড়ে ওঠা দেশগাঁয়ের গল্প শোনায়। ক্লান্তিবোধ কাটাতে চাইলেও পরিপার্শ্বের সংকটগুলি মাথার কোষে ঘাই মারতে থাকে। সে ইমামাকে ডেকে আনে। ইমামার চোখের স্নিগ্ধতা পান করে। বাইরের নিসর্গে সব কিছুর অবস্থিতি। বৃক্ষ গাইবলদ হাঁসমোরগ দৈনন্দিন হয়ে পরম্পরাগত হয়েই জাগরুক থাকে এই সারসত্যের ভিতর মাসুদ তার জীবন ও যাপনকে কবিতার স্রোতে মিশিয়ে দেয়। তার ক্রোধ তার হর্ষ তাকে সীমা পরিসীমার একটা বোধে আত্মস্থ করে তোলে। এইভাবে আত্মগত হওয়াটাকে সে বেশ উপভোগ্য করে তুলতে চাইলেও তার চূড়ান্ত

কোন মুক্তি মেলে না। সে তার দর্শনবোধের পৃথিবীতে ডুবুরির দক্ষতায় সঞ্চরণশীল থাকলেও ঘুমের আর্তি নিয়ে বারবার তার বিপন্ন হয়ে পড়া। সে তার ব্যর্থতাবোধের কথা কখনো বিস্মৃত হয় না। কিছু হতে চাইলেও আদতে কি আর কিছু হওয়া হয়ে ওঠে! এইসকল দার্শনিক প্রশ্নের তোড়ে মাসুদ ভেসে যায়, ভেসে যেতে থাকে। সে বিস্মরণ থেকে ফিরেও আসে। জীবন থেকে সরে থাকা আর হয় না। অসুখবিসুখ সমেত গোরআজাবসমেত সে বরাবরই ঢুকে পড়ে আস্ত গোটা এক জীবনের জায়মানতায়। যেখানে প্রিয় পাখিরা তাকে সঙ্গ দেয়। পুকুরের হাঁসেরা তাকে নিঃসঙ্গ করে দিলেও মাসুদ সমগ্র স্বত্বা দিয়ে কেন যেন বুঝিবা জীবনেই ফিরতে থাকে।



১৬।


আবার মেঘ জমছে আকাশে। আবার মেঘ ডাকছে আকাশে। মেঘনদীপানিবাতাসের বেষ্টনে আটকে গিয়েও তীব্র প্রতিরোধ দিয়ে মাসুদ,মানে মাসুদার তাকে প্রতিহত করে। তার বেদনাবোধ জাগে। সে বাহিরউঠোনে এসে দাঁড়ায়। সদ্য জাগা পৃথিবীতে ভোরের স্নিগ্ধতায় মাসুদ জীবনকে, জীবনযাপনকে নতুনভাবে ফিরে দেখতে থাকে। মৃত্যুময়তার বোধ যা আঁঠার মতো আটকে থাকে তার সঙ্গে সে কি তা থেকে মুক্ত হতে পারবে! সকল অসুখ ডিঙিয়ে জীবনের বহমানতায় প্লুত হয়ে উঠবে এবার! মানুষ বেঁচেবর্তে থাকে ,মানুষকে বেঁচেবর্তে থাকতে হয়; প্রজন্মতাড়িত জনমানুষের চিরকালীনতায় মানুষ বারবার জীবনকে চিরজীবিত করে তুলতে থাকে। মাসুদ কি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়! না কি জীবনের ভরকেন্দ্রে শেষ পর্যন্ত জীবনমরণমায়া উন্মোচনের চিরদিনের এক খেলায় পর্যবসিত করে দিয়ে তাকে চলে যেতে হয় আবারো মাঠের শূন্যতায়! ফসলহীন রিক্ত মাঠে হেঁটে যেতে যেতে সে ভরা ফসলের আসন্ন সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। জীবন তার কাছে তখন অনন্তের এক গান। সম্ভাবনার অঢেল প্রাচুর্যে মোহমায়ায় মাসুদ নিজের সমগ্র স্বত্বাকে বিনির্মিত করে তুলতে থাকে। চোখের মণিতে বিস্ময় মাখিয়ে সে দেখে বকের ডানার ছন্দময়তা, ভরত পাখির ঝাঁকের উড়ে চলা। জীবন তো দিকভ্রান্তি দিয়ে ভরা কোন দানাফসলের দেশ যার আবশ্যিক অংশ হয়ে জেগে থাকে স্বপ্নের মতো, ছায়াছবির মতো এক সোনাপাড়া। মাসুদ জীবনেই ফেরে। মেঘলা আকাশের নিচে অগণন নদীনালার খালবিলের পাখপাখালির এক দেশে সে ঘুরে বেড়াতে থাকে অন্তহীন জীবনের খোঁজে। শাপলাশালুকের খোঁজে। শিউলিবকুলের গন্ধে সে ভরিয়ে তোলে নিজেকে। সোনাপাড়ায় আলো জ্বলে নিশিরাতে। সোনাপাড়া জেগে থাকে। জেগে থাকাটা নিয়তি। বেঁচে থাকতে থাকতে মাসুদ একসময় বেঁচে থাকাটাকেই চিরকালীন করে তোলে। তার দিকে তখন এগিয়ে যায় লালন ভাই,বংশীধ্বনি ও সোনাপাড়ার হাঁস।