সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২

প্রবন্ধ - পল্লব ভট্টাচার্য

কেন্দ্র ও পরিধির ভূমিকা
পল্লব ভট্টাচার্য


‘না থাকায় আছি’, এরকম একটি কথা, সম্ভবত ১৯৯০-য়ে, কাকবন্ধ্যা কবিতাগুচ্ছে লেখা হয়েছিল। আজ এত বছর পরও, থাকা ও না থাকার সেই একই বিভ্রমে বিদ্ধস্ত হওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই। ভাবি, এই যে পশ্চিম ত্রিপুরার এক ছোট্ট গ্রামে, বেশ মহাশয় ভাবে আছি, অনেকেই চেনে, জানে এবং মানেও, তাতে, অনেকটা গর্বে মাটিতে পা পড়ে না গোছের ভাব ধরলে, মনে হয়, এই যে আমার থাকা, তা কি দিল্লির বাসিন্দা ডঃ কালাম জানেন? কিংবা, দক্ষিণ আমেরিকার কোনও এক কোণে রেড ইন্ডিয়ানদের যে মেয়েটি থাকে, আমি কি তাকে জানি? সেও কি পৃথিবীর ম্যাপ খুলে, কোনদিন খুঁজে পাবে, ত্রিপুরা নামক ভূখণ্ডের এই ছোট্ট গ্রামটিকে, যেখানে আমার থাকা? তাহলে ডঃ কালামের কাছে, আমার এই মহাশয় থাকাও কি, না থাকা হয়ে নেই? অথবা, রেড ইন্ডিয়ানদের সেই মেয়েটির কাছে, আমার এই ছোট্ট গ্রামটিও কি না থাকা হয়ে রইল না!

কিছুদিন আগে, খবরের কাগজ পড়ে জানা গেল, গত একবছরে, ‘হার্ট অফ বোর্ণিও’র গভীর অরণ্যে খুঁজে পাওয়া গেছে ৫২টি নতুন প্রজাতি। যাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে, এর আগে, আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। অর্থাৎ এরা মানুষের আধুনিকতায়, জ্ঞান সাম্রাজ্যে, এতদিন ‘না থাকা’ হয়েছিল। এই না থাকায় থাকার মধ্যে যে একটা বেদনা আছে, সম্ভবত, মানুষই তা অনুভব করতে পারে। পারে, কারণ তার মস্তিষ্কের গঠনে মাইক্রোকেফালিন নামের একটা জিনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আশ্চর্য এই যে, হোমোস্যাপিয়েন্স মাসুষ, সম্ভবত এই জিন নিয়ানডার্থালের কাছ থেকে অর্জন করেছিল ৩৭০০০ বছর আগে; আর, এই জিনের অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত হয়েই, তারা পৃথিবী থেকে লুপ্ত করে দিয়েছিল নিয়ানডার্থাল নামের সেই মাতৃপ্রকৃতিকে। তবে কি জিনের তন্তুজালেই লেখা রয়েছে প্রতিপত্তিপ্রবণতার গূঢ় সংকেত? মানুষ নামের একটি প্রজাতি কি ক্রমশ হয়ে উঠতে চাইছে মহাবিশ্বের কেন্দ্র? নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সমগ্র প্রকৃতিকে? যদি এভাবে ভাবা যায়, তবে হয়তো, বিবর্তনবাদী ‘যোগ্যতমের উর্ধতন’ ধারণার কাছে, নিজেদের সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি আমরা। কিন্তু, এই যে যোগ্যতম হিসাবে আবিস্কার করে, মানুষ, নিজেকে উচ্চতলের বাসিন্দা ভাবছে, আর, ‘মানবিকতা’ শব্দটিকে ঔদার্য ও মহত্বের একমাত্র মাপকাঠি করে তুলছে, তার আড়ালে কি লুকিয়ে রইল না, অন্য সমস্ত কিছুকে তুচ্ছার্থে অমানবিক ভাববার হীন ও কূট আত্মগরিমা!

পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতায় আত্মরক্ষা, আর আত্মরক্ষার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে সুনিশ্চিত করার তাড়না, যা ব্যক্তিমানুষকে যুথবদ্ধতায়, সমাজ সংগঠনে প্ররোচিত করেছে, সেই একই তাড়নায়, এই সংগঠনকে নিয়ন্ত্রিত করতে মানুষকে তৈরি করে নিতে হয়েছে প্রথা ও পদ্ধতির বন্ধন। হায়ারার্কি বা স্তর বিন্যাসে, ‘মানবিক’ এই প্রথা ও পদ্ধতির যে প্রয়োগ, তাতে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ জাতীয় মহত্ত্বকামী উদ্ধত বাক্যবন্ধটিও যে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারে না, এটা তো আমাদের জানা। ক্ষমতা আর ক্ষমতাহীনতায়, মানুষের সমাজ-শরীর, ইতিহাস, ভৌগলিকতাও খণ্ডিত হয়েছে অবজ্ঞায়-অস্বীকারে। প্রচলিত বিপরীতার্থক শব্দজোটগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে, আমরা দেখি, নেতা শব্দটি জনতার, রাজা শব্দটি প্রজার, শাসক শব্দটি শাসিতের, পুরুষ শব্দটি নারীর, বুদ্ধিজীবী শব্দটি শ্রমজীবীর পরিপূরক না হয়ে, বিপরীতার্থক হিসেবেই রচিত। আর এই বিপরীতার্থক শব্দজোটে, অর্থবোধকতায়; একটিতে অভিধেয়কে যে উচ্চতায় চিহ্নিত করা হয়েছে, অন্যটিতে ততটাই নিম্নতায় স্থাপন করা হয়।

ভাষা ,যেহেতু, বোধ ও বুদ্ধির চিহ্নায়ন, তাহলে, এইসব শব্দজোটের মধ্যে থেকে যাওয়া, আমাদের বোধ ও ধারণার ছাপ মিলিয়ে, যে কোন চিহ্নবিশারদ, খুব সহজে জানিয়ে দিতে পারে আমাদের মগজে বাসা বেঁধে থাকা মানুষ সম্পর্কিত ধারণার ধরন। আর এই ধরনটি অনেকটাই ক্ষমতালোভী ও ক্ষমতার মেসোয়েবিয়ানায় ব্যপ্ত, এটা জানা থাকে সত্ত্বোও, আমরা যে তা স্বীকার করি না, এটা হয়তো আমাদের সভ্যতার আবিস্কার। অথবা হতে পারে, যে ক্যামোফ্লেজ-প্রবণতা প্রজাপতির পাখায় চোখ এঁকে দেয়, এ তারই কোনও প্রাকৃতিক অবদান, আত্মরক্ষার্থে মূল প্রবণতাটিকে আড়াল করে রাখার!

এই যে, মানুষ সম্পর্কে মানুষের ধারণা, তাও তো আবার এক অভিমুখে চলছে না। একদিকে তাকে যখন জন (People) বলা হচ্ছে, তখন, তার মধ্যে আরোপ করা হচ্ছে নিম্নতলের ধারণা। প্রজা, নীচ, পামর, শ্রমজীবী, মজুর, এই যে কয়েকটি অর্থ আভিধানিকভাবে দেওয়া হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, সামাজিকভাবে এই শব্দটি নিম্নতলীয় এবং দমিত অর্থবোধক। আবার, এই প্রজা বা শ্রমজীবী মানুষের পরিবারে, মানুষটি যখন কর্তার ভূমিকায় তখন তার দমিত সত্ত্বাটি প্রকট নয়, প্রকট হয় প্রতিপত্তিপ্রবণ সত্ত্বাটি। তাহলে, ধারণার ক্ষেত্রে অবস্থানের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে যাচ্ছে। আর, যে কোনও অবস্থানকে দেখার জন্য, বুঝে নেওয়ার জন্য কাঠামোটির ধরন বুঝে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কেমন সেই কাঠামো? ভিত্তি থেকে সৌধ পর্যন্ত বহুতল বিশিষ্ট? মাটি থেকে মানুষ পর্যন্ত, জন থেকে নেতা পর্যন্ত, স্তরে স্তরে বিন্যস্ত? যদি তাই হয়, তবে, নিয়ন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রিত এই একটি ধারণাই অমোঘ হয়ে ওঠে। এত সহজে কি পৃথিবীর প্রতিটি সত্ত্বার অহং তৃপ্ত হতে পারে? হয়নি যে, হচ্ছে না যে, এর সাক্ষ্য জীবনের, ইতিহাসের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় লেখা আছে। তাই, একদিকে যখন নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে চেয়েছে, অন্যদিকে সে নিয়ন্ত্রিতও হয়েছে। এই যে প্যারাডক্স, নিয়ন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রিতের, তা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে, হয়তো বা সেই নিউট্রিনো কণাদের মতো বদলে ফেলছে নিজেদের চেহারা চরিত্র; আর তাই, আপাত দৃষ্টিতে যে কাঠামোটি স্থির মনে হচ্ছে, তা অজস্র পরিবর্তনশীল অবস্থানের প্রবাহমানতা হয়ে উঠতে পারে।

তবুও, ব্যক্তির অহং এই অবিচ্ছিন্ন প্রবাহমানতায় নয়, নিজেকে সময়াস্তরে কোন না কোন একটি নির্দিষ্ট অবস্থানেই হয়তো দেখতে চায়। এবং তৃপ্ত হতে চায় আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। এক্ষেত্রে, এমন একটা বৃত্তাকার কাঠামোর গড়ন কি মানুষের অবচেতনেও গড়ে ওঠে না, যার কেন্দ্রে সে একমাত্র নিজেকেই অনুভব করে? নিজেকে কেন্দ্র ভাবার এই কল্পনায়, চারপাশের সমস্ত কিছুই কি তার কাছে পরিধি হয়ে ওঠে না? নিজেকে সমস্ত কিছুর কেন্ত্র করে তুলবার এই যে ইচ্ছা, তা শুধু নেপোলিয়ান, হিটলার বা বুশের মধ্যেই রয়েছে, এমন তো নয়। হয়তো, এই ইচ্ছা মানুষের মস্তিষ্কে মস্তিষ্কে আদি ও অকৃত্রিম কোন জিনের অবদান।

প্রত্যেকেই যদি কেন্দ্র, তবে আলাদা করে এই কেন্দ্র কল্পনাকে আধিপত্যবাদী বা নিয়ন্ত্রক, বলে, ভাববার কোন কারণ থাকে না। ফলে, ১৯৮৬-তে দমদম অঞ্চলের এক দেয়ালে, কোন এক রাজনৈতিক দলের দেয়াললিখনে দেখা,- ‘কেন্দ্রের উপর দিয়ে দোষ. পার পাবে না অমুক বোস’ জাতীয় হুঁশিয়ারির পরও, কেন্দ্রকে অনেক দোষেই দায়ী করা হয়। হচ্ছেও। কারণ, ক্ষমতা নামক চাবির গোছাটি, তা সে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক. ভাষিক, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক বা লৈঙ্গিক, যাই হোক না কেন, যে বা যারা যত বেশি সংখ্যক আয়ত্ত করতে পেরেছে বা পারছে, তারাই ক্ষমতাকেন্দ্রটি গড়ে তুলছে। আর এই ক্ষমতাকেন্দ্রটি স্বভাবগতভাবেই প্রতিপত্তিহীন এবং তার ইচ্ছা ও রুচির বাইরের অন্য সমস্তকিছুকেই অবহেলায়, তাচ্ছিল্যে হীন ও কুরুচিকর হিসাবে সে প্রতিপন্ন করে, শুধুমাত্র ক্ষমতার জোরে। এই যে আধিপত্য বজায় রাখা, তা কি শুধু জর্জ বুশের ইরাক আক্রমণের মতো শক্তি প্রদর্শনেই থাকে, নাকি আরও মসৃণ কোনও প্রচারণায় সে অবিরত জানিয়ে চলে, জ্ঞান-বিজ্ঞান. সবকিছুতেই তার শ্রেষ্ঠতার কথা? প্ররোচিত করে., শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে কার মাপকাঠিটি ব্যবহার করার জন্য? এর বাইরের সমস্ত মাপকাঠিকেই বাতিল করে দেয়ার মতো মন তৈরি করাও কি এর স্বভাব নয়? যে ব্যবস্থা, পরিধিতে অবস্থানরত মানুষের মনকে, ধীরে ধীরে পরিণত করে স্বেচ্ছাসেবকে। সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব বা হেগেমনি সৃষ্টি কৌশল, পরিধির অহং যখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন, আপাত সহনশীলতার মুখোশে, সে কি সবাইকে আমন্ত্রণ জানায় না গ্লোবালিজশনের প্রস্তাবনায়? সে প্রস্তাবনা, পরিধিকে বাইরে রাখে না, কিন্তু পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সক্ষম কোনো সদস্য হিসাবেও স্বীকার করে না। শুধু একটা জায়গা রেখে দেয়, যাতে তার অবহেলিত হিসাবে প্রতিবাদেরও কোন সুযোগ থাকে না।

আমি বা আমার মতো যারা, সার্বিক সামাজিক ক্ষমতার কোনও কেন্দ্রেই নেই, অর্থাৎ ত্রিপুরা নামক এক আঞ্চলিক পরিধির বাসিন্দা হয়ে আছি, তাদের কাছে প্রায়ই একটা প্রশ্ন উঠে আসে, তোমার কি কখনো মনে হয়, যে, তুমি মূলস্রোতের বাইরে আছো? নিজেকে কি মনে হয় কলোনির জীব? ভাবি, যে অঞ্চলে আমি আছি, প্রায়ই তাকে প্রত্যন্ত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কেন তা প্রত্যন্ত হবে? অভিধান ঘেটে দেখা গেল, প্রত্যন্ত শব্দটির অর্থ, প্রান্তবর্তী, সীমান্ত সন্নিহিত, ম্লেচ্ছদেশ, প্রতি (প্রায়) অস্ত (শেষ) যেখানে তাহা। যদি প্রান্তবর্তী হয়, তবে একটা কেন্দ্রও নিশ্চয়ই থাকবে, যেখান থেকে প্রান্তের পরিমাপ করা হবে। প্রায় শেষ যেখানে তাও যদি হয়, তাহলেও তার একটা শুরু তো থাকবে। সেটা কোত্থেকে? এর সীমাই বা কতটুকু? রাজনৈতিক ভুগোলের দিক থেকে সীমান্ত সন্নিহিত কথাটার একটা অর্থ হয়তো দাঁড় করানো যায়, কিন্তু তাও রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিস্তারের সাথে সম্পর্কিত এবং পরিবর্তশীল বলেই নিত্য-সত্য নয়। আর ম্লেচ্ছ কথাটার মধ্যেই তো একটা অস্পৃশ্য দূরত্বের ভাব আরোপিত করা হয়ে গেছে বহুদিন। তাহলে, এই প্রত্যন্ততা বা প্রান্তিক ব্যাপারটা ঠিক কোথায় এসে দাঁড়ায়?

দাঁড়ায়, কেন্দ্র নামের একটা ধারণার উপর। যে ধারণা কোনও একটি বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র হিসাবে ধরে নিয়ে, তার থেতে দূরবর্তী অন্য একটি অঞ্চলকে প্রত্যন্ত হিসাবে চিহ্নত করে। যদিও কোনও কারণে আমি যে অঞ্চলে আছি সে অঞ্চলটিকে কেন্দ্র হিসাবে ধরা হয়, অর্থাৎ কেন্দ্রসুলভ সমস্ত ক্ষমতা ও সুবিধা অর্জিত, তবে দিল্লি কি আমার দৃষ্টিতে প্রত্যন্ত হয়ে উঠবে না? অবশ্য এই হয়ে ওঠার জন্য, ক্ষমতা ও সুবিধার যে শর্তগুলো থাকে, তা পূরণ করতে হয়। যতক্ষণ তা না হয়, ততক্ষণ এক বিরাট অঞ্চল প্রত্যন্ত হিসাবে চিহ্নিত হতে থাকে। আর সে অঞ্চলের মানুষেরা হয়ে ওঠে প্রান্তিক। অবশ্য, দিল্লি-কলকাতার দৃষ্টিতে, ত্রিপুরা যখন প্রত্যন্ত, তখন, এই প্রত্যন্ত ত্রিপুরায়, রাজধানী আগরতলার দৃষ্টিতে গণ্ডাছড়া প্রত্যন্ত অঞ্চল হয়ে থাকে। আবার গণ্ডাছড়া মহকুমা সদরের কাছে ভগীরথ গ্রামটি প্রত্যন্ত হিসাবে চিহ্নিত হতে থাকে। তাহলে প্রত্যন্ততা ব্যাপারটা কি আপেক্ষিক হয়ে যাচ্ছে না?

তিনটি গণ্ডগ্রাম নিয়ে, জোব চার্ণক যখন গড়ে তুলেছিলেন কলকাতা বাণিজ্যনগরী, তখনও কি তিনি জানতেন, এই তিনটি গ্রাম একদিন হয়ে উঠবে বাংলার কেন্দ্র! আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, বাংলায় লেখালিখি করার চেষ্টা করি, অথচ কলকাতা চৌহদ্দির বাইরে থাকতে হয়, তাদের কাছে ক্ষমতা ও সুযোগের নিরিখে কলকাতা বহুদিন থেকেই কেন্দ্র হয়ে আছে। এবং কেন্দ্রের স্বাভাবিক চরিত্র অনুযায়ী, কলকাতা যদি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিপ্রবণ এবং পরিধির বা প্রান্তিক বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রতি উদাসীন ও অবজ্ঞাপ্রবণ হয়, তবে কিছু কিছু অঞ্চলে আলাদা আত্মপরিচয়ের, স্বীকৃতির দাবি দেখা দিতেই পারে। বহুদিন পর্যন্ত কলকাতার বাংলা ভাষা, ভাষার স্ট্যান্ডার্ড ফর্মের মান্যতা পেয়ে আসছে, মান্যতা বা সম্ভ্রম আদায় করছে, এর পেছনে, বাংলার অন্য non-standard য়ের তুলনায় এই বিশেষ ফর্মটিও কোনও inherent aesthetic বা linguistic advantage তো নেই! ভাষাতিরিক্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে, আর্থ-সামাজিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারায়, ভাষার একটি বিশেষ form, অন্যান্য য়ের তুলনায় সম্ভ্রম আদায় করে নিচ্ছে, এটুকু লক্ষ্য করলে, মূলস্রোত বা মূলধারা বলে যাকে চিহ্নিত করা হয়, সেই স্রোত বা ধারাটি যে, তার অন্তর্গত বিশেষ কোনও গুণের জন্য মূল বা প্রধান হয়ে ওঠে না, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবুও আমাদের বাস্তবতা কেন্দ্র ও মূলস্রোত দুটোকেই ধারণ করে রেখেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই মূলস্রোত ব্যাপারটাকে মেনে নিয়ে, এর বাইরে থাকার জন্য, আমাদের কোন গ্লানি আছে কিনা। পরিধি চিহ্নিত অঞ্চলের মানুষের কোনও গ্লানি থাকে কিনা?

মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘বাঙাল দেখিলে আমরা ঠাট্টা করিতাম ও উৎপাত করিতাম’। অর্থাৎ, একই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেও, non-standard dialect ভাষী হওয়ার কারণে একদল অপমানিত হতেন। এবং হীনমন্যতায় আক্রান্ত হয়ে ভাবতেই পারেন,- ‘এত কর্যাও ক্কলকত্বার মত হবার পারলাম না, তবে এ পাপ দেহেতে আর কাজ কি, আমি জলে জাপ দিই’। সধবার একাদশীর রামমাণিক্য কি আজও নেই? আজ যখন শিক্ষাভাবনায় গোটাকতক centre of excellence তৈরির কথা ভাবা শুরু হয়ে গেছে, ইংরাজি ভাষা ও হিন্দিভাষা হয়ে উঠছে কলকাতার তথাকথিত শিক্ষিত ও বণিকমহলের ভাষা, অর্থাৎ ক্ষমতাকেন্দ্রের ভাষা, তখন standard dialect এর গর্বে গর্বিত বাঙালির এক অংশে কি আত্মপরিচয় মুছে যাওয়ার আতঙ্কে আতঙ্কিত হচ্ছেন না? খই ফোটা ইংরাজি বলতে না পারার হীনমন্যতায় নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কি ‘আন্টি নিকেতনে’ ছুটে যাচ্ছেন না? ভাবছেন না কি, জলে ঝাঁপ দিই? কিন্তু, অধিকাংশ মানুষের পক্ষে, ঝাঁপ দেওয়ার মতো জলও কি আর পাওয়া সম্ভব হবে. যখন জলও হয়ে উঠছে বিশ্ববাণিজ্যের পণ্য! খবরের কাগজ পড়ে জানা গেছে, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর মানুষেরা যে পরিমাণ জল ব্যবহার করতে পারে, এর চেয়ে প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মানুষেরা কয়েকগুণ বেশি পরিমাণ জল ব্যবহার করে। অথচ, মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষই তো থাকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। এই যে প্রকৃতির একটি সাধারণ উপাদান থেকেও অধিকাংশ মানুষকে বঞ্চিত রেখে, কিছু সংখ্যক মানুষ নির্বিচারে ভোগ করছে, আর ভোগ করতে করতে গড়ে তুলছে, এক ‘মানবিক’ সংস্কৃতি, যা মূলত বঞ্চনার তাতে কি বঞ্চিত মানুষেরা হয়ে উঠছে না -ভাষাহীন? কৃতিহীন, অক্রিয়?

Culture শব্দটির পরিভাষা হিসাবে, যোগেশচন্দ্র বিধ্যানিধির ‘কৃষ্টি’ শব্দটি বাতিল করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ‘সংষ্কৃত ভাষায় উৎকর্ষ প্রকর্ষ শব্দের ধাতুগত অর্থে চাষের ভাব আছে কিন্তু ব্যবহার সে অর্থে কেটে গেছে। কৃষ্টিতে কাটেনি।‘ তাই ঐতরেয় আরণ্যকের ‘আত্মসংস্কৃতর্বাব শিল্পানি’ বা ‘ছন্দোময়ং বা ঐতের্যজমান আত্মানং সংস্কুরুতে’ বাক্যগুলোর অনুসরণে, রবীন্দ্রনাথ, সংস্কৃতি শব্দটি বেছে নিয়েছিলেন Culture য়ের পরিভাষা হিসাবে। এই বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়ে, সংস্কৃতির যে ধারণা বা ভাববলয় গড়ে উঠলো, তা দীর্ঘকালীন সংস্কৃতিভাবনার অসংখ্য সম্ভাবনাকে খণ্ডিত ও সীমায়িত করে, এক মুষ্টিমেয় মানবগোষ্ঠিকে এর আওতাভুক্ত করলো, যারা Cultured, আর এর বাইরে থেকে গেল তথাকথিত ‘অমার্জিত’, ‘অসংস্কৃত’, ‘শিল্পহীন’ বৃহত্তর এক মানবগোষ্ঠী। যাদের একটি অংশের জীবনযাত্রা ও সৃষ্টিমূলক প্রয়াস সম্পর্কে একটি মহৎ গ্রন্থের নামও, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে রাখতে হয়, -‘কিরাতজনকতি’। সংস্কৃতি নয়।

তবে কি সংস্কৃতি শুধু সভ্যতায়? যে সভ্যতা বা Civilisation গড়ে উঠেছিল Civis বা নগরকে কেন্দ্র করে? মদিনা বা নাগরিক জীবনযাত্রাই তমুদ্দূন বা সভ্যতা? যদি তাই হয়, তবে, গুটিকয় নগরের বাইরে থেকে যাচ্ছে অসংখ্য সভ্যতাহীন মানুষের গ্রাম। যার কোনও ‘সংস্কৃতি’ নেই। কেন্দ্রের অস্বীকারে এক ভাষাহীন নৈঃশব্দ নিয়ে এইসব গ্রাম বা পরিধি আছে, না-থাকায়। তৈরি হয়েছে এমন এক অস্বীকারের দূরত্ব, যাতে দাঁড়িয়ে, দুই স্তরের মধ্যে কথা চালাচালি আজ প্রায় অসম্ভব। এখন পরিধি শুধু হয়ে উঠতে পারে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতির Content ও Consumer। ফিল্ম নামক আগ্রাসী আধুনিক সংস্কৃতি মাধ্যমের কাছে অধিকাংশ মানুষের ভূমিকা কি এর চেয়ে বেশি কিছু?

এই যে ভূমিকাহীন মানুষ, যাদের উপর একদিকে চলে দমনমূলক কাজকর্ম, অন্যদিকে কেন্দ্রের চিন্তাভাবনা আচরণ তাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে, এক ধরণের আনুগত্যই তো আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা চলেছে। যেমন অন্য প্রজাতির উপর, প্রকৃতির উপর, মানুষ প্রজাতিটি করে চলেছে, নিজের আধিপত্য চারিয়ে দেওয়ার জন্য; তেমনি, নিজের প্রজাতির অন্য একটি লিঙ্গের উপর আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ রাখতে, পুরুষ মানুষও কি স্ত্রী-মানুষদের না-মানুষ করে রাখতে চায় নি?

কিন্তু কোনও সত্ত্বাই তো অমর্যাদায় থাকতে চায় না। সে ফিরে পেতে চায় মর্যাদা। আত্মপরিচয়। তাই, নিজের মর্যাদা আদায় করে নিতে, অন্য অনেক পরিধির মতোই, স্ত্রী-মানুষ খানিকটা উগ্রতায়, তার জন্য সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ, পুরুষের আচরণ, পোষাক, নৈতিকতাকে আয়ত্ত করে, নিজেকে কেন্দ্রের সমকক্ষ করে তুলতে চেয়েছিল। যেভাবে, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ভারতের আদি বাসিন্দারা, প্রথম পর্যায়ে, তাদের নব্য ইংরাজ প্রভুদের ভাষক, আচার, আচরণ, পোশাক সমস্ত কিছুই নকল করে, তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে চেয়েছিল, চেয়ে তাদের ক্যারিকেচার হয়ে উঠেছিল, তেমনি স্ত্রী-মানুষও নিয়ন্ত্রকের সমকক্ষ হয়ে উঠতে চেয়ে নিজের আত্মপরিচয়ের যে সংকট ঘনিয়ে তুলেছিল, তা থেকেই তারাও উপলব্ধি করতে পেরেছে, পরিধি অঞ্চলের বিশাল ব্যাপ্তি ও তার নিজস্ব চরিত্র। যদি বলা যায়, শাসিত নিয়ন্ত্রিত, তবে পরিধি অঞ্চলটিতে চলে আসে, নদী সমুদ্র, বন, বায়ু থেকে শুরু করে মানুষ ব্যতিরেকে বিভিন্ন প্রজাতি, আর মানুষের মধ্যেও যখন এই পরিধি অঞ্চলটিকে দেখা যায়, তখন কালো মানুষ, গ্রামীণ মানুষ, শোষিত মেহনতি দরিদ্র জনতা, বিভিন্ন দলিত জনগোষ্ঠি, অশিক্ষিত মানুষ, আর স্ত্রী-মানুষ চলে আসে এর আওতায়।

দীর্ঘকালীন অমার্যাদা ও অবমূল্যায়নের মাঝে, বহুস্তরে থেকে যাওয়া, অসংখ্য পরিধি অঞ্চল আর কেন্দ্র নিয়ে গড়ে ওঠা এই কাঠামোকে, শ্রেণীরেখায় ভাগ করে নেয়ার সরল জ্যামিতি যেমন আজ আর সম্ভব নয়, তেমনি শ্রেণীরেখাহীন কোনও উপপাদ্যেও প্রমাণ করা যাবে না এই জটিলতার স্বরূপ। প্রতিটি বৃত্তের মধ্যে, আরও অসংখ্য বৃত্ত পরস্পর মিলে মিশে গড়ে তুলেছে এই কাঠামো। সংখ্যাহীন কেন্দ্র আর অসংখ্য পরিধি থেকে গেছে এর ভেতরে। নিয়ন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রিত, কেন্দ্র ও পরিধির মধ্যে স্থানচ্যুতিও ঘটে গেছে অনবরত। এই স্থানচ্যুতি কি আমাদের ভেতরেও চলছে না? আমার ভেতরেও কি রয়ে যায় না যুক্তিশাসিত আবেগের অঞ্চল! যুক্তি কি কেন্দ্র হয়ে উঠতে চায় না আবেগ পরিধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে? সেই যে ২২ জোড়া জিন, তাদের xy ক্রোমোজোম নিয়ে কি আমার এই শরীরের ভেতরেই পুরুষত্ব ও স্ত্রীত্ব নিয়ন্ত্রণ করছে না? আমার পুরুষ আধিপত্য কী আমার প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে না! আর আমার প্রকৃতিও কী হয়ে উঠতে চাইছে না আর বেশি প্রাকৃতিক! কেন্দ্রের থাকা আর প্রকৃতির না-থাকা নিয়েই তো আমার অস্তিত্ব এক বিপুল অনিশ্চয়তার দিকে বয়ে চলেছে, যেখানে আছি আর নেই দুটোই এক। কখনো দেখা যাবে আছি, কখনো নেই। কখনো কেন্দ্র, কখনো পরিধি। মনে হয়, অসংখ্য তরঙ্গ ও কণার এক একটি বিন্দু, একদিন সেই সরলতায় ফিরে যাবে, যার প্রতিটি ঘূর্ণনে উচ্চারিত হবে, - ‘সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু, অব্যাপজ্‌ঝা হোন্তু, সুখি অত্তানং পরিহরন্তু। সব্বে সত্তা দুখ্‌খাপমুঞ্চন্তু।‘ ততদিন, না-থাকায় আছি