চান্দের চর
(দশম কিস্তি)
অলোকপর্ণা
শ্রীচরণেষু দিদি,
আপনি আমার আচরণে স্তম্ভিত এবং ভীত হইয়াছেন, কিন্তু আমি ইহার কারণে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। আমার অপরাধবোধ নাই বলিলে ভুল হইবে, কিন্তু সেদিন অন্ধকারে আপনাকে কাছে পাইবার লোভ সম্বরণ করিবার ক্ষমতা এবং সংযম আমি হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম। দেশের খোঁজ আমরা কতটুকুই বা রাখি, এমন হইতেই পারে যে কলিকাতার বাহিরে কোথাও আমাদের মত কোনো নারীরা পরষ্পরকে চাহিতেছে আপ্রাণ। ঈশ্বরের জীব আমরা। প্রেমও তাহারই সৃষ্টি। প্রেম যদি অন্যায় না হইয়া থাকে তাহা হইলে আমিও অন্যায় করি নাই। প্রথম দিন হইতেই আপনার প্রতি আমি আকর্ষণ বোধ করিয়াছি, পরবর্তী কালেও করিব। আর ইহাও আমি জানিয়াছি, বুঝিয়াছি যে আপনিও আমাকে ততটুকুই চাহিতেছেন যতটুকু আমি। ভয় যে আমি পাইনা তাহা নয়। কিন্তু ভয়ের চেয়েও আমার কাছে আপনার প্রতি দুনির্বার আকর্ষণ বড় হইয়া উঠিয়াছে। তবে এটুকুই শান্তি আমাদের যে আজীবন আমাদের কেহ পৃথক করিতে পারিবে না। প্রণাম জানাইয়া আজ শেষ করিতেছি,
ইতি, আপনার কেহ।
“পিসঠাকমা!” অস্ফুটে বলে ওঠে দোপাটি। অবাক শহরে রাত বেড়ে চলে। দোপাটির ঘুম নামে না। বিছানায় বসে সে চিঠিটা বারংবার পড়তে থাকে।
- বেশ কিছুটা একনাগাড়ে লিখে থেমে যান তীর্থঙ্কর। নতুন উপন্যাস প্রায় মাঝপথে, কিন্তু এর মধ্যেই তিনি টের পাচ্ছেন রাইটার্স ব্লক আসছে। সন্তর্পনে এই সব খরা তীর্থঙ্করের কলম দখল করে নেয়। দিনের পর দিন রাতের পর রাত একটাও শব্দ তখন পেনের নিব থেকে ঝরে না। আবার হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে হয়তো তিনি দেখবেন না বলে কয়ে শয়ে শয়ে শব্দ মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে। তীর্থঙ্কর পাত্তা দেন না। বইমেলার কাজ সেরে ফেলার পর আর কোনো কিছুই বিচলিত করতে পারে না তাকে। বাইরে অঝোর বৃষ্টি নামলেও তিনি ঠিক করেন এর মধ্যেই বের হবেন। দুদিন আগের সন্ধ্যার দিকে তাই তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীকে গাড়ি চালিয়ে কলকাতার পথে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। কলকাতার রাস্তা, কলকাতার বৃষ্টি নিখুঁত ফুটিয়ে তোলেন তিনি তাঁর লেখায়। মানুষ নিজেকে তাঁর লেখার মধ্যে খুঁজে পায় অতি সহজেই। বইমেলার স্টলে বহুবার বহু মানুষ এসে কেঁদে ফেলেছেন তাঁর সামনে, তাদের চোখেমুখে একটাই প্রশ্ন- “আপনি আমার কথা জানলেন কি করে?” তীর্থঙ্কর মৃদু হেসেছেন। ঈশ্বর ছাড়া একমাত্র তিনিই জানেন যে ওই সব মানুষদের জন্ম তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর কলমে, কোনো মাতৃগর্ভে নয়। আত্মতুষ্ট তীর্থঙ্কর হাসেন গাড়ির স্টিয়ারিং- এ বসে। এমন ভাবে পাশের সীটের দিকে তাকান যেন তিনি ঈশ্বরের পাশে বসে গাড়ি চালাচ্ছেন। তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী ও তাঁর ঈশ্বরকে নিয়ে বিদেশী গাড়িটা কলকাতার ভীড়ে একসময় হারিয়ে যায়।
“ও দাদা! অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অ্যালজেব্রার পি সি ডি এর বই আছে?” বৃষ্টি উপেক্ষা করে কঙ্কাবতী চেঁচিয়ে যায় কলেজ স্ট্রীটের কোনো এক বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যার পড়াটা না থাকায় দোপাটি আঁকার খাতা বাঁচাতে বাসে উঠে গেছে একটু আগেই। একা কঙ্কাবতী জুতো সমেত তার জঙ্ঘা জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় চিৎকার শুনে ত্রিপলের আড়াল সরিয়ে প্রৌঢ় মুখ বের করেন, “এই বৃষ্টিতে মানুষ আসে এখানে? এখন দোকান বন্ধ! কিছু বিক্রি হবে না!”
“হবে না মানে? আমার সামনের সপ্তাহে টেস্ট আছে, আপনি বই দিন!”
“আহ্, বলছি না এখন বই বিক্রি হবে না।”
“আপনি দেবেন না বই?”
“না বললাম তো!”
“ঠিক আছে, আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো, যখন আপনার দোকান খুলবে আমি তখনই বই নিয়ে যাবো, কিন্তু বই আমি আজ নেবই।”
“যা খুশি করো!” আড়ালে ঢুকে যান বিক্রেতা। কঙ্কাবতী দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যিই সে আর কোনো দোকান খোলা দেখতে পায় না। এই জলজমা শহরে ট্রাম আর প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া যেন কিছুই নেই। নিরুপায় কঙ্কাবতী দোকানের সামনে কোনোক্রমে ছাতা আগলে দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তার এক দিকে একটা গাড়ি এসে থামে। দেখেই বোঝা যায় সেটা বেশ দামী। কঙ্কাবতী একটু ভীত হয়। ফাঁকা কলেজস্ট্রীটে বিপদে পড়লে জনমানবের সাহায্য আশা করা বৃথা। সে দোকানের দিকে আরও একটু সরে আসে। গাড়ি থেকে কাউকে নামতে দেখা যায় না। কঙ্কাবতী একটু আশ্বস্ত হতেই দোকানের আড়াল আবার সরে প্রৌঢ়র মুখ দেখা দেয়, “এই নাও, আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। কি জেদই না হয়েছে আজকালকার মেয়েদের, এক্কেবারে কাজ সেরে তবে তারা থামবে, একশো কুড়ি হয়েছে।” বইটা এগিয়ে দেন তিনি কঙ্কাবতীর দিকে।
“ডিসকাউন্ট দিয়েছেন তো?”
“হ্যাঁ বাবা, তোমার থেকে বেশি টাকা নিলে আমার দোকান আস্ত রাখবে তুমি! যাও বাড়ি যাও, আকাশের হাল ভাল না।”
টাকা মিটিয়ে কঙ্কাবতী রাস্তায় নামে, কলকাতা তার এইকারণেই প্রিয়,- কলকাতার মানুষের জন্য। কলেজস্ট্রীট মোড়ে এসে রাস্তা পার হয়ে সে খুশি মনে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ায়। দ্রুত কিছু অটো বেরিয়ে যাচ্ছে স্টেশন অভিমুখে, হাত দেখিয়ে ব্যর্থ হয় সে। একসময় পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াতে কঙ্কাবতী পিছিয়ে আসে- সেই দামী গাড়িটা। ড্রাইভারের কাচ নেমে যায়, সুদর্শন এক মধ্যবয়স তার দিকে হাসিমুখে তাকায়, কঙ্কাবতীর টিভি দেখার অভ্যাস না থাকায় সে ভদ্রলোককে চিনতে পারে না, তবু ভয় পাওয়ার বদলে কঙ্কাবতীর ভাল লাগে।
“আমি ছেড়ে দেব আপনাকে?”
“না, ঠিক আছে।”
“ভয় নেই আপনার কোনো।”
“আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি না।”- নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না কঙ্কাবতী।
“তাহলে আপনি বাসের জন্যই অপেক্ষা করবেন?”
“হ্যাঁ।” হাসিমুখে সে উত্তর দেয়।
ভদ্রলোক জালনার কাচ তুলে গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিকেল কলেজের দিকে চলে যান। কিছু পরেই বাস পেয়ে যায় কঙ্কাবতী। ফাঁকা জালানার ধারে বসে আজ কেন কে জানে এক রোগা ছেলের কথা তার বারবার মনে পড়তে থাকে। মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে যায়।
রবিবার সেনবাড়িতে সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য বস্তু হল টিভির রিমোট। জ্যেঠু, বাবা, ছোটকার খবর, ছোড়দার খেলা, মা, ছোটকাকি, পিসঠাকমার সিরিয়াল, সিনেমা আর বাবুর কার্টুন পার করে তা আর কখনই দোপাটির হাতে পৌঁছায় না। তাই সে অন্যদের সাথে ভাগে ভাগে টিভি দেখে নেয়। আজকাল অবশ্য সবাই একটাই চ্যানেল দেখছে- বাংলা খবরের, যেটায় প্রতি তিন মিনিট অন্তর ছবি সমেত কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ঘোষের নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা করা হচ্ছে। বাবু গুণে বার করেছে আজ তিনদিন হল দ্বৈপায়নকে কেউ শেষ দেখেছে।
“তোমার কি মনে হয় দাদা, কোথায় যেতে পারেন উনি?” মা বলেন খবর চলাকালীন।
জ্যেঠু তাঁর চিরকালীন নিশ্চিন্ত স্বরে বলেন “ধুর কলকাতা শহরে কেউ হারায় না কি! দেখো কোথায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন...”
“দাদা, ভয় দেখিয়ে দিও না এদের।” বাবা টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই বলেন।
বাবু একমনে টিভি দেখছিল, তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ছোড়দা, “কি রে, তোর কৃষ্ণস্যার বলেছে - কোথায় যেতে পারে?”
“আহ্ ছোড়দা, সরো না! না বলেনি, আমার সাথে লাস্ট দিন দেখাই হয়নি স্যরের!” বাবু বিরক্ত হয়।
ছোড়দা সরে গেলে সবাই আবার টিভিতে মন দেয়। খানিক পড়ে মা বলে ওঠেন, “আচ্ছা, ওরা কৃষ্ণস্যারের পুরোনো ছবি দেখাচ্ছে কেন?”
“হয়তো নতুন ছবি নেই!” ছোটোকাকি বলেন।
“ওরা তো শ্বেতীর কথাও বিবরণে বলছে না।” বাবা মুখ ফেরান বাকীদের দিকে।
বাবু বলে “আমার মনে হয় ওরা জানেই না স্যরের শ্বেতীর কথা, স্যর বলেছিলেন অনেকদিন তিনি বাবা, দিদিকে দেখেননি। খালি ফোনেই কথা হত।”
জ্যেঠু বলেন, “তো কৃষ্ণ নিশ্চয়ই ফোনেই বলেছে, এ কথা চেপে রাখার কি আছে?”
“না জ্যেঠু, স্যর নিজেই জানেন না যে ওনার শ্বেতী হয়েছে।” বাবু বলে। সবাই অবাক হয়, “স্যর তো জীবনেও আয়না দেখেন না! উনি নাকি ভয় পান... কি একটা আইসোপফোবিয়া না কি একটার কথা আমায় বলেছিলেন একদিন।”
বাবা বলেন “তাহলেও কেউ কি ওনাকে মুখের দাগগুলোর কথা বলেনি? নিশ্চয়ই বলেছে...”
“না বাবা, কেউ বলেনি। আমার জন্মদিনের ছবিতে স্যর নিজেকে খুঁজেই পেলেন না, বার বার নিজের মুখের ওপর আঙুল বুলিয়ে চলে গেলেন, তারপর রাগ করে থাকলেন কিছুক্ষণ, ওনাকে না নিয়ে ছবি তোলার জন্য।”
সবাই চুপ হয়ে গেলে বাবা নিস্তব্ধতা ভাঙেন, “তাহলে বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?”
“মানে?” মা জানতে চান।
জ্যেঠু বলেন, “মানে হল এই শ্বেতীর কথা দীপান্বিতা চ্যাটার্জী এবং তাঁর বাবাকে কে জানাবে?”
“আমি।” সবাইকে অবাক করে দিয়ে দোপাটি বলে, “দীপা ম্যাম আমার কলেজে ইংলিশ পড়ান।”
সারা ঘরে টিভি ছাড়া আর কোনো আওয়াজ শোনা যায় না। শুধু একসময় বাবা বলেন “যখন বলবে, নরম ভাবে বোলো।”
শরৎ কাল কলকাতাকে কিছু মেঘ দেয়, কিছু মর্জি মাফিক রোদ, কাজেই আবহাওয়ার অদলবদলে মন মেজাজ বদলে যায় মানুষের। দুদিন আগের সন্ধ্যার বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় দ্বৈপায়নের জ্বর এসেছে। এমনিতেই তার সারা বছর কাঁথা প্রয়োজন। ইলেক্ট্রিক বিল কমানোর জন্য ফ্যান ছাড়া বেঁচে থাকার অভ্যাস তার আছে, তাই অতি অল্প হাওয়াতেই তার শীত লাগতে শুরু করে। এবং অসময়ে স্নান বা বৃষ্টি তার উষ্ণতা বাড়িয়ে জ্বর এনে ফেলে। চাঁদনী চকের এক গলির অন্ধকারে পড়ে পড়ে কাঁপতে থাকে দ্বৈপায়ন, মনে মনে মা কে ডাকতে থাকে। আজ একুশ বছর কেটে যাওয়ার পরও অসহায় বোধ করলে দ্বৈপায়নের সবার প্রথমে মায়ের কথাই মনে পড়ে। তারপর দিদি।
জ্বর বাড়ায় “মা... মা...” বলে গোঙাতে থাকে সে। কেউ একজন তার কপালে হাত রাখে,- ঠান্ডা নরম হাত। চোখ খুলে দ্বৈপায়ন দেখে রবিবাউল, অন্ধকারে তাঁর সাদা দাড়ি আরো সাদা দেখাচ্ছে।
“আপনি?”
“চুপ, কথা বোলো না।”
দ্বৈপায়ন চুপ করে চোখ বোজে, জ্বরের তাপে মণিগুলো যেন গলে যাচ্ছে তার। চোখ বুজেই সে টের পায় কোথা থেকে রবি বাউল জলপটি জোগাড় করে তার কপালে চেপে চেপে ধরছেন। আরো চোখ বুজে আসে দ্বৈপায়নের। রবি বাউলের গলার গুনগুন সুরটা মৌমাছির মত ম ম করতে থাকে তার কান ভরে। সেই গান যখন সঞ্চারীতে পড়ে তখন ধুম জ্বরের সাথে সাথে দ্বৈপায়ন জ্ঞান হারায়।
চাঁদনী চক অঞ্চলে আগে কখনো দ্বৈপায়নের পা পড়েনি, চোখ খুলতেই চকচকে রোদ যেন ঢুকে গেল তার মধ্যে। ভাল করে তাকিয়ে সে দেখতে পেল,- একটা ময়লার বড় ড্রামের পাশে সে শুয়ে আছে। জ্বর আছে কি না বুঝতে পারল না সে। উঠে বসার পর তার চোখ পড়ল একটা শাল পাতার ওপর, যার মধ্যে থেকে একটা পাকা কলা উঁকি দিচ্ছে। শালপাতাটা খুলতেই সে ভিতরে কলার সাথে সাথে পাউরুটি আর ডিম পেল। রবি বাউল,- নামটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বৈপায়ন খাওয়া শুরু করল। নিমেষে পুরোটা শেষ করে যখন মুখ তুলল সে তখন দেখতে পেল রাস্তার উলটো দিকের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেই পাঁচমাথামোড়ের শিশু শ্রমিক। এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করার জন্য যখনই দ্বৈপায়ন তার কাছে উঠে আসতে গেল তখনই এক লোমশ দশাসই চেহারার পুরুষ তাকে প্রায় টানতে টানতে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। ভিতরের অন্ধকারের জন্য তাদের আর সে দেখতে পেল না।
(দশম কিস্তি)
অলোকপর্ণা
শ্রীচরণেষু দিদি,
আপনি আমার আচরণে স্তম্ভিত এবং ভীত হইয়াছেন, কিন্তু আমি ইহার কারণে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। আমার অপরাধবোধ নাই বলিলে ভুল হইবে, কিন্তু সেদিন অন্ধকারে আপনাকে কাছে পাইবার লোভ সম্বরণ করিবার ক্ষমতা এবং সংযম আমি হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম। দেশের খোঁজ আমরা কতটুকুই বা রাখি, এমন হইতেই পারে যে কলিকাতার বাহিরে কোথাও আমাদের মত কোনো নারীরা পরষ্পরকে চাহিতেছে আপ্রাণ। ঈশ্বরের জীব আমরা। প্রেমও তাহারই সৃষ্টি। প্রেম যদি অন্যায় না হইয়া থাকে তাহা হইলে আমিও অন্যায় করি নাই। প্রথম দিন হইতেই আপনার প্রতি আমি আকর্ষণ বোধ করিয়াছি, পরবর্তী কালেও করিব। আর ইহাও আমি জানিয়াছি, বুঝিয়াছি যে আপনিও আমাকে ততটুকুই চাহিতেছেন যতটুকু আমি। ভয় যে আমি পাইনা তাহা নয়। কিন্তু ভয়ের চেয়েও আমার কাছে আপনার প্রতি দুনির্বার আকর্ষণ বড় হইয়া উঠিয়াছে। তবে এটুকুই শান্তি আমাদের যে আজীবন আমাদের কেহ পৃথক করিতে পারিবে না। প্রণাম জানাইয়া আজ শেষ করিতেছি,
ইতি, আপনার কেহ।
“পিসঠাকমা!” অস্ফুটে বলে ওঠে দোপাটি। অবাক শহরে রাত বেড়ে চলে। দোপাটির ঘুম নামে না। বিছানায় বসে সে চিঠিটা বারংবার পড়তে থাকে।
- বেশ কিছুটা একনাগাড়ে লিখে থেমে যান তীর্থঙ্কর। নতুন উপন্যাস প্রায় মাঝপথে, কিন্তু এর মধ্যেই তিনি টের পাচ্ছেন রাইটার্স ব্লক আসছে। সন্তর্পনে এই সব খরা তীর্থঙ্করের কলম দখল করে নেয়। দিনের পর দিন রাতের পর রাত একটাও শব্দ তখন পেনের নিব থেকে ঝরে না। আবার হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে হয়তো তিনি দেখবেন না বলে কয়ে শয়ে শয়ে শব্দ মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে। তীর্থঙ্কর পাত্তা দেন না। বইমেলার কাজ সেরে ফেলার পর আর কোনো কিছুই বিচলিত করতে পারে না তাকে। বাইরে অঝোর বৃষ্টি নামলেও তিনি ঠিক করেন এর মধ্যেই বের হবেন। দুদিন আগের সন্ধ্যার দিকে তাই তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীকে গাড়ি চালিয়ে কলকাতার পথে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। কলকাতার রাস্তা, কলকাতার বৃষ্টি নিখুঁত ফুটিয়ে তোলেন তিনি তাঁর লেখায়। মানুষ নিজেকে তাঁর লেখার মধ্যে খুঁজে পায় অতি সহজেই। বইমেলার স্টলে বহুবার বহু মানুষ এসে কেঁদে ফেলেছেন তাঁর সামনে, তাদের চোখেমুখে একটাই প্রশ্ন- “আপনি আমার কথা জানলেন কি করে?” তীর্থঙ্কর মৃদু হেসেছেন। ঈশ্বর ছাড়া একমাত্র তিনিই জানেন যে ওই সব মানুষদের জন্ম তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর কলমে, কোনো মাতৃগর্ভে নয়। আত্মতুষ্ট তীর্থঙ্কর হাসেন গাড়ির স্টিয়ারিং- এ বসে। এমন ভাবে পাশের সীটের দিকে তাকান যেন তিনি ঈশ্বরের পাশে বসে গাড়ি চালাচ্ছেন। তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী ও তাঁর ঈশ্বরকে নিয়ে বিদেশী গাড়িটা কলকাতার ভীড়ে একসময় হারিয়ে যায়।
“ও দাদা! অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অ্যালজেব্রার পি সি ডি এর বই আছে?” বৃষ্টি উপেক্ষা করে কঙ্কাবতী চেঁচিয়ে যায় কলেজ স্ট্রীটের কোনো এক বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যার পড়াটা না থাকায় দোপাটি আঁকার খাতা বাঁচাতে বাসে উঠে গেছে একটু আগেই। একা কঙ্কাবতী জুতো সমেত তার জঙ্ঘা জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় চিৎকার শুনে ত্রিপলের আড়াল সরিয়ে প্রৌঢ় মুখ বের করেন, “এই বৃষ্টিতে মানুষ আসে এখানে? এখন দোকান বন্ধ! কিছু বিক্রি হবে না!”
