শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

ধারাবাহিক উপন্যাস - অলোকপর্ণা

চান্দের চর
(১৩ কিস্তি )
অলোকপর্ণা



সাব ইন্সপেক্টর ডঃ ঘোষের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়, “আপনি শিয়োর স্যর?”

“আমার ছেলেকে আমি চিনবো না!”

তীর্থঙ্করকে আসতে দেখে শিঁটিয়ে আসেন ডঃ ঘোষ।

“কোথায় সে?”

পুলিশ পিকুর দিকে আঙুল দেখায়।

“এটা পিকু!?” তীর্থঙ্কর কাচের গায়ে ঝুঁকে এসে দেখতে থাকে।

“কি মনে হয় চ্যাটার্জী? এটা পিকু হতে পারে?” ডঃ ঘোষ তীর্থঙ্করকে দ্বিধান্বিত করে খানিক দায় ঝেড়ে ফেলতে চান। তীর্থঙ্করও বোঝে এই সেই লোক যার সাথে পিকুর চেহারার মিল থাকায় এডিটর ভুল করেছিলেন। ডঃ ঘোষ চুপ করে থাকেন।

“এই বলেছে যে তার নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ঘোষ?!” তীর্থঙ্কর জানতে চান।

পুলিশ সম্মতি জানায়।

“হতেই পারে না!”

তীর্থঙ্করের কথায় চূড়ান্ত আশ্বস্ত হন ডঃ ঘোষ। “চ্যাটার্জী... আজকালকার লোকেরা টাকার লোভে কিই না করতে পারে!”

তীর্থঙ্কর নিরাশ হয়।

“আমি আসি বুঝলে... অনেক কাজ পড়ে আছে” ডঃ ঘোষ আর কথা না বাড়িয়ে প্রায় পালিয়ে আসেন। পিকুর দিকে তাকাতেও তার ঘৃণা করছে। এই ছেলের সারা দেহে রাস্তার চিহ্ন। শহরের বলিরেখা এর সমগ্র শরীরে, একে ঘরে তোলা সম্ভব নয় ডঃ ঘোষের পক্ষে। আর এই পিকুও পথ থেকে কতটা নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে সন্দেহ হয় তাঁর। ফিরে আসতে আসতে তিনি ঠিক করেন দীপাকে কিছুই জানাবেন না। তাঁর ছেলে সারা মুখে শ্বেতী নিয়ে পড়ে আছে! ইস্‌! এতোদিন ধরে পেশেন্টদের শরীরে এই রোগের প্রকোপ দেখে এসেছেন তিনি। তাঁর পিকুর গায়ে... ডঃ ঘোষের ছেলের গায়ে এসব!

কিছুক্ষণের মধ্যে ডঃ ঘোষ নিজেকে বুঝিয়ে নিলেন যে ওটা পিকু নয়। অন্য কেউ। পিকু হারিয়ে গেছে। সে আর ফিরবে না। শহর জানতে পারে ডঃ ঘোষ আজ সেই সব মানুষের দলে ভিরে গেলেন যারা সারা জীবন অশান্তি পেয়েছে এবং পেয়ে চলবে।
“একবার ধরতে পেরে মনে মানুষ ছেড়ে দিতে আর চেয়ো না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।”

গতকাল সুলগ্না ম্যামের সাথে বেরিয়ে যাওয়ায় দীপাম্যামকে ধরতে পারেনি দোপাটি। আজ তাই কলেজে এসেই সে ফ্যাকাল্টিরুমের বাইরে ঘুরতে থাকে। ঘড়ির কাটা ধরে ঠিক পৌনে এগারোটায় দীপান্বিতা চ্যাটার্জী কলেজে ঢোকে। ফ্যাকাল্টি রুমে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় সে। সেই মেয়েটা... দীপাকে দেখে দোপাটি এগিয়ে আসে। দীপার গলা চোকড হয়ে যায়।

“ম্যাম...”

গলায় জোর আনে দীপা, “বলো।”

“আমি আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু জানাতে এসেছি।”

বিস্মিত হয় দীপা। এই মেয়েটা পিকুর খোঁজ পেয়েছে?

“ম্যাম আমার ভাইকে উনি পড়াতে আসতেন যাদবপুরে... আপনি যে বাড়িতে এসেছিলেন গত সপ্তাহে...”

