সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

আলোচনা - ক্ষেপচুরিয়াস-অলস দুপুর

ক্ষেপচুরিয়াস-অলস দুপুর অনলাইন আলোচনা
১১ই জানুয়ারী, ২০১৩

ক্ষেপচুরিয়াস- অলস দুপুর অনলাইন আলোচনা প্রকল্পের প্রতি শুক্রবারের বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল থেকে রাত অব্দি এই আলোচনা চলে। বিষয় ছিল 'সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোনও দশক বলে সীমারেখা থাকা কি উচিত?' মোট ২২ জন কবি- লেখক আলোচনায় অংশ নেন। এরা হলেন-

সরদার আমিন, ইয়াসীন ফিদা হোসেন, অত্রি ভট্টাচার্য্য, রীতা রায় মিঠু, পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়, কচি রেজা, উষসী ভট্টাচার্য্য, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, সন্দ্বীপক মল্লিক, হীরক মুখার্জী, জুবিন ঘোষ, বীরেন মুখার্জি, সিদ্ধার্থ শর্মা, জলধি রায়, রেজওয়ান তানিম, দেবাদ্রিতা বোস, অমিতাভ রক্ষিত, বিদিশা সরকার, সুশান্ত কর, মিলন চ্যাটার্জি, আব্দুল্লাহ্ জামিল ও দুপুর মিত্র।

নিচে পুরো আলোচনা তুলে দেওয়া হল।

সরদার আমিন: বুঝলাম না। সীমারেখার কথা উঠছে কেন? আর সাহিত্য কোন দশকে কি রকম ছিল, কোন প্রেক্ষাপটে কি সাহিত্য রচিত হয়, ষাটের দশকের সামাজিক বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতা এক নয়। তখন ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কবিতা এসেছে সৃষ্টিতে, এখন কি আসবে? দারিদ্র্য আর অপমান বঞ্চনা শোষণের যে সময়কাল সুকান্ত দেখেছিলেন যে ঝাঁঝ তার কবিতায় উঠে এসেছিল, এখন কি তা আছে? সময় ধারণ করে সাহিত্যকে। সাহিত্য থেকে সময় ও তার ইতিহাসকে বোঝা যায়। সুতরাং সীমারেখা না থাকার মত বিষয়টিঈ বুঝলাম না দুপুর মিত্র।

দুপুর মিত্র: আপনি কন্টেন্টের জায়গা ধরে বলেছেন। সময় শুধু এক রকম থাকে না। এটাকে পরিবর্তনও করতে হয়। কিন্তু দশকের বিষয়টা এসেছে মূলত সমালোচনা সাহিত্যে। সমালোচকরা দশক ধরে সাহিত্য আলোচনা করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এর ব্যবহার বা অপব্যবহার যাই বলেন না কেন তা করছে কবিরা।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: আমার কথা পরে বলবো। এবিষয়ে কবি শোয়াইব জিবরানের বিশ্লেষণ আমার ভালো লেগেছে। তার কথা সরাসরি কোট করে দিলাম- "দশকওয়ারি বিচার পশ্চিমা সাহিত্যে প্রচল রয়েছে। বুদ্ধদেব বসু ওটি বাংলা সাহিত্যে আমদানি করেছেন। মাইক্রো লেবেলে বিচারের ক্ষেত্রে এটি বেশ কাজের। এখন যে কবি লিখছেন তাকে যদি দেড়হাজার বছরের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দেখা হয় তাহলে তাঁকে বালছাল মনে হতে পারে। কিন্তু দশকবছরের ফ্রেমে দেখলে একটা জায়গা তাঁকে দেয়া যাবে। হ্যাঁ একটা সময়ে তাঁকে দেড়হাজার বছরের সাথেই লড়াই করে দাঁড়াতে হবে। সে সময়টা তাঁকে দিতে হবে। "

অত্রি ভট্টাচার্য্য: দশক বিভাগটা একটা সুবিধার জন্য তৈরি টুল (Tool)-এর থেকে বেশি কিছুই মনে হয় না আমার। আমি যদি সাহিত্যের ক্ষেত্রে খুঁটির মত দশকের অস্তিত্ব স্বীকার ক'রি - তবে নানান কন্ট্রাডিকশন-ও এসে পড়ে। যেমন, আশির দশকের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এই দশকের কোন কবিতা আন্দোলনে যদি আশির কিছু চিহ্ন, কিছু মূলসুর থেকে যায় - তবে কিভাবে বিভাগ করব? আশি দ্বারা প্রভাবিত এই দশক? হাস্যকর ! আবার - টাইম স্কেল তো মানবিনির্মিত। কবিতার উত্থানপতনকে টাইম স্কেল কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? এক্ষেত্রে হয়তো দশকবাদিরা কইবেন দশক কবিতাকে আদৌ নিয়ন্ত্রণ ক'রে না। তবে, দশকপ্রথার কাজ কী? আমি বলি - এ একটি বৃহৎ হুজুগ। আমার মনে আছে, মাসকয়েক আগে ক্ষেপুতে আমার সাথে দশকপ্রথার গুঢ় সমর্থক জুবিনদার দশক নিয়ে লেগেছিল। তখনো ঠিকঠাক প্রমাণিত হয়নি - কবিতায় দশক প্রথা অপরিহার্য্য বা সর্বজন স্বীকৃত ! উদাহরনস্বরূপ, কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য্যকে বোধ হয় নব্বই-এর দশকের কবি বলা হয়ে থাকে। অথচ তিনি নিজে স্বীকার করেছেন, তার লেখা প্রথমদিকে মৃদুল দাশগুপ্ত দ্বারা প্রভাবিত ছিল। মৃদুলদা-র সবচেয়ে জনপ্রিয় বই "জলপাইকাঠের এস্রাজ" ১৯৮০-ত প্রথম বেরুয়। তবে? এই যে প্রভাব - তা দশকপ্রথা চিহ্নিত করবে কী ক'রে? আমি অমুক দশকের কবি - এতে কী তবে আমার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে? বোধ হয় না। দশকপ্রথার কোন ভিভিড বেনিফিট থাকলে, অথবা বাংলা কবিতাকে দশক অদৃশ্য এক সুতো দ্বারা চালিত করছে - এর প্রমাণ থাকলে, দয়া ক'রে জানান।

রীতা রায় মিঠু: দুপুর, আমার কাছে খুবই কঠিন লাগছে, এমন আলোচনা। আর সবাই কত নামী দামী, মান্য-গণ্য জন, আমি কী লিখতে কি লিখবো, হাসাহাসি হবে আমাকে নিয়ে। আমি ওখানে পোস্ট করেছিলাম, কিন্তু পোস্ট হয় নি। যাই হোক, তোমাকে মেসেজ করে দিলাম।বাবারে! দুপুর মিত্র আমাকে এ কোথায় এনে ছেড়ে দিয়েছে রে! সাহিত্যের কিছুই জানিনা, বুঝিও না, কী বলতে কী বলবো, সবাই শেষে আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে!সাহিত্য শব্দটিই আমার কাছে বিরাট এক ধাঁধাঁ বলে মনে হয়। এ এমনই এক ধাঁধাঁর জগত, যেখানে আমার মত হাটুরেদের উঁকি মেরে দেখার জন্য আরেকটু লম্বা হওয়া উচিত ছিল। পায়ের গোড়ালী যতটা উঁচুতে উঠানো যায়, ততটুকু উঠিয়েও সাহিত্যের দেখা পাই না। কারণ সাহিত্য অনেক দামী, অনেক গভীর, রসে টইটুম্বুর ব্যাপার। দামী জিনিস সাধারণের জন্য নয়। সাধারণের হাতে পড়লে নাকি সাহিত্যের বারোটা বেজে যায়।
তা বারোটা বাজতেই পারে, সাহিত্যই বুঝিনা, তার আবার দশক, শতক বুঝবো কি করে। দৈনন্দিন বাজারের হিসেব লিখতে গিয়েই হয়ে যাই গলদঘর্ম। নুন আনতে গিয়ে ঘরে পান্তা ফুরাতে চায়, রাতের অন্ধকারে হাটুরের দল হাটের দিকে যায়, তারা কী করে উপভোগ করবে ঊষার আলো অথবা রবির কিরণ! জমিদারি প্রথাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেই কবে, এখন রাজা, প্রজা সবই সাধারণ জনগণ। ক্ষিদের জ্বালায় মন মাথা হয়ে থাকে ক্ষেপচুরিয়াস, অলস দুপুর কথাটি শুনলেই গায়ে ঈর্ষার জ্বালা টের পাওয়া যায়। মনে এত বেশি ঈর্ষা নিয়ে, মেজাজ ক্ষেপচুরিয়াস করে কী আর সাহিত্যের নাগাল পাওয়া যায়! বরং ‘অলস দুপুর’ এর চেয়ে ‘ক্ষেপচুরিয়াস’ শুনতে বেশি ভালো লাগে।এখন আর সহজ কথা, সরল কথার মধ্যে সাহিত্য থাকে না। অথচ আমার মত হাটুরেরা আবার সহজ-সরল কথা ছাড়া কথাই বলতে পারি না। যেমন ধরা যাক, আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে যদি কিছু বলতে যাই, দেখা যাবে এসব নিয়ে ভাববার মত চিন্তাশক্তি বা মেধার কোনটাই নেই। তা থাকবেই বা কী করে,
ক্ষেপচুরিয়াস জমানায় মন মাথা সব সময় আউলা ঝাউলা হয়ে থাকে। এই জমানায় অলস দুপুর বলে কিছু নেই। অলস দুপু্রের জমানা শেষ। ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশের দশকে জীবন-যাপনের সাথে অলস দুপুর ছিল, সেই অলস দুপুরে শীতের রোদে পিঠ দিয়ে অ-কবির মনও উদাস হয়ে যেতো। আর কবি মন হলেতো কথাই ছিল না। ‘শীতের কবোষ্ণ রোদ’ জাতীয় কথামালা দিয়ে রচনা করে ফেলতো কতই না শ্রুতিমধুর কবিতা আর গান। সে সকল দশকের সাহিত্যে রস পাওয়া যেতো, রসের গভীরতা পাওয়া যেতো। রসময় সাহিত্য সৃষ্টির জন্য রসময় প্রেরণা দরকার। একবিংশ শতাব্দীতে কে কাকে প্রেরণা দিবে, মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা সবার। সুন্দর সুন্দর কাব্যিক কথামালা মুখেও আসেনা, কলমেও আসেনা। কলমের যুগও শেষ হয়ে গেছে, এখন মাথা, মন, দেহ সব কিছুই কম্পিউটারাইজড হয়ে গেছে। এইজন্যই বর্তমান শতকের সাহিত্যে কম্পিউটারাইজড শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয়। মনের খুশি, আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে, অথবা কাউকে প্রশংসা করতে গিয়ে কম্পিউটারাইজড সাহিত্য ভান্ডার থেকে বেরিয়ে আসে ‘ক্ষেপচুরিয়াস’ ‘ জোস’, ‘অসাম শালা’, ‘কুত্তা পাগল’, ‘জটিল’, ‘বীভৎস’ জাতীয় শব্দ। এবং এগুলোই এই দশকের সাহিত্যমালা। কাজেই কারো চাওয়া বা না চাওয়ায় কিছুই আসে যায় না, সময়ের প্রয়োজনে, সময়ের পরিবর্তনে, সময়ের দাবিতেই সাহিত্যে দশক, শতকের বেষ্টনি দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।

পাদটীকাঃ সাহিত্যে দশক থাকাই উত্তম। নাহলে আমার মত অসাহিত্যিক ভাবনা নিয়ে এমন অনায়াসে সাহিত্য বিষয়ক গুরুগম্ভীর আলোচনায় অংশ গ্রহণ করা যাবে না। সাহিত্যের কাল থাকুক, দশক থাকুক, শতক থাকুক, তবেই আমার লেখায় কেউ সাহিত্য খুঁজতে গেলে বলা যাবে, এটাই হচ্ছে বর্তমান সময়ের সাহিত্য! এর নাম কম্পিউটারাইজড সাহিত্য।

পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: আসল কথা বলা টাই মূলব্যাপার..যুগের ছাপ থাকবেই,কিন্তু কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠাটাই চ্যালেঞ্জ।

দুপুর মিত্র: ইয়াসমিন ফিদা হুসাইন ভাই আপনি যে বললেন, আমার কথা পরে বলবো। এবিষয়ে কবি শোয়াইব জিবরানের বিশ্লেষন আমার ভালো লেগেছে। তার কথা সরাসরি কোট করে দিলামঃ "দশকওয়ারি বিচার পশ্চিমা সাহিত্যে প্রচল রয়েছে। বুদ্ধদেব বসু ওটি বাংলা সাহিত্যে আমদানি করেছেন। মাইক্রো লেবেলে বিচারের ক্ষেত্রে এটি বেশ কাজের। এখন যে কবি লিখছেন তাকে যদি দেড়হাজার বছরের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দেখা হয় তাহলে তাঁকে বালছাল মনে হতে পারে। কিন্তু দশকবছরের ফ্রেমে দেখলে একটা জায়গা তাঁকে দেয়া যাবে। হ্যাঁ একটা সময়ে তাঁকে দেড়হাজার বছরের সাথেই লড়াই করে দাঁড়াতে হবে। সে সময়টা তাঁকে দিতে হবে। " আপনি যে রেফারেন্স টেনেছেন তার সাথে আমি একমত নই। কবিতা-গল্প-উপন্যাস সবই তো পশ্চিমা ফর্ম। এখানে আমদানি-রপ্তানির কোনও বিষয় নাই। শিল্পে আমদানি-রপ্তানি বলে কোনও বিষয় থাকে না। মানে শিল্পের দেশ কাল পাত্র থাকে না। দশকের ফ্রেমে কে দেখবে কখন দেখবে এটা আসলে সমালোচকের বিষয় না কবির বিষয় এটা কিন্তু দেখার বিষয়। দেখা যাচ্ছে কবিরাই দশক দখলের জন্য নানা বাটপারি করে যাচ্ছেন। এখানে কোনও সমালোচক কোনও কথাই বলছেন না। দশক তো আর চর নয় যে তাকে দখল করতে হবে। আর এটা সাহিত্যকে সমালোচনা করার একটা টুলস। সমালোচকরা যদি এই টুলস ধরে কাজ করেন তারাই বের করতে পারবেন কে কোন দশকের। এখানে সমস্যাটা হচ্ছে দখলের।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: সাহিত্যে আমদানি-রপ্তানি থাকতে পারে, সব শিল্পেই কিছু না কিছু থাকে। ... বাটপারি কবি বা সমালোচক কে কিভাবে করছেন এটা বুঝে ওঠাটা একারণে দায় হয়ে গিয়েছে যে একজন ব্যক্তিই একবার কবির পোষাক পরছেন, আরেকবার সমালোচকের পোষাক পরছেন।

কচি রেজা: যে-কারনেই দশকের চ'ল আসুক এইটা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বিভিন্ন সাক্ষৎকারেও কিন্তু দশক নিয়ে একটা দুটো প্রশ্ন থাকে। আমাদের কাজ হবে এইটাকে গুরুত্ব না দিয়ে টুলস হিসেবে দেখাই উচিৎ। কেউ যেন কারুর মুখ নিসৃত দশকের কবি হলেন না অথবা লেখক হলেন না বলে মনে না করেন তিনি কবি ই নন। কবির কাজ তার অতীত পিতাকে এবং অতীত বিশ্বকে আয়ত্ব করার চেষ্টা করা। আমার তো মনে হয় অতীত এবং সমকালের সন্তান হলেন
লেখক। সে আবার আগামীর ও রুপকার---অনেক দূর যিনি দেখেন, তিনি কি করে দশকের গুনতি কবি হ'ন?

দুপুর মিত্র: না বাংলা সাহিত্যে যা দেখা যাচ্ছে তাতে কবি কখনই সমালোচকের কাজ করেন না। ৯৯ ভাগ কবিরই সমালোচনা সাহিত্যের কোনও বই নেই। কেবল তরুণ কবিদেরই দেখা যায় দশক দখলের সময় তাদের সমালোচনা সাহিত্য নয় ক্ষমতার চর্চার মাধ্যমে দশক দখলের চেষ্টা। ইয়াসিন ভাই।

উষসী ভট্টাচার্য্য: আমি কচি দির সাথে একমত। দেশ কাল অতিক্রম করে গেলেই লেখা সাহিত্যের মানে পৌঁছোয়।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: আর দখলের রাজনীতি যেটা বলছেন সেটা আসলে এক ধরনের গ্রুপিং। যতক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সকলকে এক ফ্রেমে আনা না যাচ্ছে, ততক্ষণ তাকে দখল বলা যাচ্ছেনা। আর দখল শব্দটাই তো নেগেটিভ শব্দ, এটার মাধ্যমে কখনোই দশকে কাউকে এস্টাব্লিস করা যায় না।

দুপুর মিত্র: আমি কচি রেজার সাথে একমত নই। একমত নই এই কারণে যে দশক চল আসুক বলে কিছু বিষয় নেই। এটা চলের কোনও বিষয় নয়। এটা আবারও বলছি সমালোচনার একটা টুলস। যেমন মালায়লাম সাহিত্যে ১৯৪০-১৯৫০ এর দশককে পিংক ডিকেড বলা হয় পিংক দশক। এ সময় এখানকার কবিরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও মার্কসিজমের প্রভাবে ব্যাপক হারে কবিতা লিখতে থাকে। আবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৫০ এর দশকটাকে বলা হয় ড্রাম ডিকেড এই সময়ে জ্যাজ মিউজিক, সেবিনস এসব বেশ জনপ্রিয় হয়। এই যে এক এক দশককে এক এক নামে বলা হল এটা করেছে সমালোচক, একটি বিশেষ কবিতার বা সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যকে সামনে এনে। এখানে কোনও কবি কিন্তু বলে নি আমি এই দশকে এটা করেছি কাজেই এই দশকের বৈশিষ্ট্য এইটা। এটা আমার দশক।

ধরুণ ইয়াসীন ফিদা হুসাইন ভাই, শূন্য দশকের কোনও সংকলন ৯৭-৯৮ সালে বের করলেন কোনও কবি, তিনি নিজের দলের লোকজনকে নিয়ে একটা সংকলন করে ফেললেন এটা আপনি কি বলবেন? আবার ধরুণ এই সংকলনকে বয়কট করে আরেকদল তরুণ আরেকটা শূন্য দশকের সংকলন বের করলেন। এভাবে ৫/৬টা শূন্য দশকেরই সংকলন হল। পাঠক কোন সংকলনকে দশকের সংকলন মনে করবে। তারচেয়ে বড় কথা কবিরা এটা করছে এই ভয়
থেকে সে বোধহয় দশক থেকে ছিটকে গেল। অথবা দশক থেকে কেউ হয় তাকে ছেটে দিল। তাকে দশকে থাকতেই হবে। এ জন্য দাঙ্গা-হাঙ্গামা মারপিট ইত্যাদি।
অত্রি ভট্টাচার্য্যের বিষয়টা ভাবনার। আসলেই অমুক দশকের কবি এটা বরলে কবির পরিচয়টাই থাকে না। পরিচয় হয়ে ওঠে দশকের।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর: সাহিত্যে বিশেষত গল্পে তো দশকের বিষয়টা আছে। একজন লেখকের উত্থানকালকে এভাবে চিহ্নিত করা যায়। সেটা তার বয়সকে নিশ্চয়ই নির্দেশ করে না। আবার এতে কোন দশকে সাহিত্যের কী কী ধারার প্রবণতা বেশি তাও বোঝা যায়। এখন কথা হচ্ছে, হাসান আজিজুল হক বা অন্য সিনিয়রা যেমন ৯ দশকে লিখেছেন, তেমনি আমার বয়সের মশিউল আলম বা শাহাদুজ্জামানরা লিখছেন। আবার একই সময়ে বয়সের দিক থেকে জুনিয়র হলেও মাহবুব মোর্শেদ, রায়হান রাইন, অদিতি ফাল্গুনী, রবিউল করিম বা অন্যরা লিখছেন। অন্যদিকে আমাদের থেকে একটু জুনিয়র আহমাদ মোস্তফা কামাল, জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, পাপড়ি রহমানরা লিখে আসছেন। কিন্তু আমরা একটা সময়কেই ধারণ করছি। কাজেই আমাদের চর্চা কালের একটা ইতিহাসও তা হয়ে যায়। আমার ধারণা দশকের বিষয়টা থাকা উচিত। একে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও বোঝা যায়।

দুপুর মিত্র: কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাই, আপনি দশক থাকার পক্ষে মত দিয়েছেন। আমরা বলছি দশক থাকা না থাকার বিষয়টি তো লেখক-কবিদের ভাবনার বিষয় নয়। সমালোচকরা দশকের হিসেবে সমালোচনা করতে পারেন আবার মাসিক হিসেবেও সমালোচনা করতে পারেন। আমি বলছিলাম বাংলাভাষায় দশক বিভাজনটা আসলে কিভাবে করা হয়, কারা করে, কেন করে। এখানে দশক দখলের বিষয়, কবি-লেখকদের জন্য দশক তো দখলের বিষয় নয়, সমালোচকরা কবি-লেখকদের বিশ্লেষণ করবেন দশক দিয়ে। সেটা সে মাসিক দিয়েও করতে পারে। যেমন আমি আগে উদাহরণ দিলাম মালায়রাম সাহিত্যে পিংক দশক কিভাবে কেন সমালোচকরা বলেন, এটা কিন্তু কবিরা নিজেরা বলেন নাই আমরা এই দশক এই দশক এরকম। এটা একটা টাইমে বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেছে। কিন্তু আমরা ক্রমাগত দশককে নিয়ে যাচ্ছি কোথায়, বা লেখকরা দশকের ভিতরে আদৌ থাকতে পারেন কিনা। লেখক দশককে ছাপিয়ে ওঠেন কিনা।

সন্দ্বীপক মল্লিক: সবকিছু ঠিক থাক, তবে, প্রগতিজ্যোতির্বলয়ই মূলকথা । কে কতো মানবিক মূল্যবোধকে আত্মঃস্থ করছেন, সেটিই মূলবিষয় ।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: এবার আমার বক্তব্য বলি। কবিতায় দশকের বিষয়টা নিয়ে আসাটা মাঝে মাঝে আমার কাছে একশ্রেণীর ধূর্ত কবি, সাহিত্য-সমালোচক, ও সাহিত্য সম্পাদকদের একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফাঁদ বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে নবীন এবং অসচেতন কবি/লেখকেরা এর শিকার। একটা উদাহরণ দেই, কোন কবি বা লেখক যদি বলেন অমুক দশকে আবু হাসান শাহরিয়ার আমার প্রিয় কবি, তখন কিছু অনুসিদ্ধান্ত সাথে সাথে টেনে ফেলার চেষ্টা করা হয়, যেমন উনি
শামসুর রাহমান ঘরানার কবি, আল-মাহমুদীয় নন। আদতে হয়তো উক্ত কবি এই দু'টির একটিও বোঝাতে চাননি। ... দশকের আলোচনাটা যদি আসতেই হয় তাবে কেবলমাত্র তা সময় নিরূপকের ভূমিকায় থাকতে পারে, ঐ সময়ে কবিতার সাহিত্যগুণ বা প্রভাব নিরূপণের ভূমিকায় নয়।

দুপুর মিত্র: আরও বিস্তারিত বলবেন কি, ইয়াসমিন ফিদা হুসাইন?

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: দুপুর মিত্র, তাত্ত্বিক বিষয়গুলোতে একটু অল্প কথাতেই বলার চেষ্টা করি। তবে কোন স্পষ্ট আলোচনা থাকলে অবশ্যই অংশ নিবো। আমরা এখনো নতুন, অনেক সাবধানে পা ফেলতে হয়।

দুপুর মিত্র: কিন্তু সেটা তো পরিষ্কারভাবে বলতে হবে। তা না হলে তো বুঝতে পারব না। আপনার বলার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আরেকজনকে জানানো, বুঝানো।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: পরিষ্কার করার জন্য তো একটা উদাহরণ দিয়েছি।

দুপুর মিত্র: একটা উদাহরণ দেই, কোন কবি বা লেখক যদি বলেন অমুক দশকে আবু হাসান শাহরিয়ার আমার প্রিয় কবি, তখন কিছু অনুসিদ্ধান্ত সাথে সাথে টেনে ফেলার চেষ্টা করা হয়, যেমন উনি শামসুর রাহমান ঘরানার কবি, আল-মাহমুদীয় নন। আদতে হয়তো উক্ত কবি এই দু'টির একটিও বোঝাতে চাননি।' এই বাক্যের অমুক দশকের বলার সমস্যাটা কোথায়? ইয়াসমিন ফিদা হুসাইন।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: অমুক দশক বলায় বক্তার কোন সমস্যা আছে তা তো বলিনি। আমি বলেছি সমস্যাগুলো অকারণ অনুসিদ্ধান্তে।
দুপুর মিত্র: দশক নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তো একারণে, তাহরে দশকে কোনও সমস্যা নেই। ইয়াসমিন ফিদা হুসাইন।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: এই যে সমস্যাটা তৈরি হতে যাচ্ছে, আপনি সংকলনে লিপিবদ্ধ করতে চাইছেন হয়তো ['ইয়াসীন ফিদা হোসেন' এর মতে কবিতায় দশক বিষয়টাতে কোন সমস্যা নেই] ... অথচ আমি কিন্তু আগেই বলেছি "কবিতায় দশকের বিষয়টা নিয়ে আসাটা মাঝে মাঝে আমার কাছে একশ্রেণীর ধূর্ত কবি, সাহিত্য-সমালোচক, ও সাহিত্য সম্পাদকদের একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফাঁদ বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে নবীন এবং অসচেতন কবি/লেখকেরা এর শিকার।" "অমুক দশক বলায় বক্তার কোন সমস্যা আছে তা তো বলিনি। আমি বলেছি সমস্যাগুলো অকারণ অনুসিদ্ধান্তে।" এবং "অমুক দশক বলায় কোন সমস্যা আছে তা তো বলিনি। আমি বলেছি সমস্যাগুলো অকারণ অনুসিদ্ধান্তে।" --- লাইন দু'টিতে একটিমাত্র শব্দ পার্থক্য করে দিচ্ছে। আমার বক্তব্য প্রথমটি এবং উক্ত লাইনে বক্তা দশকের বিষয়টি আনছেন শুধু সময় নিরূপনে, আর কোন উদ্দেশ্যে নয়।

দুপুর মিত্র: আচ্ছা এবার আপনার কাছে জানতে চাই দশক ভিত্তিক সমালোচনা সাহিত্য কি আপনার মতে বাংলাদেশে গড়ে ওঠেছে না কবিরাই নিজেদের অমুক দশকের বলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই. দশক ভিত্তিক সমালোচনা সাহিত্য কি সমালোচনা সাহিত্যে খুব ইফেকটিভ কোনও টুলস বা উপাদান। ইয়াসমিন ফিদা হুসাইন। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছেও একই প্রশ্ন দশক ভিত্তিক সমালোচনা সাহিত্য কি আপনার মতে বাংলাদেশে গড়ে ওঠেছে না কবিরাই নিজেদের অমুক দশকের বলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই. দশক ভিত্তিক সমালোচনা সাহিত্য কি সমালোচনা সাহিত্যে খুব ইফেকটিভ কোনও টুলস বা উপাদান।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: সমালোচনা সাহিত্যে না বলে সাহিত্য সমালোচনায় বলাটা উপযুক্ত মনে হয়। ... দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর ইতিমধ্যে দিয়েছি। দশকের আলোচনা শুধু সময় নিরূপনে আসতে পারে, ঐ সময়ে সাহিত্যের গুণ বা প্রভাব নিরুপণে নয়। প্রথমটির বিষয় বলবো, সত্যিকারের কবি কখনো এধরনের প্রচারণা চালাননা। দশকভিত্তিক সাহিত্য সমালোচনা কিছু ধূর্ত কবি, সাহিত্য-সমালোচক, সাহিত্য-সম্পাদক করতে চাইছেন, নাম জানতে চেয়ে বিব্রত করবেননা প্লিজ।

হীরক মুখার্জী: দশক তো একটা আঙ্কিক ভাষা, কালের প্রেক্ষাপটগুলিকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য। নব্বই'র দশকের কোনো কবি সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে কবিতা লিখলে তাকে কোন দশকের কবি বলা হবে?! কবিতা দশকের আধারে থাকুক, কাম্য নয়, দশকই বরং কবিতার আধারে ফুটে উঠুক।

জুবিন ঘোষ: একথা ঠিক দশক বিভাজনের এই কনসেপ্ট না নব্য আমদানি বাংলা বাজারে , তবে এর কোনও খারাপ দিক পাই না । কবিকে একটা সময় হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে যাতে যারা জানেন না তাঁদের কাছে তিনি কোন সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন বোঝা যায় । এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে কবিকে কি সময় দিয়ে বাঁধা যায় । এটা কিন্তু এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয় । কবিতা কালজয়ী , সর্বসময় ও সতত অনুভূতিকে ব্যক্ত করলে কালজয়ী হবেই । কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে কবি একজন
চলমান হিস্ট্রি চ্যানেল । তিনি একজন ঐতিহাসিক নথি । তার সমসাময়িক প্রেক্ষাপট কবিটাতে ফুটে ওঠে । দশক একটা শর্ট টাইম জোনকে নির্দেশ করে,প্রত্যেকটা সময় আমাদের জীবনের অনুসঙ্গ পাল্টাচ্ছে, কথাবলার ভাষা পাল্টাচ্ছে , এটা ৩০ এর দশকে এই ভাষারীতি ছিল না । কেন ছিল না , কারণ আমেরিকান ও ইউরোপীয় মডার্নিজম এর ধাপ্পাবাজিটা মানুষ তখনও গ্রহণ করেনি । স্বাধীনতার পরেও না পাবার অবক্ষয়টা আসেনি । মানুষ এত একা হয়ে পড়েনি । অনেক অনেক
কারণ । তাই এই সময়টাতে এই কাব্যভাষাও একএকটা ইতিহাসের দর্পন । সেটাকে সহজ ও প্রাথমিক পরিচয় দেবার জন্যই ছোট ছোট টাইমজোনে ভাগ করে দেওয়া ও দশক বিভাজন । এটা আমার চোখে কিন্তু ক্ষতিকারক নয় । বাকিদের ব্যক্তিগত দর্শন আলাদা হতেই পারে । আমি দশকের কবিতা বলেছি, কবির দশক বলিনি ।

দুপুর মিত্র: কিন্তু জুবিন ঘোষ, দশক বিভাজন তো কবি-লেখকদের কাজ নয়, কাজ সাহিত্য সমালোচকদের। তবে দেখা যাচ্ছে এই কাজ সাহিত্য সমালোচকরা না করে করে যাচ্ছেন কবি-লেখকেরাই এটাকে কি বলবেন। এটা করছে তারা যেন দশক থেকে ছিটকে না যায় বা কেউ যাতে দশক থেকে তাদেরকে ঝেড়ে ফেলে না দেয়। এটা অনেকটা অনেক কবি সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে জীবন-মরণের লড়াইয়ের মত। দশকে থাকতে না পারলে বা নিজের নাম কোনও রকম দশকে না ঢুকাতে পালে সে যেন লেখক-কবিই নয়। এটাকে আপনি কি বলবেন?

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: জুবিন ঘোষ, দশকের কবিতা বললেও কথা থেকে যায়, কবিতায় কি শুধু সমসাময়িক চিত্রই ফুটে ওঠে। আজ যদি আমি দেশভাগের কবিতা লিখি আমার কবিতাকে কোন দশকের কবিতা বলা হবে?

জুবিন ঘোষ: সেটা তাদের ইনসিক্যুরিটি কমপ্লেক্স, কিন্তু দশক সময়সূচক একটা হিসেব, একশ বছর আগে এই প্রয়োজন ছিল না, কারণ কবির সংখ্যা তখন কম, এখন অনেক কবি, ঘটনা প্রবাহ অনেক, কবির স্মপর্কে আর তার সমকাল সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা করার জন্য কোন দশক আমরা জিজ্ঞেস করেই থাকি, সংকলনে অন্তর্ভূক্ত হোন আর না হোন সূচক হিসেবে তো থেকেই যান । সংকলনে অন্তর্ভূক্ত না হলেও কেউ দশক বর্হিভূত তো নন । ইনসিক্যুরিটি কমপ্লেক্স থেকে যারা যা কিছু করেন সেটা তাদের ধারণা বর্হিভূত, আদপে তিনি ভুলে যান তিনিও কোনো-না-কোনো একটি দশক অন্তর্ভূক্ত। ভালো লিখলে সে আবিষ্কৃত হবেই।

দুপুর মিত্র: কাজেই আমাদের মনে হয় কবি-লেখকদের দশক নিয়ে ক্ষমতা চর্চা না করাই ভাল। জুবিন ঘোষ, তবে সমালোচনা সাহিত্য দশক কতটা কার্যকরী এই বিষয়টা নিয়ে আলচনা করলে একটা ভাল ধারণা তৈরি হবে আমাদের মনে হয়। এ ব্যাপারে আপনি কিছু বলবেন কি?

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: জুবিন ঘোষ, সেই অর্থে আমি আর আপনি একই কথাই বলছি, দশক একটা সময় নিরূপকমাত্র, এর বেশি কিছুনা।

সিদ্ধার্থ শর্মা: আমি তো পদাবলী , চর্যাপদ লিখি আমাকে কি প্রাগ ঐতিহাসিক ঋণাত্মক দশকের বলা হবে?

বীরেন মুখার্জি: দশক বিভাজন যেভাবেই ঘটে থাক না কেন- বিষয়টি এখন লেখক-কবিদের এক ধরনের স্ট্যাটাস হিসেব দাঁড়িয়েছে। দশক আলোচকদের বিষয় হলেও বর্তমানে কবি-লেখকরা এটা নিয়ে মাতামাতি-ফাটাফাটি করছে, যা দুঃখজনক। এটাকে বৃত্তাবদ্ধ মানসিকতা হিসেবে দেখা যায়।
কবিতার সহযাত্রীরা মহাকালের চিন্তা করেন সমকালকে সঙ্গে নিয়ে। অপরপে যুদ্ধংদেহি মনোভাবসম্পন্ন কবিকূল, যারা দশক নিয়ে আস্ফালন করেন। নজরুল ইসলাম সমকালীন যে মর্মপীড়া নিয়ে 'বিদ্রোহী' কবিতা লিখেছিলেন, তা কি আজকের যুগে এসেও অস্বীকার করা যায়? তাহলে নজরুল কি এসময়ের কবি নন? কেন তাকে 'দশক' দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে!! আবার জীবনানন্দ দাশ কবিতা লেখা শুরু করেন ৩০ বছর বয়সে কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যদের সময়পর্বে। কিন্তু তার উপস্থাপনা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের চেয়ে অন্তত ১০ বছরের ছোট হলেও তিনি সেই তিরিশ পর্বের কবি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দশক টুলস বৈ নয়। সুতরাং ঢালাওভাবে আমি দশক সমর্থন করতে পারি না।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: আমার মনে হয় দশক বিষয়ে অবস্থানটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এই আলোচনা আর বেশিদূর এগোবেনা।

দুপুর মিত্র: মানে কি ? ইয়াসমিন ফিদা হুসাইন

সিদ্ধার্থ শর্মা: কবিতা আর যাই হোক গাণিতিক সংখায়নে এর মূল্যায়ন অনভিপ্রেত। মনে রাখতে হবে গণিত যেন কবিতাকে ফলো না করে - কবিতা যদিও মানসিক

পরিমিতি কে নির্দিষ্ট আকার দেয় - অজান্তেই ...ফিবোনাক্কি
অনুমিত অধ্যুষিত গন্ডিতে ব্যপ্ত
কুসুমিত ভালোবাসার ফিবোনাক্কি।
মহুলিয়া আবেগিত আকন্ঠ নিমজ্জিত চঞ্চল ছন্দিত
দারুচিনি অনুভবে ফুলেল ভালোবাসার ফিবোনাক্কি।
আর কি কিছু আলোচনা হবে?

দুপুর মিত্র: হায় হায় কি বলেন আলোচনা তো চলছে। সিদ্ধার্থ শর্মা, আপনি যেভাবে দশককে দেখছেন তাতে বিষয় ও দশক মানে কন্টেন্ট ও টাইমকে মিলিয়ে ফেলেছেন। মানে আপনি চর্যাপদ লিখলে সেটা চর্যাপদের যুগ হয়ে যাবে কেন? বলা হবে এই সময়ে আপনি চর্যাপদ লিখছেন। দশকের বৈশিষ্ঠ্য তৈরি হয় পরে। সেটা করে সমালোচনাকারীরা। একাডেমিসিয়ানরা। আর এখন বাংলা ভাষায় সাহিত্যে এমন সময় এসেছে কবি-লেখকরাই বলে দেন আমরা এই দশকের কবি, আমাদের বৈশিষ্ট্য এই। মানলে মানেন না মানলে খবর আছে।

সিদ্ধার্থ শর্মা: কথাটা হচ্ছে আমাদের আলোচনাটা কে কতটা বিস্তৃত করতে চাইছি আমরা। এর আকাশ কত বড়? যদি ফোকাস টা কেবল মাত্র আধুনিক কবিতার আঙ্গিকে হবে তাহলে সেই ভাবে আলোচনায় থাকব - আর যদি খুঁজতে চাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দশকের প্রাসঙ্গিকতা তাহলে ভাবনাটা সেভাবেই ব্যক্ত করব।

দুপুর মিত্র: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দশকের প্রাসঙ্গিকতা- আপাতত এভাবে শুরু করা যাক, সিদ্ধার্থ শর্মা।

জুবিন ঘোষ: সিদ্ধার্থ শর্মা, তোমার বক্তব্য ধরে বলছি তুমি যদি এই সময় দাঁড়িয়ে পদাবলি, চর্যাপদ লেখো সেটাও তো একটা তাৎপর্য্যপূর্ণ , তুমি এই সময় দাঁড়িয়ে সেটা লিখছ , এটাই তো তাৎপর্য । সেক্ষেত্রেও তোমার লেখালিখির সময়টাই বিবেচিত হবে , তাতেও তুমি সমকালীন দশক-বর্হিভূত হলে না , বরং এই সময় দাঁড়িয়ে তুমি আদি রসের যে কাজটি করলে সেটাই চিহ্নিত হবে। এই সময়ের চোখে নতুন করে পদাবলি বা চর্যাপদ ।

সিদ্ধার্থ শর্মা: হা হা হা দুপুর দা তাহলে তো অবাক হব না কিছুদিন পরে কোনো কবি সম্মেলনে দশক ভিত্তিক ব্যাচ বিতরণ করা হলে - এই কবির বুকে সবুজ ব্যাচ তো ওনার বুকে হলুদ ব্যাচ - উনি এই দশকের আর ইনি ওই দশকের ...হাহাহাহাহা ...সমালোচক দের বায় নাক্কায় কেলোর কীর্তি ..

হীরক মুখার্জি: তাহলে মোটামুটি একটা সামারাইজ করা যেতে পারে যে, অমুক দশকের কবি মানে, তিনি যে সময়ে লেখালিখি করেছেন, তাঁর লেখা সেই সমকালীন প্রভাবেই প্রভাবিত হবে, তাই তো?

দুপুর মিত্র: সিদ্ধার্থ শর্মা, আমি বিষয়টাকে এভাবে বলিনি। যেমন ধরেন জীবনানন্দ দাশকে তিরিশের কবি বলা হয়। এটা জীবনানন্দ দাশ নিজে করেন নি। একাডেমিসিয়ানরা করেছেন। কবি-শিল্পীরা কখনই একাডেমিসিয়ান- সাহিত্য সমালোচকদের মেনে চলেন না। সত্যি কথা বলতে সমালোচনা সাহিত্যকে অনেকে তৃতীয় শ্রেনীর সাহিত্য বলেই মনে করে। দশককেও কবিরা মানেন না। কিন্তু একাডেমিসিয়ানরা নিজেদের স্বার্থে এটা ব্যবহার করেন। আবার এটা করেন বলেন জীবনানন্দ সেই দশকে আটকে থাকেন বা আছেন বিষয়টা এমন নয়।

দুপুর মিত্র: হীরক মুখার্জি contemporary poetry মানে contemporary বিষয় নয়। অনেক কিছুই বিশ্বজগত, মহা জগত সব কিছুই কবিকে প্রভাবিত করে। অতীত, বর্তমান , ভবিষ্যত সব।

সিদ্ধার্থ শর্মা: জুবিন দা ভুল কিছু বলোনি - সেটা আমিও রিয়েলাইজ করি। অপভ্রংশ সৌরশেনি লিখলে কেউ রে রে করে বুঝলাম না বুঝলাম না - কেউ আবার হা হা করে ছুটে আসে - ইটা কি হলো? বাংলা তদ্ভব দিলে কেন? তত্সম অন্তত দাও নইলে .. "যাও কিসসু হয় নি!" আরও পড় আরও পড় "আমার মনে হয় পাঠক দের মধ্যেও অবচেতনে দশক বোধ তা কাজ করে ........জুবিন ঘোষ ও দুপুর মিত্র।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর: দুপুর মিত্র, একজন লেখক নিজেকে স্থাপন করে মাত্র, নিজের সৃষ্টিশীলতার তাগিদেই তা করেন, এখানে ছাপিয়ে উঠার প্রশ্ন আসে কেন? দশক দিয়ে বাহাদুরি করার কিছু নেই। দশক শুধু সমালোচকের নয়, লেখকেরও। যেমন, আমরা যেই সময়ে লেখা শুরু করলাম, সেই যে স্বৈরাচার পতন আর সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের উত্থানপর্ব, নিজেকে জানার সেই সময়টা, মোকাবেলার সময়টায় নিজের কাজটি করতে পারলাম কিনা, সেটা তো সময়ই প্রকাশ করে। কাজেই দশককে আমি একজন লেখক বা সমালোচক হিসাবে বাদ দিতে পারি না। লেখক মানেই উচ্চমার্গীয় কিছু আর আলোচক মানেই লেখকদের খোখ-খবর করণেঅলা ধরনের কিছু বলে আমি মনে করি না।
সমালোচনার অনেক উপাধানই থাকে, এর ভিতর দশকও একটা দরকারি বিষয়।

সিদ্ধার্থ শর্মা: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দশকের প্রাসঙ্গিকতার ছাপ রয়েছে। অজান্তেই ...মনে রাখতে হবে কবিতা কিন্তু সাহিত্যের আদি রূপ, গদ্যের জন্ম অনেক পরে -- প্রথম দশক বলতে চর্যাপদ কেই বোঝানো যায় , এর পর বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ ..তুর্কি আক্রমনের ফলে। প্রথম দশকে সাহিত্য নিদর্শন হিসাবে আমরা পেয়ে থাকি বড়ু চণ্ডীদাসের পদাবলীতে , শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন কাব্য তে - লেখাতে সময়ের ছাপ স্পষ্ট (এই দশক মানে ১০ বছর নয় বহু কাল)...

দুপুর মিত্র: আমার মনে হয় পাঠক দের মধ্যেও অবচেতনে দশক বোধ তা কাজ করে। হ্যাঁ হয়ত করে। কিন্তু এই অবচেতনাবোধটা সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর। এটাকে আঘাত করা জরুরি। সিদ্ধার্থ শর্মা।

হুঁ কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, এটা আপনি মনে করে না করার জায়গা থেকে শুধু বলছেন বলে ধরে নিচ্ছি না। আমার ধারণা কোনও লেখকই চান না সে কেবল সেই দশকেই আটকে থাকুক আবার এরকম করে কোনও লেখকই চান না দশক ধরার জন্য সে মারপিট করুক। যদিও এটা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাপিয়ে ওঠার প্রশ্ন এই কারণেই আসে যে সে শুধু দশকের নয়, মহাকালের। অনন্ত কালের। দশক সে হিসেবে একটা তেলাপোকা মাত্র। আপনি যে বাংলাদেশের নব্বই দশককে নিয়ে এসেছেন স্বৈরাচার পতন এসব দিয়ে আবার এই জায়গাতে আমি একটু জুড়ে দিতে চাই এই স্বৈরাচার শাসকই আমাদের নতুন সাহিত্য দিয়েছে যেটা হুমায়ূন আহমেদরা চর্চা করেছেন। মানুষের কথা নয়, মানুষকে নতুন হাস্যকর জগতে নিয়ে যাবার। সেই নব্বই দশককে যখন আমরা সমালোচনা
করব তখন সে সময়কার সমস্ত লেখকদের ভূমিকা নিয়েই সমালোচনা করব। যেমন ধরুন সৈয়দ হকের ভূমিকা নিয়েই। সেক্ষেত্রে রাজনীতি যদি ইনডিকেটর হয় দশক সেখানে বিষয় নয়, কে কখন লিখছে সেটাও বিশেষ কিছু নয়। কেবল দশক সাময়িক সময়ের পণ্য মাত্র। এই ভাবে ভাবা যায় কি?

সিদ্ধার্থ শর্মা: তবে আলোচনা যদি আধুনিক সাহিত্য কে ঘিরে হয় আমার মনে হয় তা দুটি ভাগে ভাগ করতে হবে --- ১) রবীন্দ্রপূর্ব যুগ (দশক না বলে যুগ বললাম), ২) রবীন্দ্রোত্তর যুগ .....
এই দ্বিতীয় যুগ টাতেই যত হিসেবের মারপ্যাচ শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ কবি-ই নিজের মত করে লিখে যান প্রানের আনন্দ নিতে - মুষ্টিমেয় কয়েকজন হিসেব নিকেশে বসেন গুছিয়ে নিজের মত করে নিজেকে সকলের থেকে আলাদা প্রতিপন্ন করতে - এরাই সমালোচক সৃষ্টি করেন - পৃষ্ঠ পোষকতা দেন - সমালোচক রাও বেশ কিছু অভ্ধানিক অপভ্রংশ ব্যাখ্যা তুলে ধরেন .... কবি ভাবেন "তাই তো! আমার তো দশক নাই! ওই সমালোচকের গুন গাই!" অবশ্যই এই সব দশক ভাবনা পাঠক (অবচেতনে) ও সমালোচকেরা করতে পারেন সচেতনে নিজেদের একজিসটেন্স টিকিয়ে রাখার জন্যে - কিন্তু কবি তারাই যারা খুব সুন্দর ভাবে মন, পরিবেশ ও অর্থ সামাজিক চিত্র কে প্রকাশ করতে পারেন - যাদের প্রকাশের রহস্য সৃষ্টি করবার ক্ষমতায় তাদের স্বকীয়তা দেবে ... সৃষ্টির সুখ কবি কবিতা ও পাঠক (সমালোচক ইনক্লুডেড) সকলেই পাবে - আমার বক্তব্য শেষ করছি - অনেক ধন্যবাদ এই আলোচনাতে ডাকার জন্যে - জুবিন ও দুপুর।

জুবিন ঘোষ: হীরক মুখার্জি, আমার মনে হয় সঠিক সামারাইজড্‌ হলো না, তোমার কথা মতো "অমুক দশকের কবি মানে, তিনি যে সময়ে লেখালিখি করেছেন, তাঁর লেখা সেই সমকালীন প্রভাবেই প্রভাবিত হবে" এটা তো হামেশাই দেখা যায় যে সমকালীন হলেও অনেকের ভাষা রাবীন্দিক যুগেই বা চল্লিশ বছরের পুরুনো ভাষাতেই আটকে আছে । তাই সমকালীন প্রভাবেই প্রভাবিত হবেই এমন নাও হতে পারে । তবুও দশক বহির্ভূত নয় । দশক মানে এই সময় থেকে এই সময় লেখালিখি শুরু বা উত্থানের শুরু, বা মোটামুটি তার সাহিত্যসাধনা শুরু হয়েছে । সে সমকালীন প্রভাবমুক্ত বা যুক্ত দুটোই হতে পারে ।

হীরক মুখার্জি: বাহ্‌ ! বড় সুন্দর বললে জুবিন'দা ! কনফিউশন ছিলো এখানেই, এখন নেই

উষসী ভট্টাচার্য্য: যদি দশক মেনে নিতে হয়, তবি সাহিত্যিক রা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা কথা টা ভুলে যেতে হয়

দুপুর মিত্র: বেশ ভাল একটা পয়েন্ট এনেছেন আপনি উষসী ভট্টাচার্য্য। এ বিষয়ে আন্যান্যদেরমন্তব্য আশা করছি।

পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: আমি এইদশকের কবি,এটা একটা সময়চিহ্ন হলে ক্ষতি কি,অতীতপ্রভাব আছে কিনা,তিনি কালজয়ী হবেন কিনা,সেটা ঠিক করবে তার লেখা।

দুপুর মিত্র: তাহলে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি। কবি বা লেখক দশক মেনে নিলে সে কি দশক বন্দী হয়ে যায়। দশক বা এই ১০ বছর সাহিত্যের জন্য কি অনেক বড় সময় না ছোট বিষয়? উষসী।

পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: শুন্যদশকের কবি মানে শুন্যের সাম্প্রতিক আগে বা পরে যারা লিখছেন,এবং তাদের লেখায় যুগবৈশিষ্ট্য থাকাটাই স্বাভাবিক,সাহিত্যচর্চা শুধু সাহিত্যচর্চার জন্যে হলে ঠিক আছে,কিন্তু তাকে যদি তত্কালীন সময়ের আয়না করে তুলতে হয় তবে দশকের প্রভাব অনস্বীকার্য..আর যুগ বহির্ভূত। কিছু থাকবে না,তেমনও নয়..কিন্তু সেটা অবশ্যই সামনের দিকে হওয়া দরকার..

দুপুর মিত্র: দশক কি কখনও প্রভাব ফেলে না প্রভাব ফেলে লেখক? পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়।

পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: কেউকেউ অবশ্য শীতে অন্তর্বাস আর গ্রীষ্মকালে গরম শাল গায়ে ঘুরতে ভালবাসেন l ওটাকে ব্যতিক্রম ধরে নেওয়ায় ভালো

দুপুর মিত্র: মানে কি? পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়।

পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: অবশ্যই দশক প্রভাব ফেলে l বর্তমানের জটিলতা,কলুষতা,তীব্র যৌনতার প্রকাশ,সাহিত্যে প্রভাব ফেলবেই l কিন্তু যখন কেউ কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠেন,তখন সময়কে নিজের আঁচলে ভরে নেন.তখন যুগের পরিবর্তে ব্যক্তিঅনুসারী বা ব্যক্তিবিরোধী হয়ে ওঠে পরবর্তী সাহিত্যজগত, সেটাও কিন্তু আপেক্ষিক সময়ের প্রভাবই..।

দুপুর মিত্র: দশককে যদি আমরা ইউনিট অব টাইম ধরি, এটা ১০ বছর সময় হয়। শুধু লেখককে নয়, একজন মানুষ কি শুধুমাত্র ১০ বছরে প্রভাবিত হয় বা শুধুমাত্র এই ১০ বছর প্রভাবিত করতে পারে? পীযূস কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়।

পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: তা কেন? মানুষ একটু একটু করে সবসময় বদলে যাচ্ছে..তার যাপন, শিক্ষাদীক্ষা, বাহ্যিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করবে তার বদলে যাওয়ার হার..ইউনিট অফ টাইমে দশের জায়গায় বিশ হলেও তর্ক টা একই থাকত,সময় মানুষকে প্রভাবিত করবেই..এবার ব্যাপার হলো..আশির প্রভাব একানব্বইয়ের উপর যতটা থাকবে, নিরানব্বইয়ের উপর ততটা অবশ্যই থাকবে না। সে দশকের পরিবর্তে শতক হলেও এই আর্গুমেন্ট চলতই..

বীরেন মুখার্জি: তেমনটি মনে করি না। ১০ বছর যথেষ্ট সময় নয়।একজন কবির উত্থানপর্বকে ‌'দশক' বিবেচনায় ধরে নিয়ে বলি, তিনি সে সময়ের কাব্যভাষা আয়ত্ব করতে সমর্থ হলেও সার্বক্ষণিক নিজেকে নবায়ন করতে থাকেন। যেহেতু যাপনের প্রভাব, যুগযন্ত্রণা ইত্যাদি তার মধ্যে ক্রিয়াশীল। উদাহরণ দেই....প্রভাত চৌধুরী ১০ বছর কবিতা রচনা থেকে বিরত থাকার পরও তিনি কিন্তু নিজেকে ফিরিয়ে এনেছেন কবিতায়। তিনি বলেন, 'রবীন্দ্রনাথ এসময় বেঁচে থাকলে যা লিখতেন, আমি তাই লিখছি।'

পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: রাতে আবার আসছি..কতদিন মনভরে কথা বলা হয়নি

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: দুপুর মিত্র, ফিরে এলাম একটা বিষয়ে বলার জন্য। "এই স্বৈরাচার শাসকই আমাদের নতুন সাহিত্য দিয়েছে যেটা হুমায়ূন আহমেদরা চর্চা করেছেন। মানুষের কথা নয়, মানুষকে নতুন হাস্যকর জগতে নিয়ে যাবার।" --- 'স্বৈরাচার শাসক আমাদের নতুন সাহিত্য দিয়েছে' এটা কিভাবে বলা যায় বা প্রমাণ করা যায়? আর হুমায়ুন আহমেদরা বলতে কি বোঝালেন তাও বোঝা গেলোনা, রবীন্দ্রনাথের সমকালে যারা লিখতেন তাদের কি তবে "রবীন্দ্রনাথ"রা বলবেন?
(আমি এখানে সাহিত্যকীর্তির তুলনা করছিনা।) সবশেষ হুমায়ুন আহমেদ (রা অংশটা কেটে দিলাম) স্বৈরাচারপ্রদত্ত সাহিত্যচর্চ্চা করেছেন তাই বা কিভাবে বললেন? ব্যাখ্যা কাম্য।

জুবিন ঘোষ: দুপুর মিত্রকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে খুব মন চাইছে । আলোচনার প্রথম দিকে দেখলাম যে দুপুরবাবু দশক বিভাজনের উলটো প্রান্তে ছিলেন ideologically , এক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন, আপনি যদি দশক ভাবনার বিপরীতেই থাকেন তাহলে অলস দুপুরের বিভিন্ন ইন্টারভিউতে তরুণ কবিদের কাছে আপনার একটা কমন প্রশ্ন থাকে "আপনি নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি? " - এই প্রশ্নটা কি কিছুটা অবচেতনেই
আপনার নিজের মধ্যেই দশক ভাবনা মেনে নেওয়াই হয় না ? এই ভাবনাতেও তো আপনি আপনারই অবচেতনে বা সচেতনে দশক বিভাজনের মাধ্যমে একটা সময় সূচককেই ধরে নিচ্ছেন প্রথমেই । দুপুর বাবু আমার মনে হয় এখানেই দশকের প্রয়োজনীয়তা । একটা টাইম আর স্পেসকে ধরতে ।

দুপুর মিত্র: দুইজনের প্রশ্নই বেশ ইন্টারেস্টিং আমি এক এক করে উত্তর দিচ্ছি। ইয়াসিন ও জুবিন।
রেজওয়ান তানিম: আলোচনা ভাল লাগল দেখতে, যদিও ঘুরে ফিরে একই কথা। কেউ দশকের পক্ষে কেউ বিপক্ষে। আসলে দশকবাদী চিন্তা থাকলেও যা না থাকলেও তা। আমি ঠিক জানি না বিশ্ব সাহিত্যে দশকীয় রীতির এত ব্যাপক প্রচলন আছে কিনা। বাংলা সাহিত্যে একে যে ভাবে দেখা হয় তাতে মনে হয় কবি বা লেখক হবার এটাই প্রধান ক্রাইটেরিয়া, আপনাকে একটা নির্দিষ্ট দশক ধরে চলতে হবে। সেই দশকের সব কটি সংকলনে আপনাকে পাটিসিপেট করতে হবে। যদিও আমার বিশ্বাস এতে খুব বেশি আশা যাওয়ার কিছু নাই তাদের, যারা মূলত সত্যিকার সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক। দশকিয়া ধারাটাই আমার মতে একটা মোটামুটি ব্যর্থ জিনিস যা সাহিত্যে নতুন ধারা তৈরির বিষয়টিকে কখনোই ডিফাইন করতে পারেনি। কেননা এত স্বল্প সময়ে কোন ভাষাতেই কবিতা গল্পের আঙ্গিক কাঠামো বদলের নজির নাই। আমাদের মগজের উপনিবেশ গত কারনে যাদের আমরা আমাদের সাহিত্যের পুরোধা মনে করি তাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ভিক্টোরিয়ান এজ, ক্লাসিক্যাল এজ এভাবে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সাহিত্যের সুরবিচার কার্যে আগাতে। আর এই যে আমরা বাংলা সাহিত্যে ত্রিশের দশক বলে যে এত গলা ফাটাই ত্রিশের দশকের কবিদের আমরা কবি হিসেবে আলাদা সুরের চিনতে সমর্থ হয়েছি মধ্য চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ অব্ধি সময়ে। সে বিবেচনায় দশকিয়া চিন্তারীতির সাহিত্যিক মূল্য নাই তেমন।কিন্তু কবিতা কোন একদর্শীয় চিন্তার বিষয় না, তাও আমরা জানি। আর এখানেই এত বিভক্তি। দশকিয়া চর্চা আমি যখন কবি তখন মূল্যহীন লাগলেও যখন আমিই সমালোচক রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সময়ের সত্যিকারের কবি অকবির তালিকা ফর্দ তৈরি করতে গেলে কিন্তু দশকের কাছে আশ্রয় নেই। এর কারন কি ? কারন যারা দশক প্রচলন করেছিলেন তারাই দশকরীতিকে কোন না কোন ভাবে সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের আমল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে যুগ সন্ধিক্ষণ, ক্লাসিক কিংবা রোম্যান্টিক ধারা প্রবল আকারেই ছিল। ওর থেকে নিজেদের পৃথক করতেই বুদ্ধবাবু ও তার পাণ্ডবেরা করলেন ত্রিশের দশকের প্রচলন। তারা ভাল করছেন কি খারাপ আমি তার বিবেচনায় যাব না, আমার বিবেচনা সামথিং নিউ। ওটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই দশকের চর্চাও তো প্রায় আশি বছরের বেশি হয়ে
গেল। একাডেমিক কিংবা সমালোচকরা এ চর্চা করুন সমস্যা নেই কিন্তু কবিরা কেন এখনো এ্ চর্চা করেন, যে চর্চা বিগত দশক গুলোতে সর্বজন স্বীকৃত আলাদা কণ্ঠের জন্ম দিতে ব্যর্থ গুটিকয়েক কবি লেখকের দলবাজি ছাড়া? এতে লাভ কি সাহিত্যের, সে প্রশ্ন কি আমরা ভেবে দেখেছি? আমরা কি ভেবে দেখেছি দশকচ্যুত বলে যাকে আমরা অনেক বেশি অগ্রাহ্য করি সে তার দশকের প্রকৃতার্থে সেরা কবি কিনা? আমার বিবেচনায় দশকচর্চায় লাভের চেয়ে লোকসান বেশি। দশকের হরিদাস পালে একদল ভেড়া ঢুকে যায়, যাবেই- কেননা আগেও গিয়েছিল; এটা ঠেকাবার নয়। দলবদ্ধ হয়ে চলার চর্চা লেখকের নিজের শক্তি কমাতে যথেষ্ট যদিও এটাই এ অঞ্চলের কবি লেখকের একটা সাধারন বৈশিষ্ট্য হয়ে দাড়িয়েছে। তবে দশকচর্চা এরপরও চলবে কেননা সমালোচনা সাহিত্যে অনেক আরামের জন্ম দিয়ে গেছে দশকীয় প্রবনতা। সমালোচনার নতুন কোন পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি না আসা পর্যন্ত একে ধারন করে যাবেই আমাদের সাহিত্য। তবে কবির তা মান্য করার কিছু নেই বলেই মনে করি। ধরি আজকে বাংলা কবিতার কয়েকটি রাজধানী কলকাতা, ঢাকা, ত্রিপুরা, রাজশাহীতে যে চর্চা, যে ভাষা, যে প্রকাশভঙ্গি মেনে লেখা হয় ওটাকে স্টান্ডার্ড ধরে তালই মিলিয়ে গেলাম, নতুন কিছু দিলাম না মহাকাল কি রাখবে আমাকে তার সোনার তরীতে ? বরং এই সব আধুনিকতার বদলে আমি যদি নতুন কোন আধুনিকতা নিয়া লেখি, হোক সে উত্তর, দক্ষিণ কিংবা পূর্ব পশ্চিম আধুনিকতা, একদিন সময় খুঁজে নেবেই তাকে। অনেক কথা বললাম। দুপুর বাবুকে ধন্যবাদ ডাকার জন্যে। শুভ সন্ধ্যা

দুপুর মিত্র: নব্বইয়ের সময়টা ছিল উত্তাল। সে সময়ে স্বৈরাচারী এরশাদ পতনের ভেতর দিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান আন্দোলন কাজ করছিল। সে সময়ে কবি মোহাম্মদ রফিকসহ অনেককেই সেনা ছাউনিতে নিয়ে অত্যাচার করা হয়। কেননা এরশাদ কবিতা লিখেন বলে কবি রফিক লিখেছিলেন সব শালারা কবি হতে চায়। সেই সময়েই এমন সাহিত্য জগত তৈরি হতে দেখা যায়, যেখানে ভাষা শব্দের এমন ব্যবহার থাকবে যেখানে রাষ্ট্র নাক গলাতে আসবে না। একটা মধ্যবিত্ত
মিরমিরে সুরে সাহিত্য রচনা শুরু হয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদ সেই শ্রনীর সাহিত্যিক। আহমদ ছফার ভাষায় নন্দিত নরকের পরে তিনি কোনও কিছুই দিতে পারেন নি। বা একবার তিনি তাকে মারতেই গিয়েছিলেন। অবশ্য সেটা নাকি দুষ্টামি করে। সে যাক। হুমায়ুন এমন সাহিত্যই জনপ্রিয় করলেন যেখানে মানুষের সংগ্রাম নেই, কিন্তু সংগ্রাম নিয়ে ঠাট্টা-মসকারা আছে। সেটাকে মধ্যবিত্তও গিলতে লাগলেন। জনপ্রিয় হয়েছে বলে তিনি এই বিষয় বেছে নিয়েছেন তা নয়, শরতও জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু শরত ব্রাহ্মন্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। এবং জনপ্রিয় হয়েছেন। হুমায়ুনরা কারও বিরুদ্ধে লড়েন নি। বরং হাসিয়েছেন শুধু। তিনি হাসি বিক্রয়ে ওস্তাদ ছিলেন। এই হুমায়ূনের সাহিত্যকেই জাতীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ হিসেবে ধরে নেয়। কেননা এতে তাদের কোনও ক্ষতি হয় না বরং লাভ হয়। এবং এরা হুমায়ুনকে ঘিরে এমন এক জাতীয় সাহিত্যের পরিবৃত্ত তৈরি করেন যেখানে বামপন্থী নেতা কর্মীদেরও পরবর্তী সময়ে হুমায়ুনের স্তুতি গাইতে দেখা যায়। হুমায়ূনরা বললাম এই কারণে যে হুমায়ুনের এই জায়গা ধরে পরবর্তীতে এখানে আনিসুল হুক একই ভঙ্গিমার কাজ শুরু করেন। মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীরা নাটক বানাতে শুরু করেন। একটি বিশেষ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়ে যায় এখানে। যা জাতীয় সাহিত্য বলে অনেকেই পরিচিতি দিয়ে গর্বিত হতে থাকে। ইয়াসিন।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: দশক ভাবনাটা কি তবে ভগবানের মত অবচেতন বা প্রবৃত্তির মত, নাকি সংস্কারের মত? এক-ই দশকে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন ধারার সাহিত্য আন্দোলন জন্ম নিলে (জুবিনদা-র কথা মত অনেক কবি, অনেক লেখালেখি হচ্ছে - তাই এটা খুব স্বাভাবিক) তাদেরকে দশক দিয়ে চিহ্নিত ক'রা কী উচিত হবে? দশকপ্রথা যদি "ইউনিট অব টাইম"-এর থেকে বেশী কিছু না হয়, তবে তার প্রয়োজন-ও সবসময় থাকার কথা নয়। এ যেন - ডাকনাম সবজায়গায় চলে না। অফিশিয়াল আর ফর্মাল নাম হ'ল ভালোনাম, যার গুরুত্ব আছে। আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডাকনামের কোন গুরুত্ব নেই - এইরকম নয় কি? দশকপ্রথা খুব মোটা দাগের বিভাজন ছাড়া কিছু আমার মনে হয় না আমার, ওতে কবি তো দূরের কথা - কবিতাও সবসময় ঠিকঠাক চিহ্নিত হয় না। আমি ওমুক দশকে লেখালেখি শুরু করেছি? তা, আমি তো ওমুক সালে লেখালেখি শুরু করেছি - টু বি প্রিসাইজ। টাইম স্কেলে তো ইউনিটের অভাব নেই, প্রচলিতকেই মেনে নিতে হবে কেন? প্রচলিত কবিতাকে যদি আঘাত ক'রি, প্রচলিত প্রথাকেও করব। নইলে আমার অস্তিত্ব অর্থহীন।

দুপুর মিত্র: জুবিন ঘোষ, হুম ভাল জায়গাটা ধরেছেন। আমি বরাবরই কিন্তু বলছি, লেখক-কবিদের দশকের পেছনে না ছুটা প্রসঙ্গে। কারণ জায়গাটা চর দখলের মত হয়ে গ্যাছে। একাডেমিক বা সাহিত্যের জায়গা থেকেও দশকের পেছনে কবি-লেখকেরা দৌড়াতে পারেন না। কারণ দশক বিষয়টাই সমালোচনার জন্য। একটা পণ্য তৈরির জন্য, যেখানে এই পণ্যে কিছু কবি-লেখক ভরিয়ে বিক্রি করা হবে। সাহিত্যের টাইম-স্পেসে আর দশক সাহিত্যের টাইম-স্পেস আকাশ-পাতাল তফাত। খুব ক্ষীণ একটা সময়ের জন্য অর্থাত দশকের জন্য অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকের দৌড়ানোটা একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। এখানে সমালোচনা সাহিত্য একটা বড় ব্যাপার। মানে আপনাকে যখন আমি চিনতে যাব তখন এই টাইম-স্পেস দিয়ে চিনব। কিন্তু আমি যদি এই দশকের পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরি তখন সেটা হবে হাস্যকর।

জুবিন ঘোষ: এটাকে আগেই সমর্থণ করেছিলাম , এখনও সমর্থণ করলাম দুপুর বাবু, আলোচনার আর একটা দিশা কিন্তু দেখালো অত্রি ভট্টাচার্য্য, এদিকে কি কেউ আলোকপাত করবেন ?

জলধি রায়: ধন্যবাদ দুপুর মিত্র। অনেকের মন্তব্যই পড়লাম । বলা হয়ে গেছে প্রায় সবকিছুই, মনে হয় না আরও নতুন করে কিছু বলা সম্ভব । তারপরেও কিছু বলি, আমি যেমন বুঝি ।কে যেন বলেছিলেন, কোনোকিছুকে বুঝতে হলে আগে তার শ্রেণিবিন্যাস করো, কারণ শ্রেণিবিন্যাস করতে হলে প্রথমেই কিছু বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করতে হয়, আর এটা করতে গেলে বিষয়টাকে বুঝতেও হয় । তবু ডাক্তারিবিদ্যায় শ্রেণিবিন্যাস যেমন জীবন মরণের ব্যাপার, সাহিত্যের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তা নয় । সাহিত্যের দশক নিশ্চয়ই কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করতে পারে, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই রাত থেকে দিন হয়ে যাওয়া নয়, কারণ সাহিত্যের সামগ্রিক পরিবর্তন তো একটা কনটিনিউয়াম ।এবং ভাবি, বড় কবিদের আসলে দশক দরকার হয় না, কারণ তাঁদের থাকে সম্পূর্ণ জীবন, আমরা তাঁদের জীবনকে পাঠ করি, যে জীবন শুধু দশক নয়, তার থেকে আরো বিস্তৃত, হতে পারে কয়েক শতক । আমরা জীবনানন্দের জীবনকে পাঠ করি, তাঁর দশক না থাকলেও পাঠ করতাম । তবু দশক এখানে এসেছে, কারণ অন্যান্যরাও এখানে আছেন, আছে অন্যদের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ । অন্যান্যরা না থাকলে দশক দরকার হতো না ।শামসুর রাহমানের দশক দরকার নেই, দরকার হবে হয়ত আমার । কারণ আমি বড় কবি নই । আমার সম্পূর্ণ জীবন নেই, যে জীবনকে পাঠকরা পাঠ করতে পারেন । আমাকে পড়তে হবে অন্যদের সঙ্গে, অন্যদের সঙ্গেই আমার স্থান । দশক নিয়ে কবিরা মারামারি করছেন হয়ত একারণেই...

‌ইয়াসীন ফিদা হোসেন: দুপুর মিত্র, মতপ্রকাশে স্বাধীনতার জায়গা থেকে আপনার বিশ্লেষণ পড়লাম। একমাত্র হুমায়ুন আহমেদ তার সাহিত্য চর্চ্চায় বহুলাংশে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, এটুকু বিষয় ছাড়া বাকি মন্তব্যে সহমত হতে পারলামনা। হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে কখনো যদি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হয়, সেখানে বিস্তারিত বলবো। আমার মনে হয়েছে এটা একটা আলোচনা ডিমান্ড করে। ... এরপরও দু'একটি কথা। সাহিত্যে সংগ্রাম থাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে কিনা? কারো লেখায় কেউ হাসলে কার বিষয় সেটা? যতদূর জানি কোন সমালোচকই হুমায়ুনকে রম্য লেখক বলেননি। হুমায়ুন, আনিসুল, ফারুকীদের এক ঘরানার বলতে পারছিনা, এটুকু বলতে পারি ইনারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জনপ্রিয়।

জুবিন ঘোষ: রেজওয়ান তানিম এবং জলধি রায়ের সংযোজন নতুন বাতাস আনলো এই আলোচনায় । ধন্যবাদ আপনাদের ।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: একটা কথা - বিতর্কের ফোরামে কে মোশনের পক্ষে বলছে, কে বিপক্ষে তা কিন্তু সবসময় তাদের নিজেদের প্রকৃত বিশ্বাস বা বক্তব্যের পরিচায়ক হতে পারে না। উদাহরনস্বরূপ, বাংলা কবিতায় অন্ততঃ শূন্য ও শূন্য পরবর্তী দশকের অস্তিত্ব-এর আমি সমর্থক। দুপুরদা ইন্টারভিউতে কী প্রশ্ন করেন - তার প্রসঙ্গ উত্থাপন আমি ব্যাক্তিগতভাবে সমর্থন করছি না জুবিন ঘোষ ও দুপুর মিত্র।

জুবিন ঘোষ: অত্রি ডিবেট আর গ্রুপ ডিসকার্সন এক নয় ।এটা ঠিক বিতর্কের ফোরাম নয় , গ্রুপ ডিসকার্সনের ফোরাম । আইডিওলজিক্যাল ডিফারেন্স অথবা সমভাবাপন্ন থেকেই কথা বলব আমরা তাইনা ? এটার মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবনা পরষ্পরের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে । দুপুরের ইন্টারভিউ আর কথা এখানে তাই আমরা ক্লিয়ার করে নিলাম - যে দুটোর মধ্যে কোনো মনস্তাত্ত্বিক দন্দ্ব থাকছে কি না !

দুপুর মিত্র: অত্রি ও জুবিন, আমার মনে হয় জুবিন দা যে প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন, তা আসতেই পারে কারণ এটা টেক্সটের বাইরে নয়।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: যে কোন আলোচনার যেটা মূল উদ্দেশ্য - ইনফরমেশন সংগ্রহ, আমি সেটার উপরেই জোর দিতে চাই। আমি কী বলছি, তার থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হ'ল প্রতিপক্ষ কী বলছে। এনি ওয়ে, ট্র্যাক থেকে না সরাই ভালো। পার্ডন মি আন্ড গো আহেড।

দুপুর মিত্র: খুব ভালো আলোচনা করেছেন রেজওয়ান।
আমার মনে হয় এই মুহূর্তে আলোচনার একটা সাম আপ করা দরকার, যাতে আরও অন্যান্য বিষয়গুলোও আলোচনায় আসতে পারে। এখানে দশকের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে জোরাল মত এসেছে। কিন্তু কিছু বিষয় অনেক বেশি আলোচনার দাবি রাখে। যেমন সমালোচনা সাহিত্যে দশকের গুরুত্ব কতখানি। সমালোচকের চেয়ে লেখকেরা কেন বেশি দশকের পেছনে ঘুরেন। অতীতের সাহিত্য চর্চা কি দশক দিয়ে বিশ্লেষণ করা সহজ হয়? বড় কবি-লেখকদের দশক কোনটা এটা জানার
পরও কি দশক দিয়ে তাকে বিচার করা সম্ভব হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আশা করি পরবর্তী আলোচনা এ দিকে গড়াবে।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: 'সমালোচকের চেয়ে লেখকেরা কেন বেশি দশকের পেছনে ঘুরেন।' - ইনারা আসলে কোন শ্রেণীর লেখক?

আব্দুল্লাহ্ জামিল: আমার ব্যক্তিগত মতামত দিচ্ছিঃ দশকের বা যুগের বিভাজন সব সাহিত্যে আছে এবং থাকবে। আর এটা আরোপিত কিছু নয়। পাঠক ও সমালোচকদের বোঝার ও ব্যাখ্যা প্রদানের সুবিধার্থে এই সময়ের ভাগ এসেছে। এখন কেউ যদি চর্যাপদ পড়েন, তিনি যদি তদানিন্তন সময়ের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান না রাখেন ও ঐ সময়ের বাংলা ভাষা সম্পর্কে ধারণা না রাখেন তাইলে এর অর্থ আস্বাদন করতে পারবে না। তেমনি বঙ্কিম রচনাও। তাই সময়ের বিভাজন সাহিত্যে প্রয়োজন।সময়ের সাথে সাথে সমাজের যেমন পরিবর্তন আসে তেমনি ভাষারও। তাই বর্তমান যুগের কোনো কবি যদি একশত বছর আগে যে বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য রচনা করেছেন সেই ভাষায় কবিতা লেখেন তা এই যুগের পাঠকদের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: 'তাই বর্তমান যুগের কোনো কবি যদি একশত বছর আগে যে বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য রচনা করেছেন সেই ভাষায় কবিতা লেখেন তা এই যুগের পাঠকদের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না।' - হতেও তো পারে, নাও হতে পারে। সেটা আমরা নাহয় পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেই। পাঠককে আধুনিক কবিতা অনেকাংশেই তাচ্ছিল্য করেছে, চাপিয়ে দিতে চেয়েছে অনেক কিছু। পরিবর্তন দরকার, পাঠককে গুরুত্ব দেয়া দরকার। আব্দুল্লাহ্ জামিল।

আব্দুল্লাহ্ জামিল: আপনার সাথে আধুনিকীকরণ করার ব্যপারে চাপিয়ে দেয়ার বিষয়টিতে সহমত। ইয়াসিন।

মিলন চ্যাটার্জি: আমি পোস্ট পড়লাম । আসলে দশক বিভাজন নির্দেশ করে কবির লেখালিখির সময়কে । কবি কবে থেকে লেখা শুরু করেছেন সেটাও নয় আসলে কবি প্রথম ছাপলেন কবে । দশক নিয়ে আলোচনা আসলে কবির প্রকাশের সময়ের নির্দেশক । যেমন সত্তরের দশকে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় কবি জয় গোস্বামীর, অতএব কবি ৭০ দশকের । এখন প্রশ্ন হচ্ছে - কবি কি সত্তরেই আটকে থাকেন ? তা তো নয় । তিনি সমসাময়িক সময়কেই ধরেন তাঁর কবিতায় । এক্ষেত্রে প্রথম
দশকেও এমন কবি আছেন যারা ১৯৫০ সালেই পড়ে আছেন । তবে এরা কোন গোত্রের ? দশক নিয়ে পাঠকের মাথাব্যাথা নেই । সে সেই কবিতা খুঁজে নেবে যা তাকে রিপ্রেসেণ্ট করে, সেই কবিতাই পড়বে যা তাকে দেবে প্রাণের আরাম, মগজের কোষে ধারণ করবে - যা নাড়া দেবে । সেখানে রবীন্দ্রনাথ কারো কাছে নিঃশ্বাস, প্রশ্বাস, কণ্ঠস্বর আবার কারো কাছে জয়, সুনীল, শক্তি । আবার কেউ বারেবারে ফিরে যাবেন বিনয় মজুমদার, বীতশোক ভট্টাচার্য, ভাস্করের কাছে । মোদ্দা ব্যাপার হল -- দশক আসলে সময় নির্দেশক, দিক নির্দেশক নয় । আর সামাজিক প্রভাব ? তাকে অস্বীকার করে কবিতা হয়নি, হয়না, হবেও না ।।

অমিতাভ রক্ষিত: সুপ্রভাত - ঘুম থেকে উঠে দেখি একশটার বেশী কমেন্ট হয়ে গেছে। পৃথিবীর ভিন্ন প্রান্ত থেকে মনে হয় এই ফোরামে যোগদান করাটা সুবিধের হবে না। কমেন্ট পড়তেই তো একঘন্টা লেগে গেল! আলোচনা খুব ভাল লাগল। দুপুর বাবু যে রকম ধৈর্য ধরে সকলের কমেন্ট-ই এক এক করে উত্তর দিয়েছেন তার জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাই। আমার যে দু একটা কথা মনে হল তা বলি। শুধু যা আলোচনা হয়নি তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছি।

১) দশক (বা এরকম অন্য কোন কৃত্রিম বিভাজক) দিয়ে ভাগ করলে, যাঁরা নিজেরা কবি বা লেখক নন অথচ সাহিত্যে উৎসাহ আছে, এমন লোকেদের পক্ষে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা লেখার বিবর্তন-কে বুঝতে সুবিধে হয়। অন্যথায়, হাজার হাজার লেখাকে কিভাবে বিশ্লেষণ করে পড়বেন সে বিষয়ে সংশয় থেকে যেতে পারে। কিন্তু এভাবে কেউ কিছু ভাগ করল কিনা, তাতে কবি বা সাহিত্যিকদের নিজেদের কিছু যায় আসে না। অন্ততঃ যাঁরা নিজেরাই শক্তিশালী, তাঁদের অন্যরা কিভাবে লিখল বা কেন লিখল, তাতে কিছু যায় আসে না। বরুঞ দেখা গেল হয়ত বা তাঁদেরি ঘিরে একটা ধারার সৃষ্টি হল - সঙ্গীতে যেমন হয়।কিন্তু আর একটা জিনিষ আছে যেটা আলোচিত হয় নি। সেটা হল দুই বাংলার সামাজিক অবস্থার তারতম্য। যদিও আমরা সেই কথা প্রথমেই ভাবি না, কিন্তু তফাৎ যে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেমন, স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে ভারতে বোঝায় অগ্নিযুগ, অসহযোগ ইত্যাদি। বাংলাদেশে সেই ইতিহাস সামাজিক ভাবে চাপা পড়ে গেছে ১৯৭০-৭১ এর ঘটনা দিয়ে। এর প্রতিফলন নিঃসন্দেহে দেখা যায় দুই বাংলার লেখায়। ফারাকটা ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাহিত্যের মধ্যে ফারাকের-ই মতন। অতএব শুধু দশক দিয়ে ভাগ করলে আর চলবে না। বুদ্ধদেব বসুর সময় বাংলাদেশের সাহিত্য পর্দার ওপারে ছিল। সেজন্য ভারতীয় চোখে দশক-ই তিনি দেখেছেন শুধু। সৌভাগ্যবশতঃ এখন আর সেই পর্দাটা নেই। কিন্তু তার জন্য আবার বৃহত্তর ভাবে বাংলা সাহিত্য-কে বৃহত্তর মাপ কাঠি দিয়ে দেখবার সময় এসে গেছে।

আব্দুল্লাহ্ জামিল: চমৎকার বলেছো মিলন। সহমত। মিলন।

উষসী ভট্টাচার্য্য: দুপুর মিত্র .. আমার মনে হয় সাহিত্য কোনো কিছুর তোয়াক্কা করলে তবেই তা চরম মাত্রা ছুতে পারে. আমি এই দশকের কবি .. তার অর্থে আমি একটা সময়ে আটকে গেলাম.. এটা আমি মানিনা. আর সমসাময়িক কথাটা খুব কনটেম্পোরারি দশক বেধে এটি বোঝানো যায় না. দশক অবশ্যই খুবই ছোট্ট।

দুপুর মিত্র: একমত উষসী, তবে কিছু বিষয় যদি খেয়াল করেন তাহলে আপনিই আপনার জায়গাটা ধরতে পারবেন। যেমন য় সাহিত্য কোনো কিছুর তোয়াক্কা করলে তবেই তা চরম মাত্রা ছুতে পারে. এটা কখনও নই তোয়াক্কা না করলেই চরম মাত্রা ছুঁতে পারে। চরমমাত্রা বিষয়টি আসলে চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে তৈরি হয়।

কচি রেজা: এতক্ষনের আলোচনা, মতামতে যা সাব্যস্ত হলো কি হলো না----সে নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া গেল--কিন্তু স্পষ্ট হল না। আমার মতে সমালোচকেরা যদি এ-ধরনের প্রশ্ন না করেন, তাহলে কবির নিজেকে দশকে নির্দিষ্টকরণ নিয়ে চিন্তা থাকবে না। বন্ধু কবিদের মনোরঞ্জনে করে নাম বলাতে ও চাপ দেবে না।

দুপুর মিত্র: আবার ধরুন 'সমসাময়িক কথাটা খুব কনটেম্পোরারি দশক বেধে এটি বোঝানো যায় না. দশক অবশ্যই খুবই ছোট্ট' সমসাময়িক বা কনটেমপোরারি মানে একই সময়ের। উষসী।

কবির এ নিয়ে মাথা ঘামানোরই দরকার আছে বলে মনে হয় না যদি সে মহাকালের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সমালোচকরা লেখকদের অনেক বিষয় নিয়েই লেগে থাকেন এবং থাকবেন। কবি-লেখকেরা অনেক ক্ষেত্রেই বা বলা যায় সব ক্ষেত্রেই সেসব সলজ্জ চিত্তে নম্র মুখে এড়িয়ে চলেন। কচি রেজা।

কচি রেজা: দুপুর মিত্র, আসল লেখক এবং কবিরা তাই করেন।তারা সময়কে পরিচালনা করেন। পাঠককে ও।কারা নাম বলবেন না বলবেন এটা উদ্দেশ্য করে তারা লেখেন না। কিন্তু এই প্রশ্নটা অবধারিত কেন? কবিদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে--্কারো কারো।তারা আগেই ভেবে রাখেন কার কার নাম বলবেন। সে নিয়ে আলাপ আলোচনা ও হয়। না বললে হয় গলা গলি থেকে গালা গালিও। সমালোচকেরা অনেক কিছু বলেন, করেন--সে তারা করুন, কিন্তু প্রশ্ন না থাকলে ত অস্তিত্ব থাকে না---আর অস্তিত্ব না থাকলে দশকের কবি হবার মোহ ও থাকে না।--

উষসী ভট্টাচার্য্য: আমি অমুক দশকের কবি এটি বললে কবি সত্বা আটকে যায় .. তাই বিশ্বাস আমার , দুপুর। আমি কচি দির বক্তব্য স্পষ্ট বুঝলাম না।

দুপুর মিত্র: হুম এটা ঠিক এই জন্যই সেই সময়কে সেই দশককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। যে আমি শুধু এই সময়ের নই, শুধু এই দশকের নই সময়ের উর্ধ্বে,দশকের উর্ধ্বে, ঈশ্বরের সাথে পাল্লা দিয়ে চলেন কবি। উষসী।

সমালোচকের বিশেষ করে সমসাময়িক সময়ের সমালোচকদের প্রশ্নের সাথে অস্তিত্ব মোটেই জড়িত নয়। জীবনানন্দকে দেখুন, জীবিতকালে তাকে কতই না বঞ্চনা, গঞ্জনা সইতে হয়েছে। সমালোচকেরা শনিবারের চিঠিতে তাকে কত কিই না লিখেছে। আর এখন সেই সমালোচক শ্রেনীটাই পূজা ছাড়া আর কোনও শব্দ উচ্চারণ করে না। কচি রেজা।

দুপুর মিত্র: আজ আমি উঠতে চাচ্ছি। আপনারা আলোচনা করুন। আরও চুলচেরা বিশ্লেষণ চাই। ধন্যবাদ জানিয়ে রাখলাম সবাইকে।

উষসী ভট্টাচার্য্য: একমত দুপুর। কলম দিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন স্রষ্টা। ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ বটেই।

কচি রেজা: এটাই আমি বলতে চেয়েছি। প্রশ্নটার অস্তিত্বই যদি না থাকত! আর থাকেও যদি, দুপুর বলেছেন, সমালোকেরা কত কি ই বলেন, করেন''-- কবিদের উচিত কবিতা সৃষ্টির দিকে মন দেয়া। একটি ভাল লেখার জন্য পড়তে হবে--জানতে হবে--নিজের সময়কে ও বুঝতে হবে।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর: ইহা তবে সমালোচক বধকরণ প্রকল্প বটে!!!

সুশান্ত কর: অনেকগুলো কথা বলা হয়ে গেছে। সব অনুসরণ করতে পারিনি। কিন্তু বেশ সুচিন্তিত মতামতও এসছে এখানে ওখানে। আমি মোটের উপর তাদের সঙ্গে আছি, যারা দশকের হিসেবে গোলমাল দেখছেন। তবে কিনা যারা বলছেন, এই হিসেবটা সমালোচকের সুবিধের জন্যে, কবিরা এই নিয়ে না ভাবলেও হয়-সেও সত্য। মুস্কিল হলো। কবি সমালোকের সম্পর্কটি অনেকটাই রাধা আর কৃষ্ণের মতো। ঝাড়েমুলে উপাড়িয়া যমুনাতে ভাসাবার ইচ্ছেটাও সত্য, আর বাঁশির জ্বালায় রন্ধন আওউলাইবার খবরও সত্য। কবিরা যেন মুখিয়ে থাকেন, কোন যে দশকে শুরু করলেন, তার বাঁধা খাঁচাতে ধরা পড়লেন কিনা, না পড়লেই অনেকের কলমের কালি ফুরোরে থাকে। থুড়ি, আজকাল মনে হয় কম্পিঊটারে ভাইরাস ঢোকে। একটা মোদ্দা কথা আমাকে ভাবায়। কালকে কি সত্যি স্থান থেকে আলাদা করা যায়? স্থান বলতে আমি ভৌগলিক স্থান এবং তার অনেক অতিরিক্ত কিছুও বলছি। চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতা বলে যদিও বা কিছু একটা আলাদা করা গেল , ৪৭এর বা ৫০এর পর কি আর তা করা যাচ্ছে সে ভাবে? আমিতো সোজা দেখি, আমাদের ভারতে দশক ওয়ারি কবিতার কথাতে বাংলাদেশ বা পূর্বোত্তর ভারত আসে নি সেভাবে। বাংলাদেশে কি এসছে ? আসা সম্ভব? এতো গায়ের জোরে সময়কে স্থান নিরপেক্ষ করে দেয়া। আচ্ছা, বিশ্ব সাহিত্যকে কি দশক ওয়ারি চিহ্নিত করা যায়? দুপুর মিত্র এক জায়গাতে সঠিক ভাবেই লিখেছেন," যেমন মালায়লাম সাহিত্যে ১৯৪০-১৯৫০ এর দশককে পিংক ডিকেড বলা হয় পিংক দশক। এ সময় এখানকার কবিরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও মার্কসিজমের প্রভাবে ব্যাপক হারে কবিতা লিখতে থাকে। আবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৫০ এর দশকটাকে বলা হয় ড্রাম ডিকেড এই সময়ে জ্যাজ মিউজিক, সেবিনস এসব বেশ জনপ্রিয় হয়। " এই বক্তব্যেই স্থান-এবং কালের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ইঙ্গিতটি আছে। আমাকে যদি বলা হয় পূর্বোত্তরের ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এবং অন্যান্য এলাকার সাহিত্যকে দশক ওরারি চিহ্নিত করতে , আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে, এবং একে রীতিমত এক জুলুমবাজি বলে মনে হবে। আমি নিশ্চিত প্রবুদ্ধসুন্দর এখানে যোগ দিলে আমার সঙ্গে একমত হবেন । আবার 'ভারতীয় বাংলা বিশ্বকে যদি স্থান বলে ভাবি (এটা যে কী বস্তু, আপাতত বুঝে নিন) তবে, একেবারে কোনো সম্পর্ক পরস্পরে থাকে না বলাও কঠিন। কিন্তু সেই
দিয়ে লেখার মান নির্ণয় করলে স্থানবৈষমের প্রশ্নটি এসেই যাবে। অনেকে বলবেন, সাহিত্যে শিল্পে স্থাল-কালের কথা বলা নিরর্থক। এগুলো স্থান-কালকে অতিক্রম করে যাবার জন্যে তৈরি। কিন্তু যাত্রা বিন্দু আর গন্তব্য কি দুটো বস্তু নয়? এদের সম্পর্ক কী দ্বান্দ্বিক নয়? আধুনিকতা এক সরল রৈখিক সময়কে ধরবার দৌঁড়ে যোগ দিয়েছিল। দশকের প্রথম পুরস্কার ছিনিয়ে নেবার পাগলামো তারই জন্যে। আবার যারা 'বামপন্থি' তারা ভারতের বাজারে 'সমাজতান্ত্রিকবাস্তবতার' মালও চালিয়ে
দেবার তালে ছিলেন ( দেশটা সমাজতন্ত্রে না পৌঁছুতেই) , 'উত্তরাধুনিক'দের অনেকে সময়ের এই আঁকাবাকা গতির কথা বলেন , দেখি। কিন্তু স্থান নিয়ে ভাবনাটা এখনো আমার নজরে পড়ে না। স্থান পাল্টালে কাল পালতে যায়, এবং উল্টোটাও হয়। এবং একই মানুষ আমরা একই 'কেলেন্ডার সময়ে এবং ভৌগলিক স্থানে' আসলে অনেকগুলো স্থানে-কালেও বাস করি। এর সঙ্গে নদীর স্রোত-প্রতিস্রোতকেও মেলানো যায় না। ( স্মরণ করুন, নদীর একই জলে দু'বার স্নান করা যায় না) ।
"চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন" কথাগুলো কবি কী ভেবে লিখেছিলেন জানি না, সমালোচকেরা যে খুব ভেবেছিলেন , দেখিনি। ভাবা উচিত ছিল।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, ধূর্ত সমালোচক বধকরণ প্রকল্প বলতে পারেন।

বিদিশা সরকার: কচি রেজা আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে সমালোচকদের সমালোচনাকে কিছুটা হরেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ এর মাধ্যমেই কবি তার লেখার ভাল আর খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে কিছুটা হলেও ওয়াকিবহাল হতে পারবেন।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: জানতাম, সুশান্তদা যোগ দিলে কিছু চিন্তার খোরাক দিয়ে যাবেন। দিলেন-ও। আমার তো ধারণা, শুধু সুশান্ত কর-এর দেওয়া পয়েন্টটা (অর্থাৎ, রাফলি, স্থান-কাল যেহেতু পরস্পর-নিরপেক্ষ নয়, সেহেতু কবিতায় স্থানকে ইগনোর ক'রে দশকওয়াড়ী বিভাগ নিতান্ত অসম্পূর্ন ও অ-বৈজ্ঞানিক।) নিয়েই আরো দু'দিন আলোচনা চালানো যায় । টাইমস্কেলকে অকিঞ্চিৎকর গণ্য ক'রে, এক্ষেত্রেও এই পয়েন্ট নিয়ে আগামী দু'দিন আর কোন থ্রেড না খুলে আলোচনা চালাতে চাইছি। যাই হোক, একটা কথা। এই সামগ্রিক আলোচনায় একটা অংশ একেবারে অবহেলিত মনে হচ্ছে। বিস্তারিতভাবে গত তিন-চার দশকে পশ্চিমবঙ্গে (এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে) জন্ম নেওয়া সাহিত্য (পার্টিকুলারলি কবিতা) আন্দোলনগুলিকে নিয়ে কেউ লিখছেন না, যতটা বাংলাদেশ, মালয়ালম, থেকে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকার কবিতা নিয়েও চর্চা হচ্ছে। এ নিয়ে জুবিন ঘোষ কিছু লেখো। একাধিক পত্রিকা এবং গোষ্ঠীর উঠে আসা এবং তার উপর এবং প্রেক্ষাপটে সময় ও স্থানের যুগপৎ প্রভাব ও কারণ হিসেবে কাজ ক'রা - এর থেকে বোধহয় সুশান্তদা উল্লিখিত স্থান-কালের সম্পর্ক্টি কিছুটা খোলসা হবে। তবে, আলোচনা চাইছি কবিতার মধ্যে, কবিতার উদ্ধৃতি তুলে - কবিতার বাইরে গিয়ে কবিতাকে দূর থেকে দেখে নয়, যেমনটা সুশান্তদা-র বক্তব্যে দেখলাম। আরেকটা কথা - সুশান্তদা-র
পয়েন্টটা নিয়ে আলোচনা চালানোর আগেই একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায় - যে, তিনি দশকওয়াড়ী বিভাগকে স্বীকার করেই তার ত্রুটি খুঁজছেন, তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন না। এখানেই আমি ওনার মতের বিরোধী। আমি জানি যে সময় বলে কিস্যু নাই, ওটা মানুষনামক প্রকৃতির দুর্বলতম সন্তানের একখান খেলনা মাত্র। যাই হোক - আলোচনা চলুক।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: অত্রি ভট্টাচার্য্য, আমার মতে স্থান ও কাল উপজীব্য করে আরেকটি নতুন বিষয়, নতুন থ্রেডে আলোচনা হওয়া দরকার।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: কি প্রয়োজন? থ্রেড-ফেড খুব যান্রিক বিষয়। যত বাড়বে তত ডিস্ট্র্যাকশন। তাছাড়া আটশো-হাজার কমেন্ট হ'লে তবে একটা আলোচনাকে ফলপ্রসূ বলার রেওয়াজ ফেসবুকে। চলুক, এখানেই চলুক। এসব ফ্লক্সিনোসিনিহিলিপিলিফিকেশন বাড়িয়ে স্থান-কাল নষ্ট ছাড়া কিছু হবে না।

বিদিশা সরকার: অত্রি, আমার মনে হয় দশকটা কবি ও কবিতার সীমানা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। যেখানে কবিতার তো সীমানা বানানোই কাম্য নয়।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: কিন্তু অনেকে ক্লান্ত হবেন যে, খেই হারিয়ে ফেলবেন যে, তাই বলছিলাম।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: আমরা আর এত সুপারফিশিয়াল জায়গায় নেই বিদিশাদেবী, আলোচনা অনেক গভীরে ঢুকে গিয়েছে। খুলে বলুন - কি ধরণের সীমানার কথা আপনি বলছেন? উদাহরণ দিয়ে বলুন।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: আর দুপুর দা'র কথাও একটু ভাবুন। ওনাকে তো পুরোটা সম্পাদনা করতে হবে। অত্রি, দুপুর।

সুশান্ত কর: না না, অত্রি আমার মূল কথা কিন্তু এটাই "আমি মোটের উপর তাদের সঙ্গে আছি, যারা দশকের হিসেবে গোলমাল দেখছেন।" এটা গোল মেলে ব্যাপার। কিন্তু ধরুন, কোন সমালোচক এই বলে শুরু করলেন, 'মালদাতে আশির দশকে যারা কবিতা লিখতে এলেন'---তাতে অসুবিধে কোথায়? কোথাওতো শুরু করতে হবে তাঁকে। এখন আপনি যদি বলেন, এই দশক ওয়ারী ভাবনা আরো অনেক কুসংস্কার দিয়ে গেছে আমাদের, একে ধাক্কা দিয়ে তাড়াতে হবে। আমি আপনার সঙ্গে আছি। সেক্ষেত্রেও 'বিশ শতকের শেষ সিকি ভাগে যারা লিখতে এলেন মালদাতে' এরকম কিছু একটা লিখতে হবে সমালোচককে। যদি তিনি ইতিবৃত্ত লিখতে বসেন। কিন্তু কেউ যদি লুই পাদের কবিতা পাশে আপনার কবিতা নিয়ে কথা বলেন, কিম্বা রবীন্দ্রনাথের পাশে লালন ফকির ( আমাদের সরলরৈখিক কাব্য ইতিহাসে যার নাম ঢুকলই না) তখন তার স্থান-কাল আরো দুমড়ে যাবে সুতরাং কথাতে ব্যবহৃত পরিভাষাও পালটে যাবে। আমরা যদি সেরকম কোন সংস্কৃতি নিয়ে আসতে পারি, যা খুব কম হলেও . আছে, তবে হয়তো ধাক্কাটা জোরালো হবে। কিন্তু মোদ্দা কথা, কাল-কে বাদ দিয়ে স্থান, আর স্থানকে বাদ দিয়ে কালের কথা একেবারেই পশ্চিমি চাল। এগুলো আমাদের কালের অন্তর্ভুক্ত নয়, বহিষ্কৃত করবারই তাল। আর এই কাজটা তারা করেও যাচ্ছেন। আমরাই শুধু পড়ি কি মরি ওদের কালে ঢুকবার জন্যে বেহুদা দৌঁড়ে যাচ্ছি। ওরা দেখে শুনে খিল খিলিয়ে হেসেই যাচ্ছেন।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: না - উনি আজকে রাত আটটার মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তাই প্রকাশ করবেন বলে লিখেছেন।

ইয়াসীন ফিদা হোসেন: পরিসর কিন্তু সেক্ষেত্রে বাড়তেই থাকবে। স্থান এবং কালের কথা বললে, সেই স্থান এবং কালে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতগুলোও চলে আসে, বা আসবে, যার প্রতিটিই কবিতাকে বা আরো বড়ো অর্থে সাহিত্যচর্চ্চাকে প্রভাবিত করে, করেছে এবং করবে।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে আমার ধারণা যদিও সামাণ্য - তবু আমি আপনার কথার সাথে একমত। বাংলা কবিতার ইতিহাসে গীতিকবিতা যতটা প্রাধান্য পেয়েছে, গান হয়তো তার সিকিভাগ-ও পায়নি। বহুমুখী চিন্তার কোন ধারা আমাদের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দানা বাঁধেনি বলেই মনে হয়। অথচ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখাপত্রেই দেখতে পাচ্ছি - তিনি ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় আন্থ্রোপলজি নিয়ে আসছেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আডপ্ট করছেন, গোঁড়া হিন্দুধর্মের যুগে দাড়িয়ে
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম শাসনের (এখানেও সেই স্থানের সাথে কাল ওতপ্রোত) গুরুত্বের কথা তুলে ধরছেন। তার ডিটেল্‌ড সিস্টেমেটিক কাজ দেখলে মনে হয় না বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসরচনা এমন সরলরৈখীক পথ ধরে নেবে কাল্ক্রমে। যাই হোক, ইতিহাস ছাড়া সাহিত্য অচল আর ইতিহাসবিদের ইতিহাস্রচনার জন্য দশকপ্রথা ব্যবহার ক'রা হার্ম্ফুল্কিছু না - জুবিনদা আগেই বলেছে। আমার কথা - কেন্দ্র-প্রান্ত বলে তো একটা ব্যাপার আছে। আপনি যে বললেন, "মালদাতে আশির দশকে যারা কবিতা লিখতে এলেন" - এই একই ভঙ্গী আমি হুবহু পেয়েছি ব্রিটিশ কবিতার ইতিহাস নিয়ে লেখা একটা প্রবন্ধের অনুবাদ পড়তে গিয়ে। সুতরাং, আমাদের সচেতনতা - পশ্চিমি ক্রিটিসিজম আর হিস্ট্রি রচনাপদ্ধতি থেকে - ঠিক কোথায় কোথায় প্রয়োজন - তা প্রতি পদেই সংশোধন করে নিতে হবে, হচ্ছে। সুশান্ত।

বিদিশা সরকার: যেমন ধরুণ, রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ বা জয় গোস্বামী কিম্বা হুমায়ুন আহমেদ এদের লেখার সময় বা কাল যাই বলুন সেটা ভিন্ন। কিন্তু এদের লেখাকে দশকের ভাগে সীমাবদ্ধ করা যায় কি? এদের কবিতা দশকের উর্ধ্বে। তাহলে দশকটা কোন কবিদের লেখার ক্ষেত্র তা কে নির্দিষ্ট করবে।

অমিতাভ রক্ষিত: সুশান্ত বাবুর বক্তব্যগুলো ভাল লাগল। তবে মনে করি সাহিত্য যেহেতু ক্রমবৃদ্ধমান সেহেতু তাকে গুছিয়ে লাইব্রেরিতে ভাঁজ করে ভবিষ্যতের সম্পদ করে ধরে রাখতে গেলে তাকে কিছু না কিছু ভাবে ভাগাভাগি করতেই হবে বইয়ের ক্যাটালগ করবার মতন করে - তা না হলে ভবিষ্যতে আর কেউ খেই ধরতে পারবেন না। আর সেই ভাগাভাগি কি ভাবে হবে সেটাই তো আলোচ্য। আমার মনে আমাদের সাহিত্য এখন এত বিস্তৃত হয়ে গেছে যে তাকে ঠিক ভাবে ক্যাটালগ করবার জন্য স্থান ও কাল দুটোরি প্রয়োজন। কিন্তু তার বেশি লাগবে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা যেমন দূরত্বে কমে কাছে এসে যাচ্ছে, তেমনি দূরত্ব এখন অনেক বাকি। যেমন, আমাদের মত যারা সারা জীবন দেশের বাইরে তাদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তা ধারা আমাদেরি সমবয়সী দেশের লোকের থেকে ভিন্ন। তারা যখন কিছু লিখবে, তখন তাদের চিন্তার স্বাতন্ত্র তাদের লেখায় এসে যাবে। লাইব্রারিয়ান দের কিন্তু সেটা বুঝতে হবে এবং সেই স্বাতন্ত্র কে ঠিক ভাবে ভাঁজতে হবে। এই কারণে আমি ননে করি বাংলা সাহিত্যে অন্ততো তিন রকম ভঁআজ পড়বে। দশকের ভারতীয় লেখ, দশকের বাংলা দেশের বাংলা লেখা এবং প্রবাসী বাংলার লেখা।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: বিদিশাদেবী - আমি তো একাধিক কবির নাম বলতে পারি, যাদের নামের আগে "অমুক দশকের কবি" লেখাটাই দস্তুর। এইভাবে তুলনা-প্রতিতুলনা কি ঠিক? আপনি নিজেও তো "সীমানা" শব্দটা জাস্টিফাই করতে পারলেন না। দশকের কবি বললে সেখানে সীমাবদ্ধতার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?

সুশান্ত কর: "সুতরাং, আমাদের সচেতনতা - পশ্চিমি ক্রিটিসিজম আর হিস্ট্রি রচনাপদ্ধতি থেকে - ঠিক কোথায় কোথায় প্রয়োজন - তা প্রতি পদেই সংশোধন করে নিতে হবে, হচ্ছে। " ঠিক। এবং পুরো বেরিয়ে যেতে কোনদিনই পারব না, কারণ ওই "চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন"। নদী হলে না হয় বাঁধ দিয়ে বেরিয়ে যেতাম!

সুশান্ত কর: অমিতাভ রক্ষিত, আপনি যা বললেন সে কিন্তু একেবারেই গ্রন্থাগারিকের কাজ। তিনি কিন্তু আদ্যাক্ষরকেও প্রধান্য দিতে পারেন। অ-কবি, আ-কবি এরকম! কিন্তু কবি যদি ঐ ক্যাটালগে ঢুকবার তালে থাকেন তবে আর হয়েই গেছে কবিতা লেখা! আর ঐ যে বললেন 'প্রবাসী' সেও কিন্তু আমাদের স্থানে-কালে তৈরি শব্দ নয়। প্রবুদ্ধকেই জিজ্ঞেস করুন না, সে 'প্রবাসী' তালিকাতেও ঢুকতে চায় কিনা! আমি কবি হলে, আমার কিন্তু শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যেতো। অথচ লিখছি অসম থেকে!

বিদিশা সরকার: অমুক দশকের কবি বলতে তার কবিতায় সেই দশককে বিলং করে এটাই বোঝায় না কি? সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন কোনও কবিতা কি নির্দিষ্ট একটি দশকের হয়ে থাকে? তা তাো থাকে না। তাহলে দশকের প্রবাবটা কোথায়? কবিতা লেখার রীতি, ভাষার প্রয়োগ বা গঠন শৈলীটা কি?

অমিতাভ রক্ষিত: সুশান্ত কর- আমি কিন্তু একবারও কবি বা লেখককে "অ, আ, ক, খ"-র তালিকায় ঢুকবার চেষ্টা করতে বলছিনা। তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। কবি কবির মতই লিখবেন। তা না হলে সমস্ত আলোচনাই এ পর্যন্ত বানচাল হয়ে যাবে। আমার লক্ষ্য লাইব্রেরিয়ান - যিনি আমাকে বলে দেবেন যে বইয়ের কোন তাকে গেলে কোন দশক বা দ্বিদশকিয় বাংলা দেশের কবি-র প্রতিনিধি মুলক লেখা পেতে পারব, কারণ আমি জানি যে সেই একি দশকের বহির্বাংলা থেকে বাংলা লেখা বেশ ভিন্ন হবে। এই সত্যটাই আপনাদের বোঝাতে চাইছি। কবিদের এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কি প্রয়োজন? মাথা ঘামাবেন পাঠক ও সমালোচকেরা। আপনি আগে বলছিলেন স্থান ও কালের কথা। আমি বলছি সুরুহ ভাবে সাজাবার জন্য স্থান ও কাল ছাড়াও আরও বিভাজনের প্রয়োজন আছে।

দেবাদ্রিতা বোস: প্রতিস্থান পাঠ্যক্রম তৈরি করে। এবং পাঠ্যক্রম তৈরির এক অন্যতম কারিগরি হোল ক্যানন কে অনুসরন করা। সত্তর, আশি, নব্বই, শূন্য এবং প্রথম এই বিভাজন নতুন কিছু নয়। ইংরাজি সাহিত্যে পড়ে এসেছি দশক না হোক শতক এর বিভাজন। এমনকি ভিক্তরিও নারী সাহিত্যিক দের জন্য বই গুলিতে কিনা আলাদা চ্যাপ্টার । ভাবা যায়! এও এক গভীর নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস। প্রযুক্তি । তবে কি যারা শূন্যের কবি তারা আজ আর লিখবে না? বা নিশ্বাস নেবে না? একজন লেখকের সময়সিমা কে রক্ত মাংসের দশটা বছর দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সবই তো সাপেক্ষ । তালিকাভুক্ত করা মানে ঘুরির ল্যাজে দড়িটা রইল মোস্ট পাওয়ারফুলের হাতে।
বহুমুখিতা কে বেঁধে পেড়ে ফেল। হাতে রইল পেন্সিল ।

দুপুর মিত্র: আলোচনার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। আর পরবর্তী শুক্রবারের বিশেষ আলোচনাতেও আপনাদের অংশগ্রহণের আশা রেখে এখানে আলোচনার সমাপ্তি টানছি।

1 comments:

Pritam Bhattacharyya বলেছেন...

ক্ষেপুর এই প্রয়াস টি আমার খুব ভালো লেগেছে।