মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৩

শিল্পকলা আর নিজের কাজ সম্পর্কে - গণেশ পাইন

শিল্পকলা আর নিজের কাজ সম্পর্কে
গণেশ পাইনের লিখিত উক্তি

গণেশ পাইন



আধুনিক চিত্রকলায় দুটি প্রধান প্রবণতা। এক, ছবির গঠন নির্মাণ নিয়ে নতুন ভাবনা। দুই, মনের অবচেতন স্তর সম্প্ররকে আগ্রহ। এই দুটি লক্ষণই সাধ্যমত বিবেচনা করেছি। গঠনের ব্যাপারে আমার ঝোঁক ঋজু রেখায় স্থাপত্যের মত করে ছবি গড়ার দিকে। ছবির বিষয়বস্তু বা theme সংগ্রহ করি অন্তর্মনের অভীপ্সা থেকে। সে কারণে আমার ছবি অনেকটা আদিরূপাত্মক (archetype)। ছবির সূচনা আবেশ থেকে। আবেশ বিমূর্ত অথচ অর্থময়। ছবি আঁকার প্রাথমিক স্তরে আবেশকে রূপ দেওয়ার তাগিদে ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত ফর্ম খুঁজি। তা পেলে কাগজে খসড়া করি। খসড়া বারবার বদলাই যতক্ষণ না গঠন আর বিন্যাস মনোমত হয়। তারপর খসড়া থেকে মূল ছবি শুরু করি। রঙের কাজটা ধীরে ধীরে স্তরে স্তরে চলে। মধ্যপর্যায় ছবি যেন নিজেই নিজেকে বদলায়। এই সময়টা খুবই যন্ত্রণাদায়ক এবং উদ্বেগের। তখন যেন চেতন মনের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। ছবি প্রায়শই পন্ড হয় এই পর্যায়। দৈবাৎ এই সঙ্কট থেকে উতরে গেলে ছবি সাঙ্গ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। এভাবেই আঁকি।



মনের ভিতরে একটা ক্রিস্ট্যালের মতো কিছুতে বাইরের জগতের সব ছাপ তো পড়ছে। সব অন্তর্মুখী মানুষের পড়ে। বাইরের জগতের সব ছাপ তো অতীত ও বর্তমানের সব অভিজ্ঞতা। বাইরের আলো বলুন, রিফলেকশন বল্লুন, সেগুলো তো সেই ক্রিস্ট্যালের ওপর পড়ছে। তবে পড়ে প্রতিসরিত হচ্ছে। হয়ে একটা কেন্দ্রগত বোধের মধ্যে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেইখান থেকেই আমার ছবির বেশিরভাগ ইমেজারিগুলো উঠে আসে।



কুৎসিতকে তার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রকাশিত করা শিল্পীর পক্ষে এক চ্যালেঞ্জ বিশেষ। শিল্পে শোধিত হয় বলেই সে আর যথার্থ কুৎসিত থাকে না, 'সুন্দর' হয়ে ওঠে। আমার ধারণা সত্যিকারের কুৎসিত শিল্পের শর্তাধীন নয়, যেহেতু শিল্প মাত্রই সুন্দর।



জনৈক সমালোচকের মতে শিল্প সমৃদ্ধ হলে শিল্প সমালোচনাও সমৃদ্ধ হয়। অতএব বাংলা শিল্প সমৃদ্ধ হলে বাংলায় শিল্পসমালোচনাও সমৃদ্ধ হবে। ইংরাজী পরিভাষার তর্জমা একটি দুর্ঘট ব্যাপার। শিল্প বিশ্লেষণের বিদেশী প্রধানত ইংরাজী নজির অনুসরণ করতে গিয়ে বাংলা সমালোচনা প্রায়ই জটিল আর অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে। সম্ভবত চিন্তার কাজটা সমালোচক ইংরাজীতে করেন, লেখন কাজটা করেন বাংলায়। শ্রম এবং নিষ্ঠায় যদি উৎকৃষ্ট শিল্প সম্ভব হয়, উৎকৃষ্ট সমালোচনার জন্যও শ্রম এবং নিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। শিল্পের করণকৌশলগত দিকটি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকাটাও সমালোচনার পক্ষে জরুরী।



বুদ্ধি আর আবেগকে আলাদা করে দেখা যায় কিনা জানি না। আবেগ বলতে যদি তরল ভাবোচ্ছ্বা আর বুদ্ধি বলতে বিশুদ্ধ বিচার ঠাওরান, তাহলে বিপত্তি আছে। আমি সে রকম করে আবেগ বা বুদ্ধি আলাদা করে দেখি নি কখনও। Form-এর দৃঢ়তা, স্থাপত্যসুলভ গঠনই আমার আরাধ্য। এটি বুদ্ধি বা আবেগের একক প্রবণতা নয়। ছবির বিষয়বোধের চরিত্র রঙের Tone-ই বর্ণনা করতে পারে, আর সে চরিত্রও আবেগ বা বুদ্ধির একক ক্রিয়া নয়, পাস্কাল বলেছিলেনঃ হৃদয়েরও একটা যুক্তি আছে, বুদ্ধি যায় খোঁজ রাখে না। তেমনি একথাও হয়ত বলা যায়, বুদ্ধিরও একটা হৃদয় আছে, হৃদয় যার খোঁজ রাখে না।



আমি সবকিছুর ওপর একটা সর্বগ্রাসী সৌন্দর্য, সর্বব্যাপী একটা ব্যালান্সকে আবিষ্কার করে নিই। মানুষ যখন আত্মমগ্ন হয় তখন হয়তো জগতের মধ্যে জীবনের মধ্যে এটাকেই আবিষ্কার করতেই হয় তাকে। নদীর স্রোত থেকে পাখি উড়ে যাওয়া পর্যন্ত এর মধ্যে সে একই ছন্দকে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করে ধীরে ধীরে। এবং সে একটা একক জগতের অধিবাসী হতে থাকে ক্রমশ। যে জগতের একটা কমন অর্ডারটা একটা নিজস্ব নকশায় আবদ্ধ। এই পাটার্নটাই আসল। আমি চেষ্টা করি কতগুলো ক্রিস্ট্যালাইজড ফর্মকে আমার ছবিতে এস্টাব্লিশ করতে। প্রত্যক্ষ বাস্তবের স্থূল লক্ষণগুলো এক কারণে অনেকটাই রূপান্তরিত হয়ে যায় আমার ছবিতে। কিন্তু বাস্তবকে পরিহার করা বলতে যা বোঝায় তা নয় কিছুতেই।



জীবন কিন্তু নবজাতককে দু'হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় না। সে আঘাত করেই তাকে। তার প্রথম পরীক্ষাই হচ্ছে সেই আঘাত তাকে সামলে নিয়ে সবলে তাকে জয় করা।