রবিবার, ২ মার্চ, ২০১৪

ছোটগল্প – বিবেক ভট্টাচার্য



ভর


শালা কোন কপাল করে যে মানুষ বেলঘরিয়ায় জন্মায় ! ট্রেনে উঠতে গেলে যুদ্ধ করো ! ট্রেন থেকে নামতে হলেও তাই । নামার সময় তবু সহ্য করা যায় । কিন্তু ওঠার ধাক্কা ? নৈব নৈব চ । জীবনেও এই দুর্ভোগ আর কাটবে না নাকি ? এই তো আজই ট্রেনে ফ্রি বডি ম্যাসাজ নিয়ে দমদমে নামার সময় আরেকটু হলেই একটা লোকের ঘাড়ে পড়ছিলো অর্পণ । ব্যাস ! আর যাবে কোথায় ? সাথে সাথেই মাতৃভাষার অপপ্রয়োগ শুরু ! এই হল সমস্যা । সবাই শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যাস্ত । পেছনের লোকটা যে নামার জন্য রাম গুঁতো দিয়ে ওকে ফেলে দিল সেটা দেখার সময় কারুর নেই । হাতে নেহাত সময় নেই আজ নাহলে অর্পণও দু’কথা শুনিয়ে দিত লোকটাকে । কিন্তু আজ ওকে এগারোটার মধ্যে ময়দান পৌঁছাতে হবে, ক্রিকেটের প্র্যাকটিস আছে ।

কোনোমতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল অর্পণ । সাবওয়ে দিয়ে নামতেই ‘ দেখি টিকিটটা ’। আরে ! টিটি বাবু যে ! ব্যাপার কি ? এরা তো কোনোদিনও টিকিট কাটলে টিকিট চায় না । আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে ! ভাবতে ভাবতে টিকিটটা বার করে দেখাতেই লোকটা মাথা নেড়ে টিকিটটা ফেরত দিল ওকে । ও-ও পাশ কাটিয়ে গিয়ে মেট্রোর লাইনে দাঁড়ালো । আজ মেট্রোর লাইনটা একটু বেশি । আড়চোখে একবার দেখে নিল ডিজিটাল ঘড়িটা । দশটা পাঁচ । আজ দেরি না করিয়ে ছাড়বে না নাকি এরা । দেরি হলেই আবার স্যারের ঝাড় শুনতে হবে । আজকেই যত লোকের দরকার পড়েছে নাকি মেট্রোতে ! এখন গান্‌...মানে ইয়ের মত দাঁড়িয়ে থাকো লাইন দিয়ে ! এই লাইন দেওয়া ব্যাপারটা একদম অসহ্য লাগে অর্পণের । টাইম কাটতেই চায় না । এই ফাঁকে আরেকবার শিঞ্জিনীকে ট্রাই করলে কেমন হয় ! টাইমও কাটবে কিছুটা আর কপাল ভালো থাকলে সকালের এই খারাপ লাগাটাও কমবে । তবে সেটা কপাল ভালো থাকলে তবেই ! কেননা ও সবসময় অর্পণের ফোন রিসিভ করে না । দেরী না করে মোবাইলটা বের করে শিঞ্জিনীর নাম্বারটা ডায়াল করে কানে ঠেকাল অর্পণ । প্রথমে খানিকক্ষণ সব নিস্তব্ধ, তারপর খুব চেনা রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে এল ওপাশ থেকে । ‘ মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো / দোলে মন দোলে অকারণ হরষে ’। কলার টিউন বেজে যেতে লাগলো আপন তালে ।

শিঞ্জিনী । শিঞ্জিনী চক্রবর্তী । এককালে কত পাগলামিই না করেছে অর্পণ ওর জন্য । রামের মত ধনুকভাঙ্গা পণ করেছে এককালে । হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছে । হাত কেটেছে । শিঞ্জিনী যে কোচিং-এ পড়ে ও তার সামনে ক্যালানের মতো দাঁড়িয়ে থেকে পাড়ার দাদার সাথে শিঞ্জিনীর ফুচকা খাওয়া দেখেছে । ওকে একবার দেখার জন্য ওদের জানলার নিচে দাঁড়িয়ে থেকে বন্ধুদের গালাগাল খেয়েছে । এমনকি শিঞ্জিনী নিরামিষ খায় বলে ও নিজেও নিরামিষ খেয়ে কাটিয়েছে । কিন্তু শিঞ্জিনী পাত্তা দেয়নি । অথচ কারুর সাথে প্রেমও করে না ও । মেয়েটা যে কি আজও বোঝেনা অর্পণ । কেনই বা অর্পণের এত পাগলামি ওর জন্য ? মেয়েটা যে একেবারে স্বর্গের অপ্সরা তাও না, কিন্তু কিছু একটা আছে । ওর নীলচে চোখে, ওর ওই গজদাঁতে, টোল পড়া গালে একটা পাগল করা ব্যাপার আছে ।

- “ দাদা, টিকিটটা কাটলে কাটুন নয়তো সাইড দিন । এটা ফোন করার লাইন না ।” এ বাবা ! শিঞ্জিনীর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে কাউন্টারের সামনে এসে পড়েছে খেয়ালই ছিল না ওর । হাতে ধরা টাকাটা এগিয়ে দিয়ে অর্পণ বলল “ ময়দান একটা ” তারপর টিকিটটা নিয়ে এগিয়ে গেল এন্ট্রান্সের দিকে । ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার ঘড়িটা দেখে নিল । দশটা পনেরো । একছুটে এস্কালেটার দিয়ে ওপরে উঠেই মেট্রো পেয়ে তাতে উঠে পড়ল । একে শীতের দিন তার ওপর এ.সি. মেট্রোর ঠাণ্ডা । একেই বোধহয় বলে ‘ জমে ক্ষীর ’ ! নেহাত আজ হাতে টাইম কম নয়তো কোন শালা উঠত এখন এ.সি. মেট্রোয় ! সে যাক তবু তো নিশ্চিন্ত । আরামে পৌঁছে যাবে এগারোটার আগেই । মেট্রোটা পেল বলে রক্ষে নাহলেই হয়েছিল ! রাঘব স্যার যা পাংচুয়াল ! লেট করলে হেভি ঝাড়ে । অর্পণ একবার পকেটগুলো হাতড়ে দেখে নিল যে টিকিটটা কোন পকেটে রেখেছে । মেট্রো ময়দান ঢোকার সময় হেলেদুলে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো ও । ট্রেন থামতেই দরজা খুলে গেল । টুক করে নেমে আরেকবার ঘড়িটা দেখে নিল । সবে দশটা পঁয়তাল্লিশ । অনেক সময় আছে – মনে মনে বলল অর্পণ । বাতাসার মত টিকিটটা নিয়ে এক্সিট গেটের দিকে এগিয়ে গেল ও । টিকিটটা জায়গা মত ফেলতেই গেট খুলে গেল । বাইরে বেরিয়ে আরেকবার শিঞ্জিনীকে ট্রাই করবে ভেবে ফোনটা বার করেই দেখল ফোন অফ হয়ে গেছে । সুইচ টিপে অন করতেই ব্যাটারি লো দেখিয়ে আবার অফ হয়ে গেল । অগত্যা ! কলকাতার এই জায়গাটা অর্পণের খুব পছন্দের । একদিকে ময়দান, ইলিয়ট পার্ক আরেকদিকে ভিক্টোরিয়া । উফফ, জাস্ট ভাবা যায়না । অর্পণ জায়গাটার নাম দিয়েছে প্রেমপুরী । সব ভালোবাসা যেন এখানেই । স্টেশান থেকে বেরিয়ে প্রথমেই পড়ে ইলিয়ট পার্ক । প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রেম করবার জায়গা । একবার বন্ধুরা মিলে ইলিয়ট পার্কে মজা করতে ঢুকেছিল । যেখানেই ঝোপেঝাড়ে মাখো মাখো সিন চলছিলো সেখানেই গিয়ে কখনো উঁকি মারা কখনো চেঁচানো এইসব করেছিল ওরা । কত ইচ্ছা ছিল শিঞ্জিনীকে নিয়ে এখানে আসার । পাশাপাশি বসে গল্প করার । কিছুই হল না । ভাবতে ভাবতেই অর্পণের চোখ চলে গেল পার্কটার দিকে । তাকিয়েই মন খারাপ হয়ে গেল । আগে কত ভালো ছিল জায়গাটা । চারিদিক খোলা থাকতো । পার্কের ভেতরের সিন দেখা যেত রাস্তা থেকে । এখন সব ঘিরে দিয়েছে । যদিও এই সময় পার্ক বন্ধ থাকে তবুও ফেরার সময় তো দেখা যেত । এখন থেকে আর কিছুই দেখা যাবে না ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল ওর । আরে এই যারা অর্পণের মত একা তাদের কথা কি কেউ ভাবে না ?

‘ এই হিরো ! দশটা টাকা দে ’। এই খেয়েছে, মনে মনে ভাবল অর্পণ । মুখে বলল “ আমি মোহিনীদি ছাড়া কাউকে দিই না ।” এই প্রেমপুরীর এই একটাই সমস্যা । অনেক হিজড়ের আস্থানা জায়গাটা । এখানে এলে কোন না কোন হিজড়ে টাকা চাইবেই । মোহিনীও এখানকারই একটা হিজড়ের নাম । ভাগ্যিস নাম টা সেবার জেনে নিয়েছিল তাই আজ বেঁচে গেল, নয়তো দশ টাকা যেত এখন । আবার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাল অর্পণ । এখনও মিনিট সাতেক আছে । আর ও তো প্রায় পৌঁছেই গেছে । এখান থেকে ওদের প্র্যাকটিসের জায়গায় পৌছাতে দু’মিনিটও লাগবে না ।

