সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২

ভালোবাসি বাংলা - সম্পাদনা উষসী

বাংলা সাহিত্যের কথা
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য


(প্রথম পর্ব)

আজকাল যে বাংলা সাহিত্য আমরা পড়ি,তার আরম্ভ কি করে হয়েছিল এ ব্যাপারে যথেষ্ট কৌতুহল থাকা স্বাভাবিক। গদ্য না পদ্য, কি ভাবে লেখা হত এই সাহিত্য? কিরকম ছিল সেই ভাষা? আসুন, দেখা যাক কি ভাবে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা!
যতদূর জানা যায়,আনুমানিক খ্রীষ্টীয় নবম শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় (মাগধী এবং প্রাকৃতের বাতাবরণে সংস্কৃতভাষার গর্ভে বাংলাভাষার জন্ম।) সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। খ্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোঁহা-সংকলন চর্যাপদ, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন।
অনেকেরই ধন্দ ছিল, চর্যাপদ আদৌ বাংলা ভাষায় রচিত কিনা!
প্রাচীন বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলির সন্ধানে প্রাকৃত বাংলায় রচিত চর্যাপদ একটি মূল্যবান উপাদান। ১৯২৬ সালে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রথম এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন, তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে। এরপর ডক্টর সুকুমার সেন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, পরেশচন্দ্র মজুমদার ও ডক্টর রামেশ্বর শহ, চর্যার ভাষাতত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন। ফলে আজ চর্যার ভাষার স্বরূপটি অনেক বেশি সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।
চর্যা পদসংগ্রহ প্রকাশিত হবার পর চর্যার ভাষা নিয়ে যেমন প্রচুর গবেষণা হয়েছে, তেমনি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্বজ্জনেরা এই ভাষার উপর নিজ নিজ মাতৃভাষার অধিকার দাবি করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত হাজার বছরের পুরান বাঙ্গলা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকার্ণব-কে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভও তাঁর দাবিকে সমর্থন করেন। ১৯২০ সালে বিজয়চন্দ্র মজুমদার তাঁদের দাবি অস্বীকার করে চর্যা ও অন্যান্য কবিতাগুলির সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্বন্ধের দাবি নস্যাৎ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯২৬ সালে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর সেই, The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিশ্লেষণ করে শুধুমাত্র এইগুলিকেই প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্যারিস থেকে প্রকাশিত Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মত গ্রহণ করেন।
যে সকল ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য চর্যার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ককে প্রমাণ করে সেগুলি হল সম্বন্ধ পদে –অর বিভক্তি, সম্প্রদানে –কে, সম্প্রদানবাচক অনুসর্গ –অন্তরে (মধ্যযুগীয় ও আধুনিক রূপ –তরে), অধিকরণে –অন্ত, -ত, অধিকরণবাচক অনুসর্গ –মাঝে, অতীত ক্রিয়ায় –ইল এবং ভবিষ্যত ক্রিয়ায় -ইব। চর্যা মৈথিলী বা পূরবীয়া হিন্দিতে রচিত হলে অতীত ক্রিয়ায় –অল ও ভবিষ্যতে –অব যুক্ত হত।
• গুনিয়া, লেহঁ, দিল, ভণিআঁ, সড়ি, পড়িআঁ, উঠি গেল, আখি বুজিঅ, ধরণ ন জাঅ, কহন না জাই, পার করেই, নিদ গেলা, আপনা মাংসে হরিণা বৈরী, হাড়ীত ভাত নাহি ইত্যাদি বাগভঙ্গিমা ও শব্দযোজনা বাংলা ভাষায় পরবর্তীকালেও সুলভ। এর সঙ্গে অবশ্য তসু, জৈসন, জিস, কাঁহি, পুছমি প্রভৃতি পশ্চিমা অপভ্রংশের শব্দও আছে। তবে সেগুলি মূলত কৃতঋণ বা অতিথি ( Loan words) শব্দ হিসাবেই চর্যায় ব্যবহৃত হয়েছে।
• এছাড়া সম্প্রদানে –ক এবং –সাথ, -লাগ, -লগ-এর বদলে সঙ্গে, সম অনুসর্গের ব্যবহার এবং নাসিক্যধ্বনির বাহুল্যের জন্য চর্যার ভাষাকে রাঢ় অঞ্চলের ভাষা বলে মনে করা হয়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “চর্যার আচার্যেরা কামরূপ, সোমপুরী, বিক্রমপুর – যেখান থেকেই আসুন না কেন, আশ্চর্যের বিষয়, এঁরা সকলেই রাঢ় অঞ্চলের ভাষানীতি গ্রহণ করেছিলেন।”
• রাহুল সাংকৃত্যায়ন বা অন্যান্য ভাষার বিদ্বজ্জনেরা যাঁরা চর্যাকে নিজ নিজ ভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলে দাবি করেছিলেন, তাঁরা এই রকম সুস্পষ্ট ও সুসংহত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দ্বারা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হননি।
• চর্যার প্রধান কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।লেখকেরা রাঢ় অঞ্চলের ভাষানীতি গ্রহণ করেছিলেন। সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু কেন?
তাহলে, রাঢ় অঞ্চল সম্বন্ধে একটু লেখা যাক। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগে বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত একটি বিস্তৃত সমভূমি অঞ্চলের নাম ছিল/আছে রাঢ়। এর সীমানা পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভূমির প্রান্তভাগ থেকে পূর্বে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চল ঈষৎ ঢেউ খেলানো ও এর ঢাল পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে।
‘রাঢ়’ শব্দটি এসেছে সাঁওতালি ভাষার ‘রাঢ়ো’ শব্দটি থেকে, যার অর্থ ‘পাথুরে জমি’। অন্যমতে, গঙ্গারিডাই রাজ্যের নাম থেকে এই শব্দটি উৎপন্ন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম প্রধান অবদানকারী।
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যেও রাঢ়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।মহাভারতে সুহ্ম ও তাম্রলিপ্তকে পৃথক করে দেখা হলেও গুপ্ত শাসনে রচিত দণ্ডীর ‘দশকুমারচরিত’-এ বলা হয়েছে ‘সুহ্মেষু দামলিপ্তাহ্বয়স্য নগরস্য’। অর্থাৎ দামলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) সুহ্মেরই একটি নগর ছিল। ধোয়ীর পবনদূত কাব্যে রাঢ় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে –
গঙ্গাবীচিপ্লুত পরিসরঃ সৌধমালাবতংসো
বাস্যতুচ্চৈ স্তুয়ি রসময়ো বিস্ময়ং সুহ্ম দেশঃ।

অর্থাৎ, ‘যে-দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গঙ্গাপ্রবাহের দ্বারা প্লাবিত হয়, যে দেশ সৌধশ্রেণীর দ্বারা অলংকৃত, সেই রহস্যময় সুহ্মদেশ তোমার মনে বিশেষ বিষ্ময় এনে দেবে।’ পরবর্তীকালে রচিত ‘দিগ্বিজয়-প্রকাশ’-এ বলা হয়েছে –
গৌড়স্য পশ্চিমে ভাবে বীরদেশস্য পূর্বতঃ।
দামোদরোত্তরে ভাগে সুহ্মদেশঃ প্রকীর্তিতঃ।
অর্থাৎ, গৌড়ের পশ্চিমে, বীরদেশের (বীরভূম) পূর্বে, দামোদরের উত্তরে অবস্থিত প্রদেশই সুহ্ম নামে খ্যাত। এই সকল বর্ণনার প্রেক্ষিতে বর্তমান হুগলি জেলাকেই প্রাচীন রাঢ়ের কেন্দ্রস্থল বলে অনুমান করা হয় এবং এর সীমানা বীরভূম থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান।

চৈতন্যচরিতামৃতের বর্ণনা অনুসারে, রাঢ়ের জঙ্গলাকীর্ণ পথে চৈতন্যদেব কাশীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কবির বর্ণনায় রাঢ়ের অরণ্যভূমির একটি কাল্পনিক বর্ণনা পাওয়া যায়, যা বাংলা সাহিত্যে একটি অন্যতম উজ্জ্বল কবিকল্পনা –

প্রসিদ্ধ পথ ছাড়ি প্রভু উপপথে চলিলা।
কটক ডাহিনে করি বনে প্রবাশিলা।।
নির্জন বনে চলেন প্রভু কৃষ্ণ নাম লৈয়া।
হস্তী ব্যাঘ্র পথ ছাড়ে প্রভুকে দেখিয়া।
পালে পালে ব্যাঘ্র হস্তী গণ্ডার শূকরগণ।
তার মধ্যে আবেশে প্রভু করেন গমন।।
ময়ূরাদি পক্ষিগণ প্রভুকে দেখিয়া।
সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ বলে নাচে মত্ত হৈয়া।।
হরিবোল বলি প্রভু করে উচ্চধ্বনি।
বৃক্ষলতা প্রফুলিত সেই ধ্বনি শুনি।।
ঝারিখণ্ডে স্থাবর জঙ্গম আছে যত।
কৃষ্ণনাম দিয়া কৈল প্রেমেতে উন্মত্ত।।
যাই হোক, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য।মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্তপদাবলী,বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, পীরসাহিত্য, নাথসাহিত্য, বাউল পদাবলী এবং ইসলামি ধর্মসাহিত্য ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়।
বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস প্রধানত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত:
• আদিযুগ বা প্রাচীন যুগ (আনুমানিক ৯০০ খ্রী.–১২০০ খ্রী.)
• মধ্যযুগ (১২০০ খ্রী.– ১৮০০ খ্রী.)
• আধুনিক যুগ (১৮০০ খ্রী. – বর্তমান কাল)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজনৈতিক ইতিহাসের মতো নির্দিষ্ট সালতারিখ অনুযায়ী সাহিত্যের ইতিহাসের যুগ বিভাজন করা সম্ভব নয়। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সালতারিখের হিসেব অগ্রাহ্য করে না। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্টে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে।
যেমন ধরুন:- এই লেখাটি এক শিলালিপিতে পাওয়া:-
শুতনুকা নম দেবদশিক্যী
তং কময়িথ বলনশেয়ে
দেবদিনে নম লূপদখে
এর অর্থ:- সুতনুকা নামে( নম) এক দেবদাসী(দেবদশিক্যী), তাকে(তং)কামনা করেছিল(কময়িথ) বারাণসীর(বলনশেয়ে)দেবদিন নামের এক রূপদক্ষ(লূপদখে), মানে ভাস্কর।

এটা কবে লেখা হয়েছিল, এখনও গবেষণার বিষয়বস্তু। তবে এটা যে আদিযুগ বা প্রাচীন যুগে লেখা হয়েছিল, মনে হয় এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের পূর্বে বাংলায় সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অবহট্ট ভাষায় সাহিত্য রচনার রীতি প্রচলিত ছিল। এই সাহিত্যের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায়ের সূচনা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণের বহু আগেই বাঙালিরা একটি বিশেষ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উন্মেষ ঘটে বাংলা ভাষারও। তবে প্রথম দিকে বাংলায় আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেনি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা অভিনন্দ ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন, উমাপতি ধরের কাব্যকবিতা, জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় ও সদুক্তিকর্ণামৃত নামক দুটি সংস্কৃত শ্লোকসংগ্রহ; এবং অবহট্ট ভাষায় রচিত কবিতা সংকলন প্রাকৃত-পৈঙ্গল বাঙালির সাহিত্য রচনার আদি নিদর্শন। এই সব বই বাংলা ভাষায় রচিত না হলেও সমকালীন বাঙালি সমাজ ও মননের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীকালের বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যে গীতগোবিন্দম কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।
আগেই বলেছি,বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। খ্রিস্টিয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত চর্যা পদাবলী ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কয়েকটি পদ কালজয়ী।

শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন, বড়ুচণ্ডীদাস নামক জনৈক মধ্যযুগীয় কবি রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক একটি আখ্যানকাব্য। ১৯০৯ সালে বসন্ত রঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রাম থেকে এই কাব্যের একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে তাঁরই সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে পুঁথিটি প্রকাশিত হয়। যদিও কারও কারও মতে মূল গ্রন্থটির নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ। কৃষ্ণের জন্ম, বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং অন্তে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ – এই হল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল উপজীব্য। আখ্যানভাগ মোট এগারোটি খণ্ডে বিভক্ত। পুঁথিটি খণ্ডিত বলে কাব্যরচনার তারিখ জানা যায় না। তবে কাব্যটি আখ্যানধর্মী ও সংলাপের আকারে রচিত বলে প্রাচীন বাংলা নাটকের একটি আভাস মেলে এই কাব্যে। গ্রন্থটি স্থানে স্থানে আদিরসে জারিত ও গ্রাম্য অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও আখ্যানভাগের বর্ণনানৈপূণ্য ও চরিত্রচিত্রণে মুন্সিয়ানা আধুনিক পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চর্যাপদের পর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীনতম আবিষ্কৃত নিদর্শন। বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। অপরদিকে এটিই প্রথম বাংলায় রচিত কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য। মনে করা হয়, এই গ্রন্থের পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর পথ সুগম হয়।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর, ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী, বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্বের আদায়ের ভার পেয়ে গেল।ফলে, কয়েক বছরের মধ্যেই কোম্পানী; দেশের রাজশক্তি,একেবারে কুক্ষীগত করে ফেলে।“বণিকের মানদণ্ড পরিণত হলো রাজদণ্ডে”। পরবর্তী কালের নিরীখে, সূচনা হলো এক নতুন যুগের। এ সময়ের কিছু আগে থেকেই, বাংলায় গদ্য রচনা আরম্ভ হয়ে গেছিল। শুধু, খ্রীষ্টান মিশনারীরা নয়; ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাও এ বিষয়ে যত্নবান হয়েছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য, স্মৃতি ও ন্যায় শাস্ত্রের কয়েকটি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদের কাজ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই শুরু হয়েছিল।বৈদ্য চিকিৎসকরাও, কয়েকটি কবিরাজী বই, বাংলা গদ্যে লিখেছিলেন। তেতো লাগলেও, এটা মেনে নিতে লজ্জা নেই যে ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অভ্যুদয় না ঘটলে; এ প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসু হতো, তা গবেষনার বিষয়বস্তু।কারণ,ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত নমুনা হলেও; বাংলা গদ্য সাহিত্য এই সাম্রাজ্যবাদের কাছেই ঋণী।ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী, রাজ্যভার পেয়েই, দেশে আইনকানুন প্রণয়ণ করতে লাগল। সবটাই অবশ্য নিজেদের সুবিধের জন্য। চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজের বাইরে, এটাই হলো বাংলা গদ্য ভাষার প্রথম কার্য্যকর ও ব্যাপক ব্যাবহার।
তারপর, বাঙ্গালিকে, ইংরেজী আর ইংরেজকে বাংলা শেখাবার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে, ব্যাকরণ আর অভিধান রচনা করা হতে লাগল। এ পর্যন্ত, হাতে লেখা বইয়ের ব্যাবহার ছিল। প্রচুর নকলনবীশ ছিলেন, যাঁরা এই বই গুলো হাতে নকল করে লিখতেন। কিন্তু, এগুলো ছিল, সময় ও ব্যায়সাপেক্ষ। তাই, ছাপার যন্ত্র আর বাংলা টাইপের প্রয়োজন অনিবার্য্য হয়ে উঠল।
বাংলা টাইপের সর্বপ্রথম ছেনী কাটেন একজন ইংরেজ।ইনি ছিলেন,ইস্ট- ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী। নাম- চার্লস উইলকিনস। পরে অবশ্য ইনি স্যার উপাধি পেয়েছিলেন। এই সাহেব, শ্রীরামপুরের শ্রী পঞ্চানন কর্মকারকে বাংলা টাইপের ছেনী কাটান শিখিয়ে দেন। এইভাবে, বাংলা টাইপের আবির্ভাব হলো।বাংলা টাইপের প্রথম ব্যাবহার হয়; হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণে।১৭৭৮ সালে এটি হুগলি থেকে প্রকাশিত হয়।


