মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৪

প্রবন্ধ -শুকদেব চট্টোপাধ্যায়

বিধান-রায়


না, ইনি সেই কিংবদন্তি চিকিৎসক এবং বাংলার স্বনামধন্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নন। ইনি বা সঠিক ভাবে বলতে গেলে এনারা বিশ্বের নানান জায়গায় ছড়িয়ে আছেন বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক গুলোর মধ্যে। এদের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ উদ্যোগে সুন্দর স্বাভাবিক ছন্দে প্রবহমান সমাজে আসে নানা প্রতিবন্ধকতা। নানা প্রকার বিধান এবং রায়দানের মাধ্যমে এরা সমাজে দখলদারির চেষ্টা করেন। এই প্রয়াস মানব সভ্যতার আদি পর্ব থেকেই চলে আসছে। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে প্রকট হয়েছে এদের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি। মূলত ধর্মীয় ভাবাবেগকে পাথেয় করেই গড়ে ওঠে এদের কর্মশালা। সাফল্য যে সব সময় একই পরিমাণে আসে এমনটা নয়। কিন্তু যখন এরা নিজেদের মতের পক্ষে রাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয় তখন ফল হয় ভয়ংকর। মানুষের সুস্থ চিন্তা ভাবনা, বৈজ্ঞানিক চেতনা, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, সব কিছু অবদমিত হয়ে যায়। প্রাচীন এবং মধ্য যুগের ইউরোপে বহু যুগান্তকারী  বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে চার্চ কর্তৃক অস্বীকার এবং ক্ষেত্র বিশেষে আবিষ্কর্তাকে চরম নিপিড়ন, মধ্যযুগে ভারতবর্ষে সতীদাহ, কুলীন ব্রাহ্মণদের বিবাহ ও অন্যান্য কুকাজ এর মত অসংখ্য বর্বরোচিত ও পাশবিক ক্রিয়াকলাপে সমাজের মাতব্বরদের সমর্থন এবং পৃষ্ঠপোষকতা, হাল আমলের তালিবানি ফতোয়া--- সারা বিশ্ব জুড়ে পাওয়া যাবে এমন অসংখ্য উদাহরণ। বিভিন্ন সময়ে প্রণম্য কিছু সমাজ সংস্কারক আজীবন সংগ্রাম করে সমাজের বুকে গজিয়ে ওঠা বিষাক্ত এই আগাছা গুলোকে নির্মূল করার চেষ্টা করেছেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা সফলও হয়েছেন। কিন্তু এর শিকড় যে বড় গভীরে। কিছুকাল পরে আবার গজায় নতুন আগাছা।
আমি ইতিহাসবিদ নই। ফলে এই সংক্রান্ত দীর্ঘ ইতিহাসের গভীরে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। পদে পদে পদস্খলনের সম্ভাবনা থেকে যায়।
ফিরে আসি বর্তমানে। একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার শিখরে ওঠা মানব সমাজেও  বহাল  তবিয়তে  বিচরণ করছে এই বিধান, রায় দাতারা। হয়ত সর্বত্র এদের খবরদারি আগের মত অতটা বলিষ্ঠ  নয় এবং তা অগ্রাহ্য করার মত মানুষের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে, তবু ক্ষেত্র বিশেষে এখনও এরা স্বমহিমায় রয়েছে।
যাজকরা বিধান দেওয়ার ব্যাপারে চিরকালই পুরোভাগে থাকে।  বিধি নিষেধগুলো তৈরি হয়   সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারকে(কু) অবলম্বন করে। এই সংস্কার আবার সর্বত্র এক নয়। একই বাঙালি পূর্ব এবং পশ্চিমে ভিন্ন সংস্কারে আচ্ছন্ন। প্রচলিত সংস্কারকে নিজের প্রয়োজন মত  পরিবর্ধন এবং পরিবর্তন করে এঁরা পরিবেশন করেন। 
যাজক ছাড়া ইদানীং আবার কিছু মাতব্বর নেতা মন্ত্রীদের মুখেও মাঝে মাঝে তাঁর এলাকার মানুষ  কি করবে আর কি করবেনা তার একটা ফিরিস্তি দিতে শোনা যাচ্ছে। সত্যিই, আমাদের কত অভিভাবক।
পড়া বা শোনা ঘটনাতে পরে আসছিনিজেদের চেনা পরিমণ্ডলে প্রাত্যহিক জীবনে আমরা অহরহ নানাবিধ বিধিনিষেধের সম্মুখীন হই। সেগুলি কেউ বিশ্বাসের সঙ্গে মানি, কেউ লোকলজ্জার ভয়ে পাশ কাটাতে পারি না, আবার কেউ কেউ বিরোধিতা করি।
নিজের জীবনের  ঘটনা দিয়ে শুরু করি।
আমার পৈতে হয় মামার বাড়িতে। কান ফুটো করা হবে না, বাবার কাছে এই অভয় পাওয়ার পর আমি পৈতেতে রাজি হইসমস্ত ক্রিয়া কর্ম হয়ে যাওয়ার পর পুরোহিত মশাই আমাকে বিধান দিলেন---তুমি তো হস্টেলে থেকে পড়াশুনো কর তাই মাছ মাংস না খেলে অসুবিধে হবে। মাছ, মাংস খেও কিন্তু এক বছর ডিমটা খেও না।
আমার কিশোর মনে তখন প্রশ্ন জেগেছিল যে আমাকে মাছ মাংস খেতে বলা এবং ডিম খেতে নিষেধ করার ক্ষমতা উনি পেলেন কোথায়। স্বভাবতই ওই রায় আমার পক্ষে মানা সম্ভব হয়নি। তবে হস্টেলে থাকার জন্য ব্যাপারটা যত সহজে হয়েছিল বাড়িতে মার সামনে হয়ত সেটা হত না।
আমার নিকট আত্মীয়া এক বৃদ্ধা মারা গেছেন। ভদ্রমহিলা শেষ জীবনটা তাঁর একমাত্র মেয়ের বাড়িতে কাটিয়েছেন।  মহিলার শ্বশুরবাড়িতে খবর পাঠান হয়েছে। কাকিমার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সুশান্ত এসেছে। সুশান্ত মাঝে মাঝে এসে কাকিমার খোঁজ খবর নিত। কাকিমার মুখাগ্নি সে করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের কুল পুরোহিত বিধান দিয়েছেন যে যেহেতু কয়েক মাস আগে তার আর এক নিঃসন্তান কাকিমার সে মুখাগ্নি করেছে তাই সুশান্তর এখন অশৌচ চলছে। অশৌচ অবস্থায় এই কাকিমার মুখাগ্নি করা তার চলবে না। অসুবিধে হয়নি। বৃদ্ধার জামাই মুখাগ্নি এবং অন্যান্য পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মগুলি করে। কেবল কাছা নেয়নি। শ্রাদ্ধের কাজের জন্য সেই পুরোহিতকেই ডাকা হয়। একথা সেকথার পর জামাই তাকে জিজ্ঞেস করে যে কারো বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে যদি মা মারা যায় তাহলে কি হবে ? ছেলেটিই সব কাজকর্ম করবে,  না তার অশৌচ চলছে বলে মায়ের ক্রিয়া কর্মের জন্য অন্য লোক খুঁজতে হবে। পুরোহিত কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। অবশ্য মানুষটা চতুর হলে আর একটা স্বরচিত বিধান দিয়ে বাবা/মায়ের ক্ষেত্রে স্পেশাল ছাড় ঘোষণা করে দিত।
আমাদের ঘরে দৈনন্দিন জীবনে আরোপিত বিধি নিষেধের রূপায়নের দিকটি নিষ্ঠার সঙ্গে তদারকি করেন পরিবারের বয়স্কা মহিলারাএঁদের কর্মের ব্যাপ্তি নির্ভর করে পরিবারের আয়তনের ওপর। অনু পরিবারে শতেক সমস্যা থাকলেও এই একটা ব্যাপারে তারা তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ। অবশ্য কিছু প্রথিতযশা মাসিমা/কাকিমা তাঁদের কর্মকাণ্ডের পরিধি কেবল নিজের পরিবারের মধ্যেই আটকে রাখাটা পছন্দ করেন না। পাড়ার অথবা আত্মীয় পরিজনের যে কোন কাজেই, তারা চাক বা না চাক, গিয়ে হাজির হন এবং অবশ্যই কিছু বিধি নিষেধের ফিরিস্তি শুনিয়ে আসেন। 
দিন দুয়েক হল অভিজিৎ এর মা গত হয়েছেন। খবর শুনেই পিসিমা চলে এসেছেন। ভাই আর ভাইপো/ভাইঝিদের খুবই ভালবাসেন। ভাল না বাসলে কেউ নিজের সংসারের সব কাজকর্ম ফেলে এতদিন অন্যের বাড়িতে পড়ে থাকতে পারে। মহিলার সব ভাল সমস্যা একটাই, অতি মাত্রায় সংস্কারচ্ছন্ন। অভিজিৎ অল্প বয়স থেকেই গ্যাস অম্বলের রুগী। হবিষ্যির আতপ চাল আর ঘি কোনটাই তার সহ্য হবে না। তাই মেনুতে সামান্য অদল বদল করে আতপের জায়গায় সিদ্ধ চাল আর ঘি এর জায়গায় মাখন খেয়েছিল। হবিষ্যির প্রথম দিন পিসি বিশেষ প্রয়োজনে একবেলার জন্য বাড়ি গিয়েছিলেন। হবিষ্যি পর্ব নির্বিঘ্নে কেটেছে। সন্ধ্যে বেলাই পিসি ফিরে এসেছেন। দ্বিতীয় দিন সকালে হবিষ্যির আইটেম দেখে তো পিসি আঁতকে উঠলেন। জানালেন যে অবিলম্বে আতপ  চাল আর ঘিতে ফিরে না গেলে অভিজিৎ এর ইহকাল এবং পরকালে বিপদের শেষ থাকবে না। শুধু তাই নয়, পুত্রের এ হেন অনাচারের জন্য তার মায়ের নাকি পরলোকে সঠিক পুনর্বাসন পেতে বেশ সমস্যা হবে। এরপর কোন কথা চলে না। অগত্যা অভিজিৎকে সেই সনাতন মেনুতেই ফিরতে হল। ফল পেতে বেশি সময় লাগেনি। দিন পনেরর মধ্যেই গ্যাস্টিকের জ্বালায় ডাক্তার ডাকতে হল।
অসুস্থ অভিজিৎকে দেখতে এসে পিসিমার খেদোক্তি—সবই করলি অথচ কেন যে বাবা ঐ একদিনের জন্য নিয়মটা ভাঙলি! সামান্য একটু ভুলের জন্য কত কষ্ট পাচ্ছিস বলত!
অভিজিৎ এর বলার কিছু নেই। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে ফ্যালফ্যাল করে পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
নিতাইএর এক জ্ঞাতি মারা গেছে। কাছেই থাকত। শ্মশানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই বাড়ি থেকে আপত্তি এল। তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, এমন অবস্থায় স্মশানে যাওয়ার নিয়ম নেই। নিতাই বুঝে উঠতে পারে না যে সে তো আর সন্তানসম্ভবা নয়, তার যেতে বাধাটা কোথায়! এসবে তেমন বিশ্বাস না থাকলেও পারিপার্শ্বিক চাপ আর সন্তানের কথা ভেবে কিছুটা দ্বিধায় সে বার নিতাই শ্মশান যাওয়া থেকে বিরত হয়। ব্যাপারটা কাকতালীয় হলেও এর কয়েক মাসের মধ্যেই তার বাবা পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। তখন অবশ্য শ্মশানে যেতে কেউ বারন করেনি।
মহিলাদের ক্ষেত্রে এই বিধি নিষেধের কোন সীমা পরিসীমা নেই। শৈশব থেকে একটি মেয়ের বেড়ে ওঠার প্রতিটি মুহূর্তে তার পোশাক, আচার- আচরণ, গতিবিধি, শিক্ষা- জীবনের সর্ব ক্ষেত্রেই আরোপিত হয় নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা। আর বিধবাদের ক্ষেত্রে তো দুর্দশার অন্ত নেই। স্বামীর মৃত্যুটা যেন তার অপরাধ। সেই অপরাধে আনন্দ অনুষ্ঠানের ক্রিয়া কর্মে তারা ব্রাত্য। শুধু তাই নয় এক এক করে কেড়ে নেওয়া হয় তাদের জীবনের আনন্দের সব উপকরণ। এক সময় তো সহমরণে পাঠিয়ে বাঁচার অধিকারটাও কেড়ে নেওয়া হত।   
এ তো গেল আমাদের চেনা পরিমণ্ডলের কথা। এখানে বিধান সম্পূর্ণ অথবা আংশিক অগ্রাহ্য ইদানীং অনেকেই করেন। ফল স্বরূপ কিছু ক্ষেত্রে হয়ত নিকটজনের সাথে সৌহার্দ সাময়িক বিঘ্নিত হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই, বড় কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন সচরাচর হতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশেরই কিছু কিছু জায়গায় সামাজিক বিধিনিষেধকে ( অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতপাতকে  কেন্দ্র করে) অবজ্ঞা করার ফল হচ্ছে  ভয়ংকর।  মানসিক, শারীরিক নির্যাতন, এমনকি হত্যা   পর্যন্ত করা হয়। হত্যার মত নৃশংস ঘটনারও আবার কোন কোন ক্ষেত্রে  বাহারি নাম দেওয়া হয়েছে- ‘সম্মান রক্ষার্থে হত্যা‘  এই honour killing এর  হত্যাকারি সাধারণত অত্যন্ত নিকট আত্মীয় হয়। ভাবা যায়, স্নেহ, ভালবাসা, রক্তের টান সব কিছু হারিয়ে যায় ভয়ানক এই কুসংস্কারের অন্ধকারে। আশার কথা,  প্রতিবাদ  এবং প্রতিরোধের ক্ষেত্রগুলোও পূর্বাপেক্ষা অনেক প্রশস্ত হচ্ছে।
বিধান দানের ক্ষেত্রে বেশ কিছুকাল যাবত সকলকে ছাপিয়ে গেছে তালিবান অধ্যুষিত এবং সন্নিহিত অঞ্চলগুলি।
অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানের দেহ সালাহতে জারি হয়েছে নতুন তালিবানি ফতোয়া। বাড়ির কোন পুরুষের সঙ্গে ছাড়া মহিলাদের একা বাড়ির বাইরে বার হওয়া চলবে না। দোকান বাজার তো নয়ই ডাক্তার দেখাবার প্রয়োজন হলেও সঙ্গে বাড়ির কোন পুরুষকে থাকতে হবে। হঠাত শুনলে মনে হতে পারে যে আদেশটা মহিলাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়।  মহিলারা একা বাইরে বেরলে নাকি নানারকম অশ্লীলতা ছড়ায় এবং চুরি ডাকাতি  করে। ওখানকার নিরীহ, নিষ্পাপ, পুরুষদের তাদেরই বাড়ির মহিলাদের কু দৃষ্টি এবং কু কর্মের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই তো স্থানীয় ধর্মগুরুদের এমন বিচিত্র আদেশ দিতে হয়েছে।    পাশাপাশি জারি হয়েছে সমস্ত প্রসাধনের দোকানের ওপর নিষেধাজ্ঞা। ঐ দোকান গুলো নাকি মদত দিচ্ছে বেশ্যা বৃত্তিতে। ওই অঞ্চলটি তালিবানি শাসনের সময়ে প্রতিবাদের এক উজ্জ্বল মরূদ্যান ছিল। এবারও অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ সরকারকে জানিয়েছে। দুঃখের ব্যাপার কারজাই সরকারের ধর্মীয় উপদেষ্টারা জানিয়েছেন যে এটা সঠিক সিধান্ত, তাই সরকার এতে হস্তক্ষেপ করবে না। ফতোয়ার প্রতি রাষ্ট্রের এই সমর্থনেই বোঝা যায় সরকারে না থেকেও তালিবান ঐ অঞ্চলগুলোতে কতটা প্রাসঙ্গিক। তবু ওই মানুষগুলো হার মানেনি, সাধ্যমত প্রতিবাদ করে যাচ্ছে।
আর একটি যুগান্তকারী বিধান কিছুদিন আগে ইরানের এক ধর্মগুরুর মুখে শোনা গেল। পৃথিবীর সমস্ত অনাসৃষ্টির মূলে নাকি মেয়েদের পাপ। তাদের পুঞ্জীভূত পাপই পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে  যাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই মনে আসতে পারে।
যেমন পাপ কি?
সহজ উত্তর-  কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা বৃহত্তর প্রেক্ষিতে এদের সমন্বয়ে গঠিত  সমাজের কিছু মাতব্বরের যা না পসন্দ সেটাই তার বা তাদের কাছে পাপ।
পাপি কেবল মেয়েরা কেন?
কি বোকার মত কথা। পুরুষের আবার পাপ হবে কেন? মেয়েদের দেখে প্রলোভিত হয় বলেই তো মাঝে সাঝে একটু আধটু শ্লীলতাহানি বা বলাৎকার করে ফেলে। তাহলে দোষটা কার হল? প্রলোভনের সামগ্রী, অর্থাৎ যে মেয়েটিকে দেখে সে প্রলুব্ধ হয়েছে অবশ্যই তার। এ ব্যাপারে  আমাদের দু একজন রাজনৈতিক নেতাও তো পরিস্থিতি বিশেষে একাধিকবার সহমত পোষণ করেছেন। এছাড়া মেয়েদের জীবনে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা থেকে আরম্ভ করে বধূ নির্যাতন পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারেই দোষ কিন্তু মেয়েটির। তার আচরণই তো পুরুষকে বাধ্য করে এইসব পদক্ষেপ নিতে।
ইরানের ঐ মানুষটির এমন উদ্ভট মন্তব্য করার আগে জানি না নিজের মায়ের মুখটা একবারও মনে পড়েছিল কিনা। দুর্ভাগ্যবশত এমন কথা শোনার এবং বিশ্বাস করার বেশ কিছু লোক পৃথিবীতে আছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার কেবল পুরুষ নয়, যাদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ, সেই মহিলাদেরও অনেকে ওই অসুস্থ চিন্তার শরিক।
ধর্মগুরুদের এই সব বিধান ধর্মকে জড়িয়ে দেওয়া হলেও ধর্মগ্রন্থগুলোতে এমন সব অসুস্থ ধারনার সমর্থনে বিশেষ কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
এমনই সব ফরমানের ফলে সম্প্রতি পাকিস্তানে পর পর ঘটে গেল হৃদয়বিদারক কিছু ঘটনা। ফতোয়া অমান্য করে কলেজে পড়তে যাওয়ার অপরাধে নিজের হবু স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করল এক ব্যক্তি।
মহিলা কলেজের একটি বাসকে লক্ষ্য করে এলোপাতারি গুলি চালায় কিছু দুষ্কৃতী। বেশ কিছু ছাত্রী হতাহত হয়।
আর তৃতীয় ঘটনাটিতে মালালা নামে এক কিশোরী কিছু ঘৃণ্য কাপুরুষের বর্বরোচিত আক্রমণে চরমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সুখের কথা বহুদিন চিকিৎসার পর এখন সে সুস্থ। মৃত্যুর অত্যন্ত কাছ থেকে ঘুরে এসেও মেয়েটি কিন্তু এতটুকু ভীত নয়আজ সারা বিশ্বে সে প্রতিবাদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই ধরণের ঘটনা আরো অনেক ঘটছে। সংবাদ মাধ্যমে সব খবর এসে পৌঁছায় না। ঘটনাগুলির স্থান, কাল, পাত্র, ধরণ, ভিন্ন হলেও আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে  প্রায় এক। যে কোন প্রকারে শিক্ষার প্রসারে বাধা। শিক্ষা সমাজকে প্রগতিশীল করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধ করতে শেখায়। সেই অতি চর্চিত কথাটাই বলতে হয়-যত শিখবে, পড়বে, জানবে, ততই কম মানবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অশিক্ষিত, অনুন্নত অঞ্চল এবং মানুষজন(মূলত মেয়েরা, কারণ শিক্ষার হার মেয়েদের মধ্যে অনেক কম) এইসব মাতব্বরদের আদর্শ চারণভূমি। যে কারণে পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্যের দেশগুলিতে এদের খবরদারি তুলনামূলক ভাবে অনেকটা বেশি। শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে নিরঙ্কুশ খবরদারির অঞ্চলও ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। তাই শিক্ষার ওপর এত আক্রোশ।
মনে পড়ে হীরক রাজার দেশের সেই শিক্ষককে, যে ছিল নির্লোভ, শান্ত অথচ দৃঢ়চেতা, লক্ষ্যে আবিচল আর অকুতোভয়। শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রাখার জন্য তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল জঙ্গলের অন্ধকারে। রাজার ফরমানের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে অনেক বাধা-বিপত্তি, অত্যাচারের মুকাবিলা করে পৌঁছতে পেরেছিল ঈপ্সিত লক্ষ্যে। তবে রাজদ্রোহে সে একা ছিল না। সাথে ছিল তার ছাত্রেরা আর পাশে ছিল গুপি বাঘার মত বুদ্ধিমান বিবেকবান মানুষ।
নিভৃতে জনহিতকর কাজে জীবন উৎসর্গ করা এমন লোক সমাজে আজও আছে। সমাজের সর্বস্তরের বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের কাছ থেকে একটু সাহায্য, সহযোগিতা ও নৈতিক সমর্থন পেলে এদের হাত ধরেই উঠে আসবে শতশত বিক্রম বা মালালা। যারা দড়ি ধরে টান মেরে সরিয়ে দেবে অশিক্ষার যবনিকা, জ্বালবে জ্ঞানের আলো, আর সেই আলোয় আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হবে সমাজের ওই বিষাক্ত কিট পতঙ্গেরা। দেখতে পাব এক সুন্দর স্বাধীন সমাজ, যেখানে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বিধান বা ফতোয়া দ্বারা চালিত হবে না।