“হবে না মানে? আমার সামনের সপ্তাহে টেস্ট আছে, আপনি বই দিন!”
“আহ্, বলছি না এখন বই বিক্রি হবে না।”
“আপনি দেবেন না বই?”
“না বললাম তো!”
“ঠিক আছে, আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো, যখন আপনার দোকান খুলবে আমি তখনই বই নিয়ে যাবো, কিন্তু বই আমি আজ নেবই।”
“যা খুশি করো!” আড়ালে ঢুকে যান বিক্রেতা। কঙ্কাবতী দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যিই সে আর কোনো দোকান খোলা দেখতে পায় না। এই জলজমা শহরে ট্রাম আর প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া যেন কিছুই নেই। নিরুপায় কঙ্কাবতী দোকানের সামনে কোনোক্রমে ছাতা আগলে দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তার এক দিকে একটা গাড়ি এসে থামে। দেখেই বোঝা যায় সেটা বেশ দামী। কঙ্কাবতী একটু ভীত হয়। ফাঁকা কলেজস্ট্রীটে বিপদে পড়লে জনমানবের সাহায্য আশা করা বৃথা। সে দোকানের দিকে আরও একটু সরে আসে। গাড়ি থেকে কাউকে নামতে দেখা যায় না। কঙ্কাবতী একটু আশ্বস্ত হতেই দোকানের আড়াল আবার সরে প্রৌঢ়র মুখ দেখা দেয়, “এই নাও, আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। কি জেদই না হয়েছে আজকালকার মেয়েদের, এক্কেবারে কাজ সেরে তবে তারা থামবে, একশো কুড়ি হয়েছে।” বইটা এগিয়ে দেন তিনি কঙ্কাবতীর দিকে।
“ডিসকাউন্ট দিয়েছেন তো?”
“হ্যাঁ বাবা, তোমার থেকে বেশি টাকা নিলে আমার দোকান আস্ত রাখবে তুমি! যাও বাড়ি যাও, আকাশের হাল ভাল না।”
টাকা মিটিয়ে কঙ্কাবতী রাস্তায় নামে, কলকাতা তার এইকারণেই প্রিয়,- কলকাতার মানুষের জন্য। কলেজস্ট্রীট মোড়ে এসে রাস্তা পার হয়ে সে খুশি মনে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ায়। দ্রুত কিছু অটো বেরিয়ে যাচ্ছে স্টেশন অভিমুখে, হাত দেখিয়ে ব্যর্থ হয় সে। একসময় পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াতে কঙ্কাবতী পিছিয়ে আসে- সেই দামী গাড়িটা। ড্রাইভারের কাচ নেমে যায়, সুদর্শন এক মধ্যবয়স তার দিকে হাসিমুখে তাকায়, কঙ্কাবতীর টিভি দেখার অভ্যাস না থাকায় সে ভদ্রলোককে চিনতে পারে না, তবু ভয় পাওয়ার বদলে কঙ্কাবতীর ভাল লাগে।
“আমি ছেড়ে দেব আপনাকে?”
“না, ঠিক আছে।”
“ভয় নেই আপনার কোনো।”
“আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি না।”- নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না কঙ্কাবতী।
“তাহলে আপনি বাসের জন্যই অপেক্ষা করবেন?”
“হ্যাঁ।” হাসিমুখে সে উত্তর দেয়।
ভদ্রলোক জালনার কাচ তুলে গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিকেল কলেজের দিকে চলে যান। কিছু পরেই বাস পেয়ে যায় কঙ্কাবতী। ফাঁকা জালানার ধারে বসে আজ কেন কে জানে এক রোগা ছেলের কথা তার বারবার মনে পড়তে থাকে। মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে যায়।
রবিবার সেনবাড়িতে সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য বস্তু হল টিভির রিমোট। জ্যেঠু, বাবা, ছোটকার খবর, ছোড়দার খেলা, মা, ছোটকাকি, পিসঠাকমার সিরিয়াল, সিনেমা আর বাবুর কার্টুন পার করে তা আর কখনই দোপাটির হাতে পৌঁছায় না। তাই সে অন্যদের সাথে ভাগে ভাগে টিভি দেখে নেয়। আজকাল অবশ্য সবাই একটাই চ্যানেল দেখছে- বাংলা খবরের, যেটায় প্রতি তিন মিনিট অন্তর ছবি সমেত কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ঘোষের নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা করা হচ্ছে। বাবু গুণে বার করেছে আজ তিনদিন হল দ্বৈপায়নকে কেউ শেষ দেখেছে।
“তোমার কি মনে হয় দাদা, কোথায় যেতে পারেন উনি?” মা বলেন খবর চলাকালীন।
জ্যেঠু তাঁর চিরকালীন নিশ্চিন্ত স্বরে বলেন “ধুর কলকাতা শহরে কেউ হারায় না কি! দেখো কোথায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন...”
“দাদা, ভয় দেখিয়ে দিও না এদের।” বাবা টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই বলেন।
বাবু একমনে টিভি দেখছিল, তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ছোড়দা, “কি রে, তোর কৃষ্ণস্যার বলেছে - কোথায় যেতে পারে?”
“আহ্ ছোড়দা, সরো না! না বলেনি, আমার সাথে লাস্ট দিন দেখাই হয়নি স্যরের!” বাবু বিরক্ত হয়।
ছোড়দা সরে গেলে সবাই আবার টিভিতে মন দেয়। খানিক পড়ে মা বলে ওঠেন, “আচ্ছা, ওরা কৃষ্ণস্যারের পুরোনো ছবি দেখাচ্ছে কেন?”
“হয়তো নতুন ছবি নেই!” ছোটোকাকি বলেন।
“ওরা তো শ্বেতীর কথাও বিবরণে বলছে না।” বাবা মুখ ফেরান বাকীদের দিকে।
বাবু বলে “আমার মনে হয় ওরা জানেই না স্যরের শ্বেতীর কথা, স্যর বলেছিলেন অনেকদিন তিনি বাবা, দিদিকে দেখেননি। খালি ফোনেই কথা হত।”
জ্যেঠু বলেন, “তো কৃষ্ণ নিশ্চয়ই ফোনেই বলেছে, এ কথা চেপে রাখার কি আছে?”
“না জ্যেঠু, স্যর নিজেই জানেন না যে ওনার শ্বেতী হয়েছে।” বাবু বলে। সবাই অবাক হয়, “স্যর তো জীবনেও আয়না দেখেন না! উনি নাকি ভয় পান... কি একটা আইসোপফোবিয়া না কি একটার কথা আমায় বলেছিলেন একদিন।”
বাবা বলেন “তাহলেও কেউ কি ওনাকে মুখের দাগগুলোর কথা বলেনি? নিশ্চয়ই বলেছে...”
“না বাবা, কেউ বলেনি। আমার জন্মদিনের ছবিতে স্যর নিজেকে খুঁজেই পেলেন না, বার বার নিজের মুখের ওপর আঙুল বুলিয়ে চলে গেলেন, তারপর রাগ করে থাকলেন কিছুক্ষণ, ওনাকে না নিয়ে ছবি তোলার জন্য।”
সবাই চুপ হয়ে গেলে বাবা নিস্তব্ধতা ভাঙেন, “তাহলে বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?”
“মানে?” মা জানতে চান।
জ্যেঠু বলেন, “মানে হল এই শ্বেতীর কথা দীপান্বিতা চ্যাটার্জী এবং তাঁর বাবাকে কে জানাবে?”
“আমি।” সবাইকে অবাক করে দিয়ে দোপাটি বলে, “দীপা ম্যাম আমার কলেজে ইংলিশ পড়ান।”
সারা ঘরে টিভি ছাড়া আর কোনো আওয়াজ শোনা যায় না। শুধু একসময় বাবা বলেন “যখন বলবে, নরম ভাবে বোলো।”
শরৎ কাল কলকাতাকে কিছু মেঘ দেয়, কিছু মর্জি মাফিক রোদ, কাজেই আবহাওয়ার অদলবদলে মন মেজাজ বদলে যায় মানুষের। দুদিন আগের সন্ধ্যার বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় দ্বৈপায়নের জ্বর এসেছে। এমনিতেই তার সারা বছর কাঁথা প্রয়োজন। ইলেক্ট্রিক বিল কমানোর জন্য ফ্যান ছাড়া বেঁচে থাকার অভ্যাস তার আছে, তাই অতি অল্প হাওয়াতেই তার শীত লাগতে শুরু করে। এবং অসময়ে স্নান বা বৃষ্টি তার উষ্ণতা বাড়িয়ে জ্বর এনে ফেলে। চাঁদনী চকের এক গলির অন্ধকারে পড়ে পড়ে কাঁপতে থাকে দ্বৈপায়ন, মনে মনে মা কে ডাকতে থাকে। আজ একুশ বছর কেটে যাওয়ার পরও অসহায় বোধ করলে দ্বৈপায়নের সবার প্রথমে মায়ের কথাই মনে পড়ে। তারপর দিদি।
জ্বর বাড়ায় “মা... মা...” বলে গোঙাতে থাকে সে। কেউ একজন তার কপালে হাত রাখে,- ঠান্ডা নরম হাত। চোখ খুলে দ্বৈপায়ন দেখে রবিবাউল, অন্ধকারে তাঁর সাদা দাড়ি আরো সাদা দেখাচ্ছে।
“আপনি?”
“চুপ, কথা বোলো না।”
দ্বৈপায়ন চুপ করে চোখ বোজে, জ্বরের তাপে মণিগুলো যেন গলে যাচ্ছে তার। চোখ বুজেই সে টের পায় কোথা থেকে রবি বাউল জলপটি জোগাড় করে তার কপালে চেপে চেপে ধরছেন। আরো চোখ বুজে আসে দ্বৈপায়নের। রবি বাউলের গলার গুনগুন সুরটা মৌমাছির মত ম ম করতে থাকে তার কান ভরে। সেই গান যখন সঞ্চারীতে পড়ে তখন ধুম জ্বরের সাথে সাথে দ্বৈপায়ন জ্ঞান হারায়।
“যে দিন তুমি অগ্নিবেশে সব-কিছু মোর নিলে এসে
সে দিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব।”
চাঁদনী চক অঞ্চলে আগে কখনো দ্বৈপায়নের পা পড়েনি, চোখ খুলতেই চকচকে রোদ যেন ঢুকে গেল তার মধ্যে। ভাল করে তাকিয়ে সে দেখতে পেল,- একটা ময়লার বড় ড্রামের পাশে সে শুয়ে আছে। জ্বর আছে কি না বুঝতে পারল না সে। উঠে বসার পর তার চোখ পড়ল একটা শাল পাতার ওপর, যার মধ্যে থেকে একটা পাকা কলা উঁকি দিচ্ছে। শালপাতাটা খুলতেই সে ভিতরে কলার সাথে সাথে পাউরুটি আর ডিম পেল। রবি বাউল,- নামটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বৈপায়ন খাওয়া শুরু করল। নিমেষে পুরোটা শেষ করে যখন মুখ তুলল সে তখন দেখতে পেল রাস্তার উলটো দিকের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেই পাঁচমাথামোড়ের শিশু শ্রমিক। এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করার জন্য যখনই দ্বৈপায়ন তার কাছে উঠে আসতে গেল তখনই এক লোমশ দশাসই চেহারার পুরুষ তাকে প্রায় টানতে টানতে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। ভিতরের অন্ধকারের জন্য তাদের আর সে দেখতে পেল না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন