মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৪

প্রবন্ধ – রাজীব দত্ত

সেই সব ধুলার দুলাল পেয়েছে যে ভাষা : বাংলার পথে ঘাটের খেলার ছড়া


       

যুগে যুগে, কালে কালে, শৈশবে, বাংলার ছেলেমেয়েরা তাদের দিদা-ঠাকুমা, মা-মাসিদের কাছ থেকে শোনা ও শেখা আগাডুম-বাগাডুম বা দোল দোল দুলুনির মতো ছড়াগুলি আওড়ে এক আশ্চর্য জগতের আনন্দধারায় নিজেদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এই সকল ছড়া কে, কবে, কখন রচনা করেছিলেন তার কোন হদিশ পাওয়া যায় না স্রষ্টা এবং সৃষ্টির এক অলৌকিক জাদুদন্ডের স্পর্শে এই ছড়াগুলি জীবন পরম্পরায় শৈশবকে অমর করে তুলেছে। পাশাপাশি নিজেদেরও অমরত্ব ঘটিয়েছে। মুখেমুখে প্রচারিত ছড়াগুলি স্থান ও কাল এবং সামাজিক ও ভৌগলিক অবস্থা ভেদে মূল থেকে হয়তো খানিকটা পাঠান্তরিত হয়েছে, একটি ছড়ার কিছু অংশের সাথে অন্য ছড়ার কিছু অংশ জুড়ে গিয়ে নতুন রূপে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তাতে তার রসাস্বাদনে কোন বিঘ্ন ঘটেনি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, সাহিত্যের cubism বলা যেতে পারে এই সব যা খুশি জিনিসকে  এইসব আশ্চর্য শব্দের মণিমালাকে কখনও আমরা ঘুমপাড়ানি ছড়া, ছেলেভুলানো ছড়া, খেলার ছড়া কখনও বা মেয়েলি ছড়া বলে থাকি। আবার হিন্দিভাষীরা একেই ফুটকল, ইউরোপীয়রা নার্সারি রাইম(Nursery Rhyme), উত্তর আমেরিকানরা মাদার গুসি(Mother Goose), জাপানিরা ওরাবে উটা(Warabe Uta) এবং কোমারি উটা(Komori Uta) বলে থাকেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অন্যান্য ভাষাভাষীদের মধ্যে না জানি এর আরও কত নাম আছে।
        অনেকেই এই লোক ছড়াকে সকল ভাষা-সাহিত্যের আদিরূপ বলে থাকেন। আবার কেউ কেউ একে সঙ্গীতের আদি জননীও বলেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনেক প্রাজ্ঞজনেরা মনে করেন এই লোক ছড়া কিছু না হলেও হাজার বছর আগে রচিত চর্যাপদের অনেক আগে থেকেই তার পালকের ডানা মেলে বাংলার ঘরে-ঘরে মুখে-মুখে উড়ে বেরিয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে তার ওড়ার আকাশ প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম গ্রাম- দেশে সীমায়িত হয়ে এলেও খুব নির্জনে নিভৃতে সেই উড়ান এখনও শেষ হয়ে যায় নি
২.
যেহেতু বেদের মতো (সুকুমার সেন মহাশয় এদেরকে শিশু-বেদ নামেই আখ্যায়িত করেছেন) মুখে মুখে শুনে শুনে প্রচারিত এই সব লোক ছড়া, তাই, পরিবর্তিত সময়ে মানুষের রুচি ও মূল্যবোধের পরিবর্তনের সাথে সাথেই, চিরতরে তা হারিয়ে যাবার একটা প্রবল সম্ভাবনা দেখা যায়। আর এই সংশয় থেকেই রসিকজনেরা এইসকল সাহিত্য সম্ভারকে সংগ্রহ করে রাখার ব্যাপারে তৎপর হয়েছেন। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসের নিরিখে প্রথম  ইউরোপেই এই লোক ছড়াকে ছাপার অক্ষরে সংগ্রহ করে রাখার ব্যাপারে  তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মাঝামাঝি সময়ে ইংরাজি নার্সারি রাইমের প্রথম সংগ্রহ দেখা যায় ‘Tommy Thumb’s  Song Book’(১৭৪৪?) এবং ‘Tommy Thumb’s Pretty Song Book’(১৭৪৪) নামক দুটি গ্রন্থে। তবে ১৮৪২ সালে, মাত্র বাইশ বছরের জেমস অর্চার্ড হ্যালিওয়েল (James Orchard Halliwell) নামের এক যুবক ‘‘The Nursery Rhymes Of England’ collected principally from oral tradition’’ নামক নার্সারি রাইমের তথ্যবহুল যে অনবদ্য সংকলন প্রকাশ করেন, সেটি এবং ‘Popular Rhymes and Nursery Tales’(১৮৪৯) নামে তাঁরই অন্য আর একটি বই-ই বলা যেতে পারে, যে কোন ভাষায় সংকলিত লোক ছড়া সংক্রান্ত তথ্যবহুল প্রথম আকর গ্রন্থআবার বিংশ শতাব্দীতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবল  অস্থিরতম সময়ে ও তার পরবর্তীকালে হ্যাম্পশায়রের অল্টনবাসী দুইজন প্রেমিক মানুষ, প্রবাদপ্রতিম লোকসাহিত্য গবেষক ওপি দম্পতি (Iona Opie এবং Piter  Opie), নীরবে, পিটার্সফিল্ড, হাম্পশায়রের পথে-পথে ইস্কুলে-ইস্কুলে ঘুরে ঘুরে, ছোট ছোট শিশুদের কখনো সরাসরি সাক্ষাতকার নিয়ে, কখনও বিভিন্ন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাহায্য নিয়ে ইউরোপীয় লোক ছড়া (যার মধ্যে প্রচুর খেলার ছড়া, খেলা ও খেলনা সামগ্রী) সযত্নে সংরক্ষিত করে গবেষণা ধর্মী একটির পর একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে গেছেন যার মধ্যে The Oxford Dictionary of Nursery Rhymes (1951, Oxford University Press), The Lore And Language of Schoolchildren (1959, Oxford University Press), The Puffin Book of Nursery Rhymes (1963, Penguin/Puffin), Children’s Games in Street & Playground (1969, Oxford University Press) গ্রন্থগুলি খুবই উল্লেখযোগ্য।
      পশ্চিমী আধুনিক দেশে এই সমস্ত ক্রিয়াকর্মের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব কাজ করেছিল। তবে, আমাদের বাংলায় এই লোকজ সাহিত্য সম্পদ সংগ্রহের ব্যাপারে প্রথম আলোটি জ্বালেন সেইসব ব্রিটিশ রাজ কর্মচারী ও খ্রিষ্টান মিশনারিরা, যাঁদেরকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের দেশে আনা হয়েছিল। তাঁদেরই দুইজন, উইলিয়াম মর্টন এবং জেমস লং ১৮৩২ থেকে ১৮৭২-এর মধ্যে বাংলা প্রবাদের চারটি খণ্ড প্রকাশিত করেছিলেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম পথ প্রদর্শক, যিনি বাংলার মাটি থেকে উঠে আসা স্নিগ্ধ-শীতল লোক ছড়া, তাঁর ভাষায় শৈশবের মেঘদূত-এর দিকে বাঙালী রসিক-মহলকে ফিরে তাকাতে উৎসাহিত করেছিলেন। ১৩০১ বঙ্গাব্দে (ইংরাজির ১৮৯৫ সন) এক প্রকাশ্য সভায় মেয়েলি ছড়া নামে এক প্রবন্ধে তিনি এ বিষয়ে আলোকপাত করেন। পরবর্তীকালে অসংখ্য ছড়া ও আরও কিছু প্রবন্ধ সহযোগে তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থে যার পরিমার্জিত রূপ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁর উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার শতাধিক ছড়ার অসামান্য সংকলন খুকুমণির ছড়া প্রকাশ করেনরামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর একটি অসামান্য ভূমিকা সহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত লোকছড়ার এটিই প্রথম সংকলন। রবীন্দ্রনাথ ও যোগীন্দ্রনাথের হাত ধরে লোক ছড়া সংগ্রহের যে কাজ উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে শুরু হয়েছিল, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ জুড়ে ভারতি সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন লেখক ও সংগ্রাহকের হাত ধরে তা প্রকাশিত হতে থাকে সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে। এক্ষেত্রে অবশ্যয় উল্লেখ করতে হয় বৈষ্ণব বসাক, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। ছেলেভুলানো ছড়ার পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথ তো মেয়েলি ব্রতকথা নিয়েও মূল্যবান কাজ করে গেছেন।
     ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পাশাপাশি বাংলা ভাগের পর লোক ছড়া সংগ্রহের কাজও দুই বাংলায় আলাদা আলাদা ভাবে চলতে থাকে। ওপার বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ইউনেস্কো প্রোজেক্ট (UNESCO Project) হিসাবে মোহম্মদ সাহিদুল্লাহ্ ও মোহম্মদ আবদুল হাই সাহেব একাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এপার বাংলায় এগিয়ে আসেন সুকুমার সেন, আশুতোষ ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু ভৌমিকের মতো বিশিষ্টেরাবঙ্গসৃজনাকাশের আরেক বিস্ময় মাননীয় কমলকুমার মজুমদার মহাশয় আইকম বাইকম (বৈশাখ, ১৩৭০ বঙ্গাব্দ, ইং- এপ্রিল, ১৯৬৪) নামে একটি সংকলন গ্রন্থে নিজের আঁকা অসামান্য রেখাচিত্র সহযোগে বেশকিছু লোক ছড়া সংকলিত করে আমাদের সকলের দায় কিছুটা নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৩৭৭ বঙ্গাব্দে ভবতারণ দত্তের সম্পাদনায় বাংলাদেশের ছড়া নামেও লোকছড়ার একটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যে গ্রন্থে সুকুমার সেন মহাশয় শিশু-বেদ নামক অসামান্য লাবণ্যময়ী একটি প্রবন্ধ ভূমিকা হিসাবে লেখেন। তাঁরই উৎসাহে ভবতারণবাবুর এই বইটির পরিবর্ধিত রূপ বাংলার ছড়া নামে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে ১৯৯৭ সনে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে আছে সহস্রাধিক প্রচলিত এবং দুষ্প্রাপ্য ছড়া। অন্যদিকে ওপার বাংলার এই সময়ের প্রথিতযশা লোকসংস্কৃতি গবেষক সৈয়দ মোহম্মদ সাহিদ  Asian Folklore Studies, Vol. 52, (১৯৯৩) তে প্রকাশিত Bengali Folk Rhymes : An Introduction  নামক লোক ছড়া বিষয়ক এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে  জানাচ্ছেন : During the 1960s the academy (বাংলা একাডেমী,ঢাকা) undertook the collection of folk literature from a vast number of village, with approximately five thousand sand rhymes being recorded by about thirty researchers. About half of these were published by the academy during the 1960s, 1970s and 1980s, but a large number have yet to appear in print (SHAHED 1988, 50-52). In addition to these major organized efforts, a small but steady source of rhymes has been provided by journals and newspapers published in both Bangladesh and West Bengal. সম্প্রতি লোরক সোসাইটি নামে ওপার বাংলার একটি ছোট সংগঠনও এই লোকছড়া সংগ্রহের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
        উল্লেখিত বা অনুল্লেখিত এইসব ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সাধু উদ্যোগের কথা স্বীকার করেও বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথের দেখানো পথেই,  শিশু কেন্দ্রিক যে লোকছড়া তার অন্তর্গত ছেলেভোলানি বা ঘুমপাড়ানি ছড়ার প্রতিই আমাদের যাবতীয় আকর্ষণ ও নজর কেন্দ্রীভূত হয়ে আছেএইসব ছড়ার বাইরেও আমাদের এ বঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে এখনও এমন অনেক ছড়া সংকলনভুক্ত না হওয়ার কারণে, হারিয়ে না গিয়ে, আপনমনে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলার সাথী হয়ে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, লোকছড়ার অন্তর্গত যা খেলার ছড়া নামে অভিহিত। ভাবলে খারাপ লাগে, যখন দেখি বাংলার  এই খেলার ছড়া ও যে সব ছোট ছোট শিশুরা আজও নীরবে এই ভূমিজ দায় নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে, তাদের জগতকে নিয়ে কোন ক্ষেত্র সমীক্ষা ভিত্তিক আকর কাজ স্বাধীনতার ৬৪ বছর পরেও আমাদের বাংলায় আর হয়ে ওঠে না। অথচ এই খেলার ছড়াই জন্মের পর সুতিকা গৃহ থেকে পা পা হাঁটি হাঁটি করে উত্তরোত্তর বাংলার লোকছড়ার ভাণ্ডারকে আজও সমানভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
৩.
পোকেমন, ডোরেমন, বেনটেন বা বিভিন্ন চীনা-জাপানী ভিডিও গেমের জগত থেকে বহুদূরে থাকা টিমটিমে আলোর মতো গ্রাম-বাংলার প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা, বিশেষত মেয়েরা, ভবিষ্যৎ জীবনে যাদেরকে সংসার নামক এক অসহায় খাঁচায় কাটাতে হবে অথবা যাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চিতরূপে হারিয়ে যাবে কোন এক স্বপ্নহীন অন্ধকার গোলকধাঁধায়, তারাই যুগে যুগে কালে কালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লোকসাহিত্যের এই বিশেষ ধারাটিকে শুধু বুকে করে বয়ে নিয়েই বেড়াচ্ছে না, খেলতে খেলতে তাদের অসম্ভব কল্পনাপ্রবণ এবং বাস্তব সমাজ জীবনের প্রত্যক্ষ নিরিক্ষণধর্মী মন, নিত্য নতুন, নিজেদের অজান্তে, অসচেতনভাবেই সৃষ্টি করে চলেছে একটার পর একটা ছড়া; যা অবশ্যই খেলার অঙ্গ হিসাবে অন্যকোন অঞ্চলের শিশুমহলে প্রচারিত এবং প্রসারিত হয়ে চলেছে। তারা জানেনা  শৈশবের দিনগুলিতে খেলার অঙ্গ হিসাবে এই সব ছড়া আবৃত্তি করতে করতে তারা কখন এক সামাজিক দলিল লিপিবদ্ধ করে রেখে যাচ্ছে। তারা এও জানে না এইভাবে এক অদ্ভুত মজার সুরে ভাসতে ভাসতে তারা তাদের শৈশবকে অতিক্রম করে কবে কখন পৌঁছে যাচ্ছে তাদের কৈশোরে। হয়তো কৈশোরে পৌঁছে তারা সেই সব ছড়া ভুলেও যায়, ভুলে যায় সমস্ত খেলা। কিন্তু ততদিনে সেইসব খেলা ও ছড়া ধুলা থেকে কুড়িয়ে নিজেদের ভূষণ করে নেয় তাদেরই ছোটো ছোটো ভাই-বোনেরা। আগ্রহবশত অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি দুই বছর বয়স থেকে শিশুরা এই ছড়াগুলি খেলার অঙ্গ হিসাবে বলা শুরু করলেও মূলত ছয় থেকে এগার-বার বছরের মেয়ে এবং কিছু কিছু ছেলেদের গুপ্ত ভাণ্ডারের অমূল্য রত্ন হিসাবেই থেকে থাকে।
        বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম, কাঁকসা ও বুদবুদ অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের সেইসব ধূলার দুলাল-দুলালীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আনা ইতিপূর্বে অনালোকিত অপ্রকাশিত গুপ্তভান্ডারের বেশ কিছু খেলার ছড়া ক্ষেপচুরিয়াসের পাতায় তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। আশাকরি, শিশুমনের অধিকারী সকল রসিকজনের আশীর্বাদ ধুলার সন্তানদের জন্য বর্ষিত হবে।
রাজীব দত্ত


১.
চুলোর পিঠে ঘুঁটের ছাই                                          
পয়সা কুড়িয়ে পাই
সেই পয়সা নিয়ে আমি
বর্ধমানে যাই।
বর্ধমানের আয়না
মুখ দেখতে পাই না।
বর্ধমানের গাড়িগুলোর বড়ো বড়ো চাকা
আমার ভাই দাম করেছে আশি হাজার টাকা।

খেলার নিয়ম:       একসাথে গোল করে দাঁড়িয়ে ছড়ার ছন্দে ছন্দে একজন গণনা শুরু করবে। যার কাছে ছড়া শেষ হবে সে বসে পড়বে। তারপরের জন থেকে আবার নতুন করে ছড়া বলার সঙ্গে সঙ্গে গণনা শুরু হবে। অর্থাৎ এটিকে একটি গণনার খেলা বলা যায়

২.

বক একটু মাংস... দে       
ঝাল লেগেছে পানি... দে
জ্বর এসেছে ক্যাঁথা... দে                                         
-কোথায় মাটি দেবো রে?
বটগাছটির গোঁড়ায় রে
বট ঝুর ঝুর করে।

খেলার নিয়ম:       জানা নেই।


৩.

তালগাছে পানি পড়ে
টবাং     টবাং
ভদ্রলোকের কথা গাই
বরাং     বরাং

খেলার নিয়ম:       জানা নেই।
৪.
আমার একটি মুরগী ছিল
টি বি হয়ে মরে গেল
হায় মা আমার কি হল
ধান শুকিয়ে ভাত হল
বৌ খেয়ে ঘাটে গেল
বিটা খেয়ে মাঠে গেল
বৌ-এর একটি ছেলে হল
দুধ খেয়ে দুধ, দুধালো হল
দুধে পড়ল মাছি
কোদাল ধরে চাঁছি
কোদাল হল ভোঁতা
খা কামারের মাথা
কামারকে ডাকি
কামার বলে পাড়ব না
কোদাল বলে ছাড়ব না
খেলার নিয়ম:       ১ নং-এর অনুরূপ গণনার খেলা।
৫.

হলুদ বনের গোঁড়ায় রে
নীল পাখিটি ডাকে রে
এত ডাকা ডাকো না
স্বামীর কথা ভেবো না
স্বামী গেছে বিদেশে
ও লাও বাতাসা
লি...বো...না...
কন্যার বিয়ে দি...বো... না...
কন্যার নাম চম্পা
গলাতে গামছা
হাতে তার বাউটি
কাঁকালে কলসি
মাথাতে ওড়না
কুচবরণ কন্যা।
খেলার নিয়ম:       দুজনে মিলে নির্দিষ্ট কৌশলে ছড়ার ছন্দে হাতে হাতে তালি দিয়ে খেলা।


৬.

ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে
লিচুর বাগানে
একটা লিচু পড়ে গেল
চায়ের দোকানে
চা-বালা চা-বালা
দোকান খোলো না
ইস্টিশনে বৌ আসবে দেখতে পাবে না
বট গাছটির ঢল ঢল পাতা
ভাই বোনদের বিয়ে হচ্ছে
কি লজ্জার কথা।



খেলার নিয়ম:       ১ নং-এর অনুরূপ গণনার খেলা।


১ থেকে ৬ নং ছড়াগুলি সংগৃহীত হয়েছে ২০০৭ সালে বাগরাই প্রাথমিক বিদ্যালয় (বাগরাই, বননবগ্রাম, আউসগ্রাম)-এর ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। সংগ্রহে সাহায্য করেছেন ঐ বিদ্যালয়ের তৎকালীন সহ: শিক্ষক উদয় পাল ।

৭.

আমার নাম চম্পা
গলায় গামছা
কাঁখে কলসি
হাতে বালতি
ও জামাই বসো
দুঃখের কথা শোনো
তোমার মেয়ে ঘাটে যায়
প্যাকেট প্যাকেট সিগরেট খায়
আমি যদি ছ্যামরা হতাম
মোড়ের মাথায় দোকান দিতাম
পয়সা নিতাম না
বাঁশ গাছ নড়ে চড়ে
স্বামীর কথা মনে পড়ে
স্বামীকে যদি দেখতে চাও
চিঠি লিখে পাঠিয়ে দাও

খেলার নিয়ম:       ১ নং-এর অনুরূপ গণনার খেলা।

৮.

মা গো মা
চা করো না,
ইস্টেশনে যাবো আমি
ট্রেন পাবো না।
বাবার জন্য আনব আমি
হাতে বাঁধা ঘড়ি
মায়ের জন্য আনব আমি
লাল পেড়ে শাড়ি
ভায়ের জন্য আনব আমি
ল-এ লাটিম
বোনের জন্য আনব আমি
দুধ খাওয়ার বাটি
বৌদির জন্য আনব আমি
টক আমরার আঁটি
বৌদি আমায় গাল দিয়েছে
দূর পোড়ামুখী।

খেলার নিয়ম:       ৫ নং-এর অনুরূপ হাতে হাতে তালি দিয়ে খেলা।

৯.

কচি কচি পেয়ারা
কচির কি চেহারা
কচি যদি পাকত
রাস্তার লোকে দেখত

খেলার নিয়ম:       ৫ নং-এর অনুরূপ হাতে হাতে তালি দিয়ে খেলা।

১০.

টুনটুনি পাখি
নাচোতো দেখি
না বাব নাচবো না
পড়ে গেলে বাঁচব না
ছোটো দেওয়ের বিয়ে
নাচব ধীরে ধীরে
আঁচল পেতে কুড়িয়ে নেব
সরু ধানের চিড়ে।

খেলার নিয়ম:       হাঁটু মুড়ে মাটিতে হাত ঠিকিয়ে প্রণাম করার ভঙ্গিতে একজন বসে থাকবে। বাকিরা ওর মাথার উপর দিয়ে লাফ দিয়ে পেড়িয়ে যাবে। যার পা বসে থাকা জনের মাথায় লাগবে, তার বদলে সে ফরি হবে।
        ৭-১০ নং ছড়া সংগৃহীত হয়েছে ২০০৭ সালে ছোড়া প্রা বিদ্যালয়রে ( ছোড়া কলোনি, আউসগ্রাম) ছাত্রী অঞ্জনা বাড়ৈ(৯) ও স্বরূপা বিশ্বাসের(১০) কাছ থেকে।

১১.

টেন টেন টেন
সূয্যি-তারার টেন
সূয্যিতারা সূয্যিতারা
তোমার ব্যাগে কী?
আমার ব্যাগে যায় থাকুক
তোমার তাতে কি?
উত্তমকুমারের জন্মদিন
নুচি-মিষ্টি ভেজেছি।

খেলার নিয়ম:       দুজনে মিলে নির্দিষ্ট কৌশলে ছড়ার ছন্দে হাতে হাতে তালি দিয়ে খেলা।
        সংগৃহীত হয়েছে ২০০৮ সালে অমরপুর প্রা বিদ্যালয়ের (অমরপুর, আউসগ্রাম) ছাত্রী রাণী বাগ্দীর(৮) কাছ থেকে।

১২.

ট্রেন ট্রেন ট্রেন
ট্রেনের ভিতর বসেছিল
ছোট্ট একটি মেম।
মেমকে আমি জিজ্ঞাস করলাম
হোয়াট ইজ ইওর নেম?
হোয়াটিজ ইওরজি হোয়াটিজ ইওরজি
তোমার ব্যাগে কী?
উত্তমদার জন্য আমি
কচুরি এনেছি।


খেলার নিয়ম:       ৫ নং-এর অনুরূপ হাতে হাতে তালি দিয়ে খেলা।
        সংগৃহীত হয়েছে ২০০৮ সালে অমরপুর প্রা বিদ্যালয়ের (অমরপুর, আউসগ্রাম) ছাত্রী চুমকি মেহতরীর(৮) কাছ থেকে।

১৩.

শিকল শিকল কত দূর?
বহুদূর
কার বিয়ে?
ভাদুর বিয়ে ( খেলতে থাকা একজনের নাম)
কী বাজিয়ে?
সানাই বাজিয়ে।
কিসে চড়ে যাবে?
পালকিতে
উলু...লু....লু...লু..লু...
শিকল শিকল কত দূর?
বহুদূর
কার বিয়ে?
চম্পার বিয়ে। ( খেলতে থাকা অন্যজনের নাম)
কি বাজিয়ে?
ঢোল বাজিয়ে।
কিসে চড়ে যাবে?
গরুর গাড়ি।
উলু...লু....লু...লু..লু...

খেলার নিয়ম:       পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়িয়ে সকলে মিলে দ্বিতীয়জনের উদ্দেশে (ছড়া অনুযায়ী দ্বিতীয়জন হল ভাদু) ছড়াটি বলেতারপর উলু উলু দিতে দিতে প্রথম ও দ্বিতীয়জনের  ধরে থাকা অবস্থায় হাতের ফাঁক দিয়ে বাকিরা গলে গিয়ে একটা, তারপর তৃতীয়জনের উদ্দেশে ছড়াটি বলে দ্বিতীয় ও তৃতীয়-জনের হাতের ফাঁক দিয়ে গলে আরও একটা এইভাবে শিকলের প্যাঁচ করবেখেলোয়াড়দের সংখ্যা অনুযায়ী শিকল গড়ার কাজ সম্পূর্ণ হলে প্রথম ও শেষ-জন খেলোয়াড় শিকল ভেঙ্গে দেবে, বাকিরা পদ্মাসনের মতো বসবে। তারপর ওরা দুজনে হাতে ধরে বাকিদের একে একে ওদের কাল্পনিক শ্বশুরঘরে পৌঁছে দেবেতুলে নিয়ে যাওয়ার পথে কারও যদি হাত বা পা আলগা হয়ে খুলে যায় তাহলে তার পিঠে পড়বে শ্বশুর-শাশুড়ির দুই কিল।       
সংগৃহীত হয়েছে ২০১০ সালে আউসগ্রামের অমরপুর ও বুদবুদের সাঁকুরি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে।