গণেশ পাইনকে অন্যভাবে
সুধীরঞ্জন মুখার্জী
যে মানুষ কালও ছবি এঁকেছেন আজ তিনি আর নেই। পড়ে রইলো তাঁর রঙ, তুলি কালি, কলম আর পট। তাঁর শিল্পভাবনা নিয়ে তিনি লোকান্তরিত হলেন। এই বোধ আমাদের বেদনার গভীরে নিয়ে যায় যে ছবি সম্পর্কে তাঁর পরবর্তী পর্যায়গুলি যা হতে পারতো আমরা তা হারালাম।
আমি কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁর ছবি দেখে আসছি। শুনতাম শিল্পী গণেশ পাইনের ছবি নাকি সব বিক্রি হয়ে যায় আর তার নাকি অনেক দাম। ওনার ছবি দেখে প্রথম যে ভাব আমার মনের মধ্যে ফুটে উঠেছিল তা হলো তাঁর ছবির চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে তিনি যেন কাল অতিক্রম করে চলেছেন। দ্বিমাত্রিক পটে বিধৃত সেই সব চরিত্রের অভিব্যক্তি ও গড়ন এক চিরকালীন আবেদন নিয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত সেই সব মানুষ, প্রানী, গাছ যেন অন্ধকার ও অনন্ত মহাকাশের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত। তাঁর ছবির জ্যামিতিক বিভাজন সংক্রান্ত সচেতনতা লক্ষণীয়ভাবে সব সময়েই ছবির আয়তকার পটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে উঠেছে। ওনার ছবির ভিতরে আকারের ভাঙ্গা-গড়া তাঁর অন্তর্নিহিত তাগিদ থেকেই হয়ে চলেছিল। রঙ, কালি, কলম ও তুলি ছাড়া অন্য কোনো আধুনিক মাধ্যমের আশ্রয় নিয়ে চমক সৃষ্টির পথে তিনি হাঁটেন নি। এক স্থিতপ্রজ্ঞ শিল্পী যিনি নিরন্তর আকারের মহাযাত্রায় যাত্রী হয়ে রইলেন।
আমার ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পরেই সামান্য ৩/৪ বার শিল্পী গণেশ পাইনের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই রকম একদিনের আলাপচারিতার কথা তখনই বাড়ি ফিরে ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আজ পাঠকের কাছে সেই পাতা ক'খানি খুলে দিলাম।
আজ ১১ ই মার্চ, ১৯৮১ আমি আর আমার দুই বন্ধু শ্রী উত্তম পাত্র আর শ্রী উত্তম সেনগুপ্ত গিয়েছিলাম কলেজস্ট্রীট মার্কেটের বসন্ত কেবিনে। অবশ্য এই যাওয়ার আগে এর সূত্র ধরে কয়েকদিন আগের ঘটনা মনে করতে হয়। সেটা ছিল একাডেমী অফ ফাইন আর্টস এ (১৯৮১) আমাদের যৌথ চিত্র প্রদর্শনীর শেষ দিন। শিল্পী গণেশ পাইন সেদিন একাডেমীতে এসেছিলেন। উনি একাডেমীর ক্যান্টিনের চা 'বিষ' মনে করতেন। কারণ আমাদের এর আগের প্রদর্শনীতে এসে চা খাওয়াতে প্রবল আপত্তি প্রকাশ করেছিলেন। তা এবারে (১৯৮১) সাউথ গ্যালারীতে আমাদের প্রদর্শনীতে জিজ্ঞাসা করলাম -- "চা খাবেন তো ? নাকি বিষ বলে আপত্তি আছে ?" উনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন "না খেতে পারি এখন আর বিষ নেই, তবে তোমরা সকলে যদি খাও তবেই।"
আমি ক্যান্টিন থেকে যখন চা নিয়ে ফিরলাম অখন দেখলাম উনি আমার ছবিগুলোর সামনে একটা দেয়ার নিয়ে বসে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে দেখছেন। চা হাতে দিয়ে পাশে একটা চেয়ার নিয়ে আমি বসলাম অনুগত ছাত্রের মতো। উনি বললেন "আমি 'Statesman' পত্রিকায় তোমার ছবির review পড়েছি, আমার মনে হয় নীরদবাবুর (শ্রী নীরদ মজুমদার) schooling তোমার consciously follow করা উচিত। দ্যাখো বিদেশে শিল্পের ক্ষেত্রে একটা পরম্পরা আছে, একটা ধারাবাহিকতা আছে, একটা ঘরণাকে অনুসরণ করে তাকে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেটা আমাদের দেশে হয় না। তুমি যদি নীরদবাবুর রীতিনীতি ও পদ্ধতিগত ক্রিয়াকৌশল ভালোভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে অনুধাবন করতে পারো তাহলে সেটা খোলাখুলিভাবে গ্রহণ করা উচিত।" আমি জানালাম আমার কথা -- "দেখুন, নীরদ মজুমদারের ছবি আমার খুবই ভালবাসি, তবে এটা ঠিক সেজান আমার কাছে অনেকখানি। আমি consciously সেজানকে যতটা বুঝতে চেষ্টা করি বা মেলাতে চেষ্টা করি সরাসরি নীরদবাবুর ছবিকে ততটা নয়।"
আমার ছবিগুলো থেকে গণেশদা ওঁর পছন্দ জানালেন -- "Nature এর বড় ছবিটা খুব ভালো হয়েছে।" সেদিনের কথা এই পর্যন্তই। এরপর ওঁর পরামর্শ মতোই আমরা মিলিত হলাম ১১ই মার্চ সন্ধ্যায় বসন্ত কেবিনে।
১১ই মার্চ সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেছে। বসন্ত কেবিনে যখন পৌঁছালাম তখন ও পাড়ায় লোডশেডিং চলছে। হ্যাজাকের আলোয় চাপা গরমে উনি বসেছিলেন। আমরা গিয়ে ওনাকে ঘিরে বসলাম। চা না হলে চলবে না বিশেষ করে রেস্তোরাঁয় বসে শুকনো গল্প চলে না। সুতরাং টোস্ট, ফিস ফ্রাই ও চা এলো। নানারকম টুকরো টুকরো কথাবার্তা চলতে লাগলো। ছবিতে influence বা প্রভাবের কথা উঠলো। উনি শিল্পী অতুল বসুর কথা বলছিলেন। অতুলবাবু নাকি বলেছিলেন যে একজন শিল্পের ছাত্রের পক্ষে আর্ট কলেজের পাঁচ বছর খুব বেশী সময়। এ ক্ষেত্রে ছ মাসই যথেষ্ট। অর্থাৎ ছ মাসে তাকে How to draw and paint শিখিয়ে ছেড়ে দাও, তারপর সে তার নিজের পথ খুঁজে নেবে। গণেশদার মত -- "পাঁচ বছর ধরে শেখানোর ফলে আর্ট কলেজের ছাত্ররা ক্রমশঃ নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। অন্যের জামা গায়ে দিয়ে বেরোয়, সেটা কাম্য নয়।" আমি বলতে চাইলাম যে আপনি বলছেন তা ঠিক, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্বতা অতি দুর্লভ বস্তু। খুব কম শিল্পীই একটি রেখা টেনে বলতে পারে যে এই লাইন টানলাম, রঙ লাগালাম -- এ পুরোপুরি আমার। এই রঙ রেখা এর আগে কোনো শিল্পী দেকাহতে পারেন নি। গণেশদা অবশ্য এ যুক্তি মানলেন। বললেন -- "হ্যাঁ, তা ঠিকই।" আমি তখন বললাম যে আমাদের অশেষ কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। মন দিয়ে ছবি আঁকার মধ্যে ডুবে থাকলে একদিন ঠিকই পত খুঁজে পাবো, তাই না ? উপস্থিত সকলেই একথা মানলেন। গণেশদা বললেন -- "হ্যাঁ, Passion for painting থাকতে হবে। রাতে ঘুম থেকে উঠে সদ্য করা ছবির গায়ে হাত বুলিয়ে তাপমাত্রা অনুভব করার চেষ্টা সেই শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব যে কাজ পাগল। যে জানে ছবির একটা প্রাণ আছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস সবই অনুভব করা যায়।" এই প্রসঙ্গে পিকাসোর একটা উক্তি মনে পড়ে গেলো যার অর্থ এইরকম যে একটা ছবি তার জন্মের পর থেকে একটা প্রাণীর মতই বাঁচে ও জীবনধারণ করে যার স্পন্দন অনুভব করা যায়।
এরপর প্রসঙ্গ উঠলো ছবিতে ভারতীয়ত্ব কিভাবে আনা যায়। আমি এই প্রশ্ন তুলতে গণেশদা বেশ হেসে উঠলেন। উনি বললেন " তোমরা জামাই হলে এই প্রশ্নটা করা হবে।" অর্থাৎ এটা বেশ জামাই ঠকানো প্রশ্ন। আমরা বুঝলাম যে এই ভারতীয় প্রসঙ্গটা ছবির ক্ষেত্রে বেশ ধোঁয়াটে। বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতা, শুধু পাশ্চাত্য বলিই বা কেন পৃথিবীর নানা সভ্যতার মধ্যে আদান প্রদান প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে। গণেশদা বললেন যে বর্তমান যুগে আমরা আমাদের জীবনে প্রতিমুহূর্তে পাশ্চাত্য উপাদানের প্রবেশ মেনে নিচ্ছি, না মানলে উপায় নেই এবং এ সব উপাদান আমাদের জীবনধারণ ও আমোদ-প্রমোদের সঙ্গে এত জড়িয়ে যাচ্ছে যে তা আর আলাদা করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমি কতখানি খাঁটি ভারতীয় আছি বা থাকতে পারবো তা ভাববার বিষয়। এই তর্কের অবশ্য কোনো শেষ হলো না।
গণেশদা জানতে চাইলেন যেহেতু আমরা রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র, সুতরাং চিত্রে ভারতীয়ত্ব সম্পর্কে আমাদের কোনো বিশেষ জ্ঞানলাভ হয়েছে কিনা। আমরা সবাই মাথা নাড়লাম -- অর্থাৎ জানি না। পরীক্ষার জন্য theory মুখস্থ করা ছাড়া এসব জানার চেষ্টা করিনি বা কেউ জানায়ওনি আমাদের।
উনি জিজ্ঞাসা করলেন -- "এখন ছবি আঁকতে আঁকতে কেমন বুঝছো ?" আমি বললাম -- "বড় ভয়ে আছি, কখন পিছলে না পড়ি।" গণেশদা হাসলেন, বললেন -- "বিশ্বাস রেখে কাজ করে যাও। তবে এটা ঠিকই survive করা খুব শক্ত।" আমরাও মানলাম এ কথা। বললাম যে ঠিকই তো, কত কত ছাত্রছাত্রী প্রতিবছর বিভিন্ন শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেরোচ্ছে। এরপর অনেক ঝরে যাচ্ছে, কিছু টিকছে। কয়েক বছর বাদে তাও থাকছে না, একজন বা দুজন ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে তার বাদবাকী সব জনারণ্যে মিশে যাচ্ছে। সুতরাং কাজ আর কাজ। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। এর বেশী আমরা আর কিছু পারি না।
রাত তখন ৮টা বেজে ১৫ মিনিট। বসন্ত কেবিনে লোডশেডিং শেষ হয়ে আলো ফিরে এসেছে। আমরা উঠে পড়লাম। গণেশদার সঙ্গে কথা হলো এখানেই আবার আমরা বসবো। না, সেটা আর হয় নি।
যে মানুষ কালও ছবি এঁকেছেন আজ তিনি আর নেই। পড়ে রইলো তাঁর রঙ, তুলি কালি, কলম আর পট। তাঁর শিল্পভাবনা নিয়ে তিনি লোকান্তরিত হলেন। এই বোধ আমাদের বেদনার গভীরে নিয়ে যায় যে ছবি সম্পর্কে তাঁর পরবর্তী পর্যায়গুলি যা হতে পারতো আমরা তা হারালাম।
আমি কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁর ছবি দেখে আসছি। শুনতাম শিল্পী গণেশ পাইনের ছবি নাকি সব বিক্রি হয়ে যায় আর তার নাকি অনেক দাম। ওনার ছবি দেখে প্রথম যে ভাব আমার মনের মধ্যে ফুটে উঠেছিল তা হলো তাঁর ছবির চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে তিনি যেন কাল অতিক্রম করে চলেছেন। দ্বিমাত্রিক পটে বিধৃত সেই সব চরিত্রের অভিব্যক্তি ও গড়ন এক চিরকালীন আবেদন নিয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত সেই সব মানুষ, প্রানী, গাছ যেন অন্ধকার ও অনন্ত মহাকাশের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত। তাঁর ছবির জ্যামিতিক বিভাজন সংক্রান্ত সচেতনতা লক্ষণীয়ভাবে সব সময়েই ছবির আয়তকার পটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে উঠেছে। ওনার ছবির ভিতরে আকারের ভাঙ্গা-গড়া তাঁর অন্তর্নিহিত তাগিদ থেকেই হয়ে চলেছিল। রঙ, কালি, কলম ও তুলি ছাড়া অন্য কোনো আধুনিক মাধ্যমের আশ্রয় নিয়ে চমক সৃষ্টির পথে তিনি হাঁটেন নি। এক স্থিতপ্রজ্ঞ শিল্পী যিনি নিরন্তর আকারের মহাযাত্রায় যাত্রী হয়ে রইলেন।
আমার ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পরেই সামান্য ৩/৪ বার শিল্পী গণেশ পাইনের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই রকম একদিনের আলাপচারিতার কথা তখনই বাড়ি ফিরে ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আজ পাঠকের কাছে সেই পাতা ক'খানি খুলে দিলাম।
আজ ১১ ই মার্চ, ১৯৮১ আমি আর আমার দুই বন্ধু শ্রী উত্তম পাত্র আর শ্রী উত্তম সেনগুপ্ত গিয়েছিলাম কলেজস্ট্রীট মার্কেটের বসন্ত কেবিনে। অবশ্য এই যাওয়ার আগে এর সূত্র ধরে কয়েকদিন আগের ঘটনা মনে করতে হয়। সেটা ছিল একাডেমী অফ ফাইন আর্টস এ (১৯৮১) আমাদের যৌথ চিত্র প্রদর্শনীর শেষ দিন। শিল্পী গণেশ পাইন সেদিন একাডেমীতে এসেছিলেন। উনি একাডেমীর ক্যান্টিনের চা 'বিষ' মনে করতেন। কারণ আমাদের এর আগের প্রদর্শনীতে এসে চা খাওয়াতে প্রবল আপত্তি প্রকাশ করেছিলেন। তা এবারে (১৯৮১) সাউথ গ্যালারীতে আমাদের প্রদর্শনীতে জিজ্ঞাসা করলাম -- "চা খাবেন তো ? নাকি বিষ বলে আপত্তি আছে ?" উনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন "না খেতে পারি এখন আর বিষ নেই, তবে তোমরা সকলে যদি খাও তবেই।"
আমি ক্যান্টিন থেকে যখন চা নিয়ে ফিরলাম অখন দেখলাম উনি আমার ছবিগুলোর সামনে একটা দেয়ার নিয়ে বসে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে দেখছেন। চা হাতে দিয়ে পাশে একটা চেয়ার নিয়ে আমি বসলাম অনুগত ছাত্রের মতো। উনি বললেন "আমি 'Statesman' পত্রিকায় তোমার ছবির review পড়েছি, আমার মনে হয় নীরদবাবুর (শ্রী নীরদ মজুমদার) schooling তোমার consciously follow করা উচিত। দ্যাখো বিদেশে শিল্পের ক্ষেত্রে একটা পরম্পরা আছে, একটা ধারাবাহিকতা আছে, একটা ঘরণাকে অনুসরণ করে তাকে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেটা আমাদের দেশে হয় না। তুমি যদি নীরদবাবুর রীতিনীতি ও পদ্ধতিগত ক্রিয়াকৌশল ভালোভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে অনুধাবন করতে পারো তাহলে সেটা খোলাখুলিভাবে গ্রহণ করা উচিত।" আমি জানালাম আমার কথা -- "দেখুন, নীরদ মজুমদারের ছবি আমার খুবই ভালবাসি, তবে এটা ঠিক সেজান আমার কাছে অনেকখানি। আমি consciously সেজানকে যতটা বুঝতে চেষ্টা করি বা মেলাতে চেষ্টা করি সরাসরি নীরদবাবুর ছবিকে ততটা নয়।"
আমার ছবিগুলো থেকে গণেশদা ওঁর পছন্দ জানালেন -- "Nature এর বড় ছবিটা খুব ভালো হয়েছে।" সেদিনের কথা এই পর্যন্তই। এরপর ওঁর পরামর্শ মতোই আমরা মিলিত হলাম ১১ই মার্চ সন্ধ্যায় বসন্ত কেবিনে।
১১ই মার্চ সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেছে। বসন্ত কেবিনে যখন পৌঁছালাম তখন ও পাড়ায় লোডশেডিং চলছে। হ্যাজাকের আলোয় চাপা গরমে উনি বসেছিলেন। আমরা গিয়ে ওনাকে ঘিরে বসলাম। চা না হলে চলবে না বিশেষ করে রেস্তোরাঁয় বসে শুকনো গল্প চলে না। সুতরাং টোস্ট, ফিস ফ্রাই ও চা এলো। নানারকম টুকরো টুকরো কথাবার্তা চলতে লাগলো। ছবিতে influence বা প্রভাবের কথা উঠলো। উনি শিল্পী অতুল বসুর কথা বলছিলেন। অতুলবাবু নাকি বলেছিলেন যে একজন শিল্পের ছাত্রের পক্ষে আর্ট কলেজের পাঁচ বছর খুব বেশী সময়। এ ক্ষেত্রে ছ মাসই যথেষ্ট। অর্থাৎ ছ মাসে তাকে How to draw and paint শিখিয়ে ছেড়ে দাও, তারপর সে তার নিজের পথ খুঁজে নেবে। গণেশদার মত -- "পাঁচ বছর ধরে শেখানোর ফলে আর্ট কলেজের ছাত্ররা ক্রমশঃ নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। অন্যের জামা গায়ে দিয়ে বেরোয়, সেটা কাম্য নয়।" আমি বলতে চাইলাম যে আপনি বলছেন তা ঠিক, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্বতা অতি দুর্লভ বস্তু। খুব কম শিল্পীই একটি রেখা টেনে বলতে পারে যে এই লাইন টানলাম, রঙ লাগালাম -- এ পুরোপুরি আমার। এই রঙ রেখা এর আগে কোনো শিল্পী দেকাহতে পারেন নি। গণেশদা অবশ্য এ যুক্তি মানলেন। বললেন -- "হ্যাঁ, তা ঠিকই।" আমি তখন বললাম যে আমাদের অশেষ কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। মন দিয়ে ছবি আঁকার মধ্যে ডুবে থাকলে একদিন ঠিকই পত খুঁজে পাবো, তাই না ? উপস্থিত সকলেই একথা মানলেন। গণেশদা বললেন -- "হ্যাঁ, Passion for painting থাকতে হবে। রাতে ঘুম থেকে উঠে সদ্য করা ছবির গায়ে হাত বুলিয়ে তাপমাত্রা অনুভব করার চেষ্টা সেই শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব যে কাজ পাগল। যে জানে ছবির একটা প্রাণ আছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস সবই অনুভব করা যায়।" এই প্রসঙ্গে পিকাসোর একটা উক্তি মনে পড়ে গেলো যার অর্থ এইরকম যে একটা ছবি তার জন্মের পর থেকে একটা প্রাণীর মতই বাঁচে ও জীবনধারণ করে যার স্পন্দন অনুভব করা যায়।
এরপর প্রসঙ্গ উঠলো ছবিতে ভারতীয়ত্ব কিভাবে আনা যায়। আমি এই প্রশ্ন তুলতে গণেশদা বেশ হেসে উঠলেন। উনি বললেন " তোমরা জামাই হলে এই প্রশ্নটা করা হবে।" অর্থাৎ এটা বেশ জামাই ঠকানো প্রশ্ন। আমরা বুঝলাম যে এই ভারতীয় প্রসঙ্গটা ছবির ক্ষেত্রে বেশ ধোঁয়াটে। বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতা, শুধু পাশ্চাত্য বলিই বা কেন পৃথিবীর নানা সভ্যতার মধ্যে আদান প্রদান প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে। গণেশদা বললেন যে বর্তমান যুগে আমরা আমাদের জীবনে প্রতিমুহূর্তে পাশ্চাত্য উপাদানের প্রবেশ মেনে নিচ্ছি, না মানলে উপায় নেই এবং এ সব উপাদান আমাদের জীবনধারণ ও আমোদ-প্রমোদের সঙ্গে এত জড়িয়ে যাচ্ছে যে তা আর আলাদা করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমি কতখানি খাঁটি ভারতীয় আছি বা থাকতে পারবো তা ভাববার বিষয়। এই তর্কের অবশ্য কোনো শেষ হলো না।
গণেশদা জানতে চাইলেন যেহেতু আমরা রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র, সুতরাং চিত্রে ভারতীয়ত্ব সম্পর্কে আমাদের কোনো বিশেষ জ্ঞানলাভ হয়েছে কিনা। আমরা সবাই মাথা নাড়লাম -- অর্থাৎ জানি না। পরীক্ষার জন্য theory মুখস্থ করা ছাড়া এসব জানার চেষ্টা করিনি বা কেউ জানায়ওনি আমাদের।
উনি জিজ্ঞাসা করলেন -- "এখন ছবি আঁকতে আঁকতে কেমন বুঝছো ?" আমি বললাম -- "বড় ভয়ে আছি, কখন পিছলে না পড়ি।" গণেশদা হাসলেন, বললেন -- "বিশ্বাস রেখে কাজ করে যাও। তবে এটা ঠিকই survive করা খুব শক্ত।" আমরাও মানলাম এ কথা। বললাম যে ঠিকই তো, কত কত ছাত্রছাত্রী প্রতিবছর বিভিন্ন শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেরোচ্ছে। এরপর অনেক ঝরে যাচ্ছে, কিছু টিকছে। কয়েক বছর বাদে তাও থাকছে না, একজন বা দুজন ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে তার বাদবাকী সব জনারণ্যে মিশে যাচ্ছে। সুতরাং কাজ আর কাজ। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। এর বেশী আমরা আর কিছু পারি না।
রাত তখন ৮টা বেজে ১৫ মিনিট। বসন্ত কেবিনে লোডশেডিং শেষ হয়ে আলো ফিরে এসেছে। আমরা উঠে পড়লাম। গণেশদার সঙ্গে কথা হলো এখানেই আবার আমরা বসবো। না, সেটা আর হয় নি।
পশ্চিম পল্লী
শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন