মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

অনুবাদ – কৌশিক ভাদুড়ী


অনুবাদ – কৌশিক ভাদুড়ী

মূল কবিতা - রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা (ওড়িয়া)

অনুবাদকের ভূমিকা

শ্রদ্ধেয় কবি রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা বাবুর পরিণতি-সম্পৃক্ত “দ্রোহবাক্য” গ্রন্থভুক্ত গভীর বোধাশ্রিত কবিতাগুলির অনুবাদার্থে আমার কম্পিউটারে ওড়িয়া ফন্ট না থাকায়; শ্রদ্ধেয় সম্বিদ দাশ বাবু আমাকে যৎপরোনাস্তি আদর প্রদর্শন হেতু; স্বহস্তে বাংলা ফন্টে আপলোড করে কবিতাগুলি পাঠিয়েছেন। আমি সম্মানিত। আমি গর্বিত। আমার সীমিত ক্ষমতাতে অনুবাদ প্রচেষ্টা নিচ্ছি।

শ্রী সচ্চিদানন্দ রাউতরায়ের (১৯১৬-২০০৪) পরবর্তী উত্তরাধিকারত্বে ওড়িয়া সাহিত্যের যে ‘নব্য আধুনিক’ (Neo-modernity) যুগের প্রবর্তন হয়, কবি রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা তার অন্যতম ধারক। ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষায় কবিতার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত। পেশগত জীবনে কবি ভারত সরকারের এক আই-এ-এস আধিকারিক ছিলেন, অধুনা অবসরপ্রাপ্ত। কবি রাজেন্দ্রকিশোরের শৈলকল্প কাব্য গ্রন্থটি ১৯৮২ সালে কটকের এক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। কাব্য গ্রন্থটির জন্য কবি ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।

তত্সম শব্দ ওড়িয়া ও বাংলায় অনুরূপ। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, অনুরূপ বাংলা শব্দ সব সময় সমান্তরাল অনুভূতি বহন করে না। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় কবিতার আত্মাটিকে( স্প্যানিশ কবিতায় বিবৃত—দুয়েন্দে, লোরকা বিভিন্ন সময়ে শব্দটা ব্যবহার করেছেন) সনাক্ত করে ফুটিয়ে তোলাটাই সঙ্গত ও সঠিক অনুবাদ। এখানেও সামান্য দু একটি জায়গায় তাই করেছি। যদিও ওড়িয়া ও বাংলার ব্যুত্পত্তিগত অতিন্নতা স্বীকার করে তত্সম শব্দ অপ্রতিস্থাপিত রাখার দায় আগাগোড়াই থেকেছে।

দ্রোহবাক্য প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে, কটক থেকে। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলি অব্যবহিত আগের রচনা।



অনুবাদ – কৌশিক ভাদুরী
ব্যাদান


মূল কবি - শ্রী রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা
(ওড়িয়া ভাষার কবি শ্রী রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডার দ্রোহ বাক্য গ্রন্থ থেকে)


প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হাঁ করে তেড়ে আসছে

নগর, পর্বত, খেত,
গুহা আর শিশু-খুলির ডাঁই
প্রতি পদক্ষেপে তার, বিদারি বিদারি
তেড়ে আসছে
হিংস্র বিশাল কুরূপ জন্তু এক,
আমার দিকে ...

কবে মুখোমুখি হবে কে জানে !

পলায়ন কলা আমার অজানা,
আমি সে ভাবেই বাঁচি
যেটুকু আমার জন্যে উদ্দিষ্ট
কেবল সেই বৃত্তটুকুর পরিধির ভেতরে।

খোঁয়াড়ের ভেতর থেকে মারণাকে, ঘাউআকে
সুধারকে, চোরণীকে,
ওলেইকে, গেহ্লেইকে,
কালিআকে আর কসরাকে
চিনে নিতে জানি,
গোচরে আর গোয়ালে,
পৃথক করে নিতে জানি
আপন প্রতিবিম্ব থেকে নিজের ভেতরকে :
গোঠের ভেতরে বুনোরা থাকে না।

একদিন না একদিন বশ হয় সর্ব ধরনের পশুত্ব ,
একদা অবাধ্য ঘোড়া
পক্ষীরাজ-প্রতিম উড়ে বেড়ায় কিন্নর নভে।
ব্যাদানের ভেতরে আকাশ কিছু রেখে দেয় ,
খুরেতে রক্তকষ কিছু রাঙিয়ে,
ব্যস।

আমাকে লক্ষ্য কোরে
যোজন যোজন দূর থেকে তেড়ে আসা
হিংস্র পশুটির হাঁএর ভেতরেও
বিশ্বরূপ আছে?
...............

টীকা : মারণা, ঘাউআ, সুধার, চোরণী, ওলেই, গেহ্লেই, কালিআ, কসরা : পোষা গরুদের নাম।

----------------

আকাশে স্বাক্ষর কর


মূল কবি - শ্রী রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা
(ওড়িয়া ভাষার কবি শ্রী রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডার দ্রোহ বাক্য গ্রন্থ থেকে)



সূর্যোদয়ে লাল সূর্যাস্তেও লাল-
অথচ আকাশের রং নীলই রয়ে যায়
আকাশের রক্ত সর্বদা নীলই রয়ে যায়।

ডাকে, কিন্তু হাত বাড়ায় না নিচু পানে ,
পিছু নেয় না জাপটেও ধরে না
বন্ধুত্ব পাশে।

স্থল জোয়ার শূন্যে উঠে স্থির হয়ে গেলে,
আর নেমে আসে না ভাঁটার টানে।

যে তুমিই নীচে থাক,
গহ্বরে,
তেতে ওঠ চরম শক্তিতে।

আকাশের সঙ্গে সংলাপ সম্ভব-
কেবল উদ্গিরণের কোমল ভাষায়।

আজ প্রতিটি মাটির ঢেলা আগ্নেয়গিরি হয়ে যাক,
পাছে কাল পুঁতে যায়
নিজেরই শীতল লাভায়।

স্বাক্ষর করে দাও গিরিমাটিতে।
.................


যে কোনো মুহূর্তে আমি গ্রেফতার হতে পারি

মূল কবি - শ্রী রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা
(ওড়িয়া ভাষার কবি শ্রী রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডার দ্রোহ বাক্য গ্রন্থ থেকে)




যে কোনো মুহূর্তে আমি গ্রেফতার হতে পারি
দেশদ্রোহের অভিযোগে।
গণতন্ত্র
কীর্তনদলকে সৈন্যবাহিনী করে দিতে পারে।

যে কোনো মুহূর্তে আমি বরখাস্ত হয়ে যেতে পারি
কুর্সিকে বেখাতির করার অপরাধে,
চোখের রং নীল নয় বলে।

সুধর্মা সভার অপ্সরাধামকে অস্বীকার করে
আমার ভেতরের চিরন্তন অসুর,
অমৃতে আমার অধিকার সমান-
এ কথা উচ্চারণের দ্রোহে
গুলিবিদ্ধ হতে পারি যে কোনো মুহূর্তে।

গণতন্ত্র চুম্বনকে বিদ্যুত-শক করে দিতে পারে,
লৌহ ভীমকে আলিঙ্গন করতে না করতে
কড়মড় করে ভেঙে যেতে পারে এবার
হয়তো ধৃতরাষ্ট্রের হাড়গোড়।

কবিতার সাথে কথাবার্তার সময় মৌনতা বরং সহনীয় ,
দোভাষী কিন্তু অপরিহার্য নয় আমার, ধন্যবাদ,
বাধ্য কোরো না ।

আকাশকে ধ্বজা বলে মেনে নেওয়ার পরে
আবার আমি আনুগত্য দেখাব
কোন পতাকাকে?

প্রকাশ্য দম্ভে
সকল নীরবতাকে আমি তোষামোদ করে রেখেছি
একটি শব্দ গড়ার জন্যে বর্তমানে,
চক্রবৃদ্ধি সুদ সহ পুনরায় ফিরিয়ে দেব।

অথচ
সারা সৃষ্টিকে ভেঙেচুরে গলিয়ে জুড়ে
হাতকড়ি তৈরি হবে কামারশালায়
খাস আমারই জন্যে!

যে কোনো মুহূর্তে আমি গ্রেফতার হতে পারি...
নির্বাসিত হয়ে যেতে পারি নির্বাসনের রাজ্য থেকে,
চিহ্নিত করা যেতে পারে আমাকে হাড়ক্রস-খুপরি চিহ্নে,
যে কোনো মুহূর্তে আমি দণ্ডিত হতে পারি
'নাগরিক' না বলে
'মানুষ' পরিচয় দেওয়ার দায়ে!

"যে কোনো মুহূর্তে আমি গ্রেফতার হয়ে যেতে পারি"
এ কথা উচ্চারণের দ্রোহে
যে কোনো মুহূর্তে আমি গ্রেফতার হয়ে যেতে পারি
হঠাত্... গণতন্ত্র আশঙ্কাকে ঘটনা করে দিতে পারে।