মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৩

অনুবাদ কবিতা – কৌশিক ভাদুড়ী




অনুবাদ কবিতা
কৌশিক ভাদুড়ী



অনুবাদকের ভূমিকা

শ্রদ্ধেয় কবি রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা বাবুর পরিণতি-সম্পৃক্ত “দ্রোহবাক্য” গ্রন্থভুক্ত গভীর বোধাশ্রিত কবিতাগুলির অনুবাদার্থে আমার কম্পিউটারে ওড়িয়া ফন্ট না থাকায়; শ্রদ্ধেয় সম্বিদ দাশ বাবু আমাকে যৎপরোনাস্তি আদর প্রদর্শন হেতু; স্বহস্তে বাংলা ফন্টে আপলোড করে কবিতাগুলি পাঠিয়েছেন। আমি সম্মানিত। আমি গর্বিত। আমার সীমিত ক্ষমতাতে অনুবাদ প্রচেষ্টা নিচ্ছি।

শ্রী সচ্চিদানন্দ রাউতরায়ের (১৯১৬-২০০৪) পরবর্তী উত্তরাধিকারত্বে ওড়িয়া সাহিত্যের যে ‘নব্য আধুনিক’ (Neo-modernity) যুগের প্রবর্তন হয়, কবি রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা তার অন্যতম ধারক। ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষায় কবিতার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত। পেশগত জীবনে কবি ভারত সরকারের এক আই-এ-এস আধিকারিক ছিলেন, অধুনা অবসরপ্রাপ্ত। কবি রাজেন্দ্রকিশোরের শৈলকল্প কাব্য গ্রন্থটি ১৯৮২ সালে কটকের এক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। কাব্য গ্রন্থটির জন্য কবি ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।

তত্সম শব্দ ওড়িয়া ও বাংলায় অনুরূপ। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, অনুরূপ বাংলা শব্দ সব সময় সমান্তরাল অনুভূতি বহন করে না। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় কবিতার আত্মাটিকে( স্প্যানিশ কবিতায় বিবৃত—দুয়েন্দে, লোরকা বিভিন্ন সময়ে শব্দটা ব্যবহার করেছেন) সনাক্ত করে ফুটিয়ে তোলাটাই সঙ্গত ও সঠিক অনুবাদ। এখানেও সামান্য দু একটি জায়গায় তাই করেছি। যদিও ওড়িয়া ও বাংলার ব্যুত্পত্তিগত অতিন্নতা স্বীকার করে তত্সম শব্দ অপ্রতিস্থাপিত রাখার দায় আগাগোড়াই থেকেছে।

দ্রোহবাক্য প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে, কটক থেকে। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলি অব্যবহিত আগের রচনা।



সিংহদর্শন
রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা


[অনুবাদ – কৌশিক ভাদুড়ী ]

রক্তাক্ত আর দিগ্ভ্রান্ত হয়ে
আহত সিংহের মতন
সারা অরণ্য দৌড়ে বেড়াতে আমার আপত্তি নেই,
ধূর্ত শৃগালের রাজ্যপাট আমার কাম্য নয়,
কদাপি নয়।

আমার মৃত্যু-ভেদ আমার ও প্রতিবিম্ব ভিতরে কেবল ।

এখনও যথেষ্ট গর্জন আমার কন্ঠে আছে,
নিজের ঘা চেটে নেওয়ার মতন যথেষ্ট লালা আছে জিভে।
অরণ্যানীর মৌন অনুনয়ের মোহে
লোভনীয় ক’টা শিকারকে 'যাঃ' বলে মুক্ত করে দিয়েছি
আমার অধিকারের পাঞ্জা থেকে

তা বোলে ভেব না :
হনন শক্তি অপসৃত হয়েছে নখ, দন্ত ও মন থেকে।

যুদ্ধময় পৃথিবীতে তিষ্টে থাকার সাক্ষ্য
প্রেমময় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সাক্ষ্য :
ঘা চিহ্ন,
ঘা চিহ্ন না থাকলে অসম্পূর্ণ রয়ে যায় পুরুষ বিগ্রহ।

আমার মৃত্যু-ভেদ কেবল আমার ও প্রতিবিম্ব ভিতরে।

আহত না হলে সংলাপ আমার সিংহীয় লাগে না।
আত্মাকে ধারণ করতে চাই আমি
সম্পদ করে রাখতে চাই আমার ঘা চিহ্ন :
প্রিয় জনের সম্প্রদান,
আমার স্বীকৃতি!

গুম্ফবিহীন সিংহীবিহীন শিকারবিহীন হয়ে
সারা অরণ্য দৌড়ে বেড়াতে আমার আপত্তি নেই,
ধূর্ত শৃগালের রাজ্যপাট আমার কাম্য নয়,
কদাপি নয়।

শুনে রাখো সকলে,
সান্ত্বনা চাই না, শুশ্রূষা চাই না,
চাই না নারী-আসঙ্গের কোমল চরণ
আমার আর্তি
সখ্যতা হলে হয়ে যাক মহিষের সাথে!
আমাকে বাহন পেতে অভিলাষী দেবীর থেকে
আমার আহত পা থেকে এক দিন
কাঁটা নিষ্কর্ষিত করা মানুষ
নিশ্চই মহত্তর।

আমার জটা আমার ছটা আমার গতি আমার রতি
আমার আহার আর বিহারে আমি গর্বিত !
প্রত্যেক ঝম্পে হামড়ে পড়ে

অহরহ আহততর হতে আমার
শোচনা নেই।

আমার মৃত্যু-ভেদ কেবল আমার ও প্রতিবিম্ব ভিতরে,
যাকে আমি আজও দেখিনি।
দর্পণ দেখার আমার সময় কই!

অশোকস্তম্ভের ওপরে আমার ব্যাঙ্গচিত্র সেঁটে
পরাজিত করা যাবে না আমাকে।

সিংহবাহিনীর রূপের সাথে চাই না মানানসই হতে;
বরং যদি পার, কিছুটা নরত্বের সাথে

আমাকে বিবর্তিত হতে দিও; নৃসিংহ ঢঙে
নিজেকে নিজের কোলগত করে
ছিঁড়ে খুঁড়ে বিদীর্ণ করে দিতে।

যদি না পার ব্যস্ত হয়ো না,
এই আমি বেশ অছি ।
গুম্ফবিহীন সিংহীবিহীন, রক্তাক্ত আর দিগ্ভ্রান্ত হয়ে
সারা অরণ্য দৌড়ে বেড়াতে আমার আপত্তি নেই,
ধূর্ত শৃগালের রাজ্যপাট আমার কাম্য নয়,
কদাপি নয়।

আমার মৃত্যু-ভেদ আমার ও প্রতিবিম্ব ভিতরে ।
দর্পণ মুখোমুখি হও,
দেখ আমার প্রতিবিম্ব ঠিক তোমার মত দেখাচ্ছে।
স্তম্ভের ভিতরে নিরীক্ষণ কর : দেখ কেশরী বসে আছে...
আহত সিংহের মতন বেঁচে থাকতে আমার আপত্তি নেই, আপত্তি নেই ...