অমোঘ শঙ্খ ধ্বনি
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
কবিতা আমায় নষ্ট করলো তেরোতে । কবিতা হয়ে উঠলো আমার ‘ নষ্ট প্রভু ‘ অতঃপর । একটা বয়সে সব বাঙ্গালিই অল্পবিস্তর কবিতা চর্চা করে , সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেমে পড়লে । সেই চর্চা অনেকটাই নষ্ট হয় সময় নামক প্রভুর কাছে বশ্যতা স্বীকারের মাধ্যমে ।মুষ্টিমেয় লড়ে যায় তারপরও , জীবনের প্রেম অপ্রেম ছাড়িয়ে বৃহত্তর জীবনযাপন চালচিত্রের অঙ্গ হয়ে ওঠে তখন কবিতা । তো আমি কবিতাকে ভালোবেসে ফেললাম কয়েকজনের হাত ধরে । কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য । ‘কবিতা কল্পলতা ‘, কেবল হয়ে থাকেনি তাঁর কাছে , রঙ্গ , ব্যঙ্গ , তির্যক কথন , প্রবল কাব্যিক চপেটাঘাত নীতি ভ্রষ্ট সামাজিক প্রভুদের নধর লালিমাযুক্ত গালে এমন মসৃণ আর কে দিতে পারেন ? কাজেই দিনেদিনে সে প্রেম বেড়েই চলে । ছন্দে মজেছিলাম প্রথমে ,তারপর বয়সোচিত মানসিক বন্ধন তৈরি হোল , কবিতার অন্তরাত্মা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা , আত্মিকরন সে এক প্রবল পরাক্রমি শব্দমালাকে , পেটোর মতো ফেটে পরে যারা আমার সামান্য সন্দিগ্ধ আচরণ ছিন্নভিন্ন করে , সাহস জোগায় পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার স্বার্থপরতা ঝেড়েফেলে সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার ।
তাঁর কবিতায় তুমুল প্রেম আছে , কিন্তু তাঁর কোন পেটেন্ট প্রেয়সী নেই , আর সেইজন্যই বোধহয় , তাঁর কবিতায় আরও বেশিকরে নিজেকে দেখি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে , লজ্জাহীন । মনে হয় , আরে , আমিই তো সেই ।আদ্যন্ত রোম্যান্টিকতা তো আছেই ,আমার প্রেমের চিঠিগুলো ভরে উঠতো তাঁর লাইন কোট করে করে । ছেলেমানুষি প্রেম ভেঙ্গে গেলে সান্ত্বনা খুঁজি তাঁর অমোঘ ‘কাব্যতত্ত্ব’ তে, ‘ মানুষ তো আর শালগ্রাম নয় ঠিক / একইরকম থাকবে সারাজীবন / মাঝে মাঝে পাশ ফিরতেও হবে / মাঝেমাঝেই উড়াল দেবে মন ‘। কমোডিটি সর্বস্ব বাঁচায় সহজ সরল কথাগুলো আমাদের মাথা ঠুকে মরে বিজ্ঞাপনে । সামাজিক থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় আমরা মুখে ঝুলিয়ে রাখি মুখোশ।অথচ কি প্রাঞ্জল , কি সহজ , কি সুগভীর তাঁর উচ্চারণ,কথাগুলি আমার মরমে পশে , আকুল করে আমার বেঁচে থাকা যখন পৃথিবী হুঁশিয়ারি দেয় , ‘ তোমার কোন বন্ধু নেই তোমার কোন বৃত্তি নেই / কেবল বন্ধন ‘। অসীম যন্ত্রণায় , প্রবল একাকীত্বে , মৃত্যুচেতনা যখন নির্ভেজাল গ্রাস করে ফেলতে চায় আমার সমস্ত তনুমন , তখনও কি গভীর প্রত্যয়ে , কি ব্যাপক নির্ভরতায় ফিরেছি আমার প্রথম প্রেমিকের কাছে ,তাঁর দর্শনে, ‘ হলে হলো , না হলে নেই । / এইভাবেই / জীবনটাকে রেখো ।‘ রবীন্দ্রগান , কবিতার পরে তিনি ই আমার আত্মার আনন্দ , প্রাণের আরাম , কষ্টের সাথী , প্রেমের সাক্ষী , অপ্রেমের সান্ত্বনা ,’ সেই সনাতন ভরসাহীনা অশ্রুহীনা / তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না ? / তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয় / তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়। ‘
কবিতার ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা বরাবরই চলছে, চলবে । অনেকেই তৈরি করেন স্বতন্ত্র স্টাইল ; কেউ কেউ ভালোবাসেন রহস্যময় আড়াল , চান পাঠক মস্তিষ্কের অনুশীলন করুক আগে ,যোগ্য হয়ে উঠুক কবির প্রজ্ঞার। নির্বোধ পাঠক কবিতার সাথে আইডেনটিফাই করলো কিনা তাতে তাঁর কোন মাথাব্যথা নেই । কিন্তু সত্যি বলছি , শঙ্খ ঘোষের লেখা পড়তে গিয়ে আমি কখনো আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগিনি । কখনো হীনমন্যতায় ভুগিনি , কখনো মনে হয় নি , তিনি গ্রহান্তরের বুদ্ধিজীবী ,যার সিগন্যাল অ্যান্টেনা ছাড়া ধরা যায় না । আর এই জন্যই হয়তো আমার সে প্রেম আরও বেড়ে চলে , বয়সের সাথে , ম্যাচিওরিটির সাথে আরও গভীর হতে থাকে , আরও নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হতে থাকে,তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে এক প্রিজম, যার বর্ণবিচ্ছুরণ আমার অস্তিত্বের এক একটা পরত উন্মোচন করে আমায় ব্যাপক রোমাঞ্চের সন্ধান দেয় । রক্তমাংসের অবয়ব ধারণ করে তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ,আমার যা যখন যাকে বলার দরকার , সবই দেখি তিনি কথা জোগান সময়মত।আমি অবসেসড হয়ে পড়ি। আমার বোধের এক্সফলিয়েসান হয় , বোধি লাভ করতে পারি এমন আমি কেউকেটা নই । কিন্তু বুক বাজিয়ে বলতে পারি , ‘ আমি খুব ভালো বেঁচে আছি ‘ ,তাঁর কবিতার ‘ সংসারে কানামাছি ‘।তিনি আজীবন শহর কেন্দ্রিক জীবন যাপন করেন , কিন্তু কোলকাতা শহর নিয়ে তাঁর কোন ভান নেই ।কি অবলীলায় আমিনার বর বলে ওঠে , ‘ কইলকাত্তার পথে ঘাটে অন্যসবাই দুষ্ট বটে / নিজে তো কেউ দুষ্ট না ... কইলকাত্তার লাশে / যার দিকে চাই তারই মুখে আদ্যিকালের মজা পুকুর / শ্যাওলাপচা ভাসে’। জীবন থাকতে তাই সে আর কোলকাতায় যাবে না ।
‘লাইনে ‘ থেকেও লাইন ভাঙার মুরোদ তাঁর আজও অক্ষুণ্ণ , সাম্প্রতিক রাজ্যরাজনীতির প্রেক্ষিতে তা বারবার সামনে এসেছে, আসছে । সেইসাথে ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণ সমাজ রাষ্ট্র সময় আর মানবিকতার । আছে ধিকিধিকি ক্রোধ , আছে মরমিয়া মন , অন্যায় যে করে তার মুখের ওপর বলে ওঠার স্পর্ধা , না , তিনি কারুর ‘ইয়েস ম্যান ‘ হন নি ।তিনি জানেই ‘ এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান’ ... ‘ না – এর পর না , না – এর পর না, না – এর পর না’। ‘ মত তা – ই যা আমার মত / সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ / জ্ঞানীও সে, এমন – কী আপনলোক , প্রিয় । তার চাই / দুপাঁচটি পালকলাগানো টুপি , ছড়ি’। এদিক থেকে প্রবল অহংকারী তিনি । বশ্যতা স্বীকার শিল্পীর ধর্ম নয় । শঙ্খ ঘোষও দাপটে শাসন করছেন তাঁর কাব্য সাম্রাজ্য ।কুডোস।
কবিতা আমায় নষ্ট করলো তেরোতে । কবিতা হয়ে উঠলো আমার ‘ নষ্ট প্রভু ‘ অতঃপর । একটা বয়সে সব বাঙ্গালিই অল্পবিস্তর কবিতা চর্চা করে , সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেমে পড়লে । সেই চর্চা অনেকটাই নষ্ট হয় সময় নামক প্রভুর কাছে বশ্যতা স্বীকারের মাধ্যমে ।মুষ্টিমেয় লড়ে যায় তারপরও , জীবনের প্রেম অপ্রেম ছাড়িয়ে বৃহত্তর জীবনযাপন চালচিত্রের অঙ্গ হয়ে ওঠে তখন কবিতা । তো আমি কবিতাকে ভালোবেসে ফেললাম কয়েকজনের হাত ধরে । কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য । ‘কবিতা কল্পলতা ‘, কেবল হয়ে থাকেনি তাঁর কাছে , রঙ্গ , ব্যঙ্গ , তির্যক কথন , প্রবল কাব্যিক চপেটাঘাত নীতি ভ্রষ্ট সামাজিক প্রভুদের নধর লালিমাযুক্ত গালে এমন মসৃণ আর কে দিতে পারেন ? কাজেই দিনেদিনে সে প্রেম বেড়েই চলে । ছন্দে মজেছিলাম প্রথমে ,তারপর বয়সোচিত মানসিক বন্ধন তৈরি হোল , কবিতার অন্তরাত্মা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা , আত্মিকরন সে এক প্রবল পরাক্রমি শব্দমালাকে , পেটোর মতো ফেটে পরে যারা আমার সামান্য সন্দিগ্ধ আচরণ ছিন্নভিন্ন করে , সাহস জোগায় পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার স্বার্থপরতা ঝেড়েফেলে সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার ।
তাঁর কবিতায় তুমুল প্রেম আছে , কিন্তু তাঁর কোন পেটেন্ট প্রেয়সী নেই , আর সেইজন্যই বোধহয় , তাঁর কবিতায় আরও বেশিকরে নিজেকে দেখি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে , লজ্জাহীন । মনে হয় , আরে , আমিই তো সেই ।আদ্যন্ত রোম্যান্টিকতা তো আছেই ,আমার প্রেমের চিঠিগুলো ভরে উঠতো তাঁর লাইন কোট করে করে । ছেলেমানুষি প্রেম ভেঙ্গে গেলে সান্ত্বনা খুঁজি তাঁর অমোঘ ‘কাব্যতত্ত্ব’ তে, ‘ মানুষ তো আর শালগ্রাম নয় ঠিক / একইরকম থাকবে সারাজীবন / মাঝে মাঝে পাশ ফিরতেও হবে / মাঝেমাঝেই উড়াল দেবে মন ‘। কমোডিটি সর্বস্ব বাঁচায় সহজ সরল কথাগুলো আমাদের মাথা ঠুকে মরে বিজ্ঞাপনে । সামাজিক থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় আমরা মুখে ঝুলিয়ে রাখি মুখোশ।অথচ কি প্রাঞ্জল , কি সহজ , কি সুগভীর তাঁর উচ্চারণ,কথাগুলি আমার মরমে পশে , আকুল করে আমার বেঁচে থাকা যখন পৃথিবী হুঁশিয়ারি দেয় , ‘ তোমার কোন বন্ধু নেই তোমার কোন বৃত্তি নেই / কেবল বন্ধন ‘। অসীম যন্ত্রণায় , প্রবল একাকীত্বে , মৃত্যুচেতনা যখন নির্ভেজাল গ্রাস করে ফেলতে চায় আমার সমস্ত তনুমন , তখনও কি গভীর প্রত্যয়ে , কি ব্যাপক নির্ভরতায় ফিরেছি আমার প্রথম প্রেমিকের কাছে ,তাঁর দর্শনে, ‘ হলে হলো , না হলে নেই । / এইভাবেই / জীবনটাকে রেখো ।‘ রবীন্দ্রগান , কবিতার পরে তিনি ই আমার আত্মার আনন্দ , প্রাণের আরাম , কষ্টের সাথী , প্রেমের সাক্ষী , অপ্রেমের সান্ত্বনা ,’ সেই সনাতন ভরসাহীনা অশ্রুহীনা / তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না ? / তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয় / তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়। ‘
কবিতার ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা বরাবরই চলছে, চলবে । অনেকেই তৈরি করেন স্বতন্ত্র স্টাইল ; কেউ কেউ ভালোবাসেন রহস্যময় আড়াল , চান পাঠক মস্তিষ্কের অনুশীলন করুক আগে ,যোগ্য হয়ে উঠুক কবির প্রজ্ঞার। নির্বোধ পাঠক কবিতার সাথে আইডেনটিফাই করলো কিনা তাতে তাঁর কোন মাথাব্যথা নেই । কিন্তু সত্যি বলছি , শঙ্খ ঘোষের লেখা পড়তে গিয়ে আমি কখনো আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগিনি । কখনো হীনমন্যতায় ভুগিনি , কখনো মনে হয় নি , তিনি গ্রহান্তরের বুদ্ধিজীবী ,যার সিগন্যাল অ্যান্টেনা ছাড়া ধরা যায় না । আর এই জন্যই হয়তো আমার সে প্রেম আরও বেড়ে চলে , বয়সের সাথে , ম্যাচিওরিটির সাথে আরও গভীর হতে থাকে , আরও নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হতে থাকে,তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে এক প্রিজম, যার বর্ণবিচ্ছুরণ আমার অস্তিত্বের এক একটা পরত উন্মোচন করে আমায় ব্যাপক রোমাঞ্চের সন্ধান দেয় । রক্তমাংসের অবয়ব ধারণ করে তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ,আমার যা যখন যাকে বলার দরকার , সবই দেখি তিনি কথা জোগান সময়মত।আমি অবসেসড হয়ে পড়ি। আমার বোধের এক্সফলিয়েসান হয় , বোধি লাভ করতে পারি এমন আমি কেউকেটা নই । কিন্তু বুক বাজিয়ে বলতে পারি , ‘ আমি খুব ভালো বেঁচে আছি ‘ ,তাঁর কবিতার ‘ সংসারে কানামাছি ‘।তিনি আজীবন শহর কেন্দ্রিক জীবন যাপন করেন , কিন্তু কোলকাতা শহর নিয়ে তাঁর কোন ভান নেই ।কি অবলীলায় আমিনার বর বলে ওঠে , ‘ কইলকাত্তার পথে ঘাটে অন্যসবাই দুষ্ট বটে / নিজে তো কেউ দুষ্ট না ... কইলকাত্তার লাশে / যার দিকে চাই তারই মুখে আদ্যিকালের মজা পুকুর / শ্যাওলাপচা ভাসে’। জীবন থাকতে তাই সে আর কোলকাতায় যাবে না ।
‘লাইনে ‘ থেকেও লাইন ভাঙার মুরোদ তাঁর আজও অক্ষুণ্ণ , সাম্প্রতিক রাজ্যরাজনীতির প্রেক্ষিতে তা বারবার সামনে এসেছে, আসছে । সেইসাথে ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণ সমাজ রাষ্ট্র সময় আর মানবিকতার । আছে ধিকিধিকি ক্রোধ , আছে মরমিয়া মন , অন্যায় যে করে তার মুখের ওপর বলে ওঠার স্পর্ধা , না , তিনি কারুর ‘ইয়েস ম্যান ‘ হন নি ।তিনি জানেই ‘ এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান’ ... ‘ না – এর পর না , না – এর পর না, না – এর পর না’। ‘ মত তা – ই যা আমার মত / সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ / জ্ঞানীও সে, এমন – কী আপনলোক , প্রিয় । তার চাই / দুপাঁচটি পালকলাগানো টুপি , ছড়ি’। এদিক থেকে প্রবল অহংকারী তিনি । বশ্যতা স্বীকার শিল্পীর ধর্ম নয় । শঙ্খ ঘোষও দাপটে শাসন করছেন তাঁর কাব্য সাম্রাজ্য ।কুডোস।
2 comments:
শেষ বাক্যের আগের তিনটি বাক্য ছাড়াই বলছি, লেখাটি চমৎকার হয়ে উঠেছে শর্মিষ্ঠার উর্বর স্বভার কবিত্বগুণে।
চমৎকার লেখা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন