সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২

ছোটগল্প - মনোরঞ্জন রায় বর্মণ

শেষ নিঃশ্বাস
মনোরঞ্জন রায় বর্মণ


"ওরে বাবা রে,মরি গেইল রে!বাঁচাও রে!-অদ্ভুত চিৎকারে পাড়ার সবাই জড়ো হল।আমিও দৌড়ে গেলাম।আমাদের বাড়ি থেকে চার লাফে যাওয়ার পথ।গিয়ে দেখি জ্যাঠা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।বিছানায় শুয়ে মাথায় জল ঢালা হচ্ছে।জ্যাঠিমা তো মাথার চুল খুলে দিয়ে প্রাণপনে কান্না করছে,আর জল ঢালছে।আমিও জ্ঞান শূন্য ভাবে জল আনতে লাগলাম।কিছুক্ষন পর একটু বিশ্রাম লাম।জ্যাঠার ভাইয়ের বাড়ি পোয়া কিমি দূরে।জ্যাঠিমা আমাকে বলল-বাবা তুই গিয়ে ডাক্তারের ফোন নম্বরটা নিয়ে আয় না?ঠিক আছে বলে আমি ছুটে দৌড় দিলাম।গিয়ে ডাকাডাকি করে নম্বর নিয়ে এলাম।সঙ্গে মুনমুন দিদি আর বেনাম জ্যাঠা এল।তখন সবাই কান্না
করছিল।জ্যাঠার এই জ্ঞান হারা নিয়ে তিনবার হল।
#
জ্যাঠার দুই ছেলে।বড় ছেলে অমিত,কম্পিউটারের দোকান থাকায় প্রতিদিন রাতে দোকানে থাকে।তার বাড়ি আসার সময় শুধু সকাল আর বিকেল।আর ছোট ছেলে সুজিত,কলেজে পড়ে।একটা চাকরির পরিক্ষায় গেছে ব'ধমান।আরো দুই দিন বাকি আছে
ফেরার।মুনমুন দিদি অমিত দাদাকে ফোন করলো-অমিত দা রে তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়,তোর বাবা খুব অসুস্থ।অমিত বলল-তোরা দেখ আমি আছি। সে খুব ভীত।রাত এগারো হওয়ায় বাড়ি আসার সাহস পাচ্ছে না।
#
প্রায় আধ ঘন্টা পর ডাক্তার এল।কিছুক্ষন আগে জ্যাঠার জ্ঞান ফিরেছে।তাই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পারল। ডাক্তার বলল-কানু তুই ঔষধ কেন মাঝে মধ্যে বাদ দিস? জ্যাঠা বলল-দাদা কয়েক দিন থেকে সময় পাই না।দোকানের মাল করা,বাড়ির কাজ সামলানো সবে মিলে কত কাজ।একাই কত সামলাই। -তোকে বলেছিলাম না তোর ঐ পায়ের উপর বেশি চাপ দেওয়া যাবে না।
ঔষধ দিয়ে ডাক্তার বলল-শুয়ে থাকো ঠিক হবে।বেশী চিন্তা করিস না। কিন্তু কিছুক্ষন পর জ্যাঠার গা শীত করতে লাগল।জ্যাঠা জ্যাঠিমাকে বলল-অনি আমায় খুব শীত লাগছে।কিছু কাঁথা ও কম্বল দিয়ে গায়ে চাপা দেনা?জ্যাঠিমা বলল-শুয়ে থাকো আমি আনছি।তার পর শুয়ে ঘুম গেল।
#
নাম কামিনি কান্ত রায়,কানু বলে পরিচিত।জমিজমা থাকলেও অর্থের টানাটানি।পঁচিশ-তিরিশ বছর আগের ঘটনা।গরু পাড়া দেওয়ায় একটু পায়ের ছাল উঠে যায়।তার পর সেখানে একটু ঘাঁ।ধিরেধিরে সমস্যা বাড়তে লাগল।একদিন যেতে হল ভেলর। সেখানে ডাক্তার পা কাটার পরামর্শ দিলে রাজি হননি।শুধু অপারেশন করে বাড়ি ফেরে।কিন্তু তবুও সমস্যা সমাধান হয়নি।পায়ের সেই ঘাঁ থেকে প্রতিনিয়ত ব্যথা ও পুঁজ বেরতে থাকে। তাছাড়া দোকানের মাল করা হয় সাইকেলে।সেই পায়ের উপর চাপ পড়ায় রোগ সাড়ার কোন
লক্ষণ নেই।
#
বাড়িতে কেউ নেই।তাই আমাকে থাকতে হল পাশের ঘড়ে।সবে ঘুম ধরেছে।প্রায় রাত বারোটার পর আবার কান্না শুনতে পেলাম।জ্যাঠিমা আমাকে ডাক দিয়ে বলল-বাবা,তোর বাবা মাকে ডাকতো।দেখ তোর জ্যাঠা আবার জ্ঞান হারা হয়ে পড়েছে।আমি তাড়াতাড়ি তাই বিছানা ছেড়ে ডাক দিলাম।আবার বাড়িতে লোকের সমাগম ঘটল।আবার জল ঢালাঢালি।অবস্থা খারাপ দেখে হাসপাতালের ব্যবস্থা করার জন্য আমি আর আমার কাকা সাইকেল নিয়ে ছুটলাম গাড়ির খোঁজে।কিন্তু গাড়িওয়ালা সেদিন
মারুতি বাড়ি আনেনি।তাই হতাশ মুখে বাড়ি ফিরলাম।বাড়ি এসে অমিত দাদা কে জানা হল।তারপর সে গাড়ির ব্যবস্থা করলো।তখন রাত 'একটা'।গাড়ি এল,জ্যাঠার জ্ঞান না থাকায় ধরাধরি করে গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করা হল।আমিও তাতে অংশ গ্রহণ করলাম।সঙ্গে গেল জ্যাঠিমা,কাকা,বেনাম জ্যাঠা ও আর কয়েক জন।অমিত দাদাও মোটরসাইকেল নিয়ে গেল।অবশেষে আমি আর ঠাকুমা শুয়ে পড়লাম একলা বাড়িতে।কিন্তু কিছুক্ষন পর আবার ডাক পরল।অমিত দাদা আমাকে ডাক দিয়ে বলল- চল,গাড়িতে ওই।লাঙুলিয়ায় তার বোনের বাড়ি।সেখানে যেতে হবে।রাত অনেক হওয়ায় একাই যেতে সাহস পাচ্ছিল না। আমি গাড়িতে উঠে পড়লাম।গাড়ি চলতে লাগলো।চারি দিকে অন্ধকার। ঠান্ডা বাতাস আমার গায়ের প্রতিটি লোম কূপকে সজাগ করতে লাগলো।
#
মিনিট দশ পর বাড়িতে উপস্থিত হলাম।দাদা সেখানে আমাকে রেখে দিদির বর কে নিয়ে গেল।আমাকে বলে গেল-তুই এখানে থাক,ফেরার পথে তোকে নিয়ে যাবো।ঘড়ে গিয়ে দিদি আমার কাছে সব শুনতে পেয়ে কান্না করতে লাগল।তখন রাত আড়াই টা। তবুও কান্না শেষ হয়না।আমি বললাম-দিদি চল অনেক রাত হল!শুয়ে পড়,কিছু হবে না......
#
সকাল পাঁচটায় অ্যালারাম বেজে ওঠার পর ঘুম থেকে উঠলাম।দিদি তখন হাসপাতাল যাওয়ার জন্য বেরচ্ছিল।আমার সেলফোন থাকায় বলল-একটু ফোন করে দেখতো।বল আমি যাচ্ছি।আমি ফোন লাগার পর মোবাইল টা দিদিকে দিলাম।কিন্তু সেখান থেকে উওর এল তোকে হাসপাতালে আসতে হবেনা।আমরা এখনই বাড়ি যাচ্ছি।সেই কথা টা দিদির সন্দেহ হতে লাগলো।সে ফোনটা রাখার পর কান্না করতে লাগলো।বলতে লাগলো-বাবা বোধ হয় আর বেঁচে নেই!তারপর পাড়ার সবাই এসে হাজির হতে লাগলো। কারো চোখে তো জল এসে গেল।মাটিতে শুয়ে চুল ছড়িয়ে দিয়ে সে কি কান্না?আমি অবস্থা দেখে বুঝলাম এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।তাই বাড়িতে ফোন করে পাশের বাড়ির ছেলেকে পাঠাতে বললাম আমাকে আনার জন্য।
#
যখন বাড়ি ফিরলাম দেখলাম বাড়ির সামনে লোকের ভিড় জমে গেছে।প্রথমত আমি বুঝতে পারলাম নাকেন এত লোক?বাড়িতে এসে শুনতে পেলাম-কাকা বাড়ি এসেছে।জ্যাঠা নাকি মারা গেছে।ভোর চারয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।এই বাক্যটা আমাকে খুব আঘাত করল।যেন কোনো অন্ধকার ঘড়ে আমাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল।একটু দুঃখ অনুভব করলাম।যাকে কাল রাত্রে দোকান করতে দেখলাম,দোকানের ঝাপ নামিয়ে দিলাম।আজই নিঃশেষ হয়ে গেল।জ্যাঠা আমাকে খুব ভালোবাসতো।আমার সঙ্গে ঠাট্টাও করত।মনে হতে লাগলো আতিতের কিছু কথা।সেই দোকানে বসে কত মজার পুরনো গল্প।জ্যাঠার একাই পুকুর খুঁড়ে মাছ ছাড়ার নেশা।সব যেন ভেঙে চুরমার হতে লাগলো।
#
বডি পোস্টমাডাম হতে তিন ঘন্টা সময় লাগায় দেহ আসতে দেরি।নটার সময় একটা মারুতি এসে থামল।সবাই গেলাম।বডি বাদে সবাই ফেরত এসেছে।জ্যাঠিমা তো কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়লো।সব আত্মীয়স্বজন আসতে লাগলো।পাশাপাশি জ্যাঠার
ভাইয়ের ও আরো আত্মীয়স্বজন এসেছে।কান্নার একরাশ দুঃখ এক সকালে আমাদের গ্রামটা স্তব্ধ হয়ে গেল।বাড়ির চারপাশে গ্রামের সবাই উপস্থিত। সবাই কাঁদছে।কেউ শুকনো ভাবে,কেউ গঙ্গার সমান।কিন্তু আমি কাঁদলাম না।যদিও দুঃখ অনুভূতি কিছুটা আঘাত করেছে।জন্মে মরনে শেষ এটাই আমার মূল মন্ত্র।তবুও চারপাশের একটা বিকট কান্নার পরিবেশ তার সমসাময়িক করে তুললো
#
এদিকে আজ সুজিত দাদার পরিক্ষা।তাকে কালরাত্রে ফোনে জানানো হয়েছিল তার বাবা অসুস্থ।সেই অবধি সে সেটাই জানে।তাই বাড়ি থেকে সবাই সতর্ক তাকে যেন তাঁর বাবার মারা যাওয়ার খবর না দেওয়া হয়।সে যেন ভালো ভাবে পরিক্ষা দিয়ে আসে। তাই তাকে আবার জানানো হলো যে তার বাবা হাসপাতালে আছে।
#
বেলা এগারোটা নাগাদ বডি এল গাড়িতে।বাড়িতে তো গ্রামের লোক উপচে পড়তে লাগল।আমি একটু দুর থেকে দাড়িয়ে ভাবতে লাগলাম।কাল রাত্রের সেই গাড়িতে তোলার সময় ছোঁয়াই কি আমার জীবনে তোমার শেষ ছোঁয়া।কি সেই কারণ -যা কাল ছিল
আজ নেই?কেন এত বিধ্বংস যা জীবন কে দূরে ঠেলে দেয়?সবে মিলে যেনো কোথায় হারিয়ে গেলাম।চোখের তারায় একটাই ছবি-সেই অতীত আর ব'তমানের একটু পার্থক্য।তারপর বডি আঙিনায় নেওয়া হল।একে একে জ্যাঠার মেয়ে,দূর দুরান্ত আত্মীয়স্বজন আগমন ঘটল।কেউ কেউ দেহ ছুঁয়ে কান্না করতে লাগলো।কিছুক্ষন বাদে অমিত দাদার বন্ধুরা এসে জ্যাঠার শেষ ছবি তুলে নিয়ে গেল।
# মরা পোড়ার ব্যবস্থা চলতে লাগলো।কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা সমস্যা দেখা ।জ্যাঠার বড় দাদার ছেলে জয়ন্ত,সরকারি বাসের কন্ডেকটর। সে গেছে শিলিগুড়ি।সেও এসে জ্যাঠার শেষ দেখার দাবি করল।তাই সবাই অপেক্ষা করতে লাগলো।আমি তো সারাদিন উপোস রইলাম।সময় গুনতে গুনতে বেলা দুইটা বেজে গেল।তবুও তার কোনো পাত্তা নেই।কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে পড়ল।বলল মরার গন্ধ বের হচ্ছে।তাই সবাই জোগাড় করতে শুরু করলো।কেউ বলল বাড়ির পাশের জমিতে পোড়া হোক।কেউ বলল-শ্মশানে। কিন্তু সব শেষ শশানে পোড়ার পোড়ার সিদ্ধান্ত হল। কারণ জ্যাঠিমা খুব ভয় পান তাই।সবাই মরা নিয়ে শশানে পৌছালাম।প্রায় ঘন্টা খানেক পর জয়ন্ত দাদা এল।সে এসে গায়ে জরিয়ে কান্না করতে লাগল।অবশেষে দেহ ভস্মের পালা। মরা চিতায় তোলা হলো।জ্যাঠার বড় ছেলে হাতে আগুনের শলা নিয়ে চিতার চারপাশে ঘুরতে লাগলো।হঠাৎ একটা প্রচন্ড হাওয়া আগুনকে আরো বাড়িয়ে দিলো। ঠিক সেই সময় চেনা দেহটা হারানোর দুঃখে চোখ থেকে অশ্রু বিন্দু ঝড়ে পড়ল।