শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩

ছোটগল্প – শুভেন্দু ধাড়া

শুভেন্দু ধাড়া
বৃষ্টি ভেজা বিকেল



(১)

‘‘ আঁধার ছুঁয়ে পুড়ে যাব
দীর্ঘতর হওয়ার পূর্বে ঝরে যাব কৃষ্ণচূড়ায়
নিমিত্ত অকারণে ধস্ত হতে হতে
কিছু অমসৃণ ভগ্নাংশ অতিক্রম করে
হাতে নেব আপাদমস্তক পরিহাস তোর অহংকারের’’

মাথার উপর ছাদটা ভেঙ্গে পড়েছে, চড়া রোদ বাধাহীন হয়েই নেমে আসছে, চারিপাশের দেওয়াল মাটি আঁকড়ে পড়ে। এ এক ভূকম্পন , কখন হল ! কিভাবে হল ! কিছুই বোঝা যায়নি । সামান্যতম সতর্কবার্তা ছিল না তেমন নয়, ছিল, কিন্তু নিতান্ত অবহেলায় ডুবে ছিল সময়, যার উপর দিয়ে শয়ে শয়ে লতা আগাছা জ্বাল বিস্তার করছে ক্রমশ । বাইরের প্রিয় বাগান থেকে উজাড় হয়ে গেছে গোলাপের ঝাড় , যেখানে দিন দুবেলা ছিল অজস্র আশা ভরসার সমাগম। তবু কি নেশায়, না কি খুঁজে দেখার শেষ চেষ্টায় এগিয়ে গেল ঘোর কাঁটাঝোপের দিকে, হঠাৎ একতাল রোদ মাথার উপর ঝাঁ করে পড়ল বাজের মত, কোনো এক জাদুর মতই সঙ্গে সঙ্গে কাঁটাঝোপটাও চোখের সামনে থেকে উবে গেল কর্পূরের মত, দৃশ্যপটে কিছু-ই রইল না আর , বীথি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল শক্ত মাটিতে ।

তারপর অনেক কষ্টে চোখ খুলে মাথাটা একটু তোলার চেষ্টা করে সে , তুলতে তুলতে নজরে এলো একটি ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে, সেই ছেলে যার পদক্ষেপে বীথি রেখেছিল তার পথচলা আর আত্ম-অভিমান, তাকে দেখে যেন বুকে ধড় ফিরে পেল বীথি, মনে হল, এই ছেলেটা তাকে নিশ্চয় দাঁড়াতে সাহায্য করবে ঠিক আগের মত-ই । ছেলেটা কাছে আসে , কিন্তু বীথি দেখতে পেল ছেলেটার পরিচিত কোমল দুটি চোখ আজ বজ্রকঠিন হয়ে উঠছে মুহূর্তে, দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করছে সে - কেন এসেছিস এতবেলা ? সে চোখের দিকে চোখ রেখে কোনও কথা বলার সাহসটাই হারিয়ে গেল বীথির , তবু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বীথি বলল- 'আমাদের সেই বাগান ! কোথায় ? কোথায় গেল ? তুই বল, প্লিজ তুই বল আমায় ।

ছেলেটা হো হো করে হেসে উঠছে, তারপর সে চলে যাচ্ছে তার পথে, দূর থেকে ভেসে আসছে ছেলেটার অট্টহাসি আর বাতাসে ভাসছে 'ও টা ভেঙ্গে গেছে, যা , তুই চলে যা, ওটা আর ফিরে পাবি না কোনোদিন । শুনতে শুনতে আবার বীথি মাটিতে এলিয়ে পড়ছে, এলিয়ে পড়ছে তার সকল আশা ভরসার ইলেকট্রন কণা, ঠিক তারপরই বাঁধ ভাঙ্গল ঘোর অন্ধকারের, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে উঠলো সে ।একটি হাতের ঠ্যালা খেয়ে থেমে গেল , চোখ খুলে দেখল রমা কেমন ভিতু ভিতু নজরে তাকে দেখছে, আর বলছে, কি রে? কোনও স্বপ্ন দেখছিলি নাকি?

বিছানায় উঠে বসে বীথি, শরীর জুড়ে একটা আলস্য, মাথার ভারটাও কাটেনি , কিছু বলার ছিল না । আলস্য বুকে নিয়ে নেমে এলো বিছানা থেকে, ঘড়িতে চোখ রাখে, এখনো বাকি আছে সময় । জানালাটা ইদানীং তার প্রিয় জায়গা, সেখানেই সে ধুয়ে ফেলতে চায় জমে ওঠা অবসাদ। অন্যান্য দিন এরকম হলে রমা এতবেলা জ্বালাতন শুরু করত, কি স্বপ্ন দেখছিলি? কার স্বপ্ন দেখছিলি বল, এই সব বলে ক্ষ্যাপাত নিশ্চিত, কিন্তু আজ রমা যথেষ্ট সচেতন, কেননা সে জানে এই দিন গুলোতে প্রতিদিন কিভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে সমস্ত ইচ্ছা-কুসুম। একদিকে নিজের মন, অন্যদিকে নিজের পরিবার, এই দুইয়ের মধ্যে পেশাই হতে হতে বীথির সকল সবুজ পাতা ধীরে ধীরে হলদে মরচেতে হারাচ্ছে তার কূল .

অথচ এই বীথি কি নাই চঞ্চল ছিল, কিছুদিন আগে পর্যন্ত । কলেজে নাটক করা, গান বাজনা, সবেতেই ছিল তার স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা, খুব যে ভালো পারত তা কিন্তু নয় তবে উৎসাহে ভাটা ছিল না কোনদিনই। অসিতা মাম কোনোকিছুতেই বীথিকে ছেড়ে এগুতো না, কলেজে সমস্ত প্রকার প্রোগ্রাম গাইড করত মাম, আর তার ছায়া সঙ্গী হত এই বীথি , মাম প্রায়ই বলতেন বীথি সত্যিকারের আধুনিকা, এত প্রাঞ্জল সার্টিফিকেট অন্যান্য কারো ভাগ্যে জুটেনি যা ওর ছিল, আসলে ওর ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা অতুলনীয়, মুখে সদা এক অদ্ভুত হাসি, যেখানে ভেসে যায় সমস্ত প্রতিরোধ । সেই জন্য ওর বন্ধুর তালিকাও বেশ লম্বা, এই নিয়ে ওর কোনও কোনও বান্ধবীর হিংসে আসত খুব, শ্রেয়া আবার এক-ঘাট এগিয়ে আড়ালে দ্রৌপদী বলত এই বীথিকে। তবে রমা চিরদিন বীথির সত্যিকারের বন্ধুই ছিল, তাই আজ এমন ঝোড়ো হাওয়ার দিনেও একান্ত ভাবে তাকেই পাশে দেখা যায় আর কাউকে না .

রমা এগিয়ে আসে বীথির পাশে , ঠিক পাশে, জানালা আজ দুটি উদাস মনকে সান্ত্বনা দিতে কিছুটা হলেও ব্যর্থ হচ্ছে না কি! হচ্ছে, তাই কারও মুখে কোন কথা নেই, কেবল দৃষ্টি মসৃণ রেখা পেয়ে সোজা আছড়ে পড়ছে ব্যস্ত গলিপথে । অগত্যা নীরবতা ভাঙ্গে রমা, বলে ওঠে – এখনও সময় আছে, অত চিন্তা করছিস কেন ? প্রশান্ত তেমন ছেলে না যে তোকে অবহেলা করবে । দ্যাখ সব ঠিক হয়ে যাবে ।

বীথি ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে রমার দিকে, কিছু যেন বলতে চায়, একটু আগের দেখা স্বপ্নটা যদি সত্যি হয় তাহলে সব শেষ। তখন তাকে জন্ম নিতে হবে নতুন করে, একটা অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পর। না, সুইসাইড না, কেবল বর্তমান অস্তিত্বের মৃত্যু, স্বপ্নের মৃত্যু, যার জন্য কোথাও কেউ দোষী সাব্যস্ত হবে না, কোনও বিচারও হবে না, এটাই অলিখিত ব্যাকরণ জীবনের, এরকম হাজার মৃত্যুর মিছিলের নেতৃত্ব দেয় এক আয়ু মাত্র । তা জানে না রমা। তবু সে তার বন্ধুত্বের দোহাইয়ে এক টুকরো আলো জ্বালতে চাইছে, তাতে কি কাটে আঁধার গভীরে ? সব মনস্তাপ পুড়ে যায়নি কি ! যেমন তার নিজের পায়ের তলায় মাটি গড়ার ইচ্ছা, শুধু ইচ্ছা নয়, প্রখর সংকল্প, একদিন সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেই । কিন্তু কি ভাবে?

একটি মেয়ের নিজস্ব ইচ্ছা -অনিচ্ছা বলে কিছু থাকতে নেই, এই বিষয়টার সাথে ছোট বেলার পরিচয় যেমন করে পরিচয় হয়েছিল বর্ণের সাথে । তবুও বদলে যাওয়া সময় রেখেছিল কিছুটা আশ্বাস তার পথে। ছিল আরও বদলের স্লোগান, সমস্ত মাধ্যম জুড়ে তার বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রতিদিন সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকেছে আপাত চোরের মতোই, অভ্যর্থনা পেয়েছে চরম নাস্তিকেরও , কিন্তু বদল কেবল মৌখিক প্রতিশ্রুতি যা এযাবৎ সহজলভ্য বলেই খ্যাত । তাহলে বীথির পরিবার কে বদলাবে কে? স্বয়ং সে ? তেমন কিছু লাভের অংক নেই বলেই অন্য পথের খোঁজে শেষে ফিরেছে রমার হোস্টেলে । এখান থেকে প্রশান্তর হোস্টেল বেশি দূর না, সামনের উল্টো-ডাঙ্গা মোড়, ওখান থেকে লেক টাউন, বেশিটা পথ না, মিনিট তিরিশ সময় লাগে বাসে ।

- রমা, তুই কি যাবি আমার সাথে ? আমার কেমন যেন ভয় করছে ।

- আরে না, তুই মিছি মিছি টেনশন করছিস,দ্যাখ না, সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ে ।

- টেনশন না, কি রকম যেন একটা অপরাধ বোধ ঘিরে ধরছে আমায় । কি হয়ে গেল বলত, বেশতো চলছিল, কি যে মাথায় ঢুকল বাবার কে জানে !

- কিছু না, তাছাড়া ছেলেটা তো খারাপ না, ভালো চাকরি , ভালো মাইনে, এগুলো কি যথেষ্ট নয় জীবনে ?

- তুইও এরকম বলিস না, তুই বুঝতে পারছিস না ।

- ওই অপবাদ দিসনা বীথি, বুঝি, কিন্তু আমিও তো তোরই মত একজন, আধুনিকতার বর্মটুকু বাদ দিলে আমাদের বোঝা না বোঝায় তেমন কিছু যায় আসে না কারো ।

আজ বীথির কিছু বলার নেই কাউকেই, নিজের মাঝে ডুবে থেকে তথাকথিত শান্তির উপাসনায় যেন সে ব্রতী, এ যেন এক নিরলস টিকে থাকার গভীর প্রচেষ্টা ঝড় জল এড়িয়ে ।




(২)

বীথি, দেখতে কিন্তু সুন্দরী বলতে যা বোঝায় মোটেও তা নয় সে, ওর ব্যাচে আরও অনেকে ছিল যারা পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে তাদের আঁচ আশেপাশের সব বয়সকে গ্রাস করে ফেলত, নজর নেচে উঠত ছেলেদের । বীথির ভাগ্যে তেমন কিছু জুটত না যদিও তবে এটাও ঠিক, একদল মেয়ে’র মধ্যেও বীথিকে চেনা যায় আজও তার সরল মুখের উজ্জ্বল হাসিতে। ছোট্ট গোল আদলে কালো দুটি চোখ কি এক অপরূপ মনমোহিনী রূপ নিয়ে ভেসে ওঠে যা ঠিক যেন শুক্লপক্ষের ন্যায় ।

এহেন বীথি কলেজ পেরিয়ে যায় যায়, অথচ তার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই । সারা কলেজের ছেলেরা যদি সব বন্ধু হয়ে যায়, বয়ফ্রেন্ড হবে বা কে ? এত খোলামেলা ছিল সবার সাথে যে সেটা তার যেন অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কেউ আর প্রেমে পড়ত না । এ নিয়ে তার নিজের যে কিছুমাত্র চিন্তা ছিল না, তেমন কিন্তু নয়, ছিল, প্রত্যেকের মতই তারও খোঁজ ছিল দুটি চোখ, যেখানে সে তার একান্ত নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে।

এমন কি কেউ ছিল না ? ছিল , ঠিক তার কাছেই , চোখে চোখে। এত কাছে যে তাকে আলাদা করে দেখতে পায়নি বীথি। প্রথম দেখল যেদিন, সেদিন সে কলেজে ছিল না, বীথি দেখল তার সব বন্ধুরা আছে, হাসছে , খেলছে, আড্ডা মারছে, ক্যান্টিন , লাইব্রেরী মাতিয়ে তুলছে , কিন্তু সে নেই ! কেন ? প্রশ্নটা না চাইতেও উঁকি দিয়ে যায় মনে । অভাবটা আরও তীব্র হল তিনদিন পর, যেদিন নাটকের মহড়ার প্রথম দিন, চোখের বালি, কিন্তু কি করে মহড়া হবে ! বিহারি বাবু যে আসেন নি ! অসিতা মাম মহড়া বাতিল করলেন, একদিন , দুই দিন , তিন দিন, প্রশান্ত আসে না, নাটকের প্রসঙ্গ ছাড়া এ নিয়ে অবশ্য কারো তেমন কোনও মাথা ব্যথা ছিল না ।

তবু যেন ছিল কারো, কিন্তু নিরুপায়, প্রশান্ত মোবাইলটা হারিয়েছিল গত সপ্তাহেই। কেনেনি এখনো, কিংবা কিনেছে, বীথি জানে না । যেটা জেনেছিল সে, তা তার নিজের মনের শূন্যতা, কিছু অকারণ চঞ্চলতা । বারবার মনে পড়ছিল সেই কথা, যেটা প্রশান্ত তাকে বেশি কথা বলত বলে প্রায়ই গেয়ে গেয়ে বলত - তুমি কেমন করে কথা কও হে গুনি, আমি অবাক, অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি । অনেকদিন শুনেনি বীথি সেই পরিচিত সুর, মনের মধ্যে কিছু চিন্তার দোলাচল বেবাক হচ্ছিল তার । দিন বারো পরে যখন প্রশান্ত কলেজে পা রাখল , আক্রোশে ফেটে পড়েছিল বীথি, ‘ কি ছেলে রে তুই, একটা খবর দিতে পারিস না? আমার চিন্তা হয় না?

বীথি নিজেও জানে না, সে কি বলছে। এমনি করেই মন তো তার নিজের পথে চলে, সে কবে সচেতন ছিল ভাবে ? ভুলটা বুঝতে পেরেই লজ্জায় গুটিয়ে গিয়েছিল সেদিন ।

এটা ছিল পূর্বরাগের পালা, যেখানে মন তেমন কোনও উচ্চাঙ্গ পায়নি, শুধু এক চিলতে রঙ উঁকি দিয়েছিল, সেই রঙ জলজ উদ্ভিদের মতোই প্রকাশ্যে আসেনি কোথাও। কিন্তু সে বয়ে যায় বেড়ে যায় চোরাস্রোতের ভিতর, ঘাট শিলা কলেজ ট্যুরের সময় ব্যাপারটা কিছু আলো পায়, প্রশান্ত কি একটা কারণে ট্যুর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু প্রশান্ত না গেলে কেই বা সিন্থেসাইজারে গেয়ে শোনাবে রবীন্দ্রনাথ! তাছাড়া ট্যুরটা ঘাটশিলা করার প্রধান কারিগর তো প্রশান্তই যে, না হলে শৈবাল স্যার শংকরপুর নিয়ে গিয়েই ছাড়ত, একদল তরুণ মনেমনে ঘাট শিলা যেতে চাইছে, অথচ শৈবাল স্যার এর ইচ্ছা শংকরপুর মৎস্য বন্দর, অগত্যা প্রশান্তকে আসরে নামতে হয় শৈবাল স্যারকে ম্যানেজ করার জন্য। দায়িত্ব কঠিন ছিল, কেননা যাত্রার জন্য বাস রিজার্ভ হয়ে গেছে। দিন ক্ষণ স্থির, অবশেষে কঠিন কাজটাও সফল হয় । কিন্তু যাওয়ার দুদিন আগে প্রশান্ত জানাল, সে যেতে পারছে না, অনেক অনুরোধ করল বন্ধুরা, বিশেষ করে বীথি, কিন্তু সে রাজি হয় না। আড়ালে কারো কারো মুখে এও শোনা গেল যে প্রশান্ত ভাল গান গায় বলে ওর অহংকার, তাই এত অনুরোধ সত্ত্বেও ওর না হ্যাঁ হয় না । অগত্যা তাকে বাইরে রেখেই প্রোগ্রাম স্থির রইল। কিন্তু যাত্রার দিন সবাই দেখল শুধু প্রশান্ত নয়, আরও একজন যাচ্ছে না, একে একে সবাই জড়ো হয়েছে কিন্তু বীথি এলনা, মোবাইল সুইচ অফ ।

এই অফ সুইচটাই আর একটি সুইচ অন করে দিয়েছিল কারো কারো মনে, ফলে ট্যুর থেকে ফিরেই বন্ধুরা পাকড়াও করল বীথিকে, বীথি সলজ্জ হাসিতে বলত তোরা যা ভাবছিস তা নয়। ঠিক তাই, তা নয়, কেননা সে নিজেই জানত না কেন তার শেষে যেতে ইচ্ছে হল না, কেনই বা প্রশান্ত কলেজে না এলে তার দৃষ্টি গেটের কোলে গিয়ে বসে! এসবের কোনও উত্তর ছিল না, ছিল কি? না, থাকলে পরে লজ্জায় লুকিয়ে রাখার মত এত লাজুক ছিল না তো সে , আসলে সে নিজেকে স্পষ্ট করে বুঝতে পারত না প্রথম প্রেমের ব্যাকরণ মেনে । একের পর এক প্রশ্ন, সঠিক উত্তর নেই , কেন না সে তো নিজেই জানত না কেন শেষে তার যেতে মন চাইল না । কখন বলছে শরীর খারাপ ছিল, কখন বলছে ঘরে আপত্তি ছিল। যদিও কোনটাই নয় । এভাবেই এড়াতে এড়াতে কতদূর যাওয়া যায়? আটকে গেল কিছু পরেই, যখন প্রশান্ত প্রশ্ন করল – কি রে, তুই গেলি না কেন হঠাৎ ?

- এমনিই, ইচ্ছে হল না, তাই।

- বলিহারি তোর ইচ্ছেকে, মনেকর একটু, ঘাটশিলা ঘাটশিলা করে সবাইকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলি তুই ।

ঠিক সে মুহূর্তে তৃণা কথা কেটে বলে ওঠে , - তোর জন্যই তো ও গেল না।

কিছুমাত্র ভাবল প্রশান্ত,

- আমার জন্য? আমি কি দোষ করলাম! কি’রে বীথি?

বীথি কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না, অগত্যা বাঁচিয়ে দিল প্রশান্তই, ঘড়িতে নজর মেরে পাখির মত উড়ে গেল- ‘এই যা! বেলা হয়ে গেছে , আমি আসি রে’ বলেই সে বেরিয়ে গেল ।

ঠিক সেদিনই কিছু পর কলেজ স্কয়ারে বিকেলের দিকে বেঞ্চে বসে বসে গল্প করছিল বীথি ও তার বন্ধুরা, গল্পের মাঝেই প্রত্যেকে দেখতে পেল প্রশান্ত ঠিক উলটো দিকে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ের সাথে আড্ডা মারছে, তৃণা বলে উঠল, এই তোরা দেখছিস , ওটা আমাদের প্রশান্ত না! সাথে মেয়েটা কে বলত ? চলত গিয়ে দেখি ।

কিন্তু কাউকেই যেতে হল না, সবাই দেখল প্রশান্ত আর সেই মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে ঠিক তাদের দিকেই । একসময় তারা দুজনেই এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। কেউ কিছু বলে তার আগেই প্রশান্ত বলে উঠল- চল তোদের সাথে এর পরিচয় করিয়ে দি- এ হচ্ছে শম্পা , আমার গার্ল ফ্রেন্ড । আর কিছু বলার আগেই সবাই দেখল বীথি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল দল ছেড়ে , কলেজ স্কয়ার ছেড়ে ।

সেই প্রথম নিজেকে দেখতে পেল বীথি,। ‘‘আমার গার্ল ফ্রেন্ড’’ তিন টি শব্দ যেন তিন হাজার বার তার কানকে ক্ষত বিক্ষত করে গেল । প্রতিটি ক্ষত থেকে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘিরে ধরেছিল তাকে । ঘরে ফিরে অনেক ভেবেছে, এভাবে চলে আসাটা কি ঠিক হল? কেনই বা এটা করল সে? জেলাসি ? তবে কি প্রশান্তর প্রতি তার অজান্তেই ছিল প্রেম!! কিন্তু আর ওটা প্রশ্ন হয়ে নেই, যথাযথ উত্তরের পথে সে চিহ্ন ফেলে রেখে এসেছে এইমাত্র। মনে মনে বীথি কিছু আশ্চর্য হল নিজেকে নিয়েই, কেন সে আগে বোঝেনি? যেদিন বুঝল, সেদিন প্রেম এসেছে তাকে বিদায় জানাতে! সারা রাত ঘুম হয়নি। মোবাইলে গেম খেলে খেলে নিজেকে ভুলাতে চাইলেও, ঘুম ছিল কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চে ।

পরদিন ভয়ে ভয়ে , লজ্জায় পা রাখল কলেজে, গেট দিয়ে ঢুকতেই মুখোমুখি প্রশান্ত। মুচকি হেসে বলছে – আমি সব জানি।

বীথির রাগ হয়, লজ্জাও হয়, পালটা প্রশ্ন করে – কি? কি জানিস তুই?

- এই যে , যা সবাই জানে, তুই যে নাটক করতে ভাল পারিস না, সেটা তো আমরা সবাই জানি। ধরা পড়ে গেলি ত?

ততক্ষণে একে একে সবাই জুটেছে চারপাশে, সব বন্ধুরা, এবার হার মানা ছাড়া উপায় নেই আর।

বীথি লজ্জা পেয়েছিল, এত লজ্জা এর আগে কবে পেয়েছিল তার নিজের মনে পড়ে না।

পরে সেই লজ্জাটা জয়মাল্য হয়েছিল, যখন জানতে পেরেছিল, ওই শম্পা আর কেউ না, অমিতের বোন, এবং পুরোটাই ছিল একটা গেম। বীথিকে টেনে বের করবার একটা গেম, কেননা প্রশান্ত বীথিকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করত খুব ।

সেই শুরু , তার পর একে একে দুই হয়েছে পথের কিনারায়। মিলে যাওয়ার অদম্য টানে ভেসে গেছিল দুজনেই, সব কিছু যেন রঙ্গিন ছিল। রঙের কোনও বসন নেই বাসনা ছিল উপকুল জুড়ে রোদের মত । ফলত যা হওয়ার তাই হয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই, সেই দিন প্রশান্তের হোস্টেল আর এক বেডের খাট আশ্রয় দিয়েছিল হোস্টেল মালিকের চাপ সত্ত্বেও । ডাক এড়াতে পারেনি বীথি, বিছানায় বসে যখন প্রশান্ত তার মনের ইচ্ছাটি বলল বীথি বাধা দেয়নি। নির্দ্বিধায় প্রশান্তের সাথে মেতেছিল বিছানায়। মেঝেতে পড়েছিল পোশাক উন্মাদনায় আক্রান্ত হয়ে । বেতাল হওয়ার ভরসা টা আটকেছিল বীথির নিয়ে যাওয়া কন্ডোমে ।

কিছুদিনের মধ্যেই সেই সকল আনন্দ কিন্তু অনেকটাই ম্রিয়মাণ, যেটার শুরু যবে থেকে বীথি’র বিয়ের দেখাশুনা আরম্ভ হয়েছিল। প্রশান্তকে বলেছিল – আমার বিয়ের কথা বার্তা চলছে, কালকে দেখতে আসছে পাত্রপক্ষ । প্রশান্ত কিছুই বলল না, এমন ভান করল যে সে যেন কিছুই শোনেনি কানে, আপন মনে গুন গুন কি যেন গাইছিল সে, যা বীথিরও শোনার মন ছিল না।

তবে তারপর থেকেই বীথি লক্ষ করল প্রশান্ত যেন হঠাৎ চেঞ্জ হয়ে গেছে । পার্কে যেতে চাইলে যেতে চায়না। এমন কি দু পা দুরে’র কলেজ স্কয়ারেও না। এড়িয়ে যেতে লাগল নানা অছিলায় । যেন ধীরে ধীরে সে নিজেকে বীথির কাছ দূরে কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু এই অবহেলা , এই উদাসীনতা কিছুতেই সহ্যের সীমানায় ছিল না। কি এমন হয়েছে যে এভাবে দূরে সরে যেতে হয়? সবে তো বিয়ের কথা বার্তা চলছে, বিয়ে তো হয়ে যায় নি। তাছাড়া সেই বা কি করবে? ঘর থেকে যদি চাপাচাপি করে!

প্রশান্ত একবার বলেছিল অনেকদিন আগে, ঘরে জানাতে। সেদিন বলার প্রয়োজন বোধ হয়নি বীথির। যেমন চলছে চলুক , চলতে চলতে পথ ফুরাবার উপক্রম হলে বীথি বলতে চেয়েও নিজের অসহায়তা লক্ষ করেছে প্রখর ভাবেই এবং সেই অসহায়তা তাকে আরও বেশি সহায়হীন করে তুলল , হঠাৎ করেই একটা দমকা হাওয়া এসে যেন তাকে বলল – ওঠ ছুঁড়ি, তোর বিয়ে!

প্রথম দেখাতেই পাত্র পক্ষের পছন্দ হয়ে যায়। পাত্রও ভাল। আই টি ইঞ্জিনিয়ার , সিঙ্গাপুরে চাকরি । এমন পাত্র হাত ছাড়া করার মত বোকা নন বীথির বাবা ।ফলত বিয়ের দিনও ধার্য হয়ে গেল । সব কিছু এত তাড়াতাড়ি হল যে বীথির দর্শক হওয়া ছাড়া তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না। বিয়ের তারিখ পাকা হওয়ার সাথে সাথেই তার যেন ঘুম ভাঙ্গল । দৌড়ে গেল ছাদে মোবাইল টা নিয়ে । রিংটা অনেকক্ষণ বেজে চলার পর রিসিভ হল । ওপাশে প্রশান্তের কণ্ঠ

- হ্যাঁ, বল কি বলছিস।

বীথি ভয়ে ভয়ে শুধু কয়েকটা শব্দ বলল –আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল যে!

মুহূর্তে ওপাশটা চুপ, কোনও কথা নেই। কিছু আওয়াজ নেই । বীথি অস্থির হয় বলল –

তুই শুনছিস? আমি কি বলছি ।

দেখল, প্রত্যুত্তর পাওয়ার আগেই ফোনটা কেটে গেল ।

তারপর বার কয়েক কল করেও প্রশান্তর কোনও সাড়া পেল না বলে শেষ মেষ এই রমার হোস্টেলে।

না, আর দেরি করে লাভ নেই। সন্ধের আগে ফিরতে হবে, নইলে নানা কথা শুনতে হতে পারে, কদিন পরে বিয়ে, মেয়ে’র এভাবে বাইরে ঘোরাটা ভাল ভাবে নেবে বলে বীথির মনে হয় না। মেনে নেওয়ার হলে আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ের জন্য এত তাড়াহুড়ো করত না। ফলে বীথি বেরিয়ে পড়ল লেক টাউন এর উদ্দেশ্যে ।



(৩)

দরজায় কড়া নড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে প্রশান্তর, সেই বারোটা থেকে ঘুম, ঘুম , আর ঘুম। মোবাইলটা অফ করে দিয়ে, যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চাইছিল সব কিছু থেকে। কেন? সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই, সামনে এস এস সি র পরীক্ষা, এই সময় টা যদি একটু শান্তি পাওয়া যেত তাহলে বোধ হয় ভালই হত, খানিক টা যেন উটকো ঝড় তাকে পাক খাওয়াচ্ছে কাল বিকেল থেকে । এরপর কি হবে? তার যে বিশেষ কিছু করার নেই সে জানে। আর যাই হোক বিয়ে সে এখন করতে পারবে না। আগে একটা চাকরির ব্যবস্থা না করে সে কোনও ভাবেই বীথিকে নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবতে পারবে না, ভাবতে না পারার জন্যই ঘুম, ঘুমিয়ে নিজেকে কিছুটা সান্ত্বনা দিতে ছেয়েছে সে।

খাট থেকে নেমে এসে প্রশান্ত দরজা খোলে। খুলেই অবাক, স্বপ্নেও ভাবেনি সে যে এই সময় বীথি তার কাছে আসতে পারে!! বলার অপেক্ষা না দিয়ে বীথি ঘরের মধ্যে আসে । বসে সেই পুরানো খাটে , কিছুদিন আগে যে পুড়েছিল এই দুজনার তাপে । থমথমে ঘর, প্রশান্ত কিছু বিব্রত বোধ করে। কেননা তাকে এই বার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে বীথি। আলতো করে দরজা বন্ধ করে এসে বসে চেয়ারে । স্তব্ধতা ভেঙ্গে বীথিই প্রথম বলে

- তুই মোবাইল বন্ধ রেখেছিস কেন? মন ভরে গেল বুঝি?

বীথির কথায় খোঁচা খেয়েও প্রশান্ত বিশেষ কিছু আমল দিল না, শুধু গম্ভীর হয়ে বসে থাকা ছাড়া। বীথির ভেতরে জমে থাকা রাগ ও অভিমান উঠে এসে আটকে আছে গলায় , ফলে সে আবার বলে ওঠে – কি রে, জবাব দে... বল আমি কি করব? আমি যে কিছু ভেবে পাচ্ছিনা, এভাবে তুইও যদি না চুপ মেরে যাস, আমি কথায় যাই?

এই বার মুখ খলে প্রশান্ত, বলে – তোর এটা আগে ভাবা উচিৎ ছিল, এত তাড়াতাড়ি কিছু করা যায় না।

এবার যেন ক্ষেপে ওঠে বীথি - যায় , সব যায়, তুই চাইলেই সব করা যায়, কিন্তু তুই চাস না আমি থাকি। তাই এড়িয়ে যাচ্ছিস। বীথি যেন কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে । সামনে প্রশান্ত চুপ মেরে বসে আছে। বাস্তবেও তার কিছু করার নেই। কেননা বাপের পয়সায় সংসার করার মানে নিজেকে ছোটো করা ছাড়া কিছু নয় তার কাছে। সে হিসেবে প্রশান্ত চুপ থাকা মানায়। কিন্তু বীথির কোনও ক্ষতি হোক , সে টা সে চাইতে পারবে না কোনও মতেই। রেগে গিয়ে কোথায় কি করে বসে! খানিক টা সেই ভয়েই প্রশান্ত কথা বাড়াতে চাইল না।

- কি রে, তুই কিছু বল? এমন চুপ মেরে থাকবি এখনও? এই জন্য কি আমি এতটা পথ এলাম?

- তুই বল, আমি শুনি, কিন্তু শোন, আমায় এখনি বিয়ে করতে বলিস না, আমার কিছু সময় চাই।

- সময়? কবে তোর সময় হবে। আমি চলে গেলে , তবে?

- হ্যাঁ, তাই। তোর আর কিছু বলার আছে?? -প্রশান্ত এবার যেন খুলছে নিজেকে।

- তাহলে আমি কি করব?

- যা করতে যাচ্ছিস, তাই কর। মিছি মিছি আর কিছু করিস না ।

- তুই ও এই কথা বলছিস?

- এছাড়া আর কি বলার আছে আমার? মেয়ে দেখা হল। ছেলে দেখা হল। দিন ধার্য হল আর তুই এসব শুনাচ্ছিস বসে বসে । কেন? ঘরে বললে তোকে কি কেটে ফেলত ? আসলে তুই নিজের ব্যর্থতা টাকে ঢাকতে আমাকে অতিমাত্রায় সক্রিয় হতে বলছিস।

- তাতে কি হয়েছে? বিয়ে তো হয়নি এখনও।

এবার যেন প্রশান্ত আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না, দরজা খুলে দিল হাট করে। দমকা হাওয়ার সামনে বীথি নিরুপায়।

- বা ! সাবাস, বিয়ে হয়নি বলে কি অনায়াসে তুই এসব বলছিস। কেন? মানুষের বিশ্বাসের কোনও মূল্য নেই বুঝি? ওই ছেলেটা কি দোষ করল যে তোকে পছন্দ করে বিয়ের স্বপ্ন দেখছে? তুই বলবি, আমি রাজি নই। যদি তাই হয়, তবে কেন থামিয়ে দিলি না বিষয়টাকে ? এগিয়ে যেতে দিলি কেন? কোন উত্তর আছে তোর? ননসেন্স কোথাকার। তুই বলবি ঘরের চাপ। শোন, চাপ হল দৃঢ়টার মাপকাঠি । চাপ দিলেই বোঝা যায় ভেতরে কতটা কি আছে। যা দৃঢ় হয়, তা এত সহজে ভাঙ্গে না। আর যেটা ভেঙ্গে যায়, তা নিয়ে আমার বিন্দু মাত্র আপসোস নেই রে। যদি দুঃখ পাই তা আমার নিতান্তই বোকামো ছাড়া আর কিছু নয়।

বীথি চুপ থাকে। এভাবে প্রশান্তকে আগে দেখেনি সে। এই যুক্তিবাদী প্রশান্তকে সে জানত না সাথে এটাও জানত না তাকে প্রশান্ত এমন করে কিছু বলতে পারে কোনও দিন। কিন্তু মন আর যুক্তি কবে একসাথে চলেছিল ? কিছুটা ভাঙ্গন এসে ঘিরে ধরে বীথিকে , মুখটা কেমন ফ্যাকাসে দেখায়, যা নজর এড়ায় না প্রশান্তরও। অগত্যা কথা ঘুরিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে প্রশান্ত বলে , -যাক , এসব বাদ দে। অনেক দিন পরে এসেছিস, কি খাবি বল?

উত্তরটা দরজা হাট করে খুলে বেরিয়ে দাঁড়াল পথে, একবার ঘুরে তাকাল , তারপর বলল- না । প্রশান্ত ও দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। বিদায় দিতে দিতে বলছে- পারলে আবার আসিস।

কিছুটা এগিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় বীথি। প্রশান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে- আসব, তবে এভাবে ফিরে যেতে নয়।

প্রশান্তর মুখে তখন হাল্কা হাঁসি খেলে যায়। যে হাঁসিতে ধুলোর সাথে ভেসে যায় তার একটু আগের শক্ত কথা গুলো ।



( ৪ )

‘‘সেখানে পার্থিব প্রলাপ রাখে না কিছুমাত্র অগ্নি স্রোত
দালান জুড়ে ডেকে নেয় অতিক্রান্ত আলপনা
প্রোজ্জ্বল মেহেন্দি রং
পালকের ইশারায় উড়ে যায় লাজহিন রোদের আকুতিতে
স্মৃতিভ্রষ্ট প্রজাপতিটি ’’

অবশেষে কাটিয়ে উঠেছে সে সিদ্ধান্তহীনতার রোগটা। না, সে আজ আর কাউকে ভয় করে না। যার সাথে তার বিয়ের কথা ছিল, সে ফোন করেছিল, কথায় কথায় বীথিকে বলেছে সে , বিয়ের পর সিঙ্গাপুরেই থাকতে হবে এবং পড়াশুনা করা চলবে না । বাকিটা কল্পনা করে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি বীথির। ঘর কুনো হয়ে ঘর কন্যা করার জন্য সে কলেজ যায়নি। একটা খাঁচা, তা সোনার হলেও সেটা খাঁচাই যার মধ্যে বীথি নামের একটা পাখিকে ভরার প্ল্যান করেছে দুপক্ষই। আর তার নাটক গান উন্মুক্ত বর্তমান , সেটা কোথায় রাখবে বীথি! বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে সে কথা। এমন কি পাত্রকেও। বাবা এখন মধ্যস্থতা কারি। বিগড়ে যাওয়া পাত্রটিকে রাজি করাতে। আর বীথি ? অসিতা ম্যাডাম বলে, সবার নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত। যেটা বীথি সেই কিশোরী বেলা থেকে ভেবে এসেছে এতদিন, সেটাকে ভেঙ্গে ফেলা যায় না ।

‘ মা, একটু রমার কাছ থেকে আসছি’ , এই বলে বেরিয়েছিল সে। এখন বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে । বাসের অপেক্ষায় । লক্ষ লেকটাউন, ভরসা বলতে বিশ্বাস আর দরজায় দাঁড়ানো হাসিটুকুই । একবার পেছন দিকে তাকাল। ঘরটা অনেক দূরে ছেড়ে এসেছে অটোর সহায়তায় , তাই দেখা যাচ্ছে না। তবু ইচ্ছে করছিল কিছু, হয়ত আর ফেরার রাস্তা দেবে না তাকে তার পিতার আত্মসম্মান । জানে না সে আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারবে কিনা । একটা এল ২৩৮ বাস আসছে । কিছুক্ষণ আগে জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে। তারপরের সূর্যটা রাস্তায় ফুটপাতে বাসের কাঁচে, সর্বত্র হলুদ রঙে ভাসিয়েছে অকৃপণ ভাবেই। আজ যেন সারা শহরের গায়ে হলুদ ।