শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

প্রসেনজিৎ দত্ত

জীবনানন্দের ছবিলেখ

আত্মপক্ষে নয়, লিখতে বসলাম আবিষ্কারের আশায়। যদিও ইউরেকা বলার সময় আসেনি। তা সত্ত্বেও একটা প্রশ্ন, বিজ্ঞানী না হয়েও বিজ্ঞানী কেউ ? জানি না। ভাবতে বসলাম। ভাবাল কবি। আমার কবি ছবি আঁকতেন। তবু কখনও দেখিনি ইতিহাস। কখনও ঘুরিনি সময়। আক্ষেপ ? না। এহেন বিষাদে উল্কি দেগে দেয় ‘নিয়ন্ত্রক’। আজ-কাল-পরশুর বিশালতায় ইতিহাসে কলি ভাসেসেই চক্রের নাম জীবনানন্দ দাশ‘আজ আর খোঁজাখুঁজি নাই কিছু—নাটাফলে মিটিতেছে আশ’—না-দেখায় দেখা হল, না-ঘোরায় ঘোরা হল—তবু লেখা হল না কো সারা।




সংস্কৃতির ইতিহাসে কবিতা এবং ছবি অত্যন্ত প্রভাবশালী দু’টি শিল্পমাধ্যম। অনেক সময়েই ছবির মাধ্যমে কবিতার জন্ম হয়। আবার কবিতা সৃষ্টি করে ছবিকে। কবিতায় ইমেজেরি (imagery) ছাড়াও এতে আরও একটি ভাবপ্রবাহ ক্রিয়াশীল থাকে। তা হল মিউস (muse)চিত্রকর বিজন চৌধুরী জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতাটিকে চিত্রকল্পে রূপ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ছবি আঁকতে গিয়ে বিষয় ভাবনার যা ভীষণভাবে সাহায্য করে তা হল, শব্দচয়ন ও বিমূর্ত অবস্থানে তাঁর প্রয়োগ। এরা আমাকে প্ররোচিত করে প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রে অঙ্কিত ঘোড়াগুলিকে চিত্রভাবনায় যুক্ত করতে। বিস্তীর্ণ মাঠ, জ্যোৎস্নার রাত্রি এবং এই পরিচিত দৃশ্যের সঙ্গে এক প্রবহমানতার প্রতীক হয়ে ওঠে ঘোড়ারা। এই ভাবেই আমার ছবিতে তারা উপস্থিত হয় এবং এই চিত্ররূপ অবশ্যই আমার সমকালীন চিত্রভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমার মতন করে নিজের আঙ্গিকেই চিত্রিত হয়।’  তাঁর মত করে নির্যাস হলেও আবেগ থেমে থাকে না বলে কতকগুলি প্রশ্ন, এই ‘লেখ’ কি কবিতা গড়ার? চিত্র গড়ার? নাকি, দৃশ্য গড়ার? কবিতা গড়ার, কারণ এখানে গীতিকবির আত্মরতি জড়িয়ে আছে। চিত্র গড়ার, কারণ প্রত্নলেখ মুদ্রণের আত্মিক সম্পর্ক জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। দৃশ্য গড়ারও, কারণ এর যাত্রা বাস্তব থেকে ‘অন্যবাস্তবে’। আর সেই অন্যবাস্তব হোক না চিত্রকলায়। হোক না কবিতায়। গদ্যের যুক্তিতে আবেগ হত্যা করার বাচন আমার জানা নেই। তাই আপাতত ভ্রমণ করি চৌহাদ্দির বাইরে। বাংলার উড়োজাহাজ ততক্ষণে দেশ কালের গণ্ডী ছেড়েছে।

আট বছর আগের কথা। আমার দিদির কাছে একটি বই দেখে প্রায় জোর করে ছিনিয়ে নেবার লোভ সামলাতে পারিনি। ‘ওরে আমার মেয়েরা এমএ পড়তে আসবে কাল, ওদের লাগবে’। দিদির কথায় নিকুজি বলে বুড়ো আঙুল। শর্মী পাণ্ডের স্বপ্নের ম্যানিফেস্তআমি আগে পড়ব। কিন্তু দিদিও ছাড়ার পাত্রী ননআর নাছোড়বান্দা আমিও বলে বসলাম, ‘তোমার এমএ-র নোট আমি তৈরি করে দেব।’ নোটের বিষয় ছিল, স্যুররিয়ালিজম এবং জীবনানন্দ দাশ। তারপরের ঘটনা এখানে আলোচনা নয়। যাই হোক, বই পাওয়া হল। পড়াও শুরু হল। একটু-আধটু ছবি আঁকার সুবাদে আশ ছিল ছবির এই আন্দোলনটি সম্পর্কে আরও জানার।

স্যুররিয়ালিজম আসলে কী ? সাহিত্যিক আভিধান এই সম্পর্কে বলছে—A movement in the 20thCentury literature and art which attempts to express and exhibit the working of the subconscious mind especially and as manifested in dreams and uncontrolled by reason or any conscious prices, characterized by the incongruous and starting arrangement and presentation of subject matter. ১৯১৭ সালে ফরাসি কবি গিয়োম আপোলিনেয়ার প্রথম ‘স্যুররিয়ালিজম’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তবে ১৯২২ সালের ‘ডাডাবাদী’ আন্দোলনের [‘Dadaism’—যার সূচনা সুইটজারল্যান্ডে, ১৯১৫ সালে। ত্রিস্টান জারা (Tristan Tzara) ছিলেন এই ‘Anti-Art-Movement’-এর ভিত্তিস্থাপক। সমাপ্তির পর এর প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে আঁদ্রে ব্রেতোঁ রচনা করেছিলেন ম্যানিফেস্‌ত্‌ দ্যু স্যুররিয়ালিজম্‌ (Manifest du Surrealism]—১৯২৪ সালে। বিশুদ্ধ বাস্তবের সম্ভাব্যতায় বিশ্বাসী ব্রেতোঁ ঘোষণা করেছিলেন, Pure psychic automatism by which it is real intended to express verbally, in writing or other by means… the real process of thought. The dictation of thought free from any control exercised by reason and outside all aesthetic or moral considerations. ম্যানিফেস্ত তো লিখেছিলেন জীবনানন্দও‘পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায়, কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায়—তাহলে পৃথিবীর এই দিনরাত্রি, মানুষ ও তার আকাঙ্ক্ষা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধুলো, সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন ব্যবহারের কল্পনা করা যেতে পারে...।’ তাই ‘সৃষ্টির সমস্ত ধুলো, সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে তিনি লিখে ফেললেন—
‘নক্ষত্রেরা অন্ধকারের পটভূমি থেকে
তাকিয়ে আছে হেমন্তলোক স্পষ্ট করে নিচের নিরাশায়
মৃতপ্রায় মানবতার অনাম চোখের দিকে
এই পৃথিবীর মৃত নবজাতকদের মুখচ্ছবির মত
নক্ষত্রেরা শুভ্র শূন্য নিমেষনিহত।

চলার পথে শীত অতীতের প্রয়োজনীয় স্মৃতি
বহন করে ম্যামথ ম্যামাল কালক্রমে মানুষ বানানো
নিনেভে রোম হিরোশিমায় পৌঁছে অ্যাটমের
হাতে মানুষ, মানব-ফসিল, ক্রমোন্নতির আলো।
                                      (নক্ষত্রেরা অন্ধকারের/ হে প্রেম, তোমারে ভেবে ভেবে)

কবিতাটির রেশ নিয়ে ফেলল দুটি স্টেশনে। প্রথম স্টেশনের নাম ‘জীবনানন্দের ঘোড়া’।
‘আমরা যাইনি মরে আজও—তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে।

আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রি হাওয়ায়;
বিষণ্ণ খড়ের শব্দ পড়ে ইস্পাতের কালে;
চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো—ঘুমে-ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে

হিম হয়ে পড়ে গেল ওপাশের পাইস্‌-রেস্তরাঁতে,
প্যারাফিন-লণ্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে।
সময়ের অশান্তির ফুঁয়ে;
সেই সব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।’


দ্বিতীয় স্টেশন ‘বিজন চৌধুরীর ঘোড়া’।
(গ্যালারি / বিজন চৌধুরী)
স্মরণাতীত দুরত্বে সময়ের সঙ্গে দেখা। দর্শনে বিস্তর ফাঁক। এপার-ওপার তোলপাড় করে গাথামালা নিশ্বাসে ঢুকে পড়েছে দেখে বিস্মিত হতেই হয়! মানুষের ইতিহাসই কী একমাত্র পরিধেয় ? আমাদের শিক্ষার তোতাকাহিনি প্রভাবদুষ্ট। সময় থেকে সময়ভূমির ধস, সমর থেকে সমরভূমির ধস জাগিয়ে রেখেছে সভ্যতার ইতিহাস। দৃশ্য জন্মেছে। কখনও তা সময়ের সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির আবার ব্যক্তির সঙ্গে সময়ের ‘synthetic and magical power’—‘প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে...আবার কখনও তা কষ্টকল্পনা। চক্রাকারে ঘূর্ণিত। ‘আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রি হাওয়ায়; / বিষণ্ণ খড়ের শব্দ পড়ে ইস্পাতের কালে; / চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো—ঘুমে-ঘেয়ো / কুকুরের অস্পষ্ট কবলে...’কী বলার থাকতে পারে এরপর ?সুখ নেই ? শান্তি নেই ? বোধ কাজ করছে ? শূন্য মনে হচ্ছে ? সহজ লোকের মত কে চলতে পারে ? শরীরে মাটির গন্ধ নেই। শরীরে জলের গন্ধ নেই। মাথা থেমে যায়। আমি থামি। সেও থেমে যায়। ঠিক তখনই যদি জন্মের সময় হয়, তাহলে সেই জন্ম সৃষ্টি না হয়ে দৃশ্য হবে। আর প্রেম ? হায় প্রেম, আস্বাদন করছি ‘বিচ্ছিন্নতা’র ব্যাধিকে। সেই প্রেমে সঙ্কর্ষণ নেই। সেই প্রেম শরীরও পায় না—মন মন খেলা করে কেবল। হ্যাঁ খেলাই করে। খেলা করতে করতে গান বাঁধে—‘সারেগামাপাধানি বোম ফেলেছে জাপানি/বোমের ভিতর কেউটে সাপ/ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ...’ কী আশ্চর্য তাই না ? এবার ভাবুন সময়টাকে। আমাকে সেই সময়টার প্রথম পাঠ দিয়েছিলেন দাদু। ঠোঁটকাটা ছড়ায় ঠোঁট কাটছিল গল্প—গল্প থেকে সত্যি—এই সত্যিটাকে কানে নিয়ে বড় হলাম। মেলালাম অনুষঙ্গ। বইয়ের পাতার সঙ্গে মিশল দৃশ্য। এও কী কল্পনা নয় ? ইতিবাচকে সায় দিয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, জাপানি আক্রমণের ভয়ে কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সন্ধে হলে ঘরের আলো নিভিয়ে রাখার কথা, রাস্তার আলোর গায়ে ঠুলি জড়ানোর কথা। এও কী তখন তৎকালীন পরিস্থিতিকে গম্ভীর করেনি! যাই হোক, এখন কথা হল, কেন এই প্রসঙ্গ আনা ? দৃশ্য গড়ার যে নিপুনতায় চিত্রকর জীবনানন্দ দাশ শব্দ আঁকতেন, সেই দৃশ্যই ভাবতে শেখায় নিভে যাওয়া ‘প্যারাফিন লণ্ঠন’ আসলে কলকাতার রাজপথের ধারে সেই সব গৃহস্থের আত্ম-আতঙ্ক, ‘আস্তাবল’ আসলে পরাধীনতার কারাগার, আর ‘ঘোড়া’রা সেই রাজপথের নিরাপত্তাহীন মানুষগুলির প্রতীক। কালগত দিক থেকে দেখলে ঐতিহাসিক তথ্যে আমরা চুবলাম। অতীতে গেলাম। আরও ঘোর অতীতে গিয়ে ঘুরে আসলাম প্রস্তরযুগ। আবারও ফিরলাম যখন তখন চকচক করছে ১৯৪২-৪৩।

(ক্রমশ)

1 comments:

A Fair well to pen. বলেছেন...

"আমাদের শিক্ষার তোতাকাহিনি প্রভাবদুষ্ট" প্রবন্ধপাঠের অভ্যাসে, আলোচ্য প্রবন্ধাংশটিকে মোটামুটি দু'টি খন্ডে ভেঙে নিতে পারছি এবং দু'টি পৃথক বিষয়ের উপর আলোকপাত স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করছি।
১) স্যুররিয়্যালিজম সম্পর্কিত একটি প্রাথমিক ধারনাপ্রদানঃ- এইবিষয়ে, স্পষ্টতঃ প্রাবন্ধিক আশাহত করলেন। দু'টি পৃথক সংজ্ঞা এখানে উল্লিখিত, তারপরই লেখক কিঞ্চিৎ ইতিহাস (একান্ত অপ্রতুল) ঘেঁষে লাফ দিয়েছেন জীবনানন্দের নিজস্ব বয়ানে। যদিও স্যুররিয়্যালিজম নয়, জীবনানন্দ-ই এই প্রবন্ধের মূল উপজীব্য, তবুও একটি বিশেষ দার্শনতত্ত্বের সংজ্ঞার সাথে সাথে তাকে নিয়ে যথঞ্চিৎ আলোচনাও কাম্য। সর্বোপরী, রেফারেন্স-চিহ্নবীহিন বেশ কিছু উদ্ধৃতি এসেছে, যা নিয়ে অন্ধ পাঠক অথৈ জলে। জনৈকা শর্মী পান্ডে প্রণিত একটি গ্রন্থের নামমাত্র উল্লেখ, একটি তথাকথিত "সাহিত্যিক অভিধান", যার লেখক, সম্পাদক বা প্রকাশক সম্পর্কে এই খন্ডে কোনও সূত্র দেওয়া নেই, জীবনানন্দের বয়ান, তার কবিতার স্তবক এবং বিজন চৌধুরীর বিবৃতি - প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই একই কথা। এমনকি, প্রবন্ধরচনার স্বাভাবিক নিয়মানুসারে, শেষ খন্ডে যদি রেফারেন্সগুলি প্রকাশিত হয়-ও, তাহলেও বলতে হয়, বিবৃতি, উদ্ধৃতি বা বই-এর নাম ইত্যাদি ক্রমিকসংখ্যা বা অন্য উপযুক্ত চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত ক'রে রাখা উচিত ছিল, যাতে ভবিষ্যতে প্রাবন্ধিকের নিজের রেফারেন্স দিতে ও পাঠকের সেই রেফারেন্স খুঁজে নিতে সুবিধা হত।
আশা ক'রা যাক পরবর্ত্তী কিস্তিগুলিতে এই ত্রুটিগুলি নিয়ে তিনি যত্নবান হবেন।
প্রসঙ্গতঃ- প্রথম থেকেই যেহেতু প্রাবন্ধিক নিজেই স্পষ্ট ক’রে দিয়েছেন এই প্রবন্ধে কবিতা এবং ছবি ওতপ্রোত থাকবে, তাই মৃদু কৌতুহল মাথাচাড়া দিচ্ছে, যে, স্যুররিয়্যালিজমের উল্লেখের সাথে সাথে পাবলো পিকাসো প্রসঙ্গে এখনো তিনি একটি শব্দ-ও খরচ করলেন না কেন?
২) জীবনানন্দের কবিতাঃ- মৃদু ভাবগম্ভীর কাব্যভাষায় রচিত এই প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক ভারী মনোজ্ঞ ভঙ্গীতে বুঝিয়েছেন ইতিহাসের দীর্ঘ পাল্লায় মানবমনের ছোটাছুটি এবং ইতিহাসের এক বিমূর্ত তথাপি ইন্দ্রিয়াধীন প্রতিমানির্মাণের প্রসেসটি। যদিও, এই প্রক্রিয়ার উপর পরিবর্ত্নশীল সমাজব্যবস্থার বিস্তারিত প্রভাব জানবার অপেক্ষায় রয়েছি। কিন্তু এহ বাহ্য, পূর্বেই একস্থানে থমকে দাঁড়িয়েছি। প্রাবন্ধিক ব্রেঁতো-র দেয় পরাবাস্তববাদের সংজ্ঞার উল্লেখ করেছেন, “….The dictation of thought free from any control exercised by reason and outside all aesthetic or moral considerations” এবং তারপর জীবনানন্দের গদ্যাংশ উদ্ধৃত ক’রবার পর উদাহরন হিসেবে যে কবিতাংশের উল্লেখ ক’রেছেন (হে প্রেম, তোমারে ভেবে ভেবে), তার মধ্যে “Freedom from any control exercised by reason” খোঁজা একান্ত কষ্টকল্পিত বোধ হয়। কারন স্যুররিয়্যালিজম, উদ্ধৃত সংজ্ঞানুসারেই, প্রচলিত যুক্তিকাঠামোর বিরোধীতা ক’রা (দমন ক’রা নয়, সেটা মৌলবাদ) এক প্যারালাল রিয়্যালিটি। পিকাসো, মানে, মনে-র ছবিগুলি বারবার দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু সেই নিরিখে আলোচ্য কবিতাটি, বা একই সঙ্গে যে নামহীন বহুবিখ্যাত কবিতা(সম্ভবতঃ “ঘোড়া”)-র উল্লেখ করেছেন – সেখানে কার্য্যকারন সম্পর্কের সাবেকি নিয়ম ভেঙে ফেলবার কোনও প্রয়াস পাই কি আমরা? ইতিহাসের নিজস্ব বয়ান নির্মাণের যে পদ্ধতি প্রাবন্ধিক বর্ণনা করেছেন, তা তো একান্তই কার্য্যকারনসম্পর্কপ্রসূত। বরং, ততোধিক বিখ্যাত লাশকাটা ঘর কবিতার চেতনা বা কমলালেবু কবিতা-র কয়েকটি শব্দ-ও কিন্তু ভেঙে চূরমার ক’রে দিতে পারে আমাদের এই সযত্নলালিত সর্বব্যাপী “যুক্তি”-র রাজপাটকে, উত্তরাধুনিকতাবাদীরা, বিশেষতঃ মিশেল ফুকো যাকে সভ্যতার উন্মাদনা (Madness of civilization, ১৯৬১, প্যারিস) বলে অভিহিত করেছেন।
অলমতি বিস্তারেন। প্রাবন্ধিকের শক্তিমান কলমের উপর পূর্ণ আস্থা রেখেই আমার মতামত জানালাম। হয়তো অনেক কিছু জানালাম-ও না। কিন্তু আশায় রইলাম, পরবর্ত্তী সংখ্যায় এই বিষয়গুলি নিয়ে তিনি সামান্য হলেও ভেবে দেখবেন।