শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ভালোবাসি বাংলা - বঙ্গজীবনে চরিত্রবদল - শ্রী শুভ্র

বঙ্গজীবনে চরিত্রবদল
শ্রী শুভ্র


কোনো একটি জাতিগোষ্ঠির চরিত্র কালের প্রবাহে; সেই জাতিগোষ্ঠির মাতৃভূমির ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে এবং বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির সাথে মেলামেশার প্রবাহে কালে কালে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে! সেটাই স্বাভাবিক! চরিত্রের সেই বিকাশের পর্ব থেকে পর্বান্তরে অনেক ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে জাতিসত্তা! সেই জাতিসত্তার চরিত্রের বদল কিন্তু দুদিনেই হঠাৎ হয় না! প্রায় দুইহাজার বছরের ইতিহাস ব্যাপী এই যে বঙ্গজীবন এর পরতে পরতে কালের পালে এসে লাগা হাওয়ায় ঘটে গেছে পরিবর্তনের পর পরিবর্তন! কিন্তু সেই পরিবর্তনের ফলে যে বাঙালির চরিত্রের বদল ঘটবেই তা নয়! আবার ঘটলেও তাকে বাস্তব বলে মেনে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত! কাম্য না হলেও!

এক কালে কালাপানি পেরোলে বাঙালির জাত যেত! পুরুত ডাকিয়ে গোবর খেয়ে রীতিমত যাগযোজ্ঞ করে তবেই তার প্রায়শ্চিত্য হতো সম্পূর্ণ! তারপর বাঙালি যখন ইংরেজের বৈভবে দিশাহারা হল, তখন অবস্থা গেল বদলে, সমাজে বিলেত ফেরতের কদর গেল বেড়ে! বিলেত ফেরত না হলে, নামের পাশে বিলাতী ডিগ্রী না ঝুললে পণ্ডিত বলে আর মান্যিগন্যি পাওয়া যায় না সমাজে! কি আশ্চর্যম!ঘরজামাইয়ের যুগ নেই আর! একদিন মান্যিগন্যি ব্যক্তিরা ঘরজামাই রেখে সমাজে ছড়ি ঘোরাতে পারতেন! এযুগে এন আর আই জামাই দেখিয়ে শ্বশুর শ্বাশুরীর গর্বে মাটিতে পা পড়ে না!সংস্কৃত পণ্ডিতদের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল এককালে! আজ তারা থাকলে করুণার পাত্র!গৃহশিক্ষকের কাজও জোটে না! এও বদল!

রামমোহনের যুগে বঙ্গ সমাজে সহমরণ প্রথার বড়োই মহিমা ছিল! মৃত স্বামীর সাথে জ্যান্ত বৌ পুড়িয়ে ধর্মরক্ষা করা হতো! যুগ পাল্টিয়েছে তবু বৌ পোড়ানো বন্ধ হয়নি! বদলে গেছে ধরণ! সে যুগে মৃতের সম্পত্তি থেকে তার বৌকে বঞ্চিত করার দায় ছিল! এখন বৌকে চাপ দিয়ে তার বাপের বাড়ির সম্পত্তি সম্পদ হাতিয়ে নেবার প্রচলন হয়েছে সমাজের সর্বচ্চো স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্য্যন্ত সর্বত্র! চাহিদা পুরণ না হলেই ভর্তুকির কেরোসিন গায়ে ঢেলে দেশলাই জ্বালিয়ে দিলেই হলো! তাই বলে বৌকে লাই দেওয়া কদাপি নয়! সেযুগে স্বামীর পরিজন বাড়ির বধুকে জ্যান্ত দেহে চিতায় ওঠাতো! এযুগে স্বামী নিজেই মূল উদ্যোগতা হয়ে দেশলাই কেরোসিনের ব্যায় বহনের দায়িত্ব নেন!

সে এক যুগ ছিল, সমাজে শিক্ষককূলের একটা আলাদা সম্মান ছিল! শিক্ষকের গৃহে দারিদ্র ছিল কিন্তু আদর্শের অভাব ছিল না! কালের প্রবাহে শিক্ষককূলের ঘরে আর অভাব নেই! তবে তার সাথে আদর্শও ফাঁকা হয়ে গিয়েছে অলক্ষ্যে! আগে ছাত্রদের মধ্যেই স্কুল ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা ছিল সীমাবদ্ধ! আজ শিক্ষককূলও স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাঁধা মাহিনার সাথে বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে উই টি আই এর নানান স্কীম থেকে শেয়ার বাজারেও ফাটকা খেলছেন নিশ্চিন্তে! মানুষ গড়ার কারিগররা এখন জয়েণ্ট পাশ করাচ্ছেন! বিষয় বস্তুতে ছাত্রদের বিদ্যাদানের বদলে নোটদান করছেন! কোশ্চেন লিকের নতুন নামকরণ হয়েছে শিওর সাজেশানস! সেই দেখেই শিক্ষকের গৃহে অভিভাবকের লম্বা লাইন!

এক সময় শিক্ষকের সম্মান ছিল ছাত্র সমাজে! আজ শিক্ষকের প্রয়োজন পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়াতে! আগে ছাত্ররা শিক্ষকের ভয়ে সভ্য হয়ে থাকত সুবোধ হয়ে! পরিবর্তনের হাত ধরে সেসব বদলে গেছে ধীরে ধীরে! ছাত্র আন্দোলনের সূত্রে শিক্ষকরা হতে থাকলেন ঘেরাওয়ের শিকার! আর আজ ছাত্রদের হাতে উত্তম মধ্যম জোটে শিক্ষকের ভাগ্যেও! আগে শিক্ষকের কথায় ছাত্ররা ওঠবোস করতো! এখন ছাত্র ইউনিয়ন পরিচালনা করে শিক্ষকদের! আগে অভিভাবকদের স্বপ্ন ছিল সন্তান মানুষ হবে! এখন অভিভাবকরা সন্তানের জন্য ডিগ্রী কিনতে ঘটিবাটি বেচতেও রাজী! আগে অভিভাবকরা শিক্ষা দিতেন সততার! আজ তারা শিক্ষা দেন চতুরতার! শিক্ষার লক্ষ্য এখন লাক্সারি ফ্ল্যাট গাড়ী, বিদেশ যাত্রা!

আগেকার কালে বাল্যবিবাহ বহুবিবাহর প্রচলন ছিল ঘরে ঘরে! আইন করে সেসব কুপ্রথা রদ হয়েছে ঠিক! তবে এখন বাল্য প্রেমের পরিণতি বিবাহ থেকে মুখে এসিড ছুঁড়ে মারা পর্য্যন্ত গড়িয়েছে! বহুবিবাহ আইনত বন্ধ বলে পরকীয়া পল্লবিত হয়েছে নানা রঙে! বাঙালির প্রেম আড়াল থেকে এখন সর্বসমক্ষে উত্তীর্ণ! বিবাহ বিচ্ছেদ এখন আর বিরল ঘটনা নয়! বরং অধিকাংশ প্রেমের পরিণতি বিবাহ না বিচ্ছেদ সেটাও গবেষণা সাপেক্ষ! বিধবা বিবাহ এখন আর সামাজিক নিন্দার নয়! ফলে বাঙালির সামাজ জীবনের নানান পরিবর্তনের সাথে চরিত্রবদল ঘটে গেছে ব্যক্তি বাঙালির বহিরাঙ্গে! কিন্তু প্রশ্ন হল সেই বদল বাঙালির ব্যক্তি চরিত্রের অন্তরাঙ্গে কতটা হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি?

বহুযুগ ধরেই বাংলার মানুষের মধ্যে কোনো অভিন্ন জাতিসত্তা গড়ে ওঠেনি! ক্রমাগত বিদেশী শাসনে অভ্যস্ত হয়ে শাসকের অনুগ্রহ অর্জনেই সে ব্যস্ত থেকেছে সবচেয়ে বেশি! ফলে বাঙালির ব্যক্তি চরিত্রের মধ্যে গড়ে ওঠেনি আত্মপ্রত্যয়! বরং প্রশাসকেরসেবার মধ্যেই সে আত্মমর্যাদা লাভে হয়েছে স্বচেষ্ট! ঠিক এই কারণেই বাঙালির চরিত্রের সাথে স্তাবকতার সুসম্পর্ক বহুদিনের! এই ভাবেই সে আখের গোছাতে মনোনিবেশ করেছে বংশ পরম্পরায়! এর অবশ্যাম্ভাবি ফলসরূপ লুব্ধচিত্তে সে ঐশ্বর্য্যশালী পরাক্রমী জাতির করুণা অর্জনে কাঙাল হয়েছে! আর অবজ্ঞা করেছে নিজ জাতির দরিদ্র জনসাধারণকে! বঞ্চিত করেছে তাদেরকে তাদের প্রাপ্য থেকে! এই চরিত্রের বদল হয়েছে কোথায়?

শত শত শতাব্দী ব্যাপী বাঙালি একের পর এক বিদেশী জাতির শাসনের অধীনে থেকে নিজস্ব জাতীয়তায় কোনোদিনই দীক্ষিত হয়ে ওঠেনি! আজ বিভক্ত বাঙালির একপক্ষ দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে থেকে নিজেকে যতটা ভারতীয় নাগরিক বলে বিশ্বাস করে, বাঙালি বলে ততটা অনুভব করতে চায় না নিজেকে! সর্বদা তার লক্ষ্য কতটা ভারতীয় হয়ে ওঠা যায়! আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইংরেজী আর রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে হিন্দী ভাষার প্রতি তার সাধনা যত; নিজের মাতৃভাষার প্রতি তার সাধনা ও ভালোবাসা তার ভগ্নাংশ মাত্র! ফলে স্বদেশী বাঙালির প্রতি ব্যক্তি বাঙালির সংবেদনশীলতা খুব বেশি নয়! যে কারণে বাংলার প্রতি তার স্বদেশ প্রেমও আজও দানা বাঁধল না!

মোঘোল সম্রাট বাবর তাঁর আত্মচরিতে বাঙালি সম্বন্ধে লিখেছিলেন; "বাঙালিরা পদকেই শ্রদ্ধা করে, তারা বলে আমরা তখতের প্রতি বিশ্বস্ত! যিনি সিংহাসন অধিকার করেন আমরা তাঁরই আনুগত্য স্বীকার করি!" যার ফলসরূপ বাঙালির চরিত্রের মধ্যে তোষামোদ, চাটুকারিতা, পরনিন্দা পরচর্চা, সুযোগসন্ধানী সুবিধেবাদী মানসিকতা,তদ্বির প্রবণতা প্রভৃতি প্রকৃতিগুলি ভীষণ ভাবেই প্রবল! ভোগলিপ্সা তার মজ্জাগত কিন্তু কর্মক্ষেত্রে ফাঁকিবাজিতে সে ওস্তাদ! কোনো যৌথ প্রয়াসে বাঙালির সাফল্য যে বিশেষ দেখা যায় না, তার জন্যে এই কারণগুলির সাথে ঈর্ষাপরায়ণতাও দায়ী! মূলত স্বাজাত্যবোধ না জাগলে প্রকৃতিগত এই ত্রুটিগুলি কোনো জাতির পক্ষেই কাটিয়ে ওঠা যায় না!

আত্মপ্রত্যয়হীনতায় ভুগে বিদেশী প্রশাসকের ভাষা সংস্কৃতিতে দক্ষতা অর্জনকেই বাঙালি তার সমৃদ্ধি বলে মনে করেছে! ফলে অন্ধ অনুকরণ প্রবণতা তাকে মৌলিকতা অর্জনে কোনো কালেই উদ্বুদ্ধ করে নি জাতিগত ভাবে! বাঙালির চরিত্রের এই মৌলিক প্রকৃতির কোনোই বদল তো হয়নিই, বরঞ্চ তা সমাজদেহের সর্বত্র ছড়িয়েছে! এবং এই আবিশ্ব বিশ্বায়নের গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে বর্তমানে বাঙালি বাঙালিত্ব বর্জন করে অতি দ্রুত আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার মত্ততায় ছুটেছে নেশাগ্রস্তের মতো! ফলে স্বাধীনতার পূর্বে ও পরেও বাঙালি রয়ে গেছে বাঙালিতেই! পৃথিবীর অন্যান্য জাতি যখন স্বাজাত্ববোধে দীক্ষিত হয়ে আপন জাতিসত্বায় গর্বিত! বাঙালী তখন ভারতীয়তায় আত্মবিসর্জনে মগ্ন!