মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১২

বাণীব্রত কুন্ডু

কাব্যগ্রন্থ পর্যালোচনা:
 ‘ব্রহ্মকমল অত উঁচু থেকে নীচে পড়লে বাঁচে না।’
রোদবসতির উঠোন / সুবীর ঘোষ
যাঁর কবিতার কাছাকাছি পৌঁছাতে প্রথমেই পার হতে হয় ‘কবির দরজা’ তিনি হলেন কবি সুবীর ঘোষ। ‘কবির দরজায় বৃষ্টিফলক’এ লেখা ‘এসো গোপনে অন্ধগলির শীতধন্দে/টুকে রাখছি হৈ-ভাবনা’। হ্যাঁ, তিনি এভাবেই একের পর এক কবিতা নির্নাণ করে গেছেন কী বিচিত্র ভঙ্গিমায়। যেহেতু সমকাল ছাড়া সাহিত্য হয় না তাই কবিও অপারগ তাকে এড়িয়ে যেতে। তাঁর কবিতাসমূহের অর্ধেক আকাশই রচিত হয়েছে প্রেম, প্রেমে শরীর, সমাজ, সমাজের নানান অন্তর্দ্বন্দ প্রভৃতি। কবির দৃপ্ত লেখনি তাই প্রতিবাদ জানায় ‘দাঁত বসাচ্ছে সমাজ কোথায়? কার গায়?’। আবার অন্য একটি কবিতায় কবি বলছেন -‘জন্ম থেকে যারা খ্যাংরাখ্যাপন বোঝে না তাদের জন্য / চাই কার্বাইড’, ‘আমি এখন হাঁচোড়পাঁচোড় ক’রে বাঁচছি’-প্রভৃতি। ‘নেচে বেড়াচ্ছে পাথর’ কবিতায় কবি বড়ো অদ্ভূতসুন্দর ভাষায় জানিয়েছেন নিভৃত প্রতিবাদ! সেখানে তিনি বলছেন-‘পরের অন্ন খেতে খেতে / ছেলেটি মারা গেল / আর তখনি এল মেঘ / গাছে গাছে নেচে বেড়ালো / পাথর’। অন্য একটি কবিতায় কবি নির্মাণ করেছেন অপুর্ব আচ্ছন্নতা - ‘আজ দুঃখে শিলাবৃষ্টি নামে রাতের গভীরে,/ বুদ্বুদ মিসাইল / ফসলবঞ্চিত মাঠে পড়ে থাকছে চোখের খোলস / সাপঘুমে নিরক্ষর / আমার হরিণগুলো ঘাস ভেবে খেতে চায় / ভালোবাসা স্মৃতি’। অভিনব চিত্রকল্পনা রচনায় কবি সিদ্ধহস্ত, ‘উষ্ণ পৃথিবীর কবিতা’য় লিখছেন – ‘হরিণ মাংসাশী হলে আমিও অশ্বক্ষুরে পদচিহ্ন ঢেকে / কুসুমে কুসুমে হেঁটে চলে যেতে পারি দূরে...’ অথবা, - ‘আমি কখনো খেটে খাচ্ছি কখনো আগুন জ্বেলে নাচছি টইটম্বুর; / একুশিকার জঙ্ঘা ছুঁয়ে ঘাসমুড়োনো যন্ত্র ঘুরছে, ফিরছে, এগিয়ে যাচ্ছে / গড়জঙ্গলের দিকে – টিলা সাজছে উৎসবে, ছাতা খুলে দিয়ে ঢাকছে / আকাশের ছায়া।’ ‘দেহবান্ধবী’ কবির এক আসামান্য শব্দবন্ধনির্মাণ। কুশলী কলমে রূপরচনা করেছেন দেহবান্ধবীর। - ‘ভাতের গন্ধ বড়ো সনাতন...বয়েজ হস্টেলের খাটে পড়ে থাকে দেহবান্ধবীর ঘর।’। ‘আমার বসন্ত নিংড়ে তোমাকে বর্ষার শিল খাইয়েছি বহুবার...’  কবিতার মধ্যে স্বাভাবিক হতাশাব্যঞ্জক চরণও উঠে আসে যেন আধুনিক সমাজের জঠরে মোচড় দিয়ে, - ‘আমরা আর কিছু চাইব না / কেননা দেয়ার মতো কোনো লোক নেই। / কোনোদিন কি ছিল? কর্ণ শিবিরাজা বা হর্ষবর্ধন?’ অথবা, ‘দু-কদম এগিয়ে যাবার ফাঁকে উঁকি মেরে দেখি / কেউ বুঝি পিছু নেয়; বানচাল করে দেয় শৈশবের / হংসকল্প শ্লোক।’ যে কবিতা নিজেই নারী সেই কবিতাকে দিয়েই কবি তাঁর ‘নারীবিষয়ক কিছু ভাবনাচিন্তা’ উগ্‌রে দিয়েছেন। - ‘নারী আসলে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো তুলো বা খই ভূমি স্পর্শ করার আগেই যে দিক পরিবর্তন করে।...নারী যেন সেই চিল, দেখা পাওয়া মুশকিল।’ এভাবেই কবি একের পর এক কবিতা সাজিয়েছেন আপন কৌশলে। শুধু অর্থগতভাবে নয়, কবিতায় নতুন ভাববিষয়ের সঞ্চার, শন্দমাধুর্য়, শব্দবিন্যাসের যথাযথ প্রয়োগ, নতুন শব্দকল্পদ্রুম-প্রণয়ন; সবমিলিয়ে ‘রোদবসতির উঠোন’ এক অনন্ত সময়ের কোমলকঠিন জ্যোত্স্নামাধুরিমায় আপ্লুত, আচ্ছন্ন। কবির সৃজন অমর হোক।