যালহেডের আসল বাংলা ব্যাকরণ বইটির প্রচ্ছদের প্রতিলিপি

ফলে, বই আর সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সর্বসাধারণের কাছে উন্মুক্ত হল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, আমরা দেখতে পাই-দু- একটি আইনের বই; বাংলায় লেখা হয়েছিল। বইগুলো দলিল পত্রের মত, আরবী-ফার্সী শব্দে ভরা। তাই, পরবর্তীকালে এগুলোকে ঠিক সাহিত্যের কোঠায় ফেলা হয় নি।ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ঢল নামল।খাস বিলেত থেকে আসা ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের(এদের সিভিলিয়ান বলা হত) শিক্ষার জন্য ১৮০০ খ্রীঃ এ কোলকাতায় কলেজ অব ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হল।এই কলেজে প্রাচ্য ভাষার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন-শ্রীরামপুরের মিশনারী পাদ্রী উইলিয়াম কেরী।১৮০১ সালের মে মাসে;উইলিয়াম কেরীর সহকারী পণ্ডিত ও মুনশী কয়েকজনকে নিযুক্ত করা হলে; কলেজের প্রকৃত কাজ শুরু হয়।
সিভিলিয়ানদের বাংলা পড়াতে গিয়ে, দেখা গেল- বাংলা বই গুলো সবই কাব্য। এখন প্রয়োজন হয়ে পড়ল বাংলা গদ্যের।কারণ, ব্যাবহারোপযোগী বাংলা গদ্য না পড়ালে সিভিলিয়ানরা তথাকথিত নেটিভদের সাথে কথা বলবে কি করে?
উইলিয়াম কেরী, তাঁর মুনসী এবং পণ্ডিতদের বললেন ব্যাবহারোপযোগী বাংলা গদ্যের বই লিখতে। নিজেও লেগে গেলেন। লিখে ফেললেন- একটা ব্যাকরণ, একটা অভিধান, একটা কথোপকথনের বই আর একটা গদ্য গ্রন্থ সংকলন। সূচনা হলো, বাংলা গদ্যের। নিজেদের রাজ্য শাসনের জন্য, এগুলো তৈরী করলেও; ভবিষ্যতের বাংলা গদ্য সাহিত্য ঋণী হয়ে থাকল এঁদের কাছে। যে বছর কলেজ কাজ আরম্ভ করল, সেই বছরেই প্রকাশিত হলো; কেরীর “ব্যাকরণ”, ‌‍রামরাম বসুর “প্রতাপাদিত্যচরিত্র”, আর গোলোক শর্মার “হিতোপদেশ”।‌‍রামরাম বসুর “প্রতাপাদিত্যচরিত্র”,বাংলা অক্ষরে ছাপা প্রথম মৌলিক গদ্য গ্রন্থ।

এর আগে, পোর্তুগীজ পাদ্রীরা যে সব গদ্য গ্রন্থ বের করেছিলেন, সে সবই ছিল ইংরাজি বা রোমান হরফে ছাপা।
এ প্রসঙ্গে, জানিয়ে রাখা যেতে পারে; অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে যে তিনখানা আইনের অনুবাদ গ্রন্থ এবং ১৮০০-০১ সালে বাইবেলের যেটুকু অনুবাদ, শ্রীরামপুর মিশন প্রকাশ করেছিল, তা কিন্তু বাংলা অক্ষরে ছাপা হয়েছিল।
রামরাম বসুর আর একটি গদ্য গ্রন্থ- “লিপিমালা”, প্রকাশিত হয়; পরের বছর অর্থাৎ ১৮০২ সালে। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত হয়,চণ্ডীচরণ মুন্সীর- “তোতা ইতিহাস”। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের- “ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম্” ।
সবাইকে ছাপিয়ে গেছিলেন- মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। কলেজের শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক ছিলেন এই মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ এই মহাপণ্ডিত, কেরী সাহেবের ডান হাত ছিলেন। দেশী লোকের লেখা প্রথম ভারতবর্ষের ইতিহাস- “রাজাবলি”, এনারই রচনা। ১৮১৯ সালে ইনি প্রয়াত হন।
এরপর এলেন বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার, বিশেষত বাংলা গদ্যের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান পুরুষ ও অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনিই প্রথম বাংলাভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ লিখেছেন, যা মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণেরই প্রসারণ/অনুবাদ হলেও আজ অব্ধি বাংলাভাষার ব্যাকরণ এই আদলের মধ্যেই রয়েছে। প্রয়াত হূমায়ুন আজাদ একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বাংলাভাষার ব্যাকরণ রচনার আগ্রহ ও প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকবার বললেও কাজটি শেষ পর্যন্ত আরদ্ধই রয়ে গেছে, সম্ভবত যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে।
• মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগের ১৬টি স্বরবর্ণ রেখেছিলেন।
• ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ে প্রথম ভাগের ১৬টি থেকে কমিয়ে ১২টি স্বরবর্ণ করলেন। তিনি দেখালেন ৯, দীর্ঘ ৯, দীর্ঘ ঋ কারের কোনো দরকার নেই।
• মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগের ৩৪টি ব্যাঞ্জনবর্ণ ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে ৪০টি ব্যাঞ্জনবর্ণ আনলেন।

শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়! অপেক্ষাকৃত নতুন বাংলা ভাষার বাক্যবিন্যাস কিন্তু নেওয়া হয়, ফার্সী থেকে। এলেন ঋষি বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ!


বাংলা হরফের বিবর্তন ও আরও কিছু ছবি


(২য় পর্ব )

উনবিংশ শতাব্দী থেকে বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের শুরু । বাংলা সাহিত্যে গদ্যের ব্যবহার, এই যুগের থেকেই আরম্ভ হয়েছিল ।

সংস্কৃত শব্দের বা তৎসম শব্দের আমদানি হয়েছিল, গদ্যশৈলীর প্রবর্তনে । অধিকাংশ গদ্যলেখক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন বলে, এই সব তৎসম শব্দের বাড়াবাড়ি হয়েছিল, এটা বলতেই হবে ।

ইদানিং যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হল-বাংলা সাহিত্যে, ইংরেজী ইডিয়মের ব্যবহার প্রচুর । বিশেষ করে কম্পিউটার আসার পর, এই সব “টার্ম” প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে । উভয় বঙ্গের “ভাষা সাহিত্যের” ভাষা এবং কোলকাতা অঞ্চলের ভাষা, শিক্ষিতের ভাষায় স্বীকৃত হচ্ছে নজর এড়িয়ে । এটা ভালো না মন্দ- ভবিষ্যৎ বলবে । রায় দেবার সময় এখনও সময় আসে নি । তবে, একটা কথা মনে হয়- লোকেরা যে সব শব্দে অভ্যস্ত, সেগুলো ব্যবহার করলে, গদ্য বা পদ্য আরও পাঠক পাবে ।

আগেই আমরা দেখেছি, বাঙলা ভাষার উপভাষা এবং কোন কোন অঞ্চলে চালু । এবারে বিশিষ্ট লক্ষণ গুলো দেখা যাক ।

রাঢ় বা পশ্চিমবাঙলার উপভাষায় অভিশ্রুতি আর স্বরসঙ্গতির ফলে বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে । যেমন :-

রাখিয়া > রেখে

করিয়া > কোরে

দেশী > দিশী

বিলাতি > বিলিতি

অ- কার এবং ও কারের প্রবণতা এই উপভাষায় লক্ষণীয় । যেমন :-

অতুল > ওতুল । আনুনাসিক স্বরের উপস্থিতিও একটা প্রধান বিশেষত্ব ।

চাঁদ, আঁট, কাঁটা, হাঁসপাতাল ( ইং – হসপিটাল) – এই গুলো উদাহরণ ।

পশ্চিমবঙ্গের উপভাষায় পদের স্বরধ্বনিতে শ্বাসাঘাত হয়ে থাকে , আর তার ফলে পদের শেষে থাকা ব্যঞ্জনবর্ণের মহাপ্রাণতা অথবা ঘোষবত্তা লোপ পেয়ে যায় ।

উদাহরণ দিচ্ছি :-

দুধ > দুদ, মধু > মদু, ইং লার্ড ( লর্ড) > লাড> লাট ।

কয়েকটা জায়গায়, অঘোষধ্বনি, ঘোষ হয় । ছত্র > ছাত > ছাদ, কাক> কাগ, শাক> শাগ, ফারসী গলৎ > গলদ ।

এবারে, পূর্ববঙ্গের উপভাষায় অভিশ্রুতি আর স্বরসঙ্গতি নাই । তাই স্বরধ্বনিতে অনেকটা প্রাচীনত্ব বজায় আছে ।

রাখিয়া >*রাইখিআ > রাইখা , করিয়া > *কইরিয়া > কইরা, দেশি > দেশি ।

য- ফলা যুক্ত যুক্তব্যঞ্জনেও অপিনিহিতি হয় । সত্য > সইত্ব । ব্রাহ্ম > *ব্রাহ্ম্য > ব্রাইম্ম ।

আবার, এ- কার এবং ও- কার প্রায়ই আ্য- কার এবং উ- কারে পরিণত হয় । লক্ষণীয় যে, আনুনাসিক স্বরধ্বনির অস্তিত্ব একেবারেই নেই । শ্বাসাঘাতেরও নির্দ্দিষ্ট স্থান নেই । ঘোষ বর্ণের মত মহাপ্রাণ অর্থাৎ চতুর্থ বর্ণ মহাপ্রাণতা ছেড়ে এক রকম বিশেষ তৃতীয় বর্ণে রূপান্তরিত হয় ।

ভাত >ব’আত্ ,ঘা > গা’আ ।

ড়-কার,ঢ়-কার, রকারে পরিণত হয়ে যায় । এইজন্যই অনেকের র-কার আর ড়- কার ঠিক মত বসাতে পারেন না ।

এবারে, যে সব শব্দ আধুনিক বাংলা ভাষায় সরাসরি সংস্কৃত থেকে এসেছে , সেগুলো তৎসম ( তাহার সম ) শব্দ । এবারে কালের নিয়মে উচ্চারণ দোষে সে শব্দগুলো একটু বিকৃত হয়ে গিয়েছে, সেগুলো হল – অর্দ্ধ তৎসম শব্দ ।

শ্রদ্ধা ( তৎসম ) >সাধ >ছেদ্দা,ছরাদ । কৃষ্ণ > কেষ্ট > কানাই, কানু ( এটা তদ্ভব , মানে “ কেষ্ট” থেকে এর উদ্ভব ) ।

এছাড়াও প্রচুর আরবী, ফারসী, তুর্কি,পর্তুগীস, ওলন্দাজ, ইংরেজী শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে । এগুলোকে ইংরেজীতে বলে- লোন ওয়ার্ডস । বাংলা করলে দাঁড়ায় কৃতঋণ শব্দ ( বাংলাদেশ এই শব্দটার বাংলা করেছে) । পশ্চিম বঙ্গে বলা হয় – অতিথি শব্দ ।

আলমারী, পাঁও, আনারস, আলপিন,বাসন – পর্তুগীস শব্দ ।

আবার দেখুন – ঝিঙ্গা হচ্ছে সাঁওতালি শব্দ । লুঙ্গি- বার্মিস ।

কিছু গ্রীক শব্দও এসেছে ।

যেমন- দাম ( এখানে পয়সা অর্থে, বাংলা শব্দ ) । সংস্কৃত হলো – দ্রাম্য । গ্রীক মূল শব্দ- দ্রাখ্ মে । (drakhme)

আন্দাজ, খরচ, কম, বেশী, নগদ- ফারসী শব্দ ।

আক্কেল, হুঁকা, কেচ্ছা,খাসী, তাজ্জব – আরবী শব্দ ।

আলখাল্লা, উজবুক,কাবু, কুলি,চাকু – তুর্কি শব্দ ।

এগুলোও বাংলা ভাষা আত্মসাৎ করেছে । যেমন , কয়েকটা ইংরেজী শব্দ বাংলাভাষা আত্তিকরণ করেছে ।

সিনেমা, চেয়ার, টেবিল, কাপ, প্লেট – উদাহরণ ভুরি ভুরি ।

ইদানীং নেটের কল্যাণে এসেছে – আড্ডানো, আপলোডানো , ফেসবুকীয়র মত বহু শব্দ । তাই বাংলা ভাষা এখন আর সংস্কৃতের ঘেরাটোপে আবদ্ধ নেই । প্রামাণ্য বাংলা ভাষাও বলে আজকাল আর কিছুই নেই । এটা আক্ষেপ নয় । এই রকম প্রচুর শব্দ আছে । লেখক কি লিখবেন, সেটা তাঁর নিজস্ব পছন্দ । পাঠক পড়ে যদি বুঝতে পারেন, তাহলে এই সব ব্যবহারে বাংলা সাহিত্যে ছুৎমার্গ না রাখাই ভালো ।

একটা অক্ষম প্রয়াস করলাম । ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, পরিবর্তন যদি জীবনোর সব ক্ষেত্রে আসে, তবে ভাষায় কেন আসবে না ?

অলমতি






ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি
শ্রীশুভ্র


শোনা যায় ভারতবর্ষে প্রতি কুড়ি মিনিটে একটি করে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে! এরসাথে শ্লীলতাহানী যৌনহয়রানী যোগ করলে পরিসংখ্যানটি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে! শারীরীক সক্ষমতায় মেয়েরা দূর্বল বলেই যে এঘটনা ঘটে তা নয়! পুরুষের মনস্তত্বে নারী মানেই ভোগ্যপণ্য স্বরূপ! মূল কারণটা নিহিত আছে এখানে! আর এই মানসিকতা থেকে প্রায় কেউই মুক্ত নন! তারা সবাই যে ধর্ষণে উৎসাহ পাচ্ছেন সর্বদা, তা নয়! কিন্তু সমাজের সেকল শ্রেণীতেই নারী মানেই পুরুষের ইচ্ছাধীন, পুরুষের কামনা বাসনা মেটানোর নরম ক্ষেত্র! পারিবারিক সূত্রেই এই বোধ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে বেড়ে ওঠে একটি বালক! ফলে সামাজ বাস্তবতার প্রতিফলনে এই জমিতেই জমে ওঠে তার মূল্যবোধ!

ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের মধ্যেই নারীকে পুরুষের ভোগ্য করে রাখার প্রচলন চলে আসছে আবহমান কাল ধরেই! ফলে যারা বলেন পশ্চিমী খোলা দুনিয়ার খোলামেলা পোশাকের সংস্কৃতি এই সব অপসংস্কৃতির মূলে তারা সঠিক বলেন না! যে দেশে একদিকে দেবদাসী প্রথা আর একদিকে একটি পুরুষের বহু বিবাহ সমাজ স্বীকৃত ব্যবস্থা ছিল বহু শতাব্দীব্যাপী এবং আজও কোনো কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পুরুষের বহুবিবাহ প্রথা আজও প্রচলিত; সেখানে নারীর উপর পুরুষের ক্ষমতায়ন সতঃসিদ্ধ হবেই! ফলে ভালো মন্দ সকল পুরুষের মধ্যেই নারীকে ভোগ করার মানসিকতাতেই পুরুষার্থ বোধটি ষোলো আনা কাজ করে! এই সামাজিক পটভূমিতেই পারিবারিক সংস্কৃতির বিন্যাসে বেড়ে উঠতে থাকে ছেলেরা!

ভারতবর্ষের অধিকাংশ জাতিতেই অধিকাংশ সম্প্রদায়েই পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপে, নারী মানেই পুরুষের পোষ্য! পুরুষের ইচ্ছাধীনেই নারীর স্বাধীনতার পরিসর! এখানেই পুরুষের মানসিকতায় নারীর প্রতি কোনো সম্মানবোধ গড়ে ওঠার পরিসর থাকে না! ফলত ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক সমাজবাস্তবতার উত্তরাধিকার সূত্রেই নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান কোনোকালেই দেওয়া হয় নি! বর্তমানে স্বাধীন ভারতবর্ষের সমাজে নারীর অবস্থানের মৌলিক কোনো পরিবর্তন আজও সূচীত হয়নি! হয়নি বলেই বধু নির্যাতন বধু হত্যার এত বাড়বাড়ন্ত! যে সমাজে নিজের স্বামীর কাছে, শ্বশুর বাড়িতেই নারীর জীবনের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে পথে ঘাটে তার সুরক্ষার নিশ্চয়তা কে দেবে!

ফলে ভারতবর্ষে ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়! এই রকম সামাজিক প্রেক্ষিতেই সুপ্ত থাকে এই জঘন্যতম অপরাধের বীজ! উপযুক্ত জলবায়ু পেলেই তা অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে! পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে শিশুদের শৈশব থেকেই প্রায় ছেলে মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিক মেলামেশার ক্ষেত্রগুলিকেই যথাসম্ভব সঙ্কুচিত করে রাখা হয়! আর এই পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হয়ে দেখা দেয় ছেলেদের মেয়েদের আলাদা আলাদা স্কুল কলেজগুলি! জ্ঞান উন্মেষের সূচনা লগ্ন থেকেই সম্পূর্ণ এই অপ্রাকৃতিক অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগে শিশুমন সুস্থ হয়ে বিকশিত হবার সুযোগ পায় না! গড়ে ওঠে অজানা কৌতুহলের হাত ধরে একটা অসম্ভ্রমবোধের মানসিকতা! স্বাভাবিক মেলামেশার অভাবে শ্রদ্ধাবোধ জাগে না!

সামাজিক উৎসবে পার্বণেও এই লিঙ্গভেদের দূরত্বের কারণে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা সহজ সচ্ছন্দ হয় না! ফলে একটা অজানা আকর্ষণ ক্রিয়াশীল থাকে! যে আকর্ষণটা মূলতই বয়সসন্ধি জনিত শারীরীক উত্তেজনা প্রসূত! যেখানে মানসিক সৌকর্য গড়ে ওঠার পরিসর থাকে না সমাজ বাস্তবতার পরিকাঠামোতেই! এইযে মানসিক সৌকর্য, এরই পরিশিলীত নিরন্তর অনুশীলনে গড়ে ওঠে পরস্পরের সম্বন্ধে শ্রদ্ধাজনিত সম্ভ্রমবোধের! যা থেকে সৃষ্টি হয় দরদের! গড়ে ওঠে দায়িত্ববোধ! সামাজিক প্রেক্ষিতে সুস্থ নৈতিকতার বাস্তবায়নে যা সবচেয়ে জরুরী! কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতবর্ষের

সমাজের সকল স্তরেই এই জরুরী বিষয়টাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত! এই অবহেলার পথরেখা ধরেই সমাজে দানা বাঁধে অসুখ!

এই যে সামাজিক অসুখ এরই অন্যতম ভয়ংকর প্রকাশ এই ধর্ষণ! মানুষের সমাজে এর থেকে জঘন্য অপরাধ আর হয় না! অথচ এই অপরাধের ফলে সমাজে প্রায় একঘোরে হয়ে পড়ে ধর্ষিতা নারী! সমাজ তাকে আর আশ্রয় দেয় না সসস্মানে! এই যে সমাজের ভূমিকা, যেখানে সে ভিকটিমের পক্ষে ততটা সহানুভূতিশীল নয়; এই ভূমিকাই অপরাধীদের উৎসাহ দেয় অপরাধে! একটি সমাজ যখন তার নৈতিক দায়বদ্ধতার দায় এড়িয়ে উদাসীন থাকে, বুঝতে হবে সেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন! সেই পচন থেকেই সৃষ্টি হয় দূর্নীতির! জন্ম নেয় অপরাধী! ফলে ধর্ষণের ঘটনার দায় সমাজের ওপরও বর্তায়! আমরা স্বীকার করি আর না করি! আর সেই সুযোগে দূর্নীতির পালে হাওয়া লাগিয়ে অবাধে বিচরণ করে বেড়ায় অপরাধীরা!

ভারতবর্ষের সমাজে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বস্তরে যে অনৈতিকতা এবং আদর্শহীনতার বাড়বাড়ন্ত তারই প্রতিফলন; একদিকে গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দলতন্ত্রের ক্ষমতা নিয়ে ব্যাভিচার যার ফলে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, আর অন্যদিকে অপরাধীদের অবাধ স্বাধীনতা ও দুঃসাহস! ধর্ষণের এত বাড়বাড়ন্ত এই সমস্ত কারণেই আজ এতখানি সমাজবাস্তব! ফলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে কোনো সামাজিক আন্দোলনের অভিমুখকেই এই সমগ্র বাস্তবতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে! কোনো একটি ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত নির্দিষ্ট অপরাধীর চরমতম শাস্তিবিধান নিশ্চিত করতে পারলেই কিন্তু আন্দোলন সফল হবে না! ধর্ষণমুক্ত সমাজ দূর্নীতি মুক্ত প্রশাসন ছাড়া সম্ভব নয়!

আবার দূর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নির্ভর করে সুস্থ সবল সুন্দর দায়িত্বশীল সমাজের উপর! যে সমাজ গড়ে ওঠে সুশিক্ষিত সুনাগরিকের ভিতের উপর! ফলে দেখা যাচ্ছে ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়ার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে সুশিক্ষিত সুনাগরিকের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে! তাই এই সামাজিক আন্দোলনের মূল অভিমুখ থাকা দরকার সার্বিক সুশিক্ষার প্রসারের দিকে! যে শিক্ষার ভিত্তি হবে সমস্ত রকম লিঙ্গ বৈষম্যের উর্ধে! যে শিক্ষার সূত্রপাত হতে হবে একেবারে প্রতিটি সংসারের নিজস্ব চৌহদ্দী থেকে! সমাজে সম্প্রদায়ে স্কুল কলেজে কর্মক্ষেত্রে যে শিক্ষাকে করতে হবে সর্বত্রগামী! সামাজিক অসুখকে সমাজের অন্তর থেকে না সারালে শুধুমাত্র ওপর থেকে কটা আইন প্রনয়ণ করে হবে না!

যে কোনো আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা রক্ষা করার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের! যে দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রশাসন যত বেশি নিরপেক্ষ থাকতে পারে, সে তত বেশি দক্ষ হয়! এই নিরপেক্ষতা আর দক্ষতার বিষয়ে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনের সুখ্যাতি কেউ করবে না! কিন্তু এদেশের প্রশাসনের প্রতিটি অলিন্দে যে পরিমাণ দূর্নীতির চর্চা হয়, তাতে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে সাধারণ মানুষের অবস্থা জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ নিয়ে বেঁচে থাকার মতো! ফলে এই রকম সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নারীর সুরক্ষার বিষয়ে নিশ্চিত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে কে? আইন আদলতও তো দূর্নীতির উর্দ্ধে নয়! পুলিশ সরকারী দলের আজ্ঞাবহ! স্বভাবতই এই অবস্থায় রক্ষকও ভক্ষক হয়ে উঠবে সেটাই খুব স্বাভাবিক! এবং অপরাধীরাও ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক মঞ্চকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে! ভারতবর্ষের সমাজে এটাই বাস্তব চিত্র! এই প্রেক্ষিতেই মোকাবিলা করতে হবে ধর্ষণের মতো নারকীয় অপরাধের সাথে! ফলে কাজটি যে চুড়ান্ত কঠিন তা বলাইবাহূল্য! শুধুই আইন আদালতের উপর ভরসা করে থাকলে কপাল চাপড়াতে হবে! কারণ সর্ষের মধ্যেই যে অনেক সময়ে ভুতের উপদ্রপ! আর এইখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সদর্থক সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয় উপযোগিতার! সমাজের সর্বত্র দূর্নীতির পচন ধরলেও এখনও বহু মানুষ সুনীতির পক্ষে আদর্শের পক্ষে জীবন সংগ্রাম করে চলেছেন! প্রয়োজন শুধু সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠার!

সামাজিক আন্দোলনের স্বার্থে চিন্তাশীল সুনাগরিকদের প্রবলভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলতে হবে সামগ্রিক প্রতিরোধ! এই প্রতিরোধী গণ আন্দোলনের অভিমুখ একদিকে যেমন সমাজের ভিতর থেকে শুদ্ধিকরণের প্রস্তুতিতে ক্রিয়াশীল থাকবে; সেই সঙ্গে একই সাথে সরকারী প্রশাসনের দায়বদ্ধতা সুদক্ষতা এবং বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির উপর নিরন্তর গণতান্ত্রিক চাপ বজায় রাখতে স্বচেষ্ট থাকবে! প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রয়োজনে অকার্যকর আইনের সংশোধন করে সংঘটিত অপরাধগুলির দ্রত সুবিচার সম্পন্ন করার বিষয়ে সংঘবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম! বিভিন্ন গণ সংগঠন গুলির এই ব্যাপারে সামনে এগিয়ে আসা উচিৎ!

সংগঠিত প্রতিরোধী এই সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার নিতে হবে নারীদেরকেই! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঘরে বাইরে নারী আজও শেষ পর্য্যন্ত পুরুষের উপরেই নির্ভরতার জীয়ন কাঠিটি ন্যাস্ত রাখে! আর তখনই মুখ থুবড়ে পড়ে সমস্ত প্রয়াসের মূল কার্যকারিতা! তাই নারী আন্দোলনের প্রবক্তাদের নিজেদের এই পুরুষ নির্ভরতা কাটিয়ে উঠে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে হবে দ্রুত! নেতৃত্ব দিতে হবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সুনাগরিকদের আত্মবিশ্বাসী প্রত্যয়ে! সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার সূত্রেই ধর্ষণ মুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব! এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার হাত ধরেই সম্ভব দেশের সামগ্রিক উন্নতির বাস্তবায়ন! সামাজিক সুস্থতা আজ তাই নারী আন্দোলনের উপরই নির্ভরশীল!