বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০১৩

ছোটগল্প - শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়

ধোঁকাবাজি
শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়




।।হালকা গৌরচন্দ্রিকা।।

ধোঁকাভাজা বা ধোঁকার ডালনা খেতে আমার তো বেশ লাগে, অনেকেরই নিশ্চয়। একটু গ্যাস হতে পারে, তবে সেই ভয়ে বাঙালি খাওয়া ছেড়েছে কবে? বাঙালিবাড়িতে শ্রাদ্ধের নেমন্তন্নে ধোঁকার ডালনা মাস্ট, এখনও। অনেকের মতে ওটা নাকি মাছের পরিবর্ত হিসেবে মেনুলিস্টে আসে, আমিষ তো খাওয়া যায় না সেদিন। আমার মনে হয় কারণ আরও একটা আছে। আসলে জলজ্যান্ত মানুষটাকে কজনই বা পুরো চিনতে পেরেছিল। এখন সে ইহ জগতের মায়া কাটিয়েছে। কতজনে কতভাবে চিনে-জেনেছিল তাকে। আসুন আমরা একটু ধোঁকা শেয়ার করি। এ জগৎ তো মায়া, ধোঁকার টাটি।




।।এক।।

প্রিয়া। পছন্দের কেউ বা কিছু না। ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থা। গোদা বাংলায় চিটফান্ড। আমার প্রথম চোখের সামনে থেকে দেখা একমাত্র চিটফান্ড “প্রিয়া ইনভেস্টমেন্ট”। ১৯৮৬ বা ৮৭ সাল হবে, বিশুদা একদিন বাবাকে হঠাৎ ধরে বসল, “মামা, আপনার সদরঘরটা আমাদের দিন। সপ্তায় একদিন করে, মাত্র এক ঘণ্টা থেকে বড়জোর দেড় ঘণ্টা, বিকেলের দিকে। এই ধরুন পাঁচটা থেকে শুরু...”

কীসের শুরু সেটাই বুঝতে পারে না বাবা। বিশুর কি আবার নাটকের বাই চাগল নাকি! ওরে বাবা, সেতো এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার! সবকটা হেঁড়ে গলায় চেল্লাবে, চায়ের ভাঁড় আর বিড়ি-সিগারেটের মিলনমেলা হয়ে থাকবে সাধের সদরঘর। কোনও প্রয়োজন নেই... “না না, সেসব কিছু নয় মামা। ওসবের কি আর বয়েস আছে? রোজগারপানির ধান্দাও তো দেখতে হবে। আমরা প্রিয়া এজেন্ট, মাসে-সপ্তায়-দিনের স্কীমে আমরা মানুষের থেকে টাকা জমা নিই, আর সপ্তায় সপ্তায় আমরা জমা করে দিই এই এলাকার ডিও, মানে ডেভেলপমেন্ট অফিসারের কাছে। বছর শেষে ভালো রিটার্ন মামা। এ ছাড়াও আছে, একলপ্তে জমা, তিন বছরে টাকা ডবল। আপনাকেও একটা পলিসি করতে হবে কিন্তু মামা, আমি স্পেশাল কমিশনের ব্যবস্থা করে দেব। নদু, বুদ্ধু, শনু, শৈলেন... আমরা অনেকেই এখানকার এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছি, তাও হতে চলল বছর দুয়েক।”

আমার সদরঘরে তোদের কাজটা ঠিক কী, সপ্তার মধ্যে কোন দিনটা (কবে কবে বসবি?)... “সেসব নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না আপনাকে,” বিশু আর আগের বিশু নেই, এখন সে হাঁ করলে হাওড়া না হাবড়া স্পষ্ট বুঝে যায়, “শনিবার শনিবার, ওই বিকেলে যেমন বললাম, আমাদের মালিক সায়েব আসবে। একটা মিটিং মতো হবে, আর আমাদের সকলের কালেকশন, মানে জড়ো করা ক্যাশ নিয়ে চলে যাবে। আবার পরের শনিবার। সায়েবের নিজের বেয়ারাও আসবে সঙ্গে, যাবার আগে সব সাফসুতরো করে আপনার ঘর যেমনকে তেমন করে রেখে যাব মামা। আর মাসে মাসে কড়কড়ে পাঁচশো টাকা, রসিদ দিতেও পারেন, না দিলেও চলবে।”



।।দুই।।

শুরু হল প্রিয়া ইনভেস্টমেন্টের সাপ্তাহিক মিটিং, চালু লব্জে প্রিয়া কোম্পানির মিটিং। মালিক অয়ন সেনগুপ্ত এলেন নিজের বাজাজ নর্মদা স্কুটারে, পিছনে বসিয়ে খাস বেয়ারা জয়ন্তকে। প্রথম দিন এসেই বাবার সঙ্গে দেখা করে নমস্কার জানিয়ে গেলেন। বয়সের তুলনায় ছোট ঠাউরে আমায় একটা ক্যাডবেরিও দিলেন।

সদরঘরের একদিকের দেওয়ালে ছিল ভিতর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের একটা জানালা। প্রতি শনিবার বিকেল বিকেল আমি সেই জানালায় স্থিত হতাম, নিজেকে গোপন রেখেই, মোটা পর্দার পিছনে। একটা অচেনা জগৎ, অচেনা কথাবার্তা, অচেনা আদবকায়দা পাকে পাকে জড়াতে লাগল আমার সেই বায়ো কি তেয়ো বছর বয়েস। অয়ন সেনগুপ্তর মধ্যে ছিল এক অজানা ম্যাজিক। কথা দিয়ে পরম শত্রুকেও বন্ধু করে নিতে দেরি হত না তাঁর। নদুদা-শনুদাদের মতো এজেন্টদের যেন বস নয়, বড় দাদা এই অয়নদা। বিজনেস পলিসি বোঝানোর সময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত সবাই। শনিবারের এই মিটিং তাই সবার কাছেই যত না কাজের, তার থেকেও বেশি আড্ডার, আনন্দের। ক্রমে ক্রমে সেই মিটিঙে পা পড়তে শুরু হল এলাকার ডানদিকের-বামদিকের রাজনৈতিক নেতাদের।

একদিন শৈলেনদা নিয়ে এল একজন মাঝবয়সী মানুষকে, তাকে নিয়ে সে কী হইচই! তিনি প্রদীপ ধর, ধর চানাচুরের তখন রমরমা ব্যবসা প্রায় পুরো হাওড়া-হুগলী জুড়ে। প্রদীপ ধরকে শৈলেনদা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, আর প্রদীপ ধর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে এক-সুটকেস টাকা, পলিসি করতে চেয়ে। আমি চিকের আড়াল থেকে, সিনেমায় যেমন হয়, এক-সুটকেস ভরতি টাকা...!

তখন তো আর মোবাইল, সাথে ঘড়ি-ক্যামেরা-আলার্ম-রেডিও নিয়ে একটা চলমান বিস্ময় পকেটে পকেটে ঘুরত না। তাই সাপ্তাহিক চুক্তিতে পাশের পাড়ার উঠতি ক্যামেরাম্যান মন্টু ওরফে মনোতোষ মজুমদার প্রতি শনিতে ক্যামেরা কাঁধে উজ্জ্বল। ছবি তুলে নিত প্রিয়া কোম্পানির সঙ্গে এইসব রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক গা ঘষাঘষির। এসব ছবিই তো নিয়ে আসবে আরও আরও লগ্নি, বোঝাত অয়ন সেনগুপ্ত।

প্রিয়া কোম্পানি খুব ছোট অঙ্কের টাকা তুলত, এই যেমন রোজ পাঁচ কি দশ টাকা, দোকানে দোকানে ঘুরে। ফেরৎ কেমন? রোজ দশ টাকা করে জমা হলে বছরে তিন হাজার ছশো পঞ্চাশ, কিন্তু পলিসি ম্যাচিওর হল পাঁচ হাজার টাকায়। আরিব্বাস! সেই পাঁচ হাজার টাকা বিশ্বাসের ডানায় ভর করে “তিন-এ দুই”, মানে তিন বছরে ডবল স্কিমে ঢুকে গেল, বেরিয়েও এল দশ হাজার টাকা। এইবার এই দশ হাজার টাকা গিয়ে ঢুকবে “পাঁচ-এ তিন”, মানে পাঁচ বছরে তিনগুণ স্কিমে। স্কিম তো প্রচুর, যত স্কিম, তত স্ক্যাম।

বিশুদারা তখন আর নেহাৎ এজেন্ট নয়, ডেভেলপমেন্ট অফিসার। ওদের অধীনে আরও আরও এজেন্ট চষে ফেলছে, বাড়িয়ে তুলছে নিজেদের পরিধি। আমার বাবাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি বিশুদা, তবে ডোমজুড়-সাঁকরাইল-জগাছা-জগৎবল্লভপুর থানা এলাকার ঢের-প্রচুর লোক টাকা জমিয়েছিল প্রিয়ার নানা প্রকল্পে। একদিকে আর্থিকভাবে দুর্বল দিনমজুর, মিস্ত্রি-জোগাড়ে-ঘরামি, বাড়ি বাড়ি তোলা-কাজের বউ-ঝি, ছোটখাট দোকানিদের বিপুল অংশের রোজের জমানো টাকা, আর অন্যদিকে ছিল এলাকার গুটিকয়েক ধনী-ব্যবসায়ীমহলে কালো টাকা সাদা করার হিড়িক। তিন-চার বছরের মাথায় ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। অয়ন সেনগুপ্তর চেহারা-চালচলন গেল বদলে। স্কুটার ছেড়ে ফিয়াট, ফিয়াট ছেড়ে কন্টেসা, বিড়ি থেকে ডানহিল ভায়া চার্মস, বাড়ির বউ ছেড়ে না দিয়ে বিভিন্ন শহরে আলাদা আলাদা বন্দোবস্ত...

আর আমাদের বাড়ির সদরঘরে এঁটে উঠছিল না প্রিয়া কোম্পানির মিটিং। দু’ বছর পুরো হবার আগেই আন্দুল বাসস্ট্যান্ডের মাথায় একটা অফিস নিয়ে নিল প্রিয়া ইনভেস্টমেন্ট, বড় হোর্ডিং লাগাল। আমার শনিবারের বিকেলবেলা গোপন ক্যামেরা সিরিজেরও ওখানেই শেষ।



।।তিন।।

নদুদা-বিশুদাদের সঙ্গে দেখা হত, রাস্তায়-বাজারে। ক্রমে দেখা হওয়া কমে গেল। ক্রমে ক্রমে শুনলাম শৈলেনদা নাকি নিজে প্রোমোটারি কাজ শুরু করেছে, বুদ্ধুদা বাড়ির সামনে একটা গুমটি দোকান দিয়েছে, চা-ঘুগনি-আলুরদম-পাঁউরুটির। প্রিয়ার আন্দুলের বুকে অফিসঘরও উঠে গেল, দুভাগে ভাগ হয়ে সেখানে একদিকে হল একটা ঝিনচ্যাক সেলুন, যেটাকে অনেক বলতে শুরু করল, ওটা নাকি আসলে সেলুন নয়, সালোঁ। আর অন্যদিকটা বহু বছর খালি পড়েছিল। এই হালে সেখানে সদা হিমশীতল চেরীরঙা অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের এটিএম।

সবই তো হল। কোথায় গেল অয়ন সেনগুপ্ত? তলে তলে অনেক আগে থেকেই গুটিয়ে নিচ্ছিল ব্যবসা, কাউকে কিচ্ছুটি না বুঝতে দিয়ে। “তিন-এ পাঁচ” স্কীমের প্রথম ঝাঁকটা যখন ম্যাচিওর হবার মুখে মুখে, সেই সময় রাতারাতি ধর্মপত্নী ও শিশুপুত্রকে নিয়ে ফেরার হয়ে যান। অধর্মপত্নীদের দায় উনি কেন নেবেন? দায় কেন নেবেন পঙ্কিল পথের সাথী যতেক কর্মচারীর ভবিষ্যতের বা আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থের?

বাতাসে নানা কথা ভাসত সেই সময়। উনি নাকি মিজোরামের রাজধানী আইজল-এ একটা মিশনারী স্কুলে অঙ্ক শেখান। আবার কেউ বলে ওঁকে দেখেছে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকুর্মম শহরে একটা সিনেমাহলের টিকিট-কাউন্টারে, টিকিট বিক্রি করতে। বিশুদার সাথে মাঝে দেখা হয়েছিল, অনেক বছর পর। কথাবার্তা-পোশাক তেমনই চৌকস, খালি চোয়াল ভেঙে গেছে, চোখমুখ ভিতরে ঢোকা। একটা গ্লোবাল মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সংস্থায় কাজ শুরু করেছে । নাকি ছ’সাত বছর কাজ করলেই হবে, বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। মনে মনে ভাবছিলাম, আবারও চক্করে পড়ল বিশুদা!

এটা-সেটা কথার মাঝে এসে গেল অয়ন সেনগুপ্তর প্রসঙ্গ... “সে কী, তুই শুনিসনি! কাগজে তো বেরিয়েছিল। গুজরাতে থাকা এক বাঙালি পরিবারের তিনজনেই গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, ছেলেটা সদ্য ক্লাস টেন পাশ করেছিল...”


জানি না কোনটা সত্যি? তবে টাকা ফেরৎ পায়নি কেউ প্রিয়া ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি থেকে, এটা নির্জলা সত্যি। হয়নি কোনও অভিযোগেরও নিষ্পত্তি, না থানায়, না ন্যায়ালয়ে।

4 comments:

Indranil Sengupta বলেছেন...

খুব ভাল লাগল।

abhirup mitra বলেছেন...

amar besh legeche .....

Simita Mukherjee বলেছেন...

একটি জলজ্যান্ত লেখা...

Shelley বলেছেন...

ভালো লাগল ।।