বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

ছোটগল্প - একুয়া রেজিয়া

যা তোমাকে বলা হয়নি

আমার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, থামাতে পারছি না। ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠ ভেসে আসছে-

-হ্যালো, হ্যালো... কে বলছেন?

আমার কালো ফ্রেমের চশমার কাঁচ ঝাঁপসা হয়ে আসছে চোখের পানিতে। গাল বেয়ে চোখের পানিগুলো ভীষণ অবহেলায় টুপটাপ করে মেঝেতে ঝরে পড়ছে। কতদিন পর......কতদিন পর আমি আসাদের কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। আমি খুব সাবধানে নিজের কান্না আর ভারী নিঃশ্বাস গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি । এত বছর পর আসাদের মুঠোফোনের নাম্বারটা খুঁজে পেয়ে কতদিন, কতরাত, কতবার আমি এই এগারো ডিজিটের ফোন নাম্বারটি ডায়াল করেছি আর প্রতিবার রিং হবার আগেই লাইন কেটে দিয়েছি, তার কোনো হিসেব নেই। একবার, দুবার, শতবার, অসংখ্য বার আমি ওর নাম্বারটিতে ফোন করে লাইন কেটেছি। নিজেকে প্রতি নিয়ত প্রশ্ন করেছি, কেন ফোন করবো আমি আসাদকে? কেন? আমি এই “কেন”-র কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। আমি তো বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলাম আমার ছোট্ট পৃথিবীটাকে, হঠাৎ কেন আমার চোখে পড়লো খবরের কাগজের সেই ছোট কলামটা। যে কলামের নিচে লেখা দু’ শব্দের নামটি আমাকে এত বছর পর আবারও ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার অসীম ক্ষমতা রাখে!

আমার চোখে যেন আজ ভরা বর্ষার বৃষ্টি উপচে পড়ছে, যেন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরছে...আসাদ চলে যাবার পর আমি কতদিন একা একা বসে ওকে চিঠি লিখেছি, মেইল করেছি, মুঠোফোনে মেসেজ লিখেছি কিংবা ভয়েস ম্যাসেজে নিজের বলতে চাওয়া চাপা আবেগগুলোকে ক্যানভাসের তুলির আঁচড়ের মতো করে এঁকে গিয়েছি। কিন্তু এরপর আর কিছুই ওকে পাঠানো হয়নি। আমার ভেতরের সত্ত্বা আমাকে আটকে ফেলেছে অদৃশ্য এক গণ্ডিতে, যেখানে সে আমাকে বার বার বলেছে-যা হয়েছে সেই ভালো।

এই পৃথিবীর নিয়ম এত অদ্ভুত কেন? কেউ হয়ত একজনের জীবন থেকে স্বেচ্ছায় চলে যাবে, আর অন্যজন আজীবন সেই চলে মানুষটিকেই ভালোবেসে যাবে। দিন, মাস, আর বছরের স্মৃতিগুলোকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে রাখবে যেমন করে মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। যেমন করে মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে ছোট্ট শিশুটি তার মাকে আঁকড়ে ধরে। মেঘের মধ্যে চাঁদ যেভাবে ভীষণ মায়া নিয়ে জড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনিভাবে অন্য মানুষটি চলে যাওয়া মানুষটিকে ভালোবেসে যায়।

আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছি শত সহস্র হয়ে। আমি জানি না চলে যেতে চাওয়া, বা চলে যাওয়া মানুষকে কীভাবে ফেরাতে হয়। আমি যদি জানতাম, যদি সত্যিই আমি জানতাম তবে আমি কখনো ওকে চলে যেতে দিতাম না। আমি কতকিছু কল্পনা করে গিয়েছি এরপর। কত কথা, কত স্বপ্ন! আমার অনেকবার মনে হয়েছে আমি হয়ত অনেক মানুষের ভিড়ের মাঝে মিশে গেছি। হঠাৎ করে হাজার মানুষের ভীড়ে আমার সাথে ওর দেখা হয়ে গিয়েছে, সেই হঠাৎ দেখা আমাদের দুজনকে বিস্মিত করে ফেলেছে। তারপর আমাদের দুজনের চোখে বাসন্তিরঙা জ্যোৎস্না উঠেছে আর নক্ষত্রফুল আমাদের সঙ্গি হয়েছে।

আমি চাইলেই হয়ত ওকে অনেক কিছু বলতে পারতাম, জোর করে শোনাতে পারতাম আমার মনের কথাগুলো, কিংবা ওর সামনে এসে ঝরঝর করে কেঁদে নিজেকে হালকা করে ফেলতে পারতাম। কিছু আমি তা চাইনি, চাইনি ওকে কোনো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে, বা ওর ওপর কোনো জোর খাটাতে।কারো জীবনে বা কারো মনেই আমি বোঝা হয়ে থাকতে চাইনি। কেন আমাকে আর সে ভালোবাসবে না তা জানতে চেয়ে ,তাকে কোনো কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে আমার মনে বাধবে খুব। নাহ, এ আমি পারিনি, আর পারবো না। আমার শুধু মনে হতো, কখনো যদি কোনোদিন সে নিজ থেকে এসে আমার কথাগুলো শুনতে চাইতো। কখনো যদি আমাকে একটা দু’মিনিটের ফোনকল করে বলতো-তোমার কী খুব কষ্ট হচ্ছে?

আমার ছেলেবেলার খেলার মাঠের দক্ষিণ কোণে বিশাল একটা বটগাছ ছিল। বয়সের ভারে ওর ডালগুলো নুয়ে পড়েছে আর স্থির হয়ে গেছে ওর আবয়ব। মাঠের কোণে বুড়ো বটগাছটা নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আসাদ চলে যাবার পর থেকে নিজেকে আমার গাছ মনে হয়, আমি অনুভব করি গাছ আমাকে সহিষ্ণু হতে শেখায়, আমাকে নীরব থাকতে শেখায়, আমাকে শেখায় কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েও নিজ বেদনাকে ধারণ রাখা যায়। আসাদ যাবার সময় বলেছিল- আমাকে ও মুক্তি দিয়ে গিয়েছে, অথচ আমি যে মুক্ত হতে চাইনি তা আমি আর ওকে বলতে পারিনি। শুধু নিজেকে বলেছি বার বার। নিজের কন্ঠ নিজেই শুনেছি কেবল।

ওপাশ থেকে লাইন কেটে যাওয়ায় আবারো নিজের অজান্তেই কলিং বাটনে হাত দিয়ে ফেলি। ওপাশে ভরাট কণ্ঠ স্বরে এখন কিছুটা বিরক্তি...

-হ্যালো...

আসাদের এই বিরক্তি আমার বড্ড চেনা। কোনো কিছুকে বুঝতে না পারার বিরক্তি, অপেক্ষা করে অধৈর্য হবার ঠিক আগের সময়ের বিরক্তি।

জলন্ত মোমবাতি গলে গলে পড়ে যেমন নকশা করে, মেঝেতে আমার চোখের জলেরও ঠিক তেমনি একটা নকশা হয়েছে। স্বচ্ছ, টলটলে একটা নকশা। আমি মনে মনে আসাদকে বলি, কত বছর হয়ে গিয়েছে, কত বছর তারপরেও আমার মনের সেই পুরনো আমিটা আসাদের সাথে কথা বলার জন্যে আগের মতোই কিছুক্ষণ পর পর কেমন যেন উদগ্রীব হয়ে উঠে। কিন্তু আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না, ঠোঁটগুলো কেমন অসাড় হয়ে গেছে আমার, অনেক বছর আগের সময়ে বার বার হারিয়ে যাচ্ছে মন।

হয়ত এই পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষের মাঝেই ভালোবাসা নিয়ে বিভ্রম কাজ করে। অল্পদিনেই তাঁরা একে অন্যের কাছে আসতে পারে, আবার খুব অল্পদিনের মাঝে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে, শুধুমাত্র দলছুট হওয়া কিছু বোকা মানুষই নিজেকে দূরে সরাতে অপরাগত হয়। অল্পদিন বা বেশিদিন নয় বরং কোনো দিনই তাঁরা দূরে সরে যেতে পারে না। আমিও একজন দলছুট মানুষ। আমিও একজন বোকা মানুষ। আসাদ কত অল্পদিনেই না বুঝে গিয়েছিল যে আমি ওর জন্যে সেই মানুষটি নই যার সাথে ও বাকি জীবন কাটাতে চায়, ও বুঝে গিয়েছিল আমাকে নিয়ে সে আর জীবনের পথে হাঁটতে চায় না। হুইসেল বেজে ওঠার পর স্টেশন থেকে যেভাবে ট্রেন ঝিক ঝিক শব্দ তুলে একটু একটু করে অনেক দূরে চলে যায়, আসাদ আমার কাছ থেকে সেভাবেই অনেক দূরে চলে গেলো। আমাকে জানিয়ে দিয়ে গেলো এই পুরোনো স্টেশন ওর আর ভালো লাগেনা, এ জায়গা ওর জন্যে নয়......ওকে অন্য পৃথিবী ডাকছে...ওকে যে যেতেই হবে।

সেদিন আমরা দুজনে একই বিন্দু থেকে আলাদা হয়ে যাই। আসাদ চলে যায় অনেক দূরে, আমি সেই বিন্দুতেই দাঁড়িয়ে থাকি তফাৎ শুধু এটুকুই। আমাকে কেউ না বলে দিলেও আমি সেদিন বুঝতে পারি এখন থেকে আসাদ ওর মুঠোফোনের নাম্বারটা বদলে ফেলবে, মেসেঞ্জারে হয়ত আমার প্রিয় নিকটা ব্লকড হয়ে অবহেলায় পরে থাকবে। আমাদের চেনা জায়গাগুলো আর আসবে না ও। আমি সব বুঝে নেই নীরবে। অথচ কী আশ্চর্য! আমার মধ্যে কেন যেন কোনো অভিমানও কাজ করে না। একটুও না।

আমার চোখের জলগুলো অল্প অল্প করে কালের গহবরে হারিয়ে গিয়েছিল। আমি কাঁদি না বহুদিন হয়ে গিয়েছিল। আমি তো সবকিছুর পরেও নিজের ছোট্ট চড়ুই পাখির মতো জীবনটাকে সাজিয়ে ফেলেছিলাম নিজের মতো করে। আমার বারান্দার রোদ্দুর, আমার স্নিগ্ধ আকাশ, আমার রংতুলির বাক্স, আমার ভাবালুতা, আমার এলেবেলে সব ভাবনা নিয়ে বেশ ছিলাম আমি। কেমন করে যেন বুঝতে পারতাম এতদিনে আসাদ হয়ত বেশ খ্যাতিমান ডাক্তার হয়ে গিয়েছে, ওর মনের মতো কোনো মেয়ে এখন ওর স্ত্রী, জীবনসঙ্গি। ওর বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগানে ওর ফুটফুটে সন্তান খেলা করে। ওকে রোজ সকালে সেই সন্তানকে স্কুলে পৌছে দিতে হয়। আমি তো সবই বুঝতে পারতাম। সব বুঝেও ভালো ছিলাম। নিজেকে নিজের মায়াঘেরা জগতে রেখে ভালো ছিলাম। কিন্তু সেদিন সাত সকালে খবরের কাগজের সেই পাতাটা আমার সাজানো জগতটাকে আবার তাসের ঘরের মতো এলোমেলো করে দিলো। আমাকে নস্টালজিক করে ফেলল। সূতো কাটা ঘুড়ির মতো আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো বেশ অনেক বছর আগের সময়ে।

আমি এখন জানি আসাদ তার জীবনে সুখেই আছে, তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খুব ভালো আছে। কেনই বা আমি ফোন করবো আসাদকে? কেন? আমার ফোন করাতে কী বা আসে যায়! কেন ও এতদিন পর শুনবে আমার অপেক্ষার কথা, আবেগের কথা, আমার একলা জীবনের কথা। নাহ... আমি কাউকে বা কোনো মানুষকেই বলতে চাইনা আমার জীবনের ক্লান্তিকর দীর্ঘ গল্প। বরং আমার জানালার পাশে যে ছোট্ট গাছটায় নয়নতারা ফুল ফোটে তা আমার বড্ড আপন, কালচে নীল আকাশের বাসন্তিরঙা জ্যোৎস্না আমার আপন। গভীর রাতে চুপি চুপি তাদেরকে আমার গল্প শোনাতে পারি।

মুঠোফোনের স্ক্রিন কালো হয়ে এসেছিল। আবার আলোকিত হয়ে গেলো, স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আমার খুব চেনা নাম্বার। আসাদ ফোন করে যাচ্ছে, তাকে মধ্যরাতে ফোন করা অচেনা নাম্বারের আগন্তুককে হয়ত সে জানতে চায়। আমি চুপচাপ দু হাতের মুঠোয় মুঠোফোনটা আলতো করে ধরে রাখি, আর ফিসফিস করে বলি-

তুমি কী একটা ছোট্ট হলোদে পাখিকে চিনতে পারো? যে পাখিটা তার সঙ্গি পাখির সাথে খুব ভালোবেসে বাঁচার সাধ রেখে! যে পাখিটা মুক্ত আকাশে কখনো একলা উড়তে চায়নি। সে চেয়েছিল তার সঙ্গিকে সাথে নিয়ে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে যাবে দূর অজানায়। কিন্তু পাখিটাকে যে একাই উড়তে হয়। সে আর বাতাসের সাথে পাল্লা দিতে পারে না, কারণ তার মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। পাখিটা নীড়ে একলা ফিরে আসে...আসাদ, তুমি কী সেই ছোট্ট হলোদে পাখিকে চিনতে পারো?