বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

ধর্ম-সমাজ-নারী: সেকাল-একাল

ধর্ম-সমাজ-নারী: সেকাল-একাল
সুমিত রঞ্জন দাস


নারী কি শুধুমাত্র ভোগপণ্য, সন্তান উৎপাদন ছাড়া তার কি কোন নিজস্ব সত্তা নেই?

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়েও আজ এই প্রশ্ন আবার নতুন করে দরজায় কড়া নারছে। সুদুর অতীতে হরপ্পা-মহেঞ্জোদরো সভ্যতাকালে পৃথিবী মাতৃতান্ত্রিকতার অধীন ছিল। পরবর্তীকালে ক্রমশঃ সমাজ পিতৃতান্ত্রিক রুপ নিয়েছে। এক সময় এশিয়ার সমস্ত দেশই মাতৃতান্ত্রিক ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের বেশ কিছু সমাজ ও রাষ্ট্রে আজও মাতৃতান্ত্রিকতার বেশ প্রভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরুপ ভারতের পুর্বাঞ্চলে বাংলাদেশ এবং তার সীমান্তে অবস্থিত ভারতের বেশ কয়েকটি প্রদেশ গারো, খাসিয়া প্রভৃতি জাতি আজও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অধীন। বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত বরাবর রয়েছে ভারতের মেঘালয় প্রদেশ, এই প্রদেশের সমাজ ব্যবস্থা এখনও মাতৃতান্ত্রিক।

মাতৃতান্ত্রিক, শব্দটা শুনেই আমরা বুঝতে পারি সেই সমস্ত সমাজ যা মাতা বা নারীকে কেন্দ্র করে গঠিত। মাতৃতান্ত্রিকসমাজে মাতাই পরিবারের কর্তা অর্থাৎ নারীকেই প্রাধান্য দেওয়া হত। মাতৃতান্ত্রিকসমাজে, মেয়েরা বাবা মায়ের সম্পতি পেতো, ছেলেরা পেতো না। কারন তারা নাকি সম্পতি রক্ষা করতে পারতো না। সেইজন্য ছেলেদেরকে বাবা মায়ের সম্পতি দেওয়া হত না, মেয়েদেরকেই শুধু দেওয়া হত। মেয়েদেরকে সম্পতি দিলে সম্পতি রক্ষা পাবে এই ধারনা মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আজ, সব সমাজব্যবস্থাই কম-বেশি পিতৃতান্ত্রিক। আসলে মাতৃতান্ত্রিকতা ও পিতৃতান্ত্রিকতা বলতে আমরা সাধারণতঃ পরিবার ও সমাজশাসনের ব্যবস্থাপনা বুঝি। মানব সমাজ বিকাশের এক স্তরে এসে পশু শিকার ও মৎসশিকার স্তর পার করে মানুষ কৃষি জীবনে প্রবেশ করে। মৎস শিকারী মানব গোষ্ঠি নদীর নিকটস্ত এলাকার হওয়ায় কৃষি ব্যবস্থা শীগ্রই বিকাশ লাভ করে। আর এই কৃষি ব্যবস্থা বিকাশে নারীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আর যেহেতু শিকার করার দায়িত্ব ছিল পুরুষদের, এই কারণে পৃথিবীর যে সকল অঞ্চলের মানুষ শিকারের উপর নির্ভরশীল ছিল, সেই সমস্ত অঞ্চলে পিতৃতান্ত্রিকতা ছিল পরিবার ও সমাজ শাসনের ব্যবস্থাধীন। অবশ্য এটা একটা সম্ভবপর কারন হিসাবে ধরা যেতে পারে।

তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় শাসনের উৎস ছিল ক্ষমতা। ক্ষমতার উৎস কোথায়? তৎকালীন ধর্মসূমহ। বহু ঈশ্বরবাদী ও একেশ্বরবাদী ধর্ম দুইধরনের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছে। বহু ঈশ্বরবাদীদের মতে ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বর ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ক্ষমতার অধিকারী। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বহু ঈশ্বরবাদী ধর্মগুলোর লালনক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে। এই সমাজ বহু-সাংস্কৃতিক সমাজ হিসেবেও বিকাশ লাভ করেছে। এ ক্ষেত্রে সমাজ বহুধর্ম, বহু সাংস্কৃতি, বহু ভাষা ও বহু নৃ-জাতিক সভ্যতার অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। অপরদিকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সকল ক্ষমতার মালিক এক ‌ঈশ্বর ধারনার লালনপালনে বিশ্বাসী ছিল। একেশ্বরবাদীরা মনে করেন সকল ক্ষমতার মালিক একজন মাত্র ঈশ্বর। একেশ্বরের আরাধনার মাধ্যমেই ক্ষমতাবান হওয়া যায়। একেশ্বর যাকে ইচ্ছা ক্ষমতাবান করেন। আর যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ইসলাম-খৃষ্টান-জুদাইজম হলো একেশ্বরবাদী ধর্ম। ইউরোপে গড়ে উঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও জাতীয় রাষ্ট্রসূমহ গড়ে উঠেছে পিতৃতান্ত্রিক ভুবন চিন্তার উপর ভিত্তি করে। শিকার যুগ, ধর্মাশ্রিত সামন্তবাদ, ধর্মাশ্রিত পুঁজিবাদ এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁ পিতৃতান্ত্রিকতার প্রাধান্য বজায় রেখে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ করেছে। রেনেসাঁসৃষ্ট অখন্ড স্বত্বার পরস্পর বিপরীতমুখী ধারনায় পিতৃতান্ত্রিকতাকে প্রাধান্যে রাখা হয়েছে। আর মাতৃতান্ত্রিকতাকে অধীনস্থকরা হয়েছে।

সুতরাং একথা আজ স্পষ্ট যে নারী-পুরুষ বিভাজনে তথা পুরুষশাসিত সমাজ গঠনে যদি কিছু সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে থাকে তা হল তৎকালীন ধর্ম। ধর্মীয় গোঁড়ামির আড়ালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পুরুষশাসনের পক্ষে ধর্মীয় পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে, বা রায় দান করতে দেখা গেছে।

ধর্মীয় পুস্তকে নারীকে কিভাবে দেখা হয়েছে তা উল্লেখ করার আগে একবার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে নারীর অবস্থানটিও খতিয়ে দেখা দরকার। আজও একজন তিরিশ উর্ধ নারীর অভিভাবক হিসেবে দেখা যায় বারো বছরের নাবালককে। দৈহিক সামাজিক এবং ধর্মীয় ভাবে অভিভাবকত্ব এনে দিয়েছে নাবালক পুরুষকে, নারী আজও সেখানে ব্রাত্য। শুধু মাত্র সে নারী বলেই এ হেন আচার ? পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহন করলে যে ধরনের সমাদর পায় একজন নতুন মা, কন্যা সন্তান প্রসবের পরে ততোটাই ধিকৃত হতে হয় সেই মা-কেই । অথচ কন্যা সন্তান হোক বা পুত্র সন্তান হোক জন্ম দেবার জন্যে দায়ী পুরুষের XY ক্রোমোজোমই। XY ক্রমজম নারীর কিন্তু নেই, নারীর কেবল XX, যখন নারীর X পুরুষের X এর সাথে মিলিত হয় তখন জন্ম নেয় কন্যা সন্তান। নারীর কিন্তু নেই কোন Y ক্রোমোজোম। আর পুরুষের Y এবং নারীর X ক্রোমোজোম যখন মিলিত হয় তখন জন্ম গ্রহন করে পুত্র সন্তান। সমগ্র পরীক্ষাটা একেবারেই মনুষ্য নিয়ান্ত্রিত নয়। এখানে নারীকে কোনভাবেই দায়ী করা উচিত নয়। তবু কন্যা সন্তান জন্মদানের অপরাধে ঐ মেয়ের স্বামীকে আর একটা বিয়ে করার জন্যে প্ররোচিত করা হতে থাকে, এবং আরও আশ্চর্য্যে বিষয় এই প্ররোচনায় সবথেকে বেশি যারা লেগে থাকেন তারা হলেন মেয়েটির শ্বাশুড়ি-মা, নোনদ-ভগ্নী (তারাও কিন্তু নারী !) এক জন নারী হয়ে নারীর কষ্ট সেই সময় অনুধাবন করেনা তারা। কি আশ্চর্য্যের বিষয়।

আসুন এবারে দেখা যাক প্রাচীন ধর্মে নারীর স্থান কি রকম ছিল। হিন্দুধর্মের মূল গ্রন্থ চারটি বেদ। শুক্লযজুর্বেদের অন্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে তুলনা করে বলা হয়েছে যে - “সে ব্যক্তিই ভাগ্যবান, যার পশুসংখ্যা স্ত্রীর সংখ্যারচেয়ে বেশি” (২/৩/২/৮)। শতপথ ব্রাহ্মণের এই বক্তব্যের হয়তো অধুনা বিভিন্ন দরদী ধর্মবাদীরা ভিন্ন ব্যাখ্যা ভিন্ন যুক্তি দিতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু পরবর্তী আরেকটি শ্লোকে আরও স্পষ্টভাবে হিন্দু ধর্মে নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারনা করা যায় - “বজ্র বা লাঠি দিয়ে নারীকে দুর্বল করা উচিৎ, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার না থাকতে পারে” (৪/৪/২/১৩)। এর থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্যের আর প্রয়োজন আছে? নারীকে পশুর থেকেও নিম্নতম স্থান দেওয়াই তদানীন্তন সমাজধর্মের উদ্দেশ্য ছিল বলেই ধরা যেতে পারে।

আরও কয়েকটা উদাহরণ নেওয়া যাক। বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবাল্ক্য বলেছেন - “স্ত্রী স্বামীর সম্ভোগকামনা চরিতার্থ করতে অসম্মত হলে প্রথমে উপহার দিয়ে স্বামী তাকে ‘কেনবার’ চেষ্টা করবে, তাতেও অসম্মত হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে” (৬/৪/৭, ১/৯/২/১৪)।
দেবীভাগবত-এ নারীর চরিত্র সম্পর্কে বলা আছে (৯:১): “নারীরা জোঁকের মত, সতত পুরুষের রক্তপান করেথাকে। মুর্খ পুরুষ তা বুঝতে পারে না, কেননা তারা নারীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েপড়ে।“ হিন্দু ধর্মে মাতৃজ্ঞানে দেবীর (দূর্গা, কালি, মনসা, স্বরসতী, লক্ষী) পূজা করা হয়ে থাকে। অথচ ‘নারী’ সম্পর্কে সেই ধর্মীয় বিধানে এমন হীন বক্তব্য রয়েছে। ঋক বা অন্যান্য বেদে, উপনিষদে কয়েকজন বিদুষী ও শাস্ত্রজ্ঞনারীর নাম জানা যায়, যারা বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে শ্লোক রচনা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, গার্গী, বাৎসী, বাক্, অপালা, সূর্যা, ইন্দ্রাণী প্রভৃতি। আধুনিককালে অনেকেই সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিদুষী নারীদের নাম দিয়ে যুকিতু দেন যে সেকালে নারীরা এতটাই স্বাধীন ছিল যে তাঁরা বেদের শ্লোক পর্যন্ত রচনা করেছিলেন! অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে সেকালে কয়েকজন বিদুষি নারী শ্লোক-মন্ত্র রচনা করে শিক্ষা ক্ষেত্রে নিজেদের স্বতন্ত্র্য অবস্থান প্রমাণ করে গেছেন। কারণ ধর্মগ্রন্থকে ঘিরেই ছিল সেকালের শিক্ষা। আবার অপরপক্ষে যে নারীরা বেদ-উপনিষদের শ্লোক-মন্ত্র রচনা করেছেন, সেই নারীদেরই উত্তরসূরীদের জন্য মনু বেদসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, “নারীরা ধর্মজ্ঞ নয়, এরা মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় (অশুভ) -এই শাস্ত্রীয় নিয়ম” (মনুসংহিতা, ৯/১৮)। হায়রে ধর্ম।

অথর্ববেদের কাল থেকেই হিন্দুধর্মের ইতিহাসে কুখ্যাত সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা জানা যায়। “... জীবিত নারীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃতের বধু হতে” (১৮/৩/৩); “এই নারী পতিলোকে যাচ্ছে, এ প্রাচীন রীতি অনুসরণ করছে...” (১৮/৩/৩/১)। এই রীতি কত পুরানো? এটাকে কি আদৌ সংস্কৃতি বলা যায়? কারণ ইন্দো-ইউরোপীয় সভ্যতাগুলিতে সহমরণের কথা তো পাওয়া যায় না। উত্তর বোধ হয় জানা নেই। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে এই বাংলাতেই ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত মাত্র তের বছরে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পুণ্যলাভের আশায় আর নারীর সতীত্ব (?) রক্ষার ধুয়া তুলে ৮১৩৫ জন নারীকেআগুনে পুড়িয়ে মেরে সতী বানিয়েছিল! ভাবুন তো, একটি নিরাপরাধ মেয়েকে টেনে-হিচড়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, পাশে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সকলে দাঁড়িয়ে ‘বল হরি বল’ কীর্তন গেয়ে নিজেদের স্বর্গে যাবার আয়োজন করছে, অনুমান করা যায়! মানুষ কী পরিমাণ ধর্মান্ধ হলে এরকম কাজ করতে পারে? ধর্মীয় মাদক মানুষকে কতটা নিবোর্ধ, কতটা পরিমানে মানবিকতাহীন বানিয়ে দেয়, তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ উপমহাদেশের এই সতীদাহ প্রথা।

এবারে শোনা যাক সনাতন হিন্দু ধর্মের নিয়মের উৎস মনুসংহিতার কথা। নারীর কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে - “বৈবাহিকোবিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ/পতিসেবা গুরৌ বাসোগৃহার্থোহগ্নিপরিক্রিয়া।” (২:৬৭), অর্থাৎ স্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম তাদের (হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা। আবার গৃহকর্ম এবং সন্তান উৎপাদন সম্পর্কে বলা হয়েছে - সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যই নারী এবং সন্তান উৎপাদনার্থে পুরুষ সৃষ্টি হয়েছে (৯:৯৬)। কন্যা, যুবতী, রোগাদি পীড়িত ব্যক্তির হোম নিষিদ্ধ এবং করলে নরকে পতিত হয় (১১:৩৭)! স্বামীরপ্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে (৫:১৫৪)¾“বিশীলঃ কামবৃত্তো বাগুণৈর্বা পরিবর্জিতঃ/উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ।” বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, স্বামী দুশ্চরিত্র, কামুক বা নির্গুণ হলেও তিনি সাধ্বী স্ত্রী কর্তৃক সর্বদা দেবতার ন্যায় সেব্য! আজ আশ্চর্য হতে হয়ে আমরা এই সনামত ধর্মের পুজারী। সাধ্বী নারী কখনো জীবিত অথবা মৃত স্বামীর অপ্রিয় কিছু করবেন না (৫:১৫৬)। স্বামী মারা গেলে স্ত্রীদের কি করতে হবে -“কামন্তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুস্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ/ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎপত্যৌ প্রেতে পরস্য তু॥” (৫:১৫৭), সহজ ভাষায় বাংলা করলে হয়, স্ত্রী সারাজীবন ফলমূল খেয়ে দেহ ক্ষয় করবেন, কিন্তু অন্য পুরুষের নামোচ্চারণ করবেন না। কিন্তু স্ত্রী মারা গেলে স্বামী কি করবেন সেটা দেখা যাক - “ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈদত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি/পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ॥” (৫:১৬৮), এই শ্লোকের বাংলা করলে দেখা যায় - দাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ করে স্বামী আবার বিয়ে এবং অগ্ন্যাধ্যান করবেন। অবাক হতে হয়, নারী-পুরুষের মধ্যে কী চমৎকার সমতা! শোনা যায় ‘মনুবাদ’ থেকেই না-কি ‘মানবতাবাদ’ শব্দের উৎপত্তি। আবার এই ‘মনুবাদ’ না-কী হিন্দু ধর্মের সমস্ত নিয়মের উৎস!

নারীর গুণাবলী নিয়ে মনু বলেন, নারীর কোনো গুণ নেই, নদী যেমন সমুদ্রের সাথে মিশে লবনাক্ত (সমুদ্রের গুণপ্রাপ্ত) হয়, তেমনই নারী বিয়ের পর স্বামীর গুণযুক্ত হন (৯:২২)। নারীর স্বাধীনতা সম্পর্কে মনু সংহিতাতে বলা আছে : “অস্বতন্ত্রাঃস্ত্রিয়ঃ কার্য্যাঃ পুরুষৈঃ স্বৈর্দ্দিবানিশম্/ বিষয়েষু চ সজ্জন্ত্যঃসংস্থাপ্যা আত্মনো বশে॥” (৯:২), অর্থাৎ স্ত্রীলোকদের স্বামীসহ প্রভৃতি ব্যক্তিগণ দিনরাত পরাধীন রাখবেন, নিজের বশে রাখবেন; আবার আছে সেই শ্লোক : “পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে/রক্ষতিস্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি॥” (৯:৩) অর্থাৎ স্ত্রীলোককে পিতা কুমারী জীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে। কখনই স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়। এখন যারা নারীমুক্তির বিষয়ে নিজ ধর্মের পক্ষে সাফাই গান, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই শ্লোক দেখে তারা কী যুক্তি খাড়া করবেন? অস্বীকার করবেন কি অথবা এধরনের কোনো শ্লোকের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।


(ক্রমশঃ)