শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

গান নিয়ে কথা – কল্পনা দাস

গানের কথায় ডুবে আছি
কল্পনা দাস

১)

প্রযুক্তির এই ভারসাম্যহীন আস্ফালনে শেকড় হারিয়েছে মানুষ, হারিয়েছে মাটি! যে মাটি চুয়ে চুয়ে ছন্দ ওঠে, ওঠে সুর। মানুষের প্রতিদিনকার ক্রিয়া কর্মের আনন্দ- বেদনা , উচ্ছ্বাস প্রতিফলিত হয় যে সব গানে তাহাই লোক সঙ্গীত , তাহাই জীবনের গান, তাহাই মাটির গান। সঙ্গীত বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । কথাই সব নয়- বাক্য যা প্রকাশ করতে পারেনা , গান তা প্রকাশ করে।
লোক সংগীতের সম্ভার নিয়ে চলেছে ‘দোহার’ গানের দল। আমার খুব প্রিয় দোহার, A Group Of Folk Musician, দোহারের গাওয়া খুব জনপ্রিয় গান “রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা’’, অনবদ্য ! এগানের সুর ও বানী মানুষের মনে সহজে মিশে যায় – “ ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলেম আর পেলেম না’’... রাজীবের (রাজীব দাস) গলায় মুগ্ধ হয়ে শুনেছি।

বহু প্রচলিত লোক সংগীত আছে। সব উল্লেখ করতে পারবনা, তবু কিছু গান আছে তার যে স্বাদ পাই, তা থেকে আবেগ অনুভুতি, মুগ্ধতা প্রকাশ পায়, গানে গানে বলাই বাহুল্য । ভীষণ ভাবেই অনুভুতি প্রবন গান গেয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পী অনুশেষ অনাদীল -- “ আমার ঘরে বসত করে কয়জনা, মন জান না’’,বাস্তবিকই আপন হৃদয়ে /ঘরে যে বাস করে তাঁকে একবারও দেখলাম না, জানলামনা। “ এক জন ছবি আঁকে একমনে ও মন, বসে বসে রং মাখে ও মন , ও আবার সে ছবি খান নষ্ট করে কোন জনা, কোন জনা’’---অনুশেষের এই আবেগ প্রবণ গান কি অসম্ভব ভালবাসার কথা বলে।

জীবন চেতনার প্রেরণা যে সব গানে সেগুলর মধ্যে ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’, আবার ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়’। মানুষের মনে ভীষণ ভাবে নাড়া দেয় । মনে আলোড়ন তোলে ।এই সব গানে আমার নিজের মনে হয় স্বপন বসুর গায়কি বুঝতে শেখায় মানুষের জীবনের মূল্যবোধ । আমাদের মনোলোকে স্থায়ী ভাবে বাসা বেঁধেছে , এই সব গান । এগানের কথা সুর তত্ত্ব ও দর্শন মানুষের মনকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে যায় ।

মনে পড়ে যায় শচিনদেব বর্মণকে, সাচিন কর্তার প্রতি আমরা চির কৃতজ্ঞ , -----‘আমি টাগ ডুম টাগ ডুম, বাজাই বাংলাদেশের ঢোল, সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা বাংলা মায়ের বোল ......’ সোঁদা মাতির গন্ধে ভরা এমন গান শুনে কখনও মনে হয় না যে, আজকের প্রজন্মকে গভীর ভাবে নাড়া দিচ্ছে? মনে দাগ কাটে গানের এই কথা গুলো -------“ বাংলা জনম দিলা আমারে/ তোমার পরাণ আমার পরাণ এক নাড়ীতে বাঁধা রে” । জন্মভুমির টান সে যে নাড়ীর টান, শিকড়ের টান । আত্মীয় মানুষের টান , নবীন প্রজন্মকে আষটেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে ।


২)

আমার ভাল লাগা গানের একটা উল্লেখ করব ‘জলের উপর পানি, না পানির উপর জল/ বল খোদা বল খোদা বল’, ‘জমিন তলায় আসমান ওপর / নাকি আসমান জমিন সব বরাবর ...’ এই গান শুনেছি , অসম্ভব ভাল লাগা গান,কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য ও সম্পরদায়(দোহার) গাইলেন ‘মনের মানুষ’ - চলচ্চিত্রে । আবার দোহারের কথাই উল্লেখ করলাম।

বার বার রবীঠাকুরকেই স্মরণ করি। বাঙ্গালীর মন প্রাণ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ । প্রানের মানুষ রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন এক আলোকিত পরিবারে, যেখানে ছিল বিত্ত, বিদ্যা, সংস্কৃতি,শহুরে আভিজাত্য। লোক সংগীত/ বাউল গানের সুর ও বাণী,তত্ত্ব ও দর্শন কবিকে গভীর ভাবে স্পর্শ করে। বাউল গানের কাছে তাঁর যে শিল্প-ঋণ সে কথা তিনি স্বীকার করেছেন স্বয়ং । রবীন্দ্রনাথ লালন এবং গগন দু জন মরমি- সাধকের গানে প্রাণিত । আপন দেহ ঘরে যে পরম পুরুষের বাস, তাঁকে না চিনলে সাধন সিদ্ধি হয়না। লালন তাই বলেছেন- ‘আমার এই ঘর খানায় কে বিরাজ করে, তাঁরে জনম ভর একদিন দেখলাম নারে’ .........সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি / বাহির পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয় পানে চাইনি’ । এই গানখানি অসাধারন লেগেছে শুনতে শ্রাবণী সেনের সুরেলা কণ্ঠে্‌, অসাধারন তার গানের গলা ! গগনের ‘কোথায় পাব তারে’ গানটি রবীন্দ্র বাউল কে নাড়া দিয়েছিল। এই গানটির প্রেরণায় কবি রচনা করেন, স্বদেশি যুগের গান যা এখন প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ‘বাংলাদেশের’ জাতীয় সংগীত , ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’।

লোকগানের অন্তরে রয়েছে উদার মানবিকতা বোধ , সম্প্রদায় সম্প্রীতির চেতনা, রয়েছে মানুষের জীবনের মুল্য বোধ যা মানুষকে সচেতন করে তোলে , রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছেন বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের যে সাধনা—‘তাতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সাধনা, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে জেগেছে গান,এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানের কণ্ঠ্য মিলেছে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়’ ------II