শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়

এই সংখ্যার কবি -


পথিকনামা 

সত্যি সত্যি চলে গেলে পর
মায়া রেখো স্মৃতির উপর...



এই আমার পায়ে চলার পথ...
এখানে দেখো ছড়িয়ে আছে অজস্র অক্ষর
এদের নিয়ে কেটেছে দিন বেশ
শীতের দুপুর, মধ্যরাত্রি, আবছা আলো ভোর
পেরিয়ে গেছি দেশের পরে দেশ ...

এই আমার চিরদিনের ঘর...
এখানে দেখো জড়িয়ে আছে মায়াবী দিনরাত
আধেক জাগা আধেক ঘুমে ভরা
নিজেকে ভোলা অন্ধকারে আলোকসম্পাত
নিজের ই হাত নতুন করে ধরা...

এই আমার প্রভু আমার প্রিয়...
অকারণেই হারিয়ে যায় তার সে ঠিকানা

পায়ে চলার পথের পরে রাতে
চিরদিনের ঘরের আলো দিনে
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি তুমিও শিখে নিয়

হারিয়ে যেতে কোথাও নেই মানা...



মনে পড়ছে রাণারের কবির চিঠি প্রেস
পাশে হাঁটছে হরকরা মোফিদ আলম
নীরব নেহরু পার্কে সুলেখার বুকে
সুখের ই-মেল লিখছে ঝরনা কলম



অন্ধকারে একা এবং একা
একলা পথে আলোর সঙ্গে দেখা
আলো বললো, ‘চলো আমার ঘরে
সেসব কথা আর কি মনে পড়ে?

আলো আমার, আলো আমার আলো
অন্ধকারে একা থাকাই ভালো...



যাতায়াত ছিল কি কখনো?
যদিও শিখেছি উড়ান

জপমালা আঙুলে লিখেছে
স্থির এ চলন করো ত্রাণ...



বনফুলেরা গা ধুয়ে নিচ্ছে মাকাল ফলাদি তুচ্ছ ও অপেক্ষমান করে। অবাধ্য শিকচাকায়
সন্ধ্যে গড়ায় মহিষবাথানে। ফেলে দেয়া চা-নেশার ভাঁড় ভেঙে যেতে যেতে
সতর্ক করে আমার কর্ণকুহর। রঙিন স্কুলফিতের মত রাস্তা নাগাড়ে দৌড়ে
চলে, এন্তার ধানভাঙে এবং বোধহয় শিবের ও গাজন গায়। বাঁশি বাজলেই তাড়া,
যদিও সে বাঁশ যে কলিকৃষ্ণের বাঁশরি হবে তেমন কোনো ভরসা কোথায়? সুতরাং তিষ্ঠ
ক্ষণকাল, জন্ম যদি তব এই রঙ্গে।

জিরিয়ে নেয়া বাধ্যতামূলক।


স্বপ্ন ততদিনই সত্যি যতদিন জনৈক ভিখারি একমুঠো চাল তোলে নিজের ডেরায়।
ততক্ষণই স্পন্ধমান বীজ রুয়ে চলা যতক্ষণ-না পেটের এবং পেটেধরা পাপেদের আগুন
ছাড়িয়ে যাচ্ছে চুল্লির আক্রোশ।ভাবতে ভাবতে চুল্লি আর চুল্লুবিলাসের
সূক্ষ্ম ফাঁকের মধ্যে ঢুকে পড়ে মাতালহাওয়ার কানেআঙুল খেউড়। বাঁশি তাকে বুকভরে বাজায়।
নিজেও বাজে।

শেষ হয় জিরেন।

শুরু হয় চরকার গান। সুতো ছাড়া।

বনফুলেরা তখন ফলমন্ত্রে শরীরে লুকিয়ে নিচ্ছে রাত্রিবীজ...



অবান্তর ধুলোর মতো ওড়ো
ইচ্ছা রাখো নিঃশ্বাসপাখায়
নিষণ্ণ নিয়তি ও বিশ্বাসের দেবযান সাথে থাক
প্রতিটি জন্মদাগ পড়ো
পড়ো সেই দিওতিমা প্রেমের পাষাণ

সিঁদকাটো ঋষিবাক্যে, অন্তিমবুরুজে
হয়ে ওঠো প্রিয় কাঠমিস্তিরি এবং
ছত্রিশ অপার্থিব সূর্যভ্রমণ শিলালিপি

প্রলাপ, না দৈবকথকতা ?

সবজান্তা অসুখ সারিয়ে
মর্মোদ্ধার লুটিয়ে থাক ভূঁয়ে
প্রতিটি আঁচড় পড়ো, প্রেমে পড়ো
বিলাপকথনে রাখো কান
প্রতিস্পর্ধী আগুনগোলকে
দিদেলাস মিশে থাকো আতঙ্কিত মোমের গলনে

তিনি হাঁটছেন
অক্রমিক বদল লিখছেন
সাবলীল ঝরে পড়া পড়ুয়া আখরে

অসম্ভব উচ্চারণ কালে।



মেঘের বাড়িতে আছি আজকাল, 'নম্বর ঘর
চাকার পরোয়া নেই, আগুনকে কাঁচকলা দেখাই
উড়ে দেখি মানুষের ইতিহাস ও অনন্ত আগামী
গুহার আঁধারে পথ চিনে ফিরছে হাবিলিস, হোমো
দীর্ঘশ্বাসে প্রশ্নচিহ্ন - কোথা গেলি নিয়েনডারথ্যাল?
ঠিকানা হারানো চলা তার সাথে আমিও চলেছি
সরীসৃপ, উড়ে উড়ে, চারপায়ে, গর্বিত দ্বিপদ

মেঘের বাড়িতে ফেরে দিলখুশ মস্তিস্ক ধূসর



খুশি কি বদলে দিল অমোঘ এক মৃত্যু পরোয়ানা?
পরী দুটি বহুদিন দূরের বান্ধবী ছিল তার
মাঝরাতে ফুলেরা বুঝি শুনেছিলো খোলো খোলো দ্বার!
খুশি কি আমার মৃত্যু নিয়ে ফুল অনন্তবাগানে?
শেষসঙ্গী চুপচাপ সত্যি সত্যি টিউলিপ দল
অবাক আমির চোখে আশ্চর্য্য মায়ার এক পাঠ
সবকিছু ছাপিয়ে ভাসছে লং-জার্নি মনখারাপের

খুশি তোকে ঈর্ষা করে আমারও যে ইশক সুফিয়ানা



পবিত্র অরণ্যে উড়ি অবুঝ সবুজ জাদুটানে
রহস্য গাছটির নিচে বিভোর সে ভানুমতি খেল
তার সঙ্গে লুকোচুরি, ডানা ভুলে পরীরা মেতেছে
মেতে গ্যাছে মাতাগাছ, পিতাগাছ, সমাধিফলক
ঝরাপাতা গল্পে দেখি ভরে আছে ঈশ্বরবাগান
নাজানি পাখির ডাকে ঘুম ভাঙা প্রাচীন স্মৃতিরা
এসো ক্লান্তি, প্রত্নছায়া, নিজেকেই খোঁজো কিছুক্ষণ

বিশ্রামপাথরে বসে দোবরু পান্না, বিভূতিভূষণ

১০

হারিয়ে যাব না বলে পরি পরে নিল দুটি ডানা
প্রত্যেক ঋতুর সঙ্গে কিছু পথ চলি, শুনতে পাই
ফুলের অপেক্ষমান অর্কিডের স্বগতভাষণ
তখন সজলতম পৃথ্বীখণ্ডে থামে মেঘদূত
উপোসী পাথরে নামে রূপসি সে প্রপাতের পানি
কানে কানে ফিসফিস, আশ্চর্য্য কথাটা যেন জানি
পরি যে কখন ফিরবে? তাতে যায় আসে বলো কী-বা

পথিক আদর ছুঁয়ে জাগে পথ, জাগে মেঘ বালিকার গ্রীবা

১১

অসংখ্য ঈশ্বর বুঝি এভাবেই জন্ম নিয়েছিল!
মা গুহাযোনির থেকে ঝুলে যেন মৌচাক, নাকি গর্ভফুল ?
মাটিতে মুখ চুন করে প্রণম্য সে লিঙ্গভগবান
হাওয়া কি ভাসিয়ে আনে ঋকবেদ, ঋষি-উচ্চারণ?
আদিতে ছিল না কোনো ইন্দ্রিয়ের ধানাইপানাই
মানুষ ও ঈশ্বর দেখে মনে পড়ে মুরগি ও ডিম
কে আমাকে বলে দেবে বৈদিক সে প্রশ্নের উত্তর

প্রথম মানব শিশু, ঈশ্বরের অগ্রজপ্রতিম?

১২

কাল থেকে থাকব না আর টইটই মেঘেদের বাড়ি
বৃষ্টি ও বিদ্যুত এসে এইমাত্র বাই করে গেল
ফিরে আসবে মনভার খাড়া-বড়ি-থোড়ের জীবন
ইচ্ছে করে থেকে যাই চানঘরে আয়নার বুকে
টিপের দাগের মতো, না থেকেও ভালোটি বাসিব...
পরীদেরও ডানা দেখি ধীরে ধীরে সবিষাদ, ভারী

ভোররাতে, হে ঈশ্বর, স্বপ্ন হয়ে মেঘবালিকার
অর্ধেক জীবন যেন তার চোখে রেখে যেতে পারি

১৩

মূহুর্ত আঁকড়ে থাকে, আমি তার তোয়াক্কা করিনা
বিষুবরেখার পিঠে চড়ে বসি, মন্ত্রমুগ্ধ কেশরে, ইঙ্গিতে
কালোমাটি সহস্র ধিক্কারে যেন ভেঙ্গে ফেলতে চায়
শিরদাঁড়া! কোথায় লুকিয়ে তোকে রাখি! চারিভিতে

কোথাও আড়াল নেই, নেই কোনো জন্মের ঠিকানা
অন্ধ মোহবন্ধ নাচে আদিগন্ত মায়াবিলাসিনী
একটি অরণ্য নিয়ে রক্তের বদলে ছেলেখেলা
ইচ্ছা হয় নাই বলে ঘোড়সওয়ার আমিও দেখিনি।

১৪

তারপর সেই প্রেত চিতা থেকে ওঠে
তারপর স্মৃতি-করোটি ফাটিয়া যায়
পরজন্মের হাতছানি ভুলে লাভা
এই জন্মটি ফিরিয়া দেখিতে চায়

এই জন্মের ভুলেভরা ইতিহাস
এই জন্মের হাড়জ্বালানো সে মায়া
মরণের শোধ একবার দেখে নিতে
নাভিতে আগুন লুকিয়ে হাঁটে সে ছায়া

হাঁটি হাঁটি পায়ে কিছু খুঁটিনাটি বাঁচা
কিছু আঁখিজল, এক-আধ কানাকড়ি
কিছু শ্বাসরোধ, ফাঁকতালে কিছু দম
ঝাপসা অমল, সুধা ও কলসি-দড়ি

শুধু শুধু এতপথ ফিরে এলি প্রেত

মনখারাপের শেষ ইচ্ছাটি ছুঁয়ে
এ সবই ফেরাবে আগামী জন্মঘড়ি...



১৫

বৃষ্টি লাবণ্য লিখছে নাম-না-জানা গাছের পাতায়
মেঘের ঈগল এসে টুপ করে ঠোঁটে তুলে নিল
পাহাড়ি মেয়ের চোখে কাজলের কথা ও কাহিনি
রবিঠাকুরের গান দু-লাইন হারিয়ে বাজল
মস্তির রাত্রিশেষে ঘুমঘুম ভুটিয়া বস্তির
পায়রা ওড়ালো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রার্থনাসঙ্গীত

আলস্যে আড়মোড়া ভেঙে দুর্জয়লিঙ্গ মহাকাল
দেখছেন রহস্যময় ভানুভক্ত কবির সকাল


১৬

সর্বোচ্চ শিখরে এসে দাঁড়ালেন শেরপা ও সাহেব
কিছু না পারার গ্লানি ভুলে এক দুর্বল মানুষ
গর্বিত সে ছবি দেখছে মেঘে ঢাকা সংগ্রহশালায়
ভূতের রাজার বরে জুতোজোড়া যদি পাওয়া যেতো
উন্নতির শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে আসতো পাহাড়ির পা'
এইসব এলোমেলো স্বপ্নে পেয়ে গেছে তার হুঁশ
সংসার সাগরতল থেকে জাগছে নিভৃত একক

আর একটু মাথা তুললে সেও বুঝি তেনজিং রক


১৭

অ্যালবামে ছবি হতে নারাজ সে স্মৃতি-পশারিণী
'
জাদুঘরে রাখা কোনো পুরোনো স্মারক নই আমি'
শোনার পর থেকে দেখছি মন পাথর, মণিপদ্মে চুপ
ধুপছায়া লিখে রাখছে বুকচাপা নিশ্বাসের চলা
সংসার বদলে যাচ্ছে, স্থির শুধু প্রসন্নস্বরূপ
ভগবান তথাগত। কানে কানে শেখাচ্ছেন তিনি
তুচ্ছ ভূত ভবিষ্যত - এ মুহূর্ত আনন্দআধার

ঘুমপাহাড় মুছে দিচ্ছে মারমুখী মেঘের সুনামি


১৮

শালবন সাবধানে ছিলো, আমি তাকে বিশ্রাম বলতেই
হাজার পাতার টুপি উড়ে গেল লাইন-তোড় কোরে
সন্ধ্যে বাজিয়ে দিলো রিট্রিটের বুনো বিউগল
জলপাই দিনের শেষে ঘড়ির বাঁধন ছাড়া দেশে
অস্ত্রের ঠিক ঠিকানা মাঝরাতে নিজস্ব তাঁবুতে
মানচিত্র খুলে দেখবে পৃথিবী নামের কোনো গ্রামে
অশোকস্তম্ভের নিচে অন্য ভোর, সালোকসংশ্লেষ

বন্দুকের নল ভুলে ক্লোরোফিল হাজারদুয়ারী


১৯

তিস্তাকে বললাম, 'চল' - সে আমাকে থোড়াই কেয়ার
উল্টোদিকে চলে গ্যালো। রঙ্গিত কি অপেক্ষা করছে?
বৃষ্টি বলল, 'ছাড়ো দেখি, বাদ দাও তো পাগলিটার কথা
আমি তো রয়েছি, চলো মেঘ্মুলুকে পৌঁছে দিয়ে আসি'
রিমঝিম নেশার তালে যেই একটু মাতাল হয়েছি
সেই সুযোগে চুপি চুপি পাগলাঝোরা পার হয়ে এসে
বৃষ্টিকে কি ফুসলে নিলো এক চিলতে দুষ্টু রোদ্দুর?

দূরপাহাড়ে যখন ছবি লিখছেন অবনঠাকুর


২০

সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে বুঝলাম বয়েস বেড়েছে
বজ্র ও করোটি হাতে তন্ত্রময় পদ্মসম্ভব
জীবন্ত রামধনু আর পাঁচজন জ্ঞানী ডাকিনীর
ইতিহাস জানতাম, কিন্তু মনে করতে পারার আগেই
গম্ভীরগর্ভগৃহে আবার আমি শিশু ভোলানাথ
খেলুড়ে মেঘেরা এসে ডেকে নিল চায়ের বাগানে
কোলেস্টেরল ভুলে সবুজ চুমুকে মন খুশি

ফেরার পথে নিচে দেখছি দুচোখ জুড়িয়ে যাওয়া ছবি
রঙ্গিতের স্পর্শসুখে তিস্তা আজ দারুণ রূপসি

2 comments:

A Fair well to pen. বলেছেন...

অনন্যসাধারন নির্মাল্যদা। পথিকনামা বাংলা সাহিত্যের এক সম্পদ হয়ে রইল।

N Banerjee বলেছেন...

dhonyobad Atri. besh kichhudin chhilam na. aj ese dekhlam.