বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

স্মরণ সুনীল - নীলাঞ্জন সাহা



নীলাঞ্জন , তোমাকে দিলাম ভুবন ডাঙার মেঘলা আকাশ !'
স্মরণ সুনীল - নীলাঞ্জন সাহা 
       
কী লিখব ? কীভাবে লিখব ? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না !কিন্তু লিখতে তো হবেই , ভেতরে ভেতরে অনুভূত হচ্ছে আলোড়ন , কতরকম ভাবনা আসছে ! কী আর করা , যা পারছি লিখে রাখছি কবিতা নাকি কবিতার মতো কিছু একটা , কে জানে ! ঝাপসা অন্ধকার ঘিরে থাকছে আমাকে যেন !মফস্বলের মুখচোরা ছেলে বয়েস সতেরো-আঠারো নিজের চোখে দেখা কবি বলতে একজনকেই মনে পড়ে- প্রাইমারি ইস্কুলে আমাদের আসা-যাওয়ার পথে সেই যে অদ্ভুত লোকটি একগোছা কাগজ নিয়ে যিনি একটা ধাপিতে বসে থাকতেন আর আমাদের হাতে তুলে দিতেন , কবিতা ! কবিতা কী বুঝতাম নাকি তখন ? আসলে লোকটিকে বড়ো ভালো লাগত !বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে দিতাম উনার লেখা কেউ কেউ কিছুদুর গিয়ে ফেলেও দিত ! সেই লোকটিকে খুঁজে পেলে আজ আমার কিছু লেখা পড়াতাম ! কিন্তু সে তো আর নেই , দেখি না কোত্থাও ! তাই , দু'জন ঘনিষ্ট বন্ধু সন্দীপ ও তুষারকে পড়াই ! ওরা উত্সাহ দেয়  কিন্তু আমি নিজে কিছুই বুঝছি না যে আদৌ পারছি কিনা !বস্তুত , কবিতা পড়ে কিভাবে মুগ্ধতা জাগে সেটাও ঠিক জানি না তখন !রবীন্দ্র কাব্য পড়তে লাগলাম , ভালো লাগলো না !মনে হলো এ ভাষা তো আমার না , অনেক দূরত্ব !জীবনানন্দ ? ওরে বাবা ! কী জটিল ! নীরস !মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে প্রায় !ভাগ্নে কবিতা চর্চা করছে দেখে ছোটমামা কিনে দিলেন বুদ্ধদেব বসু পড়লাম নাহ , মন ভরলো না ! আসলে , কবিতা লিখে অপরকে মুগ্ধ করার আগে আমি পাঠক হিসেবে তখন মুগ্ধ হতে চাইছি ! বিশ্বাস আনতে চাইছি কবিতার প্রতি !ঠিক এমনই এক দুঃসময়ে জেলা বইমেলায় কিনে ফেললাম দুটি কবিতার বই - কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় !ব্যাস ! মুহূর্তে উন্মোচিত হলো স্বর্গের বাগান আর আমি যেন দামাল শিশু ! রাত জেগে পড়ে ফেললাম , একবার না বারবার , রাতের পর রাত ! মুগ্ধতা ! চারপাশে বিস্ময় , নতুন করে আবিস্কারের পালা সবকিছু ! স্রেফ মরে গেলাম - এতদিন যার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম আমি !
                  আজ ভাবি সদ্য কবিতার উঠোনে পা রাখা সেদিনের আমাকে কেন মুগ্ধ করেছিলেন সুনীল ? তার অনেকগুলি কারণ আছে যার মধ্যে কয়েকটি হলো - সুনীলের কবিতায় যৌবনের উচ্ছাস ,প্রেমের তীব্রতা , ভাষার সারল্য ও গতিময়তা যা একেকসময় কী নিপুণ ঙ্গিতপূর্ণ !

"ভ্রু - পল্লবে ডাক দিলে , দেখা হবে চন্দনের বনে -
সুগন্ধের সঙ্গ পাবো দ্বিপ্রহরে বিজন ছায়ায় 
আহা , কী শীতল স্পর্শ হৃদয়-ললাটে , আহা  চন্দন , চন্দন ..."

- সেই উঠতি বয়েসে
 

ভ্রু-পল্লবের ডাক কে পায়নি ?
অথবা 

" এই বিকেলটা অন্যরকম জীবন আমার ছিঁড়ে নেবো জমিয়ে 
রাখব বাক্সে 
চেনা রাস্তায় ঘুরবো একটা মাঠের মধ্যে বাড়ি আমার 
পকেট ভর্তি ঠিকানা 
আজকে আমি নত হবো কান্না পেলে লুকাবো না .... "
-কান্না পেলে লুকাবো না ! কত না কাঁদা কান্না থাকত সেই সময়  মা-বাবার চোখ এড়িয়ে !
কিম্বা 
" শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে আসি শরীরের কাছে 
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে ..
শিশিরে ধুয়েছো বুক , কোমল জ্যোত্স্নার মতো যোনি 
মধুকূপী ঘাসের মতোন রোম,কিছুটা খয়েরী....."
- 'মধুকূপী ঘাস' কিরকম জানি না কিন্তু বাকিটা ?জানি তো !সেই বয়েসে নীল ছবির দৌলতে ধারণা হয়েছে বেশ ! সেই বর্ণনা কবিতায় , এত অনুপমভাবে ? চমকে উঠলাম ! সাহস পেলাম ! জানলাম উদাসীন সঙ্গম , অর্ধরতি !
" নীরার চোখের জল চোখের অনেক 
 নীচে  
 টলমল ...." - সেদিনের মতো  .. আজও কার সঙ্গে যেন ভীষণ মিল নীরার সেই গোপন দুঃখের !
" মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে 
শিউলিফুলের মতো বালিকার হাসি "- কোনো চিত্রকর যেন নিমেষে ছবিটা এঁকে দিলেন মনের ক্যানভাসে ! যেন এতদিনে ঊনিশ-কুড়িতে এসে চোখ ফুটল আমার ! ' Light ! Give me light ! ' হেলেন কেলারের মতো কেউ যেন আমার ভেতরেও চিত্কার করছিল আর তখনি আলো নিয়ে এলো সুনীলের কবিতা অন্য কোনো নবীন কিশোর না , তিনি যেন বললেন , 'নীলাঞ্জন , তোমাকে দিলাম ভুবন ডাঙার মেঘলা আকাশ !' আবার , আফসোসও হলো খানিক যখন দেখলাম আমার অনেক কথাই তিনি কত সহজে আগেই বলে দিয়েছেন !
" কেন  রবীন্দ্রনাথ কে তুমি বুকে জড়িয়ে বসে আছো
 জানলার ধারে
 আমি কি কেউ না ? " - এই অভিমান তো আমার !এই সেদিনও কাউকে জানালাম ! 
কিম্বা যুদ্ধ বিরোধী কবিতা পড়াতে গিয়ে চেকস্লাভ উপন্যাস থেকে নেওয়া সুনীলের সেই পংক্তি -
'কার দিকে তুমি গুলি ছুঁড়ছো হে , এখানে সবাই মানুষ ! ' -একবারও যদি না বলি ছাত্রদের তাহলে আজও তো পাঠদান বাকি থেকে যায় !
               আসলে কত বলব ? আমি জানি না কতগুলি পংক্তি উদ্ধৃত করলে এই লেখাটি সম্পূর্ণ হবে মুগ্ধতা যেখানে সীমাহীন সেখানে যত পৃষ্ঠাই লিখি না কেন এ লেখার নিয়তিই হলো অসম্পূর্ণতা ! আর এই লেখা কোনো ক্রিটিকাল এপ্রিসিয়েশানও নয় যে তাঁর কবিতায় কোথায় কতটুকু জীবনানন্দ , বুদ্ধদেব বসু বা হাংরি জেনারেশন আছে তা খুঁজবো !  সেগুলি নিয়ে এতদিন অনেক বলা হয়ে গেছে অনেকেরই  একজন পাঠক হিসেবে শুধু এটুকু বলতে পারি , আমি একদিক থেকে ভাগ্যবান কারণ  মাত্র বার দুয়েক সুনীলকে খুব কাছ থেকে দেখা ছাড়া তাঁর ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ আমি পাইনি তাই ব্যক্তি-মোহ আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেনি সেভাবে  তাঁকে আমি চিনেছি তাঁর কবিতায় , যেখানে তিনি কাঙাল প্রেমিক, প্রশ্রয় ভিখারী ,মাঝে মাঝে কবিতায় রেগে ওঠেন , 'রাজনীতি -ফিতি ' না বুঝেও মানুষের কষ্টে যিনি বলেন , 'হলুদ শাড়ি আর পরো না , এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি ', এবং যিনি আর সবার মতো নিজেও কথা রাখেন না , রাখেননি ,তাই অনায়াসে চলে গেলেন গদ্যের সভায়  , যদিও বলেছিলেন - শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম !