শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আরশাদ উল্লাহ


 
বিষয় : হাইকু কবিতা
হাইকুর ঐতিহাসিক পটভূমি


হাইকু হল জাপানি বড় কবিতার ক্ষুদ্রতম রূপ! প্রাথমিক পর্যায়ে ৫-৭-৫ অক্ষরের সিলেবল 'হক্কু'(hokku) নামে লেখা হয়! তার আগে 'রেঙ্গা'(renga) কবিতা ৫-৭-৫-৭-৭ 'অক্ষরে্র সিলেবল' মোট পাঁচটি ছোট লাইনে লেখা হতো'রেঙ্গা' (Renga)কবিতার আরেক নাম তান্‌কা (tanka)কবিতা।

জাপানের 'Heian Period' ( ৭৯৪ ১১৮৫ ) থেকে 'রেঙ্গা' কবিতা বিভিন্ন কবি ও রাজদরবারে অভিজাত ব্যক্তিত্ববর্গ রেঙ্গা বা 'তানকা' কবিতার প্রবর্তন করেনতখন থেকেই 'haikai-no-renga' রেঙ্গা কবিতারও প্রচলন হয়। সেই কবিতা গুলি 'হাইকাই'(Haikai) এর মতোই কিন্তু এই ধরণের কবিতা ছিল হাস্যরসাত্বক কবিতা এবং তাতে কিছুটা নিম্ন মানের শীল্পবোধ ছিল। তবে এই ধরণের কবিতা সতেরশ' শতাব্দী পর্যন্ত অভিজাত ব্যবসায়ীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে এই কবিতা গুলি বেশ জনপ্রিয় ও আনন্দজনক ছিল। সে যাই হোক, ক্রমাগত কবিতার বিবর্তনে সেই রেঙ্গা বা তানকা বা ওয়াকা কবিতা থেকেই হাইকু কবিতা হয়েছে।

সেই 'হক্কু' কবিতায় পরিবর্তন এনে মাৎচুঅ বাশো ( ১৬৪৪ ১৬৯৪ ) সেগুলিকে অন্যান্য 'তানকা বা ওয়াকা' কবিতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ৫-৭-৫ 'অক্ষরের সিলেবলে' নতুন ধরনের ক্ষুদ্র কবিতার প্রচলন করেন!  তারপরে Masaoka Shiki (১৮৬৭ ১৯০২ ) বাশোর কবিতার নতুন নামকরণ করেন এবং 'হাইকু' নামে প্রচলন করেছেন!

তারপর ইনেনাগা সাবুরো নামে জাপানের বিখ্যাত একজন ঐতিহাসিক "History of Japanese Culture, 1959” বইটিতে লিখেন যে হাইকু লেখার নিয়ম বেশ সিম্পল! হাইকুতে ১৭ টি অক্ষরের সিলেবল থাকে এবং তিন ভাগে বিভক্ত থাকে। আমরা জানি যে সিলেবল্‌ মানে জিহ্বার গতি না বদলিয়ে একবারে উচ্চারণ সক্ষম শব্দ বা শব্দাংশ; একস্বরবিশিষ্ট শব্দ বা শব্দাংশ! ছন্দ কবিতায় একস্বর বিশিষ্ট সিলেবল দেখা যায়! জাপানের বর্তমান জেনারেশন শুধু হিরাগানা অক্ষরে ৫-৭-৫ গুনেই হাইকু লিখেন। আর এই হিরাগানা অক্ষরের শব্দকেই "অনজিবলা যায়! তারা বলেন শব্দের rythom মিলিয়ে লিখলেই চলবে।

Traditional form of haiku
সম্পর্কে William J. Higginson তার লেখা বইতে "The Hiku Handbook”; How to Share, and Teach Hiku (Publisher Kodansha International; 323pp; ISBN4-7700 1430-9.) লিখেছেন যে "Japanese poets do not count syllable at all. Rather, they count 'onji' The Japanese word onji does not mean “syllable.” সবার অবগতির জন্য বলছি যে 'onji' অর্থ হল ধ্বনি নির্দেশক চিহ্ন বা বর্ণ যার কোনো অর্থ নেই! বলাই বাহুল্য যে বাংলা কবিতা গ্রুপে লিখে এমন একজন, নাম বলতে চাইনা। তিনি আমার ও আমার অনুকরণে যাঁরা বাংলা হাইকু লিখেন তাদের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেছেন যে হাইকু লিখতে হলে বাংলা ব্যকরণ শিখতে হবে! আর যারা হাইকু লিখছে তারা ব্যকরণ সম্পর্কে অজ্ঞ! খুব খারাপ লেগেছে তার এমনতর মন্তব্য দেখে; অথচ সে নিজেই হাইকু লিখতে জানে না! পাঠকদের অবগতির জন্য বলছি যে আমার ধারা অনুকরণে যে দু'জন হাইকু লিখতে পারেন তাদের একজন পৃথা রায়চৌধুরী আর মৌমিতা মন্ডল। তারা সুন্দর বাংলা কবিতাও লিখেন!

এখন আগের কথায় ফিরে যাই। জাপানের আটচল্লিশটি হিরাগানা অক্ষরের সাথে আশ্চর্যজনক ভাবে বাংলা আটচল্লিশটি ব্যঞ্জন বর্ণের মিল রয়েছে। শব্দও প্রায় একই ধরণের! আর বড় সুখবর যে অবিকল বাংলায় 'অন্‌জি' অক্ষর মিলিয়ে হাইকু লেখা যায়! আবার জাপানি ভাষার গঠন অবিকল বাংলা ভাষার সাথে মিলে যায়! নিম্নে ইংলিশ কবি Higginson একটি বিখ্যাত জাপানি হাইকুকে পাশাপাশি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন!

Furuike Ya           = Old Pond
Kawazu Tobikomu
  = A Frong Leaps In
Mizuno Oto
          = Water's Sound

এই হাইকুটিকে বাংলাতে আনলে হয় –

জলা পুকুর
ব্যাঙের লাফালাফি
জলের শব্দ!

কোনো পরিবর্তন না করে ৫-৭-৫ এ অনুবাদ করলাম!
উল্লেখ্য যে জাপানি হিরাগানা অক্ষরের শব্দ প্রত্যেকটিকে 'onji' বলা যায়। আগেই উল্লেখ করেছি যে জাপানি হাইকুতে 'সিলেবল' এর ব্যবহার নেই! তাহলে হিরাগানা অক্ষরের শব্দ কেমন হয় তা নিম্নে দেখানো হলঃ
কা/ কি/ কু/ কে/ ক/ (ব্যঞ্জনবর্ণ)

এখন লক্ষ্য করুন, একই 'অনজি' শব্দ বাংলাতেও রয়েছে, নয় কি ?
সুতরাং, বাংলাতে হাইকু লিখতে শুধু 'অনজি' দিয়েই লেখা যায় এবং সিলেবলের প্রয়োজন নেই!
(
উপরের হাইকুটি কবি বাশো'র লেখা)

এই হাইকুটিতে তিনি বুঝিয়েছেন বর্ষাকালের প্রকৃতি। যেমন, বাংলাদেশে বর্ষা কালের প্রারম্ভে নতুন বৃষ্টির জলে শুষ্ক ডোবা পুকুর পূর্ণ হয়। তখন ব্যাঙ-এর লাফালাফির শব্দ শোনা যায়। এই শব্দ শুনেই কবি বাশো বর্ষার আগমন বার্তা পেয়েছেন! হাইকু হল এমন এক ধরণের কবিতা যার মাধ্যমে বিশেষ একটি মুহূর্তকে নাটকীয় ভাবে প্রকাশ করা যায়!

মাৎচুঅ বাশোর পরে যে চারজন হাইকু কবি জাপানি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা হলেন -
Yusa Buson (1716 – 1784)
 তিনি শুধু কবি ছিলেন না  ইয়ুসা বুসোন চাইনীজ painting  জাপানি আর্টে প্রবর্তন করেন। প্রথমতঃ তিনি 'হাইকাই' কবিতা লিখতেন। তারপর কবি বাশোর পরে তিনিই দ্বিতীয় বিখ্যাত হাইকু কবি হন। নিম্নে তাঁর একটি হাইকুর ইংরেজি অনুবাদ ও বাংলা অনুবাদ কেমন দেখা যাক –

"
য়ুকাজে ইয়া       = Evening Breeze
মিযু আঅসাগি নো = Water Laps The Legs
হাগি অ উৎচু"      = Of The Blue Heron

এখানেও লক্ষ্য করে দেখলে বোঝা যায় যে জাপানি হাইকুর উচ্চারণ ৫-৭-৫ অক্ষর বা 'অনজি'তে এসেছে। অপূর্ব মিল নয় কি? বলাই বাহুল্য যে হাইকু গণনায় (৫-৭-৫) ইংরেজিতে আসে না ইংরেজিতে সিলেবল গণনায় হাইকু লেখা হলেও কিছু জাপানি সাহিত্যিক বলেছেন যে ইংরেজিতে অবিকল হাইকু লেখা যায় না। শুধু ভাবটুকু তাদের মতো করে লিখে নেয়! এখন হাইকুটিকে বাংলায় করলে হয় -

"সন্ধ্যা বাতাস
পায়ে পানি প্রবাহ
সারস পাখি!

৫-৭-৫ অক্ষরে এসেছে! অর্থ হল সন্ধ্যায় মৃদু বাতাস বইছে। এমন সময়ে সারস পাখিটি অগভীর নদীর জলে দাঁড়িয়ে আছে আর নদীর স্রোত ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে! এতে গ্রীষ্ম কালের একটি চিত্র ফুটেছে! তখন সারস পাখিরা শীতের দেশ থেকে মাইগ্রেট করে উষ্ণ এলাকার নদী বা খালে এসে বসে মাছ শিকার করার জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে! এই ক্ষণ বা দৃশ্যটিকে কবি তাঁর হাইকুতে রূপ দিয়েছেন!

২। Kbayashi Issa ( 1762 – 1826 )

তাঁকে হাইকুর তৃতীয় গ্রেট হাইকু কবি আখ্যায়িত করা হয়েছে
তাঁর একটি হাইকু নিম্ন রূপ-

ইয়ারে উৎচুনা        = Oh, Don't Swat
হায়ে গা তে অ ছুরু   = The Fly Rubs Hands
আসি অ সুরু"         = Rubs Feet

এই হাইকুটি বাংলাতে অবিকল ৫-৭-৫ অক্ষরে আনা হয়েছে!

বাংলায় হাইকুতে আনলে হয় --

ওটা মেরনা
মাছি হাত নাড়ায়
পা ও নাড়ায়!

এই হাইকুটিকে অনেক ভাবে চিন্তা করা যায়। যেমন, মাছি মারলে উল্টো হয়ে পড়ে হাত ও পা নাড়াতে থাকে! তার মৃত্য দশা দেখলে দরদি মানুষের মায়া লাগে! এটাও-তো জীব! তারপর বোঝা যায় গ্রীষ্মকালের কথা। এই সময়ে মাছি বেশি দেখা যায়। (Higginson হাইকুটির ইংরেজি করেছে, তাঁর মতো করে মূল হাইকু থেকে অনুবাদটি কিছুটা দূরে সরে গেছে!)

জাপানের Masaoka Shiki ( ১৮৬৭ ১৯০২ ) হলেন চতুর্থতম গ্রেট হাইকু কবি। তিনি রূগ্ন ছিলেন। তাঁর হাইকু ও তান্‌কা কবিতায় দুঃখ-বেদনা মিশ্রিত রয়েছে! শিকি কয়েক বছর চীনে জাপানের যুদ্ধকালিন সময়ে war correspondent ছিলেনতাই যুদ্ধের উপরেও তাঁর লেখা কিছু হাইকু আছে! সেগুলির একটি হল -

নাশি ছাকু য়া        = The Pear Blossoming
ইকুছা নো আত নো  = After The Battle This
কুজুরে ইয়ে"          = Ruined House

বিদ্ধস্ত ঘর
যুদ্ধ থামার পর
ফুটন্ত ফুল!

হাইকু টিকে নীচ দিক থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হলহাইকু তে চমক আনার জন্য এভাবে ৫-৭-৫ এ করা হয়েছে। নাশপাতি ফুল লিখেছেন। জাপানিতে 'নাশি' দুটি মাত্র অক্ষর কিন্তু বাংলাতে চারটি হয়। তাই 'ফুল' ব্যবহার করা হয়েছে! এই হাইকুটিতে কবি শিকি বাস্তব একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রের দৃশ্য তুলে ধরেছেন। বিদ্ধস্ত ঘরের উপরে নাশপাতি ফুল ফোটার কথাটিতে শান্তি বিরাজ বা শান্তি ফিরে এসেছে তা বুঝিয়েছেন। অথচ কতোই না গভীর অর্থবোধক হাইকুটি তিনি লিখেছেন মাত্র ১৭ টি অক্ষরে তাতে একটি বড় ইতিহাস সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে!

নীচের কবিতাটি শিকির লেখা একটি তানকা বা ওয়াকা বা রেঙ্গা কবিতা ৩১ অক্ষরে ছোট পাঁচটি লাইনে তাঁর অসুস্থ অবস্থার কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি হাসপাতালের বেড এ থাকা অবস্থায় এটি লিখেছেন।

ফুল দানিতে
রোগীর বেড পাশে
ঝুলন্ত ফুল......
ফুজির এ স্তবক
ক্ষীণালোকে বসন্ত!

(
ফুজিঃ জাপানের পার্পল রঙ্গের ফুল)

এই কবিতায় তিনি নিজের স্বাস্থ্যকে চিন্তা করে লিখেছেন। ফুজি ফুল হল নিম্নমুখি ঝুলন্ত ফুল। উর্ধমুখী ফুল নয়! বসন্তের ফুল কম আলোতে বিবর্ণ দেখাচ্ছে! এতে বলা হয়েছে তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা নিম্নমুখী অর্থাৎ ভালো অবস্থায় নয়। আর ক্ষীণালোক দিয়ে বুঝাচ্ছেন উজ্জ্বল বসন্ত নয়। তিনি উজ্জ্বল বসন্ত আর দেখবেন না!
আমার লেখা ও আরও কয়েক জন বিখ্যাত কবির লেখা হাইকুর অনুবাদ নিম্নে দেওয়া হল

অনুবাদ হাইকুঃ কবি Geraldine Clinton Little.

পতিত ঘোড়া
শকুনের ছায়ায়
উড়ন্ত মাছি!

জাপানি কবি রিঙ্কা অনোর দুইটি হাইকুঃ

১।রাজ ভোজন
রণক্ষেত্রে গমন
কোষে জোনাকি!

২।কৃত্রিম পায়ে
বরফ পথে হেঁটে
গির্জাতে কুঠো!

Elizabeth Searle Lamb
-

কুলের গাছে
ঝুলন্ত সূতা নড়ে
পতিত ঘুড়ি!

কবি বাশো –

"
শীতের রৌদ্র
গোপনে সে পড়ছে
স্ত্রীর কবিতা!


নিষ্পত্র ডাল
বিষণ্ন গুধুলিতে
একাকী কাক!

আমার নিজের কিছু হাইকু

বোনের তৈরি
পিঠার গন্ধে মাখা
মায়ের ঘ্রাণ!

শ্রাবণ বৃষ্টি
রিম ঝিম সুরেলা
বিরহ জ্বালা

ফুলের তোড়া
হাতে মেয়ে মিনারে
ভাষা দিবস!

সে নেই তাই
কাঁদে মন ফাগুনে
ক্লান্ত জীবন!


অলংকরণ – মেঘ অদিতি