সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২

ধারাবাহিক বড়গল্প - মৌ মধুবন্তী

ফোর-ওহ-ওয়ান (এক)
মৌ মধুবন্তী


সবে চোখ জুড়ে ঘুমের মেঘমল্লার নেমে আসছে। এনালগ ফোনের ঢঙ্গে ক্রিং ক্রিং আওয়াজ। কান খুলে দিয়েছে তার দরজা, কিন্তু ঘুম চোখে মেঘেরা দূরে যেতে রাজী নয়। রাজ়িস্মিতা পাশ ফিরে শোয়। ঘুমের দেশে অসাড় দেহ ভাজ হয়ে পড়ে থাকে অর্থোপেডিক বেডে। নীল রঙের বিছানার চাদর। তার খুব প্রিয় রঙ। ঐ চাদরের উপর সে দিয়েছে আজ সাদা লেসের পিলো কভার। একটু হাল্কা এমব্রয়ডারির কাজ করা। বিছানার ব্যপারে রাজিস্মিতা সব সময় বেশী রকমের বিলাসি। ঘুমাতে যাবার আগে বেডে পারফিউম ছিটাবে। নতুন করে বিছানা ঝাড়বে। কুইল্টের নীচে একটা হাল্কা রঙের চাদর তার চাই-ই চাই।কি শীত কি গ্রীষ্ম কুইল্ট আর ফ্ল্যাট বেড শীট তার বিছানায় থাকবেই। বেডটাও কিনেছে মাত্র কিছুদিন আগে। আর ম্যাট্রেস হলো টাইম নাম্বারড। ইচ্ছে মতো ফার্ম বা শক্ত বা নরম করা যায়। হিটিং প্যাড লাগানো আছে। প্রবল শীতে সুইচ অন করলে পুরো বেড বা আংশিক বেড গরম হয়ে উষ্ণ-আরাম আমেজ তৈরি করে দেয়। কত কি আছে এই নর্থ আমেরিকায়।

উত্তরাধুনিক শয্যা। পেছনে ফেলে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে রাজী। উত্তরাধুনিক মনের উপর ও হামলা করেছে নবীন কোন উল্কা। গ্রহগুলো চারিদকে বিভীষিকাময়য়। জি পি এসের থ্রি ডি প্যানেল এ একের পর এক ফোন নাম্বার ঝলসে ওঠে। এখন সব কিছু অচেনা লাগে। রিয়ার ভিউ অন করতেই মন চলে যায় দূর অতীতে। মেমোরি সেল স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মত এনিমেশানে তুলে আনে হাই পীচ, মিডিয়াম হিউ আর সার্প কাট পীচ।
পিচ ব্রিজ পার হয়ে মাত্র চার বছর আগে রাজীস্মিতা কানাডায় আসে । সিরাত ও সে , তারা জীবনসঙ্গী হিসাবে দু’জন দু’জনকে গ্রহণ করেছে। সেখানে স্বামী-স্ত্রীর ইন্সটিটিঊশানাল কোন দায় বদ্ধতা নেই। মানসিকভাবেও নেই বটে, কিন্তু বাবা-মায়ের কারণে দু’জনেই কোর্টে গিয়ে সাইন করে আই ডু করেছে। কোর্টেই তারা বলেছে, উই আর সোলমেট; লাইফ পার্টনার, ট্রু ফ্রেন্ড।
মিসিসাগার এরিন মিলসে তাদের দু’জন মানুষের জন্য পঁচিশ ‘শ স্কয়ার ফুটের অত্যাধুনিক ফেসিলিটিসসহ একটি টাউন হাউস। বাসার পেছনে ঘন সবুজ র‍্যাভিন। মাঝে মাঝে হরিণ এসে দেখা দিয়ে যায়। রাজিস্মিতার মা অনেকদিন আগে বলেছিল, সুখী বন্ধুদের কাছেই হরিণ আসে। তাই সে মাঝে মাঝে নিজের মনেই আহল্লাদিত হয়ে ওঠে। সে সত্যি সুখী। বন্ধনের নাম যাউ হোক সুখটা সবারই কাম্য।
আমেরিকায় মাইক্রোবায়োলজিতে পি এইচ ডি করার পরে, পরিচয় হয় সিরাতের সাথে, অনলাইনে। সিরাত ক্যামিস্ট্রিতে পি এইচ ডি করেছে টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে। তারপর কোম্পানীর স্পন্সরশীপে সে স্থায়ী বাসিন্দা হবার ছাড়পত্র, পিয়ারকার্ড ও অবশেষে পাসপোর্ট পায়। রাজিস্মিতার স্টুডেন্ট ভিসা শেষ হলে তাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। তার জন্য সে সম্পুর্ন প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সিরাতের সাথে পরিচয় হলে, সেই প্রস্তুতিতে নতুন বাঁক আসে। তবে সে সিরাতের স্পন্সর নিতে রাজী হয়নি; বরং নিজেই কানাডায় ইন্ডেপেন্ডেন্ট ক্যাটেগরিতে এপ্লাই করে ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে সরাসরি চাকুরী নিয়ে আসে।
যেদিন সে তার চকচকে নতুন হাইব্রিড টয়োটা ক্যামরি নিয়ে ইমিগ্রেশানের কাজ শেষে পিচ ব্রিজ পার হয়ে স্টেনলি রোড ধরে নায়েগ্রা সিটিতে ঢুকেছে, সেদিনকে মনে হচ্ছে, এই তো মুহুর্ত আগেই ঘটেছিল। যদিও মাঝে চলে গেছে নদীর স্রোতের মত চারটি বছর, পুরো আটচল্লিশ মাস আনন্দে ও উজ্জ্বল হাসিতে। ভাবেনি কখন ও এমনি করে উল্কা খসে পড়বে জীবনের সৌরমণ্ডল থেকে। আজ অজানায় সে গাড়ি চালাচ্ছে। লক্ষ্যহীন এই ফোর অহ-ওয়ানে
বোস্টন থেকে গাড়ি নিয়ে বেরুতে গিয়ে মনে হয়েছিল, আহা, গত ছয় বছরের সব স্মৃতি এখানে জমা রেখে যাচ্ছি এক গভীর প্রত্যয়ে। কোনদিন অবকাশ পেলেই ছুটে আসব এই স্মৃতির বেহালা বাজাতে। বেহালায় রাজীস্মিতার হাত দারুণ ভালো। কয়েকবার সে ইউনিভার্সিটিতে প্রতিযোগীতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মিউজিক তার মজ্জায় গাঁথা। রাজীস্মিতার বাবাও একজন পন্ডিতসম বেহালা বাদক ছিলেন। তবে নিভৃতচারী বলে তিনি তেমন খ্যাতি অর্জন করেননি। করতে চাননি। মেয়েকে শিখিয়েছেন সমস্ত যত্ন দিয়ে।
হাজার পরীক্ষার চাপেও রাজীস্মিতা কোনদিন বেহালাকে দূরে রাখেনি। অন্তরঙ্গ বন্ধু অন্যতম অনুভব তার বেহালা।
ম্যাসাসুসেটস টার্নপাইক থেকে বার্কশায়ার এক্সিট নিয়ে নিউইয়র্ক স্টেট থ্রু ওয়েতে উঠেই গানের ধারা বদলে দেয় সে। Michael Lucarelli এর ক্ল্যাসিক্যাল গীটারের সাথে Theresa Ellis ক্ল্যাসিক্যাল বেহালায় স্প্যানিশ রোমান্স শুনছে। গাড়ির স্টিয়ারিং সে হাত দিয়ে টুং টাং করছে। এই রাস্তায় সে কোনদিন গাড়ি চালায় নি। তবু মনে হচ্ছে যেন কত চেনা। সিরাত অনেকবার বলেছে, সে এসে নিয়ে যাবে তাকে বস্টন থেকে। না। রাজীস্মিতার আহলাদ, আমাকে তুমি চমক দিও পথের মাঝে। কখন? কোথায় ? কিভাবে? জানিনা। এমনকি এই যে সে আজ রওয়ানা হয়েছে কানাডার দিকে তাও সিরাতকে জানায় নাই। কিন্তু সেল ফোনে কথা হচ্ছে অনর্গল ব্লু টুথ দিয়ে। জি পি এস মিডিয়া।
সিরাত- সুইট হার্ট কবে আসবে?
রাজিস্মিতা- যে কোনদিন, তিনমাসের মধ্যে কানাডায় ঢুকে পড়লেই হলো।
সিরাত- কেন, বেবি? আই ক্যান’ট ওয়েট। আই মিস ইউ।
রাজীস্মিতা- মি ঠু; বাট অনেক কাজ গুছাতে হবে, বুঝতে পারছ তো, অনেকদিনের ঘর সংসার , একার, তাতে কি? গুছাতে হচ্ছে সবকিছু।
সিরাত- খালি ল্যান্ডিং পেপার নিয়ে তোমার আত্মাটা সাথে নিয়ে চলে আসো; পথে তোমাকে আমি হাইজ্যাক করব। কোথায়? কখন ? কিভাবে করব জানবে না।
রাজীস্মিতা- হাম। সে হাসে মনে মনে। তুমি জানো না । কখন আমি কানাডার বর্ডার পার হয়ে গাড়ি ভর্তি জিনিস নিয়ে তোমার আলয়ে হাজির হব।
সিরাত- হাই সুগার, তুমি জানো না যে আমি তোমার প্রতি মুহুর্তের খবর রাখি। আর রাজীস্মিতা জানে না যে তাকে পেছনের গাড়ি দূর থেকে ফলো করছে, এবং সিরাতকে সে অনর্গল কমেন্ট্রি দিচ্ছে।
সিরাত তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে বললো, তুই কিছুতেই ধরা পড়িস না। আর বর্ডার ক্রস করিস না। এইপারে আমি অপেক্ষা করব। কিন্তু বন্ধু সে কথা মানেনি। সে ঠিক ঠিক বর্ডার ক্রস করেছে। কারণ সে পুরো মজা থেকে বঞ্চিত হতে চায় না। অনেকদিনের পুরনো বন্ধু বলে কথা।
রাজীস্মিতা নিউইয়র্ক স্টেট থ্রু এর আরেক নাম হোল আই-নাইন্টি ওয়েস্ট। এই আই-নাইন্টি ওয়েস্ট একসময়ে আইওয়েস্ট নর্থ সেভেন এ রূপান্তরিত হয়ে যায়। সাথে তার গানের সুর বদলে যায়। এবার সে তার বিশাল কালেকশান থেকে বেচে নেয়, রিচার্ড জোন্স এর ভায়োলিন ও ফিল গ্রেগরী-এর টেট্রিস মিউজিক ইম্প্রোভাইজেশান-এ। এই সুর তাকে হালকা করে দেয়, উড়িয়ে দেয় নরম চুলের মত, আকাশে পেঁজা তুলার মত, কিংবা সাদা পালকের মত ধনাঢ্য বাতাসে। উড়তে উড়তে আই-এইটি-সেভেন নর্থ আবার সংঙ্গমে লিপ্ত হয় আই-নাইন্টি ওয়েস্ট এর সাথে। রাজীস্মিতা যেমন একাই চলছে আরেকজনের সাথে মিলিত হতে, কিন্তু আসলেই সে একা নয়, তেমনি এই আই-নাইন্টি ওয়েস্ট তার সাথে একশ যোগ করে নতুন নাম নেয়, আই-হান্ডড্রেড নাইনটি ওয়েস্ট। মনে হলো সিরাত এসে বসে পড়ে রাজীস্মিতার আগে। গন্তব্য এক অথচ ভিন্ন একটা সংখ্যা। পারসোনালিটি ভিন্ন। সত্যি তো জীবনের সংখ্যায় এখন তারা দু’জন দু’জনার । সাথে একদল স্বপ্ন। বাকী যা কিছু শুধু পথ চলার আনন্দ সুর। নবগান, উল্লাস।
সিরাত আর আই-হান্ড্রেড-নাইন্টি ওয়েস্ট রাজীস্মিতাকে নিয়ে আসে এক্সিট নাইন দিয়ে বের করে পিচ ব্রিজ বর্ডার ক্রসিং এ। ইমিগ্রেশান শেষ করেই এসে উঠে কুইন এলিজাবেথ ওয়েতে। বাহ! অনুভূতিটা এখন সত্যি রাণীর মত। এমনটা হবে ভাবে নি সে কোনদিন। শক্ত মনের মেয়ে। ভালোবাসায় বিশ্বাস আছে অগাধ ও নির্মল। তবে কারোর মনের রাণী হবে এমন তার মনের অবস্থা ছিলনা। সহজ এক বৃত্তে বড় হয়েছে বেহালার সাথে প্রেম করে। এই তার অভিজ্ঞতা পি এইচডি ডিগ্রী অর্জনের আগ পর্যন্ত। একসাথে দু’টো ডিগ্রী পেয়েছে। বন্ধুরা তাই বলে। সে হেসে উড়িয়ে দেয়। তবে ধরে রাখে সিরাতকে অন্তরের গভীরে প্রত্যয়ে ও পরম মমতায়। কিউ ই ডাবল ইউ তে প্রায় বিশ মাইল গাড়ি চালিয়ে সে এখন উঠছে হাইওয়ে ফোর টুয়েন্টিতে। চারশ বিশ। রাস্তার এমন নাম কি বাংলাদেশে দেবে? হাসতে হাসতে সে ভাবছে, আহা আজ সিরাতের দম বন্ধ হবে তাকে দেখে। ফোর টুয়েন্টি। চারশ বিশ। চমকে উঠবে ভুতের মত। সিরাত হয়ত তাকে কোলে নিয়ে নাচতেই ভুলে যাবে। যেমন করেছিল প্রথম দেখায়। বস্টন মাতিয়ে রেখেছিল সেই সন্ধ্যায়। এখানে প্রথম ট্রাফিক লাইটেই সে এসে ঢোকে স্টেনলি এভিন্যুতে , আর সাথে সাথে বিকট হঙ্কের শব্দে সে এলোমেলো হয়ে পড়ে। কয়েকটা গাড়ি তার গাড়ীকে সামনে ও পেছন থেকে ঘিরে ধরে। রাইট সিগন্যাল ইনডিকেটর দিয়ে তাকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে পাশের পার্কিং লটে যেতে। ডেয়ারি কুইন আইসক্রিম এর দোকান।
বলাই বাহুল্য, যে এই ডেয়ারি কুইন এর মালিক বর্তমান সময়ের বিলিয়নাদের অন্যতম একজন ওয়ারেন বাফার। রাজিস্মিতা হার মানার নয়; দিনে দুপুরে কানাডায় না ঢুকতেই তাকে স্কট করে হ্যাইজ্যাক করবে, এমনটা সে আশাই করতে পারেনি। তবু সে হাল ছেড়ে দেবে না। মনে মনে কুইন এলিজাবেথকে বলছে তুমি রাণী, আমি ও রানী। তোমার দেশে এসেই আমি বেমালুম হাইজ্যাক হয়ে যাব, সে হবার নয়। সে স্টেনলি এভিনিউয়ের চার লেনের রাইট লেনেই সে আছে। সামনে রেড সিগন্যাল। বাঁয়ে যাবার উপায় নেই। ডানেই মোড় নিয়ে তাকে পার্কিং লটে যেতে হবে। প্রুস্তুত হয়েই রইলো, এই ভর দুপুরে দেখি তারা কি করে আমাকে হাইজ্যাক করে। সে ডান দিকে মোড় নিয়েই সার্প আরেকটা রাইট টার্ণ করে, ডেয়ারি কুইনের এন্ট্রেনসের সামনেই গাড়ি পার্ক করে, নিজেকে প্রস্তুত করে। সবগুলো গাড়ি তাকে ঘিরেই পার্ক করলো। পেছনে একটা বড় সাদা লিমোজিন এসে আটকে দিলো তাকে।
পেছনে ব্যাক করার উপায় নাই। একদল ইয়ং ছেলে মেয়ে বের হয়ে আসলো ডেইরী কুইন থেকে হোই হৈ করতে করতে। তারাও অবাক হয়ে দেখছে, কি হচ্ছে। দরজা লক করে দিয়ে সে বসে আছে গাড়িতে। জোরে সে মিউজিক ছেড়ে দিয়েছে তার মনকে শক্ত করতে। ভায়োলিনের (বেহালা) সুর তাকে যে কোন পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে সাহায্য করেছে সারা জীবন; বিশ্বাস, আজো করবে। মুখে মাস্ক পরে এক লম্বা যুবক, কালো রঙের বস টক্সিডো পরে নেমে এসেছে লিমোজিন থেকে।
আজ রাজীস্মিতা পরেছিল সিরাতের প্রিয় নীল রঙের একটা শোল্ডারলেস মিডি। এই রঙ্গে রাজীকে দারুণ মানায়। মেসিস থেকে গতকালই সে মাত্র কিনেছে এই ড্রেস। সাথে সিলভার কালারের ড্রেস স্যান্ডেল। বর্ডার ক্রস করেই সে পা থেকে পাঙ্কি কেডস ও গা থেকে জিনস ও টি সার্ট খুলে, পরে নিয়েছিল নতুন পোশাক। কে জানতো এই পোশাক তাকে এমন বিপদে ফেলবে। কেডস থাকলে দুই চারটা কিক দেয়া যেত। আবার ভাবছে এই দিনে দুপুরে কি করে তারা সবার সামনে থেকে আমাকে হ্যাইজ্যাক করবে? দলবদ্ধ ইয়ং গ্রুপটি পার্কিং লটে আড্ডাবাজি করছে আর আড় চোখে খেয়াল রাখছে, বেগতিক দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে কেউ, কেউবা নাইন ওয়ান ওয়ান কল করবে এমন প্ল্যান। ওদের একজন এক্সিটের পাশে গাড়ি নিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করছে।
রাজীর হাসি পাচ্ছে টক্সিডো পরে কেউ হাইজ্যাক করতে আসে নাকি? আবার মুখে একটা হ্যালোইউন মাস্ক। দরজায় নক করলেই রাজীর বুকের ভেতর ভয়ের চেয়ে কেমন যেন এক আনন্দের ঢেউ উদ্বেলিত হতে থাকে। মন বলে খারাপ কিছু নয়। একি অভিনব কোন পদ্ধতি? সে এবার মনকে শক্ত করে দরজার লক খুলে দেয়। যুবকের হাতে কোন বন্দুক নেই, পিস্তল নেই। কিন্তু একটি হাত পেছিনে লুকানো। হোক তাতে কি? লক খুলতেই শাট করে দরজা খুলেই যুবক তাকে হ্যাঁচকা টানে বের করে নেয় গাড়ি থেকে, সোজা তুলে নেয় বুকের উপর। রাজীর কোন শক্তি নেই যেন তাকে বাধা দেয়। এই ধরায় এক চির চেনা আবেশ আছে, আছে মায়া, মমতা। যুবক তাকে বুকে চেপে ধরে হাগ দেয়। চুলের ভেতরে হাত চালিয়ে আদর করতেই থাকে, রাজির শরীর ক্রঃমশ নিস্তেজ হতে থাকে।
কয়েক সেকেন্ড রাজী দ্বিগুণ ত্যাজে ঝাপটা দিয়ে মাস্ক খুলে নেয় যুবকের মুখ থেকে। সি রা ত!!! আনন্দে কান্নায় রাজী সিরাতের চুল টানতে থাকে। বুকে মুখ লুকিয়ে আদর দিতে থাকে, নাক ঘসে সব আড়ষ্টতাকে বিতাড়িত করে। সিরাত তাকে কোলে করেই তাকে তুলে দেয় লিমোজিনে। সবাই শিশ বাজিয়ে তাকে অভিনন্দিত করে কানাডায়। সিরাতের হাতে তখন ওয়ান ক্যারেটের ডায়মন্ড রিং, কিছুক্ষণ আগেই সে পিপলস থেকে কিনে এনেছে। বন্ধুরা সবাই একে একে তাদের গিফটগুলো তুলে দেয় রাজির কোলে। রাজী সবাইকে হাগ দিতে থাকে। তারপর চিৎকার করে বলে সি ----র---র, আই ওয়ান আইসক্রিম।
সির জানে, রাজী আইসক্রিমের পাগল। যদি ও সে স্বাস্থ্য সচেতন। গত ছয় বছরে এক পাউন্ড ওজন বাড়তে দেয় নাই সে। সে পুরোদমে একটা মেনিক্যান কন্যা। গায়ের রঙ তেমনি উজ্জ্বল, আপেলের মত। উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। সিরাতের উচ্চতা হলো পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। স্ল্যান্ডার বডি। নিয়মিত ব্যায়াম করে। হাতে থোকা থোকা মাসল বানিয়েছে সে। বুকটাও বেশ চিতানো। পুরো হাত ও বুক ক্লিন শ্যাভেন। হাতে বুকে লোম সিরাতের একদম পছন্দ নয়। সে মেয়েদের মত ভ্রু প্লাগ করে নিয়মিত। ফ্যাশানে সে একদম ওয়েস্টার্ন কেতা দুরস্ত। রাজিও স্ট্রেস জিনস, লো কাট জিনস, টপস, মিনি স্কার্ট এই সবেই অভ্যস্ত। শাড়ি সে কোনদিন পরেনি। সালোয়ার কামিজে সে কোন ডিজাইন খুঁজে পায় না। নো কম্ফোর্ট এট অল।
রাজির গাড়িতে ড্রাইভিং সীটে বসে পড়লো ফোরম্যান, সিরাতের কানাডিয়ান বন্ধু। কেউ উঠলো লিমোজিনে, কেউ উঠলো রাজীর হাইব্রিড টয়োটাতে। সবাই মিলে এক বিরাট সমাবেশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে ডেয়ারি কুইন এর পার্কিং লট থেকে। ডান দিকে মোড় নিয়ে সোজা চলতে থাকে স্টেনলি এভিনিউতে। সেকেন্ড ট্রাফিক লাইটে লেফট টার্ণ করে তারা উঠে রবিনসন স্ট্রিটে। ফলসভিউ ব্যুলুবার্ড এ গিয়ে তারা সোজা ব্যালেট পার্কিং এর জন্য গাড়ি হোটেল শেরাটনের ফ্রন্ট ইয়ার্ডে রেখে চলে যায় প্যান্থহাউজে ফলস ভিউ রুমে। আজ ভিউ বদলে গেছে। পতন হয়েছে ভিউয়ের। সেই থেকে রাজিস্মিতা আজ এই অজানার পথে নতুন পথের সন্ধানে। সেদিনের টয়োটার বয়েস ছিল মাত্র একমাস। আজকের টয়োটার বয়েস হলো চার বছর একমাস।
পরদিন হোটেল থেকে বেরিয়ে সিরাত তার গাড়িতে, রাজী তার গাড়ি নিয়ে তাদের মিসিসাগার বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। কুইন এলিজাবেথ থেকে হ্যামিল্টন এসেই রাস্তা ভাগ হয়ে যায় হাইওয়ে ফোর ওহ থ্রিতে। হাইওয়ে ফোর ওহ থ্রিতে ধরে দু’জনের গাড়ি চলতে থাকে ইস্টের দিকে। পার হয়ে যায় বার্লিংটন, তারপর ওকভিল। মিসিসাগা আর বেশি দূরে নয়। কিন্তু হাইওয়ে ফোর ওহ থ্রি থেকে বেরিয়ে সিরাত সোজা উঠে যায় হাইওয়ে ফোর-ওহ-ওয়ানে।
রাজী ফলো করে , ভাবে, ও যাচ্ছে কোথায়? সিরাতের মাথায় সারাক্ষণ এডভ্যাঞ্চার ঘোরাঘুরি করে, অজানা নয় রাজির কাছে। হাইওয়ে ফোর-ওহ- ওয়ানে উঠেই সিরাতের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলা শুরু করে। সে সেকেন্ডে সেকেন্ডে লেন চেঞ্জ করছে। কখন ও অকারণে এক্সিট নিচ্ছে আবার উল্টো দিকে গিয়ে টার্ণ নিয়ে র‍্যাম্পে কসে থাপ্পড় লাগিয়ে মার্সেডিজ নিয়ে উঠে যাচ্ছে হাইওয়ে ফোর ওহ ওয়ানে। রাজী কি কম যায়? রাজীর বয়েস মাত্র ২৬ আর সিরাত তার থেকে দেড় বছরের বড়। রক্তে জোয়ানী টগবগ করে। এক্সিলেটর নিয়ে খেলতে এদের বয়েসের জুড়ি নেই। নতুন গাড়ি হলে তো কথাই নেই। সিরাতের গাড়ির বয়েস মাত্র ছয়মাস। এই হাইওয়ে ফোর ওহ ওয়ানে সর্বমোট পাঁচবার সে এক্সিট নিয়েছে এবং পাঁচবার সে ইউ টার্ণ করেছে। ছয়বারের সময় রাজীকে হারিয়ে ফেলে। ইস্লিংটন এসে রাজী তার জিপিএস এর মাত্রাতিরিক্ত ইউ আর ক্যাল্কুলেটিং এর রশি ধরে হাইওয়ে ফোর ওহ ওয়ানে ইস্টের থেকে ওয়েস্টে উঠে যায়। এবং ডিরেকশান ফলো করতে থাকে। এবার রাজির মাথায় শয়তানী বুদ্ধি। সে সিরাতের আগেই গিয়ে বাড়ি পৌঁছাবে। খুঁজুক সিরাত তাকে। সিরাত তার লেটেস্ট মডেলের গাড়ির ব্যাক ক্যামেরায় তাকিয়ে দেখে রাজী নেই পেছনে।
চিন্তিত হয়ে ব্লু টুথ এর সাহায্য নেয়। আই ফোন বলে দেয়, ডায়াল মেরি জান। ওদিক থেকে মিউজিক সিস্টেমে অপুর্ব একটা রিং টোন বাজে, সাথে ডায়ালগ মাই সুইট হার্ট, ইটস মি । রাজী হা হা করে হাসে আর জিজ্ঞেস করে কি করছ বেবি। তুমি কোথায়? তোমার অন্তরে। হার্টের মধ্যিখানে। হার্টের মধ্যিখানে জিপিএস লকেট করতে পারেনা। সেই রকম কোন কেরামতি এখনো কেউ আবিষ্কার করতে পারে নাই। কোথায় তুমি মাই সুগার।
সুগার তখন এক্সিট নিচ্ছে এরিন মিলসে। সিরাত এখন প্রায় ডন ভ্যালির কাছাকাছি। এই ডন ভ্যালির রোমাকন্টিকতা তাকে দুরন্ত করে তোলে। তার বাঁধ ভেঙ্গে দেয়। তার রন্দ্রে রন্দ্রে রক্ত টগবগ করে ফোটে। চুম্বনের আবেশে সে হারিয়ে যেতে চায় মেঘের ভেতর। এই মেঘ হবে আজ তার জান। জানতে চায় কোথায় সে এখন, উত্তরে শুধু খিলখিল হাসির কঙ্কন বাজে রিনিঝিনি।
সুগার তুমি কোথায়? ইউ টার্ণ এ। হাম। এই কাজ? আসছি আমিও। সুগার অপেক্ষা করতে থাকে। ডন ভ্যালি থেকে সিরাত এক্সিট নিতে যাচ্ছে ব্লোর স্ট্রীট এ। সেখানে সে র‍্যাম্প থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার ওঠে ডন ভ্যালি নর্থ এ। ৯০ কিলোমিটারের বেশী এক কিলোমিটার স্পীড বাড়তে পারে না। জিরো টলারেন্সে গাড়ি চলছে। ফোন বেজে ওঠে। ব্লু ঠুথ সত্যি এক বিশাল সহায়ক গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলতে। মিউজিক থেমে যায় ফোন কল আসলে।
বল। কলার আইডিতে পাভেলের নাম। পাভেল তার আর পাঁচজন বন্ধু সহ টরন্টো আসছিল রাজির সাথে দেখা করতে। দু’টো গাড়িতে তিনজন বন্ধু। । এক গাড়িতে স্বামী স্ত্রী ও আরেকজন ব্যাচেলর বন্ধু। তারা হাইওয়ে ফো-অহ-ওয়ানে উঠেই বিরাট এক ট্রাকের ধাক্কায় নিসপিস হয়ে গেছে। গাড়িতেই তিনজন অন দা স্পট চিরদিনের জন্য বিদায় নেয়। পাভেল এই খবর জানালো সিরাতকে। সিরাত আবার গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা ছুটছে ফোর -ওহ- ওয়ান ইস্টে। রাজী অপেক্ষা করছে বাসার সামনে। তার কাছে কোন চাবি নেই। রাজি আমি মন্ট্রিয়ালের দিকে যাচ্ছি। তানিম তার স্ত্রীসহ চিরদিনের জন্য চলে গেছে।
রাজী বললো, সিরাত আমার জন্য ওয়েট করো, আমিও আসছি। তাদের আর বাসর হলো না। তাদের আর ঘরে ঢোকা হলো না। রাজী তার গাড়ী একটা হোটেলের ব্যালেট পার্কিং এ রেখে সিরাতের গাড়ীতে উঠে পড়ে। গাড়িতে কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। নির্বাক দু’জনেই। পশ্চিমের সুর্য ক্রঃমশ হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার লাগছে। পেটে খিধা আছে কিনা কেউ জানেনা। অনুভূতি একদম ভোঁতা হয়ে গেছে। গাড়িতে কোন গান বাজছে না। রাজির ভেতর অগ্নিগিরির জ্বালামুখ থেকে উত্তপ্ত লাভা নির্গত হচ্ছে। কেবল তার সাথে দেখা করতে আসতে গিয়ে এই রকম আত্মদান? একি উপহার! আগের রাতে তানিম মহা উচ্ছ্বাসে রাজিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে, আজ সারা রাত আড্ডা হবে। নো ঘুম। নো একা থাকা। বস্টনের লাইফ ফিরে পেতে চেয়ে অনেক প্ল্যান এর কথা বলেছে রাজিকে। চোখ থেকে কোন জল ঝরছে না। মনে হচ্ছে চোখে নিঠুর পাথর তার স্থান করে নিয়েছে । সিরাত শুধু নিবিষ্ট মনে গাড়ি চালাচ্ছে। ফোর -ওহ -ওয়ান এ।
কিংস হাই ওয়ে ফোর -ও -ওয়ান আবার ম্যাকডোনাল্ড কার্টিয়ার ফ্রি ওয়ে নামেও আরেকটা পরিচিতি তৈরি করেছে। আবার আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হয় ফোর- ওহ-ওয়ান । উইন্ডসর থেকে শুরু করে মন্ট্রিয়াল পর্যন্ত এই হাই ওয়ে অন্টারিওর বুক চিরে এক ব্যাপক সংযোগ তৈরি করেছে। গানানক –ব্রকভিল সেকশানে বাই পাস করা হয়। যেখান থেকে তানিম বাইপাস করে চলে গেছে আরেক গ্রহে যার ঠিকানা আমাদের কারই জানা নেই। থাউজেন্ড আইল্যান্ড পার্কওয়েতে কত হাজার স্মৃতি তৈরি করেছে তানিম। তাই ভাবছে সিরাত । রাজি তো এতো চেনেনা। তাই তেমনি চুপচাপ বসে আছে।
পাভেল পুলিশ এম্বুলেন্স এদের সাথে চূড়ান্ত রকমের হেপার মধ্য দিয়ে গত কয়েক ঘন্টাকাটিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। স্বামী –স্ত্রী দু’জনেরই গলা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। গাড়ীর নৃশংস রকমের চুরমাচুর অবস্থা দেখে তারা দু’জনেই ভেতরে ছিন্নভিন্ন কিন্তু বাইরে ঠাটের উপরে দাঁড়িয়ে তারা সবাইকে ফোন করছে।
চার বছর পরে আজ রাজী এই ফোর-ওহ -ওয়ান এ বেরিয়ে এসেছে খালি হাতে। সব কিছু পেছনে ফেলে। সেদিন সে পিচ ব্রিজ দিয়ে কানাডায় প্রবেশ করে। আজ সে ব্রকভিল বাইপাস ধরে কোথায় বাই পাস নেবে কিছুই জানেনা। অনেক সখে গড়া স্বপ্নের সংসার, ইউনিভার্সিটির চাকুরী, ভালোবাসা ও সোসাইটি, বন্ধু, বন্ধুদের বাচ্চা ও গান সব ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে একশ বিশ কিলোমিটার গতিতে। সাথে আছে বাবার দেয়া অন্যতম বন্ধু, বেহালা। মনের ভেতর শিকে গাঁথা স্মৃতিগুলো কাবাবের গন্ধ ছড়াচ্ছে- গানানক এক্সিট পার হতে দিলোনা তাকে। হাতের ডান দিকে এক্সিট। তানিমকে দেখে যেতে হবে। একদিন এখানেই সমাপ্তি হয়েছিল তাদের। চরম লাকি। দুজন একসাথে। রাত কেতে গেছে সার্ভিস স্টেশানে। আকাশে ছিল তারা। বছরের শেষ দিন।
গাড়ি ছুটছে। এই জীবন থামার নয়। ৩১ ডিসেম্বর রাত থেমে থাকেনি। নতুন উদ্যমে চারিদিকে সুর্যের আলো ঘোষণা দিয়েছে চলতে চলতে নতুন পথ ঠিকানা খুঁজে দেবে কিনা জানা নেই- আছে শুধু অজানায় হারিয়ে যাবার এক বিস্তৃত ভাবনা। গাড়ির রেডিওতে বেজে ওঠে Said Dulevic er play—হ্যাপি নিউ ইয়ার দুই হাজার ১৩ এর চিত্তাকর্ষক বাজনা। স্পীড বাড়িয়ে দেয় রাজী-

টরন্টো, কানাডা, পৃথিবী
২৭ ডিসেম্বর, ২০১২