“ একটা কথা বলব ! কিছু মনে করবে না তো ”। চমকে উঠল অর্পণ । মাত্র কেউ যেন ওকেই ডাকল মনে হল । কে হতে পারে ভেবে পেছন ঘুরে থতমত খেয়ে গেল ও । একটা লোক ওর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু ভাবে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে । আগাগোড়া সাদা রঙে মোড়া । জামাকাপড় সাদা, চুল সাদা, এমনকি মুখে হালকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটাও ধপধপে সাদা । লোকটা ভুরু কুঁচকে ওকেই দেখছে । অস্বস্তি হল ওর । কে রে বাবা লোকটা ? গলায় আবার খ্রিস্টানদের মত ক্রস ঝুলছে । দেখে মনে হল ধর্মযাজক গোছের কেউ । হতেও পারে, সামনেই একটা চার্চ আছে । বোধহয় ওখানকারই কেউ হবেন । ‘ হ্যাঁ, বলুন ’ বলল অর্পণ । এরপর লোকটি যা বলল শুনে অর্পণের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল । এও সম্ভব ! এমনও হতে পারে !

- নাম কি তোমার ?

- অর্পণ সেনগুপ্ত ।

- শোন আমার কথা হয়তো তোমার বিশ্বাস হবে না, তাও বলি । আমি একজন পাদ্রী । আমি এমন অনেককিছু দেখতে পাই যেটা সকলে পারেনা । তোমার ওপর এক পরী ভর করেছে । স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার ঘাড়ের ওপর উঠে বসে আছে । বীভৎস তার চেহারা । ও যতদিন থাকবে ততদিন কোন মেয়ে তোমার জীবনে আসবে না । ও আসতে দেবে না ।

প-প্প-পরি ! এসবের মানে কি ? এ যে অবাস্তব, অসম্ভব কথা । পরী ঘাড়ে চেপে বসেছে এমন তো কখনো শুনিনি ! তবে কি, তবে কি এই জন্যই শিঞ্জিনী ওর কাছে আসেনা ? এই কারনেই এতদিন চেষ্টা করেও পায়নি ও শিঞ্জিনীকে ? “ কিন্তু এর থেকে বাঁচার উপায় কি ? আপনি তো সব জানেন, আপনি বলে দিন । যা করতে হবে করব শুধু আমাকে এর হাত থেকে বাঁচান আপনি ।”

ভদ্রলোক ওর কথা শুনে একটু হাসলেন । বললেন “ একটা পবিত্র জল দিচ্ছি তোমায় । রোজ স্নানের পর গায়ে ওই জলের ছিটে দেবে । ঠাকুর দেবতার প্রতি ভক্তি আনবে । আর হ্যাঁ, সকালে ঘর থেকে বেরবে না একদম ” বলেই ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন । কিন্তু অর্পণের মধ্যে তখন কেমন যেন একটা ভাবের ঘোর এসে গেছে । ও রাস্তাতেই লোকটির সামনে বসে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করল পাদ্রীটিকে । পা জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল । প্রলাপ বকতে লাগলো অর্পণ “ আপনি সাক্ষাৎ দেবতা...সাক্ষাৎ প্রভু যিশুর অবতার...আমাকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতেই আপনার আগমন ” বলেই পঞ্চাশটা টাকা দক্ষিণা দিয়ে প্রণাম করলো । ভক্তের দান প্রভু কখনো ফেলতে পারে ! পাদ্রীটি টাকার নোটটা হাতে নিয়ে ওকে আশ্বস্ত করলেন । বললেন “ ভয় পেও না, তুমি এবার মুক্তি পাবে ।” বলেই হনহন করে চলে গেলেন । নাকি মিলিয়ে গেলেন কোথাও ঠিক জানেনা অর্পণ ।

“ ওই হিরো ।” কখন যে আগের সেই হিজড়েটা অর্পণের ঠিক পাশে এসে দাড়িয়েছে ও দেখেনি । “ শালা আমাদের জন্য পয়সা নেই আর একটা পাগলের জন্য পঞ্চাশ টাকা আছে না রে ? এই বুঝি তোর মোহিনীদি ? মাসিদের সাথে লাগিস না মাইরি এমন অভিশাপ দেব তোর বাপ পর্যন্ত মাসি হয়ে যাবে বলে দিলাম ।” মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল অর্পণের “ পাগল মানে ?” চেঁচিয়ে উঠল ও, “ তুমি দেখলে না উনি আমার ঘাড়ের পরী নামানোর ব্যবস্থা করলেন ? তাই আমি খুশি হয়ে উনাকে টাকাটা দিয়েছি ।” যেই না কথাটা বলা অমনি সেই হিজড়েটা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে উঠল “ পরী না হাতি ! ওটা তো একটা বদ্ধ পাগল । বহুদিন ধরে এখানে ঘুরে বেড়ায় ।”

ভাবের ঘোরটা একটু কেটে এসেছিল অর্পণের । চোখ মুছে পাদ্রীবেশী লোকটির চলে যাওয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে দাড়ালো অর্পণ । সত্যিই ওর মত একা পাবলিকের কথা কেউই ভাবে না । হাতের ঘড়ি এখন সাড়ে এগারোটা ছুঁয়েছে । অতএব ! রাঘব স্যারের ঝাড়টাও আজ কপালে ।