“ও... আচ্ছা” আর কিছু বলতে পারে না দীপা।

“একটা কথা আপনারা জানেন না...” দোপাটি ইতস্তত করতে থাকে।

“কি?”

“ওনার মুখে গত কয়েক মাস ধরে কিছু সাদা স্পট দেখা গেছে... আই গেস ওনার ভিটিলিগো হয়েছে।”

দীপা আরো অবাক হয়ে পড়ে... পিকু এই খবরটা জানালো না কাউকে! “তুমি এসো তো আমার সাথে।” দোপাটিকে নিয়ে বারান্দার এক কোণায় চলে আসে দীপা। মেয়েটা কাছে সরে আসতেই গলা শুকিয়ে আসে তার। মেয়েটার গা থেকে দারুণ এক গন্ধ ধেয়ে আসছে তার দিকে, দীপা অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখে।

“আপনি যখন আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন আমরা বুঝতে পারিনি যে আপনারা জানেন না এই ব্যাপারটা। গতকাল বাবা খেয়াল করেছে যে বিবরণে এই কথাটা বলা হচ্ছে না। তাই আজ আমি আপনাকে জানাতে এলাম... এটা প্রচার করলে হয়তো খোঁজ পেতে সুবিধা হবে আপনাদের।”

দীপা মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। “পিকু তো একবারও বলেনি আমায়...”

“হ্যাঁ, ভাই বলছিল যে উনি নিজেই জানেন না যে ওনার এসব হয়েছে, মানে উনি আয়না দেখতে ভয় পান এটা ভাই কাল বলল...”

মাটির দিকে তাকিয়েই দীপা বলে “তাও, মেসের কেউ জানাবে না ওকে? ওর অন্য কোনো স্টুডেন্ট...”

“না ম্যাম, কেউ জানায় নি ওনাকে। অন্তত দু সপ্তাহ আগে পর্যন্ত উনি কিছুই জানতেন না। ভাইয়ের জন্মদিনের ছবিতে নিজেকে দেখে উনি চিনতেই পারেননি। আর ভাইও ওনাকে দেখিয়ে দেয়নি।”

অবশ্য পিকুটা বরাবরই মুখচোরা...তাও গোটা ব্যাপারটা দীপার খুব অদ্ভুত লাগে, খুব অ্যাবসার্ড। সে বলে, “থ্যাঙ্ক ইউ। এটা হয়তো ওকে খুঁজে বের করতে আমাদের খুবই সাহায্য করবে।”

“ম্যাম, ওনাকে খুঁজে পেলে জানাবেন আমাদের, বাড়িতে সবাই খুব চিন্তা করছে, আর আমিও...” থেমে যায় দোপাটি।

দীপা মুখ তুলে তাকায়, দেখে মেয়েটা মাথা নামিয়ে ফেলেছে। ও কি পিকুকে...

নিজেকে শূন্য লাগে দীপার।

“তুমি ক্লাসে যাও, খোঁজ পেলে নিশ্চয়ই জানাবো।”

দোপাটি ফিরে আসে। দীপা তার চলে যাওয়া দেখে যায়,

তারপর ফোন বের করে একটা কল করে।

গাড়ির হর্নের সাথে সাথে ওপাশ থেকে তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর গলা শোনা যায়।

“তীর্থ...”

“হ্যাঁ বলো।”

“আই অ্যাম সরি তীর্থ... আমি জানতাম না।”

“কি হয়েছে হঠাৎ?” তীর্থঙ্কর অবাক হন।

একটু থেমে দীপা বলে,- “আমি লেসবিয়ান”

কোনো সাড়া পায়না দীপা।

“মানে? হঠাৎ!” অতল থেকে তীর্থঙ্করের শান্ত স্বর ভেসে আসে।

“আই ফেল্ট ইট।”

“ওকে। আর কিছু?” নিজেকে অবিচল দেখাতে চেষ্টা করেন তীর্থঙ্কর।

“আর কিছু নয়।”

“তাহলে রাখি?”

“ওহ্‌, না! আর একটা কথা... একটু আগে জানতে পারলাম পিকুর নাকি ভিটিলিগো হয়েছে”

তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী গাড়ি থামিয়ে দেন মাঝ রাস্তায়। “ওই শিয়োর?”

“হ্যাঁ... ওই যাদবপুরের বাড়ি থেকে আজ খবর পেলাম”

“আমি রাখছি দীপা, একটু পরেই ফোন করবো তোমায়।” তাড়াতাড়ি ফোন রেখে তীর্থঙ্কর গাড়ি ঘুরিয়ে নেন। ই পি আই হসপিটালের বেডের পিকুকে তার দিদির হাতে তুলে দিতে হবে। তার সমকামী দিদির হাতে। অসহায় বোধ করেন তীর্থঙ্কর। এতগুলো বছর! এতগুলো বছর কাটানোর পর দীপা আজ... ঠিক শুনেছেন কি না সন্দেহ হয় তাঁর। এই প্রথম ঈশ্বর-তীর্থঙ্করের দয়া হয় নিজের প্রতি। সমস্ত কিছু মিথ্যে মনে হয়, গাড়ি চালাতে চালাতে তার মূল্যবান ট্রাউজারের ঊরুতে কয়েক ফোঁটা জল পড়ে। ছেলেবেলার পর তীর্থঙ্কর এই প্রথম নিজেকে কাঁদতে দেখেন।

“ডঃ ঘোষ এসেছিলেন?” কোনো রকমে নার্সটিকে জিজ্ঞেস করে দ্বৈপায়ন।

“হ্যাঁ, আপনি মিথ্যে পরিচয় দিয়েছেন কেন?”

“মিথ্যে!”

“হ্যাঁ, আপনি তো ওনার ছেলে নন...”

“কে বলেছে আপনাকে?”

“উনিই বলে চলে গেলেন।” নার্সটি দ্বৈপায়নের পাশে রাখা ফল, ফুল নিয়ে চলে যেতে চায়।

“আর আমার দিদি... মানে ওনার মেয়ে এসেছিলেন?”

“না। উনি আসবেন কেন? আপনি কি ওনার ভাই? বেঁচে গেছেন আপনি, ওদের হ্যারাস করার জন্য পুলিশ চার্জ করতে চেয়েছিল আপনাকে, তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী বারণ করেছেন।”

“জাম্বাবু এসেছিল?!”

নার্স জিজ্ঞাসু চোখে দ্বৈপায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“মানে, তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী?” দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করে।

“হ্যাঁ, আমি অটোগ্রাফও নিয়েছি ওনার, এই দেখুন” ডক্টরস্‌ প্যাডে সগর্বে তীর্থঙ্করের দুর্মূল্য সাক্ষর খুলে দেখান তিনি।

পিকু নিশ্চুপ হয়ে যায়। বাবা, জাম্বাবু কেউ পিকুকে চিনতে পারেনি! মানতে পারে না সে। প্রচন্ড কষ্ট হয় পিকুর। আর দিদি... দিদি একবার দেখতে পর্যন্ত এলো না! চুপ করে থাকে পিকু। কিন্তু তার ভিতরে চিৎকার করে কেঁদে চলেছে সে। নার্স চলে যায়।

পিকু টের পায় রবি বাউলের কথাটাই ঠিক। সে আর ঘরে ফিরতে পারবে না।

তাকে কেউ নেবে না ফিরিয়ে।

কি অপরাধ তার?

নিজেকেই প্রশ্ন করে দ্বৈপায়ন। কোনো জবাব পায় না। আর কতো নিরপরাধ মানুষ বঞ্চিত হবে চিরকাল? সেরাতে ওইটুকু ছেলেটা... ইস্‌, মানুষের নির্মমতার ছাপ দ্বৈপায়ন রেজ্জাকের গায়ে, নিজের গায়ে দেখতে পায়। মূল্যহীণ লাগে সমস্ত কিছু। গত দুদিনের পাঁজরের অসম্ভব যন্ত্রণা আর গায়ে লাগে না তার। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। হেঁটে হসপিটালের বাইরে চলে আসে। কেউ তাকে বাঁধা দেয় না। আর কেউ তার খোঁজও করবে না- দ্বৈপায়ন বোঝে। বাইরে এসে সে দেখে রাস্তার একপাশে রবি বাউল দাঁড়িয়ে, তার হাত ধরে অপর হাতে গায়ের চাদর আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে রেজ্জাক। দ্বৈপায়নকে দেখে নিষ্পাপ হেসে রবি বাউল হাঁটতে শুরু করেন, রেজ্জাক তার হাত ধরে এগিয়ে যায়,

পিছু পিছু দ্বৈপায়নও।