সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২

ছোটগল্প - সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

এই বিশ্বাসে
সূর্যনাথ ভট্টাচার্য


আকাশটা আজ সকাল থেকেই কুয়াশায় ঢাকা। ঠিক যেমনটি হয়ে আছে রাজনারায়ণের মন। মানুষ একবার কোন এক দুর্যোগের মধ্যে পড়ে গেলে আর এই ভাবটা থাকে না, প্রতিকূলতার মোকাবিলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু যতক্ষণ সেই দুর্যোগ না আসছে, ততক্ষণ এই ভাবটা যেন গলা চেপে থাকে। কোথা দিয়ে বিপদটা কোনরূপে দেখা দেবে, অবচেতনার অন্ধকারে সেটাই হাতড়ে বেড়ায়।

রাজনারায়ণ গ্রামের ছেলে, কিন্তু নিজের চেষ্টায় এখন শহরের এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তিনি বয়সে প্রবীণ, সাধারণত সহজে বিহ্বল হন না। কিন্তু নিরূপমার অসুখটা তো সাধারণ নয়। কাল যখন ডঃ তালুকদার সব মেডিক্যাল রিপোর্ট আর এক্স-রে পরীক্ষা করে বুঝিয়ে বলছিলেন নিরুপমার শারীরিক সমস্যাটা কতটা গুরুতর জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, রাজনারায়ণের পায়ের তলা থেকে একটু একটু করে মাটিটা সরে যাচ্ছিল। শেষে ডঃ তালুকদার বললেন, 'দেখুন, ব্যবস্থা যা নেবার, নেওয়া হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা করা, পেশেন্ট কতটা রেস্পন্ড করে তার জন্য। দেয়ার ইজ অলওয়েজ আ চান্স অফ সারভাইভাল, কিন্তু কিছু মনে করবেন না, আমি খুব একটা ভরসা দিতে পারছি না।'

ডঃ তালুকদারের এই স্পস্ট কথা বলার অভ্যাসটা বরাবর পছন্দ করেছেন রাজনারায়ণ। তাতে বোঝা সহজ হত, ডাক্তারের মনের মধ্যে আসলে কি আছে। ডঃ তালুকদার বিচক্ষণ ডাক্তার, রোগ নিদানে তাঁর বড় একটা ভুল হয় না। মনে হয় অজানা এক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন কাজ করে, অল্প কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষাতেই রোগের আসল জায়গাটিতে পৌঁছে যাবার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর আছে। ডঃ তালুকদারের এ ক্ষমতার পরিচয় রাজনারায়ণ বেশ কয়েকবার পেয়েছেন। আজ তাই একান্তভাবে রাজনারায়ণ চাইছিলেন, ডঃ তালুকদার যেন আশাব্যঞ্জক কিছু বলেন। কিন্তু তিনি তো তা বললেন না? আজ এই অভিজ্ঞ ডাক্তারের কথায় রাজনারায়ণের চিন্তাভাবনাগুলো কেমন ধূসর হয়ে গেল। তাহলে ডাক্তার তাঁর পেশেন্টের যে অবস্থা নিরূপণ করলেন, তাই কি নিরুপমার ভবিতব্য?

রাজনারায়ণের চল্লিশ বছরের পুরনো সঙ্গী নিরুপমা। স্বামী-স্ত্রী স্বভাবে ঠিক একে অপরের পরিপূরক। নিরুপমা শান্ত, মৃদুভাষী, ঘরমুখী, মন্দির ও তীর্থের প্রতি তাঁর এক সহজাত আকর্ষণ। আর রাজনারায়ণ উচ্ছাসপ্রবণ, আড্ডাবাজ, প্রথাগত পূজো-পাঠের পরিপন্থী। আজ বারবার করে সব পুরনো কথা মনে আসছে। রাজনারায়ণের চেয়ে উচ্চতায় অনেকটা খাটো ছিল নিরুপমা। আদিত্যদা একবার সে কথা নিয়ে ঠাট্টা করায় রাজনারায়ণ মজা করে বলেছিলেন, 'সমস্যা তো যতো ছোট হয় ততই ভালো, তাই না আদিত্যদা?' কথাটা অবশ্য নিতান্তই মজা করে বলা, নিরুপমা কোনোকালেই রাজনারায়ণের সমস্যার কারণ হন নি । ব্যবসাসূত্রে ব্যস্ত জীবনে নিরুপমাকে অল্পই সময় দিতে পেরেছেন রাজনারায়ণ। ছেলে চন্দনের জন্মও রাজনারায়ণের অনুপস্থিতিতে। তার জন্য কখনো কোন অভাব বা অভিযোগ জানান নি নিরুপমা।

একবারই শুধু এক বিবাহবার্ষিকীতে নিরুপমা জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আজ দিনটার কথা কি তোমার মনে আছে?' রাজনারায়ণের যথারীতি মনে ছিল না। নিরুপমা মনে করিয়ে দিতে রাজনারায়ণ ফস করে বলে দিয়েছিলেন, 'ওঃ, তা চল এক মিনিট নীরবতা পালন করা যাক।' রাজনারায়ণের স্বভাবই ওরকম, কোন কিছু না ভেবেই বলা কথা। নিরুপমা একটু অপ্রতিভ হাসি দিয়ে অবস্থা সামলে নিয়েছিলেন। বাড়ীতেই চিংড়ি মাছের মালাইকারী আর পুলি-পিঠে বানিয়ে সবাইকে খাইয়েছিলেন। কোন অভিযোগ জানান নি। রাজনারায়ণ পরে ভেবে দুঃখ পেয়েছিলেন, নিরুপমাকে আঘাত করা তার উদ্দেশ্য ছিল না।

এইসব ছোট ছোট সব কথা আজ খালি মনে আসছে। রাত পোহালেই হয়ত এসব শেষ হয়ে যাবে। রাজনারায়ণের জীবনের কতখানি জুড়ে যে নিরুপমা ছিল, সে তো আর বলার সুযোগ পাওয়া যাবে না। সারারাত ধরে ঈশ্বরের কাছে রাজনারায়ণ জানাচ্ছিলেন, আর একবার একটা সুযোগ দাও। আর নিরুপমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা নয়। এবার তাকে ঠিক বুঝিয়ে দেবেন, ছেলে-বৌ নাতি নিয়ে রাজনারায়ণের এই ভরা সংসারে তার স্ত্রীর জায়গাটা ঠিক কোথায়। বিনিদ্রায় কখন রাত শেষ হয়ে গেছে জানতেই পারেন নি।

—’দাদু, আজ তুমি বাসন্তী রঙের সিল্কের কাপড় নিয়ে আসবে কিন্তু।' সাত বছরের নাতি বাবলুর কথায় আবার বর্তমানে এসে পড়লেন রাজনারায়ণ। নিরুপমা ও রাজনারায়ণের চক্ষের মনি এই বাবলু। বাবলুরও ভীষণ প্রিয় তার দাদু আর ঠাকুমা। বাবা-মাকে ছেড়ে থাকতে পারে বাবলু, কিন্তু ঠাকুমাকে তার সর্বদা চাই। নিরুপমা খুব ভালো মাটির প্রতিমা গড়তে পারেন, নাতিকে নিয়ে মাটির পুতুল বানিয়ে জন্মাষ্টমী-রাস-দোল মানানো হয়। এবারে সামনের বসন্ত পঞ্চমীতে দুজনে ঠিক করেছিল ঠাকুর গড়ে ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো করা হবে। বাবলু স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে, ঝটপট দাদুর কাছে আবদার জানিয়ে গেল, 'আর বেশী সময় নেই। ঠাম্মা এসেই কাজ আরম্ভ করবে কিন্তু।'

—’তোমার ঠাম্মার যে শরীর খারাপ দাদু?' রাজনারায়ণ বালকের উৎসাহের খানিকটা নিজের মধ্যে নিতে চেয়েও না বলে পারলেন না।

—’তাতে কি হয়েছে?আমি কাল মা সরস্বতীকে বলে দিয়েছি, ঠাম্মাকে তাড়াতাড়ি সারিয়ে বাড়ী এনে দাও। না হলে তোমার পূজো কি করে হবে?' বাবলু সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, 'ঠাম্মা খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে চলে আসবে। তুমি আজ নিয়ে আসবে কিন্তু।'

বাবলুর গলায় কি অনাবিল আশ্বাস। শিশুরা কি এইরকমই হয়? রাজনারায়ণের সম্মুখে সময়ের ঘূর্ণি যেন হঠাৎ পিছনপানে ঘুরে চলল। তিনি পৌঁছে গেলেন অনেকগুলো বছর আগে...এক নিস্তরঙ্গ গ্রামের একটা ছোট্ট বাড়ীতে...

সেবার প্রচন্ড খরা গ্রামে, একফোঁটা বৃষ্টি নেই। মাঠঘাট ফুটিফাটা, ফসল সব ঝলসে যাচ্ছে। নিধুজ্যাঠা খবর আনলেন, পাশের গ্রামে ন্যাড়াশিব্তলার শিবঠাকুর হঠাত জাগ্রত হয়েছেন, যে যা চাইছে, পাচ্ছে। গ্রামের মাতব্বররা সবাই মিলে ঠিক করল, আর তো দেরী করা যায় না। কালই জনাকয়েক শক্তসমর্থ ছেলে-ছোকরা গিয়ে পাশের গাঁয়ে পুজো দিয়ে আসুক। নিধুজ্যাঠা শ্রীমন্তকে বললেন, 'তুমি তোমার বন্ধু ক'জনকে নিয়ে পুরো গাঁয়ের জন্যে এই কাজটি করে দাও বাছা।'

শ্রীমন্তর সাত বছরের ছেলে পল্টু সব শুনে বলল, 'তুমি শিবঠাকুরকে কি বলবে, বাবা?'

—’কি আর বলব?বলব গ্রামে দু'মাস ধরে বিষ্টি নাই, এবার একটু বিষ্টি দাও।'

—’শিবঠাকুর বিষ্টি দেবে?'

—’কেন দেবেন না?শিবঠাকুরের কাছে ভক্তিভরে যা চাওয়া হয়, উনি তাই দেন।'

পল্টু অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বোধহয় ভাবতে লাগল, শিবঠাকুরের কাছে চাইলেই যদি সব পাওয়া যায় তাহলে এতদিন কেউ বিষ্টি চায় নি কেন? শিবঠাকুর চাইলেই সব দিতে পারেন, একথাটা শিশুর মনে গভীর রেখাপাত করল। দরকার শুধু একান্তমনে তাঁকে বলবার। পল্টুর যতক্ষণ ঘুম এলনা, শিব্ঠাকুরকে মনে মনে বলতে লাগল, বাবা কাল অত কষ্ট করে তোমার কাছে যাবে, তুমি চাইলেই তো পারো, একটু বিষ্টি দিয়ে দিও শিবঠাকুর।

পরদিন শ্রীমন্ত ভোরভোর তৈরী হয়ে নিল, রোদ বেশী বাড়ার আগেই বেরিয়ে পড়বে। পল্টু এসে বলল, 'এই ছাতাটা নিয়ে যাও বাবা।'

—’দূর বোকা, এই গরম হাওয়ায় ছাতা কি হবে?মাথায় গামছা দিয়ে নিয়েছি, রাস্তায় নদী থেকে মাঝে মাঝে ভিজিয়ে নেব।'

পল্টু অবাক হয়ে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, 'কিন্তু আসবার সময়ে বিষ্টিতে যে ভিজে যাবে, বাবা।' ...

জানলার বাইরে বাসের শব্দে চমক ভাঙ্গল রাজনারায়ণের। বাবলুর স্কুলবাস এসে গেছে। তাইতে চড়ে বাবলু জানলা দিয়ে হাত নাড়ছে রাজনারায়ণের দিকে। দূরে কারখানায় সাইরেন বাজল। খবরের কাগজওয়ালা কাগজ ফেলে দিয়ে গেল। পাশের বাড়ীতে বাসন ধোয়ার আওয়াজ। লাঠিহাতে মাথায় মাফলার মুড়ে দীপ্তেনদা প্রাতর্ভ্রমণে বেরোলেন, বয়স তাঁর প্রায় আশী। তখন কুয়াশা খনিকটা কেটেছে, শীতের সকাল ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। ঘুমভাঙ্গানি সূর্যের আলো যেন একটা হালকা সোনালী রঙের চাদর চারদিকে মেলে দিয়েছে। স্কুলবাস ছেড়ে দিল, জানলা থেকে বাবলুর উজ্জ্বল সোনালী মুখটার দিকে চেয়ে সত্তর বছরের পল্টু অস্ফুটস্বরে বললেন, 'বাসন্তী রঙের সিল্কের কাপড় আমি আজ নিশ্চই নিয়ে আসবো, দাদু।'