বন্ধ কারখানা
অলোকপর্ণা
আইসি সফেদি অউর কাহাঁ
পুরনো ফটোফ্রেম তুলে নিয়ে গেলে দেওয়ালে যেমন তারই সাদা অবয়বটুকু পড়ে থাকে, আমি আমার হাতের পাতায় তাকাই, বুঝি, এইখানে কাউকে ধরতে চেয়েছিলাম। এখন সমগ্র পাতা জুড়ে শুধুমাত্র তারই ছোঁয়াচ লেগে আছে। মুঠো খুলে হাওয়ায় ছোঁয়াচগুলো উড়িয়ে দিতে শূন্য হাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এল, যেন সব সাদা ধুয়ে ফেলার প্রচেষ্টায়। আমি জানি, এসব কিছুই নয়, এখন শুধুমাত্র নিরীহ বর্ষাকাল।
ভীড়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। একেকটা গল্প ঘাড়ে বৃষ্টির ফোঁটারা নেমে আসছে মাটিতে, আমায় পাশকাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একে অন্যের হাত ধরে, গল্প তৈরি হচ্ছে। গল্পে ঠাসা শহরে আমি আমার গল্প খুঁজতে বেরিয়েছি, আমার নামে কি একটাও বৃষ্টি নামল কোথাও? রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে উঠে এলাম। এছাড়াও এখানে কুকুরের বাচ্চা, নোংরা ভিখারি, প্লাস্টিকের চায়ের কাপ দাঁড়িয়ে আছে, গল্প খুঁজে পাওয়ার আশায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি গল্পের ট্রাম চলে গেল গঙ্গার দিকে, দেখছি ফুটপাথের পসরা থেকে তুই ঘড়ি তুলে নিচ্ছিস, হাতে পরে নিচ্ছিস ‘হরেক মাল একশোর’ আমার সস্তা সময়। তোর ইচ্ছেয় মিনিটের কাঁটা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে স্টেশনের দিকে, আর তুই একলাফে ট্রেনে উঠে পড়লি, তোর ট্রেন তোর গল্প নিয়ে দূরে... চলে যাচ্ছে।
আমি পরের পাতা ওলটালাম। সমস্তটা সাদা। হাতের পাতায় মা প্রথম অন্ধকারে কিছু আদুরে ক্রিসক্রস এঁকে দিয়েছিল, কিন্তু এখানে- একটা অক্ষরও নেই।
আমি জিভ দিয়ে দাঁত গুণে দেখলাম... তিরিশ। আর মাত্র দুবার, তারপর নতুন আর কিছুই তৈরি হবে না আমার শরীরে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বন্ধ কারখানা হাতড়ালে, বালিতে ডুবে আসবে হাত, ঝিনুক ফেলে গেছে কারা যেন, এখানে সেখানে ভেজা পায়ের ছাপ। নিজেদের সমুদ্র ছেড়ে কেউ কেউ উঠে চলে গিয়েছে। পড়ে আছে শাঁখের শূন্য খোলস, সাদা।
দর্দ আচ্ছে হ্যায়
ছোটবেলার কষ্টগুলো ফার্স্টবেঞ্চে বসা, আড়ি- ভাব, বেস্টফ্রেন্ড, কারেন্ট চলে গিয়ে মিকিমাউস ক্লাব হাউস দেখতে না পারা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ওরা টের পায়নি কখন আমার জামাগুলো গায়ে ছোট হতে শুরু করল বা ওরাও তুচ্ছ হতে থাকল আমার কাছে। এমনকি আমিও বুঝতাম না মাঝরাতে কিসের জন্য অন্ধকার ছাদে গিয়ে দাঁড়াতাম, অন্ধকার দেখে যেতাম একনাগাড়ে। আঁকার স্যর বললেন, “তুই কিছু খুঁজছিস আসলে।” আমি ‘আসলে’ কি খুঁজছি? বড় বড় কষ্টদের এড়াতে ছোট হয়ে যাওয়া কষ্টদের খুঁজে ফিরছি, অন্ধকারে?
ঘরের কোণায় প্যান্ডোরার বাক্সটা রাখা, ততদিনে আমার টেক্সট বইয়ে ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ শব্দটা যুক্ত হয়ে গেছে। আমি বাক্স খুলে তোকে বার করে আনি, অ্যালবামে তুই হাসছিস, দ্বিতীয় পাতায় তুই আমার দিকেই তাকিয়ে, যেন আলতামিরা গুহাচিত্রের মত আজন্মকাল থাকবি!! (হাস্যকর), তৃতীয় পাতায় কোনো ছবি নেই, ব্ল্যাংক। আমি আর্তনাদ করে উঠি, দেখতে পাইনা কিচ্ছু, চেঁচিয়ে বলি, “এটা কি হল! কেন এরকম হয়...”
তোর ছবিরা বাক্স থেকে দ্রুত বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যায়, ওড়াউড়ি করে, ওদের সঙ্গে লড়াই করে একসময় আমি অবসন্ন হয়ে পড়ি, দেখি বাক্সের তলায় পড়ে আছে আমার ছোট ছোট কষ্টগুলো। আমি ওদের নিয়ে জোর করে ব্যস্ত হই এবার। ভাবি অভি কেন আমায় খেলায় নিল না, ভাবি অনন্যা কেন গ্রিটিংস কার্ড দেয়নি ১৯৯৮এ, বাবা কেন কোলকাতায় দুর্গাপুজো দেখাতে নিয়ে যায়নি কোনোদিন, কেনই বা জন্মদিনে কেক আসেনি কখনও... আমি খেয়াল করি,- তুই ছোট হয়ে আসছিস এতদিন ধরে জমে থাকা অন্যসব ‘কেন’র পাশে। প্যান্ডোরার বাক্সে মাথা রেখে ঘুম নেমে এল। চোখ বুজতে বুজতে যে দীর্ঘশ্বাসটা এসে দাঁড়াল আমার সামনে, গায়ে বিষণ্ণতার চাদর টেনে দিয়ে সে বলে গেল, “দর্দ আচ্ছে হ্যায়।”
আই হ্যাভ এ ড্রিম
একদিন মনে হল জিভ আটকে আসছে। আমি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। কলেজ স্ট্রীট মোড়ে তখন সন্ধ্যে নেমেছে, জোর গলায় নিজের নিজের কথা বলে যাচ্ছে কোনো এক পলিটিকাল পার্টি, অথচ আমার কথা বন্ধ হয়ে আসছে। অসহায় অবস্থায় বাস ধরার চেষ্টা করলাম, “দাঁড়াও!” -আওয়াজ বেরোল না।
রাজনৈতিক অধিবেশন শেষ হল কলেজ স্ট্রীটে, তকমা লাগানো মানুষেরা রাস্তায় নেমে ভীড়ে মিশে সাধারণ হয়ে গেলেন। শুধু দেখলাম ফুটপাথে প্রৌঢ় এক পাগলি বসা, দুহাতে খুচরো ভর্তি বাটিটা তুলে সেও বক্তাদের উদ্দেশ্যে অকাতরে হাততালি দিয়ে চিৎকার করছে, “আই নিড এ চেঞ্জ! আই নিড এ চেঞ্জ!” দুর্ভাগ্যবশত আমি তার সাথে গলা মেলাতে পারিনা, আমার জিভটা ততক্ষণে ভীড়ে হারিয়ে ফেলেছি। আর সেই ভীড় কত শব্দ হয়ে হাতিবাগান, শিয়ালদহ, ধর্মতলা অথবা হাওড়ার দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, একা একা ঘরে ফিরে যাচ্ছে, সন্ধ্যেবেলায়।
রাত তিনটে নাগাদ দেখলাম খয়েরি কার্ডিগান আমায় জড়িয়ে বলছে, “আমি জানি...” ট্রেনের দমকে জানি না তখনও মোঘলসরাই পার করে চলে গেল কি না আমার স্বপ্নটা, সে বলছে, “আর কেউ থাকুক না থাকুক, তুই থাকবি...” আমি ঘুম ভেঙে ভেঙে রেল ট্র্যাকে ছড়িয়ে দিচ্ছি যেন মুড়িমুড়কি, যেন মৃতদেহ নিয়ে গেছে কেউ এপথে, “...তুইই থাকবি।” উঠে বসে দেখলাম রাত তিনটে আমার জানালায় আমারই ছায়া তৈরি করে পিছিয়ে দিচ্ছে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গাছ, অন্ধকার। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় জেনে আমার ঘুম আসেনি আর। পরে, প্রায় একজন্ম পরে জেনেছিলাম, স্বপ্নে আমরা অচেনা কাউকে দেখিনা।
আমি দ্বিধায় পড়লাম, আমার পড়ে পাওয়া গোটা তিনেক ‘তুই’-এর কোন ‘তুই’ আমায় অপেক্ষায় রেখে গেলি তাহলে?
বন্ধ কারখানা
আমাদের ছোট নদীরা এখন আঁকে বাঁকে চলছে। রেল লাইনের তারা মত একটিবার কাছে আসছে, কাটাকুটি করে আবার চলে যাচ্ছে দূরে। এমতাবস্থায় আমি টের পাই একটা দ্বীপ তৈরি হচ্ছে আমার মধ্যে। সেখানে সমুদ্র থাকবে, বালুচর থাকবে, শালবন, ঝিনুক, কাঁকড়ার দল থাকবে, থাকবে নারকেল গাছ, দূরে ভেসে থাকা নৌকো, থাকবে শয়ে শয়ে বালির প্রাসাদ,- ঢেউয়ের আঘাতে বারংবার ভেঙে পড়ার জন্য। আর আমি, এসব জেনেও দাঁড় টানতে থাকব, শরীরে বন্ধ কারখানার কঙ্কাল নিয়ে, প্রাণপণ চেষ্টা চালাবো ওই দ্বীপ ছোঁয়ার।
অথচ প্রশ্ন করবেনা কেউ যে, একদিন একা এই দ্বীপে আমি একমাত্র কাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইব... কারণ প্রশ্ন করার মত এ লক আউটের বাজারে এখন আর কেউ নেই।
আইসি সফেদি অউর কাহাঁ
পুরনো ফটোফ্রেম তুলে নিয়ে গেলে দেওয়ালে যেমন তারই সাদা অবয়বটুকু পড়ে থাকে, আমি আমার হাতের পাতায় তাকাই, বুঝি, এইখানে কাউকে ধরতে চেয়েছিলাম। এখন সমগ্র পাতা জুড়ে শুধুমাত্র তারই ছোঁয়াচ লেগে আছে। মুঠো খুলে হাওয়ায় ছোঁয়াচগুলো উড়িয়ে দিতে শূন্য হাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এল, যেন সব সাদা ধুয়ে ফেলার প্রচেষ্টায়। আমি জানি, এসব কিছুই নয়, এখন শুধুমাত্র নিরীহ বর্ষাকাল।
ভীড়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। একেকটা গল্প ঘাড়ে বৃষ্টির ফোঁটারা নেমে আসছে মাটিতে, আমায় পাশকাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একে অন্যের হাত ধরে, গল্প তৈরি হচ্ছে। গল্পে ঠাসা শহরে আমি আমার গল্প খুঁজতে বেরিয়েছি, আমার নামে কি একটাও বৃষ্টি নামল কোথাও? রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে উঠে এলাম। এছাড়াও এখানে কুকুরের বাচ্চা, নোংরা ভিখারি, প্লাস্টিকের চায়ের কাপ দাঁড়িয়ে আছে, গল্প খুঁজে পাওয়ার আশায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি গল্পের ট্রাম চলে গেল গঙ্গার দিকে, দেখছি ফুটপাথের পসরা থেকে তুই ঘড়ি তুলে নিচ্ছিস, হাতে পরে নিচ্ছিস ‘হরেক মাল একশোর’ আমার সস্তা সময়। তোর ইচ্ছেয় মিনিটের কাঁটা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে স্টেশনের দিকে, আর তুই একলাফে ট্রেনে উঠে পড়লি, তোর ট্রেন তোর গল্প নিয়ে দূরে... চলে যাচ্ছে।
আমি পরের পাতা ওলটালাম। সমস্তটা সাদা। হাতের পাতায় মা প্রথম অন্ধকারে কিছু আদুরে ক্রিসক্রস এঁকে দিয়েছিল, কিন্তু এখানে- একটা অক্ষরও নেই।
আমি জিভ দিয়ে দাঁত গুণে দেখলাম... তিরিশ। আর মাত্র দুবার, তারপর নতুন আর কিছুই তৈরি হবে না আমার শরীরে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বন্ধ কারখানা হাতড়ালে, বালিতে ডুবে আসবে হাত, ঝিনুক ফেলে গেছে কারা যেন, এখানে সেখানে ভেজা পায়ের ছাপ। নিজেদের সমুদ্র ছেড়ে কেউ কেউ উঠে চলে গিয়েছে। পড়ে আছে শাঁখের শূন্য খোলস, সাদা।
দর্দ আচ্ছে হ্যায়
ছোটবেলার কষ্টগুলো ফার্স্টবেঞ্চে বসা, আড়ি- ভাব, বেস্টফ্রেন্ড, কারেন্ট চলে গিয়ে মিকিমাউস ক্লাব হাউস দেখতে না পারা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ওরা টের পায়নি কখন আমার জামাগুলো গায়ে ছোট হতে শুরু করল বা ওরাও তুচ্ছ হতে থাকল আমার কাছে। এমনকি আমিও বুঝতাম না মাঝরাতে কিসের জন্য অন্ধকার ছাদে গিয়ে দাঁড়াতাম, অন্ধকার দেখে যেতাম একনাগাড়ে। আঁকার স্যর বললেন, “তুই কিছু খুঁজছিস আসলে।” আমি ‘আসলে’ কি খুঁজছি? বড় বড় কষ্টদের এড়াতে ছোট হয়ে যাওয়া কষ্টদের খুঁজে ফিরছি, অন্ধকারে?
ঘরের কোণায় প্যান্ডোরার বাক্সটা রাখা, ততদিনে আমার টেক্সট বইয়ে ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ শব্দটা যুক্ত হয়ে গেছে। আমি বাক্স খুলে তোকে বার করে আনি, অ্যালবামে তুই হাসছিস, দ্বিতীয় পাতায় তুই আমার দিকেই তাকিয়ে, যেন আলতামিরা গুহাচিত্রের মত আজন্মকাল থাকবি!! (হাস্যকর), তৃতীয় পাতায় কোনো ছবি নেই, ব্ল্যাংক। আমি আর্তনাদ করে উঠি, দেখতে পাইনা কিচ্ছু, চেঁচিয়ে বলি, “এটা কি হল! কেন এরকম হয়...”
তোর ছবিরা বাক্স থেকে দ্রুত বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যায়, ওড়াউড়ি করে, ওদের সঙ্গে লড়াই করে একসময় আমি অবসন্ন হয়ে পড়ি, দেখি বাক্সের তলায় পড়ে আছে আমার ছোট ছোট কষ্টগুলো। আমি ওদের নিয়ে জোর করে ব্যস্ত হই এবার। ভাবি অভি কেন আমায় খেলায় নিল না, ভাবি অনন্যা কেন গ্রিটিংস কার্ড দেয়নি ১৯৯৮এ, বাবা কেন কোলকাতায় দুর্গাপুজো দেখাতে নিয়ে যায়নি কোনোদিন, কেনই বা জন্মদিনে কেক আসেনি কখনও... আমি খেয়াল করি,- তুই ছোট হয়ে আসছিস এতদিন ধরে জমে থাকা অন্যসব ‘কেন’র পাশে। প্যান্ডোরার বাক্সে মাথা রেখে ঘুম নেমে এল। চোখ বুজতে বুজতে যে দীর্ঘশ্বাসটা এসে দাঁড়াল আমার সামনে, গায়ে বিষণ্ণতার চাদর টেনে দিয়ে সে বলে গেল, “দর্দ আচ্ছে হ্যায়।”
আই হ্যাভ এ ড্রিম
একদিন মনে হল জিভ আটকে আসছে। আমি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। কলেজ স্ট্রীট মোড়ে তখন সন্ধ্যে নেমেছে, জোর গলায় নিজের নিজের কথা বলে যাচ্ছে কোনো এক পলিটিকাল পার্টি, অথচ আমার কথা বন্ধ হয়ে আসছে। অসহায় অবস্থায় বাস ধরার চেষ্টা করলাম, “দাঁড়াও!” -আওয়াজ বেরোল না।
রাজনৈতিক অধিবেশন শেষ হল কলেজ স্ট্রীটে, তকমা লাগানো মানুষেরা রাস্তায় নেমে ভীড়ে মিশে সাধারণ হয়ে গেলেন। শুধু দেখলাম ফুটপাথে প্রৌঢ় এক পাগলি বসা, দুহাতে খুচরো ভর্তি বাটিটা তুলে সেও বক্তাদের উদ্দেশ্যে অকাতরে হাততালি দিয়ে চিৎকার করছে, “আই নিড এ চেঞ্জ! আই নিড এ চেঞ্জ!” দুর্ভাগ্যবশত আমি তার সাথে গলা মেলাতে পারিনা, আমার জিভটা ততক্ষণে ভীড়ে হারিয়ে ফেলেছি। আর সেই ভীড় কত শব্দ হয়ে হাতিবাগান, শিয়ালদহ, ধর্মতলা অথবা হাওড়ার দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, একা একা ঘরে ফিরে যাচ্ছে, সন্ধ্যেবেলায়।
রাত তিনটে নাগাদ দেখলাম খয়েরি কার্ডিগান আমায় জড়িয়ে বলছে, “আমি জানি...” ট্রেনের দমকে জানি না তখনও মোঘলসরাই পার করে চলে গেল কি না আমার স্বপ্নটা, সে বলছে, “আর কেউ থাকুক না থাকুক, তুই থাকবি...” আমি ঘুম ভেঙে ভেঙে রেল ট্র্যাকে ছড়িয়ে দিচ্ছি যেন মুড়িমুড়কি, যেন মৃতদেহ নিয়ে গেছে কেউ এপথে, “...তুইই থাকবি।” উঠে বসে দেখলাম রাত তিনটে আমার জানালায় আমারই ছায়া তৈরি করে পিছিয়ে দিচ্ছে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গাছ, অন্ধকার। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় জেনে আমার ঘুম আসেনি আর। পরে, প্রায় একজন্ম পরে জেনেছিলাম, স্বপ্নে আমরা অচেনা কাউকে দেখিনা।
আমি দ্বিধায় পড়লাম, আমার পড়ে পাওয়া গোটা তিনেক ‘তুই’-এর কোন ‘তুই’ আমায় অপেক্ষায় রেখে গেলি তাহলে?
বন্ধ কারখানা
আমাদের ছোট নদীরা এখন আঁকে বাঁকে চলছে। রেল লাইনের তারা মত একটিবার কাছে আসছে, কাটাকুটি করে আবার চলে যাচ্ছে দূরে। এমতাবস্থায় আমি টের পাই একটা দ্বীপ তৈরি হচ্ছে আমার মধ্যে। সেখানে সমুদ্র থাকবে, বালুচর থাকবে, শালবন, ঝিনুক, কাঁকড়ার দল থাকবে, থাকবে নারকেল গাছ, দূরে ভেসে থাকা নৌকো, থাকবে শয়ে শয়ে বালির প্রাসাদ,- ঢেউয়ের আঘাতে বারংবার ভেঙে পড়ার জন্য। আর আমি, এসব জেনেও দাঁড় টানতে থাকব, শরীরে বন্ধ কারখানার কঙ্কাল নিয়ে, প্রাণপণ চেষ্টা চালাবো ওই দ্বীপ ছোঁয়ার।
অথচ প্রশ্ন করবেনা কেউ যে, একদিন একা এই দ্বীপে আমি একমাত্র কাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইব... কারণ প্রশ্ন করার মত এ লক আউটের বাজারে এখন আর কেউ নেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন