মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১২

চন্দ্রানী ঘোষ

অণুগল্প 

নিঃশব্দ  |   চন্দ্রানী ঘোষ


প্রকাণ্ড এক মহানগরের প্রান্তে কেতাবী বাসা ছিল আমার। বাসাটার মূল আকর্ষণ উল্টোদিকের শহুরে গোরোস্থান যাকে দূর থেকে দেখলে সুন্দর বাগান সাজান পার্ক মনে হয় এরপর রেলপথ, বিস্তীর্ণ নুনের খেত, ম্যানগ্রোভ অরণ্য আর তারপর পাহাড়। মানে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য্য আঁজলাভরে পান করা যায়। কিন্তু ভাগ্যবিরূপে এখানে আমাকে একাই বাস করতে হতো কথা বলতে হতো ছাদ, দেওয়াল আর নিজের সাথে। এভাবেই বাঁচতে বাঁচতে যখন একাকীত্ব আমায় প্রবলভাবে গ্রাস করেছে, নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে দুর্বল এক প্রাণী আমি শুধু বুকে হেঁটে চলেছি - সেইসময় একদিন মধ্যরাত্রির কিছু পরে আমার ঘরের ইন্টা্রকম যন্ত্রটি বেজে উঠল। দুর্বল শরীরে প্রথমে ভয়-আতঙ্কে অবশ হলাম। কিন্তু ছায়া-ই যার একমাত্র সঙ্গী তাকে ভয় করলে চলেনা। ফোনটা তুললাম আর প্রচলিত কায়দায় বললাম ‘হ্যালো হ্যালো’। ওপাশ থেকে ভেসে এল শুধু গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ কোনও কথা নয়। বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলামপরপর প্রতি রাতে একই ঘটনা ঘটে চলল। ওদিকের মানুষটার অস্তিত্ব, ঘরের টুকিটাকি আওয়াজ, পাখার শব্দ, কাগজ ওড়ার শব্দ ইত্যাদি শুনতে পাইকিন্তু সে কিছুই বলেনা। ভয় পেলাম আর তারপর এক-দুদিন ফোনটা ক্রেডল থেকে তুলে ঝুলিয়ে রেখে দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য! এক-দুদিন বাদে কি এক অমোঘ আকর্ষণে ঠিক সময় ফোনটা ক্রেডল-এ রাখলামআর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেটা বেজে উঠল। চমকে গেলাম, তবুও তুললাম, ওদিকে সেই একই নিস্তব্ধতা। আর এরপর থেকে কি হল জানিনা, প্রতিটা একলা দিন অপেক্ষা করে থাকতাম মধ্যরাত্রির জন্য। ধীরে ধীরে ওই নিঃশব্দই আমার পরম প্রিয় হয়ে উঠল। আমি যাবতীয় কাজের অকাজের গল্প করে যেতাম ওই নিঃশ্বাস-ধ্বনির সাথে। ওই কিছুক্ষণ সময়টুকুই আমাকে নতুন করে বাঁচতে শেখাল, ভালোবাসতে শেখাল।

আজ আমি বাসাবদল করেছি। এখন আর মধ্যরাত্রে আমার ঘরে কোনো টেলিফোন বাজেনা।




3 comments:

Arpita Dasgupta বলেছেন...

অপূর্ব লেখা বন্ধু

milan বলেছেন...

কষ্ট হল একটু । সত্যি খুব ভালো লেখা ।

Banibrata বলেছেন...

বাঃ!! বেশ অদ্ভূতসুন্দর অনুভূতি বয়ে আনলো। "ওদিকের মানুষটার অস্তিত্ব, ঘরের টুকিটাকি আওয়াজ, পাখার শব্দ, কাগজ ওড়ার শব্দ" এবং সম্পূর্ণ লেখাটাই - আহা, দারুণ! দারুণ!