বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়


সুনীল’দাকে যখন প্রথম দেখি তখন আমি তখন আমি এইট নাইনে পড়ি সম্ভবত । স্কুলের ছাত্র , তখন আমার সামনে তিনি সুনীল’দা ছিলেন না ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । ১৯৮৯ বা ১৯৯০ , সালটা ঠিক মনে পড়ছে না , কলকাতা বইমেলার দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে কাকাবাবুর বৈ কিনে আনন্দ পাব্‌লিসার্সের বাইরে সেই শান্ত মানুষটিই যে আমার প্রিয় লেখক, তখনও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না । কাকাবাবুর বইটা বাড়িয়ে দিতেই সহাস্যে সই করে দিলেন । না তখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ইনিই সেই কাকাবাবুর জনক । সেই একটা সই যে কতবড় সাঁতরা দেওয়ার ধন ছিল আমার সে বলে বোঝাতে পারবো না । বন্ধুরা এলে গর্ব করে দেখাতাম সেই সই । কখনো পরম আনন্দে একলা তর্জনি বুলিয়েছি সেই সই এর ওপর । অটোগ্রাফ শব্দটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমেই সত্যি হয়ে উঠেছিল আমার জীবনে । একসময় আমিও অল্প সল্প নিজেও টুকটাক লিখতে শুরু করলাম । লেখা প্রকাশ হওয়ার স্বাদের সঙ্গে কখনো কিন্তু সেই সইয়ের অমৃত মলীন হয়ে যায়নি । বাংলা কবিতায় সুনীলদা চিরকালই ছিলেন অলিখিত সম্রাট । ‘৯৭ সালে প্রথমবার দেশের শারদীয়া সংখ্যায় আমার কবিতা ছেপেছে , তখন শৈত্যের কোনো একটা অনুষ্ঠানে মল্লিকা’দির থেকে আমার নাম জেনে বাংলা সাহিত্যের সম্রাট বললেন , “তোমার লেখা পড়েছি, ভালই তো হয়েছে ” । ওই একটা বাক্যই সেদিন আমার কাছে যে কত বড়ো সম্পদ ছিল সে বলে বোঝাতে পারবো না তবুও সেই দিনের ওই কথাক’টা ছিল একজন তরুণ কবির কাছে বিরাট ব্যাপার । লিখতে লিখতে এর পরে কেটে গেছে আরও চার বছর । ২০০১ সাল । ৬ই সেটেম্বর । সুনীল’দার জন্মদিনের ঠিক আগের দিন প্রথমবার পা রাখলাম ম্যান্ডেভিল গাডেন্সের পারিজাত অ্যাপার্টমেন্টের ন’তলার সেই কিংবদন্তী কবির ঘরে । আর সেদিন অবাক হয়ে দেখেছিলাম সুনীল’দার অকৃত্রিম সহজ আন্তরিকতা । দেখেছিলাম স্বাতী বৌদির প্রত্যেককে ভালো করে খাওয়ানোর আকুলতা । আর সেই বছর থেকেই ৭ই সেপ্টেম্বর হয়ে উঠল আমার এবং আমার মতো অনেকের ক্যালেন্ডারের ‘উত্তরাধিকার’এর সেই দিন যেদিন নবীন কিশোরের হাতে সুনীল’দা তুলে দেবেন ভুবনডাঙার খোলা মাঠ। এইভাবেই সবার জন্য ছিল সুনীল দার মনের হাট খোলা দরজা । যেন সামনে সামনে সবুজ কচি ঘাসের বিশাল দিগন্ত ।

মাঝে মাঝে মনে হয় সুনীল’দার বাড়ির বৈঠকখানাটারই নাম দিকশূন্যপুর, আর সুনীল’দার বাড়ির রোববারের আড্ডাই ছিল সেই মাঠ। সবাই জানত একবার সেখানে ঢুকে পড়লে সুনীল দা আর স্বাতী বৌদি না খায়িয়ে বেরোতে দেবেন না । যথার্থই “মন-রাজা” ছিলেন তিনি । কেউ তাঁকে কান ভাঙাতে পারত না । তিনি ছিলেন সেই সবের ঊর্দ্ধে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। এমনই ছিলেন নীললোহিত । কে কার সম্ভন্ধে ভাল বলল , কে কার সম্ভন্ধে খারাপ বলল, এই সব অতি তুচ্ছতা তাঁকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারেনি । সুনীল’দার গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি তার মনেরও বোধহয় অভিষেক ঘটত প্রতিদিন , তাই প্রতিটি আড্ডায় তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বড় র‍্যাডিক্যাল, প্রতিটি যাত্রায় তিনিই ছিলেন সবার চাইতে নবীন । সুনীল’দা তাঁর লেখক জীবনের খ্যাতির সর্বচ্চ শিখরে থেকেও যিনি নিজের জীবনটাকে নিজেকে কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে ঘুরতে দেননি । নবীন লেখকদের তুলে আনাই যেন ছিল তাঁর নেশা । তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সবার সুখদুঃখের ধারক । আজ থেকে আমরা তো আর শুধু আমরা থাকব না । আমাদের সবার মধ্যে একটু সুনীল’দা মিশে যাবেন । একে কি চলে যাওয়া বলা যায় ? না, সুনীল’দা চিরকাল আমাদের মধ্যে থাকবেন । রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হবার পরও যেমন শুধুমাত্র তার শরীরটাই গেছে অথচ তিনি রয়ে গেছেন বাঙালির অন্তরে, তেমনি সুনীল’দাও থেকে যাবেন তাঁর লেখায়, মানুষের মনে, আমাদের মনে সেই স্নেহশীল সুনীল’দা হয়ে। কৃত্তিবাসও শুধু সুনীল’দার স্বপ্ন ছিল না , আমাদেরও স্বপ্ন । আমাদের সকলের স্বপ্ন কৃত্তিবাস নিশ্চয়ই আবার প্রকাশিত হতে পারে । সেদিন যখন শহরের রাস্তা দিয়ে শেষ বারের মতো চলে গেলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আর অগণিত মানুষ চোখের জলে গান স্যাল্যুট জানাল তাঁকে, সেই থেমে যাবার মুহূর্তটুকু আসলে একটা ইল্যুইশন , তারপরেই হয়তো কিছু বাদেই আমাদের লেখার টেবিলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখব সুনীল’দা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন ।

3 comments:

Preetha Roy Chowdhury বলেছেন...

khub bhalo laglo...

Unknown বলেছেন...

স্রষ্টা তো তাঁর সৃষ্টিতেই অমর হয়ে থাকেন। যথাযথ লিখেছেন আপনি বিনায়কবাবু।

স্মৃতি শেখর মিত্র বলেছেন...

খুব সুন্দর লাগলো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অল্প
বিস্তর সবাইকেই ঋণী করে গেছেন। তাঁর চিন্তা ভাবনা ‌‌‌‌‌‌অনেকের থেকে স্বতন্ত্র তাই তিনি এত
বড় মাপের মানুষ ও লেখক হতে পেরেছেন।