মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

ছোটগল্প - মুস্তাইন সুজাত

শূন্যতায় দোলা দেবশিশু
মুস্তাইন সুজাত



কবির সাহেবের নিত্য ফেরার পথ কমরেড মনি সিংহ রোড । এই রোড ধরে ঠিক একটু সামনে এগিয়ে, দৈনিক বাংলা মোড়ের চার রাস্তার জ্যামে সেদিনও আটকে ছিল গাড়িটা প্রতিদিন যেমন থাকে । ইট-সুরকির দালানের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যটা উঁকি মারছিলো অভ্যেসমত । কয়েক গোছা তির্যক রশ্মি ওপাশের বিরাট বিরাট বিল্ডিঙের জানালার কাচে প্রতিফলিত হয়ে সরাসরি পরছে কবির সাহেবের চোখে । তিনি অতিশয় বিরক্তি নিয়ে ভুরু কুচকে এদিক সেদিক তাকিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিটা সামলানোর চেষ্টা করছিলেন । ঠিক এই সময় গাড়ির জানালা গলিয়ে একটা ছোট চিরকুট এসে পড়লো তার হাঁটুর উপর । এই এক নিত্য উৎপাত ঢাকা শহরে । প্রতিটা সিগন্যাল কিংবা যাত্রী ছাউনিগুলোর সামনে, আশপাশে কিছু নেকাব-বোরখা পরা মহিলা দাঁড়িয়ে থাকে হাতে বিভিন্ন কোম্পানির চিরকুট নিয়ে । অধিকাংশই কোন না কোন গোপন রোগ নিরাময় মহৌষধ কিংবা ঝাঁর ফুঁকের বিজ্ঞাপন । গাড়িগুলো পাশে এসে দাঁড়াতেই খুব তৎপরতায় তারা যাত্রী বরাবর অদ্ভুতভাবে ছুড়ে মারে চিরকুট । আবার কেউ কেউ চলন্ত গাড়ির জানালা লক্ষ্য করে চিরকুট ঠেলে দেয় অব্যর্থভাবে । আশ্চর্য তাদের হাতের নিশানা !

হাঁটুর উপর থেকে নিচে পরার আগেই কাগজটা হাতে তুলে নিয়েছিলেন কবির সাহেব । জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে গিয়েও কেন যেন আবার হাতটাকে পেছনে এনে চিরকুটটা মেলে ধরেন চোখের সামনে । তার চোখ আটকে যায় চিরকুটের একটা বিজ্ঞাপনে এবং বিজ্ঞাপনের ঠিক নিচেই লেখা ঠিকানায় ।

যে কোন সমস্যা’র (ইহ ও পর’জাগতিক) সমাধান (ইনশাআল্লাহ্‌)

মুশকিল আসান হুজুর,

আস্তানা ঃ দেওরাকান্দা মোড় খানকাশরীফ, বাতুইলতলা, জয়গুনাগুনপুর ।

কবির সাহেব একবার ড্রাইভারের দিকে চটজলদি তাকিয়ে পকেটে চালান করে দিয়েছিলেন চিরকুটটা । রাতে বাসায় ফিরেই কথাটা জানিয়েছিলেন নিতুকে । নিতু বেশখানিকটা অবাকই হয়েছিলো সেদিন । জীবনের সব ক্ষেত্রে কবির সাহেব অসম্ভব প্রাকটিক্যাল ধরনের মানুষ । হঠাৎ এই মানুষটা কিনা ওখানে ধরনা দেবে ? পরক্ষনেই ভেবেছে , এছাড়া আর কিই বা করার আছে ওদের । অপেক্ষায় অপেক্ষায় দীর্ঘ দশটা বছর কেটে গেছে । ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েছে অগুনতি । যে যেখানে বলেছে সেখানেই গিয়েছে । কিন্তু ফল ওই একই, শুন্য হাতে ফেরা । শেষমেশ আশাই ছেড়ে দিয়েছে তারা । অথচ এই একটা চিরকুটে ওসিলায় যদি নিরাশা কেটে যায় ! কত কিছুইতো ঘটে পৃথিবীতে, ক্ষতি কি শেষ চেষ্টায় !

আজ খবরটা শোনার পর থেকে কবির সাহেবের মনটা বেশ ফুরফুরে । প্রজাপতির মত ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করছে তার । প্রতিদিনকার মত আজও বার কয়েক কথা হয়েছে বাসায় । তবে খবরটা একদমই চেপে গেছেন, বলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বলেন নি । নিতুকে সরাসরি একটা সারপ্রাইস দেবেন বলে মনঃস্থির করেছেন তিনি । অন্য কোন দিন হলে অফিস থেকে গাড়ি করে সোজা বাসায় ফিরতেন । খেয়ে দেয়ে একটু টেলিভিশন দেখা, অতঃপর ঘুম । কিন্তু আজকে বাসায় ফিরে বাকি রাতটুকু তিনি নিজের মত করে সাজাতে চান । গাড়ি নিয়ে চলে যান সোজা শাহবাগ । মোড়ের দোকান থেকে একটা বিরাট ফুলের তোড়া কিনে বাসার পথে । ভর সন্ধ্যায় কবির সাহেবকে ফিরতে দেখে নিতু বেশ অবাক হয় । আরও অবাকের পালা যখন ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দেয় নিতুর দিকে । বিবাহিত দশ বছরের জীবনে এই প্রথম রুটিনের ব্যতিক্রম কবির সাহেবের । সন্ধ্যে করে বাসায় ফেরা আর এই ফুলের তোড়া, দুটোই ।

মনে রাজ্যের উৎফুল্লতা নিয়ে বাসায় ঢুকার পরও অনেকটা সময় কেটে যায়, এখনো তিনি কিছুই বলেননি নিতুকে । খাবার সেরে বেডরুমের দিকে পা বাড়ান কবির সাহেব । নিতু আসে ঘণ্টা খানেক পর । পাশে বসতেই কবির সাহেব নিতুকে জড়িয়ে ধরেন । খুশিতে আত্মহারা কবির সাহেব সোহাগে গদগদ করছেন আবেগে । পরনের শাড়ির মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন নিতুকে । ডাক্তার কবিরাজ, শালার কারো ঔষধেই কাজ দেয় নি । অথচ কোন অজপাড়া গায়ের এক গেঁয়ো হুজুরের কারিশমা মাত্র তিন মাসের মাথায় ! কবির সাহেব নিতুর কানের কাছে মুখ নিয়ে এতটা চুপিসারে কথাটা জানান যেন পাশের দেয়ালও শুনতে না পায় ।

মফঃস্বলের মেয়ে নিতুর বরাবরই স্বপ্ন ছিল ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ালেখা করার । মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে যথারীতি ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয় । উচ্ছল প্রাণবন্ত পরিবেশ, বিস্তীর্ণ-বিস্তৃত পরিধি, সিমাহীন স্বাধীনতা কোন কিছুই নিতুকে পড়ালেখা থেকে দূরে রাখতে পারে নি । দেখতে অত্যধিক সুশ্রী না হলেও একেবারে মন্দ বলা চলে না কোন দিক দিয়েই । ছিপছিপে গড়ন, মায়াবী মুখমণ্ডল অনেকেরই মন কেড়ে নেয় প্রথম দেখায় । সহপাঠী এক ছেলে অনেক দিন নিতুর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে যখন মরিয়া প্রায় তখন নিতুর বেশ মায়া জন্মেছিল ছেলেটির উপর । প্রথমে বন্ধুত্ব । আস্তে আস্তে ছেলেটি নিতুর ভাবনার জগতে হানা দিয়েছে স্বাভাবিক নিয়মেই । এক সময় নিতুর মনে হয়েছে আসলে ছেলেটি খুব একটা খারাপ না । মননে এবং বাহ্যিক গঠনে দুই দিক দিয়েই চলনসই । আর দশটা ছেলে যা হয় ঠিক সেরকমই । বিশেষত কোন পাথক্যও খুঁজে পায় নি অন্যদের সাথে । তবে একটা গুন ছিল ছেলেটির । ভবিষ্যৎ গণনা করা । সে হাত দেখে অনেক কিছুই আগাম বলে দিতে পারত । আন্দাজে কিংবা ঢিল যাই হউক তার কথা মাঝে মাঝেই ঠিক হয়ে যেত । যদিও নিতু একদমই বিশ্বাস করত না এসব । সেদিনের অতি সাধারন ছেলেটির নাম শফিক হাযারিকা । সেই হাযারিকার সাথে দীর্ঘ পাঁচটি বছর বন্ধুত্বের ছলে সকাল-দুপুর-বিকেল, ভার্সিটি-টিএসসি-শাহবাগ-নীলক্ষেত-নিউমার্কেট ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ঠিক ঠিক প্রেমে পড়েছিল বুঝতে পারে নি নিতু । টের পেল অনেকদিন পর, যেদিন ভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে বিদায় নেয় । কিন্তু তখন অনেক দেরি করে ফেলেছে ওরা । আস্তে আস্তে জীবনচক্রের বেড়াজালে বন্দী হয়ে যে যার মত ছিটকে পড়লো দূরে । হাযারিকাও একদিন মিশে গেল লক্ষ মানুষের ভিড়ে । কিন্তু নিতু তাকে ভুলে নি কিংবা ভুলতে পারে নি মুহূর্তের জন্য । মনে মনে অনেক খুঁজেছে । ঢাকা শহরের যেখানেই গিয়েছে হাজার মানুষের ভীরে একটি মুখই খুঁজে বেড়িয়েছে সে প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ । এমনকি ঢাকার বাইরেও । অজান্তেই চোখ পরেছে নানান যায়গাতে । আজও খুঁজে চেতনে-অচেতনে ।

এরই মাঝে আরও তিনটা বছর কেটে যায় । পারিবারিক সিদ্ধান্তে কবির সাহেবের সাথে বিয়ে হয় নিতুর । কবির সাহেব সুদর্শন, স্মার্ট, শিক্ষিত । বংশগুনে বেশ নামডাক আছে । উচ্চ বেতনে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন । এমন ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । তাই ভেবে চিন্তে নিতু এ বিয়েতে রাজি হয় । বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ঢাকার বাইরে থাকতে হয়েছিল নিতুদের । সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ঘুরে গত পাঁচ বছর ধরে ঢাকায় থাকছে । নাম-জশ-খ্যাতি সব কিছু পাওয়া কবির সাহেবদের একটাই অপূর্ণতা ছিল । সেটিও আজ হুজুর সাহেবের ওসিলায় পূর্ণ হতে চলল ।

মুশকিল আসান হুজুরের ঠিকানা নেয়ার পরদিন অফিসের এক বিশ্বস্ত কলিগকে কথাটা বলেছিলেন কবির সাহেব । কথায় কথায় জানতে পারেন ,কবির সাহেবের সেই কলিগ মুশকিল হুজুরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় । আরও অনেক অজানা খবর বেরিয়ে আসে হুজুর সম্পর্কে । অনেকেই সেখানে গিয়ে উপকার পেয়েছে । ভদ্রলোক একখানা চিঠি কবির সাহেবের হাতে দিয়ে বলেন এই চিঠিটা হুজুরকে দিলে একটু ভাল ব্যবস্থা হবে । পরের সপ্তাহেই কবির সাহেব আর নিতু গিয়েছিলেন হুজুরের আস্তানায় ।

সেদিন ছিল বুধবার । অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন কবির সাহেব । বেশ সকাল সকাল রওয়ানা দিয়েছিলেন তারা নিজস্ব গাড়িতে করে । পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে হুজুরের সাক্ষাৎ পান নি সেদিন । পরের শনিবার বেশ ভোরে ঠিক ফজরের আজানের পরই রওয়ানা দেন তারা । গাছপালায় চারদিক ঘেরা বিশাল বাড়িতে হুজুরের আস্তানা । এই সকালেও হাজার হাজার মানুষ চারদিকে । তাদের হৈ চৈ আর ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দৌড় ঝাপ, এক এলাহি কাণ্ড । হুজুরের আস্তানা সুবাদে রাস্তার একপাশে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকানপাট । খাবার-দাবার, খেলনা-পাতি থেকে শুরু করে নিত্য দরকারি অনেক কিছুই বিক্রি হচ্ছে দোকানগুলোতে । সমান্তরালে বেশ ক’খানা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে মানুষজন । নিতু এগিয়ে গিয়ে মহিলাদের একটা লাইনে দাঁড়ায় । একদিকে মাইকে কে একজন ঘোষণা দিচ্ছে হুজুরের কেরামতির কাহিনী । কয়েক’শ স্বেচ্ছা সেবক এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে । কবির সাহেব তাদের একজনের হাতে একখানা শ’টাকার নোট গোঁজে দিয়ে চিঠিটা ধরিয়ে দেন হুজুরের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য । ঘণ্টা কয়েক পেরিয়ে গেছে । ততক্ষনে সকালের কুসুম রঙ্গা সূর্য ঠিক মাথার উপর ফুল্কি ঝরাচ্ছে । তীব্র রোদের সাথে ভ্যাপসা গরম । হঠাৎ মাইকে কবির সাহেবের নাম উচ্চারিত হয় দুই তিন বার পরপর । নিতু এগিয়ে যায় হুজুরের আস্তানার দিকে । পাশে পাশে কবির সাহেবও । হুজুরের রুমে ঢুকার মুখে এক সেচ্ছাসেবক এসে কবির সাহেবকে আটকে দেয় । কারন জিজ্ঞাসা করতেই অন্য একজন এগিয়ে এসে বলে,

-জি সাব, আফনে বিত্রে যাইতে পারতেন না । হুজুরের বিশেষ মানা আছে । যে তদ্বির করাইতে আইসে, হের একলাই যাওন লাগবো ।

কবির সাহেব অনুনয় করেও অনুমতি পান না ভেতরে ঢুকার । অভিবাবকদের বাইরে অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ না চিকিৎসা শেষ হয়, এটাই এখানকার নিয়ম । অবশেষে নিতু একাই হুজুরের রোমে ঢুকে । একটু পর একজন স্বেচ্ছাসেবক হুজুরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলে কবির সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করেন,

-এই যে ভাই, চিকিৎসা কতক্ষণ চলতে পারে ?

-নিবর্র কারতাসে গিয়া আফনের রোগের উফর । ধরুইন এক ঘণ্টা তো লাগবোই । উত্তর দিয়েই হন হন করে হাঁটা দেয় সামনের দিকে । এক ঘণ্টা হতে কবির সাহেবের ঘড়িতে আরও চল্লিশ মিনিট বাকি ।

কাঁচা পাকা দাঁড়ি । বেশ লম্বা দেহের অধিকারী মুশকিল আসান হুজুর একা বসে আছেন আসন করে দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে । মেঝের পুরুটা জুড়ে সাদা ফরাশ পাতা । আলোছায়ার মায়াবী খেলা সারা ঘরময় । দরজা বন্ধ, কোন জানালা নেই । আগরবাতি জ্বলছে ঘরের কোনে কোনে। আতরের মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ । হুজুরের মাথা সামনে নুয়ে আছে । বাবরি চুলে চেহেরা ঢাকা । হাতে তাজবীহ । রেডিয়ামের সাদা গোটা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে । একটা অজানা ভয় ঢুকে নিতুর মনে । মিনিট খানেক নীরবতার ভেঙে হুজুর নিতুকে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে । নাম বলতেই হুজুর এক ঝটকায় মাথাটা উপরে তুলে চোখ রাখে নিতুর দিকে । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা । হুজুরের এই অবস্থা দেখে নিতুও বেশ অবাক হয় । ভালভাবে চোখ পরতেই নিতু চমকে উঠে । খানিকটা আশ্চর্যের সুরে শুধু বলে, হাযারিকা তুমি !

এক হাতে নিতুকে জড়িয়ে ধরে কবির সাহেব অন্য হাতে পাশের টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে নেন সুখবরটা হুজুরকে জানানোর প্রয়োজনবোধ থেকে ।

খবরটা শোনার পর থেকেই নিতু ভাবলেশহীনভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মাথার উপর ঘূর্ণায়মান পাখার দিকে । এই বাতাসেও নিতুর শরীর ঘামছে শঙ্কায় কিংবা সুখানুভূতিতে । তার চোখে ভেসে উঠা দুটি পরিনত মুখাবয়বের ঠিক মাঝখানে একটি নিষ্পাপ শিশুমুখ দোল খায় অনবরত । শুন্যতায় দোল খাওয়া দেবশিশুটির দোলা থামাতে নিতুকে মনচক্ষু বুজতে হবে একাগ্রতায় অনেকক্ষণ কিংবা জীবনের বাকিটা সময় ।