চান্দের চর
(নবম কিস্তি)
অলোকপর্ণা
(নবম কিস্তি)
অলোকপর্ণা
পুজোর আগে আগে কোলকাতার মানুষজন পরিযায়ী হয়ে ওঠে। বাস, ট্রেন কোথাও তাদের পাড়ি জমাতে বাকী থাকেনা। উপচে ওঠা বাজার আরো লোক টেনে আনে পাঁচমাথামোড়ে। রেজ্জাক আর দম ফেলার সুযোগ পায় না। এক থেকে সাত সংখ্যাগুলো গত তিন মাসের পর এখন শুধুই টেবিল, তাদের সাংখ্য অস্তিত্ব তারা হারিয়ে ফেলেছে রেজ্জাকের কাছে। ধোঁয়া ওঠা মোটা চিনেমাটির প্লেটসহ সে এই সংখ্যাগুলোর মাঝে ঘুরপাক খায় সকাল থেকে রাত অবধি। এভাবেই একদিন টাকা চিনতে শিখে যায় রেজ্জাক। টাকাও এই শিশু শ্রমিককে চিনে ফেলে,- পঞ্চাইত স্কুলের অঙ্কের নামতা না জেনেও যে জেনে গিয়েছে কতগুলো পাঁচটাকার টিপস্ জমলে একটা গোটা একশো টাকা ডিম পাড়বে। ছোটো কড়া পড়া হাতের মুঠোয় টাকাগুলো শক্ত করে ধরে থাকে রেজ্জাক। কোলকাতার টাকায় ডানা থাকে, কত মানুষের হাত ফসকে তা কোথায় উড়ে যায় কেউ জানে না। কখনও রেসকোর্সে, কখনও খালাসিটোলায়, কখনও সন্ধ্যার এসপ্ল্যানেড চত্তরের মেয়েটির পিছন পিছন টাকা উড়ে চলে। কোলকাতা উড়ুক্কু টাকার শহর। সেই শহরের উপকেন্দ্রে যখন রাত নামে তখন রেজ্জাক নামের দশ বছরের ছেলেটা চিনেমাটির প্লেট থেকে টাকার রূপান্তরিত টুকরোগুলো ধুয়ে ফেলতে থাকে। সিঁড়িতে বসে আছে হাবুল। রোজকার মত আজও সে মত্ত হয়ে উঠছে প্রতি চুমুকে।
“রেজ্জাক...”
“হ্যাঁ, হাবুলদা!”
“তোকে খুব খাটাই না রে?”
“না হাবুল দা। তুমিও তো খাটো।”
“ধুর, তুই একটা ছোট্ট বিড়াল...” হাবুলের গলা জড়িয়ে আসে।
রেজ্জাক নিঃশব্দে হেসে চলে, নেশা চড়লে হাবুলদা মজার মজার কথা বলে।
“রেজ্জাক...”
“বলো।”
“আয় তো এদিকে...”
“দাঁড়াও, এই প্লেটটা সেরে আসছি।” হাতের প্লেটটা মনের মত সাফ হলে রেজ্জাক হাত মুছে সিঁড়ির কাছে আসে। “বলো...”
“জামা খোল”
রেজ্জাক একটু অপ্রস্তুত হয়, “কেন?”
“কেন আবার... আমি বলছি তাই... খোল বলছি, **কির বাচ্চা!”
রেজ্জাক আর কথা বাড়ায় না, পাতলা গেঞ্জিটা কোমর পর্যন্ত তুলে ধরে থেমে যায়।
“আরে খোলরে **, নেকাচ্ছিস কেন? হিরোইন ভাবছিস নিজেকে?” হাবুল নিজেই একটানে খুলে দেয় রেজ্জাকের গেঞ্জি। রেজ্জাক একটু জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়। হাবুলের চোখের দিকে তাকাতে তার ভয় করে। নেশায় হাবুলের চোখ গঙ্গার জলের মত ঘোলাটে হয়ে আসছে। হাবুল তাকিয়ে থাকে রেজ্জাকের আদুর শরীরে। রেজ্জাকের নরম পেট, রোগা বুকের পাঁজরগুলোর ওপর দিয়ে তার দৃষ্টি বয়ে যায়। রেজ্জাকের পেলব কোমরে তার চোখ থামে। আরামে হাবুলের চোখ বুজে আসে। রেজ্জাকের গায়ের গন্ধ সে যেন পায়,- গাঙ্গেয় বদ্বীপ তাতে নিহিত। এরপরই রোজকার রাতের মত হাবুল সিঁড়িতে ঢলে পড়ে। রেজ্জাক আজ আর তাকে তোলার চেষ্টা করে না। অজানা এক ভয়ে সে বাকী প্লেটগুলো কোনো রকমে সেরে রেখে পা টিপে উপরে উঠে আসে। পার্টিশানের এপারে আসতেই তার ধূসর ধূসর কান্না পায়- রেজ্জাক না জানলেও শহর জানে কেন। শহর জানে কেন ধূসর কান্না চেপে কত মেয়ে কত শিশু পথে নামে রোজ, অন্যের উপাদেয় ‘ডিশ’ হয়ে উঠেও তাদের নামতে হয় শহরের রাস্তায়। কোলকাতা অসহায় বসে থাকে গঙ্গার পূর্ব পাড়ে, একবিংশ শতকের মানুষের সভ্য হয়ে ওঠার আশায়।
দীপান্বিতা চ্যাটার্জীর কোলকাতাটা হঠাৎ আত্মীয় হয়ে গেল। যে শহর চিরকাল তাকে একাকীত্ব ছাড়া কিছুই দেয় নি, সেখানে হঠাৎ দীপা যেন একাই সব পেয়েছির আসর। আজকাল সব কিছুই ভাল লাগছে তার। হাওয়া দিলে ভাল লাগে, গুমোট থাকলে ভাল লাগে, আকাশে মেঘ থাকলে ভাল লাগে, না থাকলেও। তার ভাল লাগাগুলো আর কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করছে না। মধ্য ত্রিশে এসে হঠাৎ একদিন নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলল দীপা। এরপর সারা শহরকে তো তার ভাল লাগবেই।
“বাবা...”
“হ্যাঁ, বলো... শরীর কেমন এখন?” ব্যস্ততার মধ্যে থেকে ডঃ ঘোষ সাড়া দেন।
“আমি ঠিক আছি বাবা। শুধু উঠে দাঁড়ালেই মাথাটা ঘুরছে।”
“ওটা কয়েকদিন হবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। এখনো উইকনেস কাটেনি তোমার। রেস্ট দরকার আরো। ঠিক আছে, তাহলে রাখি এখন?”
“না, দাঁড়াও!” দীপা ব্যস্ত হয়।
“কি হয়েছে?”
“কিছু না, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“বলে ফেল।”
“আমার মনে হয় আমি বুঝতে পারছি কেন তীর্থর সাথে আমার সম্পর্কটা স্থায়ী হল না।”
অধৈর্য লাগলেও ফোন কেটে দিতে পারেন না ডঃ ঘোষ। অদম্য কৌতূহলও তাকে কোণ ঠাসা করে নিতে থাকে। “কেন?”
“কারণ আমি কখনই ওকে ভালবাসিনি। কারণ আমি কাউকেই কখনও ভালবাসিনি।”
ডঃ ঘোষ থমকে গেলেন। “আজ এসব বলার মানে কি?”
“আছে। তুমি জানো গত কয়েক মাস আমার শরীর ভাল ছিল না, কেন জানো?”
“হ্যাঁ, তুমি লোনলি ফিল করছিলে। এটা পুরোপুরি তোমার মনের ব্যাপার।”
“একদম। এখন আমি সুস্থ।”
“দ্যাটস্ আ গুড নিউজ! আমি রাখি এখন?”
“আহ, পুরোটা শোনো...”
“বলো।”
কিছু নিস্তব্ধতার পর সারা আসে, “আমি সমপ্রেমী।”
ডঃ ঘোষ নিমেষে কথা হারিয়ে ফেললেন। নিশ্চুপ কয়েক মুহূর্ত পরে বলতে পারলেন, “দীপা, আমার সময় নষ্ট কোরো না। আর ইউ আউট অফ ইয়োর মাইন্ড!”
“না বাবা। আমি নিশ্চিত।”
“কি করে?”
“বিকজ, আই হ্যাভ ফ্যান্টাসাইজড মাইসেলফ উইথ আ গার্ল ফ্রম পাস্ট থ্রি ফোর ডেজ। আর তীর্থর সাথে যেটা আমার কখনই হয়নি, আই হ্যাভ ফলেন ফর হার।”
“কে সে?”
“তুমি চেন না তাকে। আমার কলেজের।”
“মাই গড! আ স্টুডেন্ট!! আর ইউ ইনসেন দীপা! তুমি জানো এর ফল কি হতে পারে?” ডঃ ঘোষ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
“কি আর হবে...”
“ওরা জানলে তোমার চাকরিটা থাকবে বলে তোমার মনে হয়?”
“ওরা জানতে পারবে না।”
“এতো শিয়োর হচ্ছো কি করে!”
“কারণ আমি কাউকে জানাচ্ছি না আর তুমিও আশা করি কাউকে জানাবে না- তাই।”
“মানে? সেই মেয়েটা...”
“ও কিছুই জানে না। জানবেও না। ওর লাইফে আমার জায়গা আদৌ আছে কি না আমি জানতেও যাবো না। তবে তীর্থকে জানানো উচিৎ আমার। আমি ওর সাথে যা করেছি, সেটা অহেতুক, সেটা অন্যায়।”
ডঃ ঘোষ তীর্থঙ্করের ক্ষেত্রে দীপাকে সমর্থন করতে পারলেন না। ওই পুরুষটি চিরকাল তাঁর কাছে লম্পটই হয়ে থাকবে। এমন এক লম্পট পুরুষ যে কি না শারীরিক সুখের খোঁজে বিবাহ বিচ্ছিন্ন করেছে।
“যা ভাল বোঝ করো।”
“আরও একটা কথা ছিল...”
“বলো...”
“পিকুর মেসের ঘরের উলটো দিকের বাড়ির জালনার মেয়েটাকে দেখেছিলাম আমি, তার সাথে আমার মনে হয় পিকুর কিছু একটা কানেকশান ছিল বা আছে।”
“মানে মেয়েটা জানে পিকু কোথায়?”
“আমি- ফিজিকাল না, মেন্টাল কানেকশানের কথা বলছি।”
“ও। সে জেনে আমি কি করব। তোমার মনে হয় গর্দভটা ঠিকঠাক প্রেমও করতে পারবে? ওর দ্বারা এইরকম হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিসস্যু হতে পারে না।”
পিকুর প্রতি বাবার এই বিদ্বেষ দীপার শুনতে ভালো লাগে না। সে কথা ঘোরায়।
“বাবা, কোনো খবর পেলে?”
“না। তবে অনেক ফোন আসছে, চ্যাটার্জী বলছিল। সবাই দাবী করছে তারা পিকুকে দেখেছে। পুলিশ তো দেখছে ব্যাপারটা, তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার ভাই অতোটাও বুদ্ধি করে উঠতে পারবে না যে সে বেমালুম গায়েব হয়ে যাবে। তুমি রেস্ট নাও। তোমার ওটাই দরকার।” ফোন কেটে দেন ডঃ ঘোষ, সমকামী কন্যা আর নিরুদ্দেশ স্বল্পবুদ্ধির পুত্রের প্রতি দুশ্চিন্তা হয় তার, একেক সময় মনে হয়- পিকু বেঁচে আছে তো? তারপরই নিজেই নিজেকে সামলে নেন। নিজেকে সামলাতে না জানলে ডঃ ঘোষ আজ একুশ বছর হসপিটালকে পাখির চোখ করে চিন্তাহীণ থাকতে পারতেন না। তবে দীপা পারে না তার বাবার মতো চিন্তাহীণ হয়ে যেতে। এক এক সময় তার মনে হয় নিজে পথে নেমে এসে, শহরের প্রতিটা কোণায় তার ভাইকে খুঁজে বেরাতে। কিন্তু সে মাথা তুলে উঠতে পারেনা। একটু ওঠার চেষ্টা করলেই মনে হয় যেন সারা ঘর তাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই দীপা বিছানায় পরে থাকে। নতুন-নিজেকে ভাবতে থাকে। তীর্থঙ্করকে সে কি বলবে আর কি বলবে না- সাজাতে থাকে।
“এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও রে মন
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে”
কোলকাতার যে আকাশে তারা দেখতে পাওয়া যায় না, সেই আকাশে ধোঁয়াগুলো পাক খেয়ে উড়ে যাচ্ছে। আর দোপাটি এক এক করে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের স্কেচ করা পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে আগুনে ফেলছে। চারদিক অন্ধকার হওয়ায় কোলকাতার আকাশ থেকে দোপাটিকে আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে স্থির তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে যে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মুখ, চোখ, শ্বেতী পড়া গাল, গলা, নিজে দগ্ধ হতে হতে দোপাটি পুড়িয়ে ফেলছে কঙ্কাবতীর দ্বৈপায়নকে, দীপা ম্যামের পিকুকে। একসময় কেউ একজন তার পাশে এসে দাঁড়ায়।
“কি করছিস তুই এসব?”
চমকে ওঠে দোপাটি। “তুমি ঘুমাওনি পিসঠাকমা?”
“আমার ঘুম হবে চিতেয় উটে, তুই কি করচিস এইসব?”
দোপাটি কিছু না বলে পরের পাতাটা ছিঁড়ে নেয় খাতা থেকে। সেটা আগুনে ফেলার আগেই পিসঠাকমা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেন। আগুনের কাছে এনে খুব ভালো করে দেখতে থাকেন আঁকাটা। “তুই আঁকিস ভালো। শ্বেতীর জায়গা গুলোও একদম ঠিকমতো হয়েচে।” দোপাটি চুপ করে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিসঠাকমা পাতা উল্টে বাকী আঁকাগুলোও দেখতে থাকেন। খাতা শেষ হয়ে গেলে তিনি দোপাটির হাত ধরে বলেন, “আয় আমার সাতে, তোকে অনেক কিছু বলার আচে।” দোপাটি যন্ত্রের মতো ছাদ থেকে নেমে এসে পিসঠাকমার ঘরে আসে।
“বোস” খাটের দিকে ইঙ্গিত করেন বৃদ্ধা। দোপাটি যন্ত্রচালিতের মতো খাটের এককোণায় বসে।
“পুড়িয়ে দিচ্চিস কেন এতো ভালো আঁকাগুলো?”
দোপাটি মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
“ভাই বোন দুই জনকে তুই চিনলি কি করে? কৃষ্ণের দিদি যখন এলো, তুই তো ছিলিস না।”
“উনি, দীপাম্যাম, আমাদের কলেজে পড়ান।”
“বাবুর মাস্টার কৃষ্ণ, তার দিদি আবার তোর মাস্টার!”
“হুম্।”
“আচ্চা, সে না হয় হল। কিন্তু দুই জনের ছবিই তো তুই এঁকেচিস... কোন জনকে তোর ভালো লেগেচে?”
দোপাটি অবাক হয়। “এঁকেছি মানেই কি ভালো লাগতে হবে?”
“খুলে বল মেয়ে, মিত্যে কতা বলিস না। আজ চার কুড়ি বয়স হল আমার।”
“দুজনকেই”
“একসাথে দুই জনকেই তোর ভালোলাগলো শেষে!”
“হ্যাঁ। আমি কিন্তু জানতাম না যে ওঁরা ভাই- বোন।”
“বুঝলাম।”
বিস্মিত দোপাটি বলে “তুমি বকবে না আমায়?”
পিসঠাকমা হাসেন। কিছুই বলেন না। উঠে যান ঘরের এক দিকে। দেওয়াল আলমারী থেকে একটা কাগজ এনে দোপাটির হাতে ধরিয়ে দেন।
“যা, নিজের ঘরে যা। পড়ে দেক, তোরা তো লেকাপড়া করা মেয়ে, তোরা বুজবি।”
দোপাটি নিজের ঘরে এসে টেবিল ল্যাম্প জ্বালায়। কাগজে একটা চিঠি লেখা, বহু পুরনো হলুদ হয়ে যাওয়া এক চিঠি যা পিসঠাকমাকে কেউ কোনো এক সময় পাঠিয়েছিল। আর চিঠিটা মূল্যবান বলেই আজও পিসঠাকমা এটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। দোপাটি পড়তে আরম্ভ করে।
“রেজ্জাক...”
“হ্যাঁ, হাবুলদা!”
“তোকে খুব খাটাই না রে?”
“না হাবুল দা। তুমিও তো খাটো।”
“ধুর, তুই একটা ছোট্ট বিড়াল...” হাবুলের গলা জড়িয়ে আসে।
রেজ্জাক নিঃশব্দে হেসে চলে, নেশা চড়লে হাবুলদা মজার মজার কথা বলে।
“রেজ্জাক...”
“বলো।”
“আয় তো এদিকে...”
“দাঁড়াও, এই প্লেটটা সেরে আসছি।” হাতের প্লেটটা মনের মত সাফ হলে রেজ্জাক হাত মুছে সিঁড়ির কাছে আসে। “বলো...”
“জামা খোল”
রেজ্জাক একটু অপ্রস্তুত হয়, “কেন?”
“কেন আবার... আমি বলছি তাই... খোল বলছি, **কির বাচ্চা!”
রেজ্জাক আর কথা বাড়ায় না, পাতলা গেঞ্জিটা কোমর পর্যন্ত তুলে ধরে থেমে যায়।
“আরে খোলরে **, নেকাচ্ছিস কেন? হিরোইন ভাবছিস নিজেকে?” হাবুল নিজেই একটানে খুলে দেয় রেজ্জাকের গেঞ্জি। রেজ্জাক একটু জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়। হাবুলের চোখের দিকে তাকাতে তার ভয় করে। নেশায় হাবুলের চোখ গঙ্গার জলের মত ঘোলাটে হয়ে আসছে। হাবুল তাকিয়ে থাকে রেজ্জাকের আদুর শরীরে। রেজ্জাকের নরম পেট, রোগা বুকের পাঁজরগুলোর ওপর দিয়ে তার দৃষ্টি বয়ে যায়। রেজ্জাকের পেলব কোমরে তার চোখ থামে। আরামে হাবুলের চোখ বুজে আসে। রেজ্জাকের গায়ের গন্ধ সে যেন পায়,- গাঙ্গেয় বদ্বীপ তাতে নিহিত। এরপরই রোজকার রাতের মত হাবুল সিঁড়িতে ঢলে পড়ে। রেজ্জাক আজ আর তাকে তোলার চেষ্টা করে না। অজানা এক ভয়ে সে বাকী প্লেটগুলো কোনো রকমে সেরে রেখে পা টিপে উপরে উঠে আসে। পার্টিশানের এপারে আসতেই তার ধূসর ধূসর কান্না পায়- রেজ্জাক না জানলেও শহর জানে কেন। শহর জানে কেন ধূসর কান্না চেপে কত মেয়ে কত শিশু পথে নামে রোজ, অন্যের উপাদেয় ‘ডিশ’ হয়ে উঠেও তাদের নামতে হয় শহরের রাস্তায়। কোলকাতা অসহায় বসে থাকে গঙ্গার পূর্ব পাড়ে, একবিংশ শতকের মানুষের সভ্য হয়ে ওঠার আশায়।
দীপান্বিতা চ্যাটার্জীর কোলকাতাটা হঠাৎ আত্মীয় হয়ে গেল। যে শহর চিরকাল তাকে একাকীত্ব ছাড়া কিছুই দেয় নি, সেখানে হঠাৎ দীপা যেন একাই সব পেয়েছির আসর। আজকাল সব কিছুই ভাল লাগছে তার। হাওয়া দিলে ভাল লাগে, গুমোট থাকলে ভাল লাগে, আকাশে মেঘ থাকলে ভাল লাগে, না থাকলেও। তার ভাল লাগাগুলো আর কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করছে না। মধ্য ত্রিশে এসে হঠাৎ একদিন নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলল দীপা। এরপর সারা শহরকে তো তার ভাল লাগবেই।
“বাবা...”
“হ্যাঁ, বলো... শরীর কেমন এখন?” ব্যস্ততার মধ্যে থেকে ডঃ ঘোষ সাড়া দেন।
“আমি ঠিক আছি বাবা। শুধু উঠে দাঁড়ালেই মাথাটা ঘুরছে।”
“ওটা কয়েকদিন হবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। এখনো উইকনেস কাটেনি তোমার। রেস্ট দরকার আরো। ঠিক আছে, তাহলে রাখি এখন?”
“না, দাঁড়াও!” দীপা ব্যস্ত হয়।
“কি হয়েছে?”
“কিছু না, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“বলে ফেল।”
“আমার মনে হয় আমি বুঝতে পারছি কেন তীর্থর সাথে আমার সম্পর্কটা স্থায়ী হল না।”
অধৈর্য লাগলেও ফোন কেটে দিতে পারেন না ডঃ ঘোষ। অদম্য কৌতূহলও তাকে কোণ ঠাসা করে নিতে থাকে। “কেন?”
“কারণ আমি কখনই ওকে ভালবাসিনি। কারণ আমি কাউকেই কখনও ভালবাসিনি।”
ডঃ ঘোষ থমকে গেলেন। “আজ এসব বলার মানে কি?”
“আছে। তুমি জানো গত কয়েক মাস আমার শরীর ভাল ছিল না, কেন জানো?”
“হ্যাঁ, তুমি লোনলি ফিল করছিলে। এটা পুরোপুরি তোমার মনের ব্যাপার।”
“একদম। এখন আমি সুস্থ।”
“দ্যাটস্ আ গুড নিউজ! আমি রাখি এখন?”
“আহ, পুরোটা শোনো...”
“বলো।”
কিছু নিস্তব্ধতার পর সারা আসে, “আমি সমপ্রেমী।”
ডঃ ঘোষ নিমেষে কথা হারিয়ে ফেললেন। নিশ্চুপ কয়েক মুহূর্ত পরে বলতে পারলেন, “দীপা, আমার সময় নষ্ট কোরো না। আর ইউ আউট অফ ইয়োর মাইন্ড!”
“না বাবা। আমি নিশ্চিত।”
“কি করে?”
“বিকজ, আই হ্যাভ ফ্যান্টাসাইজড মাইসেলফ উইথ আ গার্ল ফ্রম পাস্ট থ্রি ফোর ডেজ। আর তীর্থর সাথে যেটা আমার কখনই হয়নি, আই হ্যাভ ফলেন ফর হার।”
“কে সে?”
“তুমি চেন না তাকে। আমার কলেজের।”
“মাই গড! আ স্টুডেন্ট!! আর ইউ ইনসেন দীপা! তুমি জানো এর ফল কি হতে পারে?” ডঃ ঘোষ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
“কি আর হবে...”
“ওরা জানলে তোমার চাকরিটা থাকবে বলে তোমার মনে হয়?”
“ওরা জানতে পারবে না।”
“এতো শিয়োর হচ্ছো কি করে!”
“কারণ আমি কাউকে জানাচ্ছি না আর তুমিও আশা করি কাউকে জানাবে না- তাই।”
“মানে? সেই মেয়েটা...”
“ও কিছুই জানে না। জানবেও না। ওর লাইফে আমার জায়গা আদৌ আছে কি না আমি জানতেও যাবো না। তবে তীর্থকে জানানো উচিৎ আমার। আমি ওর সাথে যা করেছি, সেটা অহেতুক, সেটা অন্যায়।”
ডঃ ঘোষ তীর্থঙ্করের ক্ষেত্রে দীপাকে সমর্থন করতে পারলেন না। ওই পুরুষটি চিরকাল তাঁর কাছে লম্পটই হয়ে থাকবে। এমন এক লম্পট পুরুষ যে কি না শারীরিক সুখের খোঁজে বিবাহ বিচ্ছিন্ন করেছে।
“যা ভাল বোঝ করো।”
“আরও একটা কথা ছিল...”
“বলো...”
“পিকুর মেসের ঘরের উলটো দিকের বাড়ির জালনার মেয়েটাকে দেখেছিলাম আমি, তার সাথে আমার মনে হয় পিকুর কিছু একটা কানেকশান ছিল বা আছে।”
“মানে মেয়েটা জানে পিকু কোথায়?”
“আমি- ফিজিকাল না, মেন্টাল কানেকশানের কথা বলছি।”
“ও। সে জেনে আমি কি করব। তোমার মনে হয় গর্দভটা ঠিকঠাক প্রেমও করতে পারবে? ওর দ্বারা এইরকম হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিসস্যু হতে পারে না।”
পিকুর প্রতি বাবার এই বিদ্বেষ দীপার শুনতে ভালো লাগে না। সে কথা ঘোরায়।
“বাবা, কোনো খবর পেলে?”
“না। তবে অনেক ফোন আসছে, চ্যাটার্জী বলছিল। সবাই দাবী করছে তারা পিকুকে দেখেছে। পুলিশ তো দেখছে ব্যাপারটা, তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার ভাই অতোটাও বুদ্ধি করে উঠতে পারবে না যে সে বেমালুম গায়েব হয়ে যাবে। তুমি রেস্ট নাও। তোমার ওটাই দরকার।” ফোন কেটে দেন ডঃ ঘোষ, সমকামী কন্যা আর নিরুদ্দেশ স্বল্পবুদ্ধির পুত্রের প্রতি দুশ্চিন্তা হয় তার, একেক সময় মনে হয়- পিকু বেঁচে আছে তো? তারপরই নিজেই নিজেকে সামলে নেন। নিজেকে সামলাতে না জানলে ডঃ ঘোষ আজ একুশ বছর হসপিটালকে পাখির চোখ করে চিন্তাহীণ থাকতে পারতেন না। তবে দীপা পারে না তার বাবার মতো চিন্তাহীণ হয়ে যেতে। এক এক সময় তার মনে হয় নিজে পথে নেমে এসে, শহরের প্রতিটা কোণায় তার ভাইকে খুঁজে বেরাতে। কিন্তু সে মাথা তুলে উঠতে পারেনা। একটু ওঠার চেষ্টা করলেই মনে হয় যেন সারা ঘর তাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই দীপা বিছানায় পরে থাকে। নতুন-নিজেকে ভাবতে থাকে। তীর্থঙ্করকে সে কি বলবে আর কি বলবে না- সাজাতে থাকে।
“এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও রে মন
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে”
কোলকাতার যে আকাশে তারা দেখতে পাওয়া যায় না, সেই আকাশে ধোঁয়াগুলো পাক খেয়ে উড়ে যাচ্ছে। আর দোপাটি এক এক করে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের স্কেচ করা পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে আগুনে ফেলছে। চারদিক অন্ধকার হওয়ায় কোলকাতার আকাশ থেকে দোপাটিকে আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে স্থির তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে যে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মুখ, চোখ, শ্বেতী পড়া গাল, গলা, নিজে দগ্ধ হতে হতে দোপাটি পুড়িয়ে ফেলছে কঙ্কাবতীর দ্বৈপায়নকে, দীপা ম্যামের পিকুকে। একসময় কেউ একজন তার পাশে এসে দাঁড়ায়।
“কি করছিস তুই এসব?”
চমকে ওঠে দোপাটি। “তুমি ঘুমাওনি পিসঠাকমা?”
“আমার ঘুম হবে চিতেয় উটে, তুই কি করচিস এইসব?”
দোপাটি কিছু না বলে পরের পাতাটা ছিঁড়ে নেয় খাতা থেকে। সেটা আগুনে ফেলার আগেই পিসঠাকমা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেন। আগুনের কাছে এনে খুব ভালো করে দেখতে থাকেন আঁকাটা। “তুই আঁকিস ভালো। শ্বেতীর জায়গা গুলোও একদম ঠিকমতো হয়েচে।” দোপাটি চুপ করে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিসঠাকমা পাতা উল্টে বাকী আঁকাগুলোও দেখতে থাকেন। খাতা শেষ হয়ে গেলে তিনি দোপাটির হাত ধরে বলেন, “আয় আমার সাতে, তোকে অনেক কিছু বলার আচে।” দোপাটি যন্ত্রের মতো ছাদ থেকে নেমে এসে পিসঠাকমার ঘরে আসে।
“বোস” খাটের দিকে ইঙ্গিত করেন বৃদ্ধা। দোপাটি যন্ত্রচালিতের মতো খাটের এককোণায় বসে।
“পুড়িয়ে দিচ্চিস কেন এতো ভালো আঁকাগুলো?”
দোপাটি মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
“ভাই বোন দুই জনকে তুই চিনলি কি করে? কৃষ্ণের দিদি যখন এলো, তুই তো ছিলিস না।”
“উনি, দীপাম্যাম, আমাদের কলেজে পড়ান।”
“বাবুর মাস্টার কৃষ্ণ, তার দিদি আবার তোর মাস্টার!”
“হুম্।”
“আচ্চা, সে না হয় হল। কিন্তু দুই জনের ছবিই তো তুই এঁকেচিস... কোন জনকে তোর ভালো লেগেচে?”
দোপাটি অবাক হয়। “এঁকেছি মানেই কি ভালো লাগতে হবে?”
“খুলে বল মেয়ে, মিত্যে কতা বলিস না। আজ চার কুড়ি বয়স হল আমার।”
“দুজনকেই”
“একসাথে দুই জনকেই তোর ভালোলাগলো শেষে!”
“হ্যাঁ। আমি কিন্তু জানতাম না যে ওঁরা ভাই- বোন।”
“বুঝলাম।”
বিস্মিত দোপাটি বলে “তুমি বকবে না আমায়?”
পিসঠাকমা হাসেন। কিছুই বলেন না। উঠে যান ঘরের এক দিকে। দেওয়াল আলমারী থেকে একটা কাগজ এনে দোপাটির হাতে ধরিয়ে দেন।
“যা, নিজের ঘরে যা। পড়ে দেক, তোরা তো লেকাপড়া করা মেয়ে, তোরা বুজবি।”
দোপাটি নিজের ঘরে এসে টেবিল ল্যাম্প জ্বালায়। কাগজে একটা চিঠি লেখা, বহু পুরনো হলুদ হয়ে যাওয়া এক চিঠি যা পিসঠাকমাকে কেউ কোনো এক সময় পাঠিয়েছিল। আর চিঠিটা মূল্যবান বলেই আজও পিসঠাকমা এটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। দোপাটি পড়তে আরম্ভ করে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন