বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

রম্য রচনা - ঘনা’দার কলম

ইতি - উতি
ঘনাদা


দুগ্গিপূজা – শেষ । বিভিন্ন জায়গার ( অ?) সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণের রেশ এখনও কানে বেজে চলেছে !

অর্থ উপার্জন একব্রহ্মের ন্যায় স্থির । মূল্যবৃদ্ধি সাগর সলিলের ন্যায় আবর্তিত ও ফেনিল । বিপণিসমূহের স্পন্দনোদ্ভূত বিজ্ঞাপনে মন বিক্ষিপ্ত । এই সকল অবস্তু- মায়া জানিলেও, ইহা দ্বারা সমাচ্ছন্ন বাঙালি জীবকূল । অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে, অনন্ত জীব ও প্রপঞ্চ রূপে এই সকল অনন্তকোটী প্রলোভন বিদ্যমান ।

মহাসমুদ্রে তৃণের ন্যায় সকলেই ভাসিতেছে । জটিলতা পূর্ণ অঘটন- ঘটনায় পর্যবসিত হইবে বলিয়া সকলেই একমতো ।

এইরকম ভাষা আগে ব্যবহার করা হত । এখন সব চলতি ভাষা । খাওয়া- দাওয়ার ধরণটাও পাল্টেছে । ক্রিসপি চিকেন, পাস্তা, পিৎজা, চাউমিঁএ – এই সব বাচ্চারা এবং জেন- এক্স এখন বেশি চেনে আর খায় ।

নাড়ু, কুচো নিমকি, বোঁদে,তক্তি- বাড়িতে বানানো বেশ হ্যাপার কাজ । তার চেয়ে রেস্তোঁরাতে গিয়ে বসে খাওয়াটা ভালো । পরিশ্রম বাঁচে, হাজার পঞ্চাশ টাকার গ্যাস দেখেশুনে খরচ করতে হয় ।

তাই, চট মগ্নি- পট বিহা । রাস্তার ফুচকা, ঘুগনি এসব স্বাস্থ – সচেতন লোকেরা খাবে না । বাচ্চাদের খেতেও দেবে না । বাচ্চারা এইসব ঘুঘনি , কুচো নিমকি স্বাদ বদলানোর জন্য একটু খাবে আর তারপরেই বায়না করবে, মোমো খাওয়ার জন্য । তার পর কোল্ড ড্রিংকস্ ।

স্কাই রুম ( এখন চিরতরে বন্ধ ), ওয়ালডর্ফ ( এটাও বন্ধ ), ফ্লুরিস, পিটার ক্যাট-ছিল ঠিকই, তবে বেশি যাওয়া হত না, কারণ মধ্যবিত্তের এইসব নাগালের বাইরে ছিল । এখন প্রায় সব পরিবারেই দোনলা বন্দুক, মানে বাবা- মা দুজনেই রোজগার করেন । তাই এই সব জায়গায় যাওয়াই যায় । তবে, কিছু পুরোনো পন্থী লোক আছেন এখনও । তাই, নাড়ুটা বড়ীটা জোটে কপালে । আমি তো আদ্দেক ডিম খেয়েই বড়ো হয়েছি, তাও হাঁসের ডিম । আজকের বাচ্চারা খাবে ?

এর পরের প্রজন্ম তো এই সব ঘুঘনি , কুচো নিমকি, নাড়ু, তক্তির কথা নেটে দেখবে । বইও বোধহয় থাকবে না !



এই কারণেই সেদিন বাজারে গিয়েছিলাম নারকোল কিনতে । “রিস্কায়” চাপলাম । দুর্গা নাকি, দুর্গতি নাশ করেন । ফুঃ ! দুর্গতি আরও বাড়ে । ওয়াট্ লগা দিয়া । একে তো জামা- কাপড়- জুতোর খরচা । তার ওপর একের পর একের বকশিশ চাওয়ার ফলে, প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যমালয়ে যাবার জন্য রেডি ।
ছয় টাকার পথ বাজার । নামতেই রিক্সাচালক বলে উঠল:- বাবু, পূজার বাজার !! কুড়ি টাকা দেবেন ।
- তোদের আজ সকালে পূজা, বিকেলে শীত, কাল গরম, পরশু বর্ষা, তরশু বিশ্বকর্মা পূজা ! বলি, আমার কিছু নেই নাকি ? আমাকে কে দ্যায় রে ? তার চেয়ে তুই আমাকেই বরং বিনা পয়সায় নিয়ে এসে উবগার কর । পূজা বলে কথা !!!! বল ?

নারকোল দর করলাম । দাম জিজ্ঞেস করাতে, দোকানদার বলল:- জোড়া চল্লিশ টাকা !

বললাম :- একটু কম হবে না ?

হবে বাবু, তবে আমার এখানে নয় ।

কোথায় ?

একটু এগিয়ে যান, জোড়া ৩৫ টাকা । আর একটু এগুলে জোড়া ৩০ টাকা । করে করে, এগিয়ে গেলে দেখবেন, বিনে পয়সায় প্রচুর নারকোল পাবেন !

ব্যঙ্গ করল, বুঝতে পারলাম । চোখে পড়ল নতুন প্রভাতী ট্যাবলয়েড পত্রিকা । তারা বলছে- আপনার প্রথম পুজো । ধ্যৎতেরিকা-পুজো, পুজোই ! তার আবার প্রথম কি ? হ্যাঁ ! শেষ আছে ,তবে সেটা মোলে ! আজকাল তো আবার সাইবারের যুগ ! সাঁই সাঁই করে, বারে ঢুকে কয়েক পাত্তর রাম গিলে মৌজ কর । পুজো বলে কথা ! মগজের, মাদার বোর্ডের র‌্যাম - একেবারে একশো জিবিতে পৌঁছবে । সাধে কি আর মাদার ? এখন মাদার, বোর্ডেই ঝুলছেন ! বিল বোর্ড । জি হচ্ছে সর্ট ফর্ম । গণেশ জি, কার্তিক জি ! বি- ও তাই ! লখস্মীবিবি, সোস্সোতি বিবি । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান । মহাদেব সারা গায়ে ছাই মেখে, পাক্কা সাহেব । মহিষাসুর তো আছেই ! পুরো ঝক্কাস- সাহেব, বিবি, গোলামের থিম্ । এরা আবার থিম্ পুজো দেখাচ্ছে ! হুঁ হুঁ বাওয়া। ইয়ার্কি পায়া হ্যায় !

ফ্ল্যাসব্যাকে চলে গেল মনটা । ছোটবেলায়, বাবার হাত ধরে পুজোর প্যান্ডেলে গেছিলাম । হঠাৎ দেখি, দুজন দুবলা পাতলা লোককে, বাবা দুহাতে চেপে ধরে- পকেটমার বলে চেঁচাচ্ছেন । পাঁড়ে “জি” কনস্টেবল দৌড়ে এসে বলল- কেয়া হুয়া “জি” ?

ওই দুই মক্কেলের ছাড়ানোর লাফা লাফিতে বাবা, হাঁপাতে হাঁপাতে “বি”ড় “বি”ড় করে বলল:- পকেটমার !


পাঁড়ে “জি” চুলের মুঠি ধরে আরেকজনের জিম্মায় দিয়ে জিজ্ঞাসা করল ওদের :-


- নাম কেয়া রে?


- আজ্ঞে, নকুল চ্যাটার্জ্জি!


- ঔর তেরা?


- আজ্ঞে, দানা ব্যানার্জ্জি!


- এঃ ! চোরি করতা, আওর নাম কি পিছে “জি” লগাতা? বোল- চাটার, ব্যানার !!!!
তবে, হ্যাঁ ! জীবনের প্রথম শক, বিয়ের পর বৌকে নিয়ে প্রথম দুগ্গাপুজো দেখা ! সেলসে চাকরি । ছুটি পাবো কিনা ঠিক ছিল না ! কোচবিহার শহরটা তো আর কাছে নয় ।
বিয়েতে, আমার বৌয়ের এক বান্ধবী আসতে পারেনি । রিক্সাতে আমাদের দুজনকে দেখেই তার প্রথম প্রতিক্রিয়া :- এঃ ! বরটা না হয়, ছুটি পেয়ে আসতেই পারেনি , তাই বলে চাকরকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিস ।

আবার রূঢ় বাস্তবের কালারফুল জগতে স্টেপ আপ করে এলাম ।

আমার এক এক সময় মনে হয়, মাছওয়ালারা জনসেবা করতে দোকান খুলেছে ! কি সব ডায়ালগ ! সেলিম বা জাভেদও হার মানবে !

বাজারে বেশ সার সার মৃতদেহ । একটু পরেই এদের শ্রাদ্ধ হবার কথা ! একটা ইলিশ মাছের মৃতদেহের দাম কত, জিজ্ঞেস করতেই মাছওয়ালা বলল- ৮০০ টাকা কেজি !

বললাম :-

বুড়ো ! ( ডাকনাম ) তোর লস হবে না তো ? মাত্র ৮০০ টাকা ? আরও একশো টাকা বেশি নে !

না না, দাদা ! অধর্ম করি না আমি ! কেনা দামেই বেচি আমি- আপনার কাছে !

আমার প্রতি তোর এই দয়ার কারণ?

আমি রোজ সন্ধেবেলায় সোনী টিভিতে সিআইডি সিরিয়ালটা দেখি ! “দয়া” কে আপনার মতো দেখতে, তাই !

তোর এই দয়াতে পোষাবে ? কষ্ট করে, পাতিপুকুরে গিয়ে মাছ কিনে, সেটা কেনা দামেই বিক্রি করবি আমায় ! এটা কোনো কথা হলো? না না ! তুই বরং ৯০০ টাকা করেই নে ! আর শোন- আমায় ১০ মিলিগ্রাম মাছ দে ! ওটাই ১ মিলি তেলে ভেজে , গন্ধ শুঁকে শুঁকে খাব ।

এইভাবেই দিন আসবে যাবে । হুল্লোড়ে মাতবে বাঙালি ! আমরা গড্ডালিকা প্রবাহের মতো ভেসেই চলব ।

আসছে বছর আবার হবে ।

12 comments:

  1. এই বছর আরও হোক। কালী মাঈ কী জয় ...মা করাল্বদনী!

    উত্তরমুছুন
  2. হেসে গড়াগড়ি খেলাম…জয় রাম !!!

    উত্তরমুছুন
  3. যা দিলেন...একদম সনাতনের ষষ্টি থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্য্যন্ত কিছুই বাদ নেই........জিও......রিক্সায় স্ত্রীর সাথে চাকর উপাধী !আহা আহা..........

    উত্তরমুছুন
  4. হাহাহাহাহা... ব্যাপক। বেঁচে থাকুন। :D

    উত্তরমুছুন
  5. আহা হা হা !! সাথের ছবিখান আর তার মইধ্যে বিশেষ কইরা সিংগি ঠাকুরের ন্যাজ দেইখা ,
    সেই কব্বেকার , only Vimal-এর মতো only Radio-র যুগের বাঁশের ডগায় অ্যানটেনা কতা মনে পইড়া গেল,।
    আর সিংগি ঠাকুরের চোকদু'টোও কি মিত্তি কি মিত্তি... চোকের মদ্যি আবার লাইটিং।
    মা ঠাগরোণ, যেন যামিনীকাকুর দেওয়া চোকদুইটা দিয়া এই জেনেক্সের হক্কলের দিকে তাকাইয়া তাকাইয়া ভাবতাছেন, কারে ছাইরা কারে দেকি ....

    মজা আর প্যাচাল ছাইড়া , আসল কতা কই।
    ছবিখান বেশ ভাল হইছে , বেশ লাগছে ।

    ছবি দেকা শেষ কইরা এইবার লেকা পড়নে মন দেই।

    কি যেন কয় ... চাম্পি হইসে। মজা পাইসি খুউব। আর, মিলায় মিলায় দেখসি --- বাড়াইয়া কন নাই , বরং কমাইয়াই কইসেন।

    চাইরখান মুকতা দিয়া মালাডা গাঁথা হইছে। মুকতাগুলি আসল। চন্দ্রাণীমার্কা না --- এক্কেরে আসলি মাল।
    যারা চিনবার পার্ব্বে তারা ঠিকই চিনবো।
    .
    কিনতু কত্তা ,এড্ডা কতা কই ? মনে কিসু নিয়েন না। গাঁথনের সুতাডা এড্ডু কমজোরী হইসে।

    লেখাডার মইধ্যে খেলনের জায়গা কম পড়সে।
    .
    এক টানে পুঁটি উঠে... খেলনের জায়গা লাগে না।
    কিন্তু, বড় মাছ ধইরলে , খেলাইতে লাগে ... এই খেলা দেইখ্যাও সুখ ,যে ধরে তারও মজা।
    (জাল দিয়া মাছ ধরনের কতা ওইন্য কতা)
    অপরাধ নিয়েনা কত্তা । আমি কুনুদিনও মাছ ধরি নাই , ওইন্যের ধরা মাছ খাই কেবলমাত্র।
    তাই এই কতাগুলান আমার অনধিকার আগড়ুম বাগড়ুম ...

    কি যেন কয় , পাঠকের জইন্যো ব্রিদিং স্পেস তৈরি করা ---- ওইডা ইট্টু কম হইসে।
    সফরী-র ফরফরানো এই বনধো কইরলাম আইজ্ঞাঁ

    উত্তরমুছুন
  6. সকলকে ধন্যবাদ । আসল কথাটা বিশ্বজিৎবাবু বলেছেন । আপনার কথাটা মনে রাখবো কত্তা !

    উত্তরমুছুন