মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১২

অমলেন্দু চন্দ

আমার বাইজ্যান্টাইন অবশেষ – আমার গোবেকলি  টেপে
 -- অমলেন্দু   চন্দ

যখন ছাব্বিশ ছিল নীল কষ্ট বিস্তীর্ণ জলার মতো তরল বয়েছে
করুন সংশয় বার বার নিয়েছে সে অন্ধকার ঘ্রান
অদ্ভুত রূপপাখী ব্যাথা হয়ে মেলেছে তার ঈগল পাখনা

          The secret of life is living, but the problem of life is to live. অতর্কিতে সমাধান হয়ে গেলে জেতার মজা পেতে পেতেই অস্থির সময়ের পাখার ঝাপটানি, সে এক অদ্ভুত অ্যালিয়েনেসান। সেই তো শুরু পাথর ভাঙার খেলা। আর একবার সে খেলায় পা দিতেই চালু হত নিবেদিত প্রাণ জীবনবাবুর  খেলা – খেলা তো নয় নিবেদন।  কত সব পাথর আর কি তার গড়ন পেটন। The innumerable vistas of alien feelings, sometimes charming, sometimes painful.  অদ্ভুত অসহ্য সব সবুজ পাগলামি। কত চাপেই না চাপা পড়া প্রতিদিন, আসে পাশের শুধীজন হেঁকে যেত – চাপ নিও না হে, পার যদি যা কিছু ভালো বোঝো তা নিয়ে নেচে যাও, যা খোঁজো সোজাসুজি সে নিয়ে নেচে যাও। তো ছাব্বিশ নাচতে জানে, কিন্তু বৈপরিত্যের কষ্টের নীল বাতাস তার ডানায় চাপ ফেলবে না – তা কি হয়? নীল বাতাস! হ্যাঁ, নীল তো বিষেও হয়। ফলে নিষাদ বিষাদ জীবনসঙ্গী, অন্তত সেই ছাব্বিসের সঙ্গী তো বটেই। কিছু  রূপটান আজীবন থেকে যায় যতই মিলিয়ে যাও সুরবেঁধে পাথর ভাঙার ছন্দ কষ্টের উল্লাসে।


               সব সুর বেঁধে যদি হাহাকারে ফোটানো যেত মেঘ মল্লার, কিম্বা জয় জয়ন্তী। বেশীর ভাগ অনুভুতির কাঁটা ঝোপ চিবিয়ে উঁটের মত পেরিয়ে যাওয়া আভুম বেছানো সময় বেছান, জিভে লেগে থাকা রক্তের নোনা স্বাদ গলা শুকতে দেয় নি।  বুকের মধ্যে সুগন্ধী রুমাল রেখে যারা একদিন আনন্দ দিয়েছিল, হঠাৎ নিঃস্পৃহ  হয়ে এলে অনুভবে ছাব্বিসের অনুভাষ - বরুনা, তুমিও। Strangely it’s not an isolation of choice, rather an acute form of mental  aloneness.  যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের জানা অজানা সমীকরনের ধারাপাত। সেই সব অধ্যায়ে চাওয়ার ঘরে ছিল তুমিই এসো আকাশ ছেয়ে আগুন দেহে মেঘ মল্লার একটু খানি বিদ্যুৎ, আর পাওয়ার নিকেষ জানান দিত ভাবনায় এ কোন প্রেমের নরক, যেন ছাল চামড়া তোলা রুদ্ধবাক স্বপ্ন আর সরব ভর্ৎসনা । 


              জলছবিতে ঠিক ভুল ভালো খারাপের পাওনা গন্ডার হিসেবের রঙে অনেক অন্ধকার ছিল। ছাব্বিসের বুকে ঘুমন্ত শিশুর স্বপ্নস্বর তান ধরত সাঁওতালি মাদলের ধ্রুপদ ধামার, আর তার পরেই ছন্দপতন। গোলাপের থ্যাঁতলানো কুড়ি। দরজায় ঝোলান ভারী পর্দার আড়াল দুলে দুলে মুচকি হাসত, বৃক্ষ পারে, পাখী পারে, ইস্তক পোষা খরগোস পারে, শুধু তুমিই পারনা। তেতে উঠে পর্দা সরিয়ে পারি আমি পারি বলতে গেলে যে প্রাক ছাব্বিশ ভ্রান্ত ধারনার নির্মোক টা ছেঁড়া দরকার, সে চুপি চুপি গান গাইত – দেওয়ালে আলোর ধারে টিকটিকি গুলো দেখেছ, কিরকম নিঃশব্দ স্বস্তিতে থাকে, আলোর কাছাকাছি, চুপচাপ, কোনো টিকটিকিকে আলোর ওপরে চড়ে শিকার ধরতে দেখেছ কখনো?

           ব্যাস, ছাব্বিশ অমনি বিনীত মোমবাতির শিখা, আলো আছে জ্বালার দেখা নেই, ওইটাই তো মন্ত্র, মনের ঘরে সব আলাদা আলাদা - মেঘ, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ - সব আছে শুধু একসাথে ঝড় তোলার এক আকাশ ইচ্ছে টাই গরহাজির। সে বয়সে কবিতা লেখার শুরু। আজও চলছে, শুধু তফাৎ একটাই – মাঝে মাঝে মৃত্যু এসে কবিতার ভাষা উপহার দিয়ে যায়। আর টিকটিকিটা চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে।



           ছাব্বিশ পেরিয়ে তাই ছাপ্পান্ন তে আজ ভাগচাষীর অবস্থা। হায়রে, সে ভাগচাষীর চোখে তো স্বপ্ন ছিল। সোনালী ধানের গন্ধে সুধন্যা পৃথিবী – ফসল উঠবে ঘরে – মাঠে থেকে যাবে নিড়ানির স্তুপাকার – শস্যের শিল্পীরা এসে আলের ধারেতে বসে তামাকে দেবে সুখটান – হল না, আমরা  তামাটে জাতি, অনার্য দ্রাবিড়। ভাগের মা, সম্পন্ন চাষী আর হবে কি করে।

                ভারী পর্দা আবার দোলে। এবার আর দুলে দুলে নয়, বেশ ভারিক্কি গম্ভীর আলতো নড়া সরা। সত্যি, কত জারিজুরি ওর হাতে। ম্যাজিক জানা ফকির যেন। বলল তাকাও তাকাও, আয়েসের দুঃখ নিয়ে ভরে আছ, শুধু নিজের নাভির গন্ধে ভুত হয়ে, সাধের কোম্পানিবাগানে চুমুর চু নিয়ে চু কিৎ কিৎ। কেউ ছুঁয়ে দিয়ে মোর বলবে না। ছ্যাঃ। চেয়ে দেখো সত্যিকারের ভাগচাষীদের দিকে। একটু মিন্ মিন্ স্বরে বলি ওঁরা তো একভাগ পেয়েছে। 


             পর্দা বলল ছ্যাঃ। ভাগের মা। সত্যি হল - ভাগচাষীর ঘরে ওঠে কিছু, বাকি যায় মহাজন সঙ্কাশে, ধার শুধতে ধান কাবার - সারের দাম থাকে বাকি, ভূমিস্বর ভাগের মায়ের ক্লান্তিহীন চেষ্টার ভেতরে যে সুখের প্রেমের স্বপ্নের খুঁটিনাটি, কে রাখে হিসাব, চাষা শুধু শুধে চলে ঋণ।

              হায়রে তেভাগা - মালিক আজ মহাজন - প্রথমে ধার দেয় ফসল ফলাবে, বীজ কিনে দেয়, সে ঋণ শুধতে যায় আর্ধেক, তারপর বাকির ফসলের বেচা কেনায় মহাজন ব্যবসাদার। শুধু ধান কেন সারাদেশ চেয়ে দেখো আখ, আলু, তুলো, পেঁয়াজ – সব সব জায়গায়, ব্যাবসাদার কেনে যে দামে তাতে যে কি হয়, আত্মহত্যাগুলো রাখে তার ইতিহাস - আর আমরা বর্গা আর বর্গের হিসেবের গল্পের অহঙ্কারি নিঃশ্বাসে মহাদেশ কাঁপাই, মালিকানা আর মালিক শুধু বদলেছে, ভাগচাষী ভাগ আজও পায় না।

            পর্দা এরপর মোক্ষম কাব্যি ঝাড়ল ইঞ্জিরিতে - It is impossible, with respect to any grief indelibly impressed upon time, to adequately exhibit and express so as to indicate the enormity of the convulsion which causes the grief. শালা কোথাকার বেনো জল কোথায় গড়িয়ে দিল।

           বললাম – সময়ের উদোম বুকে লেখা সব ঐতিহাসিক ভুলের তলায় কিছু তো আরম্ভের স্বপ্ন ছিল।  লড়াইয়ের স্বপ্নে তো ঐ সোনালী ধান আর আলে বসে হুঁকোয় সুখটানের রূপটান ছিল - কোথায় হারাল কোন বাঁকে?  পর্দার ম্লান স্বর - কত লক্ষ কোটিবার মানুষ শব্দটা ব্যবহার হলো তবু সুঠাম রোদের মতো উজ্জ্বল মানুষ শুধু কবিতায় থেকে গেল। কে নেয় হিসেব।

                কবিতায় আর শ্লোগানে থেকে গেছে ধানের রঙের গন্ধ না কি রঙ্গের গন্ধ - রঙ্গ বটে হে ঈশ্বর, তোমার তুলনা তুমি প্রাণ ...আজও তাই রোজদিন ঈশ্বর খুজে যাই ভয়ে ভয়ে ... সেও তো বদলে যায় সময়ের থামে! তাই বুঝি ভক্তি নেই দেখে বিরক্ত পুরোহিত প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে হরিজনের মতোই বের করে দেয়। শিবের লিঙ্গ আর ছোঁয়া হয় না, বুকে জড়িয়ে ধরা তো দুরের কথা। শেষমেশ দুঃখকে বাঁচিয়ে রেখে সেই নিষাদ বিষাদের শরীরের ওম্‌ নিই। 


                কি কথায় কি কথা । ঐ শালা এক মনের দোষ।  যতবার মোছো ওই এক বিষাদ নিষাদের মতো চোখ রাঙায়। শেষ রাতের কালপুরুষ, মধ্য যামের সপ্তর্ষির আঁচ, কুয়াশামাখা ঠাকুরদালান, ভোরের তুলশী তলায় পাতা ম্লান ফুলের বিছন, গাংচিলের ডাক সব সব জুড়ে বিষন্নতার দ্রিমিক দ্রিমিক স্বর। দেবতায় ভরা এই আদিগন্ত দুনিয়ায় একা রাগি উলঙ্গ সন্যাসি হওয়ার সাহস – নাহ, সেই বিষাদ আবার নিষাদ।

                 মন তুমি কৃষিকাজ জাননা। সত্যিই পারিনা ।  পারিনি মানুষ হতে, পারিনা ভিখিরী হতে, নগ্নতার গৌরবে উলঙ্গ রাজার মত। পর্দা হাসে -

“দিনের শেষে তৃপ্ত দেশের রাজা
সভার মাঝে সোনার মুকুট মাথায়,
শুধু চারণ কবির একতারাটি বলে
রাজা তোর কাপড় গেলো কোথায় !”

                 কৃষিকাজ করতে নেমে মাটিকে ভালবাসলাম। মাটি বলল আকাশকে ভালোবাস। সে তোমাকে দেবে সব – মেঘ, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ।  হয়ত সে বিদ্যুৎ হবে চেতনার সোনালি চাবুক। শুনতে পেলাম পর্দার মৃদু হাসির কষাঘাত – রাজা তোর কাপড় গেল কোথায় ।

1 comments:

খেপচুরিয়ানস্ বলেছেন...

Banibrata১৮ আগস্ট, ২০১২ ৬:১০ pm

কি লিখব!!! কিছু নীরবতা যদি প্রকাশ করে দেখাতে পারতাম... আমার মনে হয় সেটাই হত এর শ্রেষ্ঠ মন্তব্য! _অমলেন্দুদা! খুব ভালো থাকুন...
উত্তরমুছুন
উত্তরগুলি

Amalendu Chanda২১ আগস্ট, ২০১২ ৭:৫৮ pm

কিছু ভারী বাতাস আর ছেদহীন দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গন্ধ হীন ওঠা বসা - এই নিয়েই তো জ্বালিয়ে রাখি এদনান্তীন শক্তি আর ক্লান্তির সমন্বয়ে পুড়তে থাকা পীড়নের ইতিকথা - এ এক অদ্ভুত অবিদ্যমান শুন্যতার স্মৃতি - ধন্যবাদ Banibrata