শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সূরজ দাশ


ব্যক্তিগত জীবন ও কবিতায় আমি পুড়েই যেতে চেয়েছি : সুশীল ভৌমিক
সুশীল ভৌমিক সম্পর্কে লিখছেন কবি  -  সূরজ দাশ

ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যের অপরাপর আন্দোলনগুলোর বাইরে থেকে নিরন্তর স্বতন্ত্র কাব্যচর্চা করে গেছেন নিভৃতে । যদিও ভাঙা, ক্রমাগত পাল্টানো এবনং প্রথার বাইরে  বেরিয়ে যাওয়াই তাঁর আজীবন সাধনা । লেখা, ছিঁড়ে ফেলা, ফেলে দেওয়া, এ সবই তাঁর ভূষণ । আড্ডাপ্রিয় অনুজ কবিদের প্রকৃত অভিভাবক এবং আশ্রয়স্থল । বেদনা ও ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষটার কবিতায় প্রাণ, কবিতায় জীবন, কবিতায় অবসেশন ।
দূরত্ববোধ তাঁর বহু কবিতার প্রাণ । বৈপরীত্যও আসলে দূরত্ব, -- তার ভাবনা ।

টেবিলে দুটো বেদানা শুধু লাল হয়ে থাক
আস্তে ও সতর্ক হয়ে চোখ দিয়ে শুধু
স্পর্শ করো তাকে ।

চোখ দিয়ে ছোঁয়া বস্তুত তাঁর কাছে এক ধরনের কনট্রাস্ট । সবসময় কবিতায় থাকেন, তাই, এই সব স্পার্ক ঘটে যায় । প্রচার ও প্রকাশবিমুখ এই কবি একটা কবিতাই খণ্ড খণ্ড সময়ে খণ্ড খণ্ড লেখেন । নির্মাণই তাঁর কাছে সার্চ । তিনি সুশীল ভৌমিক । সবসময় ভাঙতে চেয়েছেন, ভাঙতে চান । হৃদয়াবেগ আর ভাবাদর্শই নয় শুধু, মস্তিষ্ক আর বাস্তব প্রয়োগই নতুনতর কবিতার রাজ্য গড়ে তোলে । জীবন জুড়ে একটা মানসিক যন্ত্রণা, একটা বেদনাবোধ । পাঠক পড়ুন----

সারাদিন ড্রাইভারের মতো ক্লান্ত শরীর টেনে ফিরে এলে
প্রকৃত কারুর কাছে যাওয়া শুরু হয়
স্মৃতির অরণ্য ঘুরে সার্চলাইট আলো দেয়
                  আহতের চোখের ওপর
দুদিকে চেয়ার সাজিয়ে তখন
     এক নিদ্রিতের সঙ্গে আমার যেন দেখা হয়
   বহুকাল পর
তখন পাঞ্জাবি গলিয়ে বন্ধুদের সাথে শুধু বারান্দা অবধি
                                     যাওয়া যায়
তখনই প্রকৃত কারুর কাছে যাওয়া শুরু  হয়,
প্রকৃত কারুর কাছে যেতে পারি ।
তখন হলুদ টেলিপ্রিন্টার নিউজের মতো সমস্ত শরীর
                রুদ্ধদ্বার ঘরের ভেতর । (প্রকৃত কারুর কাছে )

হ্যাঁ, প্রকৃত কারুর কাছে যেতে হলে এছাড়া কোনো উপায় নেই । অন্য কোনো পথ নেই । আহত জীবনের কাছে সার্চলাইটের আলো নিয়ে যেতে হয়, অন্বেষণ । কবি বলছেন –

“আমি তো প্রকৃত কারুর কাছে যাই-ই । যেতে পারি । বিষয়টা হচ্ছে একদিকে প্রকৃত কিছু, প্রকৃত কেউ । অন্যদিকে হচ্ছে আচ্ছন্নতা । আমরা আচ্ছন্ন থাকি । সেই আচ্ছন্নতা কাটিয়ে  প্রকৃত কারুর কাছে যাওয়ার চেষ্টা । আপাত হয়প্রকৃত । সারাদিনের প্রাত্যাহিকতার পরে সেই তো শুরু প্রকৃত কারুর কাছে যাওয়ার”

একটি কবিতা, যার কাছে পাঠককে বারবার ফিরে যেতে হয় । বহুপাঠেও তৃপ্ত হয় না পাঠ ।

স্ট্যাম্প সাইজের হরনাথবাবু যাচ্ছেন—
তার সাথে কথা হয় আমার সরষে সাইজের সব—
প্রতিবন্ধী রকমের কথাবার্তা, কুশল-শুভেচ্ছার ক্লিষ্ট সম্ভাষণ 
এখানে প্রাণতোষবাবুরা আছেন কিন্তু এণাক্ষী বা মিনাক্ষী বলে কেউ নেই
এখানে পাতায় বরফ পড়লে পাতার সাধ্য নেই যে বাঁচে
অল্প বোঝা চাপালেই সট করে ঘাড় ভেঙে পড়ে, বাঁচার
তেমন কোনোও অভিযোজন-টোজন নেই যে বাঁচব কিছুদিন
এখানে কেউ কোনোওদিন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে না
এখানে আমার কোনোও সমস্যা হয় না কিছু নিয়ে, জন্ম
থেকেই আলজাইমার অসুখ, যতদিন টেকে টিকুক না,
এখানে টোকাটুকি নেই, কারণ কেউ পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ দেয় না কিংবা
বই খুলে দিলে, মাথা নিস্তেজ হয়ে পরে কেরানিবাবুর
আবিষ্কারের নেশায় পরিষ্কার বা পুরস্কার কথাগুলোই
প্রথম গিলতে হয়, অর্থাৎ যাত্রার ড্রেস পরে টিভিতে
খানিকখন মুখ দেখাতে হয়, এর বেশি করতে গেলে বিপদ
একুশদিন হাসপাতালে থাকলে নাও ফিরতে পারে কেউ
                                           ( আবিষ্কার )

কবি সুশীল ভৌমিকের কবিতার একটি প্রিয় উপাদান ঘুম । যার প্রথম পিঠে অপার শান্তিবোধ । অন্য পিঠে ইনসমনিয়া তাড়িত ক্লান্তি ও বিষাদ । এরপরেও ঘুম অনেক কিছুর নির্ধারক । ঘুম স্বপ্ন যোগায়, ভাষা যোগায় । ভালো ঘুম হলে ভালো আলোকপ্রাপ্তি ঘটে । অন্ধকারে প্রতিবাদের জন্ম হয় । ভালো ঘুম হলে ভাবনাশক্তি বাড়ে ।  ভালো না হলে বেদনার জন্ম হয় । 

চার পাঁচজন মানুষ । একজন সেলাই করছে , সেলাই হচ্ছে না ।
একজন কিছু দেখছে অথচ চোখ চিরদিনের মতো অন্ধ
কেউ সময় মাপছে অপেক্ষা দিয়ে । কেউ কথা বলছে । বোবা ।
পুং মিলন । ঘুম ।
ঘুমিয়ে এ সব করছে সবাই ।
সিঁড়ি ঢুকছে ঘুমিয়ে ।
খালি আপেলের প্লেটে আপেল ঘুম । পাকস্থলীতে ঘুম ।
ঘরের দাঁ ও বটিতে ঘুম ।
কন্সটান্টিনপোলের ঘুম পড়ছে বারো বয়সের ছেলেটার ঘুমে ।
কুকুরের চেনে ঘুম । ঘাড়ে ঘুম । অফিসে ঘুম ।
ওয়াশিং মেশিনে ঘুম । জামা কাপড়ে ঘুম । একা
এক অন্ধকার, তারও, বিষাদ ও শূন্যতার ঘুম ।
                                      ( শূন্যতা )

কবি সুশীল ভৌমিক সেইসব বিরল কবিদের একজন যারা চটজলদি খ্যাতির লোভে কবিতাকে খাদ্যবস্তু করে তোলেননি ভিখিরি করেননি নিজেকে । তিনি জানতেন কবিতা এবং কবির সম্পর্কে নিরভান নির্জনতার চেয়ে বড় আশ্রয় আর কিছু নেই । তাঁর কবিতার শরীরেও দিতে পেরেছিলেন নির্জনতার ধীর , স্থির, পরিশীলন, যা তাঁর কবিতাকে হঠাৎ কখনও কোনোও আবেগতারিত আলোড়নের দিকে ঠেলে দেয়নি । গঠনগত পরিবর্তনেও তেমন কোনোও টান কবির সেভাবে ছিল না । যতটা ছিল অতিক্রান্ত সময়ের কবিতা–চিহ্নগুলো বিরক্তিকরভাবে নকল না করে অন্য স্বাদের অন্য ভাবনাসঞ্জাত কবিতায় নিভৃত হওয়ার তাগিদ ।

তবু আমি চিঠি লিখে যাই
এই বিকেলের ভাষার ভাঙাগুলি দিয়ে,
অন্তত সীলমোহরগুলো আমার এইসব চিঠি পড়বে ;
আমার চিঠির ওপর টানটান হবে একটা মানুষের ছবি
যার চামড়া নেই, তার
সুশ্রী মুখে আমার কথাগুলি রক্তের ফোঁটার মতো মনে হবে,
আর রক্তের কাছে মনে হবে, কালো-কালো বাইসনের শিং
জলের কাছে মনে হবে, দূরে দূরে জেগেওঠা ডাঙা
গির্জার কাছে যেন দূরাগত ঘণ্টা বেজে যাবে সারারাত,
বিকেলের কাছে মনে হবে, পুবে যেন সবে ভোর হচ্ছে, এখন
                                ( আমি, তবু )

পড়ুন এই কবিতাটি---

হাসপাতাল
হাসপাতালের ছাদে ঝরে পড়ো ফুল ।
উঠে দাঁড়াক, শায়িত স্ট্রেচার ;
ইসিজি মেশিন, হেসে ওঠো, যেন করকরে
                কোনোও চলচিত্র দেখতে গিয়েছো
আর এখানে ঝরে-পড়া ফুলের বাগান উদবোধন করো;


   ওই শাদা গম্ভীর মাকড়শা—
   মায়া মুখারজির মতো রবিবারে এই ঘর আলো করে দাও,
   হাত ধরো ;
   ঘুরে ঘুরে দ্যাখো, কী সুন্দর ভালো থাকা যায় ;
   বিছানার চাঁদরগুলি শান্তিপুরী – কী  শোভন রুচিতে সাজানো ।
   লিফটে ছতলায় উঠতে উঠতে কার না বাড়ির কথা মনে হয় !


  অসম্ভব সুন্দর একটি কবিতা দিয়ে আমার এই ছোট নিবেদন শেষ করছি ---


সমস্ত কথা বেরিয়ে আসছে
ট্রেডল মেশিন থেকে –
           সর্পিল রাস্তা-সিঁড়ি-ঘরে একাকীত্ব
কথার আলো ও আঁধার ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে উত্তর দক্ষিণ

ঝরে ঝরে কথা বলছে ফুল
শাদা ধুলো কথা বলছে দুই ঠিকানার মধ্যে
মেহগনি খাটের সঙ্গে সারারাত কথা বলছে ঘুণ ।

কথা বলছে ফুলে ঢাকা শব
শবের দিকে ঘুরে, সান্ত্বনা ও কৃতজ্ঞতায়
                কথা বলছে ভাবী বিস্মৃতি ।


ঋণ স্বীকারঃ ১)স্মরণ, সুশীল ভৌমিক ২)নির্বাচিত কবিতাঃ সুশীল ভৌমিক ৩)কবি উমাপদ কর