সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

খামচানো কালপৃষ্ঠা - মলয় রায় চৌধুরী


নেহেরু দর্শন : ব্লেডস অব গ্রাস
মলয় রায়চৌধুরী

(আমার এই লেখাগুলো, যেগুলো ক্ষেপচুরিয়ানে প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলো মগজের নামচা থেকে সরাসরি নামানো। অনেকে এই লেখাগুলো নিজের পছন্দমতো ই-জাইনে বা ব্লগ-পত্রিকায় তুলে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু পাঠকদের বলে দিচ্ছেন না যে এটা কী ধরণের লেখা। ফলে রচনাটিকে ছোটোগল্প মনে করে তাঁরা ভাষা, শৈলী, সজ্ঞাভূক্তি ইত্যাদি খুঁজছেন। আমার লেখাপত্র যেখানে ইচ্ছা প্রকাশ করা যায়। তবে উৎসটা পাঠকদের জানিয়ে দিলে তাঁরা সেইভাবে লেখাটা পড়বেন।)

আমি যে কলেজে পড়তে ঢুকি, সেখানে, কিছুদিনের ভেতরই আঁচ করতে পারি যে, হিন্দির অধ্যাপক আর ইংরেজির অধ্যাপকদের মাঝে সরকারি ভাষা নিয়ে খোঁচা দেবার একধরণের খেলা চলে । হিন্দির অধ্যাপকরা দাবি করতেন যে হিন্দি হল রাষ্ট্রভাষা । তা কিন্তু নয় । হিন্দি হল সরকারি দপতরের কাজ চালাবার ভাষা । ইংরেজির অধ্যাপকরা মাঝে-মাঝে ইংরেজি থেকে হিন্দিতে রূপান্তরিত শব্দগুলোকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতেন । ১৯৫০ সালে হিন্দি সরকারি ভাষা হিসাবে সংবিধানে গ্রহণ করার পর হিন্দি-প্রেমীদের গোঁ ধরে যায় প্রতিটি ইংরেজি শব্দের হিন্দিকরণের জন্য । বিটকেল সমস্ত শব্দের জন্ম দিতে আরম্ভ করেছিলেন তাঁরা । যেমন লেটারবক্সের হিন্দি হয়েছিল চিঠ্ঠিঘুষেড় যা পরে হল পত্রমঞ্জুষা ! সেই সমস্ত শব্দগুলো নিয়েই খোঁচাখুঁচির খেলা চলত । তাঁরা কিন্তু কেউই অহিন্দিভাষী ছিলেন না । যাঁরা ইংরেজি পড়াতেন আর হিন্দিকে টিটকিরি মারতেন তাঁদের মাতৃভাষাও হিন্দি । ইংরেজির বাঙালি বা উর্দুভাষী অধ্যাপকরা এই খেলাটিতে স্বাভাবিকভাবেই অংশগ্রহণ করতেন না ।

খোঁচামারার খেলা সবচেয়ে বেশি জমে উঠত দুই অধ্যাপকের মাঝে । হিন্দির অধ্যাপক শার্ট-ফুলপ্যান্ট পরতেন আর ইংরেজির অধ্যাপক পরতেন ধুতি-পাঞ্জাবি । হিন্দির অধ্যাপক ছিলেন কলেজে ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরের প্রশিক্ষক । সবে হিন্দি করা সৈনিক নির্দেশগুলো নিয়েও খোঁচার খেলা খেলতেন ইংরেজির অধ্যাপক । যেমন অ্যাটেনশান হিন্দিতে ছিল 'সাওধান' বা স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ হিন্দিতে ছিল 'আরাম লো' ; এখন কী হয়েছে ঠিক জানি না । ইংরেজির অধ্যাপক পান খেতেন আর পানের পিক মুখে নিয়ে এই টিটকিরিগুলো মারতেন । অবশ্য ক্লাসে ঢোকার আগে মুখ ধুয়ে আসতেন । দুজনেই ছাত্রদের প্রিয় ছিলেন, নিজের-নিজের বিষয়ে প্রভূত জ্ঞানের জন্য । দুজনেরই পদবি ছিল 'সিনহা' । ছাত্ররা হিন্দির অধ্যাপককে বলত 'হিংসিন' আর ইংরেজির অধ্যাপককে 'ইংসিন' ।

একদিন শুনলুম যে জওহরলাল নেহেরু আসছেন, সরকারি কাজকর্মে হিন্দির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ছাত্রদের জমায়েতে বক্তৃতা দেবেন । হিন্দিতেই দেবেন, যখন কিনা উনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেলে কেবল ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন । সংবাদটি চাউর হবার ফলে হিন্দির অধ্যাপকের ছাতি বেশ চওড়া দেখাতে লাগল । ইংরেজির অধ্যাপক বলেছিলেন যে নেহেরু চিন্তা করেন ইংরেজিতে, তাই ওনার বক্তৃতা শোনার পৃথক আনন্দ আছে, কেননা একজন মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিজের ভাবনাকে কোন প্রক্রিয়ায় অনুবাদ করেন তার হদিশ পাওয়া যাবে ।

আজকাল রাজনৈতিক নেতাদের কাছাকাছি হওয়া বেশ কঠিন। যে নেতা যত বেশি কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছে তাকে ঘিরে থাকে ততো বেশি পাহারাদার বন্দুকধারী । আর তাদের ঘিরে থাকে স্যাঙাতের দল । যদিও সাধারণ মানুষ তাদের থেকে যত দূরে সম্ভব থাকতে চান । নেতারা এমনভাবে তখন চলেন যেন কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে হাঁটছেন ; মুখ অনেকটা তেমনই ভজকট হয়ে থাকে । কবে থেকে যে এই অনাবশ্যক নাটুকেপনা শুরু হয়েছে জানি না । নেতাকে ঘিরে ব্যাটম্যান পোশাকের বন্দুকধারী । এই নেতাদের শত্রু যে কারা আর তাদের মেরে কার যে কী লাভ তার হদিশ মেলা কঠিন । সেসময়ে, পাঁচের-ছয়ের দশকে, নেতাদের কাছাকাছি হতে বিশেষ অসুবিধা হতো না, তার কিছুকাল আগেই মোহনদাস করমচন্দ গান্ধীর হত্যা সত্ত্বেও । নেতা হবার জন্য বোধহয় প্রথমে বেশ কিছু শত্রু তৈরি করতে হয় আজকাল । তবে টিভিতে আর সংবাদপত্রে তাঁদের মুখ থেকে যে ইনজিরি বেরোয় তা থেকে অন্তত এটা টের পাওয়া যায় যে তাঁদের প্রধান শত্রু হল ইংরেজি ভাষা । এব্যাপারে টেক্কা দেন দলনির্বিশেষে বাঙালি নেতারা । ভাষা ছাড়াই যে চিন্তা করা যায় তার তাঁরা নমুনা । একজন বিহারি নেতার স্যাঙাতের কাছে শুনেছি যে নেতা কথা আরম্ভ করলেই প্রতিটি শব্দের সঙ্গে পঞ্চাশ ফোঁটা থুতু ছেটান ।



জওহরলালকে তার আগে কাছ থেকে দেখিনি, দূর থেকে দেখেছিলুম, গান্ধি ময়দানে । বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, তার মানে কাছ থেকে দেখা যাবে, হয়তো কথা বলারও সুযোগ হতে পারে । আমার সহপাঠী বারীন গুপ্ত, সুবর্ণ উপাধ্যায় আর তরুণ শূর, যারা স্কুল থেকেই আমার সহপাঠী ছিল, কলেজেও ছিল একই সঙ্গে ; সুবর্ণ অবশ্য বিজ্ঞান পড়ত । সুবর্ণর মুখে এডউইনা মাউন্টব্যাটেন আর নেহেরুর সম্পর্কের গল্প শুনে-শুনে নেহেরুকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহ আরও বেড়ে গিয়েছিল ; বয়সকালের প্রেম বলে । তরুণ শূর নেহেরুকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছিল আগে । ও জানিয়েছিল যে নেহেরু নাকি এডউইনার চেয়েও ফরসা, গোলাপি-ফরসা, যখন কিনা এডউইনা সাদা-ফরসা ।

নেহেরু বক্তৃতা দিতে এলেন । বেশ ফরসা মানুষ । টুপি খুললে টাক আরও ফরসা দেখায় ।আমরা চারজনই এন সি সিতে ছিলুম বলে হিন্দির অধ্যাপক আমাদের ডিউটি দিলেন বক্তৃতামঞ্চের কাছেই । বক্তৃতা আরম্ভ হল । আমার সামনেই হিন্দি আর ইংরেজির অধ্যাপক । পরস্পরকে খোঁচা দেবেন বলেই বোধহয় একসঙ্গে এসে থাকবেন । হিন্দির অধ্যাপকের পেছনে ইংরেজির অধ্যাপক । হিন্দির অধ্যাপকও ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরে এসেছেন । নেহেরু হিন্দির, যাকে উনি বক্তৃতায় বলছিলেন 'হিন্দুস্তানি জবান', তার গুণগান করছিলেন । হঠাৎ উনি থেমে গেলেন, একটা উক্তিতে এসে আটকে গেলেন ।

সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে আচমকা জিগ্যেস করলেন, 'ব্লেডস অব গ্রাস'-এর ...

(ক্রমশঃ)

4 comments:

prolay mukherjee বলেছেন...

পড়ে চলেছি স্যার, ভীষণ সাবলীল এই কলমকে প্রথম থেকেই দেখে নিচ্ছি অসম চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষী থেকে।

Preetha Roy Chowdhury বলেছেন...

যতই পড়ছি, আরও পড়বার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠছে।

Na Playing Dice বলেছেন...

...

Samiul Haque বলেছেন...

Esob bhaant pore ki luv?