বিষাদের ঘেরাটোপে: বিদিশা সরকারের কবিতা
শমীক জয় সেনগুপ্ত
অবিচুয়ারি লিখতে আমার ভালো লাগেনা। মনে হয় যে মানুষটাকে দুদিন আগেও ছুঁতে পারতাম হঠাৎ করে তার না থাকাটা কেমন যেন চাপ সৃষ্টি করছে মনে মননে ও চিন্তায়। কিন্তু সময়কে আমরা টেক্কা দিয়ে বলতে পারি না...
"এখন তো সব ইচ্ছা সব লেখা আকাশ তোমাকে,
বৃষ্টি এসে মুছে দিয়ে
যাবে
তোমার মসৃণ নীলে পাল তুলে..."। (ঐচ্ছিক)
কারণ যে লিখছে তার ইচ্ছেরা অনিচ্ছেরা সব বড় বেশি জাগতিকভাবেই এখনো আছে। আর যাকে নিয়ে লিখছে তার থেকেই শব্দের ভাণ্ডার কিছুটা চুরি করে এনে সাজাচ্ছে এই মর্বিডিটির মোনোলগ। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার দেখা আমার শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের দোরগোড়ায়। যতদূর সম্ভব বেহালা কিংবা টালিগঞ্জের কোন এক সাহিত্য বাসরে যেখানে আমি গেছি বাচ্চাদের দল থেকে একটা ছড়া শোনাবার জন্য। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে ওইদিন দেখা হলেও আলাপ হয়নি এবং পরবর্তী কোন সময় যে আলাপ হবে তেমন কোন সম্ভাবনাও ছিল না। কলেজে পড়তে পড়তেই আমি চাকরি শুরু করি এবং সেই চাকরির দুনিয়া আমাকে এতটাই গ্রাস করে নিয়েছিল যে ব্যক্তিগত সময় লেখালেখি এগুলো চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা একটা বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। ততদিনে আমরা অর্কুট করতে শিখেছি। অর্কুট বন্ধ হয়ে গেলে ফেসবুক এল। এবং এই ফেসবুকেই আবার দেখা এবং তখন থেকেই রীতিমত আলাপ। কথা বলছি কবি বিদিশা সরকারকে নিয়ে। আমাদের বিদিশা'দি।
মানুষ মারা গেলে লোকে তাকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং ভাল ভাল কথা লিখে রাখে। কিন্তু একজন কবি কী শুধু এই স্মৃতি ও প্রশংসার কাঙাল! আমার তো মনে হয় সব কবি তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উদগ্রীব থাকে। আর যে কথাগুলো ব্যক্তিগত যে ভাব শুধুমাত্র পারিবারিক বা বন্ধু মহল বিশিষ্ট তাকে অনাবশ্যকভাবে লিপিবদ্ধ করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই। বরং আসুন আজ আমরা একটু কবি বিদিশা সরকারের কবিতার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্ত বা পড়বার কিছুটা সময় ভাগ করে নিই। আমাকে বিদিশা'দি অনেকগুলো বই উপহার দিয়েছিলেন কিন্তু কাজের সময় শুধুমাত্র অভিজয় প্রকাশনীর"নির্বাক টকিজ" ছাড়া অন্য কোন বই হাতের কাছে পেলাম না। যদিও ওর "হুক্কাবার" কাব্যগ্রন্থটি আমার বেশ পছন্দের একটি বই, কিন্তু আপনারা আমাকে চেনেন, আমি নিজের কবিতার লাইনই মনে রাখতে পারি না, এক্ষেত্রে স্মৃতি থেকে ভুলভাল কোটেশন করা মোটেই উচিত কাজ হবে না।
আমার মতে বিদিশা সরকার ছিলেন আধুনিক সময়ের সেই সমস্ত কবিদের একজন যারা শুধুমাত্র কবিতাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজেছেন জীবনে। ওর কবিতায় নাগরিক জনজীবন এবং তার বিচ্ছিন্নতা এবং সেখান থেকে ক্রমশ প্রকৃতির কাছে আশ্রয় খোঁজা এবং আবার এই শহুরে জীবনে প্রত্যাবর্তন, সম্পূর্ণ সার্কেলটি বারবার দেখা গেছে। কিন্তু এসবের মধ্যেই এক অদ্ভুত রকম বিষাদ ঘন আচ্ছাদন ওর লেখাকে আদ্যোপান্ত গ্রাস করেছে। আনন্দ দুঃখ বন্ধুত্ব প্রেম সব রকম অনুভূতি আসলে এক বিষাদের চাদরে নিজেকে ঢেকে ওর কবিতার মাধ্যমে বারবার পাঠকের কাছে ফিরে এসেছে।
"তুমি খুশি দিলে
মুহূর্ত উন্মার্গগামী
তারপর সমতল ছুঁয়ে
এবড়ো খেবড়ো ব্রণই তো শুধু-
একটা খালি খামে
কি জানি কি নেবে ভেবে
ফেলে রেখে গেছ
আমি তাকে নৌকা বানালাম
অন্যনামে
যদি পারো আলো কিনে দিও
কত কি হারিয়ে যাচ্ছে
নখগুলো উপড়ে দিলো কে যে!
কে সেই এমন নিষ্ঠুর
ঘুমের অতল
থই থই জল
ব্রণ খুঁটে খুঁটে কিশোরী আয়নায়" (আরশি)
এটা হয়তো এক ধরনের অবিশ্বাসসূচক আত্মবিশ্লেষণ। জীবনে যে দুঃখগুলো যে কষ্টগুলো মানুষকে বিদীর্ণ করে দেয়, একটা সময়ের পর তারা যে কেবলমাত্র গা সওয়া হয়ে যায় তা কিন্তু নয়, তারা ক্রমশ অভ্যাসে রূপান্তরিত হয়। যারা বিদিশা দিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন তারা জানেন যে মানুষটার ভেতরে একটা থমকে যাওয়া কিশোরীবেলা সব সময় ঘুরপাক খেতো। আমরা হেসে বলতাম, "আমাদের দিদি বুড়ো হবে, বড় হবে না"। সেই ছটফটে তরুণীকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য নিজের পরিণত বয়সে পাওয়া দুঃখ কষ্টগুলোকেও অনেক সময় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, আবার ওই কিশোরীবেলাকেই অবলম্বন করে জারণ করেছে, তার পরিণত বয়স্ক অনুভূতিদের। আসলে কবিমাত্রই লেখালেখির বাইরে হয়তো একটু অপরিণামদর্শী ও ছেলেমানুষ হয়ে। আবার কখনো কখনো বুঝতেও পারতো যে সামনের মানুষটি এত ভালো ভালো কথা বলছে আসলে সবই ছদ্ম অনুরাগ। একটা জায়গায় লিখছেন -
"আমাকে শুনবে বলে কেউ কেউ হলমার্ক প্রত্যয় শোনায়। সেলফিতে সহজ হয় বাথরুম - আয়নার নিজস্ব বয়ান। দূরে কোন আগুন সংবাদ শুনে দমকল এক- চতুর্থাংশটুকু নিভাতে পারে না।
........ বানানো খবর আর খবর বানানো নিয়ে কিছু কারিগর অনিচ্ছুক শব্দগুলো প্রকাশ্যে সাজায়। বাকি অংশ পাঁচের পাতায়-" (আমাকে শুনবে বলে)
বিদিশা সরকারের কবিতায় যে ভাষা ব্যবহৃত হতো, তা ছিল অত্যন্ত স্মার্ট এবং সময় সচেতন একটি ভাষাশৈলী। এটা আমাদের ৯০ দশকের বেশিরভাগ কবিরই স্বকীয় ভাষা খোঁজার প্রবণতা থেকেই এসেছে। নয়ের দশকের বেশিরভাগ কবি, কবিতাতে একটা সিগনেচার স্টাইল ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বারবার। শূন্য ও পরবর্তী দশক কবিতার গঠনকে ভাঙচুর করার দিকে যতটা মন দিয়েছে নয়ের দশক সেখানে বারবার খোঁজ করেছে স্বকীয় স্বর।
"পাখি আসবে না ভেবে
বেচে দিলে হরিয়ালি খেত
অথচ পাখালি শব্দে ঘুম ভাঙ্গে অসফল ভোরে
স্বপ্নের শতাব্দী কোনো স্টেশনে থামে না
কখন পৌঁছে যায় রাজধানী" (রবিশস্য)
সবুজাভ বা শ্যামলী খেত নয়, হরিয়ালি। কারণ ওই যে আগে বলেছি নগর জীবন থেকে পালিয়ে প্রকৃতির বুকে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব এক প্রাণ। কিন্তু সেই প্রকৃতি সবসময় যে বঙ্গ জননীর বুকে খুঁজে পাবে আশ্বাস তা কিন্তু নয়। সে সর্বত্র বিচরণ করে। নিজের ভাষাকে অবজ্ঞা করে না কিন্তু অন্যের ভাষা কি গ্রহণ করতেও দুবার ভাবে না। সেখানে সবসময় "গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ" না বেজে মাঝের মধ্যে "তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম" ও শোনা যায়। এখানে চুপিচুপি বলে রাখি শাহরুখ খান আমার ও বিদিশাদির দুজনেরই খুব প্রিয় অভিনেতা। যদিও ব্যক্তিগত কথা বলব না বলেছি কিন্তু তাও যখন নিজের মানুষকে নিয়ে কথা বলতে বসা হয় একটা দুটো স্লিপ অফ টাং হয়ে যায়। আবার এই প্রিয় অভিনেতা যাকে ধরা ছোঁয়া যায় না বা এমন অনেক প্রিয়জন যাদের সঙ্গে চাইলেই কথা বলা যায় না তাদের উপর অভিমানও জমে উঠতো।
"এমন তাচ্ছিল্য করে প্রেম হয় নাকি
এমন গোয়ালা ভোরে..." (তর্কে বহুদূর)
তখন যদি কেউ একটু হাসি ঠাট্টা করত, অমনি বকুনি দিয়ে দিত। আবার ওখান থেকেই শুরু হতো অন্য কোন কবিতার প্রেক্ষাপট। সবসময় থেকে লেখাগুলো তার ব্যক্তিগত যাপন থেকে উঠে আসছে তা কিন্তু নয়। যারা মানুষ বিদিশা সরকারকে চেনেন, তারা জানেন সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গেই সমানভাবে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতো এই মানুষটি। ফলে তাদের গল্প তাদের জীবন গভীরভাবে রেখাপাত কাটতো। আর রেখাপাত কাটতো ওইসব মানুষগুলোর যন্ত্রণা। নিজের কষ্টগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে সুবিধা হতো হয়তো, এবং অনেক সময় বলতো, "ওরা যে কষ্টে আছে তার কাছে আমাদের দুঃখ কিছুই না..."
হয়তো সত্যিই কিছু না আবার হয়তো অনেক কিছুই। কিন্তু না বলা সংলাপগুলো শখের বাগান থেকে যে শ্রীমতি টনিক দিয়ে গুছিয়ে রাখত তার কি বিষাদ আঁকড়ে বসে থাকলে চলে। শ্রীমতি টনিক কবিতাতে নিজেই লিখছে
"বৃষ্টি নামবে এইবারে সরযু অস্থির
ছাদে মেলে রাখা সব রঙিন
বসন ধুয়ে যাবে
ধুয়ে যাবে সব রং
তুমিও তো এখন দেখছি নকল
হইতে সাবধান"
এই বৃষ্টির জলে রং ধুয়ে যেতে যেতে আর সব নকল মেকি মুখগুলোকে সরাতে সরাতে সত্যিই কি এই শ্রীমতিরও ধুয়ে যাওয়া উচিত হয়েছে? একেক সময় ভাবি আর তখনই দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
মন খারাপের দাস্তান
উত্তরমুছুনঅনেক দিনের হারানো সুর পেলাম যে আবার...
উত্তরমুছুনমন খারাপ হয়ে গেল।
উত্তরমুছুন