নেহেরু দর্শন : ব্লেডস অব গ্রাস
মলয় রায়চৌধুরী
আমি যে কলেজে পড়তে ঢুকি, সেখানে, কিছুদিনের ভেতরই আঁচ করতে পারি যে, হিন্দির অধ্যাপক আর ইংরেজির অধ্যাপকদের মাঝে সরকারি ভাষা নিয়ে খোঁচা দেবার একধরণের খেলা চলে । হিন্দির অধ্যাপকরা দাবি করতেন যে হিন্দি হল রাষ্ট্রভাষা । তা কিন্তু নয় । হিন্দি হল সরকারি দপতরের কাজ চালাবার ভাষা । ইংরেজির অধ্যাপকরা মাঝে-মাঝে ইংরেজি থেকে হিন্দিতে রূপান্তরিত শব্দগুলোকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতেন । ১৯৫০ সালে হিন্দি সরকারি ভাষা হিসাবে সংবিধানে গ্রহণ করার পর হিন্দি-প্রেমীদের গোঁ ধরে যায় প্রতিটি ইংরেজি শব্দের হিন্দিকরণের জন্য । বিটকেল সমস্ত শব্দের জন্ম দিতে আরম্ভ করেছিলেন তাঁরা । যেমন লেটারবক্সের হিন্দি হয়েছিল চিঠ্ঠিঘুষেড় যা পরে হল পত্রমঞ্জুষা ! সেই সমস্ত শব্দগুলো নিয়েই খোঁচাখুঁচির খেলা চলত । তাঁরা কিন্তু কেউই অহিন্দিভাষী ছিলেন না । যাঁরা ইংরেজি পড়াতেন আর হিন্দিকে টিটকিরি মারতেন তাঁদের মাতৃভাষাও হিন্দি । ইংরেজির বাঙালি বা উর্দুভাষী অধ্যাপকরা এই খেলাটিতে স্বাভাবিকভাবেই অংশগ্রহণ করতেন না ।

একদিন শুনলুম যে জওহরলাল নেহেরু আসছেন, সরকারি কাজকর্মে হিন্দির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ছাত্রদের জমায়েতে বক্তৃতা দেবেন । হিন্দিতেই দেবেন, যখন কিনা উনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেলে কেবল ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন । সংবাদটি চাউর হবার ফলে হিন্দির অধ্যাপকের ছাতি বেশ চওড়া দেখাতে লাগল । ইংরেজির অধ্যাপক বলেছিলেন যে নেহেরু চিন্তা করেন ইংরেজিতে, তাই ওনার বক্তৃতা শোনার পৃথক আনন্দ আছে, কেননা একজন মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিজের ভাবনাকে কোন প্রক্রিয়ায় অনুবাদ করেন তার হদিশ পাওয়া যাবে ।


জওহরলালকে তার আগে কাছ থেকে দেখিনি, দূর থেকে দেখেছিলুম, গান্ধি ময়দানে । বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, তার মানে কাছ থেকে দেখা যাবে, হয়তো কথা বলারও সুযোগ হতে পারে । আমার সহপাঠী বারীন গুপ্ত, সুবর্ণ উপাধ্যায় আর তরুণ শূর, যারা স্কুল থেকেই আমার সহপাঠী ছিল, কলেজেও ছিল একই সঙ্গে ; সুবর্ণ অবশ্য বিজ্ঞান পড়ত । সুবর্ণর মুখে এডউইনা মাউন্টব্যাটেন আর নেহেরুর সম্পর্কের গল্প শুনে-শুনে নেহেরুকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহ আরও বেড়ে গিয়েছিল ; বয়সকালের প্রেম বলে । তরুণ শূর নেহেরুকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছিল আগে । ও জানিয়েছিল যে নেহেরু নাকি এডউইনার চেয়েও ফরসা, গোলাপি-ফরসা, যখন কিনা এডউইনা সাদা-ফরসা ।
নেহেরু বক্তৃতা দিতে এলেন । বেশ ফরসা মানুষ । টুপি খুললে টাক আরও ফরসা দেখায় ।আমরা চারজনই এন সি সিতে ছিলুম বলে হিন্দির অধ্যাপক আমাদের ডিউটি দিলেন বক্তৃতামঞ্চের কাছেই । বক্তৃতা আরম্ভ হল । আমার সামনেই হিন্দি আর ইংরেজির অধ্যাপক । পরস্পরকে খোঁচা দেবেন বলেই বোধহয় একসঙ্গে এসে থাকবেন । হিন্দির অধ্যাপকের পেছনে ইংরেজির অধ্যাপক । হিন্দির অধ্যাপকও ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরে এসেছেন । নেহেরু হিন্দির, যাকে উনি বক্তৃতায় বলছিলেন 'হিন্দুস্তানি জবান', তার গুণগান করছিলেন । হঠাৎ উনি থেমে গেলেন, একটা উক্তিতে এসে আটকে গেলেন ।
সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে আচমকা জিগ্যেস করলেন, 'ব্লেডস অব গ্রাস'-এর ...
(ক্রমশঃ)
4 comments:
পড়ে চলেছি স্যার, ভীষণ সাবলীল এই কলমকে প্রথম থেকেই দেখে নিচ্ছি অসম চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষী থেকে।
যতই পড়ছি, আরও পড়বার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠছে।
...
Esob bhaant pore ki luv?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন